#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ছত্রিশ
হানিয়া আর ইনায়া ডা.এহসানের কাছ থেকে ফিরছে ইনায়ার গাড়িতে করে। হানিয়া ড্রাইভার আঙ্কেলকে যেই সময়ে আসতে বলেছিলো তার থেকেও দেরি হয়ে গেছে তাদের ফিরতে। ইনায়া এই বিষয় নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তা করলেও হানিয়া একদম শান্ত হয়ে বসে বাহিরের পরিবেশ দেখছে। ইনায়া ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকায়,,মেয়েটার মুখটা একদম চুপসে গিয়েছে। যে কেউ তার মুখ দেখে বলে দিতে পারবে তার মন আজ ভয়াবহ রকমের খারাপ। ইনায়া হানিয়ার একটু কাছাকাছি এসে বসে তার হাতের উপর হাত রাখে। নিজের হাতের উপর কারো স্পর্প পেয়ে হানিয়া স্পর্শ করা ব্যক্তির দিকে তাকায়। ইনায়া তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে–
–দোস্ত মন খারাপ করিস না। এহসান তো বললো স্পর্শ আপুর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তুই যদি এতটা ভেঙে পরিস তাহলে তাকে সুস্থ করবি কীভাবে? নিজেকে একটু শক্ত কর।
হানিয়া মলিন হেঁসে সম্মতি দেয় —
–হুম।
তাদের কথা মধ্যেই গাড়ি এসে কলেজের পেছনের গেইটে উপস্থিত হয়। সেখান দিয়ে তারা কলেজে প্রবেশ করে। তারপর তাদের এক ক্লাসমেট থেকে লাস্টের ক্লাসের পড়া নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে আসে। ইনায়া তার বাসার গাড়িতে করে চলে যায়,,হানিয়াও তাদের গাড়ির উদ্দেশ্য যায়। গাড়ির কাছে এসে হানিয়া একটু চমকে যায়। জাভিয়ান এসেছে তাকে নিতে। জাভিয়ান গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন চালাচ্ছে। শীতকাল হলেও আজ ভালোই গরম পরেছে,, হালকা পাতলা ঘেমে যাওয়ায় ভারী চোয়ালওয়ালা মুখটা লাল হয়ে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
হানিয়া পা চালিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জাভিয়ান ফোন থেকে মুখ তুলে। দেখতে পায় তার অপ্রিয় বঁধূয়া দাঁড়িয়ে আছে মলিন মুখ নিয়ে। হানিয়ার মলিন মুখটা দেখে নিমিষেই জাভিয়ানের মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি হয়েছে তার বঁধূয়ার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি কেউ কিছু বলেছে? নাকি তাঁকে দেখেই সদা হাসতে থাকা গোলগাল ওই মুখ টায় অমাবস্যার অন্ধকার দেখা দিয়েছে? নিজের মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো চেপে না রেখে জাভিয়ান জিজ্ঞেসই করে ফেলে–
–কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?
–কিছু হয় নি। মন খারাপ হবে কেন আবার। তা আজ আপনি আসলেন যে?
জাভিয়ান বুঝল হানিয়া তাকে নিজের মন খারাপের কারণ জানাতে চায় না। জাভিয়ানও জোর করে না,,সবসময় সব জায়গায় জোর খাটানো যায় না। আর বিষয়টা যদি হয় মনের সাথে সম্পর্কিত তাহলো তো আরো আগে যায় না। জাভিয়ান হানিয়ার প্রশ্নের জবাবে বলে–
–অফিসে তেমন কাজ ছিলো না তাই ভাবলাম আজ আমি আসি তোমাকে নিতে। কেন কোন সমস্যা আছে আমি নিতে আসলে?
হানিয়ার মুড আজ একদমই ভালো না তাই বেশি কথাও বলতে মন চাচ্ছে না তার। সে ছোট করে বলে —
–না কোন সমস্যা নেই। চলুন তাহলে, বাসায় যাওয়া যাক।
–হুম।
জাভিয়ান হানিয়ার জন্য গাড়ির দরজা খুলে তাকে বসায় তারপর নিজেও বসে পরে ড্রাইভিং সিটে। জাভিয়ান ড্রাইভ করার পাশাপাশি আঁড়চোখে হানিয়ার দিকে তাকায়,,দেখে হানিয়া চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে। মুখটা শুঁকনো,, দুপুর প্রায় একটা বাজতে চলল কিছু খাওয়া হয়নি হয়ত হানিয়ার। জাভিয়ান নিস্তব্ধতা ভেঙে নিজেই জিজ্ঞেস করে–
–আজকে এতো লেট হলো যে?
হানিয়া চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলে–
–এক্সট্রা ক্লাস ছিলো,, ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলে দিয়েছিলাম।
জাভিয়ান কথা বাড়ানোর মতো আর কোন কথা পায় না। তাই সেও চুপ করে বসে থাকে। চোখ বন্ধ করে রাখায় হানিয়া কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরেছিলো,, তখনই জাভিয়ান তাকে ডাক দেয় বাসায় এসে পরেছে তাই। হানিয়া তার ডাকে চোখ মেলে তাকালে জাভিয়ান দেখতে পায় হানিয়ার চোখ অনেক লাল হয়ে আছে। জাভিয়ান অস্থির হয়ে হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–চোখ এতো লাল হয়ে আছে কেন তোমার? মাথা ব্যথা করছে আবার?
–হুম।
হানিয়ার এই ছোট্ট জবাব জাভিয়ানকে অস্থির করার জন্য যথেষ্ট। জাভিয়ান কোন কিছু বলার আগেই হানিয়া গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটা দেয়। জাভিয়ানও তার পেছন পেছন ছুট লাগায়। হানিয়া বাসায় এসে তার জামাকাপড় নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। জাভিয়ানের সাথে কথা বলার মনমানসিকতা নেই তার এখন।
__________________
হানিয়া একটা কথা ভাবতে ভাবতে পাগলপ্রায়। কথাটা হলো- ডা.এহসানের ঔষধগুলো স্পর্শকে দিবে কিভাবে? কীভাবে ভুল ঔষধগুলো চেঞ্জ করবে? চিন্তায় আবারও তার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। হানিয়ার এক্সিডেন্টের পর ডা. তাকে কড়াকড়ি করে নিষেধ করে দিয়েছে মাথায় কোন প্রকার চাপ দিতে। এটা তার জন্যই ক্ষতিকারক। কিন্তু সে একটু সুস্থ হওয়ার পর থেকেই তো লেগে পরেছে স্পর্শকে খুজে বের করার কাজে। আর এর জন্য তাকে প্রতিনিয়ত দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
হানিয়া কোন উপায় না পেয়ে ইনায়াকে ফোন লাগায়। ইনায়াকে কল লাগানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে ফোন রিসিভ করে। প্রাথমিক কয়েকটা কথা শেষ হওয়ার পর হানিয়া ইনায়াকে বলে–
–দোস্ত আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না স্পর্শ আপুকে ঔষধ গুলো কিভাবে দিবো?
–আমিও তাই ভাবছি। আচ্ছা আমরা ভাইয়ার অগোচরে সেখানে গিয়ে মিসেস জুলিয়াকে সব বুঝিয়ে বলে ঔষধ গুলো চেঞ্জ করে দিয়ে আসলে কেমন হয়?
–বিষয়টা একটু রিস্কি হয়ে যায়। বাসার ভেতরে কাজটা করতে গেলে কারো না কারো কাছে ধরা অবশ্যই পরবো। কাজটা বাড়ির বাহিরে করলে ভালো হয়।
–হুম। তাহলে মিসেস জুলিয়াকে কোথাও ডাকি? কি বলিস?
–হুম এটাই করবো। আমি নজর রাখবো তার উপরে কখন কখন সে বের হয়। তারপর সুযোগ দু’জনে একসাথে সকল প্রমাণ সহ কথাগুলো বললে হয়ত সে বিশ্বাস করবে। আর কাজটা তাড়াতাড়ি করতে হবে। নাহলে আপুর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে সমস্যা হবে।
–হুম। তোর মন কি এখানো খারাপ?
–আর আমার মন খারাপ।(তাচ্ছিল্য করে বলে) আমার ভাগ্যই খারাপ সেখানে মন খারাপ নিয়ে চিন্তা করা বোকামি।
–ধুরু বেডি। আজাইরা কথা। আচ্ছা দোস্ত পরে কথা বলছি,,আম্মু ডাকছে।
–আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।
দু’জনে দুজনার থেকে বিদায় নেয়। হানিয়া ফোন কেটে পিছনে ঘুরলে জাভিয়ানকে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পরাণপাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। জাভিয়ান এখানে কেন? সে না বাহিরে গিয়েছিলো,,তাহলে কখন আসলো? সে কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে? সে কি আমার কথাগুলো শুনে ফেলেছে? জাভিয়ান জানতে পারলেও হানিয়ার কথাগুলো বিশ্বাস করবে কিনা হানিয়া জানে না।
হানিয়া তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করে–
–আপ..নি?
জাভিয়ান কোন উত্তর দেয় না। সে একপা একপা করে হেটে হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। হানিয়া ভয়ে ভয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিলে। জাভিয়ান তার মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে–
–কলেজ থেকে ফেরার সময় কতবার মন খারাপ কেন জিজ্ঞেস করেছিলাম,,তখন বললে মন খারাপ না। এখন আরেকজনের কাছে ভাগ্য খারাপ বলছিলে। আপনার ভাগ্য যে খারাপ এটা আপনি আজ বুঝতে পারলেন মিসেস তালুকদার?
হানিয়া জাভিয়ানের কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারে না। তার মাথায় তো ঘুরছে জাভিয়ান তার কথা কতটুকু শুনেছে এটা। হানিয়ার চুপ থাকা জাভিয়ানকে রাগিয়ে দেয়। মেয়েটা আফসোস করছে তাকে বিয়ে করে। এটাই তো চেয়েছিলো সে। হানিয়ার কষ্ট,, মির্জা বাড়ির হাহাকার,,কষ্ট। কিন্তু জাভিয়ান কেন যেন আজ তা মেনে নিতে পারছে না।
জাভিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর হানিয়ার সামনে থেকে সরে কাবার্ডের কাছে গিয়ে নিজের জামাকাপড় নিতে নিতে বলে–
–তোমার কোন আপুর অবস্থা খারাপ হবে? কি হয়েছে তার? আর কি করার কথা বলছিলে ফোনে তুমি?
জাভিয়ানের কথাগুলো শুনে হানিয়া বুঝতে পারে সে শুধু শেষের কথাগুলো শুনেছে। হানিয়ার এতক্ষণ চেপে রাখা শ্বাস ফুস করে ছাড়ে। অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। হানিয়া আমতা আমতা করে বলে–
–আসলে আমার এক সিনিয়র আপুর কথা বলছিলাম আমার ফ্রেন্ডকে। সে একটা পরামর্শ চেয়েছিলো তাই ওই কথাগুলো বলা।
হানিয়ার এমন আমতা আমতা করে বলা কথাগুলো জাভিয়ানের বিশ্বাস হয় না। তাও কিছু বলে না। চুপচাপ চলে যায় ফ্রেশ হতে। হানিয়াও তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে আসে।
__________________
পরপর ৩/৪ দিন হানিয়া রাতদিন এক করে মিসেস জুলিয়ার দিকে নজর রাখে। স্পর্শর খেয়াল রাখার জন্য জাভিয়ান দু’জন নার্স রেখেছে। একজন হলো মিসেস জুলিয়া আরেকজন হলো কম বয়সী একজন নার্স। তাদের মধ্যে মিসেস জুলিয়া একদম পুরোনো এবং সে একদম শুরু থেকে স্পর্শর খেয়াল রাখছে। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি করে ওই নার্স আর মিসেস জুলিয়া তার পরের সময়গুলো স্পর্শর সাথে থাকে। হানিয়া মিসেস জুলিয়ার আসা-যাওয়ার বিষয়টি ইনায়াকে বলে। সেই অনুযায়ী আজ তারা ঠিক করেছে মিসেস জুলিয়ার সাথে দেখা করবে।
জাভিয়ান ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে একটু আগে। রাতের প্রায়ই অনেকটা সময় সে তার বোনের সাথে কাটায়। কখনো স্পর্শ জেগে থাকে তো কখন ঘুমিয়ে থাকে। যেহেতু রাত জেগে জাভিয়ান স্পর্শর কাছে বসে থাকে তাই যখন স্পর্শর কাছ থেকে এসে ঘুমায় তখন তার ঘুমটা হয় গভীর। হানিয়াও আজ ফজরের পর আর ঘুমায়নি। ছয়টা বাজার পনেরো মিনিট আগে সে রুম থেকে বের হয়। শীতকাল তাই সবাই নামাজ পড়ে আবার শুয়েছে। উঠবে সাড়ে সাতটা কি আটটায়।
হানিয়া রুম থেকে বের হয়ে ইনায়াকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলে তাদের বাড়ির পেছনের গেইটে। কারণ মিসেস জুলিয়া আর অপর নার্সটু ওই গেইট দিয়েই যাওয়া আসা করে। হানিয়া বাসা থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি করে বাড়ির পেছনের দিকে যায়। দারোয়ান তাকে এত সকালে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে হাঁটতে বের হয়েছে। হানিয়া ইনিয়েবিনিয়ে এটাও তাকে বলে “সে যেনো হানিয়ার এত সকালে বের হওয়ার কথা জাভিয়ানকে না জানায়,তাহলে জাভিয়ান তাকে বকবে।” দারোয়ানের বিষয়টা একটু কেমন লাগলেও পরে হানিয়ার কথায় সম্মতি দেয়।
হানিয়া বাসার পেছনের দিকে এসে দেখে ইনায়া তার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি করে ইনায়ার গাড়িতে গিয়ে বসে পরে। তার মিনিট দুয়েক পরই মিসেস জুলিয়া পেছনের গেইট দিয়ে বের হয়। ইনায়া নিজেই গাড়ি চালাতে পারে তাই সে চটজলদি গাড়ি চালিয়ে মিসেস জুলিয়ার সামনে এসে থামে। তারপর দুই বান্ধবী একপ্রকার অপহরণ করে মিসেস জুলিয়াকে নিয়ে আসে তাদের বাসার থেকে একটু দূরের এক পার্কে। মিসেস জুলিয়া প্রথমে চিৎকার চেচামেচি করলেও পরবর্তীতে যখন হানিয়াকে দেখে সে শান্ত হয়ে যায়। হানিয়াকে সে চিনে। হানিয়া মিসেস জুলিয়াকে বলে–
–আন্টি আপনি ভয় পাবেন না। আমরা কিছু জরুরি কথা বলবো আপনি মন দিয়ে সব কথা শুনবে। তারপর যা বলার বলেন।
মিসেস জুলিয়া মাথা নাড়িয়ে হানিয়ার কথায় সম্মতি দেয়। তারপর হানিয়া ইনায়ার কাছ থেকে সব রিপোর্টসগুলো নিয়ে মিসেস জুলিয়াকে দেখায় এবং পুরো ঘটনা শর্টকাটে বলে। হানিয়া তাকে এ-ও জানায় সে কীভাবে করে ঔষধ গুলো স্পর্শর রুম থেকে চুরি করেছে। সবটা শুনে মিসেস জুলিয়া কথা বলতে বা কোন প্রকার রিয়াকশন দিতে ভুলে যায়। মিসেস জুলিয়া স্পর্শকে মন থেকেই ভালোবাসে আর ছোট বোনের মতো স্নেহ করে। সেই ছোট বোনের মতো মেয়েটার সাথে যে এতো কিছু হয়েছে আর এখনো হচ্ছে এটা শুনে সে ভীষণ কষ্ট পায়। মিসেস জুলিয়া হানিয়াকে বলে—
–তাহলে তোমরা স্যারকে কেন জানাচ্ছ না? সে যদি জানে তার বোনকে কেউ এমন ভুল ঔষধ দিয়ে তালে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার জানটাই স্যার নিয়ে নিবে। সে ভীষণ ভালোবাসে নিজের বোনকে। তোমরা স্যারকে সত্যটা বলে দাও।
হানিয়া অস্থির হয়ে বলে–
–না না আন্টি। উনাকে এখনি এসব জানালে সে বিশ্বাস করবে না। ভাববে আমি আমার ভাইয়ের দোষটা ঢাকতে এসব বলছি। আমরা(হানিয়া+ইনায়া) চাচ্ছি আপুকে সুস্থ করে তারপর আপুর মুখ দিয়ে উনাকে সত্যিটা জানাতে। আর আপুকে সুস্থ করতে আমাদের আপনার সাহায্য ভীষণই প্রয়োজন।
–বলো আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবো।
মিসেস জুলিয়ার কথা শুনে হানিয়া-ইনায়ার মুখে হাসি ফুটে। হানিয়া মিসেস জুলিয়াকে ডা.এহসানের দেওয়া ঔষধগুলো দেয় আর বলে–
–এই ঔষধ গুলো আপনি আপুকে লুকিয়ে দিবেন। মানে জাভিয়ান আর মি.চৌধুরী জানবে আপনি আপুকে আগের ঔষধগুলোই দিচ্ছেন কিন্তু শুধু আপনি জানবেন সত্যটা। এগুলো আপনি নিজের কাছে রাখবেন,, যখন আপুকে ঔষধ দেওয়ার সময় হবে তখন ওই ঔষধগুলোর পরিবর্তন এগুলো দিবেন। আর পনেরো দিন পর একবার করে আপুকে কাউন্সিলিংয়ের জন্য নিতে হবে।
–আচ্ছা সেটা না হয় আমি করলাম। কিন্তু আমি তো রাতের ডোজটা দিতে পারব কিন্তু সকালে আর দুপুরের ডোজটা সময় তো আয়েশা(আরেকজন নার্স) থাকে। তখন কিভাবে ঔষধ পরিবর্তন করবো? আর কাউন্সিলিং? এটাই বা তাদের চোখ ফাকি দিয়ে কিভাবে করবো?
মিসেস জুলিয়ার একথা শুনে হানিয়া একটু চিন্তায় পরে যায়। তখনই ইনায়া বলে–
–আমরা যেমন ভাবে আপনাকে সবটা জানিয়েছি তাকেও জানাবো,,যদি সে আপোষে না মানে তাহলে টাকার লোভ দেখাবো। আমার মনে হয় এটা পন্থাটা কাজে দিবে। আর রইলো কাউন্সিলিংয়ের ব্যাপারটা। এটার জন্যও একটা না একটা উপায় বের করে ফেলবো আমরা।
হানিয়া-মিসেস জুলিয়া তার কথায় একটু আশার আলো দেখতে পায়। তারা ঠিক করে সন্ধ্যায় যখন মিসেস জুলিয়া স্পর্শর কাছে আবার আসবে আর আয়েশা(নার্স) তার ডিউটি শেষ করে বের হবে তখনই তার সাথে কথা বলবে এবং ঔষধগুলো দিবে। যাতে করে স্পর্শের নতুন ঔষধগুলোর ডোজ কাল থেকেই শুরু করতে পারে।
____________
মিসেস জুলিয়ার সাথে কথা বলে হানিয়া বাসায় আসে। রুমে ঢুকে জাভিয়ানকে বেডের উপর বসে থাকতে দেখে চমকে যায়। সকাল সকাল এই কি বিপদে পরতে হবে তাকে আবার? পাগলটা একটু আগে না ঘুমালো তাহলে আজ আবার এখনি উঠে পরলো যে ঘুম থেকে।
জাভিয়ান গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে–
–এই ভোরে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
–নিচে গিয়েছিলাম।
–শুধুই নিচে?
–হুম।
–তা কি করতে?
হানিয়া কি বলবে ভেবে পায় না। ভয়ে ভয়ে বলে–
–পানি খেতে।
হুট করে জাভিয়ান হুংকার দিয়ে বলে–
–আর একটা মিথ্যা বললে জিভ ছিঁড়ে ফেলবো টেনে। বাসার বাহিরে গিয়েছিলি কেন তুই এই সাতসকালে?
জাভিয়ানের এমন হুংকার আর কথা শুনে হানিয়া ভয়ে কেঁপে উঠে। জাভিয়ান কীভাবে জানল তার বাহিরে যাওয়ার কথা? দারোয়ান কি তাহলে জাভিয়ানকে জানিয়ে দিয়েছে তার বাহিরে যাওয়ার কথা?
শব্দসংখ্যা~১৯০৭
~~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_সাতত্রিশ
[পর্বটা রোমাঞ্চধর্মী,, যাদের রোমান্স পছন্দ না তারা চাইলে স্কিপি করতে পারেন ]
গত একঘন্টায় হানিয়া রোজি বেগমকে গুণে গুণে পঞ্চাশটা চুমু দিয়েছে। আরে কতশত আদর যে করেছে তার হিসেব নেই। করবেই বা না কেন? তাকে ওই রাক্ষসরাজের থেকে বাঁচিয়েছে তো এই মহীয়সী নারীই।
যখন জাভিয়ান হানিয়ার উপর বিশ্রী ভাবে হুংকার দিয়ে উঠেছিলো,,সেই হুংকারের আওয়াজ রোজি বেগমও পেয়েছিলেন। জাভিয়ানের রুমে একরুম পরেই রোজি বেগমের রুম,,সে নামাজ পরে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত শেষে বেলকনিতে বসে ছিলেন তখনই জাভিয়ান ওই হুংকার শুনতে পান। জাভিয়ানের ওমন ধমক আর কথা শুনে সে ভয় পেয়ে যান এইভেবে যে, জাভিয়ান হয়ত আবারও হানিয়াকে মা”রছে,, তাই সে তড়িঘড়ি করে তাদের রুমে আসেন। দরজা লক করা ছিলো না দেখে সে সরাসরি রুমে ঢুকে জাভিয়ানের মারমুখো মুখভঙ্গি দেখে সে একদম সিউর হয়ে যান নিজের ভাবনায়। তাই সে জাভিয়ানকে ধমকেধামকে হানিয়াকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছেন,, আসার সময় এ-ও বলে এসেছে হানিয়া তার সাথেই থাকবে আজ থেকে। জাভিয়ান যদি এক্ষেত্রে কোন জোর খাটায় তাহলে সে মি.তালুকদারকে জাভিয়ানের পূর্ব কর্মকান্ড সম্পর্কে জানাবেন।
তখন থেকে হানিয়া রোজি বেগমকে একের পর এক আদর করেই যাচ্ছে। রোজি বেগম ভাবছেন হয়ত মেয়েটাকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য খুশিতে এমন করছে। তার ভাবনা অবশ্য ভুল না। জাভিয়ান আজ সেই আগের মতো রেগে গিয়েছিলো। জাভিয়ানকে আগের মতো রাগতে দেখে ভয়ে হানিয়ার আত্মা পিপড়ার মতো হয়ে গিয়েছিলো।
______________________
তালুকদার বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করা হয় সাধারণত আটটার মধ্যে। এখন যেহেতু শীতকাল তাই সময়টা একটু বাড়িয়ে সাড়ে আটটা করা হয়েছে। সেই হিসেবে সকাল আটটা বিশের মধ্যে সকলকে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত থাকতে হয়। নিত্যদিনের মতো সবাই উপস্থিত হয়েছে ডাইনিং টেবিলে একমাত্র হানিয়া ছাড়া। রোজি বেগমকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করতে দেখে দু’জন ব্যক্তির কপালে ভাজ পরে। ব্যক্তি দু’জন হলো মি.তালুকদার আর জাভিয়ান। জাভিয়ান হানিয়ার উপর এখনো রেগে থাকলেও ডাইনিং টেবিলে হানিয়ার অনুপস্থিতি তাকে ভাবাচ্ছে। মি.তালুকদার তো রোজি বেগমকে জিজ্ঞেসই করে ফেলেন–
–রোজ! হানিয়া কোথায়? ওর কি শরীর খারাপ করেছে?
–না ভাইয়া। ও কলেজে চলে গেছে।
–এতো সকালে কলেজে?
–হুম। আসলে ভাইয়া,,ওর সামনে পরীক্ষা আছে নাকি। মাঝে তো প্রায়ই দু-মাসের মতো কলেজে যেতে পারে নি। তাই পড়ার চাপ পরে গিয়েছে। নোটস কালেক্ট করে সেগুলো শেষ না করতে পারলে পরীক্ষায় খারাপ হবে। তাই এই কয়েকটা দিন তাড়াতাড়ি কলেজে যাবে।
–ওহ্হ। ওকে ছাড়া খেতে ভালো লাগে না। মেয়েটা একদম স্পর্শর মতো যত্ন করে খাওয়ায়।
মি.তালুকদার কথায় কথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছেন নিজেও বুঝতে পারেন না। যখন সে তার ভুলটা বুঝতে পারে তৎক্ষনাৎ চুপ হয়ে যান। চোখ তুলে উপস্থিত বাকি তিনজনের দিকে তাকালে দেখতে পায় দু’জনের চোখে অলরেডি অশ্রুরা এসে ভীর করেছে আর বাকি একজন চোখমুখ শক্ত করে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু খাচ্ছে না।
মি.তালুকদার টপিক চেঞ্জ করতে জাভিয়ানকে বলে উঠে —
–জাভিয়ান তোমার উচিত হানিয়াকে নিয়ে কোথাও একটা ঘুরে আসা। বিয়ের চার মাস পেরিয়ে পাঁচ মাসে পা দিতে চললো অথচ তোমরা কোথাও ঘুরতে যেতে পারলে না।
জাভিয়ান খেতে খেতে বলে–
–এই মাসেও পারব কিনা সন্দেহ। কারণ এক,, হানিয়ার এক্সাম। দুই,, আমি এই মাসে অনেক বিজি থাকবো। দেশের বাহিরেও যাওয়া লাগতে পারে। তাই এই মাসেও কোথাও ঘুরতে যেতে পারব না।
–তাহলে পরের মাসে একটা ট্রিপ দাও।
–আচ্ছা দেখি কি করা যায়।
কথাটা বলে জাভিয়ান টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে টেবিল ছেড়ে উঠে উপরে চলে যায় অফিসের জন্য রেডি হতে। হানিয়াকে আজ একা পেলে সিদ্ধ আলুর মতো চটকাবে। মেয়েটার সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলছে।
___________________
আজ হানিয়া কলেজে একা এতিমের মতো এখানে ওখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ইনায়া আসেনি আর আসবেও না। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে হেল্প করতে বের হয়েছে মেয়েটা,,এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। হানিয়া তাকে কলেজে আসার জন্য জোর করেনি। এমনিতেও মেয়েটা তাকে বিনাস্বার্থে নিজের সবটুকু দিয়ে সাহায্য করে চলছে।
হানিয়া উল্লুকের মতো আশেপাশে তাকাতে তাকাতে হাটছিলো তখনই একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে নেয়,,কিন্তু ব্যক্তিটি তাকে ধরে ফেলে। হানিয়া পরে যাওয়ার ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড পর যখন সে অনুভব করে যে,,সে কংক্রিটের শক্ত ফ্লোরে পরে কোমড়ে জবরদস্ত ব্যথাটা পায় নি তখন সে আস্তে করে চোখ দু’টো খুলে সামনে তাকায়। দেখতে পায় তাদের কলেজের সবচেয়ে কিউট স্যার আদিয়াত মাহবুব তাকে একহাত দিয়ে ধরে আছে। হানিয়া চোখ খুলতেই আদিয়াত তাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড় করায়। আদিয়াত তার স্বভাব অনুয়ায়ী শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলে–
–ঠিক আছেন মিস?
–জ্বি স্যার। দুঃখিত আমি দেখতে পায় নি।
হানিয়া মুখটা অপরাধীর মতো করে কথাটা বলে। হানিয়ার মুখভঙ্গি দেখে আদিয়াতের হাসি পেয়ে যায়,,খানিকটা হেঁসেও ফেলে কিন্তু হানিয়া তা দেখার আগেই সেই হাসি লুকিয়ে ফেলে। সে বলে–
–ইটস ওকে। তা আপনাকে তো অনেক দিন কলেজে দেখলাম না। অসুস্থ ছিলেন নাকি?
–জ্বি স্যার। এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আমার।
–ওহ্হ,, ভেরি ব্যাড নিউজ। এখন কেমন আছেন?
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি স্যার।
হাসি হাসি মুখে কথাটা বলায় হানিয়াকে বেশ কিউট লাগে আদিয়াতের কাছে। আদিয়াত হাঁটতে হাঁটতে বলে–
–সামনে তো এক্সাম,, পড়া তো অনেক বাকি আপনার মনে হয়। নোটস সব কালেক্ট করা হয়েছে?
–নাহ স্যার। কয়েকটা কালেক্ট করেছি। আরো অনেক বাকি,,আর পড়াও অনেকটা বাকি।
–আমার ক্লাসের নোটস সব নেওয়া হয়েছে?
–নাহ স্যার।
–আচ্ছা আমার সাথে আসুন। আমি লাইব্রেরিতেই যাচ্ছিলাম কয়েকটা টপিক নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করতে। আপনাকে নোটসগুলো দিয়ে দিবো আর কিছু না বুঝতে পারলে বুঝিয়ে দিবো নে।
হানিয়া খুশি হয়ে যায় আদিয়াতের কথা শুনে। এমনিতেই আদিয়াত যেই কোর্সটা করায় হানিয়ার কেন যেনো ওই পড়াগুলো মাথায় ঢুকতেই চায় না। আজ যেহেতু একটা সুযোগ পেয়েছে এর সদ্ব্যবহার না করলে অনেক বড় লস হয়ে যাবে।
হানিয়া-আদিয়াত চলে যায় লাইব্রেরিতে। আদিয়াত অনেকটা সময় নিয়ে তাকে পড়াগুলো বুঝিয়ে দেয়। আদিয়াতের ক্লাসের সময় হয়ো যাওয়ায় সে হানিয়াকে কয়েকটা টাক্স দিয়ে চলে যায় ক্লাস করাতে।
__________________________
অন্যদিকে জাভিয়ান আজ অফিসে সবার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। ভুল হলেও বকছে,, ভুল না হলেও বকছে। এমনিতে সবাই মি.তালুকদারের থেকে জাভিয়ানকে বেশি ভয় পায় তার উপর আজ এমন খাটাশের মতো আচরণ করায় ভয়ে সবার আত্মা একটুখানি হয়ে আছে।
অফিসে আসার পর থেকে তিন চারবার সে হানিয়াকে ফোন দিয়েছে কিন্তু মেয়েটা ফোন ধরে নি। তাই জন্য এতো রাগ হচ্ছে। আজ সকাল থেকেই হানিয়া তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে। শেষবারের মতো আবার কল দেয় হানিয়াকে। হানিয়া ক্লাসে থাকায় ফোনটা ধরতে পারে না। জাভিয়ানও রেগে নিজের ফোন বন্ধ করে ফেলে রাখে। তারপর চলে যায় মিটিং এটেন্ড করতে।
________________________
হানিয়া কলেজ শেষে ঠিক টাইমে বাসায় এসে তার যাবতীয় কাজগুলো করে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে উঠে দেখে সাড়ে পাঁচটা বাজে। মাগরিবের নামাজ পড়ে সে তার ফোনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হয় রুম নিয়ে। আর দশ মিনিট পর আয়েশার ডিউটি শেষ হবে। ইনায়াও তার বাসা থেকে রওনা দিয়েছে,, মিনিট দুয়েক পর এসে পরবে তালুকদার বাড়িতে।
হানিয়া নিচে নেমে দেখে কুলসুম ব্যতিত কেউ আপাতত ড্রয়িংরুমে নেই। সে কুলসুমকে ভুংভাং একটা বুঝ দিয়ে বের হয়ে আসে বাসা থেকে। সে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে চাইছে। কারণ জাভিয়ান বাসায় ফিরে সাতটায়। এসেও যদি হানিয়াকে বাসায় না পায় তাহলে তাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।
ঠিক সময়ে তাদের আয়েশার সাথে দেখা হয়। ইনায়া আর সে ভালো করে সব বুঝিয়ে বলে তাকে। মেয়েটা গরিব হওয়ায় তারা কিছু টাকা দিয়ে সাহায্যও করতে চায় কিন্তু সে নেয় না। সে বলে–
–গরিব হতে পারি আপু কি লোভি না। টাকা আমার প্রয়োজন কিন্তু নিজের মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়ে টাকা কামাতে আমার বাবা-মা আমায় শেখায় নি। আপনাদের কাজটা আমি এমনিতেই করে দিবো। নার্স হয়েছি যাতে মানুষের সেবা করে একটু সওয়াব আর আত্মতৃপ্তি পেতে পারি।
আয়েশার কথাগুলো ইনায়া-হানিয়ার মন ছুঁয়ে যায়। তারা জোর করে অল্প কিছু টাকা তাঁকে দিয়ে তারপর তাকে ছাড়ে।
ইনায়া চলে যায় নিজের বাসায়। হানিয়াও ফুরফুরে মেজাজে বাসায় এসে পরে। স্পর্শের সঠিক চিকিৎসা শুরু হয়েছে বিষয়টা হানিয়াকে ভীষণ খুশি করে তুলেছে। সে বাসায় এসে কুলসুমের সাথে টুকটাক কাজ করে নিজের রুমে এসে পরে। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমে আসে,,আশেপাশে না তাকিয়ে পার্সটা কাবার্ডে রেখে যেই না পিছনে ঘুরেছে তার পরাণপাখি ভয়ে উড়ে যেতে চায়। জাভিয়ান দরজা লাগিয়ে তার সাথে হেলায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ দেখে তার ভেতরের অবস্থা বুঝা যাচ্ছে না।
সকালে না হয় রোজি বেগম তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো এখন কে বাঁচাবে তাকে? তারউপর আজ সারাদিন জাভিয়ানের চোখের আড়ালে ছিলো। আর জাভিয়ান তাড়াতাড়ি আসলো কেন আজ? হানিয়া ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। সাতটা বাজতে এখনো বিশ মিনিট আছে। হানিয়া একটা ফাকা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলে–
–আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি এসে পরলেন যে? আপনি তো আরো দেরি করে আসেন।
জাভিয়ান বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটা ব্ল্যাক কালারের হুডি পরেছে আর ব্রাউন কালারের ট্রাউজার। চুলগুলো ভেজা-ভেজা লাগলো হানিয়ার কাছে। হানিয়া যখন জাভিয়ানকে স্ক্যান করতে ব্যস্ত তখন জাভিয়ান হেঁটে হানিয়ার প্রায়ই অনেকটা কাছে এসে পরেছে। হুট করে হানিয়ার ধ্যান ফিরলে সে জাভিয়ানের হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগায়,,কিন্তু এবার আর ভাগ্য সহায় হয় না। জাভিয়ান তার শক্ত হাত জোড়া দ্বারা হানিয়াকে ধরে ফেলে,, তারপর তার কোমড় ধরে কিছুটা উচু করে তুলে ছুঁড়ে ফেলে বেডে। জাভিয়ান ততটা জোরে ফেলে না এই ভেবে হানিয়ার মাথায় সমস্যা দিতে পারে। হানিয়া নিজেকে সামলে বিছানা থেকে নামতে গেলেও জাভিয়ান তার পা ধরে টেনে আবার শুইয়ে দেয়। তারপর নিজেও বেডে উঠে হানিয়াকে নিজের চার হাত পায়ের মধ্যে বন্ধি করে ফেলে।
জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ নিয়ে সেটা হানিয়ার মাথার নিচে দেয়। হানিয়া ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। জাভিয়ান হানিয়ার ভয়ার্থ মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। ভয়ে হানিয়ার বাম চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে সেই অশ্রু মুছে দেয়। তারপর হানিয়ার দু’গালের আলতো করে হাত রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয় দ্বারা আলতো করে স্লাইড করতে থাকে। নরম গলায় বলে উঠে —
–চোখ খুলো হানি।
হানিয়া তাও চোখ খুলে না। জাভিয়ান এবার হানিয়ার চোখের উপর স্লাইড করে। আস্তে আস্তে হানিয়া স্বাভাবিক হয়ে চোখ খুলে। চোখ খুলেই জাভিয়ানকে কেমন কেমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হানিয়া থতমত খেয়ে যায়। সে মনে মনে ধরেই নিয়েছিলো এখন আর রক্ষা পাবে না সে। কিন্তু এই বেটার মতলব অন্য কিছু লাগছে। হানিয়া ভয়ে ভয়ে বলে–
–আমার উপর থেকে উঠুন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
জাভিয়ান হানিয়ার কথা তো শুনলোই না উল্টো তার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এসে কন্ঠে কিছুটা ঘোর নিয়ে বলে–
–এখনো তো কিছুই করলাম তাতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু করলে তো মনে হয় না তোমাকে খুজে পাওয়া যাবে।
–কি..কি করবে?
–দেখবে কি করবো?
হানিয়া অসম্মতি জানিয়া মাথা নাড়ায়। কিন্তু জাভিয়ান তো তাকে দেখাতে চান সে কি করবে সেটা। জাভিয়ান হানিয়ার দু’হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল গুছে শক্ত করে বেডের সাথে চেপে ধরে। হানিয়া ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করে উঠে। কিন্তু জাভিয়ানের পুরু ঠোঁটের স্পর্শ তাকে নিমিষেই শান্ত করে দেয়। জাভিয়ান তার কপালে নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। হানিয়া পুনরায় চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শটা ফিল করে। জাভিয়ান হানিয়া কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে পরপর হানিয়ার দুচোখের পাতায়,,চিবুকে,, থুতনিতে নিজের পুরু ঠোঁটের স্পর্শ দিতে থাকে। তাদের বিয়ের পর জাভিয়ান হানিয়াকে অনেকবার গভীর ভাবে স্পর্শ করলেও আজকের এই স্পর্শ অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। এই স্পর্শে হানিয়া আদর,,ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু জাভিয়ান তো তাকে ভালোবাসে না।
হুট করে নিজের ঠোঁটে অন্য আরেকটি ঠোঁটের স্পর্শে হানিয়া জমে যায়। জাভিয়ান অনেক স্ফটলি তার ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিচ্ছে। জাভিয়ান নিজেই হানিয়ার একটা হাত নিজের ঘাড়ে এনে রাখলে হানিয়া শক্ত করে ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো খামচে ধরে। হানিয়ার অন্যহাতটাও মুক্ত করে দিলে,, হানিয়া জাভিয়ানের বুকের কাছের কাপড়ের অংশ ধরে টেনে নিজের আরেকটু কাছে নিয়ে আসে। তারপর দু’জন দু’জনায় মেতে উঠে ভালোবাসার আদান-প্রদান করতে। তাদের দু’জনের না থাকে সময়ের জ্ঞান,, না থাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা মনে। দুজনের মন শুধু এইটুকু চাচ্ছে,,একে অপরকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসতে।
বেশ অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও কেউ কারো ওষ্ঠ মুক্ত করে না। জাভিয়ান নিজের চোখ খুলে হানিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পায় মুখটা হালকা লাল হয়ে আছে,,আর চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। দৃশ্যটা দেখে জাভিয়ান মনে মনে একটু হাসে,,তারপর নিজেই সমাপ্ত করে তাদের ওষ্ঠ ভালোবাসা। হানিয়ার ঠোঁটকে মুক্ত দিয়ে মাথা নামিয়ে তার গলায় মুখ গুঁজে দেয়। বড়বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। হানিয়ার হাতজোড়া এখনো আগের জায়গাতেই আছে।
জাভিয়ান হানিয়ার উপর থেকে সরে বেডে শুয়ে পরে তারপর হানিয়াকে টেনে নিজের বুকের উপর এনে ফেলে। হানিয়ার শ্বাস প্রশ্বাস তখনো কিছুটা বেসামাল তাই জাভিয়ান তাকে শান্ত করতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। হানিয়া একটু সময় নিয়ে শান্ত হওয়ার পর জাভিয়ান তাকে টেনে একদম নিজের মুখোমুখি করে। হানিয়ার চোখে চোখ রেখে কঠোর অথচ শান্ত গলায় বলে–
–তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি এটা সঠিক ব্যবহার করো। আমি যদি কোনদিন জানতে পারি,, আমার দেওয়া স্বাধীনতার তুমি অপব্যবহার করেছ কসম আল্লাহর তোমাকে জ্যান্তকবর দিতে আমার বুক একবারের জন্যও কাঁপবে না। আজ যে বুকে যত্ন করে আগলে আগলে রাখছি,, এই বুক থেকে ছুঁড়ে ফেলতেও সময় নিবো না।
হানিয়া জাভিয়ানের চোখ চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর তাকে শান্ত গলায় শাঁসালো। কণ্ঠে প্রখর অধিকারবোধ অথচ বিয়েটা করেছে প্রতিশোধের জন্য। হাহ্। হানিয়াও শান্ত গলায় বলে–
–আমিও আজ একটা কথা জানাচ্ছি আপনাকে। আমি যদি কোন দিন জানতে পারি,,আমাকে বিয়ে করার পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে সেদিন আমিও আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে দু’বার ভাববো না। আপনি আমার ভালোবাসা দেখেছেন জাভিয়ান,,আমার ঘৃণা দেখেন নি। বলা হয়ে থাকে,,নারীর ঘৃণা পুরুষের ছলনার থেকেও ভয়ঙ্কর। নারীর ঘৃণা একজন পুরুষকে দুনিয়াতেই জাহান্নাম দেখিয়ে দিতে পারে।
হানিয়া-জাভিয়ানের এতোদিনের সংসারে আজ প্রথমবার হানিয়া জাভিয়ানের নাম ধরে ডাকলো।জাভিয়ানের কাছে নিজের নামটা আজ ভীষণই মিষ্টি শোনালো। কেন? হানিয়া তার নাম ধরে ডেকেছে বলে?
জাভিয়ানের কথাগুলো যেমন হানিয়াকে থমকে দিয়েছে,,তেমনি হানিয়ার উক্তি গুলো জাভিয়ানের অন্তর পূরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। তারা হয়ত জানে না বিচ্ছেদই তাদের জীবনে বিধাতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
শব্দসংখ্যা~~১৯৮৬
~~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_আটত্রিশ
চলে গেছে আরো তেরোটা দিন। আর দু’দিন পরই স্পর্শকে কাউন্সিলিংয়ের জন্য নিতে হবে। সাইকেট্রিসেরও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বের করবে কিভাবে ওরা স্পর্শকে এটাই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে গেছে। ইনায়া আর হানিয়া ক্যান্টিনে বসে গালে হাত দিয়ে এটা নিয়েই ভাবছে।
–আচ্ছা আমরা যেই সময়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি সেই সময়টায় তো ভাইয়া অফিসে থাকে। তাহলে তুই এতো চিন্তা করছিস কেন?
হানিয়াকে প্রশ্ন করে ইনায়া। হানিয়া ওয়ান টাইম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে–
–উনি যেই সেয়ানা,, তোর কি মনে হয় উনি বোনের নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা সেটআপ করেনি? আমার তো মনে হয় করেছে।
–তাও ঠিক। আচ্ছা জুলিয়া আন্টিকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। উনি তো আপুর দেখভাল করেন অনেক আগের থেকে। উনি হয়ত জানতে পারে এই বিষয় সম্পর্কে।
–হুম। দাঁড়া আমি কল দিচ্ছি।
মিসেস জুলিয়ার সঙ্গে এখন হানিয়ার প্রায়ই কথা হয়। শুধু মিসেস জুলিয়া না স্পর্শর সাথেও হয়। ভিডিও কলে তাদের দু’জনের প্রায়ই কথা হয়। ঔষধগুলোতে স্পর্শর ভালোই ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। আগের মতো এতোটা এগ্রেসিভ আচরণ করে না এখন আর। রাতে যেহেতু জাভিয়ান স্পর্শর কাছে যায় তাই তাদের কথা হয় বেশির ভাগ সময় দিনেই।
মিসেস জুলিয়াকে কল করে টুকটাক কথা শেষ করে হানিয়া আসল কথায় আসে। সে মিসেস জুলিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–আন্টি,, আপনি তো স্পর্শ আপুকে দেখভাল করছেন অনেক দিন ধরেই। সেই হিসেবে উনি আপনাকে বিশ্বাস করে অনেক কথা শেয়ারও করেছেন।
–হুম তা অবশ্য করেছে। কিন্তু হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করলে যে?
–আচ্ছা উনি স্পর্শ আপুর উপর নজর রাখার জন্য কোন ক্যামেরা লাগিয়েছে? রুমের ভেতরে লাগালে তে আমি কবেই ধরা পরে যেতাম। ধরা যেহেতু পরি নি তারমানে রুমের ভেতরে কোন ক্যামেরা নেই।কিন্তু বাহিরে কি কোন ক্যামেরা লাগিয়েছে?
–হুম লাগিয়েছে।
মিসেস জুলিয়ার এই কথা শুনে হানিয়া-ইনায়া চিন্তায় পড়ে যায়। হানিয়া ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে কথা বলছিলো তাই ইনায়াও তাদের দু’জনের কথপোকথন শুনতে পাচ্ছিল। হানিয়া বলে–
–তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে আন্টি। দু’দিন পর স্পর্শ আপুকে সাইকেট্রিসের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ক্যামেরা থাকলে কিভাবে নিয়ে যাবো?
–আরে বোকা মেয়ে,, আমার পুরো কথা তো শুনো আগে।
মিসেস জুলিয়ার কথা শুনে হানিয়া থতমত খেয়ে যা। সে বোকামির কি বললো?
–জ্বি আন্টি বলেন।
–স্যার হিডেন ক্যামেরা লাগিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সামনের দিকে। মানে স্টোররুমে সামনের দিকে। পেছনের দিকে কেমন জঙ্গল দেখেছ না,,এটা স্যারই করেছেন। যাতে এই ঝোপঝাড়ে কেউ আসার সাহস না পায়। কতোগুলো কাটাওয়ালা গাছও লাগিয়েছেন। সামনের দিকে জঙ্গলের মতো হলেও মানুষজন সেখানে আসার সাহস করতে পারো,,তাই সেদিকে ক্যামেরা সেই সাথে ইলেকট্রনিক শকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। স্টোররুমের সামনের দরজার হ্যান্ডেলের সাথে ইলেকট্রনিক তার লাগানো আছে। কেউ ওটা স্পর্শ করলেই দারুন শক খাবে। আর আমাকে স্যার একদিন এটাও বলেছিলেন যে,,উনি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের এইদিকে আসা নিষেধ করে দিয়েছেন। কেউ আসবে না ওইদিকে,, যদি আসেও সে ক্যামেরার মাধ্যমে আগে থেকেই জানতে পারবেন।
হানিয়া আর ইনায়া হা করে মিসেস জুলিয়ার কথাগুলো শুনছিলো। জাভিয়ান কতটা ডেঞ্জারাস তা তাদের জানতে আর বাকি নেই। আর বোনকে যে কতটা ভালোবাসে সেটাও তারা বুঝতে পারছে। দিন শেষে বোনকে নিজের কাছে রাখার জন্য তার কতো লুকোচুরি,, কতাে প্ল্যান। অথচ অন্যের বোনের জীবনটা বিষিয়ে দিতে সে দু’বার ভাবে নি। হায়রে মানুষ!
হানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস জুলিয়াকে
বলে —
–তাহলে তো চিন্তার কোন কারণই থাকে না। আমরা পরশু সকাল দশটায় মোড়ের কাছে গাড়ি নিয়ে ওয়েট করবো। আপনি আপুকে নিয়ে আসবেন।
–কিন্তু স্যার যদি কোন ভাবে জেনে যায়। তখন কি হবে হানিয়া?
–জানবে না। আয়েশাকে সব বলে দেওয়া হবে। ও নিজের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে স্পর্শ আপুকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে আসবে। আপনি ওখান থেকে আপুকে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত আসবেন। গাড়িতে আমি আর ইনায়া ওয়েট করবো। ইনশা আল্লাহ সমস্যা হওয়ার কথা না যদি প্ল্যান অনুযায়ী সবটা হয়।
–স্যার দিনে একবার ফোন করে ম্যামের সাথে কথা বলেন। ধরো আমরা যখন বাহিরে তখন যদি স্যার ফোন দিয়ে ম্যামকে চায় তাহলে?
–গতকাল উনাকে কাকে যেন বলতে শুনেছিলাম,, পরশু তারা ঢাকার বাহিরে একটা সাইট ভিজিটংয়ে যাবে। ওইদিন উনি ভালোই ব্যস্ত থাকবে। এতো ব্যস্ততার মাঝে তার ফোন করার কথা মনে থাকেবে না মনে হয়।
–তাই যেন হয়।
–আচ্ছা আন্টি এখন রাখছি। আমাদের আরেকটা ক্লাস আছে।ওটা শেষ করে বাসায় যাবো।
–আচ্ছা। বায়।
–আল্লাহ হাফেজ।
হানিয়া কথা শেষ করে কল কেটে দেয়। তারপর দুই বান্ধবী মিলে চলে যায় ক্লাস করতে। রাস্তায় তাদের দেখা হয় তাদের কলেজের সবচেয়ে বখাটে,, বেয়াদব আর মেয়েবাজ গ্যাংয়ের লিডার মামুনের সাথে। তার হানিয়া-ইনায়া দু’জনে উপরেই নজর পরেছে। ইনায়াকে কিছু বলতে পারে না কারণ তার বাবা নামকরা ব্যবসায়ী,,এক ভাই রাজনীতি করে তো এক ভাই তাদের কলেজেরই শিক্ষক। তাই ইনায়াকে কিছু বলার আগে তারা দশবার ভাবে কিন্তু হানিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। সদা হাস্যজ্জ্বোল মেয়েটাকে বিরক্ত করার একটা উপায়ও বাদ নেই মনে হয় তার। আজও তাই হয়েছে।
ক্লাসে যাওয়ার সময় ইনায়ার মনে পরে তার পানি শেষ হয়ে গেছে,,তাই সে হানিয়াকে ক্লাসে যেতে বলে আবার ক্যান্টিনে যায় পানি আনতে। হানিয়া ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল তখনই মামুন আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা হানিয়ার রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। হানিয়া তাদের ইগনোর করে চলে যেতে নিলে তারা হানিয়ার হাত ধরে টানাটানি লাগায়। হানিয়া এসব সহ্য করতে না পেরে লাগিয়ে দেয় একটা থাপ্পড়। হানিয়ার থাপ্পড়ের আওয়াজে আশেপাশের সকলে তাদের দিকে ফিরে তাকায়। মামুনের সাঙ্গপাঙ্গ হানিয়ার দিকে তেড় আসলে মামুন তাদের নিষেধ করে নিজেই হানিয়ার দিকে যেতে লাগে। হানিয়া রেগে নিজের পায়ের জুতা খুলে রেগে বলে–
–আর এক পা আগাবি এবার আমার হাত না পায়ের জুতা পরবে তোর গালে। বেয়াদব।
হঠাৎই পেছন থেকে একজনের গম্ভীর গলা শুনে মামুন আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা চমকে যায়। চমকে যাওয়ার চেয়েও বেশি ভয় পায়।
–হাত থাকতে মুখ চালাতে হয় না। মুখের কথা হাতে করছেন না কেন মিস? যতদিন না এদের গালে কয়েকটা জুতোর বারি পরবে ততদিন এরা ভালো হবে না।
সকলে পেছনে তাকিয়ে দেখে আদিয়াত স্যার। বেয়াদবগুলোর কলিজা কেউ যেন খামচে ধরে। আদিয়াত স্যার ভালোর ভালো তেমনি খারাপের যম। একবার এক ছেলে এক জুনিয়ারকে ইভটিজিং করেছিলো,,তাকে আদিয়াত স্যার মাথা ন্যাড়া করে কলেজের মাঠে দাড় করিয়ে রেখেছিলো পুরো পাঁচ ঘন্টা। ছেলেটার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলো যাতে লেখা ছিলো “আমি ইভটিজার” ওই ঘটনার পর ওই ছেলেটা টিসি নিয়ে অন্য কলেজে চলে গিয়েছিলো। আদিয়াত স্যার মেয়েদের অসম্মান একদমই দেখতে পারে না। আজ সেই স্যারের সামনে ওরা ধরা পরে গেছে। শাস্তিটাও তেমনই পাবে আশা করা যায়।।
হানিয়া স্যারকে দেখে নিজের জুতোটা নামিয়ে ফেলছিলো, তখনই আদিয়াত তার সামনে এসে বলে–
–যেই কাজের জন্য অস্ত্রটা উঠিয়েছিলেন সেটা করেন।
হানিয়া থতমত খেয়ে যায় আদিয়াতের কথায়। সে আমতাআমতা করে বলে–
–স্যার চড় মেরেছি। আজ না হয়…
আদিয়াত এমন ভয়াবহ শান্ত গলায় বলে–
–আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে তা করেন মিস হানিয়া।
হানিয়া বুঝতে পারে কাজটা না করলে তার নিস্তার নেই। হানিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আদিয়াত নিজেই বলে–
–আপনার সেফটির দায়িত্ব আমার। এই ঘটনার পর যদি ওরা আপনার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে আমি ওদের দেখে নিবো। এখন আপনাকে যেটা বলেছি তা করুন।
হানিয়া একবার আদিয়াতের দিকে তাকায়। আদিয়াত তাকে চোখ দিয়ে আশ্বাস দেয়। হানিয়া হালকা কাঁপতে কাঁপতে মামুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আর কিছু চিন্তা না করে ধামধাম করে মামুনের গালে তাল ফেলতে থাকে। [তাল মানে জুতার বারি আরকি]
চারটা বারি দিয়ে হানিয়া শান্ত হয়। মনের ভেতরের সব রাগ আজকে উগলে দিয়েছে। দেড় বছরে তাকে এবং অন্যান্য জুনিয়রদের কম জ্বালায় নি শয়তানটা। আশেপাশে অনেকেই হানিয়ার এই কাজটা ভিডিও করে সোশাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। ক্যাপশনে লেখা হয় “ইভটিজারকে শিক্ষা দেওয়া হলো” মুহূর্তেই ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে যায়। সকলে হানিয়ার এমন সাহসী কাজের জন্য প্রশংসার বন্যা বয়ে দিতে থাকে।
হানিয়ার কাজটা শেষ হলে আদিয়াত মামুনের সামনে এসে তার কলার গুছিয়ে দিতে দিতে শান্ত ভঙ্গিতে বলে–
–আর কোন দিন যদি এই কলেজের আশেপাশেও নজরে পরিস,,তাহলে ওইদিন আমার হাত চলবে। আজকের মধ্যে টিসি নিয়ে কলেজ থেকে বিদায় নিবি।
কথাটা বলে আদিয়াত মামুনকে ছেড়ে দেয়। তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে সকলকে একবার দেখে নেয়,,গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে–
–এর থেকে শিক্ষা নাও সকলে। তারপরও যদি আমি কখনো কোন মেয়েকে অসম্মান বা ইভটিজিং করতে দেখি তাহলে তার অবস্থা আমি এর থেকেও খারাপ করবো। কথাটা মাথায় রেখো সবাই আর এখন যে যার ক্লাসে যাও।
শেষের কথাটা অনেকটা ধমক দিয়ে বলে আদিয়াত। সকলে পরিমরি করে দৌড়ে ক্লাসে চলে যায়। ইনায়াও এসে পরেছে অনেকক্ষণ আগেই। সে হানিয়ার কাছে এসে তার হাত ধরে ক্লাসে চলে যায়। আদিয়াত হানিয়াদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। তারপর নিজেও চলে যায় ক্লাস নিতে।
___________________
জাভিয়ান মাত্রই একটা মিটিং শেষ করে এসে বসেছে নিজের কেবিনে তখনই রাহাত তাকে একটা মেসেজ পাঠায়। জাভিয়ান ফোনটা হাতে নিয়ে রাহাতের ইনবক্সে গেলে দেখতে পায় একটা ভিডিও আর তার সাথে একটা টেক্সট। জাভিয়ান ভিডিওটা দেখার আগে টেক্সটটা পড়ে। সেখানে রাহাত লিখেছে–
“মেয়ে তো না যেন একটা বাঘিনী,,হ্যান্ডেল করো কীভাবে এই বাঘিনীকে?”
জাভিয়ান তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে ভিডিওটা ভিডিওটা অপেন করেন। ভিডিওটা দেখার পর জাভিয়ানে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে উঠে। হ্যাঁ,,এটা হানিয়ার সেই কিছুক্ষণ আগের ভিডিও। রাহাত সোশাল মিডিয়ায় ভিডিওটা দেখতে পেয়ে জাভিয়ানকে পাঠায়। জাভিয়ান ভিডিওটা অন রেখেই ভাবতে থাকে —
–হানি তো কারো উপরে এতো সহজে হাইপার হয় না। তাহলে কি এই ছেলেটা হানির সাথে এমন কিছু করেছে যার কারণে হানিয়া এমন একটা স্টেপ নিয়েছে?
জাভিয়ান ভিডিওটায় হানিয়ার পেছনে আদিয়াতকে দেখে। আদিয়াত হানিয়ার একটু পেছনে বুকে হাত বেঁধে দাড়িয়ে ছিলো। বিষয়টা জাভিয়ানের ভালো লাগে না। সে তৎক্ষনাৎ হানিয়ার নাম্বারে ফোন লাগায়। হানিয়া তখন কলেজ থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছিল। ব্যাগের থেকে ফোন বের করে দেখে তার নিষ্ঠুর জামাই কল করেছে। হানিয়া এমন সময়ে তার কল পেয়ে অনেকটা চমকে যায়। কারণ ওই যে জাভিয়ান তার রেজাল্টের দিন বাজে কথা বলেছিলো পরে হানিয়া আর কখনোই তাকে ফোন দেয়নি।জাভিয়ান নিজেও কোনদিন আগ বাড়িয়ে ফোন দিয়ে তার খোঁজ খবর নেয় নি এতদিনে। আজ হুট করে তার ফোন পাওয়ায় হানিয়ার চমকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের চমকাচমকি সাইডে রেখে ফোন রিসিভ করে কানে লাগায় হানিয়া। সালাম বিনিময় শেষে জাভিয়ান হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–ক্লাস শেষ হয়েছে তোমার?
–জ্বি। বাসায় যাচ্ছিলাম এখন।
–আজ বাসায় যাওয়া লাগবে না। ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলো তোমাকে আমার অফিসে নিয়ে আসতে।
হানিয়া তার এমন অদ্ভুত কথায় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–
–আমি আপনার অফিসে গিয়ে কি করবো? বাসায় চলে যাই,,ক্ষুধা পেয়েছে আমার।
–আমারও ক্ষুধা পেয়েছে তাই তোমাকে ডাকছি। বেশি কথা না বলে যা বললাম তাই করো।
–আজব তো!! এমন একটা ভাব করছে যেন আমাকে ছাড়া এক লোকমা খাবারও মুখে তুলেন না। আপনার ক্ষুধা পেয়েছে আমি কি যেয়ে খাইয়ে দিবো নাকি আপনাকে?
–হানি,,মাই ডিয়ার ওয়াইফি। ডোন্ট ইউ থিঙ্ক,, আজকাল তোমার মুখটা একটু বেশিই চলে?
জাভিয়ান যে রেগে গেছে হানিয়া তার কথা শুনেই বুঝতে পারছে। তাই বেশি কথা না বলে জাভিয়ানের কথায় সম্মতি জানিয়ে ফোন কেটে দেয়। তারপর ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলে তাকে জাভিয়ানের অফিসে নিয়ে যেতে। হানিয়া গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে জাভিয়ানের কথা। কেনই বা আজ হুট করে তাকে ফোন দিলো আর কেনই বা তাকে অফিসে ডাকছে?
_______________
–আবরার আমাদের ডিভোর্সের বিষয়টা কতদূর ?
–আমি এপ্লিকেশন করেছি। সামনের মাসেই কোর্ট থেকে ডাকা হবে আমাদের। আমাদের দু’জনের কথা শুনে তারপর হয়তো কোন রায় দিতে পারে জজ।
–আচ্ছা। আপনি একটু বিষয়টা তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করুন প্লিজ। ফাহিম চাচ্ছিলো বিষয়টা একটু তাড়াতাড়ি শেষ করতে।
–তাহলে ফাহিমকেই বলুন বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে। সবকিছুর দায়ভার আমি একা নিবো কেন? আপনিও আপনার তরফ থেকে ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি করার।
আড়াই বছরে এই প্রথম আবরার এতোটা রুড হয়ে এশার সাথে কথা বললো।এশা তার এমন ব্যবহারে অনেক অবাক হয়ে যায়। এশা বলে উঠে —
–আপনি এমন করে বলছেন কেন আবরার?
আবরার ব্রেকফাস্ট অর্ধেক করেই উঠে পরে,,কন্ঠে কিছুটা তেজ নিয়ে বলে–
–কীভাবে বলছি আমি? মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আপনার তাই না? আমারও হয় যখন আপনি প্রতিদিন এই ফাউল বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন। আরে ভাই আপনার থেকে আমার বেশি তাড়া এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার। তাও প্রতিদিন আপনার এই প্রশ্ন শুনে মনে হয় আমি ইচ্ছে করে দেরি করছি। যদি আপনাদের এতো তাড়াই থাকে তাহলে আমি মৌখিক তালাক দিয়ে দিচ্ছি,, আপনারা তাহলে আজই বিয়ে করতে পারবেন।
তালাক,,তা….
আবরার আর বলতে পারে না। তার আগেই এশা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–না না। যেদিন ডিভোর্স পেপারে সাইন করবো ওইদিনই তালাক দিয়েন। প্লিজ শেষ বারের মতো আমার এই কথাটা রাখেন। আর কোনদিন কিচ্ছু চাইবো না আপনার কাছে।
আবরার কোন কথা না বলেই অফিস ব্যাগটা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে। সে একটু কনফিউজড। একবার মনে হচ্ছে,, সারাজীবনের জন্য আবরারের সাথে থেকে যেতে। আরেকবার মনে হচ্ছে,, ভালোবাসার মানুষটির সাথে থাকতে। সে বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে।
শব্দসংখ্যা~১৯০০
~চলবে?