প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
236

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চৌচল্লিশ

জাভিয়ান মি.চৌধুরীর সাথে কথা বলছে। জাভিয়ান টুকটাক কথা বলার পর তাকে জিজ্ঞেস করে–

–কবে আসছো তুমি?

–কাজ শেষ। দুই-একদিনের মাঝেই ফিরছি।

–ওহ্হ। তাড়াতাড়ি এসো,,তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

সারপ্রাইজের কথা শুনে মি.চৌধুরীর কপালে কয়েকটা ভাজ পরে। সে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–

–কি সারপ্রাইজ?

–সেটা যদি বলেই দেই তাহলে সারপ্রাইজ আর থাকবে? থাকবে না। তাই আমিও বলবো না। তুমি আসো,,তারপর নিজের চোখে দেখবে।

মি.চৌধুরী একটা হতাশ মিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলে–

–আচ্ছা। আমার স্পর্শের কি অবস্থা? এতদিন কাজে ব্যস্ত থাকায় তেমন একটা খোঁজ নিতে পারি নি।

জাভিয়ান চোরা হাসি দিয়ে বলে–

–আগের মতোই আছে। ভাবছি তুমি ফিরে আসার পর অন্য একজন ডাক্তারকে দেখাবো। প্রায়ই তিনবছর ধরে তো একজনের চিকিৎসা নিয়েই আসছি,, কোন ইমপ্রুভমেন্ট তো হলো না।

মি. চৌধুরী জাভিয়ানের কথা শুনে ঘাবড়ে যায়। তাও সে মিজেকে সামলে বলে–

–আচ্ছা। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরার চেষ্টা করছি।

–ওকে। রাখছি তাহলে।

–হুম,, বায়।

–বায়।

তারা একে অপরের থেকে বিদায় নিয়ে ফোন কেটে দেয়। জাভিয়ান ফোন কেটে পেছনে ফিরে হানিয়াকে দেখতে পায়। সে চমকে যায় তাঁকে দেখে। জাভিয়ানের ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে হানিয়ার কপালে ভাজ পরে কয়েকটা। কিন্তু সে আগ্রহ করে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করে না। হানিয়া জাভিয়ানের থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। হানিয়ার চলে যাওয়া জাভিয়ানকে স্বস্তি দেয়। সে তার চেপে রাখা শ্বাস ফুস করে ছেড়ে দেয়।

হানিয়া ওয়াশরুম থেকে এসে মুখ হাত মুছে বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পরে। জাভিয়ান অসহায় চোখে সবটা প্রত্যক্ষ করে। ক্র্যার্চের সাহায্য হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে–

–হানি,,বেডে চলো। তোমায় ছাড়া আমার ঘুম আসে না।

হানিয়া চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বলে–

–নতুন কেউ আসা পর্যন্ত একটু কষ্ট করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে হানিয়ার একটা হাত চেপে ধরে, তারপর বলে–

–তুমি থাকতে অন্য কারো আসার কথা আসছে কেন হানি?

হানিয়া বিরক্ত হয় জাভিয়ানের কথায়। সে জাভিয়ানের হাতটা ছাড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর মাথার বালিশটা নিয়ে উঠে দাড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগায়। জাভিয়াম হকচকিয়ে যায় তার কাজে।সে তাড়াতাড়ি করে হানিয়ার হাত পেছন থেকে ধরে তাঁকে আঁটকে দেয়। কন্ঠে অস্থিরতা নিয়ে বলে–

–বালিশ নিয়ে কই যাচ্ছো এত রাতে?

হানিয়া জাভিয়ানের দিকে ফিরে তার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। চোখে চোখ রেখে বলে–

–ক্লান্ত আমি,,শরীর চলছে না। একটু রেস্ট চাচ্ছে আমার দেহ,,মন,,মস্তিষ্ক। কিন্তু আমার চাওয়া সবসময়ই বাতিলের খাতায় স্থান পায়। বুদ্ধিমান আপনি,, আশা করি আর খুলে বলতে হবে না।

জাভিয়ান হানিয়ার ইঙ্গিতপূর্ণ কথার মানে বুঝতে পারে। জাভিয়ান স্তব্ধ হয়ে বলে–

–আমি ডিস্টার্ব করব না আর,,প্রমিজ। তাও তুমি এই রুম ছেড়ে চলে যেও না।

–ঘুমিয়ে পরুন।

হানিয়া পুনরায় সোফায় বালিশ রেখে উল্টো পাশে ফিরে শুয়ে পরে। জাভিয়ান কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেডে এসে পরে। হানিয়া যেই পাশটায় ঘুমাতো সেই পাশে শুয়ে পরে। আজ সেও ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছে। প্রতিশোধের নেশায় ডুবে আজ সে ক্লান্ত পথিকের ন্যায়। আদৌও কি তার এই ক্লান্তি কখনো দূর হবে? হলেও কিভাবে?

______________________

মাঝে একদিন পেরিয়ে যায়। হুট করে দেখা মিলে সোহার। উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো ঘাঁটি গেঁড়েছে তালুকদার বাড়িতে। এসে থেকেই জাভিয়ানের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে কেঁদে বলছে এতোদিন তার না আসতে পারার কারণ। তার নাকি কি একটা পরীক্ষা ছিলো তাই এতদিন সময় করে আসতে পারে নি। মানলাম তোর পরীক্ষা তাই বলে প্রায়ই তিনমাস লাগিয়ে একটা ইন্টার পড়ুয়া মেয়ের কি এমন পরীক্ষা হচ্ছিল? তা জানতে চাইলো জাভিয়ানের মন কিন্তু মুখ দিয়ে প্রশ্ন হয়ে বের হলো না।

হানিয়া কলেজ থেকে এসে রুমে ঢুকে এই পেত্নীকে দেখে। মনে মনে একটু বিরক্তই হয়। ড্রামা কুইন কিনা মেয়েটা। জাভিয়ান আধশোয়া হয়ো বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো আর সোহা তার পাশেই বসে বকরবকর করছি। জাভিয়ান হানিয়াকে দেখে নিজের কাজ অফ রেখে হানিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতক্ষণের সব বিরক্তি হানিয়ার উপস্থিতিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হানিয়া তার ব্যাগ,,বোরকা ছেড়ে বাসায় পরার জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। হানিয়া ওয়াশরুমে ঢুকে পরলে জাভিয়ান পুনরায় তার কাজ শুরু করে।ল্যাপটপে আঙুল চালাতে চালাতে বলে–

–সোহা,, এখন তুমি তোমার রুমে যাও।

সোহা ফট করে প্রশ্ন করে উঠে —

–কেনো জাভিয়ান? (জাভিয়ান চোখ তুলে তার দিকে তাকালে সে বলে) ভাইয়া।

জাভিয়ান সোহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে–

–বউ আমার ক্লান্ত। তার এনার্জির জন্য গ্লুকোজ লাগবে। এটা যেই সেই গ্লুকোজ না। জামাইয়ের আদরওয়ালা গ্লুকোজ। শুধু তার না আমারও একটু প্রয়োজন তাঁকে। অনেকক্ষণ দূরে তো। এখন আমি কি তোমার সামনেই গ্লুকোজ দেওয়া নেওয়া করবো? এটাই কি চাচ্ছো?

সোহা জাভিয়ানের কথা শুনে চোখ বড়বড় করে ফেলে। তারপর বিস্ময়ভাব নিয়েই রুম ত্যাগ করে। হানিয়া বের হয় এক ঘন্টা পর। জোহরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় হানিয়া জোহরের নামাজে দাঁড়িয়ে পরে। জাভিয়ানও বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,, তারপর নিজেও অজু করে এসে একটা চেয়ার নিয়ে এসে হানিয়ার থেকে কয়েক কদম সামনে রেখে নামাজে বসে।

হানিয়া নিজের নামাজ শেষ করে জাভিয়ানের নামাজ শে করার অপেক্ষা করে। জাভিয়ানের নামাজ শেষ হলে সে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–

–লাঞ্চ কি এখন করবেন নাকি আরো দেরিতে?

–এখনি করবো। আমায় একটু ধরে নিচে নিয়ে চলো। সকাল থেকে পায়ে আবার চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে।

–চলুন।

হানিয়া জাভিয়ানের কাছে এসে তার বাম হাতটা নিজের কাঁধের উপর তুলে নেয়,,আর নিজের ডান হাত জাভিয়ানের কোমড়ের চেপে ধরে আস্তে আস্তে করে নিচে নিয়ে যেতে থাকে তাঁকে। দুপুরের লাঞ্চ সকলে এক সাথেই করে নেয়। হানিয়া আর কুলসুম ব্যতীত। তারা দু’জন সবসময় একসাথেই করে। জাভিয়ানের খাওয়া শেষ হলে সে ড্রয়িংরুমে বসে বাবার সাথে অফিস সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করে। হানিয়া সেই ফাঁকে খেয়ে নেয়। তারপর জাভিয়ানের জন্য তেল গরম করে নিয়ে আসে। মি.তালুকদার নিজের রুমে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। হানিয়া জাভিয়ানের পায়ের কাছে বসে পরে,, তারপর একটা সোফার পিলো নিজের কোলে নিয়ে সেটার উপর একটা পুরানো কাপড় দিয়ে সেখানে জাভিয়ানের একটা পা রেখে তেল মালিশ করতে থাকে। বাম পা’টায় একটু বেশিই চোট পেয়েছে তাই সেটার জন্য এখনো ভুগতে হচ্ছে।

জাভিয়ানের পায়ে তেল মালিশ করার সময় সোহা এসে সেখানে উপস্থিত হয়। সে হানিয়াকে মালিশ করতে দেখে একটা ব্যঙ্গাত্বক হাসি দিয়ে বলে–

–এতদিনে একদম ঠিক জায়গায় বসে আছো। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোটা ছিল হয়নি। জাভিয়ান তোমাকে তোমার সঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে।

আকস্মিক জাভিয়ান সোহার এমন বক্তব্যে হতভম্ব হয়ে যায়। হানিয়ার ততক্ষণে কাজটা শেষ হয়ে গেছে। সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে সোহার সামনে গিয়ে বলে–

–বিশ্বাস করো এই চাঁদের প্রতি আমার বিন্দু পরিমাণেও হাত বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। বামন হয়ে আমি একজন বামন কেই আশা করেছিলাম নিজের জীবনে। কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বরাবরই নিষ্ঠুর।

কথাটা বলে হানিয়া একটা হাসি দিয়ে সোহার সামনে থেকে সরে যায়। হাতটা ধুয়ে এসে জাভিয়ানকে ধরে নিয়ে উপরে চলে আসে।

___________________

তিনদিন পরের ঘটনা। এর মধ্যে মি.চৌধুরী এসে পরেছে দেশে। জাভিয়ান আর সে খুব শীঘ্রই দেখা করতে চাইছে। তারা ঠিক করে আগামীকাল জাভিয়ানের অফিসে তারা দেখা করবে। সেখান থেকে বিকেলে বের হয়ে বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে স্পর্শর কাছে যাবে।

জাভিয়ান আজ অফিসে এসেছে। দীর্ঘ তিনমাস পর সে অফিসে পা রাখলো। তার পা’টাও আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে। মি.চৌধুরীর সাথে কথা বলা শেষ করে জাভিয়ান গাড়িতে সময় দেখে নেয়। কাটায় কাটায় দুপুর বারোটা বাজে। হানিয়ার ছুটি হবে আর পনেরো মিনিট পর। সে ভাবে আজ হানিয়াকে কলেজ থেকে নিতে সেই যাবে। যেউ ভাবা সেই কাজ। চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখা কোর্টটা হাতে নিয়ে কেবিন থেকে বের হবে তখনি কেউ একজন নক করে। জাভিয়ান তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলে স্টাফটি প্রবেশ করে। পিয়ন এসেছে,,তার হাতে একটা মাঝারি সাইজের খাম। পিয়ন তার দিকে খামটি বাড়িয়ে দিয়ে জানায় এটি জাভিয়ানের নামে এসেছে। জাভিয়ান খামটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে পিয়নকে বিদায় জানায়।

পিয়ন চলে যাওয়ার পর জাভিয়ান খামটি ছিঁড়ে। খামের ভেতর এমন কিছু পায় যা তার পুরো দুনিয়া উলটপালট করে দেয়। তার আশেপাশের সব কিছু গোলগোল ঘুরতে থাকে। জাভিয়ান ধপ করে বসে পরে তার চেয়ারে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। হুট করে একটা কথা মাথায় আসে। সে খামটা হাতে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, তারপর হনহনিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।

নিজেই গাড়ি চালিয়ে হানিয়ার কলেজে এসে উপস্থিত হয়। হানিয়ার মাত্রই ছুটি হয়েছে। সে আর কিছু স্টুডেন্ট আদিয়াত আর আরেকজন টিচারের সাথে একটা গ্রুপ প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছিলো। তখনই জাভিয়ান হুট করে এসে সকলের মাঝ থেকে হিড়হিড়িয়ে টানতে টানতে তাঁকে নিয়ে এসে গাড়িতে এক প্রকার ছুঁড়ে মারে। বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যায় যে হানিয়া কোন রিয়েক্ট করতেও সময় পায় না। জাভিয়ান তাকে গাড়িতে বসে নিজেও বসে পরে ড্রাইভিং সিটে। হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বাসায় এসে পরে। রাস্তায় হানিয়া তার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ জিনিস করে কিন্তু জাভিয়ান কোন উত্তর দেয় না। গাড়ির স্পিড কমাতে বললেও সে শুনে না। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নিজে বের হয়ে হানিয়াকে বের করে আনে। তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আগের ন্যায় টেনে নিয়ে যেতে থাকে বাড়ির ভেতরে।

কলিংবেল দেওয়ার পর কুলসুম দরজা খুলে দেয়। ড্রয়িংরুমে সোহা, মি. এন্ড মিসেস তালুকদার বসে ছিলেন। জাভিয়ান তাদের সামনে দিয়েই হানিয়াছে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে মি. তালুকদার ছেলেকে থামিয়ে দেন। জাভিয়ানের চোখমুখ দেখে বিনা যাচ্ছে সে এতটাই রেগে আছে যে সামনের ব্যক্তিটির গায়ে হাত তুলতে সে দু’বার ভাববে না। বাবার নিষেধ অমান্য করে চলে যেতে চাইলে মি. তালুকদার এবার ছেলেকে ধমকে বলে–

–দাঁড়াতে বলেছি না আমি? কি হয়েছে তোমার? এতো রেগে আছো কেন তুমি? আর হানিয়াকে এভাবে টেনেই বা নিয়ে যাচ্ছো কেন?

জাভিয়াম বাবার দিকে ফিরে বলে–

–কিছু প্রশ্নের উত্তরের জন্য ওকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছি। আর রাগ টাও এই কারণেই। পেয়েছো উত্তর? যাই এখন।

–না যাবে না তুমি। যা বলার এখানেই বলো।

–এখানে বলা যাবে না।

–কেন যাবে না?

জাভিয়ান এবার চিৎকার করে বলে–

–কোন মুখে আমি তোমাদের সামনে আমার চরিত্রহীন স্ত্রীর কথাগুলো বলবো? যে কিনা একের পর এক পুরুষের সানিধ্যে যায় বিবাহিত হওয়া সত্বেও।

জাভিয়ানের কথাগুলো যেন এটম বোম হয়ে ড্রয়িংরুমে পরে। সকলে তার কথা শুনে অবাক হতেও ভুলে যায়। হানিয়া চোখ বড়বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাভিয়ান তাকে এত বড় অপবাদ দিচ্ছে? সে নাকি একের পর এক পুরুষের সানিধ্যে যায়,,এটাও শোনার বাকি ছিলো।

মি. তালুকদার এবার ভয়াবহ রকমের রেগে যায়। সে জাভিয়ানের থেকেও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে চেচিয়ে বলে–

–কি বলছ তুমি তা জানো? সজ্ঞানে আছো তো? হানিয়া তুমি ব্যতীত অন্য পুরুষের সানিধ্যে যায়? নিজের স্ত্রীকে এত বড় একটা অপবাদ দিতে তোমার বিবেকে বাধলো না?কিসের উপর ভিত্তি করে তুমি এসব বলছো?

–যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমার কাছে যার উপর ভিত্তি করে আমি এসব বলছি।

এবার হানিয়া মুখ খুলে। সে নিস্তব্ধ গলায় বলে–

–প্রমাণ গুলো একটু দেখা যাবে? নিজের চরিত্রের সার্টিফিকেটটা একটু দেখতে পারি?

জাভিয়ান তার কোর্টের ভেতর থেকে সেই খামটা বের করে সেখান থেকে কিছু ছবি বের করে হানিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে —

–নেন ম্যাম দেখেন আপনার কীর্তিকলাপের প্রমাণ।

হানিয়া ফ্লোর থেকে ছবিগুলো তুলে দেখতে থাকে। কয়েকটা ছবি তার আর আদিয়াতের আর কয়েকটা ছবিতে অন্য আরেকটি পুরুষ আর সে। পুরুষটিকে জড়িয়ে ধরে পার্কে বসে আছে তো আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে,, সে আর পুরুষটি কোন একটা কফিশপে হাতে হাত রেখে বসে আছে। এই ছবিটি সে চিনতে পারে। মুহূর্তেই হানিয়ার দেহ-মন নিজের প্রতি আফসোস ব্যস্ত হয়ে পরে। সে যে একজন ভুল মানুষকে নিজের প্রণয়ের মানুষ বানিয়েছিলো তা আবারও প্রমাণিত হয়। জাভিয়ান কোনকালেই হানিয়ার জন্য সঠিক ছিলো না।

মি. তালুকদার ছবি গুলো দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে পরে সোফায়।। মিসেস তালুকদার আর সোহা দুনিয়ার বিশ্রী সব কথাগুলো হানিয়াকে শোনাচ্ছে। জাভিয়ান তাদের আর কথা বলতে না দিয়েই হানিয়াকে টেনে নিজেদের রুমে নিয়ে আসে। রুমে এনে ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে। হানিয়া পরে গিয়ে হাতে আর পায়ে হালকা ব্যথা পায় কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। সে নিজের মনকে নিজেকেই শান্তনা দিচ্ছে এই বলে “সকলের কপালে ভালোবাসা থাকে না হানিয়া”

জাভিয়ান একহাত কোমড়ে রেখে আরেক হাত মুখে রেখে পেছন ফিরে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে। হুট করে হুংকার দিয়ে হানিয়ার কাছে এসে তার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে বলে–

–এই জন্য বুঝি আমার থেকে এই দুরত্ব রাখতে শুরু করেছিস? শরীরের ক্ষুধা অন্য একজন মিটিয়ে দিচ্ছে তাই আমায় আর ভালো লাগছে না,,তাই না?

হানিয়া জাভিয়ানের হাত নিজের চোয়াল থেকে সরানোর চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না। তাই হানিয়া সেই অবস্থাতেই বলে–

–এমন কিছু বলেন না যেটার জন্য পরবর্তীতে আফসোস করতে হয়।

–আফসোসের কথা বলছিস। আমার নিজের প্রতিই আফসোস হচ্ছে তোকে বিয়ে করে। আমার কপালেই এমন চরিত্রহীন মেয়ে ছিলো? এই,,তোর এতো ক্ষুধা আমায় বলতি। তোর শরীরের যত জ্বালা আছে মিটিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার বউ হয়ে অন্যের সাথে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে পারলি? বল।

হানিয়া কিছু বলে না। নির্বাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জাভিয়ানও তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। দু’জনই চোখের মাধ্যমে নিজেদের না বলা কথাগুলো বলতে চাইছে। কিন্তু কেউই তা বুঝতে চাইছে না বুঝতে পারছে না।

হুট করে জাভিয়ান হানিয়ার চোয়াল চেপে রাখা হাতটা নরম করে ধরে। তারপর কন্ঠে মায়া নিয়ে বলে–

–আমায় কেন ভালোবাসলে না হানিয়া?

হানিয়ার কথাটা শুনে হাসি পায়। ভালোবাসে নি হানিয়া জাভিয়ানকে? এতো কিছু সহ্য করেও তো জাভিয়ানের সাথে থাকতে চেয়েছিলো,, নিজের মনের কথা জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু কি করলো জাভিয়ান? খুবই নিখুঁত ভাবে হানিয়ার মনটা ভেঙে দিয়েছে। সে জাভিয়ানকে ফিরতি প্রশ্ন করে–

–ভালোবাসার কোন কারণ দিয়েছিলেন?

হানিয়া প্রশ্নের কোন উত্তর খুজে পায় না জাভিয়ান। সে নিজের মাথাটা এগিয়ে এনে হানিয়ার কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে। হানিয়াও চোখ বন্ধ করে নেয়। জাভিয়ান চোখ রেখেই বলে–

–বউ।

–হুম।

–ভালোবাসিস আমায়?

–নাহ।

একবাক্যের উত্তরটি জাভিয়ানকে বাজেভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে সক্ষম। তাও সে বলে–

— ভালোবাসা দেই একটু?

–ভালোবাসা নাকি অধিকার প্রয়োগ করতে চান?

–যদি বলি ভালোবাসা?

–বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। কারণ ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয়।

–আচ্ছা,, তোমার কথাই। একটু অধিকার প্রয়োগ করি?

হানিয়া কোন উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। সবসময় ভুল করা জাভিয়ান আবারো একটা ভুল করে। সে হানিয়া নিরবতাকে সম্মতিসূচক নিরবতা মনে করে। জাভিয়ান হানিয়ার কপাল থেকে নিজের কপাল সরিয়ে সেখানে নিজের পুরুষালি ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। স্পর্শটার স্থায়ীত্ব ছিলো বেশ অনেকটা সময়। তারপর জাভিয়ান নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিতে থাকে হানিয়া চোখে,,কপোলে। বলতে গেলে পুরো মুখে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিতে থাকে। জাভিয়ান এক প্রকার ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হুট করে হানিয়ার ফোন বেজে উঠে। জাভিয়ান সেটাকে ইগনোর করে নিজের কাজ করতে থাকে। কিন্তু ফোন আসা আর বন্ধ হয় না। তিনবারের সময় জাভিয়ান বিরক্ত হয়ে হানিয়াকে ছেড়ে তার ফোনটা নিজেই তুলে। সেই “জানু” নামে সেভ করা নাম্বারটি থেকে কল এসেছে। জাভিয়ান ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে।

সে কিছু বলার পূর্বেই ফোনের অপর পাশের লোকটিই আগে বলা শুরু করে–

–হানিয়া আজ বিকেলের দিকে দেখা করতে পারবে? তোমাদের বাসার পেছনের ওই পার্কটায়। ইটস ভেরি আর্জেন্ট।

জাভিয়ান এতক্ষণ হানিয়ার মধ্যে ডুবে ছিলো,,তাই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা প্রায়ই ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু এই ফোন কলটি তাকে সেইসব কথা পুনরায় মনে করিয়ে দেয়। সে রেগে বলে–

–না পারবে না দেখা করতে। এই তুই কে বে? জানিস না হানিয়া বিবাহিত? একটা বিবাহিত,, সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়েকেই পেলি রিলেশনে জড়ানোর জন্য? দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব পরেছিলো?**** ****

জাভিয়ানের অকথ্য গালাগালি নিতে না পেরে ব্যক্তিটি ফোনটা কেটে দেয়। লোকটি ফোনটা কেটে দেওয়ায় জাভিয়ান আরো রেগে যায়। সে তাট হাতের থাকা ফোনটা আছাড় মারে ফ্লোরে। এতেও তার রাগ কমে না বলে তার পায়ের বুট জুতা দিয়ে পারিয়ে পারিয়ে ফোনটার ভবলীলা সাঙ্গ করে।

ফোনটা ভাঙা শেষ হলে সে হানিয়ার কাছে এসে তার চোয়াল চেপে বলে–

–আর যাই করি না কেন তোর মতো চরিত্রহীন ছিলাম না। সোহার সাথে ঢলাঢলি করতাম কিন্তু সেটাও তোরই সামনে। তোর পেছনে কখনো কোন মেয়ের দিকে চোখটা পর্যন্ত তুলে দেখি। আর তুই কি করলি??

হানিয়া চুপ করে তাকিয়ে দেখতে থাকে জাভিয়ানকে। জাভিয়ান নিজেই বলে–

–আই ওয়ান্ট ডিভোর্স। এতদিন তুই চাইতি,, আজ থেকে আমিও চাই। ডিভোর্স চাই তোর থেকে,,তোর মতো চরিত্রহীন মেয়ের থেকে মুক্তি চাই।

কথাগুলো বলতে বলতে জাভিয়ানের চোখ থেকে পানি বের হতে থাকে। জাভিয়ান কথাটা শেষ করেই হানিয়াকে ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজাটা সর্বশক্তি দিয়ে বন্ধ করতে ভুলে না।

জাভিয়ানকে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে মিসেস তালুকদার তাঁকে পেছন থেকে ডেকে উঠে। জিজ্ঞেস করে সে কোথায় যাচ্ছে। তখন সে সকলকে বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে বলে–

–ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে উকিলের কাছে যাচ্ছি।

কথাটা বলেই বের হয়ে যায় বাসা থেকে। মিসেস তালুকদার আর সোহা তার কথা শুনে খুশি হলেও মি. তালুকদার ভীষণ ভেঙে পরে তার কথায়। সে হতাশ হয়ে গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমে চলে যায়।

__________________________

সেদিন দুপুরের খাওয়া আর কারোরই হয় না। কুলসুম বিকেলে হানিয়াকে খাওয়ার কথা বলতে এলে হানিয়া মানা করে দেয় খাওয়ার জন্য। শুধু কুলসুমের বাটান ফোনটা নিয়ে আধা ঘণ্টার মতো কথা বলে কারো সাথে তারপর তাঁকে বিদায় করে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।

জাভিয়ান ফিরে অনেক রাতে। এসে কারো সাথে কোন কথা না বলে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে। সকালে রুটিন মাফিক অফিসেও চলে যায়। আগের কথা মতো মি.চৌধুরী জাভিয়ানের সাথে দেখা করতে তার অফিসে আসে। তারা দু’জন বসে কথা বলছিলো তখনই আয়েশা জাভিয়ানকে ফোন দেয়। এই অসময়ে আয়েশার ফোন দেওয়া দেখে জাভিয়ান একটু ভয় পেয়ে যায়। বোনটার আবার কিছু হলো নাকি? সে ভীরু মনে ফোনটা রিসিভ করে। যা ভাবেই তাই। স্পর্শ আবার হাইপার হয়ে গেছে,,কোন ভাবেই শান্ত করা যাচ্ছে না। জাভিয়ানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার নিয়ে যেতে বলেছে সে। জাভিয়ান ফোনটা কেটে বিষয়টা মি. চৌধুরীকে জানায়। তারপর তারা সময় অপচয় না করে স্পর্শ যার কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে এতবছর সেই ডাক্তার সহ তারা বাড়ি ফিরে। বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে তারা স্পর্শের কাছে যায়। গিয়ে দেখতে পারে আয়েশা ফোন করে মিসেস জুলিয়াকেও নিয়ে এসেছে। তারা দু’জন স্পর্শকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

স্পর্শর ডাক্তার এসে তাদের জিজ্ঞেস করে স্পর্শকে দেওয়া ইনজেকশন টা সঠিক সময়ে দেওয়া হয়েছে কি না। আয়েশা আর মিসেস জুলিয়া জানায় কালকে দেওয়ার ডেট থাকলেও দেওয়া হয়নি। কথাটা শুনে ডাক্তার আর জাভিয়ান দু’জনেই ভীষণ রেগে যায়। ডাক্তার তার ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করে সেটা স্পর্শকে পুশ করতে যায় কিন্তু একটা কথা তার হাতকে থামিয়ে দেয়। মেয়েলি একটা কণ্ঠ বলে উঠে —

— কাজটা ভুলেও করবেন না ডাক্তার। তাহলে আপনার শাস্তির মেয়াদ কিন্তু বাড়বে।

সকলে কথাটার উৎসস্থলের দিকে তাকালে দেখতে পায় হানিয়া,,ইনায়া আর ডা.এহসান কবির দাড়িয়ে আছে দরজায়। তাদের পেছনে কয়েকজন পুলিশকেও দেখতে পায় তারা। আয়েশা-মিসেস জুলিয়া বাদে বাদ বাকি তিনজনই তাদের দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। হানিয়া হেঁটে জাভিয়ানের সামনে এসে বলে–

–ভুল ঔষধ দিয়ে অসুস্থ করবেন আপনারা,আর দায়ভার নিবো আমরা ভাইবোনেরা? এ কেমন নীতি মি.তালুকদার?

শব্দসংখ্যা~২৭৫০

~~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_পয়তাল্লিশ
#রহস্যের_সমাধান_অন্তিম_পর্বের_প্রথমাংশ

ড্রয়িংরুমে এক আকাশ পরিমাণ বিস্ময় নিয়ে আসে আছে মি. এন্ড মিসেস তালুকদার,, সোহা,, রোজি বেগম আর জাভিয়ান। সেখানে আরো উপস্থিত আছেন মি.চৌধুরী,, স্পর্শর কেস স্টাডি করা ডা.করিম,, আবরার,, স্পর্শ,, মিসেস জুলিয়া,,আয়েশা,, ইনায়া এবং ডা.এহসান কবির। সকলকে বসে আছে। দাড়িয়ে আছে শুধু মাত্র একটা ব্যক্তিটি যে কিনা আজকে সকল মিথ্যার অবসান ঘটাবে। হানিয়া ড্রয়িংরুমে মাঝে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্য বলা শুরু করে–

–আজ আমি আপনাদের একজন বিশ্বাসঘাতক বন্ধু ও মানুষ নামের এক অমানুষের কাহিনী আপনাদের শুনাবো। তাহলে শুরু করছি। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ রইবে আপনারা আমার কথা বলার মাঝে কোন কথা বলবেন না। আমি সবটা শেষ করে তারপর আপনারা আপনাদের প্রশ্ন থাকলে করবেন।

সকলে হানিয়ার কথায় সম্মতি জানায়। হানিয়া বলে–

–ঘটনা শুরু হয় আজ থেকে তিন বছর আগে। আমার ভাই আবরার মির্জা কক্সবাজারে গিয়ে জীবনের সুন্দরতম একটা ভুল করে বসেন। মন দিয়ে বসেন তালুকদার বাড়ির রাজকন্যা স্পর্শ তালুকদারকে। কিন্তু কক্সবাজারে থাকাকালীন ভাই তার মায়াবিনীকে নিজের মনের কথাটা জানাতে পারে না কারণ মায়াবিনীকে যে হারিয়ে ফেলেছিলে সে। ভাগ্য হয়ত তার পক্ষে ছিল তাই সে পুনরায় তার মায়াবিনীর দেখা পায় তারই শহরে। দেখা হয় তাদের,,কিছুদিন পর কথাও হয়। আস্তে আস্তে তারা একে অপরের মন দেওয়া নেওয়াও করে ফেলে। বরাবরই বাস্তববাদী ভাই আমার তার মনের কথা জানিয়ে দেয় তার মায়াবিনীকে। তার মায়াবিনী হ্যা না বললেও না-ও কিন্তু বলেনি। শুরু হয় তাদের প্রণয়ের অধ্যায়। আমার ভাইয়ের এতো সুখ সহ্য হলো না মি.সাফাত চৌধুরীর ওরফে আয়মান ভাইয়ার। ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড হিংসা করা আয়মান ভাইয়া ছিলো আমার ভাইয়ের তথাকথিত জানে জিগার দোস্ত। ভাই তাঁকে নিজের ভাই মনে করে তার জীবনের ছোটবড় সব কথা,,ঘটনা শেয়ার করত। নিজের জীবনের প্রথম অনুভূতির জোগান দাতা,,ভালোবাসার মানুষটির কথাও জানায় সে তার প্রাণের বন্ধু আয়মানকে। এবং এ-ও জানায় যে, তার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়ে গেলেই তার মায়াবিনীকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে সারাজীবনের জন্য নিজের ঘরে নিয়ে যাবে। আগেই বলেছিলাম,, ছোট থেকেই ভাইকে প্রচন্ড হিংসা করত আয়মান ভাইয়া। ভাইয়া প্রথম যখন স্পর্শ আপুকে দেখায় তাকে তখন সেও স্পর্শ আপুকে ভালোবেসে ফেলে। স্পর্শ আপুর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব আরসাল তালুকদারের মেয়ে এবং তার বাবার একসময়ের বিজনেস পার্টনার। সে তার পছন্দের কথা তার পরিবারকে জানালে,, তার পরিবারও ভাবে তাদের দুই ছেলেই বিয়ের বয়সী হয়ে গেছে। বড় ছেলের যেহেতু নিজের পছন্দের পাত্রী আছে তাকেই না হয় পুত্র বধু করা যাক। এটা ভেবেই তারা নিজেদের ছেলের প্রস্তাব নিয়ে তালুকদার বাড়িতে আসে। স্পর্শ আপুর মনে আরেকজন ছিলো বিধায় সে বাবা-মাকে জানায় এখনি বিয়ের করতে চাইছে না সে। বিষয়টা সহজে শেষ হয়ে গেলেও তা মেনে নেয় না মি.চৌধুরী। সে বিষয়টাকে নিজের হার আর ভাইয়ার জিত হিসেবে ধরে নেয়। সে ভাবে স্পর্শ আপু তার না হলে আর ভাইয়ারও হওয়ার অধিকার নেই। এবার সে নিজের ক্রিমিনাল মাইন্ডের কাজ শুরু করে। সে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে ভাইয়ার ছবি এডিট করে বেনামি নামে স্পর্শ আপুকে পাঠাতে শুরু করে। আপু ভাইয়াকে এতোটাই ভালোবাসত যে সেগুলোর একটা ছবি কেও বিশ্বাস করত না। নিজের এই প্ল্যানটা ফেইল হলে এবার সে আড়ালে না সামনা-সামনি হয় স্পর্শ আপুর। বিভিন্ন ভাবে ফুসলাতে শুরু করে আপুকে। কিন্তু এবারও তার প্ল্যান বাজে ভাবে ফেইল হয়। নিজের একের পর এক প্ল্যান ফেইল হতে দেখে মি.চৌধুরী ওরফে আয়মান ভাইয়া আরো ক্ষেপে যায়। এবার সে এমন একটা প্ল্যান বাস্তবায়ন করে যে সেটায় খুবই সুন্দর ভাবে সফল হয়।

লম্বা একটা ভাষণ শেষে হানিয়া ফুস করে দম ফেলে। গলাটা শুকিয়ে গেছে তার। কুলসুমকে ইশারায় বুঝায় তাঁকে পানি দিতে। কুলসুম তাকে পানি এনে দিলে সে সেটা পান করে। এর মধ্যে দেখা যায়,, আয়মান একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে। তার উপর যে হানিয়া এতোগুলো অভিযোগ এনেছেন সেটা নিয়ে কোন চিন্তাই নেই তার। জাভিয়ান,,আবরার হা করে হানিয়ার কথা শুনছে। হানিয়া একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে–

–আমার বাবা মির্জা সাহেব বরাবরই নিজের ইচ্ছে গুলো আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পছন্দ করেন। আয়মান ভাইয়া সেটা খুব ভালো করেই জানত। সে স্পর্শ আপু আর ভাইয়ার কথাটা বাবাকে জানায়। এবং সেই সাথে আরো একটা বাজে কাজ করে। কি সেটা জানতেন চান মি.তালুকদার?

জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে হানিয়া প্রশ্নটা করে। জাভিয়ান নির্বোধের মতো মাথা নাড়িয়ে বুঝায় সে জানতে চায়। হানিয়া তার সম্মতি পেয়ে বলে–

–সে আপনার পুতুলের কিছু বাজে ছবি আমার বাবাকে দেখিয়ে এটা প্রমাণ করে যে সে একজন চরিতহীন মেয়ে। তার সাথে ভাইয়ের বিয়ে হলে ভাই ঠকে যাবে। বাবা চান নি তার ছেলে ঠকে যাক। তাই সেও একটা বড় স্টেপ নেয় যার কারণে উলটপালট হয়ে যায় দু’টি ভালোবাসার মানুষের সুন্দর জীবন। বাবা ভাইয়াকে না জানিয়ে তার বাল্যবন্ধুর মেয়ের সাথে ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলে। ভাইয়ার চাকরি পার্মানেন্ট হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরেই সে ভাইয়াকে না জানিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অসুস্থতার নাটক করে করে ভাবীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। ভাইয়া শুধুমাত্রই বাবা-মায়ের চাপে পরে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ত্যাগ করে অন্য এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনের আবদ্ধ হয়। বিয়ের পর ভাইয়া চান নি নিজে বিবাহিত হয়ে স্পর্শ আপুকে ঠকাতে। পরামর্শ চায় প্রাণপ্রিয় বন্ধুর কাছে। সে তাকে পরামর্শ দেয় আপুর ভালোবাসাকে চূড়ান্ত অপমান করতে। বোকা ভাই আমার তাই করে। লাস্ট যেদিন সে আপুর সাথে দেখা করে সেদিন চূড়ান্ত অপমান করে আপুকে। অপমান করে সে তো চলে আসে কিন্তু তার মায়াবিনীকে ছেড়ে আসে এক পিচাশের কাছে। সেদিন শুধু ভাইয়াই স্পর্শ আপুর সাথে দেখা করতে যায় নি,,তার পেছন পেছন গিয়েছিলো এই বন্ধুরূপী নিকৃষ্ট কিটটাও। এবার বাকি কথা স্পর্শ আপু বলবে। কি হয়েছিলো সেদিন তার সাথে? কেনোই বা মি.তালুকদার সেদিন রাস্তায় এলোমেলো অবস্থায় পেয়েছিলো তার সদাসর্বদা গুছিয়ে থাকা বোনকে?

হানিয়ার কথায় সবাই এবার স্পর্শের দিকে তাকায়। বাবা-মায়ের মাঝে বসে থাকা স্পর্শকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। পুতুল পুতুল লাগছে। সে হাত দিয়ে ইশারা করে হানিয়াকে তার কাছে ডাকে। হানিয়া তার সামনে এসে দাঁড়ালে স্পর্শ তার মাকে বলে হানিয়াকে বসার জন্য জায়গা করে দিতে। তাদের বসে থাকা সোফাটা যথেষ্ট বড় হওয়ায় মিসেস তালুকদার সরে গিয়ে হানিয়াকে স্পর্শের পাশে বসার সুযোগ করে দেয়। স্পর্শ হানিয়ার হাত টেনে তাঁকে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। হানিয়ার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলা শুরু করে–

–সেদিন আবরার চলে যাওয়ার পর আমি ভীষণই ভেঙে পরি। কাঁদতে কাঁদতে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম। তখনই আমার সামনে এসে উপস্থিত হয় ঐ শয়তানটা। (আঙ্গুল দিয়ে আয়মানকে দেখিয়ে বলে কথাটা) এই শয়তান সেদিনও আমায় ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়। ভালোবাসার মানুষটির থেকে ধোঁকা পেয়ে মন মেজাজ একদমই ভালো ছিলো না আমার সেদিন। তাও ভদ্র ভাষায় আবারও রিজেক্ট করে দেই তাঁকে। কিন্তু এই শয়তানটা রিজেকশন সহ্য করতে না পেরে আমার সাথে জোরজবরদস্তি করা শুরু করে। নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় একটা সুনশান রাস্তায়। সেখানে আবারও আমার সাথে জোরজবরদস্তি করতে চায়। ভাগ্য আমার সহায় ছিলো বলে হাতের কাছে একটা ভারী বস্তু পেয়ে যাই। সেটা দিয়েই শয়তান টার মাথায় আঘাত করে তাঁকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করি। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই একটা গাড়ির সাথে আমার এক্সিডেন্ট হয়। চোখ বন্ধ করার আগে জাভিয়ানকে দেখি আর তাকে সব সত্যিটা বলতে চাই। কিন্ত কিছুই বলতে পারি না শুধু চোখ বন্ধ করার আগে আবরারের নামটা নিয়েছিলাম। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।

কথাটা বলা শেষ করেই স্পর্শ কান্নায় ভেঙে পরে। হানিয়া তাঁকে শান্ত করায়। ভরসা দেয়। স্পর্শকে শান্ত করে হানিয়া আবার বলতে শুরু করে–

–এরপরের ঘটনা আমাদের মি. তালুকদার বলবেন। সে স্পর্শকে আপুকে ওই অবস্থায় পাওয়ার পরে কি করেছিলো? আর কেনোই বা সে এতদিন স্পর্শ আপুকে নিজের পরিবার ও দুনিয়ার সামনে মৃত প্রমাণ করে আসছিলো?

সকলে এবার হানিয়ার প্রশ্নের উত্তরের জন্য জাভিয়ানের দিকে তাকায়। জাভিয়ান নিজের হতভম্বতা দূরে ফেলে বলতে শুরু করে–

–সেদিন আমি স্পর্শকে ওই অবস্থায় পেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এক্সিডেন্ট কেস হওয়ায় আমি যেই ক্যাবে করে ফিরছিলাম সেটাও আমায় ওই সুনশান রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিলো। মাঝে মধ্যে যাও দু’একটা গাড়ি যাচ্ছিল তারাও থামায় নি। আমি পুতুলকে নিয়ে সেখানেই বসেই কান্না করছিলাম তখনই সাফাত কোথা থেকে নিজের গাড়ি সহ আসে। আমার মাথায় তখন শুধু পুতুলের সুস্থতাই ঘুরছিলো,,এটা মনে হয় নি ও ওই রাস্তায় কি করছিলো। ওর গাড়িতে করে আমি পুতুলকে কাছের একটা হসপিটালে নিয়ে যাই। সেখানে একদিনের মতো রাখা হয় পুতুলকে। পুতুলের অবস্থা একটু স্থিতিশীল হলে তাঁকে একটা ভালো হসপিটালে সিফট করি। তখনও পুতুলের জ্ঞান ফিরে নি। আমার তখন পুতুলের লাস্টের কথাটা মনে পরে। আমি সাফাতকে পুতুল আর তার বলা নামটার কথা জিজ্ঞেস করলে সে জানায় ছেলেটা নাকি তার বন্ধু। এবং সে নাকি পুতুলকে চিট করেছে। পুতুল এটা জানতে পেরে গেলে আবরার তার শ্লীলতাহানি করতে চায়। সে আমাকে এটাও জানায় আবরার নাকি একটা প্লেবয় টাইপ ছেলে। আমিও কোন যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করে ফেলি। পুতুলের জ্ঞান ফিরে একদিন পর। তখন ও আমায় চিনতে পারছিলো না। ডা. করিম পুতুলের কেসটা শুরু থেকে দেখছিলেন। সে জানায় পুতুল তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে এবং ওর নিজের মানসিক ভারসাম্যও কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে। কথাটা শুনে আমি নিজেই প্রচন্ড ভেঙে পরি। বাবা-মাকে জানানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। তখন সাফাত আমায় আইডিয়া দেয়,, আমি এখনি যাতে পুতুলের কথা প্রকাশ্যে না আনি। আবরার নাকি এতে করে পুতুলের ক্ষতি করে দিতে পারে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি তাহলে পুতুল যদি এতদিন নিখোঁজ থাকে তাহলে বাবা-মাকে কিভাবে সামলাবো? আর সমাজই বা কি বলবে? তখন সে আমায় বলে, সে আমায় একটা মেয়ের ডেড/বডি জোগার করে দিবে,,ওই ডেড বডিতে পুতুলের জামাকাপড় পরিয়ে সেটা একটা নির্জন জায়গায় রেখে আসবো। তারপর পুলিশকে কিছু টাকা খাইয়ে বিষয়টা এমন ভাবে উপস্থাপন করব যে ওই মেয়েটাই আমাদের স্পর্শ। আমি তখন বোনের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তার সকল কথা মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করি। পুতুলকে নিয়ে ওর এত চিন্তা দেখে আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,, ও কেন আমাদের বাড়ির মেয়ের জন্য এতো দৌড়ঝাঁপ করছে? তখন ও আমায় জানায় সে নাকি পুতুলকে অনেক ভালোবাসে। ওর তখনকার কাজ আর পুতুলকে নিয়ে ওর চিন্তা ভাবনা দেখে আমি ওকে বিশ্বাস করে ফেলি। সকলের সামনে পুতুলকে মৃত প্রমাণ করা হলে, আমি তারপর ওর স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেই। দিন যত যায় ওর মেন্টাল হেল্থ আরো খারাপ হতে থাকে। লাস্টের দু’বছরের বেশির ভাগ সময় ও মেন্টাল অ্যাসাইলামে ছিলো। প্রায় হাইপার হয়ে আশেপাশের সকলকে আঘাত করত,,তখন আমার না চাইতেও ওকে অ্যাসাইলামে পাঠাতে হতো। এভাবেই চলছিলো দিনকাল। হঠাৎই এই পনেরো দিন আগে থেকে ওর আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পাই আমি। তখন আমি সাফাতকে দেশে আসতে বলি এবং জানাই ওর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু আমি এটা ঘুনাক্ষরে টের পায় নি আমার জন্যই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ রেডি হয়ে আছে।

জাভিয়ানের কথা শেষ হলে হানিয়া বলে উঠে–

–স্পর্শ আপুর কথা আমি প্রথম জানতে পেরেছি আমার এক্সিডেন্টের দিন। সেদিন ভাইয়ার থেকে আপুকে অপমান করার কথা জানতে পেরে আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমার ভাই এমন নিকৃষ্ট একটা কাজ করতে পারে। বেখায়লি ভাবে রাস্তায় হাটছিলাম ঠিক তখনই এক্সিডেন্টটা হয়। সুস্থ হওয়ার পর এবার কোমড় বেধে লেগে পরি সব সত্য বের করতে। ঠিক করি আপুর অসুস্থতার পেছনে যদি ভাইয়ার অবদান এক পার্সেন্টও থাকে তাহলে তাকেও আমি যথাযোগ্য শাস্তি দিবো। মনে আছে মি. তালুকদার (জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে) একদিন মাঝ রাতে আপনি বাহির থেকে এসে শাওয়ার নিয়েছিলেন? আমি জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন একটা কুকুরকে কোলে নেওয়ার জন্য শাওয়ার নিয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এতো রাতে বাহিরে গিয়ে কুকুর কেন কোলে নিয়েছিলেন তখন আপনি কথাটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?

জাভিয়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বুঝায় হ্যাঁ তার মনে আছে। হানিয়া তারপর বলে–

–সেদিনই আমি স্পর্শ আপুকে ওই তালুকদার বাড়ির পেছনের স্টোররুমে প্রথমবারে মতো দেখেছিলাম। সেদিন আমি আপনার পেছন পেছন ওইরুমে যাই, তারপরই স্পর্শ আপুর খোঁজ পাই। আসার সময় কি মনে করে তার সব ঔষধ থেকে একটা করে ঔষধ খুলে নিয়ে এসেছিলাম আর আপুকে রেগুলার যেই ইনজেকশন দেওয়া হতো সেটার ফেলে রাখা অ্যাম্পুলটা নিয়ে আসি। পরবর্তীতে সময় করে ডা.এহসান কবিরের সহায়তায় সেগুলোর ল্যাব টেস্ট করতে দেই। তার মাধ্যমেই জানতে পারি ঔষধ গুলো কিভাবে আপুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরবর্তীতে তার সাজেস্ট করা ঔষধ এবং মাসে দু’বার করে সাইকায়টিস্টের কাছে নিয়ে যেতে শুরু করি। তিনমাসের কোর্স শেষ করে আজ আপনাদের সামনে এই সুস্থ-সবল, প্রাণবন্ত স্পর্শ তালুকদারকে হাজির করি।

হানিয়ার তার কথা শেষ করার পর পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা ছড়িয়ে পরে। একটা মানুষ এতোটা ক্রিমিনাল মাইন্ডের হতে পারে উপস্থিত কেউ তা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। জাভিয়ান আজ নিজ বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সকলের স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে একটা হাততালির আওয়াজে। সকলে সেই দিকে তাকালে দেখতে পায় সাফাত চৌধুরী ওরফে আয়মান হাততালি দিচ্ছে আর অনেকটা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় হাসছে। সকলে খানিকটা অবাকই হয় বটে। সাফাত হাসতে হাসতেই হেঁটে হানিয়ার সামনে এসে খানিকটা ঝুঁকে কুর্নিশ করে তাঁকে। মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে–

–ম্যাম, আপনাকে স্যালুট না দিয়ে পারছি না। আপনি তো শার্লক হোমসের ফিমেল ভার্সন। এই সুন্দর,, কোমল মুখ টার পেছনে যে এতো বড় ডিটেকটিভ সত্তা লুকিয়ে আছে আমি তো প্রথম দেখায় কল্পনাই করতে পারি নি। সেদিন অবশ্য এতো কিছু খেয়াল করার সুযোগই দেন নি,, মেরে তো আমায় বৃন্দাবনই পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন।

হানিয়া বসা থেকে উঠে সাফাতের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটেও হাসি বিরাজমান। সে বলে–

–ধন্যবাদ জনাব। এখন আপনি কি অনুগ্রহ করে বলবেন আপনি কেনো এমন বাজে গেইমটা খেললেন আমার ভাইয়ের সাথে?

–অবশ্যই। আমি সুন্দরীদের অনুরোধ ফেলতে পারি না। আপনার ভাইয়ের সাথে এমন করার কারণ হলো সে নিজেই।

–মানে?

–বুঝলেন না তো। আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি। ছোট থেকেই আমরা বন্ধু। কিন্তু ও সব কিছুতে আমার থেকে এগিয়ে থাকত। পড়াশোনা,, খেলাধুলা সব সবকিছুতে আমার উপরে থাকত। এমনকি ভালোবাসার দিক দিয়েও।

–আরেকটু খোলাসা করে বলুন মি.চৌধুরী।

–আমরা যখন কলেজে উঠলাম তখন একটা মেয়েকে আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু ভাগ্য আমার এবারও সহায় হলো না। ওই মেয়েটি আবরারকে ভালোবেসে ফেললো তার এত এত গুন দেখে। ভালোবাসবেই বা না কেন? পুরো কলেজে ফেমাসবর ছিলো কিনা আবরার। আমি মেয়েটিকে প্রপোজ করলে মেয়েটি আমায় রিজেক্ট করে এবং এর কিছুদিন পর আবরারকে প্রপোজ করে। পড়াশোনায় ডুবে থাকা আবরার এসবের প্রতি ছিলো জিরো ইন্ট্রেস। ও মেয়েটিকে রিজেক্ট করে দিলে আমি আবারও প্রপোজ করি কিন্তু মেয়েটা আমায় এবারও গ্রহণ তো করেই না উল্টো ভরা ক্যাম্পাসে আমায় অপমান করে। আমাকে বলে আমি নাকি আবরারের পায়ের নখের যোগ্যও না। সেইদিন থেকে আমি ওকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করি। আমি স্পর্শকে কোন ভালোটালো বাসি না। শুধু মাত্র আবরারকে ভালোবাসার দহন কেমন সেটা বুঝাতে এসব করেছি। আর আমি এতে সফল। এখন আমার জেল হয়ে গেলেও কোন আফসোস নেই।

সাফাত হাসতে হাসতে আবার নিজের আগের জায়গায় গিয়ে বসে পরে। আবরার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার জানের থেকেও প্রিয় বন্ধু তার বিরুদ্ধে এত বড় একটা ষড়যন্ত্র করেছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। সাফাত হানিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে–

–সবই তে বুঝলাম ম্যাম। কিন্তু এটা তো বুঝলাম না আপনি আমার গোপন খবরগুলো পেলেন কিভাবে? এসব তো একজন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ জানত না।

হানিয়া এবার একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বলে–

–যে জানত সেই বলেছে মি.চৌধুরী। আপনার জমজ ভাই রাহাত চৌধুরী।

এবার সাফাত নিজেই বড়সড় একটা ঝটকা খায়। নিজের আপন,, জমজ ভাই নাকি তার সাথে এমন ধোঁকাবাজি করলো। হানিয়া এবার জাভিয়ান আর তালুকদার বাড়ির সকলের উদ্দেশ্য বলে–

–এতক্ষণ তো নিজের ভাইকে নির্দোষ প্রমাণ করলাম। এবার সময় নিজের চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণের।

শব্দসংখ্যা~২২৭৫

চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ছেচল্লিশ
#রহস্যের_সমাধান_অন্তিম_পর্বের_শেষাংশ

–আমার ভালোবাসার,,সম্মানীয় স্বামী প্রথমবার আমার চরিত্রে আঙুল কিন্তু গতকাল তুলে নি । এর আগেও সে আমার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মনে আছে মি. তালুকদার?

শেষের কথাটা হানিয়া জাভিয়ানের দিকে ফিরে বলে। জাভিয়ান হানিয়ার প্রশ্নটা শুনে লজ্জায়,, অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে ফেলে। আরসাল তালুকদার হানিয়ার সামনে এসে গম্ভীর গলায় বলেন–

–খুলে বলো বিষয়টা। ভনিতা চাচ্ছি না কোন।

হানিয়া আরসাল তালুকদারে কথায় তার দিকে ফিরে তাকায়। তার সাথে সবসময় হাস্যজ্জ্বোল ব্যক্তিটি আজ প্রথমবারের মতো এমন গম্ভীর গলায় কঠোর ভাবে কথা বলছে। হানিয়া জীবনেও অস্বীকার করতে পারবে না বা করবে না যে এই ব্যক্তিটি তাকে তাঁর নিজের বাবার থেকেও বেশি স্নেহ করেছেন। আজ কিছু মানুষের চক্রান্তের জন্য সেই পিতাতুল্য শ্বশুড়ও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। হানিয়া কি শুধু হারাবেই? সারাজীবন হেঁসে খেলে বাঁচার জন্য যেই গুটিকয়েক মানুষ আমাদের জীবনে থাকে তাদের কি হানিয়া পাবে না নিজের জীবনে?

কথাগুলো ভেবেই এতক্ষণের ইস্পাত কঠিন হানিয়াও ভেঙে পরতে চাইছে। হানিয়া নিজের চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নেয়, তারপর সেটা ফুস করে বেরও করে দেয়। নিজেকে নিজেই শান্তনা দেয় এই বলে
“সবাই জীবনে ভালো থাকে না রে হানিয়া,, তুইও সেই কাতারে। নিজের জন্মদাতা পিতাই তোকে স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে না আর এ তো তোর শ্বশুর। ” হানিয়া নিজেকে নিজেই সাহস দেয়,,তারপর সে বলে–

–আপনাদের হয়ত মনে আছে, উনার এক্সিডেন্টের আগের দিন আমরা দু’জন একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। পার্টিতে যাওয়ার আগে আমি জানতাম না পার্টিটা রাহাত চৌধুরী একটা প্রজেক্টের সফলতা উপলক্ষে হচ্ছে। তো সেখানে গিয়ে আমি একটু অস্বস্তি অনুভব করলে উনাকে বলে আমি চৌধুরী বাড়ির গার্ডেনে যাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে। সেখানে কেউ একজন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমায় টেনে হিঁচড়ে একটা ঘরে নিয়ে যায় এবং আমার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। ঘরটা অন্ধকার ছিলো বিধায় আমি ওই ব্যক্তিটির মুখটা দেখতে পারি নি। নিজের সম্মান রক্ষা করতে আমি যখন ছটফট করছিলাম,,আশেপাশে হাতড়াচ্ছিলাম নিজেকে ওই অন্ধকারের নিকৃষ্ট মানবটির পাশবিক হাত থেকে বাঁচতে তখনই হাতে একটা লোহার তৈরি বস্তু পাই। কোন কিছুর চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ওটা দিয়ে ওই ব্যক্তির মাথায় আঘাত করে তাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেই। কোন মতো রুমের লাইটের সুইচ খুঁজে টাইট জ্বালালে রাহাতকে দেখতে পাই। পরবর্তী কিছু নাটকীয়তা শেষ করে আমার স্বামী মি. তালুকদারকে বিষয়টা জানালে সে তো আমার কথা বিশ্বাস করেই না উল্টো আমায় প্রমাণ করতে বলে নিজের কথাগুলো। তাঁকে সেই অন্ধকার রুমে নিয়ে যায় সেখানকার এলোমেলো অবস্থা দেখাতে কিন্তু ততক্ষণে সবটাই ঠিক করে ফেলা হয়েছিলো। নিজের কথা প্রমাণ করতে না পারায় মি. তালুকদার আমায় রাহাত চৌধুরী ও তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে,, কিন্তু তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া মানে নিজের কথাগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করা। আমি চায়নি ক্ষমা। তখন আমার সম্মানীয় স্বামী আমাকে সকলের সামনে চূড়ান্ত অপমান করে গায়ে হাত তুলতে যায় এক ঘরভর্তি মানুষের সামনে। সেদিন আমি তাকে বলি আমি আমার কথার সত্যতা একদিন প্রমাণ করবোই এবং সেদিনই হবে তার আর আমার সংসার জীবনের শেষদিন। অবশেষে সেই দিনটি এসেই পরলো। এবার পালা নিজের চরিত্রে শুদ্ধতা প্রমাণের।

সকলে অবাক হয়ে হানিয়ার কথা শুনে। আজ যেন তাঁদের শুধু অবাক হওয়ারই দিন। তারা দেখে হানিয়া হেঁটে ইনায়ার কাছে যায় তারপর তার কাছ থেকে একটা ল্যাপটপ নিয়ে সেটায় কতক্ষণ কিছু একটা করে। তারপর সেটা সকলে দেখা যায় এমন একটা জায়গায় রেখে একটা ভিডিও প্লে করে। ভিডিওটায় দেখা যায়,,আবছা অন্ধকারে সুটবুট পরা একজন হানিয়াকে টেনে হিঁচড়ে চৌধুরীনবাড়ির পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গাটায় কোন লাইট না থাকায় পরবর্তীতে কি হয়েছে তা দেখা যায় না। কিন্তু তার মিনিট বিশেক পরেই হানিয়াকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে ওইদিক থেকে আসতে দেখা যায়। তার পেছন পেছন ওই পুরুষ অবয়বটিকেও দৌড়ে আসতে দেখা যায়। কিন্তু অবয়বটি একটুর জন্য হানিয়াকে ধরতে পারে না। হানিয়াকে ধরতে না পেরে অবয়বটি আরো ক্ষেপে গিয়ে পাশের একটা ফুলের টব লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। অবয়বটি পায়চারি করতে করতে এক পর্যায়ে আলোর মাঝে এসে পরলে সকলেই তাকে দেখতে পায়। মাথা চোট নিয়ে পায়চারি করা লোকটিকে হুবহু রাহাতের মতো দেখতে। এই দৃশ্যটি দেখে জাভিয়ান আচমকাই বলে উঠে–

–কিন্তু সেদিন সারাটা সময় তো রাহাত আমাদের সাথে কথা বলছিলো।

সকলে তার কথায় কিছুটা অবাকও হয় আবার বিরক্তিবোধও করে। হানিয়া তাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে। তারপর সকলে আবার ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে নজর দেয়। দেখা যায়,লোকটি পকেট থেকে ফোন বের করে কারো সাথে কথা বলে। তারপর ফোন কেটে দিয়ে আবার পায়চারি করতে শুরু করে। মিনিট দুয়েক পর আরেকজন কম বয়সী ছেলে আসে তার কাছে। তারা দু’জন আবার সেই দিকে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরের দৃশ্যে দেখা যায়,,হানিয়া সকলকে নিয়ে ওই দিকে যাচ্ছে।

হানিয়া তারপর ভিডিওটা পজ করে দেয়। সে বলে উঠে–

–সেদিনের এই লোকটা মি.সাফাত চৌধুরী ছিলো। অ্যাম আই রাইট মি. চৌধুরী?

–নিঃসন্দেহে আপনি সঠিক। এখন একটু খুলে বলবেন কীভাবে আপনি এতসব প্রমাণ জোগাড় করলেন?

–অবশ্যই। মি.তালুকদারের হেল্থ একটু সুস্থ হতেই আমি আসল কালপ্রিট মানে আপনাকে খুজতে লেগে পরি। সেই সাথে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার বিষয়টাও মাথায় রাখি। আমি আপনাদের বাড়ির দারোয়ানকে কিছু টাকা খাইয়ে জানতে পারি পার্টির দিন সিকিউরিটির জন্য পুরো বাড়িতে নাকি হিডেন ক্যামেরা লাগানো হয়েছিলো। তাকে আরো কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে বলি ওইদিনের সিসিটিভি ফুটেজ যেভাবে হোক জোগাড় করে আমাকে দিতে। সে লোভে পরে তাই করে। এইদিকে আমি ভাইয়ার কাছে তার বন্ধু আয়মানের খোঁজ নেই। তার ছবি দেখতে চাইলে সে আমায় আপনার ছবি দেখায়। তারপর বাবার কাছে ভাইয়ার বিয়ের সত্যিটা জানতে চাই। বাবা প্রথমে না বলতো চাইলে আমি জোরাজোরি করার পর সে আমাকে আপনার কথা জানায়। ব্যস একে একে দুই মিলে গেলো। কিন্তু আমার মুখের কথা তো আমার সো কল্ড স্বামী,, শ্বশুর বাড়ি আর পুলিশ বিশ্বাস করবে না। তাই আমি আমার জোগাড় করা প্রমাণ গুলো নিয়ে আপনার ভাইয়ের কাছে যাই। তাকে সেগুলো দেখালে আপনার ভাই আমাকে এটা জানায় যে আপনারা দু’জন দু’জনের সব সিক্রেট একে অপরের সাথে শেয়ার করেন। সে আমায় আপনার কুকীর্তি সম্পর্কে জানায়,,কীভাবে আপনি ভাইয়া আর স্পর্শ আপুকে আলাদা করেছেন। অবশেষে আজ আপনাকে সকলের সামনে এক্সপোজ করলাম।

সাফাত বসা থেকে উঠে আবারো তাল তালি দিতে থাকে। হুট করে একটা থাপ্পড়ের শব্দে আবার পুরো ড্রয়িং রুমে নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়। সাফাতের গালে থাপ্পড়টা পরেছে। সাফাত মাথা তুলে তাকে থাপ্পড় দেওয়া ব্যক্তিটির মুখটা দেখতে চায়। তার সামনে তার মা-বাবা আর ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আর তাঁকে থাপ্পড়টা তার মা’ই মেরেছে। এতক্ষণ সাফাতের মধ্যে কোন অনুতাপ দেখা না গেলেও এবার সাফাত লজ্জায় নিজের মাথা নত করে ফেলে। সাফাতের মা তার দু’হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে–

–এই ,, তোরে আমি এই শিক্ষা দিয়েছিলাম? একটা মেয়েকে চরিত্রহীন প্রমাণ করে তাঁকে তার ভালোবাসার মানুষ থেকে কিভাবে আলাদা করতে হয় এই শিক্ষা আমি দিয়েছিলাম তোকে? তোকে আমি রাহাতের চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম,, বেশি আগলে রাখতাম আর তুই আমায়,, আমার শিক্ষাকে এভাবে অপমান করতে পারলি সাফাত? কেন এমন করলি বল?আজ জানিস আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

সাফাতের বাবা তার স্ত্রীকে ছেলের কাছ থেকে সরিয়ে আনেন। পুলিশ সাফাত আর ডা.করিমকে নিয়ে যায়। ওদের পেছন পেছন সাফাতের বাবা-মা,,রাহাতও চলে যায়। সকলে রিলাক্স হয়ে বসে পরে কিন্তু বসে না শুধু মাত্র হানিয়া। কারণ তার যে এখনো নিজের চরিত্রে শুদ্ধতার প্রমাণ দেওয়া শেষ হয়নি। সে নিজের ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে তা সকলের সামনে রাখে। তারপর সেগুলোর মধ্য থেকে তিনটা ছবি নিয়ে সেগুলো উঁচু করে সকলের উদ্দেশ্য বলে–

–চরিত্রে যখন আঙুল উঠেই পরেছে এবং সেই আঙুল ভাঙার দায়িত্ব যখন নিয়েই ফেলেছি লাস্টের প্রমাণটাও পেশ করে ফেলি। এই ছবিগুলোর মধ্যে এই তিনটার বিশ্লেষণ আমি দিচ্ছি। বাকিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মি.তালুকদারকে দিলাম আমি। (একটা ছবি দেখি হানিয়া বলে) এই ছবি আমার কলেজের। সেদিন ইনায়া না আসায় আমি একা হয়ে পরেছিলাম। তখন এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছিলাম ভুল বসত আদিয়াত স্যারের সাথে ধাক্কা লাগায় আমি পরে যেতে নিলে সে আমাকে ধরে ফেলে। তার তখনই কেউ একজন এই ছবিটা তুলে। (দ্বিতীয় ছবি দেখিয়ে বলে) এটা কিছুদিন আগের ঘটনা। সেদিন আমার এক্সাম ছিলো। দেরি হয়ে গিয়েছিলো তাই সকালের ব্রেকফাস্ট না করেই কলেজে চলে যেতে হয় আমায়। চার ঘন্টা এক্সাম শেষ করে যখন বাসায় ফিরছিলাম হুট করেই কলেজের গেটে অজ্ঞান হয়ে যাই। সেইদিনও কাকতালীয় ভাবে আদিয়াত স্যার ইনায়ার সাহায্যে আমায় নিকটবর্তী একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময়টাতেও আমি অজ্ঞান ছিলাম,,বিধায় তাঁকেই আমায় কোলে করে গাড়ি থেকে বের করে ক্লিনিকের ভেতরে নিয়ে যেতে হয়। এটাও সেদিন কেউ একজন চুপিচুপি তুলে নেয়। আর লাস্টের এই ছবিটা। এই ছবিতে যেই পুরুষটিকে দেখতে পারছেন সে এই মুহূর্তে এখানে অবস্থান করছেন। এই লোকটি হলো ডা.এহসান কবির যিনি কিনা আমার বেস্টফ্রেন্ড ইনায়ার হাসবেন্ড। আরেকটা কথা জানিয়ে দেই,, আদিয়াত মাহবুব যিনি কিনা আমায় দু’দুবার হেল্প করেছেন সে-ও ইনায়ার কাছের একজন। সে আর ইনায়া ভাইবোন হয়। আর রইলো বাকি ছবিগুলোর কথা,, একুশ শতকে এসে যদি এখনো আপনারা প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে ধারণা না রাখেন,, গুটি কয়েক ছবি দেখেই নিজেদের বাড়ির বউকে চরিত্রহীন বলে বিশ্বাস করে নেন তাহলে আমার সত্যিই বলার কিছু নেই। মি.তালুকদার (জাভিয়ানকে বলে হানিয়া) কাল জানু নামের যেই কলটা এসেছিলো সেটাও ইনায়ারই ছিলো। ডা.এহসানই ইনায়াকে বলে আমায় ফোন দিতে। আপনি চাইলে আমার এই কথাও আমি এই মুহুর্তে প্রমাণ করতে পারি। করবো?

জাভিয়ান লজ্জায় চোখ তুলে হানিয়ার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। হানিয়া আবার বলে উঠে–

–আমি চাইলে এটাও আপনাদের জানাতে পারি কে আমার পেছনে স্পাই লাগিয়ে এইসব ছবি তুলেছে আর কে-ই বা আমার ছবিগুলো এডিট করে মি.তালুকদারকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি তা করবো না। আমি চাই সে নিজের ভুল নিজেই বুঝতে পাক। অনুধাবন করুক একটা মেয়ের চরিত্রে কালি লেপন করতে চাওয়ার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।(কথাটা সে মিসেস তালুকদার আর সোহার দিকে তাকিয়ে বলে। বিষয়টা সকলের নজর এরিয়ে গেলেও মি.তালুকদার আর জাভিয়ান ঠিকই লক্ষ্য করে) সবশেষে এই কথাই বলতে চাই,,এই পর্যন্ত ছিলো আমার আজকের কথা। এখন আমি তালুকদার বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিতে চাই। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে আমায় কথাগুলো ধৈর্য সহকারে শোনার জন্য। (আবরারে দিকে তাকিয়ে বলে) ভাই,, আমার কাজ শেষ। চলো যাওয়া যাক।

হানিয়ার কথা শেষ হলে আবরার,, ইনায়া,, ডা.এহসান,, মিসেস জুলিয়া আর আয়েশা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাঁদের দাঁড়াতে দেখে তালুকদার বাড়ির সকলেও দাঁড়িয়ে পরে। জাভিয়ানের ছটফট করছে হানিয়ার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু হানিয়ার শক্ত চোখমুখ দেখে এগিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। হানিয়া আবরারের হাত ধরে চলে আসবে তখন মি.তালুকদার তাঁকে পেছন থেকে ডেকে উঠেন। হানিয়া তার ডাক উপেক্ষা করতে পারে না, শত হোক লোকটা একসময় তাকে বাবার ভালোবাসা,,স্নেহ দিয়েছে। হানিয়া পেছন ফিরে তার দিকে তাকায় ঠিকই কিন্তু এগিয়ে আসে না তার কাছে,,নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। মি. তালুকদার নিজেই হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে তার পানি। সে হানিয়ার মাথায় হাত রেখে বলে–

— আমি দুঃখিত মা। তোমায় যথাযথ সম্মান দিতে না পারার কারণে। সকলের মতো আমিও তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে চাই,,বলতে পারো অনুরোধও,, আরেকবার ভেবে দেখলে হতো না? একটা সম্পর্ক ভাঙা যতটা সহজ তার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন হলো তৈরি করা। আরেকটা বার ভেবে দেখো মা। আরেকটা বার সুযোগ দাও আমাদেরকে,, জাভিয়ানকে।

–মিথ্যা বলবো না, এই বাড়িতে একমাত্র আপনার আর মনির থেকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েছি। আপনারা আমায় নিজেদের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছিলেন,, ভালোবেসেছেন। এই ভালোবাসার প্রতিদান আমি কোনদিনই দিতে পারবো না। কিন্তু এত সবের মাঝে যার ভালোবাসাটাই আসল সে কিন্তু সবার পেছনে পরে আছে। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝের ঘটনাগুলো আমি চার দেওয়ালেই রাখতে চাই। কিন্তু যেগুলো সে চার দেওয়ালের বাহিরে করেছে সেগুলোর কি হবে? আজ সে গুটি কয়েক ছবি দেখে সকলের সামনে আমায় চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে,,কাল তো উকিলের কাছেও চলে গেছে ডিভোর্সের জন্য। দেখা গেলো,,কেউ একজন এসে বললো জাভিয়ান তোমার স্ত্রীকে আমি ওই লোকের সাথে পার্কে বসে থাকতে দেখেছি তখন উনি সত্য-মিথ্যাট যাচাই-বাছাই ছাড়াই আবারও ডিভোর্স চাইলো। আপনিই বলুন বাবা,,এমন সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত আছে? মা-ও তো আমায় পছন্দ করেন না। আজ পর্যন্ত নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেয় নি। তার চেয়ে ভালো নয় কি আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া। আমি মিডেলক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে,,আপনাদের মতো হাইক্লাস ঘরের বউ হওয়ার যোগ্য না আমি। আমি চলে যাওয়ার পর আপনাদের ক্লাস অনুযায়ী একজন মেয়ের সাথে আপনাদের ছেলের বিয়ে দিয়েন। প্লিজ বাবা আমাকে এমন কোম অনুরোধ করবেন না যেটা আমি রাখতে পারব না। আমি নিজের বাবার অনুরোধ রাখতে না পারলেও এতটা কষ্ট পাবো না,, যতটা না আপনারটা না রাখতে পারলে পাবো।

মি.তালুকদার আরো কিছু বলতে চাইলে এবার মুখ খুলে আবরার। সে বিনীতভাবে বলে–

— আমার বোন আমার বাবার জন্য বোঝা হলেও তার ভাইয়ের জন্য কিন্তু বোঝা নয়। তার সাথে কি কি হয়েছে সেটা আপনারা একি বাড়িতে থেকে না জানলেও আমি কিন্তু কিছুটা হলেও জানি। তাই আমিও চাচ্ছি না তাকে এই লোক দেখানো সম্পর্কে বেঁধে রাখতে। ডিভোর্সটা মিউচুয়ালি হোক,, আমার বোনও মুক্তি পাক এই সম্পর্ক থেকে আর আপনাদের ছেলেও। তারপর না হয় আপনারা আপনাদের ছেলের জন্য উঁচু বংশের মেয়ে নিয়ে আসলেন। আমি নিচু বংশের, অযোগ্য বোনকে আমার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

আবরারের কথা শুনে মি.তালুকদার বুঝতে পারেন তার পিঠ পেছনে এমন অনেক কিছুই হানিয়াকে সহ্য করতে হয়েছে যার কারণে মেয়েটা আজ নিজের তালাক পর্যন্ত করতে চাইছে। মি. তালুকদার হানিয়াকে বলার মতো আর কিছুই পান না। রোজি বেগম আর কুলসুম এসে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করে। হানিয়াও এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সেও তাদের জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। তারপর স্পর্শকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে আবরারের কাছে এসে পরে। জাভিয়ানের দিকে ভুলেও তাকায় না। জাভিয়ান চাতক পাখির ন্যায় হানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সুযোগ খুঁজছে একটা হানিয়ার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। যখন দেখলো হানিয়া তার ভাইয়ের হাত ধরে তালুকদার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন আর অপেক্ষা না করে দৌড়ে হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে হানিয়াকে স্পর্শ করতে চাইলে হানিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় আবরার। কঠোর গলায় জাভিয়ানকে বলে–

–ভুলেও আমার বোনের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করবেন না জাভিয়ান। এতদিন হানিয়া একা ছিলো তাই তার সাথে এতকিছু করতে পেরেছেন। কিন্তু এখন তার ভাই আছে তার সাথে। বোকা বোন আমার যদি আগেই এসব আমাকে জানাত তাহলে কবেই না তাঁকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে আমার কাছে নিয়ে যেতাম। যাইহোক,, সরে দাঁড়ান আমাদের সামনে থেকে। আমাদের বাড়ির রাজকন্যাকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি চিরকালের জন্য। ডিভোর্সের ব্যাপারটা আপনাদের দিক থেকে না হলে আমরা পাঠিয়ে দিবো পেপারস।

জাভিয়ান তাও সরে দাড়ায় না। নাছোড়বান্দার মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হানিয়া তাকে সরতে না দেখে মি.তালুকদারকে বলে–

–বাবা আপনার ছেলেকে সরে যেতে বলুন। আমি এই শেষ বেলায় কোন ঝামেলা চাচ্ছি না।

মি. তালুকদার ভীষণ ভেঙে পরেছেন। একদিকে মৃত মেয়েকে আবারও ফিরে পাওয়ার খুশি অন্যদিকে মেয়ের মতো আরেক মেয়ের চির বিদায়। সে ধীর গলায় বলে —

–জাভিয়ান সরে এসো। হানিয়াকে যেতে দাও। আর ঝামেলা করো না।

–বাবা ও……

–যা বলছি তাই করো। এটা আমার আদেশ।

মি.তালুকদার কিছুটা জোরে কথাগুলো বলে। জাভিয়ান সরে দাড়ায় হানিয়াদের সামনে থেকে। হানিয়া যাওয়ার আগে একটা কথাই বলে–

–মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি বুঝে শুনে ব্যবহার করতে হয়। এ দুটো একবার বের হয়ে গেলে আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। কথাটা মনে রেখে ভবিষ্যতের সঙ্গিনীর সাথে জীবনযাপন করবেন। দেখবেন আপনার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। দোয়া রইলো আপনার জন্য। অন্য কাউকে নিয়ে সুখের সংসার হোক আপনার।

চোখে পানি ছলছল করছে কিন্তু মুখে একটা সুন্দর হাসি নিয়ে কথাগুলো বলে হানিয়া। জাভিয়ান নির্বাক হয়ে তাট কথাগুলো শুনে। বলার মতো কোন মুখ নেই আজ তার। হানিয়া চলে যায় তার ভাইয়ের সাথে। যেই তালুকদার বাড়িতে আজ খুশিদের মেলা বসানোর কথা ছিলো সেখানে আজ বিষাদেরা নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসেছে।

শব্দসংখ্যা~২৩০০

~~চলবে?