#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চৌত্রিশ
#রহস্যের_সমাধান_০৪
হানিয়া এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে আবারও উঁকি দেয় জানালা দিয়ে ভেতরে। দেখে জাভিয়ান স্পর্শের হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে সেই হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে বোনের হাতে স্নেহের পরশ দিচ্ছে। মাঝ বয়সী মহিলাটি জাভিয়ানকে বলে–
–স্যার! ম্যামকে যে নিয়ে আসলেন অ্যাসাইলাম থেকে। ম্যাম আবার সমস্যা করলে?
জাভিয়ান মাথা তুলে নিজের চোখ মুছে জবাব দেয়–
–হবে না ইনশা আল্লাহ। পুতুলটা কাছে কাছে থাকলে একটু স্বস্তি পাই,,আপনিতো জানেনই ও আমার বড্ড আদরের।
মহিলাটি কোন জবাব দেয় না। জাভিয়ান মহিলাটিকে বলে–
–ইনজেকশনটা দিয়েছিলেন?
–জ্বী স্যার।
–পাগলামি করেছে কোন?
–তেমন একটা করেনি।
–আচ্ছা। ঔষধ আর ইনজেকশনটা রেগুলার দিতে থাকেন।
–স্যার! একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না।
–হুম বলেন মিসেস জুলিয়া।
হানিয়া মহিলা টির নাম শুনে বুঝতে পারে কাল রাতে এই মহিলার সাথেই জাভিয়ান কথা বলছিলো। হানিয়া নিজের চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে আবার তাদের কথা শোনায় মন দেয়। সে শুনতে পায়,,মিসেস জুলিয়া বলছে–
–স্যার! আজ আড়াই বছর ধরে আমি স্পর্শ ম্যামের দেখভাল করছি। তার ঔষধপত্র থেকে শুরু করে সব আমিই দেখছি। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে আমি সন্দিহান।
–কোন বিষয়?
–স্পর্শ ম্যামের হেল্থ সম্পর্কে। মি.চৌধুরীর কন্সালটেড ডাক্তারের দেওয়া ইনজেকশন-ঔষধ তো আজ আড়াই বছর ধরে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। এবার কি আমরা অন্য একটা ডাক্তারকে দেখাতে পারি না স্পর্শ ম্যামকে?
জাভিয়ান মিসেস জুলিয়ার কথা ভাবে “নাহ, মিসেস জুলিয়া মিথ্যা কিছু বলছে না। এবার স্পর্শের ডাক্তার চেঞ্জ করে এহসান কবিরের কাছে নিয়ে যাবো।” জাভিয়ান মিসেস জুলিয়াকে বলে–
–ঠিক বলেছেন মিসেস জুলিয়া। মি.চৌধুরী আসুক দেশে,,ওর সাথে পরামর্শ করে তারপর পুতুলকে নতুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ধন্যবাদ মিসেস জুলিয়া,, আপনার পরামর্শের জন্য।
মিসেস জুলিয়া হাসিমুখে বলে–
–ধন্যবাদ দিতে হবে না স্যার। ও আমার ছোট বোনের বয়সী। এতদিন ওর খেয়াল রাখতে রাখতে ওকে আমি আমার ছোট বোনের চেয়ে আলাদা চোখে দেখি না।
–আব…..
জাভিয়ান মিসেস জুলিয়াকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি একটা চাপা আর্তনাদ শুনতে পায়। আওয়াজটা শুনে সে আর মিসেস জুলিয়া ভয় পেয়ে যায়। কেউ এসে পরলো নাকি? জাভিয়ান স্পর্শের হাতটা ছেড়ে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বাহিরে বের হয়। ঘরের ভেতরে লাগানো এলইডি বাল্বের আলোয় স্টোররুমটার আশেপাশে কয়েক হাত জায়গা খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে। জাভিয়ান দেখতে পায় কয়েক কদম দূরেই ছোট্টখাট্টো একটা অবয়ব। সে তাড়াতাড়ি তার প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সেইদিকে যায় অবয়বটাকে দেখার জন্য। ফোনের আলোতে যখন অবয়বটা জাভিয়ানের চোখে স্পষ্ট হয় তখন তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়,,সেই সাথে মেজাজ এমন চূড়ান্ত খারাপ হয় যে বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা বড়সড় সাইজের একটা কুকুর কোথা থেকে একটা ময়লার পোটলা এনে তাদের বাড়ির পেছনের গেটের কাছে বসে খাবার খুঁজছে। ময়লার পোটলাটায় কাঁচ জাতীয় কিছু একটা ছিলো হয়ত সেটায় কুকুরটার মুখে ঢুকে মুখ কেটে র//ক্ত বের হচ্ছে। কুকুরটা ব্যথায় তাই আর্তনাদ করছে। মানুষ দিনদিন নিজের বিবেক-বুদ্ধি সব খাবারের সাথে খেয়ে হজম করে ফেলছে।
জাভিয়ান কুকুরটির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত করতে চায়। মিসেস জুলিয়া পেশায় একজন নার্স। জাভিয়ানের পেছন পেছন মিসেস জুলিয়াও এসেছিলো। সে কুকুরটি এমন কষ্ট দেখে জাভিয়ানের পাশ থেকে উঠে দৌড়ে স্টোররুমে আসে। ফার্স্টএড বক্স থেকে তুলো আর একটা সিজার নিয়ে আসে কাঁচ বের করার জন্য। মিসেস জুলিয়া মানুষের ক্ষতের চিকিৎসা করতে পারলেও পশু-পাখির ক্ষতে কেমন চিকিৎসা দেওয়া হয় সে সম্পর্কে তার সঠিক জানা নেই। কিন্তু সে কুকুরটির কষ্ট একটু কমানোর জন্য কিছু করতে চায় বলে ওই জিনিসগুলো নিয়ে যায়। মিসেস জুলিয়া আর জাভিয়ান কুকুরটির মুখ থেকে কাঁচের টুকরো গুলো বের করতে যখন ব্যস্ত হয়ে যায়,, এই ফাঁকে হানিয়া গাছের পেছন থেকে বের হয়ে স্পর্শকে রাখা ওই স্টোররুমে ঢুকে পরে।
হানিয়া রুমটায় কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর তার চোখ যায় তার ভাইয়ের মায়াবতীর দিকে। যার উষ্কখুষ্ক জটধরা চুল,,পুরনো ক্ষতের চিহ্নযুক্ত গালজোড়া,,আর অশ্রু ভেজা নয়ন হানিয়াকে বলে দিচ্ছে তার করুণ অবস্থার কথা। হানিয়া কাঁপা কাঁপা পায়ে স্পর্শর কাছে এসে তার মুখের ঝুঁকে পরে। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় সেই খসখসে গাল টায়। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে হানিয়ার। সে স্পর্শর দিকে আরেকটু ঝুঁকে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলে–
–আমার ভাইয়ের করা কর্মের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দিয়ে সেই মানুষটাও বেশি একটা সুখে নেই কিন্তু। কেন এমনটা হলো আপু বলতে পারো? আজ চার চারটা মানুষ কষ্টের অনলে দগ্ধ হচ্ছে,, কি করলে পাবে তারা এই কষ্ট থেকে মুক্তি?
উত্তর আসে না হানিয়ার প্রশ্নের। হানিয়া স্পর্শের গাল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ যায় স্পর্শের বেডের পাশে টেবিলের দিকে,,যেটার একটা ড্রয়ার একটু আগে খুলে তুলো আর সিজার নিয়ে গিয়েছিলো মিসেস জুলিয়া। হানিয়া স্পর্শ পাশ থেকে সরে এসে ড্রয়ারটায় নজর দেয়। অনেক অনেক ঔষধ আর একটা ব্যবহৃত ইনজেকশন দেখতে পায়। হানিয়ার এক্সিডেন্টে তার ফোনটা হারিয়ে যায়,, যেটা কিনা এখনও কেনা হয়নি তার। ফোনটা থাকলে সে ঔষধ গুলোর ছবি তুলে নিতে পারত। কিন্তু সেটা যেহেতু করতে পারছে না,,তাই হানিয়া সবগুলো ঔষধ থেকে একটা ট্যাবলেট করে বের করে নেয়। তারপর সেগুলো তার শালের এক কোণায় গিট্টু দিয়ে পেঁচিয়ে নেয় যাতে হারিয়ে বা পরে না যায়।
কাজটা শেষ করে সে আরেকবার স্পর্শকে দেখে রুমটা থেকে বের হয়ে আগে যেই গাছটার পেছনে লুকিয়েছিলো সেটার পেছনে চলে যায়। এতক্ষণে মিসেস জুলিয়ার কাজটাও শেষ হয়ে যায়। সে জাভিয়ানকে বলে–
–ওকে একজন পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হয়,,নাহলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
জাভিয়ান চিন্তিত হয়ে বলে–
–এতরাতে কি কোন পশু হসপিটাল খোলা পাবো?
মিসেস জুলিয়াও তার কথা শুনে ভেবে দেখে”রাত এখন প্রায়ই তিনটে,,এতরাতে কোন পশু হসপিটাল খোলা পাওয়া প্রায়ই অসম্ভব” সে জাভিয়ানকে বলে–
–ঠিক বলেছেন স্যার। তাহলে এখন কি করবেন ওর?
–আজ রাতটা ও আমাদের গ্যারেজেই থাকুক। কাল সকালে নিয়ে যাবো না হয়।
–ঠিক আছে স্যার। আপনিও এখন বাসায় চলে যান,,হানিয়া ম্যাম আপনাকে না দেখতে পেলে সন্দেহ করতে পারে।
–হুম। আপনি সাবধানে থাকবেন। পুতুল কোন সমস্যা করলে আমাকে কল করবেন।
–ওকে স্যার।
জাভিয়ান কুকুরটিকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে গ্যারেজের দিকে হাঁটা দেয় আর মিসেস জুলিয়া রুমে চলে যায়। হানিয়া এই ফাঁকে তাড়াতাড়ি করে কিচেনের পেছনের দরজা দিয়ে প্রথমত বাসায় ঢুকে তারপর নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। এত দৌড়াদৌড়ি করায় তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়,,সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে হানিয়া। দরজার বাহিরে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে হানিয়া ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে দিয়ে শুয়ে ঘুমের নাটক করে। জাভিয়ান রুমে ঢুকেই কার্বাডের কাছে চলে যায়। সেখান থেকে ট্রাউজার আর লংহাতার টি-শার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। ভোর সাড়ে তিনটায় জাভিয়ান শাওয়ার নেয়। জাভিয়ানের ওয়াশরুমে ঢোকার শব্দ শুনে হানিয়া চোখ মেলে তাকায়। যখন ওয়াশরুম থেকে পানি পরার শব্দ পায় তখন সে বুঝতে পারে জাভিয়ান শাওয়ার নিচ্ছে,, তাই হানিয়া শোয়া থেকে উঠে স্পর্শর রুম থেকে আনা ঔষধ গুলো তার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখে আবার শুয়ে পরে।
হানিয়া শোয়ার মিনিট দুয়েক পরই জাভিয়ান বের হয় ওয়াশরুম থেকে। মাথাট মুছে সেও ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে ঢুকে পরে। গিজার চালিয়ে শাওয়ার নেওয়ার পরও তার ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। পাশে বউ থাকতে কোন ছেলে ঠান্ডায় এমন কাঁপতে চাইবে? সে হানিয়ার কাছে এসে তাকে আগের দিনের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। হানিয়ার কামিজের ভেতরে তার ঠান্ডা হাত ঢুকিয়ে তার পেট জড়িয়ে ধরে। জাভিয়ানের বরফের ন্যায় ঠান্ডা হাতজোড়ার স্পর্শে হানিয়ার গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। হানিয়া নড়েচড়ে জাভিয়ানের ঠান্ডা হাত সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু জাভিয়ান তাকে তো ছাড়ে না বরং হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। হানিয়া জাভিয়ানের দিকে ঘুরে শোয়,, চোখ দুটো একটু মিটমিট করতে থাকে,,ভাবটা এমন যেন এইমাত্র তার ঘুমটা ভেঙেছে জাভিয়ানের ঠান্ডা হাতের স্পর্শতে। সে জাভিয়ানকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে–
–সমস্যা কি? এমন ঠান্ডা হাত আমার জামার ভেতরে ঢুকিয়েছেন কেন? আর এমন ঠান্ডাই বা কেন আপনার হাত?
জাভিয়ান তার বালিশ থেকে উঠে হানিয়ার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে–
–শাওয়ার নিয়েছি তাই ঠাণ্ডা।
হানিয়া তো মহা বিরক্ত। একে তো অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তার উপর এতো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। সে তার একহাত দিয়ে জাভিয়ানের মাথার চুল টেনে ধরে তাকে নিজের থেকে সরাতে সরাতে বলে–
–কি এমন মহান কাজ করে এলেন যে ভোর সাড়ে তিনটে কি পৌঁনে চারটায় আপনাকে শাওয়ার নিতে হলো?
–একটা আহত কুকুরকে সেবা করে আসলাম,, আর কুকুর যেহেতু নাপাক তাই শাওয়ার নেওয়া লেগেছে। পেয়েছ উত্তর? এখন চুল ছাড়ো আর আমাকে ঘুমাতে দাও। নাহলে ভালো হবে না কিন্তু।
হানিয়া জানে জাভিয়ান কোথা থেকে এসেছে আর কেনই বা শাওয়ার নিয়েছে কিন্তু তাও জিজ্ঞেস করে–
–এতো রাতে আপনি বাহিরে গিয়েছিলেন? কিন্তু কেনো?
জাভিয়ান উত্তরে কি বলবে জানে না,, তাই সে কথা কাটানোর জন্য ধমকে হানিয়াকে বলে–
–তোমাকে সব বলে তারপর করতে হবে? কোথায় গেলাম? কি করলাম? কেন করলাম? সার্ভেন্ট নাকি আমি তোমার?
জাভিয়ানের এমন কথায় হানিয়ার অনেক খারাপ লাগে। সে কি স্ত্রী হয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না এত রাতে কই গিয়েছিলো তার হাসবেন্ড? সে না-হয় জানে জাভিয়ান কই গিয়েছিলো কিন্তু জাভিয়ান তো আর জানে না যে হানিয়া তার সিক্রেট সম্পর্কে জানে। হানিয়া শান্ত গলায় বলে–
–আপনি যেমন আমার সার্ভেন্ট না আমিও আপনার চাহিদা মেটানোর খোরাক না। যখন মন চাইলো কাছে টানলেন,,নিজের মতো আদর করে আবার দূরে সরিয়ে দিলেন। আমিও মানুষ, আমারও মন বলে কিছু আছে। কষ্ট দিচ্ছেন দেন,,কিন্তু ভবিষ্যতের কথাটাও চিন্তা করেন। এখন সরুন আমার উপর থেকে।
রাত দুপুরে কাহিনি ভালো লাগছে না।
হানিয়ার প্রথম কথাগুলো শুনে জাভিয়ানের যেমন রাগ হয় লাস্টের কথাগুলো শুনে তেমনি গিল্টি ফিল হয়। সে তো ওমন কঠোর করে বলতে চায়নি কিন্তু স্বভাব অনুয়ায়ী বলে ফেলেছে। হানিয়া জাভিয়ানকে সরাতে চাইলে জাভিয়ান এবার জোরে করে তার কাঁধে একটা বাইট করে। ব্যথায় হানিয়া চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। একহাত দিয়ে জাভিয়ানের চুল খামচে ধরে তো আরেক হাত দিয়ে বেডশিট আঁকড়ে ধরে। কয়েক সেকেন্ড পর জাভিয়ান তার কাঁধ ছেড়ে দেয় কিন্তু হানিয়াকে ছাড়ে না। তার কাঁধেই মাথা রেখে শুয়ে পরে। ব্যথায় হানিয়ার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলে তা জাভিয়ানের গাল স্পর্শ করে।
হঠাৎই গালে কেমন উষ্ণ পানির অস্তিত্ব অনুভব করে জাভিয়ান। উষ্ণ পানি কোথা থেকে তার গালে আসলো দেখার জন্য চোখ খুললে দেখতে পায় হানিয়ার বন্ধ চোখজোড়া ভেজা। জাভিয়ান বুঝতে পারে এই উষ্ণ পানি গুলো হলো হানিয়ার চোখের অশ্রু। তাও সে চুপ থাকে,,চুপ থাকাটাই তার কাছে শ্রেয় মনে হয়। একসময়ে ঘুমিয়ে পরে জাভিয়ান হানিয়াকে বাহুডোরে নিয়ে। হানিয়া আর কি করবে,,সেও তার অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে ঘুমিয়ে পরে।
__________________________
আজ সকালে হানিয়া জাভিয়ানের আগে ঘুম থেকে উঠে। গতকাল সন্ধ্যার পরপরই হানিয়া ঘুমিয়ে পরেছিল আবার ভোর রাতে কতক্ষণ ঘুমানোর কারনে সকাল সকালই হানিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সে যখন বিছানা ছাড়ে তখনও জাভিয়ান গভীর ঘুমে। সান্ডাপান্ডা মার্কা জাভিয়ানকে নিজের উপর থেকে সরাতে হানিয়ার কম শক্তি অপচয় হয় না। অনেক কষ্টের পর সে জাভিয়ানকে সরিয়ে তারপর শোয়া থেকে উঠতে পারে। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়। কুলসুমের সাথে কথা বলতে বলতে তাঁদের রান্না দেখতে থাকে হানিয়া।
জাভিয়ান ঘুৃম থেকে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু হাতের কাছেই পায়। তাই জিনিস খোঁজার বাহানায় আজ আর হানিয়াকে ডাকতে পারে না। অফিসের জন্য একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমে দেখে সকলে তার জন্যই অপেক্ষা করে বসে আছে। জাভিয়ান চেয়ারে বসতেই হানিয়াকে সকলকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা শুরু করে। মি.তালুকদার হানিয়াকে বলে–
–তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হওনি মা,,আগে সুস্থ হও তারপর আমাদের শুধু সার্ভ না রান্না করে খাইয়ো। এখন তুমি বসো,,তোমার মনি আমাদের সার্ভ করুক।
হানিয়া মি.তালুকদারের প্লেটে জেলি লাগানো ব্রেড দিয়ে বলে–
–বাবা আমি আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি এখন। আপনারা আমাকে যেভাবে বসিয়ে রাখেন তার জন্য হাত-পায়ে জং ধরে যাবে কয়েকদিন পর। রান্না ঘরে ঢোকার তো পারমিশন এখনো পায় নি কিন্তু খাবারটা সার্ভ আমিই করবো আর এতে আমি আপনাদের কোন বারণ শুনবো না।
হানিয়ার কণ্ঠে প্রবল অধিকারবোধ ছিলো যা মি.তালুকদারকে মুগ্ধ করে। সে হেসে বলে–
–আচ্ছা। পরে শরীর যদি আবার খারাপ করে তখন কিন্তু আমি বকা দিবো।
হানিয়া হেসে তার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। জাভিয়ানকে খাবার সার্ভ করার সময় হানিয়া একবারও তার দিকে তাকায় না,,চুপচাপ সার্ভ করে নিজেরটা নিয়ে বসে পরে। খাবার খাওয়ার সময়টাতেও জাভিয়ান এটা ওটা চাওয়ার অজুহাতে হানিয়াকে ডিস্টার্ব করলেও হানিয়া চুপচাপ তাকে সেসব জিনিস এগিয়ে দেয় কিন্তু তার দিকে ফিরেও তাকায় না। জাভিয়ানের এবার নিজের উপরই রাগ হয়,,শুধু শুধু সে কষ্ট দেয় হানিয়াকে। জাভিয়ান ব্রেকফাস্ট করে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় বাসা থেকে,,আজ তার অনেক ইমপোর্টেন্ট সব মিটিংস আছে তাই।
জাভিয়ান চলে যেতেই হানিয়া রোজি বেগমের ফোন দিয়ে ইনায়াকে তাদের বাসার কাছের একটা ক্যাফেতে আসতে বলে জরুরি ভিত্তিতে। ইনায়া এত জরুরি তলব শুনে কোন প্রশ্ন ছাড়াই আসার জন্য সম্মতি দেয়। হানিয়া ফোনটা রেখে ভাবতে থাকে–
–ইনায়াকে তো বলে দিলাম আসার জন্য কিন্তু আমার বাড়ি থেকে বের হওয়াই তো একটা বড় চ্যালেজ্ঞ। কীভাবে বের হবো? কীভাবে?
কথাটা ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। শায়লা বেগম আর মি.তালুকদার ডাক্তারের কাছে গেছেন তাদের রেগুলার চেকআপের জন্য। বাসায় হানিয়া,, রোজি বেগম আর কুলসুম। হানিয়া সময় অপচয় না করেই রোজি বেগমের রুমে গিয়ে বলে–
–মনি আমি একটু আমাদের বাসায় যাই? অনেকদিন ও বাসায় যাওয়া হয় না। কাল মা-ও ফোন দিয়ে যেতে বলছিলো।
রোজি বেগম বলে–
–আমার পায়ের ব্যথা তো আবার বেড়েছে মা। আচ্ছা জাভিয়ান আসলো যাস।
–আমি একা একাই যাই।
রোজি বেগম চোখ বড়বড় করে বলেন–
–একদম না হানিয়া। আমি তোমার এই কথায় কিছুতেই সম্মতি দিতে পারব না।
রোজি বেগমের কণ্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে সে রেগে গিয়েছে। হানিয়াও হাল ছাড়ে না। অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করে শেষে কান্নাকাটি করে রাজি করায় রোজি বেগমকে। রোজি বেগম শর্ত দেন বাসার গাড়ি করে গেলে তবেই যেতে দিবে নাহলে নয়। হানিয়া ভাবে “বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলব না আমাদের বাসার যাওয়ার কথা,,তাহলে সে আর সন্দেহ করবে না।” এই ভাবনা মাথায় রেখে হানিয়া রাজি হয়ে যায় রোজি বেগমের কথায়।
হানিয়ার এক্সিডেন্টের পর আজই সে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে তাও একা একা। হানিয়া বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রোজি বেগম মুখ কালো করে রাখলেও হানিয়া তাকে ভাঙ্গাবুঝ দিয়ে চলে আসে। ক্যাফটা তাদের বাসা থেকে বেশি দূর না হওয়া মিনিট দশেকর মধ্যেই হানিয়া ক্যাফেতে চলে আসে। ইনায়া তখনও এসে পৌঁছায়নি বলে সে বসে বসে ইনায়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
______________________
জাভিয়ান তার একটা মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে আসে। তার এখনো আরো দু’টো মিটিং আছে। চোখ-মুখে পানি ছিটিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে কল লাগায় রোজি বেগমের নাম্বারে। হানিয়ার ফোন না থাকায় জাভিয়ান রোজি বেগমের ফোনে অথবা বাসার ল্যান্ডলাইনে ফোন দিয়ে হানিয়ার খোঁজ নেয়। রোজি বেগম ফোন রিসিভ করলে তারা দু’জন টুকটাক কথা বলার পর জাভিয়ান হানিয়াকে চায় কথা বলার জন্য। তখন রোজি বেগম জানায় হানিয়া তার বাবার বাসায় গেছে। জাভিয়াম কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায়। কেননা, কাল যে মেয়ে তার মাকে বললো আর কখনোই সে মির্জা বাড়িতে যাবে না সে নাকি আজকেই রওনা হয়েছে ওই বাসায় যাওয়ার জন্য। তাও আবার একা একা।
জাভিয়ান রোজি বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে ফোন লাগায় হানিয়ার বোন সোনিয়াকে। কুশল বিনিময় শেষে জাভিয়ান হানিয়াকে চাইলে সোনিয়া জানায় হানিয়া তাদের বাসায় আসেনি। এবার যেন জাভিয়ান হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে যায়। রোজি বেগমকে বলে এসেছে মির্জা বাড়িতে যাবে,, কিন্তু মির্জা বাড়িতেও যায়নি। তাহলে গেলো তো গেলো কই হানিয়া? রোজি বেগমের কথা অনুযায়ী হানিয়ার আরো আগে পৌছে যাওয়ার কথা মির্জা বাড়িতে,, কিন্তু এখনো পৌঁছায় নি। তাহলে রাস্তায় কি আবার কোন সমস্যা হলো? কথাটা মাথায় আসতেই জাভিয়ানের বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে।
শব্দসংখ্যা~২২৮৫
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_পঁয়ত্রিশ
হানিয়া ক্যাফেতে আসার পনেরো মিনিট পর ইনায়া হাঁপাতে হাঁপাতে আসে। হানিয়া তাকে শান্ত হয়ে বসতে বলে তার জন্য কোল্ড কফি আর নিজের জন্য চা অর্ডার দেয়। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে ইনায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলো–
— কি এমন মহাভারত বলবি যে আমাকে এরকম কুত্তার মতো দৌড়িয়ে আনাইলি?
হানিয়া চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেঁসে দেয়। তারপর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ইনায়ার পাশের চেয়ারে বসে তার হালকা ফুলো ফুলো গালদুটো টেনে দিয়ে মজা করে বলে–
–লাগ কলে না বাবুনি।
এতদিন পর হানিয়ার হাসি আর তার মজা করে কথা বলতে দেখে ইনায়ার মনটা খুশি হয়ে যায়। তাই সে আর রাগ না করে স্বাভাবিক ভাবে বলে–
–আচ্ছা করলাম না রাগ। বল কি বলবি?
হানিয়া এবার মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বলে–
–ডা.কবির ঠিক বলেছিলেন, স্পর্শ আপু বেঁচে আছে। আমি নিজের চোখে তাকে দেখেছি।
হানিয়ার মুখে এমন কথা শুনে ইনায়া হতভম্ব হয়ে যায়। আড়াই বছর আগে মারা যাওয়া মানুষ নাকি বেঁচে আছে। সে হানিয়াকে তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করে–
–কেমনে? কোথায়? কিভাবে দেখলি? A to Z বল।
ওয়েটার তাদের অর্ডার করা খাবারগুলো দিয়ে গেলে,, হানিয়া আস্তে ধীরে কাল রাতের অভিযানের কথা বলে। ইনায়া যতই শুনছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। ইনায়া ভাবে ” এই মেয়ে হিস্ট্রি নিয়ে না পড়ে ডিটেকটিভ হতো তাহলে এতদিনে ভালোই নাম কামাতো” হানিয়া কথা শেষ করে চায়ের একটা সিপ নেয়। এত বড় ঘটনা বলতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে। ইনায়া সব কথা শুনে হা হয়ে যায়। হানিয়া তার পার্স থেকে ঔষধ গুলো বের করে ইনায়াকে দেখায়। তারপর বলে–
–আমার কাছে তো ফোন ছিলো না তাই ঔষধগুলোর ছবি আনতে পারতাম না। বুদ্ধি করে ঔষধ গুলো থেকে একটা করে ট্যাবলেট বের করে এনেছি। এগুলো ল্যাবে নিয়ে টেস্ট করলেই জানতে পারব ঔষধ গুলো স্পর্শ আপুর জন্য ঠিক কি না। কাজটা ভালো করেছি না বল?
হানিয়া কথা শেষ করে ইনায়ার দিকে তাকায় তার প্রশ্নের জবাবের জন্য। হুট করে ইনায়া বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হানিয়ার পায়ের কাছে বসে তাকে সালাম করতে গেলো হানিয়া লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অস্থির হয়ে বলে–
–কি করছিস এগুলো? পায়ে হাত দিচ্ছিস কেন?
ইনায়া তার গলাটা একটু উঁচু করে বলে–
–বইন তোরে হিস্ট্রি পড়তে কইছে কোন শালায়? তুই শার্লক হোমসের এসিস্ট্যান্ট হইতে পারবি। তোর গোয়েন্দাগিরির ট্যালেন্ট দেখে আমার এখন একটু অজ্ঞান হয়ে যেতে মন চাচ্ছে।
ইনায়ার উচু গলায় কথা বলার কারণে আশপাশের অনেকেই তাদের দিকে তাকায়। হানিয়া তাদের চাহনি দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে ইনায়াকে টেনে বসিয়ে দেয়। তারপর তার মাথায় হালকা করে একটা চাটি মেরে বলে–
–চুপ কর বেদ্দপ মহিলা। এখন ভাব এই ঔষধগুলো ল্যাবে টেস্ট করাবো কীভাবে? মানে আমরা এমন কেউ নই যে ল্যাবে গিয়ে বললেই ঔষধ গুলো টেস্ট করে দিবে। এর জন্য আমাদের একজন কারো হেল্পের প্রয়োজন। কে করবে আমাদের হেল্প?
হানিয়ার কথা শুনে ইনায়া ভাবনায় পরে যায়। দুজনেই গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে কে তাদের হেল্প করবে। কয়েক মিনিট পর হঠাৎই দুজনে একসাথে চিল্লিয়ে বল উঠে —
–ডা. এহসান কবির।
তাদের চিৎকারে আশপাশের মানুষ আবার অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়। হানিয়া-ইনায়ার হুশ আসলে বুঝতে পারে তারা আবারো একটা মিস্টেক করে ফেলেছে। হানিয়া তাড়াতাড়ি তাদের বিলটা পে করে দু’জনে কেটে পরে সেখান থেকে। পাশের একটা পার্কে গিয়ে হানিয়া ইনায়াকে বলে–
–ডা. কবিরের নাম্বার আছে তোর কাছে? থাকলে ফোন দে।
–হুম আছে। দিচ্ছি দাঁড়া।
ইনায়া তার ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডা.কবিরকে ফোন লাগায়। হানিয়া তাকে বলে ফোনটা লাউডস্পিকারে রাখতে। ইনায়া তাই করে। ডা.কবির তখন মাত্র ওয়ার্ডের রাউন্ড শেষ করে নিজের কেবিনে এসে বসেছিলো। ইনায়ার কল করেছে দেখে তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে। সালাম বিনিময় শেষ হলো ইনায়া ডা.কবিরকে বলে–
–এহসান আপনি ফ্রি আছেন এখন? আপনার চেম্বারে আসা যাবে?
ডা.এহসান কবির দুষ্টু হেঁসে বলে–
–পুরো দুনিয়ার জন্য আমি বিজি পার্সন হলেও আপনার জন্য আমি সবসময় ফ্রি ম্যাম। তা আজ এই অধমের প্রতি এতো দয়া হলো যে,, আমার আদরগুলো মিস করছেন বুঝি?
ডা.কবির নিজের মতো বকবক করেই চলছে। আর ফোনের এপাশে দু’জন যে তার কাজে হতভম্ব হয়ে গেছে তা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায় না। হানিয়া হতভম্ব হয়েছে ডা.কবিরের এমন অসভ্য সব কথা শুনে। লোকটাকে প্রথম দেখায় বেশ ভদ্র,,সভ্যই মনে হয়েছিলো। কিন্তু আজ তার কথা শুনে হানিয়ার মাথাই ঘুরে যায়। সে হা করে ইনায়ার দিকে তাকালে দেখে ইনায়া কেমন চোরের মতো মুখ করে আছে। হানিয়া তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তখন ইনায়া তাকে ইশারায় বলে “পরে বলছি বিষয়টা সম্পর্কে ” তারপর ফোনের লাউডস্পিকার অফ করে ফোনটা কানে নিয়ে বলে–
–চুপ করুন অসভ্য লোক। আপনার এই অসভ্য মার্কা কথা আরো একজন শুনে ফেলেছে। আপনার জন্য আমার ফেসলস হলো। আপনি চেম্বারেই থাকেন আমি আসছি আপনার অসভ্য কথাবার্তার ওটি করতে।
কথাটা বলে দুম করে ফোনটা কেটে দেয়। বেচারা ডা.কবির আহাম্মকের মতো ফোনটা এখনো কানে লাগিয়ে রাখে। কি হলো সব তার মাথার উপর দিয়ে গেছে।
ফোন কেটে দেওয়ার পর ইনায়া হানিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পায় হানিয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইনায়া একটা শুকনো ঢোক গিলে মেকি হাসি দিয়ে বলে–
–জান রাগ করিস না। যেতে যেতে কাহিনী বলছি।
হানিয়া মুখটা ভোঁতা করে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলে —
–আঙ্কেল ***** হসপিটালে চলুন।
–মা তোমার কি শরীর খারাপ করছে? আমি কি জাভিয়ান বাবাকে ফোন দিবো?
–না না আঙ্কেল। আসলে আমার এক ফ্রেন্ডের বাবু হয়েছে তো তাই তাকে দেখতে যাবো।
হানিয়ার কথার মধ্যে ইনায়া বা হাত ঢুকিয়ে বলে–
–কার বাবু….
ইনায়াকে কথাটা শেষ করতে দেয় না হানিয়া,, তার আগেই ইনায়ার মুখটা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝায় কিছু না বলতে। ইনায়া কাহিনি বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যায়। হানিয়া ড্রাইভার চাচাকে আবার তাড়া দিলে সে গাড়ি স্টার্ট করে ছুটিয়ে নিয়ে চলে হসপিটালের উদ্দেশ্য।
________________________
অন্যদিকে জাভিয়ান হানিয়ার টেনশনে বাকি দুইটা মিটিংও ক্যান্সেল করে দেয়। তার অসুস্থ বউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এটা শোনার পর থেকে সে এক মিনিটের জন্যও শান্ত হয়ে বসতে পারছে না। চেনা পরিচিত সকলকে ফোন দিয়ে হানিয়ার কথা জিজ্ঞেস করা শেষ,, কিন্তু কেউই হানিয়ার খোঁজ দিতে পারে না। এক পর্যায়ে জাভিয়ান অফিস থেকে বের হয়ে আশেপাশে খোঁজ করতে থাকে হানিয়ার। জাভিয়ান হানিয়ার ভার্সিটিতেও ঘুরে এসেছে কিন্তু সেখানেও কেউ হানিয়ার খোঁজ দিতে পারে না। চিন্তায় জাভিয়ান নিজের চুল দু’হাতে খামচে ধরে চিৎকার করে হানিয়ার নাম ধরে ডাকে–
–হানিয়াআআআআআআ! কই গেলে তুমি?
হানিয়া এখনও ভালোভাবে ঠিক হয়নি। হাই পাওয়ারের ঔষধ খেতে হয় তাকে যার কারণে শরীর যথেষ্ট দুর্বল। সেই শরীর নিয়েই হানিয়া বাবার বাসায় যাওয়ার নাম করে কোথায় গিয়ে বসে আছে জাভিয়ান জানে না। চিন্তিত জাভিয়ানের মাথা থেকে এ কথাটা বের হয়ে যায় যে হানিয়া তাদের বাসার গাড়ি করেই বাহিরে গিয়েছে। হানিয়ার কাছে না হয় ফোন নেই কিন্তু ড্রাইভার চাচার কাছে তো ফোন আছে। তাকে ফোন দিলেই তো হানিয়ার খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু জাভিয়ান এই কাজটা করতে ভুলে যায়। ফলে তাকে চরম দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে বাকি সময়টা পার করতে হয়।
________________________
ডা.এহসানকে সব বুঝিয়ে বাসায় আসতে আসতে হানিয়ার দুপুর হয়ে যায়। বাসায় ঢুকেই ড্রয়িংরুমে মি.তালুকদার, মিসেস তালুকদার আর রোজি বেগমকে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে। হানিয়া তাদের সামনে এসে চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে–
–কি হয়েছে তোমাদের? এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
হানিয়ার গলার আওয়াজ শুনে সকলে চমকে গিয়ে তার দিকে তাকায়। হানিয়াকে চোখের সামনে সুস্থ সবল দেখে তাদের কলিজায় পানি আসে। রোজি বেগম বসা থেকে উঠে ছুটে হানিয়ার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে। মি.তালুকদারও এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে–
–কোথায় গিয়েছিলে মা? আমরা সবাই তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।
হানিয়া মি.তালুকদারের কথা শুনে বুঝতে পারে,,সে যে ওই বাসায় যায় নি সেটা সকলে জেনে গেছে। কথাটা উপলব্ধি করতে পেরে এবার হানিয়ারই কলিজার পানি শুঁকিয়ে যায়। জাভিয়ান যদি একবার জানতে পারে এই খবর তাহলে তার পা ভেঙে ঘরেই সারাজীবনের জন্য বসিয়ে রাখবে। কথাটা মনে আসতেই তার হাতে পায়ে কাঁপুনি উঠে যায়। হানিয়া আমতা আমতা করে বলে–
–আসলে বাবা ওই বাসায় যাওয়ার সময় রাস্তায় আমার ফ্রেন্ড ইনায়ার সাথে দেখা হয়,,তার থেকে জানতে পারি আমার এক ফ্রেন্ডের বেবি হবে কিন্তু অবস্থা ক্রিটিক্যাল। আর তার আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না হওয়ায় তেমন উন্নত চিকিৎসাও করতে পারছে না। তাই আমি ওই বাসায় যাওয়ার চেয়ে আমার অসুস্থ ফ্রেন্ডের কাছে যাওয়াটা উচিত মনে করেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমার কিছু জমানো টাকা ছিলো সেগুলো দিয়ে দেই আর ইনায়াও তার থেকে কিছু দেয়। পরবর্তীতে সেগুলো হসপিটালে জমা দিলে তার চিকিৎসা শুরু হয়।
একটা সত্য বের করার জন্য আজ হানিয়াছে এতগুলো মানুষকে এতো এতো মিথ্যা বলতে হচ্ছে। হানিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই শায়লা বেগম খেঁকিয়ে উঠে বলে–
–তা এটা একটু ফোন করে বলা যাচ্ছিলো না মা জননী? তাহলে আমরা এমন টেনশন করে আমাদের ব্লাড প্রেশার হাই করি না।
হানিয়া মুখটা কালো করে জবাব দেয়–
–মা এক্সিডেন্টের সময় আমার ফোনটা হারিয়ে যায়। যা এখনো কেনা হয়নি,, আমার কাছে জমানো যেই টাকাগুলো ছিলো ভেবেছিলাম ওইগুলো দিয়ে আজকালের মধ্যেই একটা ফোন কিনে ফেলব কিন্তু তা তো হলাে না আর।
শায়লা বেগম খেঁকানোর জন্য আর কোন টপিক না পাওয়ায় চুপ করে অগ্নি দৃষ্টিতে হানিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মি.তালুকদার হানিয়াকে বলে–
–যাই হোক,,তুমি তোমার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও মা। আর তোমার খাবারটা কুলসুম রুমে দিয়ে আসবে।
–আচ্ছা বাবা।
রোজি বেগম তাকে রুমে দিয়ে নিজের রুমে চলে যান। হানিয়া বাহিরের কাপড় ছেড়ে বাসায় পরা এক সুট ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে মাত্রই বের হয় সে সাথে সাথে কেউ একজন দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। হানিয়া এমন কাজে থতমত খেয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর বুঝতে পারে তাকে জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটও হলো তার নিষ্ঠুর প্রিয়তম। লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরেই হাঁপাচ্ছে। হানিয়া তোয়ালেটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে নিজেও আঁকড়ে ধরে জাভিয়ানের পিঠ। হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে চায়। হুট করে জাভিয়ান তাকে ছেড়ে দিয়ে এলোপাতাড়ি চুমো দিতে থাকে হানিয়ার পুরো মুখজুড়ে। চুমো দেওয়া শেষ হলে আবারো হানিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে। হানিয়া অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তার কর্মকান্ড দেখতে থাকে।
সময় নিয়ে জাভিয়ান শান্ত হয়। হুট করেই তার মাথায় রাগ চেপে বসে। হানিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে হানিয়াকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে একহাত দিয়ে তার গাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলে–
–এই তুই কাকে জিজ্ঞেস করে বাহিরে গিয়েছিলি? হ্যাঁ? কাকে বলে গিয়েছিলি? পা বেশি বড় হয়ে গেছে না। মনে নেই কয়দিন আগে আধমরা হয়ে রাস্তায় পরেছিলি? আজও যদি ওমন হতো? জানিস তোর এখনো লাইফ রিস্ক আছে? যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে কি করতাম আমি?
হানিয়া শান্ত গলায় বলে—
–ভালো হতো আপনার জন্যও আমার জন্যও। আপনাকে আর নিত্যনতুন দিন আমাকে কষ্ট দেওয়ার আইডিয়া খুঁজতে হতো না আর আমাকে আপনার অত্যাচার সহ্য করা লাগত না। মরে গিয়ে সকলকে খুশী করে দিতাম। কিন্তু আফসোস!!!
হানিয়ার শান্ত গলায় বলা কথাগুলো জাভিয়ানকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। হানিয়ার গাল চেপে ধরা হাতটাও আলগা হয়ে যায়। নির্নিমেষে হানিয়া-জাভিয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন চোখে চোখে দু’জনে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেদের মনে কথাগুলো।
শব্দসংখ্যা~~১৬৩৭
~~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_পঁয়ত্রিশ(বর্ধিতাংশ)
সেদিন মাঝ রাতেও জাভিয়ান স্পর্শের কাছে যায়। হানিয়া সেটা টেরও পায় কিন্তু সে আর জাভিয়ানের পিছু নেয় না। সে তার মতো ঘুমিয়ে থাকে। পরের দিন জাভিয়ান-হানিয়া কেউ কারো সাথে কথা বলে না। জাভিয়ান কয়েকবার চেষ্টা করে কথা বলার কিন্তু হানিয়া বরাবরের মতো নিরুত্তর থাকে।
অফিস শেষে করে জাভিয়ান বাসায় আসলে দেখতে পায় হানিয়া রুমে নেই। চিৎকার করে ডাকতে থাকে হানিয়াকে। তার চিৎকার চেচামেচি শুনে হানিয়া রুমে আসলে দেখে জাভিয়ান অফিসের ড্রেসআপ না চেঞ্জ করেই বসে আছে আর তাকে ডাকছে। সে জাভিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,, স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করে–
–কি হয়েছে? ডাকছেন কেনো? আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছু তো হাতের কাছেই রেখে গিয়েছি।
জাভিয়ান চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। তারপর নিঃশব্দে একটা বক্স তার দিকে এগিয়ে দেয়। হানিয়া জাভিয়ানের হাতের দিকে তাকালে দেখতে পায় একটা নতুন ফোন তাও আবার আইফোন ব্র্যান্ডের। হানিয়া ভ্রু কুঁচকে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–
–সুন্দর হয়েছে। কিন্তু আমাকে দেখানোর কি আছে?
জাভিয়ান হতাশা হয়ে বলে–
–তোমার ফোন তাই তোমাকে দেখাচ্ছি।
–আমি বলেছি আমার ফোন লাগবে? আর এত দামী ফোন আমি নিতে পারব না। তাছাড়া আমার কাছে টাকা আছে,, সেটা দিয়েই আমি নিজের জন্য ফোন কিনতে পারব।
–প্রথমত,, তুমি বলোনি তোমার ফোন লাগবে কিন্তু আমি নিজ থেকে এনে দিয়েছি। দামের ব্যাপারে তোমায় না ভাবলেও চলবে। আর দ্বিতীয়ত,, কাল বাবা বলেছে আমায় তোমার ফ্রেন্ডের কথা,, তোমার ফ্রেন্ডকে নাকি তোমার জমানো সব টাকা দিয়ে দিয়েছ তাহলে এখন টাকা পেলে কোথায়? তাহলে কি কালকে তুমি মিথ্যা বলেছ বাবাকে?
জাভিয়ানের প্রশ্ন শুনে হানিয়া থতমত খেয়ে যায়। সে যে মিথ্যা বলেছে এটা সঠিক কিন্তু সত্যিটাও তো জাভিয়ানকে জানাতে পারবে না। কি বলবে? কি বলবে? ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা কথা আসে। সে জাভিয়ানকে বলে–
–মিথ্যা না। সত্যিই বলেছি। আর রইলো টাকার কথা। টাকা ভাই দিয়েছে। প্রতি মাসে ভাই আমাদের দু’বোনকে পকেটমানি দেয় পাঁচ হাজার করে। এই মাসেও পাঠিয়েছে। বিয়ের পর সেই টাকাগুলো তেমন একটা খরব হয়নি। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরে আছে। ওগুলো তুললেই আমার ফোন কেনা হয়ে যাবে। হয়েছে? পেয়েছেন প্রমাণ সহ উত্তর? আর কিছু জিজ্ঞেস না করলে আমি কি যেতে পারি?
হানিয়ার কথা শুনে জাভিয়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিয়ের পরও তার ভাইয়ের থেকে পকেটমানি নিয়ে সে কি প্রমাণ করতে চায় যে,,জাভিয়ানের সামর্থ্য নেই হানিয়াকে হাত খরচ দেওয়ার? জাভিয়ান বসা থেকে উঠে হানিয়ার একদম মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। হানিয়া তাকে নিজের এত কাছে আসতে দেখে পেছনে সরে যেতে নিলে জাভিয়ান খপ করে তার বাম হাত দিয়ে হানিয়ার কোমড় চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। তারপর দাত কিড়মিড়ি করে বলে–
–আমার দেওয়া ফোনই তোমাকে ইউজ করতে হবে। আর তোমার ভাইয়ের থেকে কোন প্রকার টাকা নিবে না। ইটস মাই অর্ডার।
–আমি নিবো। আমি কোন পরপুরুষের অবৈধ টাকা নেই না, একি মায়ের পেটের সন্তান আমরা। আমার ভাইয়ের থেকে নিতে পারব না এটা আপনার বলার কোন অধিকার নেই।
হানিয়াও পূর্ণ তেজে কথাগুলো বলে। হানিয়ার এমন তেজ আর অধিকার নিয়ে কথা বলায় জাভিয়ানের মেজাজের পারদ বাড়তেই থাকে। সে হানিয়ার কোমড় ছেড়ে তার চোয়াল চেপে ধরে আগের থেকেও শক্ত করে। তারপর রাগে হিসহিসিয়ে বলে–
–এই আমার অধিকার নেই তোর উপর তাহলে কার আছে? একদম আমাকে রাগাবি না,,কয়েকদিন ধরে ভালো ব্যবহার করছি বলে আগে আমিকে হয়ত ভুলে গেছিস। আমার কথার একচুল নড়চড় হলে তোকে সেই দু’মাস আগের দিনগুলোতে নিয়ে যেতে আমি দু’বার ভাববো না। তুই আমার,,তোর চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত এমনকি তোর রুহের উপর উপরওয়ালার পর একমাত্র আমার অধিকার। এই আমার সামর্থ্য নেই তোর হাত খরচ চালানোর যে তোর ভাইয়ের টাকা নিতে হবে তোর?
হানিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে কি পারে না। তাই সে ওই অবস্থাতেই বলে–
–আপনার অধিকার আছে আমার উপর আর আমার ভাইয়ের নেই? সে কি পারবে না তার বোনকে কিছু দিতে?
–পারবে। কিন্তু এভাবে না। যা বললাম বলে দিবি তোর ভাইকে।
কথাটা বলে হানিয়াকে একপ্রকার ছুড়ে ফেলার মতো করে ছেড়ে দিয়ে জাভিয়ান চলে যায় ওয়াশরুমে। হানিয়া ওখানে দাঁড়িয়েই চোখের পানি ফেলতে থাকে।
_________________
আরো কয়েকটা দিন চলে যায়। হানিয়া আবারও তার ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছে,,কিন্তু অনেক শর্ত মেনে চলতে হয়। এই শর্তদাতা যে জাভিয়ান তালুকদার তা বুঝতে আর বাকি থাকে না। আজ হানিয়া কলেজ শেষ করে ডা.এহসান কবিরের কাছে যাবে ইনায়াকে নিয়ে। ঔষধ গুলো টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছিলো সেগুলোর রিপোর্ট এসে পরেছে। হানিয়া সেই রিপোর্ট সম্পর্কেই জানতে যাবে।
হানিয়া ড্রাইভারকে দেরি করে আসতে বলেছে। তিনটা ক্লাস হওয়ার কথা ছিলো হানিয়াদের আজ কিন্তু দুটো ক্লাস করেই হানিয়া-ইনায়া বের হয়ে আসে ক্লাস থেকে। ইনায়ার আনা গাড়িতে করেই তারা হসপিটালে যায়। ডা.এহসান ওই সময়ে ফ্রি থাকায় তারা গিয়েই রিপোর্ট সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করে।
ডা.এহসান রিপোর্ট গুলো হানিয়ার সামনে রেখে মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে–
— আমি তেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না তাই সোজাসাপ্টা ভাবেই বলছি,, তোমরা পেশেন্টকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছো।
ডা.এহসানের কথা শুনে হানিয়া-ইনায়ার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। হানিয়া অবাক গলায় বলে–
–মানে? আমরা কেন আপুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবো?
–তোমরা না দিতে চাইলে এই ঔষধ গুলোত সেই কথাই বলছে। এই ঔষধ গুলো জানো কিসের কাজ করে?
হানিয়া না বোধক মাথা নাড়ায়। ডা.এহসান বলে–
–তুমি আমাকে যেই ঔষধগুলো টেস্ট করাতে দিয়েছিলে সেগুলো মধ্যে কিছু ঔষধ পেশেন্টের স্মৃতিশক্তি ফিরতে বাধা দিচ্ছে আর কিছু ঔষধ পেশেন্টের ব্রেন ড্যামেজ করে দিচ্ছে। এই ঔষধ গুলো আর কিছুদিন দেওয়া হলে পেশেন্টের হয়ত ব্রেন হ্যামারেজ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
ডাক্তারের কথা শুনে হানিয়ার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যায়। এত ভয়াবহ ঔষধ গুলো জাভিয়ান কিভাবে তার আদরের বোনকে দিচ্ছে? ডা.এহসান আবার বলেন–
–সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে তোমার বলা ইনজেকশনটা। আমি এটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে যা জানতে পেরেছি তাই তোমাকে বলছি। ইনজেকশনটার উদ্দেশ্য হলো কারো মাইন্ডকে কনট্রোল করা। এটা কোন ঔষধই নয় বরং ভয়াবহ এক প্রকার ড্রাগস। এটা কাউকে দেওয়া হলে তার ব্রেন কয়েক মিনিটের মধ্যে একদম শান্ত হয়ে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তখন তাকে যেই নির্দেশনা দেওয়া হবে সে তাই করবে। এই ঘোর ২-৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আস্তে আস্তে যখন রোগীর ঘোর কাটতে থাকে তখন থেকে সে নিজের চেতনায় ফিরতে থাকে। কিন্তু আমি যেহেতু বললাম এটা ড্রাগস তাই ব্যক্তিটি আবারও সেটা নিতে চাইবে। যদি তৎক্ষনাৎ তাকে ওটা না দেওয়া হয় তাহলে সে এগ্রেসিভ হয়ে নিজের বা তার আশেপাশের মানুষের ক্ষতি করে দিতেও দু’বার ভাববে না। আরেকটা কথা,,এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটা ড্রাগসটা যদি হঠাৎই নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে পেশেন্টের মৃত্যুও হতে পারে।
[বিঃদ্রঃ আমি ড্রাগসটার নাম উল্লেখ করি নি কিছু দুষ্টু পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। নামটা উল্লেখ করলেই তারা দৌড়ে গুগল মামার কাছে গিয়ে এর নাড়িনক্ষত্র বের করবে। গল্পের স্বার্থে আমার দেওয়া ইনফরমেশনের কয়েক জায়গায় কাটছাট করতে হয়েছে তো কয়েক জায়গায় একটু বাড়িয়ে বলতে হয়েছে। ভুল হয়েছে কিছুটা আমি জানি তাই বলবো, ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]
ডা.এহসান তার কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দম নেয়। তার ডেস্কে রাখা পানির গ্লাস থেকে একটু পানি পান করে গলায় ভিজিয়ে তারপর হানিয়াদের দিকে তাকায়। দেখতে পায় হানিয়া-ইনায়া একদম “থ” হয়ে বসে আছে। ডা.এহসান বুঝতে পারে ঝটকাটা একটু বেশি জোরেই লেগেছে। সে তার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে —
–শান্ত হও হানিয়া। এখনি এতোটা ভেঙে পরলে চলবে না। তুমি যদি শক্ত না হও তাহলে আসল কালপ্রিটকে এই জঘন্য কাজটার শাস্তি দিবে কে?
হানিয়া নিশ্চুপ,,নিরুত্তাপ থাকে। সে ভীষণ শক পেয়েছে এই তথ্য গুলো জেনে। ডা.এহসান ইনায়াকে চোখ দ্বারা ইশারা করে “হানিয়াকে সামলাতে বলে” ইনায়া তাই করে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হানিয়া স্বাভাবিক হয়। তারপর ভাঙা গলায় বলে–
–কিছু একটা করুন ভাইয়া। আপু…. (গলা ভেঙে আসতে চায় হানিয়ার,,কথা বের হচ্ছে না তার গলা দিয়ে) আপু শুধু কষ্টই পেয়ে আসছে। আমার ভাইকে ভালোবেসে আজ সে একদম নিঃস্ব,, উন্মাদ হয়ে গেছে। আমি মানতে পারছি না আমার ভাইয়ের জন্য আজ একটা ফুলের মতো মেয়ের এই অবস্থা।
কথাটা বলতে বলতে হানিয়া কান্নায় ভেঙে পরে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ডা.এহসান আর ইনায়া মিলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে,,কারণ এইভাবে ব্রেনে প্রেশার নেওয়া বা এমন হাউমাউ করে কাঁদা তার জন্য নিষেধ। এতে তারই ক্ষতি হবে। হানিয়াকে যখন অনেক বুঝিয়েও শান্ত করা যাচ্ছিল না তখন ডা.এহসান তাঁকে জোরে একটা ধমক লাগায়। আর বলে–
–বলছি না শান্ত হতে? এমন ভাবে কান্না করে যে নিজের ক্ষতি নিজেই ডেকে আনছো বুঝতে পারছো তুমি? তুমিই যদি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে থাকো তাহলে তোমার আপুকে সুস্থ করবে কীভাবে? আসল কালপ্রিটকে শাস্তি দিবে কিভাবে?
ডা.এহসানের ধমকে আর কথায় কাজ হয়। হানিয়া চুপ করে বসে তার কথা শুনতে থাকে। হানিয়াকে শান্ত হতে দেখে ডা.এহসান এবার কিছুটা নরম গলায় বলে–
–শুনো আমরা চাইতো এখনো তাকে সুস্থ করতে পারি। কিছু মেডিসিন,, কাউন্সেলিং আর আপন মানুষদের ভালোবাসায় সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে ইনশা আল্লাহ।
ডা.এহসানের কথায় হানিয়া মনে একটা আশার আলো জ্বলে উঠে। এর মধ্যে ইনায়া বলে —
–কিন্তু আমি বুঝলাম না ভাইয়া এতো ভয়াবহ আর ক্ষতিকারক ঔষধ গুলো আপুকে কিভাবে দিতে পারছে,? এতো আদরের বোনকে নিজের হাতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিভাবে?
তার কথায় ডা.এহসান আর হানিয়াও চিন্তায় পরে যায়। ডা.এহসান বলে–
–এটা তো মি.তালুকদারই বলতে পারবে।
হুট করে হানিয়ার একটা কথা মনে পরে যায়। সে ইনায়াকে বলে–
–আমার মনে হচ্ছে এসবের পেছনে জাভিয়ান না অন্য কেউ আছে?
ডা.এহসান আর ইনায়া দুজনে একসাথে বলে–
–মানে? কে সে?
–মি.চৌধুরী নামের কেউ একজন।
ইনায়া জিজ্ঞেস করে–
–কে সে? আর তুই বা তার কথা জানলি কীভাবে?
হানিয়া বলে–
–আমার স্পষ্ট মনে আছে,, যেদিন উনার পিছু নিয়ে আপুকে খুজে পেলাম ওইদিন মিসেস জুলিয়া মানে আপুর নার্স যে,, উনি বলেছিলেন মি.চৌধুরীর কনসালটেড ডাক্তারের ঔষধ আপুকে দেওয়া হচ্ছে। তারমানে এই মি.চৌধুরীই ঔষধ গুলোর মধ্যে কোন একটা ঘাপলা করেছে বা তার কনসালটেড ডাক্তার দ্বারা সে করিয়েছে।
হানিয়ার কথা শুনে ডা.এহসান আর ইনায়া হা হয়ে যায়।
শব্দসংখ্যা~১৪৬০
~~চলবে?