প্রণয় রেখা পর্ব-১৯+২০

0
348

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯.

প্রথম ক্লাস শেষ করেই মোহনা এশাকে নিয়ে মাঠে গেল। এশা মোহনার ব্যবহারে কেন যেন খুব অবাক হচ্ছে। মেয়েটা সকাল থেকেই তার সাথে খুব অদ্ভুত ব্যবহার করছে। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই কেমন চুপচাপ। তার সাথেও খুব একটা কথা বলেনি। এখন আবার তাকে এভাবে মাঠে নিয়ে এল, এসব কিছুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে।

মাঠের এক কোণে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম সেই জায়গাটাই মোহনা এশাকে নিয়ে দাঁড়াল। রাফাতও তাদের পেছন পেছন এসেছে। সেও ধরতে পারছে না ব্যাপারটা কী। এশা এবার কপালে ভাঁজ ফেলল। গম্ভীর সুরে বলল,

‘কী হয়েছে তোর?’

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বেশি বনিতা না করে সরাসরিই বলল,

‘তুই’ই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’

প্রশ্ন শুনে এশা থমকে গেল। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিস্ময়। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মোহনার চোখ মুখের কঠোরতা দেখে আরো বেশি এশা হতভম্ব হচ্ছে। রাফাতও সমান তালে চমকেছে। মোহনা ঢোক গিলল। আবারও সে এশাকে একই প্রশ্ন করল,

‘চুপ করে আছিস কেন, এশা? বল, তুই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’

এশা রাফাতের দিকে চাইল। সেও আশ্চর্য। বোকা বোকা চোখে মোহনার দিকে চেয়ে বলল,

‘কী বলছিস এসব? এশা কেন লরিনকে সাহায্য করতে যাবে?’

মোহনা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল,

‘কেন সাহায্য করছে সেটা ঐ ভালো বলতে পারবে। এশা, চুপ করে না থেকে জবাব দে। দয়া করে আর কিছু লুকাস না।’

এশা এদিক ওদিক চেয়ে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুক্ষণ আবার মোহনার দিকে চেয়ে রইল। জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হৃৎস্পন্দনের ঢিপঢিপ শব্দ সে টের পাচ্ছে। মিথ্যে বললে বুকে ভয় জন্মে। তারও জন্মাচ্ছে। তাও সত্য বলার সাহস পাচ্ছে না।

মোহনার শক্ত কঠিন চোখজোড়ার দিকে বেশিক্ষণ সে চেয়ে থাকতে পারল না। কেন যে কষ্ট পাচ্ছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জোরে নিশ্বাস নিল। গলার স্বর তো আটকে আছে, কথা বলবে কী করে? মোহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘কথা বল, এশা।’

এশা টলমল চোখে কম্পিত সুরে বলল,

‘হ্যাঁ, আমিই এতদিন লরিনকে সাহায্য করেছিলাম।’

মোহনা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন যেন হুট করে মারাত্মক রকম ভাবে বেড়ে গেল তার। সে চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করল, সে ঠিক শুনেছে তো? না, হয়তো ভুল শুনেছে। তার এশা তার সাথে এমন করবে না, সে নিশ্চয়ই তাকে এত এত মিথ্যে বলবে না। এটা সম্ভবই না। মোহনা জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তুই মিথ্যে বলছিস, না? তুই এমন করিসনি, মজা করছিস তাই তো?’

এশা কেঁদে ফেলে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

‘না, আমিই এসব করেছি। লরিনকে প্রথম থেকে আমিই সাহায্য করেছি। তোর বাড়ির ঠিকানা, তোর ফোন নাম্বার ইনফেক্ট তোর সমস্ত ইনফরমেশন আমিই ওকে দিয়েছি।’

রাফাতও বাকরুদ্ধ। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে এশাকে দেখছে। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এশা কেন এমন করবে? ও তো মোহনাকে তার নিজের বোনের মতো ভালোবাসে, তাহলে?

মোহনা নিজেকে খুব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার। তার বন্ধু তার সাথে কেন এমন করল। সে না তাকে ভালোবাসতো? তাহলে সে তাদের বন্ধুত্বকে কেন অপমান করল?

মোহনা শক্ত গলায় বলল,

‘কেন করেছিস এসব?’

এশা কাঁদছে। কান্না থামিয়ে ঢোক গিলে বলল,

‘ও তোকে ভালোবাসে।’

মোহনা আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল।

‘ও আমায় ভালোবাসে? আর তুই আমায় ভালোবাসতি না? এতদিন যাবত নিজের চোখে তুই দেখেছিস, আমি কতটা ডিপ্রেসড ছিলাম। এই একটা বিষয় নিয়ে আমি কতটা দুশ্চিন্তা করেছি। কত কিছু করে গেছি সেই মানুষটাকে ধরার জন্য যে লরিনকে এত সব ইনফরমেশন দিয়েছে। এইসব কিছু নিজের চোখে দেখেও তুই এতদিন কী করে চুপ করে ছিলি? একটুও তোর বিবেকে আটকাল না এসব করতে? কে হয় ঐ ছেলে, যে ওর ভালোবাসার কথা চিন্তা করতে গিয়ে তুই তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে এমন করেছিস? বল, ঐ ছেলে তোর কে হয়?’

এশা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলছে। মোহনা ওর দুই হাত চেপে ধরে বলল,

‘নাটক বন্ধ কর, এশা। এতদিন তুই অনেক নাটক করেছিস, এখন আর তোর এসব নাটকে আমি ভুলব না। তাকা আমার দিকে, তাকিয়ে সত্যি কথা বল। লরিন তোর কে হয়? কেন এসব করেছিস তুই? জবাব দে, এশা।’

এশা নাক টেনে রাফাতের দিকে চাইল। রাফাতের চোখ মুখেও রাগ স্পষ্ট। এবার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। এমন একটা দিন যে একদিন আসবে সেটা সে আগেই জানত। সত্যকে সে কতদিন লুকিয়ে রাখবে? একদিন না একদিন সেটা ঠিকই সামনে আসবে।

এশা নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে অবশেষে বলতে আরম্ভ করে,

‘লরিন আমার কাজিন হয়। ওর বাবা সম্পর্কে আমার বড়ো মামা। মামা বিদেশ গিয়ে একজন বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করেন। তবে উনার সেই সম্পর্ক আমার নানা নানু কেউই কোনোদিন মেনে নেননি। তাই মামাও উনার বউ নিয়ে কখনো দেশে আসেননি। তবে আমার মা বাবার সাথে মামার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সবসময় মা বাবার সাথে মামার কথা হতো। একদিন নানা নানুকে না জানিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরেও গিয়েছিল। তখন লরিন নাকি খুব ছোট। আর আমার তখনও জন্মও হয়নি। সেই ছোট্ট লরিনের একটা ছবি আমার মা বাবার কাছে ছিল। সেটা দেখেই আমি প্রথম জেনেছিলাম, আমার একটা বিদেশি মামাতো ভাই আছে। তারপর আস্তে আস্তে যখন আরো বড়ো হলাম তখন একদিন শুনলাম, আমার মামা মামি নাকি একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। আর উনাদের ছেলে লরিন এখন নাকি লরিনের আংকেলের কাছে আছে। মা বাবা তখন চেষ্টা করেছিলেন লরিনকে দেশে আনার জন্য। কিন্তু লরিন তখন আমাদের কাউকে ভালো করে চিনতই না। ওর মা বাবার সুবাদে যতটুকুই আগে চিনত তবে মা বাবা মারা যাওয়ার পর একেবারেই ভুলে যায়। তাই ওর সাথে আমরা আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে ওর খোঁজ মা বাবা ওর আংকেলের কাছ থেকে সবসময়ই নিতেন। আর তখনই কোনো একদিন ওর আংকেলের কাছ থেকে ওর ফেইসবুক আইডিটা আমি নিয়েছিলাম। আর ও যেহেতু দেশে আসতে চায়না তাই ওকে দেশের আনার জন্যই আমি তোর ডেয়ারের সময় তোকে ওর আইডি টা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও ভাবতে পারেনি যে ও সত্যি সত্যিই তোর জন্য দেশে চলে আসবে। আর ওর দেশে আসার খবর তোর আগেই আমি ওর আংকেলের কাছ থেকে পেয়ে যাই। তাই ওর সাথে আমি আগে আগেই দেখা করি। তবে আমি যে ওর বোন হই সেই পরিচয় আমি এখনও ওকে দেইনি। ও আমার সাথে প্রথমে কথা বলতে চায়নি তাই আমি তোর ঠিকানা আর পরিচয় দেওয়ার শর্তে ওর সাথে কথা বলেছিলাম। ও বাংলা ভাষা শিখেছিল ওর বাবার কাছ থেকে আর বাকিটা এখানে আসার পর আমি ওকে শিখিয়েছিলাম। তবে জানিস তো ও তোকে নিয়ে সত্যিই খুব সিরিয়াস। তাই আমি ওকে তোর কথা বলে বলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম বারের মতো ও ওর বাবার বাড়িতে পা রেখেছিল। ওর দাদা দাদুকে দেখেছিল। তবে ও তাদের চিনতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি এই মানুষগুলো তার কত আপন। এখন ও কেবল এই দেশে পড়ে আছে তোর জন্য। নয়তো এই দেশে ও কখনোই থাকত না। ওর এই দেশের প্রতি কোনো মায়া নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ওর জন্ম কর্ম সব ঐদেশেই, তাই ওর এখানে মন টিকছে না। এখন ওকে এখানে শুধু তোর মায়াই আটকে রেখেছে। আর আমার নানা নানু এখন চান, ও যাতে এখানেই থাকে। উনাদের ছোট ছেলের শেষ চিহ্ন যেন উনাদের সাথেই থাকে। ছেলে হারিয়ে বৃদ্ধ মা বাবার এই একটাই দাবি। ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলেও ছেলের শেষ সম্পদটুকু নিজেদের কাছে আগলে রাখতে চান। আর তাই আমি লরিনকে তোর কথা বলে বলে এখানে রাখছি। না হয় ও আরো অনেক আগেই চলে যেত। আমি এইসব কিছু করেছি শুধুমাত্র আমার অসুস্থ নানা নানুর কথা ভেবে। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি জানি। যদি পারিস, ক্ষমা করে দিস।’

কথা শেষ করেই এশা দৌড়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। মোহনা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার সেই যাওয়ার পথের পানে। তার আঁড়ালে এতসব কিছু হয়ে গিয়েছে, অথচ সে কিছুই জানে না। এখন সবকিছু শুনে মাথা ঝিমঝিম করছে। এই জটিল সমস্যা সমাধান যে এত জটিল হবে সেটা সে ভাবেনি। ভেবেছিল অন্যকিছু। রহস্যময় লরিন যেন তার রহস্যের মায়াজালে তাকে আরো নিখুঁতভাবে আটকে ফেলছে। অথচ সে পথ পেয়েও বেরিয়ে আসতে পারছে না।

চলবে…

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০.

বিকেলটা আজ কেমন যেন বিষাদপূর্ণ। যেন চারদিক একটু বেশিই গুমট হয়ে আছে। কেমন নিস্তব্ধ, ক্লান্ত বিকেল। তেজহীন দিবাকর শান্ত হয়ে ঢলে আছে অন্তরীক্ষের পশ্চিমকোলে। সেও যেন আজ খুব চুপসে আছে। তেজ নেই, নেই উজ্জ্বলতা। যেন জীবনের সব প্রাণ সঞ্চার ফুরিয়ে এখন শেষের পথে। এত কিসের হাহাকার ওদের। প্রকৃতিও কি তবে মোহনার শোকে শোকাহত? হতেও পারে? মানুষ মন বোঝে না। হয়তো প্রকৃতির প্রাণহীন বস্তুগুলোও মানুষের চেয়ে ভালো মন বোঝে। মোহনা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। অতৃপ্ত মন নিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। যদি তার দৃশ্যপটে কোনো সুন্দর দৃশ্য পড়ে, সেই আশায়।

মাহিয়াও আজ খুব চুপচাপ। সচরাচর সে এতক্ষণ চুপ থাকার মেয়ে না। তবে আজ যেন কোনো কথা বলতেই তার ইচ্ছে হচ্ছে না। সারাক্ষণ বোনের সাথে ঝগড়া করলেও বোনের সামান্য মন খারাপ তার সহ্য হয় না। স্কুল থেকে এসেই তাই সে নিশ্চুপ হয়ে আছে।

বেলকনিতে মোহনা অনেকক্ষণ ছিল। ঠিক মাগরিবের আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ভেতরে আসে। ওযু করে একটা জায়নামাজ মাটিতে বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়। মোহনা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি না হলেও একেবারেই যে নামাজ পড়ে না তা না। যখন আল্লাহর বান্দাগুলোর উপর তার খুব অভিযোগ হয়, তখন চট করেই নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করতে বসে পড়ে। কষ্ট চেপে রাখলে তা বাড়ে, তাই সে জায়নামাজে বসে কেঁদে কেটে তার কষ্ট দূর করার চেষ্টা চালায়।

মাহিয়া বিছানায় বসে বসে বোনের কান্না দেখছে। মোহনা মোনাজাতে হাত তুলে কিছু বলছে আর কাঁদছে। তার সেই চোখের পানি দেখে মাহিয়ারও যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তাই সে আর সেই রুমেই থাকল না। বেলকনিতে চলে গেল। সেখানে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে এক মনে বলল,

‘আমার আপুর সব কষ্ট দূর করে দাও, আল্লাহ। আপুকে আর কষ্ট দিও না।’

নামাজ শেষ করেই মোহনা মাহিয়াকে ডাকে। অনেকক্ষণ পর মোহনার স্বর শুনতে পেরে যেন মাহিয়া তার প্রাণ ফিরে পায়। সে এক ছুটে বোনের কাছে যায়। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে,

‘কী হয়েছে আপু?’

‘কফি না চা খাবি?’

মাহিয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘কফি।’

মোহনা তারপর কফি বানাতে যায়। আর মাহিয়া তখন খুশিতে আত্মহারা।

মোহনা কফি নিয়ে আগে মা বাবার রুমে যায়। উনারা তখন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। মোহনাকে দেখে থেমে গিয়ে লায়লা বেগম বললেন,

‘কিরে মোহনা, তোর চোখ মুখ এত ফোলা কেন?’

মোহনা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘কই না তো, ফোলা কোথায় দেখলে তুমি? ঠিকই তো আছে।’

মোহনার বাবা বললেন,

‘আচ্ছা মা, তুমি বসো এদিকে।’

মোহনা বাবার পাশে গিয়ে বসল। তার বাবা এবার বললেন,

‘তোমার এই সেমিস্টারের ফাইনাল কবে?’

‘এইতো বাবা, আর এক মাস পর।’

‘আচ্ছা। আর তারপর তো আবার একমাসের বন্ধ, তাই না?’

‘জ্বি।’

‘হুম। উম..আসলে আমি আর তোমার আম্মু, আমরা দুজনে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মোহনা বিস্মিত সুরে বলল,

‘কী সিদ্ধান্ত বাবা?’

‘বলব, সময় এলে সব বলব। আগে একটা কথা বলতো মা, আমরা তোমার উপর আস্থা রাখতে পারব তো? আমাদের কিন্তু তোমাকে নিয়ে খুব গর্ব। তুমি সবসময় আমাদের গর্বটা ধরে রাখতে পারবে তো, মা? কখনো আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করবে না তো? আমরা কিন্তু তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। আর আমরা চাই, আমাদের সেই বিশ্বাস যেন একেবারে শেষ পর্যন্ত এভাবেই টিকে থাকে। কোনোদিন এমন কিছু করো না, যার জন্য মা বাবা কষ্ট পাবেন। মা বাবার বিশ্বাসে আঘাত লাগবে এমন কোনো কাজ করো না। কারণ একবার যদি বিশ্বাস ভেঙে যায় তাহলে কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও সেটা আর জোড়া লাগাতে পারবে না। তুমি ছোট নও, আশা করছি আমি কী বলতে চাইছি তা বুঝতে পারছো।’

মোহনা নতমস্তকে মাথা নাড়াল। মন বলছে, কিছু একটা হয়তো হতে চলেছে। হয়তো মা বাবা তার অনুপস্থিতেই কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আর এখন তারা আশা রাখছেন যে মোহনা সব শোনার পর খুব সহজেই সবকিছু মেনে নিবে।

মোহনা তার রুমে এসে দেখল, মাহিয়া তার ফোন দিয়ে যেন কার সাথে কথা বলছে। কফির স্ট্রে টা সাইডে রেখে সে মাহিয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কার সাথে কথা বলছিস?’

খানিক চমকে মাহিয়া জবাব দিল,

‘লরিন ভাইয়া।’

মোহনা মাহিয়ার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের কানে ধরল। কর্কশ স্বরে বলল,

‘কল কেন করেছেন?’

ওপাশ থেকে লরিন ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘এশাকে ভুল বুঝো না মোহনা। ও আমার কথা শুনেই এসব করেছে।’

মোহনা খুব ক্ষেপে গেল। বলল,

‘আপনি কি এশার হয়ে সাফাই গাইতে কল দিয়েছেন?’

‘না, তা না। আসলে ও…’

‘দেখুন লরিন, আমাকে দয়া করে আর কিছু বোঝাতে আসবেন না। এখানে স্বার্থ আপনারও ছিল আর এশারও ছিল। আর আপনাদের দুজনেরই স্বার্থের বলি হয়েছি আমি। এতদিন কত নাটক করেছেন দু’জন। আর আমি কত বোকা, কত সহজেই আপনাদের বিশ্বাস করে গিয়েছি। যাকগে, জীবনে এক দু’বার ধাক্কা না খেলে মানুষ চেনা যায় না। আমি আর এসব নিয়ে ভাবব না। তবে, আপনার সাথে আমার লাস্ট কিছু কথা আছে। যদি কাল ফ্রি থাকেন তবে বিকেলে দেখা করবেন। এখন রাখছি।’

লরিন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। কল কেটে দিয়ে মোহনা জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। সব ধোঁকা সহ্য করা গেলেও বন্ধুত্বের ধোঁকা সহ্য করা যায় না।

মোহনা ঢকঢক করে গরম কফিটাই গিলতে লাগল। বুকের দহনে যখন ঐ তপ্ত গরম কফি গিয়ে ঠেকল তখন যেন তা আরো বেশি উত্তাল হয়ে উঠল। তাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সে। কফি খাওয়া শেষ করে মাহিয়ার দিকে চেয়ে দেখল, মেয়েটা কেমন অসহায় ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোহনা তা দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘ভয় পাস না, ঠিক আছি আমি।’

মাহিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,

‘এশাপু এমন কেন করল, আপু?’

মোহনা ঢোক গিলে বলল,

‘এসব কথা থাক। আগে বলতো, আমাকে কিসে মানাবে? শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?’

মোহনার এসময়ে এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে মাহিয়া কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

‘হঠাৎ শাড়ি আর লেহেঙ্গার কথা কোথ থেকে এল? কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?’

মোহনা হেসে বলল,

‘আরে বাবা, আমার বিয়েতে আমাকে কী পরলে মানাবে সেটা বলছি।’

‘তোমার বিয়ে? তোমার কেন বিয়ে হতে যাবে?’

মাহিয়ার যেন মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মোহনা হাসতে হাসতে বলল,

‘আশ্চর্য, তুই এত অবাক হচ্ছিস কেন? আমি বড়ো হয়েছি, আমার বিয়ে হবে না?’

‘হবে, কিন্তু হুট করেই আজকে বিয়ের কথা কেন বলছো? এর আগে কখনও তো বিয়ে নিয়ে কিছু বলোনি।’

মোহনা নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘মানুষের জীবনে সবকিছু হুট করেই হয়। প্ল্যান মাফিক কিছু করতে গেলেই ব্যাঘাত ঘটে। তার চেয়ে হুটহাট করেই সব হয়ে যাওয়া ভালো। এখন এত না ভেবে বল, বিয়েতে কী পরব? শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?’

_________________________________

পরদিন মোহনা ভার্সিটিতে গেল না। তার বাবার কপালের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। সে সেই অজুহাত দেখিয়ে আজ বাসায়ই থেকে গেল। সকাল থেকেই রাফাত মোহনাকে অনেক কল করেছে। কিন্তু মোহনা তার কোনো কলই রিসিভ করেনি আর করবে না বলেই পণ করেছে। রাফাতের এত এত কল সে রিসিভ করছিল না বলে অবশেষে রাফাত তাকে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠায়। যেখানে লেখা ছিল, “দোস্ত, অন্তত আমার কলটা তো রিসিভ কর।” তবে মেসেজ দেখেও মোহনা রিপ্লাই করল না। সে ফোন রেখে গোসলে চলে গেল।

দুপুরে খেতে বসে মোহনার বাবা বললেন, আগামীকাল নাকি অরূপের বাড়িতে দাওয়াত আছে। তাই তারা স্বপরিবারে কাল সেখানেই যাবেন। কিন্তু মোহনার যেতে ইচ্ছে করল না। সে নরম গলায় বলল,

‘বাবা, আমি যাব না। আমার কালকে একটা সি.টি আছে।’

‘কয়টার দিকে?’

মোহনা মিথ্যে বলল। বলল,

‘ঐ তো তিনটার দিকে।’

‘ঠিক আছে তাহলে, তিনটার পরেই যাব।’

মোহনা খুব হতাশ হয়ে পড়ল। মিথ্যে বলেও লাভের লাভ কিছুই হলো না।

বিকেলের দিকে মাহিয়াকে নিয়ে মোহনা বেরিয়ে গেল লরিনের সাথে দেখা করতে। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখল, লরিন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। লরিনকে দেখে মাহিয়া খুব খুশি হলো। লরিনের মুখেও হাসি ফুটল তাকে দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি বিলিন হয়ে গেল মোহনার ম্লান মুখপানে চেয়ে।

চলবে…