প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০৫

0
5

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৫

মরুভূমির পাশের বেশকিছু গ্রামেও মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারীতে মানুষ পথে ঘাটে মরে পড়ে আছে কেউ কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারছে না।যারা এখনো সুস্থ ও আছে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এসেছে।

গ্রাম ছাড়ার পথে হৈমু বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছেন। এখানে শুধু মানুষ মহামারীতে মারা গেছে তা কিন্তু নয় ।গৃহপালিত পশু ও মারা গেছে। ক্ষেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।যেসকল গ্রামে মহামারী চলছে সেখানে কোন ফসল ফলছে না।”

বীর প্রতাপ বলল, “তা তো বটেই। এখানে নতুন মহামারী আসার আগ থেকেই মহামারী লেগে ছিল।এই যেমন প্লেগ কলেরা সহ নানান রোগ। এখানে কিছু গ্রামে মাটির নিচে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে।এই কারনে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কুয়ার পানি অনেক গভীর থেকে আসার পরেও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এইজন্যই বলেছি কুয়ার থেকে পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে”

হৈমু বলল, “এইরকম বিষ ছড়ানোর কারন কি?”

রুদ্র বলল, “এইগুলা প্রাকৃতিক ভাবে হতে পারে আবার মানুষের সৃষ্ট ও হতে পারে। সঠিক তথ্য তো আমার জানা নেই”

আরাফ বলল, “এটা একটা ভাইরাস বলতে পারেন।ফসলের মাঠে এক ধরনের গাছ ফলে।এই অজানা গাছে এক ধরনের ভাইরাস ডিম পাড়ে।এই পোকা ফসল নষ্ট করে দেয়”

হৈমু বলল, “পোকা তো নির্দিষ্ট গাছে হয়।বাকি ফসল নষ্ট হয় কীভাবে?”

আরাফ বলল, “এই গাছ বিষাক্ত হয়ে থাকে।এই গাছ বিষাক্ত হওয়ার কারণে যেখানে জন্মায় ওই জায়গায় মাটি বিষাক্ত করে দেয়।এই পোকা শুধু ফসল নষ্ট করে তা নয়।গরু ছাগলের ও ক্ষতি করে।কোন গরু কিংবা ছাগল যদি পোকায় ডিম পাড়া পাতা খায় সাথে সাথে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটে।অনেক মানুষ এইসব বুঝতে পারে না। তাই তারা ভাবে এইসব ডাইনীদের কাজ।”

রুদ্র বলল, “তাহলে পানি পান করা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে । নাহলে বিপদ আছে”

বীর প্রতাপ বলল, “আমাদের লক্ষ্য হলো এই রোগের প্রতিষেধক খুঁজে বের করা।যেটা ওই দ্বীপে আছে। কিন্তু ওখানে যেতে অনেক বাধা পেরোতে হবে। এইরকম অনেক সমস্যাই আমাদের পার করতে হবে”

বীর প্রতাপের কাফেলা নতুন গ্রামে প্রবেশ করলো।গ্রামে প্রবেশ পথে বিশাল বড় একটা গেট।গেটের পাশে একটা সাদা দামী পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।যেন সবাই কে স্বাগতম করবে বলেই তার এই জায়গায় দাড়ানো।পাথরের হাতে একটা কয়েন ভর্তি রুপোর থালা রাখা। লোকজন এখানে কয়েন দিয়ে যায়। বিনিময়ে মুর্তির কাছে কিছু চেয়ে নেয়।এই মুর্তি মানুষের মনের আশা পূরন করে। তবে এমনি এমনি চাইলে হবে না। মুর্তিকেও বিনিময় স্বরুপ কিছু দিতে হবে।তাই মানুষ এখানে রুপোর কয়েনের বিনিময়ে সকল চাওয়া পাওয়া মুর্তির কাছে নিবেদন করে।যারা একটু ধনী তারা স্বর্ণ মুদ্রা ও দিয়ে যায়।
মুর্তির সামনে এক মহিলা দুই বছরের ছোট বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাত জোড় করে বিড়বিড় করে কিছু বলে একটা রুপোর কয়েন থালায় দিয়ে বাচ্চার হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে কোথাও মিলিয়ে যায়।

দূরে বাজারের এক কোনে দুই জন মেয়ে মানুষ বেঁধে রাখা হয়েছে। কিছু লোক তাদের দুইজন কে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করছে। আশেপাশে উৎসুক জনতা সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে আর চিৎকার করে বলছে ডাইনীকে পুরিয়ে মারো।এত মানুষের ভীড়ে কিছু মানুষ সৈন্যদের পা ধরে কান্না কাটি করছে। চিৎকার করে বলছে আমার মেয়ে ডাইনী না। ‌আমাদের ছেড়ে দিন আমরা অনেক দুরে চলে যাবো।হৈমু পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে।হৈমু ভাবে এরা হয়তো মেয়ে দুটোর পরিবারের লোকজন।

মাটিতে একটা বিশাল গর্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।তাতে ধাও ধাও করে আগুন জ্বলছে।তাতে মেয়ে দুটোকে হাত পা বেঁধে আগুনে ফেলে দেয়া হয়।মেয়ে দুটো যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠে। মুহুর্তের মধ্যে চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়।হৈমু দেখে আশেপাশের মানুষ চোখের নিচে বেগুনী রঙ লাগিয়েছে।হাতে বেগুনী রঙের সুতো বাঁধা।বীর প্রতাপ ঘোড়ার থেকে হৈমুকে ধমক দেয় পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য।হৈমু সাথে সাথে পর্দা নামিয়ে ফেলে। কাফেলা আবার ও চলতে শুরু করে।

বীর প্রতাপ দুর থেকে মেয়ে দুটোকে পুড়িয়ে মরতে দেখে। একেবারে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত বীর প্রতাপের নজরে ওইদিখেই ছিল।

উটের মালিক বলল, “এরা হলো জাদুকর।কালো জাদু করে মানুষের ক্ষতি করে।তাই এদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এখনকার জমিদার কুলিশাহ খান ঠিক করেছেন সব খারাপ জাদুকরদের এভাবেই মেরে ফেলা হবে। এখানে যারা কান্নাকাটি করছে এরা কিন্তু মোটেও ভালো মানুষ নয়।এরা কালো জাদু করে মানুষের ক্ষতি করেছে”

আরাফ বলল, “কালো জাদু করে কী মানুষ মারা যায়?”

উটের মালিক বলল, “হয়তো যায়।তা নিয়ে আপনি চিন্তা করছেন কেন? আপনাদের পথ শেষ ভাড়া দিয়ে নেমে পড়ুন”

বীর প্রতাপ বলল, “আপনি এই এলাকায় থাকেন?”

উটের মালিক বলল, “জী সাহেব”

বীর প্রতাপ উটের মালিক কে তাদের ভাড়া মিটিয়ে দিলো।

রুদ্র বলল, “আজ রাতে আমরা কোথায় থাকবো? আমাদের সাথে তো হৈমন্তী আছে । এখানকার মানুষ জন আমার সুবিধার মনে হয়নি”

আরাফ বলল, “আমার জানামতে এখানে রাতে থাকার মতো জায়গা নেই।কারো বাড়িতে আশ্রয় দিবে সেরকম এলাকা এটা নয়।এরা খুব কুসংস্কার মানে। দেখা যাক কোন সরাইখানা মিলে কিনা”

আরাফ পাশেই এক ভদ্রলোক কে ডাক দিয়ে বলল, “ও ভাই শুনছেন।একটু এদিক আসবেন একটু কথা ছিল”

লোকটি বলল, “জী বলুন।কি বলতে চান।”

আরাফ ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, “আমার পাশে যাকে দেখছেন এ হলো প্রতাপ গড়ের জমিদার বীর প্রতাপ আর পালকিতে আছেন আমাদের জমিদারের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী হৈমন্তী।আমরা এখানে সফরে এসেছি একটা বিশেষ কাজে। এখানে শুধু আজ রাতটাই থাকবো।কাল সকালে আমাদের জাহাজ আসবে।আজ রাত থাকার জন্য কোন সরাইখানার সন্ধান দিতে পারবেন?”

কথাটা বলার সময় প্রমান স্বরুপ রাজকীয় সিলমোহর দেখিয়ে দেয় আরাফ।

লোকটি সাথে মাথা নিচু করে ফেলল ।মাথা নত রেখেই বলল , “আমাদের কোন সরাইখানা নেই হুজুর। আপনি চাইলে আমার বাড়িতে এক রাত কাটাতে পারেন। তাহলে সেটা হবে আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। এখানে রাতের বেলা বাইরে থাকা নিরাপদ নয়”

বীর প্রতাপ বলল, “আমাদের কোন অসুবিধা নেই। আপনি আমাদের আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন।আমরা আজ রাতে আপনার বাড়িতেই থাকবো”

লোকটি বলল, “আমার সাথে আসুন। আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়”

সবাই মিলে লোকটির সাথে চলতে শুরু করল।একটা কাঠের একতলা বাড়ির সামনে লোকটি গিয়ে দাঁড়াল।বাড়ি বললে ভুল হবে ট্রি হাউজ বলা চলে।একটা বিরাট গাছের গুঁড়ির উপর বানানো এই বাড়িটা। লোকটি দরজায় কড়া নাড়তেই একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুলে দিলো। লোকটি বলল, ইনি আমার মা। আমি আমার মায়ের সাথেই থাকি”

আরাফ বলল, “বাড়িতে আর কেউ নেই?”

লোকটি বলল, “বিয়ে করেছিলাম ।বউ বাচ্চা কলেরায় মারা গেছে।”

লোকটি তার মায়ের উদ্দেশ্য করে বলল, “ইনি প্রতাপ গড়ের জমিদার। উনি আজ আমাদের বাড়িতে থাকবেন। উনার জন্য ভালো ঘর দেখে দাও।দেখবে জমিদারের যেন কোন অযত্ন না হয়।”

আরাফ রুদ্র বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।বীর প্রতাপ অনুমতি দিতেই হৈমু পালকির বাইরে পা রাখলো। চাকরদের পালকি একপাশে রাখতে বলে বীর প্রতাপ নিজেও ঘরের ভেতর হৈমুকে নিয়ে প্রবেশ করলো। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই।

ঘরে প্রবেশ করতেই বৃদ্ধা মহিলা তাদের মাথা নিচু করে সম্মান দিয়ে বলল , “আমার সাথে আসুন । আপনাদের ঘর দেখিয়ে দেই।”

ভদ্রমহিলা চাকরদের একটা ঘর দেখিয়ে দিল। রুদ্র আর আরাফ কে একটা ঘর আর জমিদার বীর প্রতাপ ও তার স্ত্রী হৈমুর জন্য আলাদা একটা ঘর দেখিয়ে দিলো।

ঘর টা ছিল খুব পরিষ্কার আর পরিপাটি।ঘরে একটা খাট আর তেমন কিছু নেই। বীর প্রতাপ খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিলো।খাট টা খুব শক্ত। তবে তাকে মানিয়ে নিতে হবে।সে তো আর নিজেদের প্রাসাদে নেই যে নরম তুলতুলে বিছানা খুঁজবে।সে এখন সফরে আছে।এক দরিদ্র লোক তাকে আশ্রয় দিয়েছে।এটাই তো অনেক।

(চলবে)