#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_উনিশ
এতগুলো কথা একসাথে বলায় রোজি বেগম একটি হাঁপিয়ে উঠে। হানিয়া তাকে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। সে সেটা পান করে।আবার বলা শুরু করে–
–স্পর্শীয়া সম্পর্কে জড়ানোর ছ’মাস পর থেকে তাকে একটু অদ্ভুত লাগছিলো। কেমন ছন্নছাড়া,, উদাসীন হয়ে বসে থাকতো। আমি তাকে এমন উদাসীন হয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? কিন্তু সে আমাকে কোন না কোনভাবে কথা কাটিয়ে দেয়। এর মধ্যে খবর আসে জাভিয়ান খুব শীঘ্রই ফিরছে দেশে। বাড়ির ছেলে এতগুলো বছর পর বাড়িতে ফিরে আসবে সে এক অন্য রকমের আনন্দ হচ্ছিল। আমরা জাভিয়ানের আগমন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম যে আমার যত্নে গড়া ফুলটাকে ভুলেই যাই। সে হয়ে যায় একা,,নিঃসঙ্গ। জাভিয়ান যেদিন আসবে সেদিন সকাল সকাল স্পর্শীয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়,,আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কোথায় যাচ্ছে? বলে,,কি নাকি একটা জরুরি কাজ আছে সেটা করতে যাচ্ছে,, যাওয়ার আগে আরো বলে যায় তার ভাই ফিরে আসার আগেই সে চলে আসবে। কিন্তু সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া ছিলো,, আর ফিরে নি আমার ফুল।
লাস্টের কথাটা বলে রোজি বেগম হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। হানিয়া তাকে নিজের বুকে আগলে নেয়। সময় দেয় তার কষ্টগুলো বের করার। বেশ সময় নিয়ে রোজি বেগম শান্ত হয়। হানিয়া তাকে আরেকবার পানি খাইয়ে দেয়। রোজি বেগম শান্ত হয়ে নিজে থেকেই বলে–
–আমরা সকলে জাভিয়ানকে এয়ারপোর্টে নিতে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমাদের আগেই মানা করে দিয়েছিলো,,বলেছিলো সে আর তার দুয়েকটা ফ্রেন্ড নাকি আসবে তাদের সাথে শহর ঘুরতে ঘুরতে তারপর বাড়ি আসবো। আমরা মানতে চাই না কিন্তু তার জেদের কাছে পরাজিত হই। সন্ধ্যা হয়ে যায় কিন্তু স্পর্শ- জাভিয়ান বা তার বন্ধুদের কেউই বাড়ি ফিরে না। আমরা দুজনকেই সমান ভাবে কল দিতে থাকি কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করে না। আমি কি মনে করে আমার What’s app এ ঢুকি,,দেখি স্পর্শর নাম্বার থেকে একটা ভয়েজ মেসেজ। ভয়েজটা অন করলে শুনতে পাই স্পর্শ আমাকে বলছে–
–“মাম্মাম আজ আমি চরম ভাবে ঠকে গেলাম,,এত ভালোবাসার পরও এমন পরিনতি তো আমার হওয়ার কথা ছিলো না।”
–ব্যস এইটুকুই। ওইদিন সারা রাত চলে যায় কিন্তু জাভিয়ান বা স্পর্শ কেউ ফিরে আসে না। জাভিয়ানের খোঁজ পাই আমরা সকালে,,সেই আমাদের ফোন দিয়ে বলে সে নাকি তার কোন এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছে,,আসবে কয়েকদিন পর। কথাটা বলেই আমাদের কোন কথা না শুনেই কেটে দেয়। আমরা তাকে কিছু জানাতেই পারি না স্পর্শ সম্পর্কে। ভাইয়া পুলিশে রিপোর্ট করে কিন্তু কোন খবর পায় না। পাঁচদিন পর খবর আসে শহর থেকে একটু বাহিরের দিকে এক পুকুরে স্পর্শের লা//শ পাওয়া গেছে। আমরা ছুটে যাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে গিয়ে দেখি,, আসলেই আমার স্পর্শ আর নেই। অনেকদিন পানিতে থাকার কারণে তাকে তেমন একটা চেনা যাচ্ছিলো না,, শরীর ফুলে যাতা অবস্থা হয়ে গেছে।শুধু তার পোশাক আর শারীরিক গঠন দেখে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ওটা স্পর্শ ছিলো।ভাবী সইতে পারে না মেয়ের মৃত্যু,, হার্ট অ্যাটাক করে বসে। তাকে হসপিটালে এডমিট করে,,স্পর্শের বেড বডি নিয়ে আসা হয় বাসায়। জাভিয়ান কীভাবে যেন খবর পেয়ে যায় বোনের মৃত্যু আর মায়ের অসুস্থতার কথা। ছুটে আসে বাসায়,,পরবর্তীতে সেই সব দিক সামলায় শক্ত হাতে। ভেঙে পড়তে গিয়েও শক্ত থাকে পাথরের মতো। বোনকে কবরে শোয়ানোর আগে একটাই কথা বলেছিলো সে– বোন তোর এই অবস্থা যে করেছে তাকে তোর ভাই কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে। তারপর থেকেই আমাদের সেই হাসিখুশি পরিবারটি হারিয়ে যায়,,যেই বাড়ির আনাচে-কানাচে খুশিরা ঘুরে বেড়াত সেখানে এখন বিষাদেরা মেলা বসায়। স্পর্শ নেই আজ দুই বছর ছ’মাসের কিছু দিন কম হবে,, এই এতোগুলো দিন পর বাড়িটায় আবার খুশি দেখা গিয়েছিলো তোদের বিয়ের সময়। তুই আসলি বউ হয়ে,,ভাইয়া একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগলো। ভাবীর হতে একটু সময় লাগবে,, কারণ সে যখন হার্ট অ্যাটাক করে তখন একটা মিনি স্টোকও করে। তখন থেকেই মেজাজ কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে তার। আর তোর সাথে এমন অমানবিক আচরণ করার পেছনে আরেকটা কারণও আছে।
–কি কারণ মনি মা?
–সোহা,,তার বোনঝি। সে ছোট থেকেই জাভিয়ানের সাথে তার বিয়ে দিতে চাইছিলো। ভাইয়াকে এই বিষয়ে বললে সে হ্যাঁ-না কিছুই বলে না। ভাবী নিজের মনে মনেই সব ঠিক করে। হুট করে কয়েকমাস আগে ভাইয়া তোর ছবি এনে জাভিয়ানকে বলে তোর সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে,,তোকেই বিয়ে করতে হবে ওর। জাভিয়ান তো সে কি রাগ,,করবে না এই বিয়ে,,কোথাকার না কোথাকার মেয়ে। এটা আসল কারণ না আসল কারণটা হলো,,জাভিয়ান স্পর্শের ডায়রি পড়ে তার সম্পর্কের কথা জানতে পারে। মূলত তার পর থেকেই তার প্রেম-ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়। সে বলেই দেয় সে জীবনে বিয়েশাদি করবে না। ছেলের এমন কথা শুনে ভাইয়া অসুস্থ হয়ে পরে। পরে জাভিয়ান বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যায়। আমি এতদিন ভাবতাম তোর সাথে জাভিয়ান আর ভাবীর খারাপ আচরণের কারণ জাভিয়ানের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া বা সোহার সাথে জাভিয়ানের বিয়ে না হয়ে তোর সাথে হয়েছে তাই।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ছোট একটা কারণে জাভিয়ান তোকে ওইদিন ওমন কুকুরের মতো মা//রত না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন বড় কারণ আছে।
–সে শুধু ওইদিন এমন ভাবে মারে নি। এর আগেও আমাকে ওমন ভাবে মেরেছে মনি।
মলিন হেসে হানিয়া কথাটা বলে। রোজি বেগম তার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। আগেও এমন ভাবে মেরেছে,,সেদিন না হয় রোজি বেগম দেখে তাকে উদ্ধার করেছিল কিন্তু তার আগে যখন মেরেছিল তখন মেয়েটার কি অবস্থা হয়েছিল??
সে অস্থির হয়ে বলে–
–কবে? আমায় তো কিছু বলিস নি।
–আমাদের বাসর রাতেই সে আমার গায়ে প্রথম হাত তুলেছিলো,,কিন্তু কিছুদিন আগে যে মারল না ততটা প্রখর ভাবে মারে নি। আর বলি নি কারণ তোমার আদুরে বাচ্চাটা (মুখটা বেকিয়ে বলে) আমাকে হুমকি দিয়েছিল যদি আমি কাউকে তার এমন ব্যবহার সম্পর্কে বলি তাহলে আমার অবস্থা আরো খারাপ করে দিবে। তাই বলি নি।
হানিয়ার থেকে জাভিয়ান সম্পর্কে একের পর এক চমকপ্রদ কথাগুলো শুনে রোজি বেগম ভীষণ দুঃখী হয়ে যায়। সেই তো ছোট থেকে জাভিয়ান-স্পর্শকে লালন পালন করে বড় করল,,সে তো সবসময় বলত মেয়েদের সম্মান দিতে। তার সামনে তো জাভিয়ান কখনো মেয়েদের সাথে এমন কুকুরের মতো আচরণ করে নি তাহলে নিজের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ কেন তার? শুধুমাত্র বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করায়?
______________________
তাদের কথাবার্তার মাঝে মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়,,তারা দু’জনে অজু করে নামাজ পরে নেয়। বাহিরে তখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে। হানিয়া ঠিক করে সন্ধ্যার নাস্তায় গরম গরম চপ আর চা বানাবে। রোজি বেগম তাকে হেল্প করতে চাইলে হানিয়া তাকে নিষেধ করে। তাও রোজি বেগম করতে চাইলে হানিয়া তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখে।
–হাঁটুর ব্যথায় কাল কে ঘুমাতে পারে নি হ্যাঁ? একটা কথা বললে কিন্তু ডাক্তারকে বলবো বড় বড় ইনজেকশন দিতে তোমাকে।
রোজি বেগম চোখ ছোট ছোট করে বলে–
–আমাকে কি তুই বাচ্চা পেয়েছিস? ইনজেকশনের ভয় দেখাচ্ছিস যে?
–বাচ্চা ভাববো কেন? তুমিতো বাচ্চাদের মা। যার তিন তিনটে বাচ্চা আছে,,তাকে কি কোন কিছুর ভয় দেখানো যায়? কিন্তু তোমাকে যায়।(কথাটা বলে হানিয়া ক্লোজআপ মার্কা একটা হাসি দেয়) কারণ তুমি আসলেই ইনজেকশন ভয় পাও।
রোজি বেগম এক প্রকার ধরা পরে যায়। তার আসলেই ইনজেকশন ভীতি আছে। এই বিষয়টা হানিয়া সেদিন জানতে পারে যেদিন রোজি বেগম তার অসুস্থতার জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আর ডাক্তার হানিয়াকে ইনজেকশন দিচ্ছিলেন সেদিন। তারপর থেকেই হানিয়া তাকে ইনজেকশনের কথা বলে রাগায়।
রোজি বেগম নিজের হার স্বীকার করে নেন। হানিয়া খুশি মনে রান্নাঘরে চলে যায়। কুলসুম আর সে হাতে হাতে খুব কম সময়েই চপ আর চা বানিয়ে ফেলে। হানিয়া চপের প্লেটটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এনে মাত্রই সেন্টার টেবিলে রাখে তখনই কলিংবেল বেজে উঠে। কুলসুম তাড়াতাড়ি করে গিয়ে খুলতে গেলে হানিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–তুমি চায়ের কাপগুলো নিয়ে আসো,,আমি দেখছি কে আসলো।
কুলসুম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সে। হানিয়া মেইনডোরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবো–
–এই অসময়ে আবার কে আসলো? জাভিয়ান? কিন্তু সে তো এইসময়ে আসে না। তাহলে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সে দরজার সামনে উপস্থিত হয়। আর কোনকিছু না ভেবেই সে দরজা খুলে। সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে সে একটু অবাকই হয়। ব্যক্তি বললে ভুল হবে,,কারণ একজন নয় দু’জন এসেছে। জাভিয়ানের সাথে আরো একজনকে দেখতে পায় হানিয়া। তাকে সে চিনে না এমনকি তাদের বিয়ের সময়ও দেখে নি। হানিয়া তাদের সালাম দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে তাদের ভেতরে প্রবেশের জায়গা দেয়। রোজি বেগম হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–কে এলো হানিয়া?
হানিয়া জবাব দেওয়ার আগেই জাভিয়ান আর অপরিচিত সেই ব্যক্তিটি রোজি বেগমের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। লোকটি যেয়ে রোজি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে–
–সারপ্রাইজজজজজ!! আমি আন্টি।
রোজি বেগম ছেলেটিকে দেখে প্রথমে একটু অবাকই হয় কি পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে–
–রাহাত!! তুই? কেমন আছিস বাবা?
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো ছিলাম আর এখন তোমাকে দেখে আরো ভালো হয়ে গিয়েছি আন্টি।তুমি কেমন আছো?
রাহাত ছেলেটি রোজি বেগমকে ছেড়ে তার গাল আগলে ধরে কথাটা বলে। রোজি বেগমও খুশি মনে জবাব দেয় —
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। এতদিন পর বুঝি আমার কথা মনে পরলো?
–না গো আন্টি অনেক আগেই মনে পরেছিলো কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তোমাদের সাথে দেখা করতে আসতে পারছিলাম না।
–সে যাই হোক,,আয় বোস। (তারপর হানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে) ওকে চিনতে পেরেছিস?
রাহাত না বসে হেটে হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর নিজের গালে হাত রেখে কেমন একটা চাহনি নিয়ে বলে–
–চিনতে পারি নি কিন্তু গেস করি দাঁড়াও। ইনি আমার ভাবী মানে জাভিয়ানের বড় তাই না আন্টি??
–হুম ঠিক বলেছিস।
–কেমন আছেন ভাবীসাহেবা??
হানিয়া নিজের এতটা কাছে একটা অচেনা পুরুষকে দাঁড়াতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে নিজেই দুই কদম পেছনে সরে গিয়ে বলে–
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া। আপনি?
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়ে কথাটা বলে রাহাত। জাভিয়ান এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো। জাভিয়ান শুনছিলো বললে ভুল হবে,,সে আঁড়চোখে হানিয়াকে দেখছিলো। কিন্তু হানিয়া একবারও তার দিকে তাকায় না। রাহাত যখন হানিয়ার কাছে দাঁড়িয়ে কেমন কেমন চাহনি নিয়ে হানিয়ার দিকে তাকায় তখন কেন জানি বিষয়টা জাভিয়ানের ভালো লাগে না। তারউপর সে হানিয়ার অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারে। সে তাদের কথাটা বাগড়া দিয়ে বলে–
–রাহাত তুমি বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
তারপর হানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে–
–এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে আসো।
এবার রাহাত জাভিয়ানের কথায় বা হাত ঢুকিয়ে বলে–
–আহা ভাবীর সাথে কথা বলছি দেখছো না? তোমায় পানিটা যদি কুলসুম দেয় তাহলে কি বেশি সমস্যা হয়ে যাবে?
বেশ দুষ্টুমি স্বরেই কথাটা বলে রাহাত। মুহূর্তেই জাভিয়ানের শান্ত মেজাজটা অশান্ত হয়ে যায়। কিন্তু সে নিজের রাগটা চেপে নেয়,,তারপর রাহাতের একদম কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে–
–বুঝো না সারাদিন অফিসে গাধারখাটুনি খেটে প্রচুর এনার্জি লস হয়েছে,, তাই এখন একটু এনার্জি নেওয়ার জন্য বউটাকে রুমে না নিলেই নয়।
হানিয়া যেহেতু রাহাত আর জাভিয়ানের কাছাকাছি দাড়িয়ে ছিলো তাই সে জাভিয়ানের কথার কিছুটা অংশ শুনতে পায়। প্রথম গুলো শুনতে না পেলেও শেষের কথাগুলো শুনতে পায় আর সেগুলো শুনে সে হতভম্ব হয়ে যায়। কি ঠোঁটকাটা লোকটা মাইরি!!!
রাহাতের হাসি হাসি মুখটা চুপসে যায়। তাও সে জোড়াতালির একটা হাসি দিয়ে বলে–
–বুঝতে পেরেছি,,তোমার বউ তুমি নিবে আমি বলার কে। ইনজয় ইউর টাইম ব্রাদার।
কথাটা বলে রাহাত জাভিয়ানকে একটা চোখ টিপ দেয়। জাভিয়ান প্রতিউত্তরে তাকে সুন্দর একটা হাসি ফেরত দেয়। তারপর হানিয়াকে পুনরায় বলে–
–কাম ফাস্ট।
কথাটা বলে সে গটগট করে উপরে চলে যায়। হানিয়া পরে যায় মাইনকার চিপায়। এই এক সপ্তাহে সে একবারও জাভিয়ানের রুমে যায় নি আর না তার এখন যাওয়ার ইচ্ছে আছে। রাহাতকে বসতে বলে কুলসুমকে নিয়ে কিচেনে চলে যায়। তারপর রাহাতকে হালকা পাতলা নাস্তা দিয়ে কুলসুমকে নিয়ে উপরে যায় জাভিয়ানের রুমের উদ্দেশ্যে এক গ্লাস পানি নিয়ে। একজন বাহিরের মানুষের সামনে স্বামীর কথা অমান্য করে তাকে অপমান করার মতো শিক্ষা তার মা তাকে দেয় নি। সে জাভিয়ানের কথাটা মানবে কিন্তু তার উপায়ে। সে জাভিয়ানের রুমের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কুলসুমকে বলে —
–যাও এটা (পানির গ্লাসটা কুলসুমকে দিয়ে বলে) তোমার ভাইজানকে দিয়ে আসো। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
কুলসুম হানিয়ার কথা মতো পানির গ্লাসটা জাভিয়ানের রুমে নিয়ে যায়। মিনিট দুয়েক পরই রুমের ভেতর থেকে গ্লাসটা ভাঙ্গার আওয়াজ আসে।
শব্দসংখ্যা~১৭০০+
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_বিশ
গ্লাস ভাঙার শব্দে হানিয়া একটু না বেশ অবাকই হয়। কিছু মুহূর্ত পরেই কুলসুম জাভিয়ানের রুম থেকে বের হয়ে আসে ভয়ার্থ মুখ নিয়ে। বেশ ভীত দেখাচ্ছে তাকে। সে হানিয়ার কাছে এসে বলে–
–ভাইজান আপনারে ভেতরে ডাকতে আছে ভাবী।
–ওহ্হ,, আচ্ছা।
হানিয়া এমন একটা ভাব করে যেন তার কানে কোন কথাই যায় নি। কথাটা বলে হানিয়া হাটা দেয় সিঁড়ির দিকে। কুলসুম তার এমন ব্যবহার দেখে অবাক হয়। সে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে–
–ভাবী যাইবেন না ভাইয়ের রুমে? ডাকতে আছে তো আপ্নারে।
–নিচে চলো কুলসুম। মেহমান এসেছে বাড়িতে তার জন্য ভালো কিছু রান্না করতে হবে তো,,অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি আসো।
কথাটা বলে হানিয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। কুলসুমও তার পেছন পেছন কেটে পরে। দাঁড়িয়ে থাকে শুধু জাভিয়ান যে কিনা কুলসুমের পেছন পেছনই এসেছিলো কিন্তু একটু আড়ালে দাড়িয়েছিল। হানিয়ার এমন ইগনোর দেখে তার কলিজা পর্যন্ত তিতা হয়ে গেছে। সে হাত মুঠ করে প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলে–
–বাহ্,,মেরে বিল্লি মুঝিসি হি ম্যাঁউ। আমাকে ইগনোর করার ফল তোমাকে ভুগতো হবে হানি।
_________________________
রান্না শেষ করে হানিয়া হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়। দেখতে পায় জাভিয়ান আর রাহাত অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সে নিজের উপস্থিতি বুঝাতে গলা খাঁকারি দেয়। জাভিয়ান আর রাহাত দুজনই তার দিকে তাকায়। দু’জনের চোখে একটা মুগ্ধতা কাজ করছে। হানিয়ার হালকা ঘামে ভেজা মুখটা উপস্থিত দু’জন পুরুষকেই মুগ্ধ করছে। জাভিয়ান না হয় হানিয়ার স্বামী তার মুগ্ধতার বিষয় আলাদা কিন্তু রাহাত? হানিয়া তাদের উদ্দেশ্য করে বলে–
–রাত তো অনেক হলো ডিনারটা করে নিলে ভালো হয়। এখন কি ডিনার সার্ভ করবো?
জাভিয়ান ঘোর থেকে বের হয়ে বলে–
–হুম করো।
–আচ্ছা। আপনার আসুন তাহলে।
কথাটা বলে আবার কিচেনে চলে যায়। সে তার কুলসুম হাতে হাতে নিয়ে আসে খাবার গুলো।জাভিয়ান আর রাহাতও এসে পরেছে। হানিয়া কুলসুমকে বলে–
–মনিকে ডেকে নিয়ে আসো।
কুলসুম রোজি বেগমকে ডেকে নিয়ে আসলে হানিয়া সকলকে ডিনার বেড়ে দেয়। বিয়ের পর থেকে নিয়মিত রান্না করার কারণে হানিয়ার রান্নার হাতটা বেশ ভালোই হয়েছে। শুরুতে শুরুতে তো চলে যাওয়া টাইপ ছিলো। খেতে খেতে রাহাত বলে–
–ভাবী ভীষণ ভালো রান্না করেছেন।
হানিয়া হালকা হেসে বলে–
–ধন্যবাদ ভাইয়া।
–কিরে জাভিয়ান তুই তো খেয়েই যাচ্ছিস,, তা কেমন হয়েছে রান্না তা তো বললি না?
জাভিয়ান খাওয়া থামিয়ে বলে–
–প্রতিদিনের মতোই মনে হচ্ছে,, স্পেশাল কিছু না। তুই হয়ত প্রথম ওর হাতের রান্না খেলি তাই তোর কাছে ভালো লাগছে। আমরা তো প্রতিদিনই খাই তাই আমাদের কাছে একি লাগছে।
কথাটা বলে আবার খাওয়া শুরু করে। এত মনযোগ দিয়ে খাচ্ছে যেন খাওয়া ছাড়া আর কোন ইমপোর্টেন্ট কাজ তার জীবনে নেই।
–তাও? তু……
হানিয়া রাহাতকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–থাক ভাইয়া,, কারো কাছ থেকে সেধে প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি খান,,খাওয়ার সময় এত কথা বলতে হয় না।
হানিয়ার কথা জাভিয়ানের চলতে থাকা মুখটা থেমে যায়। চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়। আজকে একের পর কাজে হানিয়া জাভিয়ানকে শুধু রাগিয়ে দিচ্ছে। আসছে পর থেকে ইগনোর করছে,,রাহাতের সাথে হাসি হাসি মুখে কথা বললেও তার সাথে কেমন গম্ভীর মুখ করে কথা বলছে এখন আবার পিঞ্চ মারলো। কয়েকদিন দূরে থেকে সাহস বেড়ে গেছে তার।
খাওয়া শেষে রাহাত আর থাকে না। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে সে তার বাসায় চলে যায়। যাওয়ার আগে হানিয়াকে বলে যায়–
–আজ বিন বুলায় মেহমান হয়ে দাওয়াত খেয়ে গেলাম কিন্তু আপনাকে কিন্তু তা করতো হবে না। আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বলে যাচ্ছি,, অবশ্যই কিন্তু সময় বের করে যাবেন একদিন।
হানিয়া বলে–
–ইনশা আল্লাহ যাবো ভাইয়া। আপনি আবার আসবেন কিন্তু।
–তা তো আসবই। আপনার হাতের এত সুস্বাদু খাবার প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য আমার তো মন চাচ্ছে এখানেই থেকে যেতে কিন্তু তা তো আর করতে পারবো না। আম্মু তাহলে ঝাঁটা দিয়ে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাবে বাসায়।
প্রথম কথাগুলো হাসিহাসি মুখে বললেও শেষের কথাটা বেশ মন খারাপের ভাব ধরে বলে রাহাত। তার এমন ভঙ্গিমা আর কথা শুনে হানিয়া,,রোজি বেগম হেঁসে দেয়। রাহাতের কাছে হানিয়ার হাসিটা ভালো লাগলেও জাভিয়ানের যেন শরীর জ্বলিয়ে দেয়। সে ভাবে–
–আমার সামনে আসলে মুখটা এমন করে রাখে যেন তাকে আমি হাসতে বারন করে রেখেছি। কিন্তু এখন একজন বাহিরের ছেলের সামনে কেমন দাঁত কেলাচ্ছে। দাঁড়া আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করব আমি।
কথা গুলো ভাবছে আর মনে মনে রেগে ফুঁসছে। রাহাত তাদের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। হানিয়া সদর দরজা বন্ধ করে কিচেনের দিকে হাঁটা দিলে শুনতে পায়,,জাভিয়ান বলছে–
–১০ মিনিটের মধ্যে যেন রুমে পাই,, নাহলে কপালে দুঃখ আছে।
হানিয়া তার কথা শুনে পেছন ফেরে দেখে জাভিয়ান সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। হানিয়া তার অগোচরে একটা ভেঙচি কেটে নিজের কাজে চলে যায়।
________________
হানিয়া আর কুলসুম রাতের খাবার একসাথেই করে নেয়। সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার পর হানিয়া এক জগ পানি কুলসুমের হাতে দিয়ে বলে–
–তোমার ভাইজানের রুমে রেখে এসো এটা। আর তাকে জিজ্ঞেস করে আসবে তার আর কিছু লাগবে কি না।যাও।
কুলসুম ভয় নিয়ে বলে–
–ভাবী বলির পাঠা আমারেই বানাইন্না লাগবো আপনের?? তহন ছোড গেলাস ছিলো তাই মাথাডা বাইচ্চা গেছে কিন্তু এহন তো মনে হয় তার কুনো চান্স নাই। ভাই এইবার জগটা আমার মাথাতে ফিক্কা মারবো।
হানিয়া তার এমন ভয় দেখে হেসে দেয়। তাকে হাসতে দেখে বলে–
–আমার ভয়ে আপনে হাসতে আছেন ভাবী?
হানিয়া তার হাসি থামিয়ে বলে–
–হাসবো না? তুমি এমন হাসির কথা বললে কে না হেঁসে পারবে বলো। উনি তোমাকে মারবে না যাও।
ভাবীর থেকে অভয় বানী পেয়ে কুলসুমের ভয়টা একটু কমে। সে পানির জগটা নিয়ে জাভিয়ানের রুমে যায়। রুমে ঢোকার পূর্বে নক করলে ভেতর থেকে উত্তর আসে–
–রুমে প্রবেশের জন্য পারমিশন লাগবে না তোমার ভেতরে আসো।
জাভিয়ানের কথাটা শুনে কুলসুম একটু টাস্কি খেয়ে যায়। সে রুমের ভেতর প্রবেশ করে পানির জগটা বেডসাইড টেবিলে রেখে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–
–ভাবী কইছে আর কিছু লাগবো নাকি আপনার ভাই?
জাভিয়ান এতক্ষণ সোফা বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো তাই কুলসুম যখন রুমে প্রবেশ করে তখন সে কুলসুমকেই হানিয়া ভেবে কথাগুলো বলে। কিন্তু কুলসুম যখন তাকে কথাটা জিজ্ঞেস করে তখন সে ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে কুলসুমকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সে কুলসুমকে জিজ্ঞেস করে–
–তোর ভাবী কই?
–ভাবী নিচে কাজ করে।আপনার আর কিছু লাগবো ভাই?
জাভিয়ান রেগে নাক ফুলিয়ে বলে–
–নাহ। তোর ভাবীকে আসতে বল যা।
কুলসুম জাভিয়ানের নির্দেশ মতো কথাটা হানিয়াকে বলে।কিন্তু হানিয়া সে কথা গায়েই লাগায় না। নিজের মতো সব গুছিয়ে রেখে কুলসুমকে ঘুমাতে পাঠিয়ে নিজেও উপরে চলে আসে। জাভিয়ানের রুম ক্রস করার সময় দেখে সে বুকে হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে সিঁড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। হানিয়া তাকে আবারও ইগনোর করে রোজি বেগমের রুমের দিলে যেতে লাগলে জাভিয়ান বলে–
–তোমার মনে হচ্ছে না আজ তুমি একটু বেশিই সাহস দেখি ফেলছ? সেদিনের মা//রের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
হানিয়া তার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য হাঁটা থামিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে যায়। সেদিনের মারের কথা হানিয়া ইহজনমে ভুলতে পারবে কি না সন্দেহ। মানুষ চোরকেও এমন করে মারে না যেমনটা জাভিয়ান হানিয়াকে মেরেছিল। সেদিনের কথা গুলো মনে পরলে আজও তার শরীর কেঁপে উঠে। হানিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় হাঁটা দেয়। জাভিয়ান তাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে–
–চুপচাপ রুমে আসো,,রাত অনেক হয়েছে সিনক্রিয়েট করো না।
হানিয়া জাভিয়ানের কথা শুনেও নিজের হাটা থামায় না। সে রোজি বেগমের রুমে ঢুকবে ঠিক এমন সময় তার হাতে টান পরে। পেছন ফিরে দেখে জাভিয়ান তার দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষণ চুপ করে সব কথা শুনলেও এখন আর হানিয়া চুপ থাকতে পারে না। সে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে—
–কি হয়েছে? থামালেন কেনো?
জাভিয়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে–
–রুমে যেতে বলছি কখন থেকে শুনছ না??
–রুমে তো যাচ্ছি দেখছেন না?
হানিয়ার ছোট্ট কথায় সহজ উত্তর।
–মাম্মার রুমে না। ওই রুমে চলো।
–কোন রুমে?
–আমাদের রুমে?
–আমাদের রুম? এটা আবার কোন রুমের কথা বলছেন?
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে হানিয়া। হানিয়ার এহেন অহেতুক প্রশ্নের জাভিয়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে বলে —
–আমাদের রুমে মানে বিয়ের পর তুমি আর আমি যেই রুমে ছিলাম ওইরুমে। এখন চুপচাপ চলো,,আর একটা কথাও না।
— ও মাহ্,,ওটা আবার আমার রুম হলো কবে? ওটা তো আপনার রুম। আপনিই সেদিন বললেন আর আপনিই ভুলে গেলেন।
জাভিয়ানের মনে পরে সেদিনের কথা যেদিন হানিয়াকে সে দ্বিতীয় বারের মত চরম ভাবে মেরেছিল। সে তারপরেও বলে–
–এটাও তো তোমার রুম না,,তাহলে এটায় থাকছে যে??
–এবাড়িতে আমার নিজের বলতে কিছু আছে?? যার জন্য এই বাড়িতে আসা সেইই তো আমার নাহ। তাহলে এই বাড়ি-ঘর আমার হবে কীভাবে?
হানিয়ার এই দুই লাইনের কথায় কিছু একটা ছিলো যেটা জাভিয়ানের বুক কাঁপিয়ে দিতে যথেষ্ট। জাভিয়ান তাকিয়ে থাকে হানিয়ার দিকে কিন্তু হানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মিনিট পর হানিয়াই বলে–
–যান গিয়ে ঘুমিয়ে পরেন। সকালে আপনার অফিস আছে।
কথাটা বলে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রুমের ভেতর চলে যেতে নিলে এবার জাভিয়ান করে বসে এক কান্ড। কোন কথাবার্তা ছাড়াই সে ঝট করে হানিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা দেয় নিজের রুমের উদ্দেশ্য। হানিয়া প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও পরে সে বিষয়টা বুঝতে পেরে বলতে থাকে–
–ছাড়ুন আমাকে। আমি যাবো না ওইরুমে। কি পেয়েছেন আপনি আমাকে? খেলনার পুতুল? ইচ্ছে হলো মারলাম,,ইচ্ছে হলো অপমান করলাম আবার ইচ্ছে হলেই বুকে নিয়ে নিলাম? ছাড়েন বলছি আমাকে।
জাভিয়ানের কোল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মোচড়ামচড়ি করছে আর কথা গুলো বলছে হানিয়া। জাভিয়ান তার কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো হেটে চলছে। হানিয়া তো এবার রেগে বো//ম। আসলে হানিয়া সহজে রাগে না কিন্তু যখন রাগে তখন এমন রেগে যায় যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঠিক যেমনটা এখন তার হয়েছে। সেদিন সোহা আর শায়লা বেগমের সামনে জাভিয়ানের ওই কথা গুলোয় হানিয়া ভীষণ কষ্ট পেয়েছে সেই সাথে অপমানিতও হয়েছে। সেদিন মা-বোনের সামনে তাঁকে মেরে-অপমান করার পর আজ তাদেরই অগোচরে তাকে এমনভাবে রুমে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হানিয়া দেখছে না। সে যদি যায় তাহলে তার অধিকার নিয়েই সকলের সামনে দিয়ে যাবে নাহলে যাবে না ওইরুমে আর।
হানিয়া নিজেকে না ছাড়াতে পেরে হুট করে জাভিয়ানের গালে নিজের দাঁত বসিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরে। শরীরের যতটা শক্তি,,রাগ-ক্ষোভ ছিলো সব নিয়ে কামড়ে দেয় জাভিয়ানকে। হুট করে হানিয়ার এমন এক কান্ডে জাভিয়ান হতভম্ব হয়ে হানিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। হানিয়া জাভিয়ানের বাহু থেকে মুক্তি পেয়ে দেয় একটা দৌড় রোজি বেগমের রুমের দিকে। জাভিয়ান নিজের গালে হাত দিয়ে দেখে রক্ত বের করে দিয়েছে হানিয়া তাকে। তারপর হানিয়ার এমন দৌড় দেখে সেও তার পেছন পেছন ছুট লাগায়।
হানিয়া প্রায়ই ধরে ফেলবে জাভিয়ান এমন সময়ে হানিয়া রোজি বেগমের রুমে ঢুকে ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। জাভিয়ান এবারও একটা ব্যথা পায় দরজা এমন করে লাগিয়ে দেওয়ায়। নাকটা তার দরজার সাথে লেগে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। অন্যদিকে হানিয়া দরজা লাগিয়ে হাহা করে হেসে দেয়। রুমের বাহির থেকে হানিয়ার হাসির আওয়াজ শুনে জাভিয়ান আরে জ্বলে উঠে। সে দরজায় ধুমধাম বারি মারতে মারতে বলে–
–হানিয়া আজ কিন্তু তুমি বেশি করে ফেলছ।এর পরিনতি কি হতে পারে তা তুমি একবারও ভেবে দেখেছ?
হানিয়া রুমের ভেতর থেকে বলে উঠে–
–কি আর হবে আপনি আমাকে মারবে। কিন্তু এবার আর মা।আপনি যদি আর একদিনও আমার গায়ে হাত তুলেছেন আমি সোজা বাবাকে গিয়ে বলব। তখন দেখব আপনার এতো জারিজুরি কই থাকে। মগের মুল্লুক পেয়েছেন আমায়? মন চাইলাম হাত সাফ করে গেলাম?
–এতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা গুলো আমার সামনে এসে বলো,,দেখি কেমন পারো?
–আপনার সামনে যাওয়ার ইচ্ছা বা রুচি আমার কোনটাই নেই। যান নিজের আলিশান রুমে গিয়ে সুন্দর করে ঘুমান। আমাকেও ঘুমাতে দেখ। রাত তো প্রায় অর্ধেক শেষ হতে চললো,,সকালে তো আবার আমায় আগে আগে উঠতে হবে আপনার জন্য রাজভোগ তৈরি করতে,, তাই না? একটু রেস্ট নিতে দেন দয়া করে।
কথাটা বলে হানিয়া দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে রোজি বেগমের পাশে গিয়ে শুয়ে পরে।ডিনারে গরুর কালা ভুনা ছিলো,,রোজি বেগমের হাই প্রেশার ডাক্তার তাকে গরু খেতে একদমই নিষেধ করার পরও আজ সে খেয়েছিলো।ফলাফল যা হওয়ার তাই,,প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো।তাই হানিয়া তাকে তার সব ঔষধের সাথে একটা ঘুমের ঔষধও খাইয়ে দিয়েছিল যার কারণে হানিয়া-জাভিয়ান এমন টম এন্ড জ্যারি খেলার আওয়াজেও রোজি বেগমের ঘুম ভাঙে না। শরীর ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণ পর হানিয়াও ঘুমিয়ে পরে। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা জাভিয়ান কিছুক্ষণ হানিয়ার জন্য অপেক্ষা করে। সময় বেশ কিছুক্ষণ চলে যাওয়ার পরও যখন রুমের ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ পায় না জাভিয়ান তখন বুঝতে পারে হানিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। তাই সেও নাক ফুলিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
__________________
চলে যায় আরো তিনটে দিন। এই তিনদিনে জাভিয়ান আরো কয়েকবার হানিয়াকে রুমে আনার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। মারের ভয়ও দেখিয়েছে কিন্তু হানিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনদিন পর আজ দুপুরের দিকে হানিয়ার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বাড়ি ফিরেছে। সারাদিন রেস্ট নিয়ে রাতে সকলে একসাথে ডিনারে বসে। ডিনার শেষ করে সকলে এসে ড্রয়িং রুমে বসে। আরসাল তালুকদার দেশের বাহিরে গেলে পরিবারের জন্য টুকটাক কোন গিফট আনবেনই,,এবারও তাই হয়েছে। সে নিজের আনা গিফট গুলো সকলকে একে একে দেন। সবশেষে দেন হানিয়াকে। হানিয়ার সামনে এসে প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে মি.তালুকদার বলেন–
–দেখতো মা তোর পছন্দ হয়েছে কিনা আমার গিফটটা?
–ধন্যবাদ আব্বু। আপনি যাই এনেছে নিশ্চয়ই ভালোবেসে এনেছেন আমার জন্য। আর ভালোবেসে আনা জিনিস গুলোতে বাছবিচার করতে হয় না।তাহলে যে সেই ভালোবাসার অপমান করা হয়।
উপস্থিত সবাই হানিয়ার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায়। ঠিকই তো,,ভালোবেসে কেউ কিছু দিলে সেটা সাদরে গ্রহন করা উচিত চাই সেটা পছন্দ হোক বা না হোক। মি.তালুকদার হানিয়ার কথায় বেশ খুশি হন। সে হানিয়ার মাথায় হাত রেখে বলে–
–মানুষ চিনতে এই আরসাল তালুকদার ভুল করে না।আমি বেছে বেছে একজন বেস্ট পার্টনার এনে দিয়েছি আমার ছেলের জন্য। সুখী হও মা।
হানিয়া তার কথার প্রতিউত্তরে একটা মিষ্টি হাসি দেয়। মি.তালুকদার হানিয়ার সামনে থেকে সরে সোফায় গিয়ে বসে,,তখন হানিয়া তাকে বলে–
–একটা আবদার ছিলো আমার বাবা। এটা কিন্তু আপনাকে রাখতেই হবে প্লিজ।
তার কথা শুনে সকলের কপালে একটা ভাজ পরে। জাভিয়ানও অবাক হয়ে যায়। দুই মাসের সংসারে হানিয়া কখনোই কোন কিছুর আবদার করেনি,,আজ করলো তাও আবার শ্বশুরের কাছে। হানিয়ার কথা শুনে শায়লা তালুকদার খেঁকিয়ে উঠে বলে–
–মাত্র বিদেশ থেকে আনা একটা উপহার দিলো তাও মনে ভরে নি তোমার? আবার কিসের আবদার?
শায়লা তালুকদারের এমন খোঁটা শুনে হানিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার চুপসানো মুখটাই বলে দিচ্ছে সেই কথা। জাভিয়ানের ভালো লাগে না হানিয়ার চুপসে যাওয়া মুখটা। আরসাল তালুকদারও হানিয়ার মন খারাপ হয়ে যাওয়াটা খেয়াল করেন। তাই সে শায়লা তালুকদারকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–দেখছ বাবা-মেয়ের মাঝে কথা হচ্ছে তুমি কথা বলছ কেন তাহলে? তোমার আবদারও পূরণ করা হবে একটু সবর করো বেগম।
তার কৌতুক পূর্ণ কথায় সকলে হেসে দেয়। মি.তালুকদার হানিয়াকে বলে —
–বল মা কি আবদার? বাবা সাধ্যমতো চেষ্টা করব তোর আবদার পূরণ করতে।
–বাবা আমার আসলে ফার্স্ট ইয়ারে রেজাল্ট দিয়েছে কিছু দিন আগে। এখন সেকেন্ড ইয়ারের ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে,, আপনি পারমিশন দিলে আমি আবার ভর্তি হতে চাচ্ছি।
জাভিয়ান এটা জেনে অবাক হয় হানিয়ার এক্সামের রেজাল্ট আউট হয়েছে আর সে তাকে জানায় নি।
–তোমার রেজাল্ট তো জানালে না বাবাকে?
হানিয়া চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলো–
–ফার্স্ট ক্লাস এসেছে বাবা,,ডিপার্টমেন্টে টপ করেছি আমি।
–মাশা আল্লাহ। তোমার রেজাল্ট শুনে মনটা খুশি হয়ে গেলো।
জাভিয়ান আর শায়লা বেগমও হানিয়ার রেজাল্ট শুনে খুশি হয় কিন্তু তারা তা প্রকাশ করে না। উল্টো শায়লা বেগম বলেন–
–বাচ্চাদের পড়ালেখা শেখানোর জন্য বিদ্যা তোমার অর্জন হয়ে গেছে আর পড়ালেখা করা লাগবে না। তুমি ভার্সিটিতে চলে গেলে সংসার করবে কে? আর তাছাড়া তোমাকে দিয়ে কি আমরা চাকরিবাকরি করাবো নাকি? কোন পড়ালেখা হবে না আর।
হানিয়া শায়লা বেগমকে বলে–
–প্লিজ মা এমনটা বলবেন না। সপ্তাহে চারদিন ক্লাস থাকবে আমার। প্লিজ আমার পড়ালেখাটা থামিয়ে দিবেন না।
শায়লা বেগম পুনরায় তাকে মানা করতে যাবে তখন আরসাল তালুকদার বলেন–
–আমার মেয়ে পড়ালেখা করবে,,বড় কিছু হবে। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। এর উপর দিয়ে আর কোন কথা যেন না শুনি আমি।
–কিন্তু……
–আমি যা বলার বলে দিয়েছি শায়লা। আর কোন কথা না। (জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে), তুমি আজকালের মধ্যে হানিয়ার সাথে গিয়ে ওপর ভর্তি কনফার্ম করে আসবে। এখন সবাই ঘুমাতে যাও। শুভ রাত্রি সকলকে।
কথাটা বলে আরসাল তালুকদার শায়লা বেগমকে ইশারা করেন রুমে যেতে। শায়লা বেগম গটগট করে রুমে চলে যায়। জাভিয়ান একবার আঁড়চোখে হানিয়াকে দেখে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দেয়। তার এক অজানা কারণে অভিমান হচ্ছে। সে মনে মনে আওরাচ্ছে–
–আমি এতটাই ভ্যালুউলেস ওর কাছে যে ওর রেজাল্টটা আমাকে জানালো না?
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_একুশ
রাত প্রায়ই দুটো। নিস্তব্ধ রাত,,হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস। শীতের রাত বলে জনজীবন অনেক আগেই ঢলে পরেছে নিদ্রাপরীর কোলে। সকলে ঘুমিয়ে পরলেও একজন ব্যক্তির চোখে ঘুম নেই। কেন নেই? তার যে বড্ড খালি খালি লাগছে। শান্তি পাচ্ছে না সে কোথাও,, তাই ঘুমও আসছে না।
পা চালিয়ে মানবটি ঘর থেকে বেলকনিতে আসল। ডিসেম্বরের রাত,,পাতলা একটা টি-শার্ট গায়ে জড়ানো মানবটির হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলছে বাতাস। বেলকনিতে দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলেও মনে চলতে থাকা উত্তাপ শীতল হয় না। কোন একজনকে দেখার জন এই উত্তাপ। মানবটি মনে মনে ভাবে–
–এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। কথা তো ছিলো তাকে চূড়া পর্যায়ে কষ্ট দিয়ে,,ভালোবাসায় একদম নিঃস্ব করে দিয়ে তারপর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো। তাহলে এই আজ এমন হচ্ছে কেন তাও আমার সাথে? তাকে একটু চোখের দেখা দেখার জন্য কেন মন এত অশান্ত? তাকে কষ্ট দেওয়ার বদলে নিজেই কেন শত কষ্টে জর্জরিত হচ্ছি?
নিজেকে নিজেই পর পর কতগুলো প্রশ্ন করে মানবটি। উত্তরও আসে ততক্ষণাৎ কিন্তু সে মানতে নারাজ। তার প্রতিশোধ সত্তা তাকে মানতে দিচ্ছে না সহজ,,সুন্দর উত্তরটিকে।
________________________
আজ হানিয়া একটু তাড়াতাড়িই উঠেছে ঘুম থেকে। ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দুপুরের লাঞ্চের জন্যও একটু এগিয়ে রেখে যাবে। রোজি বেগমের হাঁটুতে বেশ ভালোই ব্যথা তাই সে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে রান্না করতে পারবে না। আর কুলসুম সে তো বেশ ছোট,, সে রান্না পারলেও এত পদ এক সাথে করতে গেলে গুলিয়ে ফেলে। হানিয়ার বিয়ের আগে রান্নার জন্য আলাদা মানুষ থাকলেও তার বিয়ে হওয়ার তিনদিন পর শায়লা বেগম তাকে ছাড়িয়ে দেন। রান্না এবং যাবতীয় সব দায়িত্ব দিয়ে দেন সদ্য বিয়ে করে আসা অনভিজ্ঞ হানিয়ার উপর। প্রথম প্রথম সেও সব সামলে উঠতে পারত না কিন্তু এখন ভালোই পারে।
হানিয়া প্রতিদিন সকলকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে,,কারো কিছু লাগবে কিনা সেটার খেয়াল রাখে।কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। সকলকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিয়ে সে আবার চলে গেছে কিচেনে। দুপুরের জন্য রান্না প্রস্তুত করছে। কুলসুমও তার হাতে হাতে কাজ করছে।
তাকে অনুপস্থিত দেখে শায়লা বেগম ব্যতিত বাকি তিনজনের কপালে ভাজ পরে। আরসাল তালুকদার তাকে ডাক দিলে সে হাত মুছতে মুছতে এসে বলে–
–আব্বু কিছু লাগবে?
–না মা। তুমি আজ এখনও রান্নাঘরে কও করছো? ব্রেকফাস্ট তো করো না আমাদের সাথে এখন কি দাড়িয়েও থাকবে না একটু?
–আসলে বাবা কলেজের সব কাজ শেষ করে আসতে কয়টা না কয়টা বেজে যায় তাই দুপুরের রান্নাটা একটু এগিয়ে রাখছিলাম। রান্না এখনো অনেকটাই নাকি।
–সেটা আজ না হয় তোমার শ্বাশুড়ি করলো। তুমি এখন একটু চুপ হয়ে দাঁড়াও তো আমার পাশে। তুমি যখন পাশে দাঁড়িয়ে বেড়ে খাওয়ায় তখন মনে হয় আমার মা পাশে দাঁড়িয়ে খাওয়াচ্ছে।
আরসাল তালুকদারের কথায় হানিয়ার মনটা খুশিতে নেচে উঠে। লোকটা তাকে ভীষণ স্নেহ করে,,তার বাবার চেয়েও কিছুটা বেশি। এতক্ষণ তার কথা চুপ করে শুনছিলো জাভিয়ান,,শায়লা বেগম আর রোজি বেগম। রোজি বেগম আর জাভিয়ান নিরবতা অবলম্বন করলেও শায়লা বেগম তার স্বভাব অনুযায়ী খেঁকিয়ে উঠে।
–ওই তো শুরু হয়ে গেলো। ছেলের বউকে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে ভার্সিটিতে পাঠাও আর আমি বান্দি হয়ে খেতে মরি। পারব না কোন রান্না করতে আমি।
–আহ্,,শায়লা! এমন করে বলছ কেন? আমি তো কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না বলে কথাটা বললাম আর তুমি এমনে মানা করে দিলে? আচ্ছা কি আর করার….
আরসাল তালুকদার জানেন এই পাগলকে তেল না মারলে কথা শুনবে না,,বরং তিল থেকে তাল বানিয়ে দিবে তাই সে এই কথাগুলো বললো। শায়লা বেগম বলেন–
–সত্যি বলছেন? শুধু এই কারণে আমাকে রান্না করতে বলেছেন নাকি আমাকে খাটানোর জন্য?
–তুমি বিশ্বাস নাই করতে পারো আমাকে রোজকে জিজ্ঞেস করো না হয়।
কথাটা বলে আরসাল তালুকদার শায়লা বেগমের অগোচরে রোজি বেগমকে চোখ টিপ দিয়ে বুঝান তার কথায় সায় দিতে। রোজি বেগমও তাই করেন। ননদের কথায় বিশ্বাস করে শায়লা বেগম বলেন–
–ঠিক আছে। কিন্তু আমি প্রতিদিন রান্না করতে পারব না। শুধু আজকেই করবো।
–আচ্ছা রানীসাহেবা।
সকলে হাসাহাসির মধ্যেই ব্রেকফাস্ট শেষ করে।সকলে টুকটাক কথা বললেপ জাভিয়ান আজ একদম চুপ। ব্রেকফাস্ট শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠার সময় জাভিয়ানকে বলে–
–হানিয়ার সাথে তুমি যাও আমি অফিস সামলে নিবো।
জাভিয়ানও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
_________
হানিয়া কোন মতো নাকে মুখে খেয়ে দৌড়ে রেডি হয়ে বের হয় বাসা থেকে। জাভিয়ান বাসার সামনে গাড়িতে হেলান দিয়ে ফোন চালাচ্ছিলো তাকে না দেখেই রিকশার খোজ করতে থাকে।
–এই মামা যাবেন?
হানিয়ার আওয়াজে জাভিয়ান ফোন থেকে মুখ তুলে তাকায়। হানিয়া তখন এক রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া দামাদামি করছে। জাভিয়ান ভাবে–
–আমি এখানে তার জন্য অপেক্ষা করছি আমাকে ইগনোর করে রিকশা খুজছে। সাহসের পারদ দিনকে দিন বেড়ই চলছে।
সে হেটে হানিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে–
— কাহিনী বাদ দিয়ে চুপচাপ গাড়িতে বসো, শুনলে ম্না তোমার শ্বশুর কি বললো তখন? তাও তার কথা অমান্য করে রিকশায় যাচ্ছো?
হানিয়া ভেবেছিলো জাভিয়ান হয়ত তার সাথে যেতে পারবে না এই কথাটা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে তাই সে আগেভাগেই রিকশার খোজ করছিলো। এখন দেখে হিটলারের রাজা তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। সে রিকশাওয়ালে বিদায় করে গাড়িতে গিয়ে বসে।
_____________
হানিয়াদের ফিরতে ফিরতে প্রায়ই তিনটা বেজে যায়। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে,,মাথা ধরেছে। ফজরের আগে উঠেছে সে,,পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে মাথাটা ব্যথায় টাসটাস করছে। সে তাড়াতাড়ি করে গোসল করে বের হয়,,জাভিয়ানও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে গেছে। জাভিয়ানকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকে। জাভিয়ান তাকে বলে–
–আমার হাত আছে নিয়ে খেতে পারব। তুমি বসে খেতে পার।
হানিয়া কোন কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জাভিয়ান বুঝতে পারে এই মেয়ে চরম লেভেলের ঘাড়ত্যাড়া। তাই সে আর কথা না বলে চুপ করে খেয়ে উঠে যায়। তার যাওয়ার পর হানিয়াও খেয়ে রোজি বেগমের রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। একটু না ঘুমালে সে মাথা ব্যথায় পাগলই হয়ে যাবে।
_______________
রাতে সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। শীতকাল হওয়ায় সবাই আগেভাগেই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। মি.তালুকদার শুয়ে পরার পর হানিয়া রোজি বেগমের রুমে ঢুকে। তার রুমে আসার সময় আজও জাভিয়ানকে রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। তাতে তার কি? যেদিন জাভিয়ান নিজে বলবে,, ওইরুম হানিয়ারও এবং তারও অধিকার আছে সেদিনই যাবে হানিয়া ওইরুমে তার আগে না।
হানিয়া মুখ হাত ধুয়ে রোজি বেগমের পাশে শুয়ে পরে। দুপুরে ঘুমানোর কারণে আজ তার ঘুম আসছে না। সে শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবছে। হুট করে হানিয়ার ইচ্ছে হয় স্পর্শকে দেখার। সেদিন রোজি বেগমের থেকে তার কথা শুনলেও তার ছবি দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ করে তার মনে পরলো স্পর্শকে দেখার। সে রোজি বেগমের দিকে তাকিয়ে দেখে,, রোজি বেগম চোখ বন্ধ কিন্তু ঠোঁট চলছে। সে বিড়বিড়িয়ে কিছু পড়ছে। তাকে সজাগ দেখে হানিয়া তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে থাকে–
–মনি মা! তুমি কি জেগে আছো?
রোজি বেগম চোখ খুলে বলে–
–হুম।তুই ঘুমাস নি? প্রতিদিন তো শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরিস।
–আজ দুপুরে একটু ঘুমালাম না তাই ঘুম আসছে না। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি??
–কর।
–স্পর্শ আপুকে যে ধোকা দিয়েছিলো তার বিরুদ্ধে তোমরা কোন ব্যবস্থা নাও নি??
–আসলে তাকে আমরা কেউই দেখি নি তাই চিনতামও না। শুধু একজন চিনত ছেলেটিকে,,স্পর্শর বেস্টফ্রেন্ড আরিফা,,কিন্তু আমরা তার কাছে পৌছানোর আগেই সে বিয়ে করে বরের সাথে বাহিরের সেটেল্ড হয়ে গিয়েছিলো। জাভিয়ান তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য বেশ দৌড়া ঝাঁপ করেছিলো,, একসময় তার কি জানি হলো সব দৌড়া ঝাঁপ থামিয়ে দিলো। তারপর আর কি? সেই বেইমান নিজের মতো বাঁচতে লাগলো আর আমরা।
–আরেকটা কথা শুনো।
–কি শুনবো? বল।
–আমি স্পর্শ আপু দেখবো। প্লিজ দেখাও না।
–এখনি??
–হুম,,এখনি। প্লিজ,,প্লিজ দেখাও।
রোজি বেগম শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর বেডের পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলটা থেকে ফটো এলবাম বের করে হানিয়াকে বলে–
–যা লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে আয়।
হানিয়া উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে রোজি বেগমের পাশে বসে। রোজি বেগম এক এক করে তাদের পুরো পরিবারের ছবি দেখাতে থাকেন। জাভিয়ানের ছোটবেলার ছবি দেখে হানিয়ার হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। ছোট বেলায় জাভিয়ান বেশ নাদুসনুদুস থাকায় তাকে বসিয়ে রাখা হলে মনে হতো একটা ছোট খাটো আলুর বস্তা বসিয়ে রাখা হয়েছে। হানিয়া তার ফোনে জাভিয়ানের ছোটবেলার কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।
এক এক করে প্রায় সব ছবিই দেখে হানিয়া। হুট করে একটা ছবিতে তার চোখ আটকে যায়। হানিয়া ছবিটি রোজি বেগমকে দেখিয়ে বলে–
–মনি মা ইনি কে??
রোজি বেগম দেখে ছবিটি তার স্বামী আদিব মাহমুদের। বিয়ের কিছুকাল আগের ছবি। সে হানিয়াকে বলে–
–এটা আদিব। তোর আঙ্কেল। কেন কি হয়েছে? এই ছবি দেখে এমন চমকে গেলি কেন?
–উনাকে না আমার কেমন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় জানি দেখেছি।
রোজি বেগম মলিন হেসে বলেন–
–২৮/২৯ বছর আগে মারা যাওয়া মানুষকে তুই কই পাবি পাগলী? হয়তো তোর মনের ভুল।
–কিন্তু….
–শুন,,পৃথিবীতে একি চেহারার সাতজন মানুষ হয়,,তুই হয়ত তেমনই একজনের সাথে তাকে গুলিয়ে ফেলছিস। যাই হোক ঘুমা এখন। রাত অনেক হয়েছে।
–তুমি ঘুমাও। আমি আরেকটু দেখবো ছবি গুলো।
–নে দেখ।
হানিয়া এলবামটা নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। এক এক করে আবার সবগুলো ছবি দেখে সে। কয়েকটা ছবি নিজের ফোনেও তুলে নেয়। ছবি দেখা শেষ করে রুমে আসবে তখন তার চোখ যায় বাসার নিচে। সে দেখতে পায় জাভিয়ান এতো রাতে কোথায় জানি যাচ্ছে। হানিয়া বেশ অবাক হয় তাকে এতো রাতে বাহিরে যেতে। সে ফোনের পাওয়ার অন বাটান’টা চেপে সময় দেখে নেয়। রাত বারোটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। এতো রাতে কই গেলে সে?? তাও গাড়ি ছাড়া।
_________________________
জাভিয়ান ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। ভাবটা অনেকটা চোরের মতো। দরজা লাগিয়ে চুপিচুপি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে তখন একটা কন্ঠ শুনে তার পিলে চমকে উঠে–
–কোথায় গিয়েছিলেন এতো রাতে আপনি?
~চলবে??