প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-২২+২৩

0
369

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_বাইশ

জাভিয়ান এই মুহূর্তে হানিয়াকে বা কাউকেই কল্পনা করেনি। সে বেশ ঘাবড়িয়ে গেছে। হানিয়া আবার জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–

–কোথায় গিয়েছিলেন এত রাতে?

জাভিয়ান কি বলবে ভেবে পায় না। সে কয়েক মিনিট সময় নেয়,,তারপর আমতা আমতা করে বলে–

–আমার ঘুম আসছিলো না তাই বাসার আশেপাশে একটু হাটতে বের হয়েছিলাম।

হানিয়া জাভিয়ানের কথা যে বিশ্বাস করেনি তা জাভিয়ান ভালোই বুঝতে পেরেছে। বাহির থেকে আসা হালকা আলোতে ড্রয়িংরুমটা অল্পস্বল্প আলোকিত হয়ে আছে সেই আলোতেই জাভিয়ান হানিয়ার মুখাবয়ব দেখতে পারছে। হানিয়া ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে–

–সত্য কথা বলবেন না সোজাসাপ্টা বলে দিলেই হয়,,মিথ্যা কথা যে বলতে পারেন না তা আপনার মুখ আর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে। যাই হোক ঘুমিয়ে পরুন। শুভ রাত্রি।

কথাটা বলেই হানিয়া জাভিয়ানের পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। কয়েক সিড়ি উঠার পর হানিয়ার হাতে টান পরে। পেছন ঘুরে দেখে জাভিয়ান কেমন করুন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হানিয়া নিজের হাত জাভিয়ানের থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করে–

–কি হয়েছে? হাত ধরে রেখেছেন কেন? যেতে দিন আমায়।

জাভিয়ান হানিয়ার হাত তো ছাড়েই না বরং আরো শক্ত করে ধরে কয়েক কদম এগিয়ে যায় হানিয়ার দিকে। হানিয়া তাকে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ অবাকই হয় কিন্তু প্রকাশ করে না,,শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জাভিয়ান কণ্ঠে কিছুটা অসহায়ত্ব নিয়ে হানিয়াকে বলে–

–রুমে চলো না। আর কতদিন মাম্মার রুমে থাকবে?

হানিয়া শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়–

–যতদিন না ওইরুমে আমারও অধিকার হচ্ছে ততদিন। আর বারবার রুমে চলো রুমে চলো দিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি? এমনটা তো না যে রুমে গেলেই আপনি আমায় আদর করবেন,,সেই তো সোফা আর বেড-ই হবে আমাদের অবস্থান। তাহলে আর পাঁচটা বিবাহিত পুরুষদের মতো করছেন কেন??

জাভিয়ান হানিয়া কথায় ভেবে দেখে সত্যিই তো। সে অন্য সব সাধারণ পুরুষদের মতো করছে কেন? অন্যরা তো নিজেদের বউকে রুমে ডাকে ভালোবাসতে,,আদর করতে। সে তো হানিয়াকে এগুলোর কিছুই করবে না তাহলে কেন এমন করছে?? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে কিন্তু কোন উত্তর মিলে না।

জাভিয়ানকে অন্যমনষ্ক হয়ে চুপ থাকতে দেখে হানিয়া নিজের হাতটা আস্তে করে জাভিয়ানের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে–

–যেদিন অধিকার দিতে পারবেন সেদিন বলবেন আমি বিনা বাক্যে চলে যাবো কিন্তু হ্যাঁ,,যাদের সামনে অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন তাদের সামনেই অধিকার দিতে হবে।

কথাটা বলে রোজি বেগমের রুমে চলে যায়। জাভিয়ান তার কথা শুনে বুঝতে পারে হানিয়া কাদেরকে বুঝিয়েছে।

__________________________

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো এক সপ্তাহ। আর তিনদিন পর থেকে হানিয়ার ক্লাস শুরু হবে। আরসাল তালুকদার বলেছেন হানিয়াকে যাতায়াতের জন্য নিজেদের কার ব্যবহার করতে। হানিয়া মানা করতে চাইলেও শ্বশুর যখন কড়া গলায় বলেছে তাকে এটাই করতে হবে তখন আর সে তার কথা অমান্য করতে পারে না।

আজ অনেকদিন পর হানিয়াকে তার এক ভার্সিটির ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে। সে বাগানে হেঁটে হেঁটে তার সাথে কথা বলছে আর হাসছে। জাভিয়ান আজ দুপুরেই চলে এসেছে। হাতের প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে যাওয়ায় আপাতত তেমন প্রেশার নেই অফিসে তাই তাড়াতাড়ি চলে আসা। জাভিয়ান তার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হানিয়াকে দেখছে কিন্তু হানিয়া নিজের মতো ব্যস্ত।

হানিয়া কথা বলতে বলতে একসময় হেঁটে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে থাকে। জাভিয়ান তাকে ওইদিকে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে দৌড় লাগায় ওইদিকে। হানিয়া কথা বলায় এতটা মশগুল ছিলো যে তার খেয়ালই ছিলো না সে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে যাচ্ছে। তাই যখন কথা শেষ করে ফোন কাটে তখন আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে না সে কোথায় এসে পরেছে। জাভিয়ানদের বাড়ির পেছনের অংশে কিছুটা জঙ্গলের মতো,, মানে ঝোপঝাড় বেশি। হানিয়া আগে কখনোই এদিকটায় আসেনি বলে তার বেশ আগ্রহ হয় জায়গাটা ঘুড়ে দেখার। সে হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু ভেতরের দিকে গেলে একটা ছোট্ট ঘর দেখতে পায়। ঘরটা দেখে সে অনেকটা অবাক হয়। এতদিন এই বাড়িতে আছে কেউ তো তাকে এই ঘর সম্পর্কে বলেনি। হানিয়া ঘরটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই জাভিয়ান পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠে।

হানিয়া পেছন ফিরে দেখে জাভিয়ান হাঁটুতে দু’হাত রেখে ঝুঁকে আছে আর হাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে। জাভিয়ান হানিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে বলে–

–এখানে কি করছো? চলো বাড়ি চলো।

–আসলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম আর এসে এই রুমটাকে দেখতে পেলাম।এটা কিসের ঘর? আমাকে তো মনি কখনো এই রুমের কথা বলেনি।

–এটা আমার পারসোনাল রুম। হয়েছে? এখন চলো।

কথাটা বলে হানিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। হানিয়া তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বলে–

–এই রুমে আপনি কি করেন?

–সেটা তোমার না জানলেও চলবে।চুপচাপ চলো।

বেশ কর্কশ গলায় কথাটা বলে জাভিয়ান। হানিয়ার ভীষণ খারাপ লাগে। সে ঝট করে নিজের হাতটা জাভিয়ানের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে–

–আমি কোন গরু না যে এমনে টেনে টেনে নিয়ে যাবেন। আমি নিজেই যেতে পারব।

কথাটা বলে সেই আগে হাটা দেয়। জাভিয়ান হাবলার মতো করে দাড়িয়ে থাকে।

_________________________
রাতে হুট করেই সোহা আর তার মা আসে তালুকদার বাড়িতে। সোহার বাবা একটা কাজে ঢাকার বাহিরে গেছেন তাই তারা মা-মেয়ে চলো এসেছে এই বাড়িতে। এসেই হানিয়াকে একের পর এক আদেশ-ফরমাশ করেই চলেছেন। হানিয়াও মুখ বুঁজে সব সহ্য করছে। তার মা সবসময় একটা কথাই বলতেন-“যেই সয়,, সেই কিন্তু রয়” এই কথাটা হানিয়া আগে মানতে চাইত না কিন্তু এখন তাকে এটাই করতে হচ্ছে।

রাতে ডিনারে কম করে হলেও ৬/৭ পদ রান্না করেছে হানিয়া তাও শায়লা বেগম মুখ কালো করে রেখেছেন। হানিয়া আজ ভীষণ আশা করেছিলো তার শ্বাশুড়ি হয়ত আজ একটু হলেও তার উপর প্রসন্ন হবেন কিন্তু তা হয়ত তার কপালে নেই। খেতে বসে সোহা শুরু করে আরেক ঢং। সে এত অয়েলি খাবার নাকি খাবে না,,সে ডায়েটিং-এ আছে। তাকে হালকা কিছু বানিয়ে দিতে হবে। কথাটা শুনে শায়লা বেগম হানিয়াকে আদেশের সুরে বলে–

–যাও সোহার জন্য হালকা পাতলা কিছু বানিয়ে দাও।

কথাটা শুনে হানিয়ার কান্না চলে আসে। সেই সন্ধ্যার পর থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত রান্না করে এতগুলো আইটেম করেছে এখন নাকি আবার রান্না করা লাগবে। ক্লান্তিতে হাত-পা ভেঙে আসছে। হানিয়া কোন কিছু না বলেই চুপ করে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিল তখন জাভিয়ানের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।

–দাঁড়াও হানি।

হানিয়া জাভিয়ানের কথা শুনে দাড়িয়ে পরে। তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এ আবার কি আদেশ দেয় এখন? কিন্তু তার ভাবনাকে মিথ্যা করে দিয়ে জাভিয়ান বলে–

–মম ও(হানিয়া) সন্ধ্যা থেকে এতগুলো আইটেম রান্না করছে,,তোমরা নিচেই বসে গল্প করছিলে তখন সোহা কেন বলল না সে ডায়েটিংয়ে আছে? তাহলে তখনই না হয় ওর জন্য কিছু রান্না করত হানি। আর সোহা! (সোহার দিকে ফিরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে) আজ না হয় একটু কষ্ট করে এই অয়েলি খাবারটা খাও তাতে আমার মনে হয় না তোমার ডায়েটিংয়ে এতটা প্রভাব ফেলবে বনু। কাল না হয় নিজের বাসায় গিয়ে আবার হালকা পাতলা খাবার খেলে। তোমার ভাবী কত কষ্ট করে তোমাদের জন্য এতকিছু রান্না করল এখন যদি তুমিই না খাও তাহলে তার কষ্টটাই বৃথা।

বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়ে কথাগুলো বলে জাভিয়ান সোহাকে। ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায় জাভিয়ানের কথা শুনে শুধুমাত্র আরসাল তালুকদার ছাড়া। তিনি ভাবেন ছেলে তার বউকে ভালোবাসে বলে তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তিনি তো আর জানেন না তার ছেলে কত বড় একটা পশু!

শায়লা বেগম,, সোহা আর তার মা এটা দেখে অবাক হয়ে যায় যে জাভিয়ান হানিয়ার পক্ষ নিয়ে কথা বলছে,,তার উপর হানিয়াকে সোহার ভাবী মানে ইনডাইরেক্টলি নিজের বউ বলে স্বীকার করছে। তাদের তিনজনের মতো আরো তিনজন অবাক হয়ে যায় জাভিয়ানের কথা শুনে। তারা হলো রোজি বেগম,,হানিয়া আর কুলসুম। তারা কেন অবাক হয়েছে এটা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন।

সোহার মা শায়লা বেগমকে বলেন–

–বাহ আপা! ছেলে তো তোমার ভালোই বেশ হয়ে গেছে। বউয়ের কষ্ট একদম সহ্যই হয় না তার।

হাসতে হাসতে কথাটা বলে মহিলা। তার কথায় বাম হাত দিয়ে আরসাল তালুকদার বলেন–

–দেখতে হবে না ছেলেটা কার। আমার ছেলে তো আমার মতোই হবে,,তাই না বলো শালিকা?

আরসাল তালুকদার যে কি মিন করে কথাটা বলেছে তা উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারে। সোহা আর তার মার মুখটা কালো হয়ে যায় আর শায়লা বেগম তার স্বামীকে চোখ গরম করে তাকায়। হানিয়া,, কুলসুম,,রোজি বেগম আর জাভিয়ান তার কথা শুনে হালকা হেঁসে দেয়। জাভিয়ান সচারাচর হাসে না,,হাসলেও জোরাতালির হাসি বা হালকা মুচকি হাসে তাতেই তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। এই যেমন এখন লাগছে। হানিয়া একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

টুকটাক কথাবার্তার মাঝেই তারা সকলে খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষে আরসাল তালুকদার,, জাভিয়ান আর রোজি বেগম নিজেদের রুমে চলে যায়। নিচে থেকে যায় সোহা,,তার মা আর শায়লা বেগম। হানিয়া আর কুলসুম ডাইনিং টেবিলে পরিষ্কার করছে। তারা তিন ডাইনী কি জানি কথা বলছে আর উচ্চস্বরে হাসছে। হঠাৎই তাদের কথার টপিক চেঞ্জ হয়ে হানিয়ার টপিক শুরু হয়।

সোহা বলে–

–জানো আম্মু আগের বার যে আসলাম না তখন কিন্তু একটা মজার ঘটনা ঘটেছে?

–কি হয়েছিলো?

তারা সকলেই আগেরবারের কথা জানে তাও হানিয়াকে অপমান করার জন্য কথাগুলো আবার তুলেছে। সোহা বলে–

–একটা পাখি খুব বেশি উড়ছিলো তারপর এমন ভাবে মুখ থুবড়ে পরল যে এখন আর উড়ার কি ডানাও ঝাপ্টাচ্ছে না।

কথাটা বলে তিনজন হাহা করে হেসে দেয়। সোহার মা বলে–

–পাখিটা কে রে? আমাকেও একটু দেখার সুযোগ করে দে।

–দেখবে। তাহলে ওই যে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাও তাহলেই দেখতে পাবে। দু’টো ফকিন্নি দাড়িয়ে আছে না তার মধ্যে থেকে বড়টা।

হানিয়া আর কুলসুমকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে সোহা। কুলসুমকে সোহা আর তার মা বাদে এই বাড়ির সকলেই ভালো ব্যবহার করে। নিজেদের পরিবারের লোক মনে করে। কিন্তু হানিয়া বিয়ে করে এবাড়িতে আসার পর কুলসুম সবসময় তার সাথে থাকা বা তার কথা,,কাজে সাপোর্ট করায় এখন শায়লা বেগমও তাকে হেয় করে। আজ যেমন সোহা কুলসুমকে ফকিন্নি বলল,, আগে হলে হয়ত শায়লা বেগম তাকে এমনটা বলতে নিষেধ করত কিন্তু আজ করছেন না।বরং সেও তাদের সাথে মজা নিচ্ছে।

অন্যদিকে তাদের সব কথাই হানিয়া আর কুলসুম শুনছে দাঁতে দাঁত চেপে। কিন্তু এখন আর কুলসুম সহ্য করতে পারে না। সে তার কাজ থামিয়ে সোহাদের কাছে এসে বলে–

–আমারে যা কইছে আমি মাইন্না নিমু কিন্তু ভাবীরে কিছু কইবেন না।

সোহা তাকে ব্যঙ্গ করে বলে–

–এক ফকিন্নির জন্য আরেক ফকিন্নির কি মায়া দেখেছ আম্মু-আন্টি??

“মানুষের জন্য মানুষের মায়া না হয়ে তাহলে কি তোর মতো গবেটের জন্য হবে? তুই কি এটাই চাচ্ছিস?”

হঠাৎই জাভিয়ানের কথায় সকলে ভড়কে যায়। কথার উৎসস্থল কোথায় দেখতে সকলে ঘাড় ঘুড়ালে দেখতে পায় জাভিয়ান সিঁড়ির মাঝামাঝিতে ট্রাউজারের পকেটে দু’হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবসময়ের চেয়ে এখন মুখটা একটু বেশিই গম্ভীর,, চোখে খানিকটা রাগের আভাস। তাকে দেখে সোহার পিলে চমকে উঠে। সে তাড়াতাড়ি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে যেতে চাইলে জাভিয়ান তাকে বলে–

–ওখানেই দাঁড়া।

সোহা দাঁড়িয়ে যায়। জাভিয়ান নিজেই নিচে নেমে আসে। তারপর সোহাদের সামনে এসে দাঁড়ায়,,তাদের উদ্দেশ্য করে বলে–

–পাখির ডানা যেমন ছাটাতে পারি তেমন তাকে আবার উড়তে শিখাতেও পারি আমি। তোদের সামনে যদি মারতে পারি তাহলে তোরা যখন থাকিস না তখন আবার ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়েও দিতে যে পারি এটা কেন মনে থাকে না তোদের? পাখিটা আমার!! তাই তাকে আমি আমার ইচ্ছে মতো উড়াবো,, ঘুড়াবো,, মারবো আবার আমিই বুকে আগলে নিবো। মনে রাখবি এই সব কিন্তু আমিই করব,,আমি ব্যতীত আমার পাখিকে অন্যকেউ কষ্ট দেওয়া চেষ্টা করলে তাঁর ডানা কাটতেও বেশি সময় নিবো না। কথাটা আজই প্রথম আর আজই শেষবারের মতো বলছি,,আর যেন বলা না লাগে। আর মিসেস জাভিয়ান তালুকদারকে ফকিন্নি বলছিস?? তোর মনে হচ্ছে না তুই সাহসটা একটু বেশিই দেখিয়ে ফেলেছিস?? ভবিষ্যতে যদি এমন সাহস দ্বিতীয় বার দেখেছি তাহলে এর পরিনতি বেশি একটা ভালো হবে না,, এটা তোকে সহ এখানে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্য বলছি।

জাভিয়ানের কথায় কিছু একটা ছিলো যা সোহার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। জাভিয়ান তাদের থেকে চোখ সরিয়ে হানিয়ার দিকে তাকায়। মেয়েটা ডাইনিং টেবিলের কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোন বাক্য ব্যয় না করে হানিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে তার দিকে,, তারপর বলে–

–রুমে চলো,, কাজ আছে।

হানিয়া নিজের সামনে জাভিয়ানের উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে। জাভিয়ান তার দিকে তাকিয়ে থাকায় তাদের চোখে চোখ পরে যায়। জাভিয়ান হানিয়ার চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখে চোখটা পানিতে টইটম্বুর,, যেকোন মুহূর্তে গড়িয়ে পরতে পারে।কিন্তু হানিয়া তা মুক্ত করে না,,চোখেই ধরে রাখে। সে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–

–কিছু লাগবে আপনার?

–হুম।

–কি লাগবে বলে,,আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

–তোমাকে লাগবে আমার,,এখনি। চলো।

কথাটা বলে নিজেই আগে হাটা দেয়। তার কথা শুনে সোহা,, তার মা আর শায়লা বেগমের চোখ বড়বড় হয়ে যায়। জাভিয়ান কয়েক কদম হেটে এগিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারে হানিয়া তার সাথে আসছে না,,তাই পেছন ফিরলে দেখতে হানিয়া তার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাভিয়ান ভীষণ বিরক্ত বোধ করে তার কাজে,,সে পুনরায় হানিয়ার কাছে এসে কোন দিক না তাকিয়েই ঝট করে কোলে তুলে নেয়। এবার যেন সোহাদের চোখ বেড়িয়ে আসবে কোটর থেকে,,হানিয়াও অবাক হয়ে চোখ বড়বড় করে তাকায়। কিন্তু জাভিয়ান নির্লিপ্ত ভাবে হাঁটছে যেন কিছুই হয়নি।

জাভিয়ান হানিয়াকে নিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি অতিক্রম করে আবার কি ভেবে নিচে নেমে আসে। তারপর সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে–

–তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস তাই একটা কথা বলছি আশা করি মাথায় রাখবি। আমরা নিউলি ম্যারিড কাপল যখন-তখন,,সময় অসময়ে আমাদের রুমে আসবি না,, বুঝিসই তো!

শেষেট কথাটা জাভিয়ান সোহাকে চোখ টিপে দিয়ে বলে। হানিয়া লজ্জায় কথা বলা ভুলে যায়। সে ভেবে পাচ্ছে না জাভিয়ান এমন করছে কেন আজ? জাভিয়ান তার কথা শেষ করে আবার হাটা দিলে কুলসুম বলে উঠে–

–ভাইজান ভাবী তো রাইত্তের খাওন খায় নাই।

জাভিয়াম কুলসুমকে বলে–

–ওর খাবারটা রুমে নিয়ে আয়। আর বাকি কাজগুলো তুই একটু কষ্ট করে শেষ কর। তোর ভাবীকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

কুলসুম হাসি মুখে বলে–

–আচ্ছা আমও ভাবীর খাওন নিয়া আইতাছি। আর আপনি চিন্তা কইরেন না ভাইজান,,আমি বাকি কামগুলা একলাই করবার পারুম। ভাবী আইজকে নিজেই সব করছে করছে একলা একলা,,আমারেও করতে দেয় নাই।

কুলসুম তার কথা শেষ করলে জাভিয়ানও তার পা চালাতে শুরু করে। হানিয়াকে নিয়ে তার রুমে চলে আসে। রুমে ঢোকার সময় জাভিয়ান হানিয়াকে বলে,–

–যা বলেছিলে তাই করলাম,,অধিকার আর স্বীকৃতি দু’টোই দিলাম এর পর থেকে আমি যেন না দেখি তুমি এই রুম ছাড়া একদিনও রাত কাটিয়েছ। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

হানিয়া মুখ ফসকে বলেই দেয়–

–আপনার চেয়ে খারাপ কেউ আছে নাকি? আমার তো লাগে না।

কথাটা বলেই হানিয়া নিজের মুখ চেপে ধরে। এমন টাটকা সত্য কথা কেমনে বলে দিলো সে। হানিয়া ভাবে এখন তার উপর আবার মারের বর্ষণ শুরু হবে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল করে দিয়ে জাভিয়ান বলে–

–কেউ জন্মগতভাবে খারাপ হয় না। তাকে কেউ না কেউ খারাপ হতে বাধ্য করে,,আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন আমি চাইলেও তোমার জন্য ভালো হতে পারছি না,,তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি এক আলাদা শান্তি পাই যে শান্তি আমি চিরকাল পেতে চাই।

কথাটা বলে জাভিয়ান হানিয়াকে বেডে বসিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। আর হানিয়া বসে বসে ভাবতে থাকে–

–আমি কি সারাজীবন শুধু অন্যকেই সুখ-শান্তি দিয়ে যাবো?? নিজে কি কখনো সুখের মুখ কি আদৌও দেখবো??

শব্দসংখ্যা~২২১২

~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_তেইশ

আজ হানিয়ার সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাস হবে। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী রান্নাবান্না সব করে ফেলে সকালেই,,সকলকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে নিজেও করে নেয়। তারপর রেডি হয়ে নিচে নেমে আসে। বাসা থেকে বের হয়ে বাহিরে আসলে দেখতে পায় জাভিয়ান গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে দরজা খুলে,,এক পা গাড়িতে থাকলেও আরেক পা বাহিরে বের করে আয়েশ করে ফোন টিপছে। হানিয়ার কপালে কয়েকটা ভাজ পরে। লোকটা অফিসে না গিয়ে এখনো বাসায় কি করছে? হয়ত কোন কাজ আছে। হানিয়া আর কিছু না ভেবে হেঁটে তাকে ক্রস করতে সামনে এগিয়ে যায় তখনই শুনতে পায়–

–তুমি যে ইন্টারনয়াশনাল লেভেলের কানা সেটা কি তুমি জানো?

সকাল সকাল এমন অবজ্ঞা পূর্ণ কথায় কার না মেজাজ খারাপ হয়? হানিয়া রেগেমেগে বলে–

–সমস্যা কি আপনার? সকাল বেলা সকালে খারাপ ব্যবহার না করলে চলত না? কি করেছি যার কারণে আমাকে কানা বললেন??

জাভিয়ান ফোন থেকে চোখ তুলে হানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে–

–দেখতে পারছ একজন জলজ্যান্ত মানুষ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তুমি তাকে না দেখেই চলে যাচ্ছ। তাহলে তোমাকে কানা বলব না তো কি বলব একটু বলো?

–কে কার জন্য অপেক্ষা করছে?

হানিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে। জাভিয়ান গাড়িতে ঠিকঠাক হয়ে বসে বলে–

–মিসেস তালুকদারের জন্য মি. তালুকদার অপেক্ষা করছিলো। এখন মিসেস তালুকদার মুখটা কম চালিয়ে গাড়িতে উঠে আসুন। যদি ভেবে থাকেন সেদিনের মতো কোলে তুলে গাড়িতে বসাবো তাহলে আপনি একদমই ভুল। বাবা রে,,সেদিন কয়েক মিনিটের জন্য কোলে তুলে আমার কোমড় ব্যথা আজ তিনদিন ধরে।

নিজের কোমড়ে হাত বুলাতে বুলাতে ভীষণ আফসোস নিয়ে কথাগুলো বলে জাভিয়ান। অন্যদিকে জাভিয়ানের কথা শুনে হানিয়া রেগে বোম। মানে কি ভাই? মানলাম সে একটু নাদুসনুদুস তাই বলে তাকে কয়েক মিনিটের জন্য কোলে তুলে জাভিয়ানের নাকি তিনদিন ধরে কোমড় ব্যথা। সে গাড়িতে বসে ঠাশ করে গাড়ির ডোর লাগায়। তার লাগানোর তেজ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার রাগের পরিমাণ।

–আপনাকে কেউ বলেছিল নিজেকে হিরো ভেবে আমাকে কোলে তুলতে? এখন তো সেই সাইড ক্যারেক্টারে পরে থাকা মানুষদের মতো করছেন।

–হিরো ভাববো কি? আমি তো হিরোই। তোমার জীবনে আর সাদিয়া আপার গল্পের হিরো আমি।😁

–গাড়ি কি স্টার্ট দিবেন নাকি নেমে রিকশা ধরব?

–নিজের শ্বশুরের কথা অমান্য করে যেতে চাইলে যেতে পার।

জাভিয়ান জানে হানিয়াকে কীভাবে চুপ করাতে হয়। তার এক কথায় হানিয়া চুপ হয়ে যায়। জাভিয়ানও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

কলেজের সামনে এসে জাভিয়ান গাড়ি থামায়। হানিয়া বের হওয়ার জন্য ডোর খুলতে গেলে দেখে ডোর লক। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকালে দেখতে পায় জাভিয়ানও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে জাভিয়ানকে বলে–

–ডোর আনলক করেন। ক্লাস শুরু হতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি খুলুন।

জাভিয়ান একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে–

–বিয়ের আগে কার সাথে কথা বলেছ বা কার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো সেসবের কথা জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু এখন তুমি বিবাহিত,, কারোর অর্ধাঙ্গিনী তুমি। এই কথাটা মাথায় রাখবে আর কোন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব রাখা দূরের কথা কথাও বলবে না। আমার নজর কিন্তু সবসময় তোমার উপর থাকবে,,যদি কখনো শুনি কোন ছেলের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছ তাহলে ওইদিনই তোমার পড়াশোনার ইতি টানতে হবে।

জাভিয়ান যেমন শান্তভাবে হানিয়াকে সুন্দর ভাবে শাঁসালো হানিয়াও শান্তভাবে তা মেনে নেয়। কিন্তু একটা কথা মনে চেপে রাখতে না পেরে বলেই দেয়–

–আর কোন ছেলে যদি যেচে এসে কথা বলে তাহলে?

জাভিয়ান চোখ বড় বড় করে খানিকটা ধমক দিয়ে বলে–

–সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে। তোমাকে যা বলেছি তাই করবে,,নাহলে আমি কিন্তু কি করতে পারি তা তুমি ভালো করেই জানো।

হানিয়া সুন্দর করে একটা কথা জিজ্ঞেস করল সুন্দর করে জবাব দিলে কি হতো? আজব এলিয়েন একটা।

–হয়েছে? নাকি আরো শাসানো বাকি আছে?

–আপাতত এতটুকুই।

–তাহলে ডোরটা আনলক করে আমায় যাওয়ার সুযোগ করে বাধিত করুন।

হানিয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে কথাগুলো বলে। জাভিয়ান ডোর আনলক করে দিলে হানিয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। জাভিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে–

–ফোন দিল ধরবে। আল্লাহ হাফেজ।

কথাটা বলেই জাভিয়ান চলে যায়,,হানিয়ার উত্তর শুনার অপেক্ষা করে না।

__________________________

হানিয়া বাসায় ফিরে দুপুর দুটোয়। এসে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নেয়। তারপর সকলকে দুপুরের খাবার খাইয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। একটু ঘুমানোর জন্য রুমে এসে সোফায় শুয়ে পরে। সে জাভিয়ানের উপস্থিত বা অনুপস্থিত কখনোই বেডে শোয় না। তাদের সম্পর্ক কেমন যেন একটা গন্ডিতে আটকে আছে।

সন্ধ্যায় সকলকে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে রুমে চলে আসে হানিয়া। টুকটাক কাজ করতে থাকে,,জাভিয়ানের শার্টগুলো আয়রন করে তার কাবার্ডে রাখতে গেলে দেখতে পায় তার কাবার্ডটা অগোছালো। হানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোছাতে শুরু করে। একটা আউলাঝাউলা শার্ট টান দিয়ে বের করার সময় শার্টটার সাথে একটা বস্তু হানিয়ার পায়ের সামনে এসে পরে। হানিয়া জিনিসটাকে তুলে হাতে নিলে দেখে একটা ডায়েরি। বেশ মোটাসোটা ব্রাউন কালারের ডায়েরিটা। হানিয়া ভাবতে থাকে “বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেলো জাভিয়ানকে কখনোই ডায়েরি বা এজাতীয় কিছু লেখতে দেখে নি। তাহলে এটা কার?”
কথাটা ভাবতে ভাবতেই ডায়েরিটা খুলে। প্রথম পেজেই দেখতে পায় গোটাগোটা কয়েকটা হাতের লেখা। লেখাটা ছিলো “স্পর্শের কিছু সুন্দর অনুভূতি” হানিয়া আরো কয়েকবার লাইনটা পড়ার পর তার মাথায় হুট করে কথাটা ঢুকে। স্পর্শ? মানে জাভিয়ানের বোন। তার ডায়েরি এটা। হানিয়ার রক্তে কৌতূহলরা দ্রুত বেগে দৌড়াতে শুরু করে। তার অবচেতন মন জানতে চাচ্ছে স্পর্শ অনুভূতি গুলো সম্পর্কে। তাই হানিয়া নিজের ভাবনা চিন্তাকে উষ্টা মেরে ডায়েরির আরেকটা পেজে গিয়ে সেটা পড়তে নিবে তখনই কেউ একজন পেছন থেকে ডায়েরিটা তার হাত থেকে কেঁড়ে নেয়।

হানিয়া হকচকিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো দেখতে পায় জাভিয়ান রক্তলাল চোখজোড়া। হানিয়া তার এমন দৃষ্টি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মনে পরে যায় কয়েকদিন আগের সেই সকাল বেলার কথাটা। জাভিয়ান প্রচন্ড রাগ নিয়ে হানিয়াকে বলে–

–কার পারমিশন নিয়ে এটা ধরেছ?

–আমি…আসলে..

জাভিয়ান হানিয়ার একদম কাছে এসে তার চোয়াল চেপে ধরে বলে–

–এই ঘরের অধিকার দিয়েছি,,স্বীকৃতি দিয়েছি,, একটু ভালো ব্যবহার করছি বলে এটা ভেবো না তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। আমার কোন পারসোনাল কাজ বা জিনিসে যদি তোমাকে হাত দিতে দেখেছি তাহলে সেই হাত কাটতে আমি দু’বার ভাববো না। এন্ড আই মিন ইট।

জাভিয়ান ইস্পাত কঠিন হাতের হাতের স্পর্শ আর তার চেয়েও কঠিন শব্দ গুলো হানিয়ার চোখ থেকে অশ্রু বের করতে সক্ষম হয়। জাভিয়ান হানিয়ার অশ্রু দেখেও না দেখার ভান করে তাকে ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। যাওয়ার আগে ডায়েরিটা কাবার্ডে রাখা ছোট্ট লকারে রেখে কাবার্ডটা ধাম করে বন্ধ করে যায়। কাবার্ডে লক না থাকলেও লকারে পাসওয়ার্ড লক দেওয়া। হানিয়া জাভিয়ানের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। এত করে সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিলো এই লোকের সামনে আর নিজের অশ্রু বিসর্জন দিবে না তাও তার বেহায়া অশ্রুকণা এই লোকের সামনেই গড়িয়ে পরে। এর জন্য মাঝে মধ্যে নিজেকেই চরাতে ইচ্ছে করে হানিয়ার।

___________________________

রাতে সকলে একসাথে ডিনার করতে বসে। হানিয়া নিত্যদিনের মতো সকলকে সার্ভ করে দিচ্ছে আর তাকে সহায়তা করছে কুলসুম। মি.আরসাল তালুকদার খেতে খেতেই পুত্রবধুকে জিজ্ঞেস করেন–

–কলেজ কেমন কাটল আম্মাজান? কোন সমস্যা হয়নি তো? পড়ার চাপ কেমন?

–আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা। আজকে প্রথমদিন ছিলো তো তাই পড়া দেয় নি। রেগুলার ক্লাস শুরু হলে তারপর বুঝতে পারব চাপ কেমন।

–যাই হোক না কেন পড়ালেখার সাথে কখনো কম্প্রোমাইজ করবে না। মনে রাখবে সকলে তোমাকে ছেড়ে গেলেও তোমার কর্মফল আর বিদ্যা এইদুটো জিনিস কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না।

–জ্বি বাবা।

–কখনো কোন সমস্যা হলে জাভিয়ান থেকে হেল্প না পেলে তৎক্ষনাৎ এই বাবার কাছে চলে আসবে। মনে থাকবে?

–জ্বি বাবা থাকবে।

তাদের দু’জনের কথার মধ্যে কেউ আর কথা বলে না। জাভিয়ান একবার চোরা চোখে তাকালেও পরবর্তীতে খেতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আরসাল তালুকদার আবার বলেন–

–তোমার গলাটা কেমন ভার ভার লাগছে কেন মা? কান্না করেছ নাকি?

হানিয়া এবার থতমত খেয়ে যায়,,জাভিয়ানের চলতে থাকা হাতটা থেমে যায়। ভাইয়ের কথা শুনে রোজি বেগমও খাওয়া থামিয়ে হানিয়ার দিলে তাকায়। তার কাছেও হানিয়ার গলাটা কেমন লাগছিলো এখন তার ভাইও একি কথা বললো। হানিয়া আমতা আমতা করে বলে–

–না বাবা,,আসলে শীতকাল না। এইসময় আমার হুটহাট করে ঠান্ডা লেগে যায় তখন গলাটা এমন ভারি ভারি লাগে,,, মনে হয় কান্না করেছি। আপনি চিন্তা করবেন না।

–সত্যি তো?

আরসাল তালুকদারের কাছে হানিয়ার কথাটা বিশ্বাস হয় না। হানিয়া মুচকি হেসে বলে–

–জ্বি বাবা। এখন খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলেন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না। খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই।

সকলে আবার খাওয়া শুরু করে দেয়। হানিয়া আসলেই কেঁদেছিল তার স্বাক্ষী কুলসুম। কিন্তু এখন শ্বশুরকে মিথ্যা বলল নাহলে ঝামেলা হতে পারে তাই। সকলে খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে যাওয়ার পর রোজি বেগম এসে হানিয়াকে চেপে ধরে। কুলসুমও তার সাথে আছে। রোজি বেগম অনেক জোড়াজুড়ি করার পরও হানিয়া সত্য কথাটা বলে না,,শুধু শুধু তাকে টেনশন দিয়ে লাভ কি। সে রোজি বেগমকে বলে” মা-বোনের কথা মনে পরছিলো তাই কেঁদেছে।” তাদের বিশ্বাস না হলেও কিছুই করার নেই।

হানিয়া রুমে এসে দেখে জাভিয়ান ঘুমিয়ে পরেছে। সেও ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের কাবার্ড থেকে কম্ফোর্ডার আর বালিশ এনে সোফায় শুয়ে পরে। শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পরে। জাভিয়ান তারও কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে তাকায়। বিছানা ছেড়ে হানিয়ার কাছে এসে তার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। গভীর নয়নে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হাত বাড়িয়ে হানিয়ার গাল স্পর্শ করে। আলতো হাতে স্লাইড করতে থাকে হানিয়ার লাল হয়ে যাওয়া গালটা। কেন তাকিয়ে আছে বা স্পর্শ করছে সে নিজেও জানে না কিন্তু এই কাজটা তার অশান্ত মনকে শান্ত করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জাভিয়ান উঠে দাঁড়ায়। কাবার্ড থেকে একটা হুডি বের করে তা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পরে প্রথমে রুম থেকে তারপর বাসা থেকে। জাভিয়ান রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই হানিয়া চোখ মেলে তাকায়। জাভিয়ানের গরম নিঃশ্বাস আর হাতের স্পর্শেই হানিয়ার ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো তাও সে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। হানিয়া শোয়া থেকে উঠে বেলকনিতে যায়। দেখতে পায় আজও জাভিয়ান চোরের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে বাসার বাহিরে যাচ্ছে। হানিয়া নির্লিপ্ত চোখে তার যাওয়া দেখে তারপর আবার নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পরে।

________________________

–আমি পারছি না ওকে আর কষ্ট দিতে,,ওকে কষ্ট দিয়ে গিয়ে আমি নিজে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছি। এমনটা কেন হচ্ছে তুমি প্লিজ আমাকে বলবে?

কাতর স্বরে কথাগুলো বলে জাভিয়ান। অজ্ঞাত ব্যক্তিটির কপালে কয়েকটা ভাজ পরে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। অজ্ঞাত ব্যক্তিটি জাভিয়ানকে বলে–

–এসবই তো প্রেমে পরার লক্ষণ। তাহলে কি তুমি হানিয়ার প্রেমে পরলে??

জাভিয়াম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অজ্ঞাত ব্যক্তিটির দিকে। ব্যক্তিটি নিজের কণ্ঠে কিছুটা রাগ আর তাচ্ছিল্য নিয়ে আবারও বলে–

–শেষ পর্যন্ত সেই ছলনাময়ীর ছলনায় পরে গেলে? ভুলে গেলে তার ভাইয়ের কারণেই আজ তোমার বোন থেকেও নেই? আমি জানতাম তারা ভাই-বোনেরা ছলনায় ফেলাতে এক্সপার্ট কিন্তু তুমি যে এত সহজে পা পিছলে তাদের ছলনায় আটকে যাবে তা বুঝতে পারি নি।

অজ্ঞাত ব্যক্তিটির কথা শুনে জাভিয়ানের এতক্ষণের সকল আবেগ-অনুভূতি উড়ে যায়। সেখানে দেখা দেয় একরাশ ক্রোধ আর প্রতিশোধের নেশা। তাকে রাগতে দেখে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি জাভিয়ানের অগোচরে হাসে,,তার কথা কাজে দিচ্ছে। সে এবার খানিকটা ধরা গলায় বলে–

–ভুলে গেলো স্পর্শকে এলোমেলো ভাবে পাওয়ার ওইদিনটা??

জাভিয়াম বসা থেকে লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায়। তার সামনে থাকা চেয়ারটায় লাথি দিয়ে ফেলে রাগে হাস ফাঁস করতে করতে বলে–

–না না আমি কিচ্ছু ভুলে নি আর না তার ছলনায় পা দিয়েছি। তুমিই বলো আমি সেদিনের কথা কীভাবে ভুলে যেতে পারি যেদিন আমি আমার পুতুলকে ওই জানোয়ার…….

জাভিয়ান আর বলতে পারে না। কথাগুলো এসে আটকে যায় গলার কাছে। চোখ ফেটে পানি বের হয় তার। সে নিজের অশ্রু লুকাতে চোখে হাত দিয়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ায়। ভাবতে থাকে তার জীবনের নিকৃষ্ট দিনটার কথা।

____________________

অতীত~~

সেদিন জাভিয়ান দেশে ফিরে তার বন্ধুদের নিয়ে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। পথে তার দু’জন বন্ধুর মাঝে একজনের বাসা থেকে কল আসায় সে বলে আজ জাভিয়ানের বাসায় যাবে না অন্য একদিন যাবে। তার সেই বন্ধুর সাথে অপরজনও চলে যায়। জাভিয়ান আর তার বুক করা ক্যাব ড্রাইভার ফিরছিলো বাসায় তখনই ড্রাইভার একটা হার্ডব্রেক করে। জাভিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন থেকে ড্রাইভারকে বলে–

–একটু দেখে চালান আঙ্কেল। আরেকটু হলেই তো দু’জনে পটোলের ক্ষেতে চলে যেতাম।

কথাটা হাসতে হাসতেই বলে। কিন্তু ড্রাইভার যা বলে তা শুনে জাভিয়ানের পিলে চমকে যায়। ড্রাইভার বলে–

–স্যার একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।

জাভিয়ান হুরমুড়িয়ে বলে–

–কি বলছেন? বসে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি চলেন গিয়ে দেখি কি অবস্থা তার।

ড্রাইভারটা ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে এক্সিডেন্ট হওয়া ব্যক্তিটি যদি মারা যায় তাহলে তো সে ফেঁসে যাবে। জাভিয়ান ড্রাইভারকে ফেলেই নিজে নেমে যায়। তালে নামতে দেখে ড্রাইভারও ভয়ে ভয়ে নেমে পরে। জাভিয়ান গাড়ির সামনে এসে দেখে একটা মেয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। সে তাড়াতাড়ি তার মাথার কাছে বসে মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। তারপর মেয়েটির গালে হালকা চাপড় মারতে মারতে বলে–

–এই যে শুনছেন? কিচ্ছু হবে না আপনার,,শুধু আপনি চোখটা বন্ধ করবেন না প্লিজ।

কথাটা বলতে বলতে জাভিয়ান মেয়েটির মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। চুলের কারণে ঢেকে থাকা মুখটা তার সামনে স্পষ্ট হতেই জাভিয়ানের পরাণ পাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। এ কাকে দেখছে সে? তার বোন তার পুতুল? জাভিয়ান স্পর্শীয়াকে ছোট থেকে পুতুল বলে ডাকে,,কারণ ছোটবেলা মনি যখন স্পর্শকে হালকা সাজিয়ে দিতো তখন তাকে একদম পুতুলের মতো লাগত। সে স্পর্শের গালে চাপড় মারতে মারতে বলে–

–পুতুল এই পুতুল উঠ। উঠ বোন,,দেখ ভাই এসে পরেছি। তোর জন্য অনেকগুলো চকলেট এনেছি। তোর এই অবস্থা কেন পুতুল? কে করেছে তোর সাথে এমন ভাইকে বল?

জাভিয়ান দেখতে পায় স্পর্শের জামার হাতা অনেকটা ছেঁড়া,, ওড়নাও নেই। ছোট থেকেই স্পর্শ ওড়না বা হিজাব ছাড়া কখনোই বাহিরে যেত না,, সেই বোনের এমন অবস্থা দেখে জাভিয়ানের বুঝতে বাকি থাকে না স্পর্শর সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। স্পর্শর তখনও হালকা জ্ঞান ছিলো। সে অনেক কষ্টে চোখটা টেনে টুনে খুলে বলে–

–ভাই…আব.রারকে বাচ….

আর বলতে পারে না স্পর্শ,, অজ্ঞান হয়ে যায়। বোনকে অজ্ঞান হতে দেখে জাভিয়ান আরো পাগল হয়ে যায়। হুট করে তার মাথায় আসে” না এমন পাগলামি না করে স্পর্শকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে” কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে জাভিয়ান চিৎকার করে ড্রাইভারকে ডাকতে থাকে। তার ডাক শুনে যখন ড্রাইভার আসে না তখন ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে সেই ক্যাব ড্রাইভার নেই। ড্রাইভারটি ভীষণ ভয় পেয়ে যাওয়ায় জাভিয়ানের লাগেজ নামিয়ে চম্পট হয়ে গেছে। জাভিয়ান দিশা হারিয়ে ফেলে,, এখন কীভাবে সে তার বোনকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। রাস্তাটা বেশ শুনশান হওয়ায় তেমন একটা গাড়িও নেই। যে দুই একটা আসছে সেটাও সাই করে চলে যাচ্ছে। জাভিয়ান বোনকে বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে আর হেল্প চাইছে। কিন্তু স্বার্থপরদের এই দুনিয়ায় কেউ এগিয়ে আসছে না। সে যখন কাঁদছিলো তখনই একটা গাড়ি এসে থামে তার সামনে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে একজন। জাভিয়ানকে বলে–

–জাভিয়ান তুমি এখানে? এভাবে কাঁদছই বা কেন?

জাভিয়ান চোখ তুলে তাকালে দেখতে পায় পরিচিত একজনকে। তাকে বলে–

–আমাকে প্লিজ হেল্প করো। স্পর্শকে এখনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।

ব্যক্তিটি জাভিয়ানের পাশে বসে বলে–

–কি হয়েছে ওর? এই স্পর্শ চোখ খুলো।

স্পর্শকে নিজের বুকে নিয়ে আর্তনাদ করে বলে লোকটি। তারপর হুট করে দাড়িয়ে যায় স্পর্শকে কোলে নিয়ে। জাভিয়ানকে বলে–

–তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলো,,ওর শ্বাস এখনো চলছে।

কথাটা বলতে বলতে লোকটি স্পর্শকে গাড়ির ব্যাক সিটে শুইয়ে দেয়। জাভিয়ান স্পর্শর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয় আর লোকটি গাড়ি চালাতে শুরু করে।

_______________________

বর্তমান~

কাঁধে কারো স্পর্শে জাভিয়ানের ধ্যান ভাঙে। অজ্ঞাত লোকটি বলতে থাকে–

–আমাদের প্ল্যান ভুলে গেলে চলবে না। যাদের জন্য আমাদের স্পর্শের আজ এই অবস্থা তাদের বাড়ির মেয়েকে আমরা শান্তিতে থাকতে দিতে পারি না।

জাভিয়ান চোয়াল শক্ত করে বলে–

–হুম ঠিক বলেছ। কিন্তু এবার মারধর করে নয় অন্য ভাবে তাকে কষ্ট দিব। তার ভাইয়ের মাশুল তাকে খুব ভয়াবহ ভাবে দিতে হবে।

জাভিয়ানের এমন কথা শুনে অজ্ঞাত ব্যক্তিটির মুখে হাসি ফুটে,,কিন্তু তা জাভিয়ানের চোখের আড়ালই রয়ে যায়।

শব্দসংখ্যা~২৩১০

~~চলবে?