#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_তিপ্পান্ন
আবরার ইনায়ার সাথে কথা বলছে। বিষয় হানিয়ার থাকার জন্য একটা গার্লস হোস্টেল। আবরার প্রথমে চেয়েছিলো ঢাকায় গিয়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করবে,,যেখানে সে আর তার বোন থাকবে। কিন্তু হানিয়া তাকে মানা করে দেয়। বলে তার সাথে যদি আবরারও ঘরছাড়া হয় তাহলে তার বাবা-মা এসে কষ্ট পাবে। ভাববে তার জন্যই হয়ত আবরার ঘরছাড়া হয়েছে। তাই সে যেন ঢাকাতে তাদের বাসায় থাকে।আবরার শুরুতে তার কথায় অসম্মতি জানায়। কিন্তু হানিয়া অনেক চেষ্টার পর তাকে তাদের বাসায় থাকতে রাজি করায়।
ইনায়া তাকে জানায়,, এখন মাসের মাঝামাঝিতে কোন হোস্টেলেই সিট খালি পাওয়া যাবে না। হানিয়াকে সিট পাওয়ার জন্য নতুন মাসের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু হানিয়া ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। কারণ মাস শেষ হতে এখনো ১২ দিন আছে,, আর নতুন মাসের একদম শুরুতেই তাদের এক্সামের ডেট পরেছে। হানিয়া আজকালের মধ্যেই ঢাকায় ফিরে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে চাচ্ছে। তার চাওয়া অযৌক্তিক নয়। হানিয়া স্কুল-কলেজ লাইফে পড়াশোনার প্রতি এতো মনোযোগী না হলেও ভার্সিটিতে উঠে সে ভালোই মনোযোগী হয়েছে। এর ফলও পেয়েছে ফার্স্ট ইয়ার এক্সামে। ডিপার্টমেন্টে টপ করা কি মুখের কথা?
আবরার হানিয়ার ইচ্ছের কথা জানালে,,ইনায়া হুট করে বলে–
–তাহলে ভাইয়া ও এই কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকুক।
বোনকে অন্যের বাসায় রাখতে আবরার নারাজ। কিছু ভালোবাসা দূর থেকেই সুন্দর। হ্যাঁ, সে জানে ইনায়া আর তার ফ্যামিলি কতটা ভালো। তাও সে তার বোনকে অন্যের বাড়িতে রাখবে না। তার উপর ইনায়ার একজন অবিবাহিত যুবক ভাই আছে। আমাদের তথাকথিত সমাজ বরাবরই মেয়েদের দোষ খুজে বের করতে পারদর্শী। সে অসম্মতি জানিয়ে দেয় এই বিষয়ে। কিন্তু ইনায়া নাছোড়বান্দার মত জেদ করতেই থাকে। সে তার যুক্তি হিসেবে বলে–
–হানিয়ার তো অনেক পড়া জমে গেছে আমার সাথে থাকলো সেসব দিকে আমি ওকে হেল্প করতে পারব। তার উপর ভাইয়া তো আছেই,,সেও হানিয়াকে গাইড করতে পারবে। আর ওর মেন্টাল হেল্থের কথাটা একবার চিন্তা করেন ভাইয়া। একা থাকলে ওর পুরোনো স্মৃতি গুলো ওকে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে৷ আমি ওকে যতটা চিনতে পেরেছি সেই ধারণা থেকে বলছি,,ওর বুক ফাটে কষ্টে কিন্তু মুখ থাকে নিশ্চুপ। ও আপনাকে যতই দেখাক ও স্ট্রংগ আছে কিন্তু দিনশেষে ওর নিরব কান্নাগুলো কিন্তু কেউ শুনে না।
ইনায়ার কথাগুলো ভাবায় আবরারকে। ইনায়ার কথার ৭০% সঠিক। প্রত্যেক সকালে হানিয়ার হালকা ফোলা চোখ আবরারের বুকে বিষাক্ত তীরের মতো আঘাত হানে। আবরার একটা লম্বা শ্বাস ত্যাগ করে,, ইনায়াকে ব’লে–
–হানিয়া কি রাজি হবে? ও’ বলেছে ও’ কারো কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চায়।
ইনায়া হালকা হেঁসে আবরারকে আশ্বাস দিয়ে ব’লে–
–রাজি না-হয়ে পারবেই না। না রাজি হলে একদম কান টেনে নিয়ে আসবো না আমি আমার সাথে। আমার হক আছে না ওর উপর? আমি এবার সেটা প্রয়োগ করবো।
ইনায়ার কথা শুনে আবরার অল্প শব্দ করে হেঁসে দেয়। টুকটাক আরো কিছু কথা বলে তারা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেয়।
_____________________________
সায়মা,,আহনাফ আর হানিয়া আজ বিকেলে একটু বের হয়েছে। উদ্দেশ্য হানিয়াকে সেখানের কাছাকাছি কিছু জায়গা ঘুরে দেখানোর। হানিয়াকে সায়মা প্রথমে প্রস্তাবটা দেওয়ার পর হানিয়া মানা করে দেয়,,সায়মা তারপর সেসব জায়গার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলে হানিয়ারও জায়গা গুলো দেখার আগ্রহ হয়। এছাড়া, কয়েকদিন পর হানিয়া চলেও যাবে এখান থেকে তাই ভাবলো একটু ঘুরে দেখা যাক। ঘুরতে বের হওয়ার আগে হানিয়া সায়মাকে সাফসাফ বলে দিয়েছে–
–আপনার দুই ভাইয়ের এক ভাইও যদি আমাদের সাথে আসে তাহলে আমি যাবো না।
হানিয়ার এমন ক্লিয়ার কাট কথার উপর সায়মা বেশি কথা বলতে পারি নি। অগত্যা রাতুল আর জাভিয়ানকে রেখেই তারা তিনজন রওনা হয়েছে। তারা বাসা থেকে একটু দূরের একটা পার্কে এসেছে। পার্কটা বাচ্চাদের খেলার জন্য অনেক কিছুই আছে সেই সাথে ছোট্ট একটা পুকুরের মতো আছে। সায়মা একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বলে–
–হানিয়া রে,, আর হাটতে পারছি না। আয় এখানে বসি।
হানিয়াও তার কথায় সম্মতি দেয়। তারা দু’জন সেখানে গিয়ে বসে পরে,,আর আহনাফ তার সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে থাকে। একটু পর হুট করে আহনাফ হানিয়ার কাছে এসে তার হাত টেনে নিয়ে বলে–
–মাম্মাম,, তলো না আমাল তাতে কেলবে। তলো না তলো না।
আহনাফ নাছোড়বান্দার মতো জেদ করায় হানিয়াকে যেতেই হয়। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আহনাফের সাথে গিয়ে খেলতে থাকে। তাদের দু’জনকে খেলতে দেখে আরো কয়েকজন বাচ্চা এসে তাদের সাথে জয়েন করে। অনেকটা সময় তারা হৈ-হুল্লোড় করে খেলতে থাকে। হানিয়া বাচ্চাদের সাথে মিশে সময়ের কথা ভুলে গেছে।
একঘন্টার মতো হুড়োহুড়ি করে হানিয়া আর আহনাফকে টেনে এনে বসা সায়মা। দুজনের হাতে দু’টো পানির বোতল দেয় খেতে। আহনাফ বায়না ধরে সে আইসক্রিম খাবে। আবহাওয়া গরম থাকায় সায়মা প্রথমে মানা করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যায়। সায়মা হানিয়াকে সেখানে বসতে বলে আহনাফকে নিয়ে রাস্তার ওপর পাশে চলে যায় আইসক্রিম আনতে। হুড়োহুড়ি করায় হানিয়াও ঘেমে টায়ার্ড। সে সেখানে বসেই বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখতে থাকে তখনই তার পাশে কেউ একজন ধপ করে বসে পরে। হানিয়া ব্যক্তিটির দিকে তাকালে দেখতে পায় তার সম্মানীয় স্বামী মহাশয় বসেছে তার পাশে। হানিয়া একটু জোরেই বলে–
–আপনি এখানে কি করছেন?
হানিয়ার গলার আওয়াজটা একটু উঁচুই ছিলো। যার কারণে আশেপাশের কয়েকজন মহিলা তার দিকে তাকায়। জাভিয়ান মহিলাদের তাকানো দেখে একটা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে–
–বউ রাগ করে চলে এসেছে,,তাই মানাতে এসেছি। আপনারাই একটু বুঝান না,,রাগ করে কি ছেড়ে চলে আসতে হবে? ছাড়াছাড়ি কি কোন কিছুর সমাধান?
মহিলা গুলো জাভিয়ানের কথায় ইমপ্রেস হয়ে যায়। তারা হানিয়ার কাছে এসে তাঁকে বুঝাতে থাকে। রাগ করা ভালো কিন্তু তাই বলে ছাড়াছাড়ি করে ফেলবে এটা ঠিক না। আরো অনেক কিছু বুঝাতে থাকে। জাভিয়ান তাদেরকে বুঝাতে দেখে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে। আর কেউ তার হাসি না দেখলেও হানিয়া দেখে ফেলে। হানিয়া তাদের উদ্দেশ্য শান্তসুরে বলে–
–কোন নারী কি তার সংসার সামান্য রাগ বা অভিমানের কারণে ছেড়ে আসবে? আপনিও নারী আমিও নারী,, আমরা বুঝি এই সমাজে আমাদের অবস্থান কোথায়। আমি সামান্য কোন রাগ বা অভিমান করে তার ঘরে ছাড়ি নি। এক বুক কষ্ট আর অপমান নিয়েই ঘর ছেড়েছি। যার জন্য আমি শ্বশুর বাড়ি পেলাম সেই যদি আমার না হয় তাহলে আমি ওই বাড়িতে কার জন্য থাকবো? উনি যতটা সহজ আর হাসি মুখে বলেছে আপনারাই বলুন এমন ব্যাপারটা এতো সহজ হলে আমি ঢাকা থেকে এই রাজশাহীতে আসতে পারতাম?
কথাগুলো মহিলাদের পাশাপাশি জাভিয়ানকেও ভাবায়। সত্যিই কি জাভিয়ান হানিয়ার না? পরক্ষণেই জাভিয়ান ভাবে–
— না না। হানিয়া যেমন জাভিয়ানের,,তেমনি সেও হানিয়ার।
মহিলা গুলো হানিয়ার প্রশ্নের কোন সদুত্তর করতে পারে না। হানিয়া তাদের চুপ থাকতে দেখে সেখান থেকে চলে আসার জন্য হাঁটা লাগায়। হানিয়া সায়মা আর আহনাফকে রেখেই বাসার উদ্দেশ্য চলতে শুরু করে। আসার সময় সে রাস্তাটুকু ভালো করে দেখছিলো,বিধায় বাসায় ফিরতে তার তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। জাভিয়ানও তার পেছন পেছন আসে। কিন্তু কথা বলার মতো কিছু পায় না।
বাসায় ফিরে হানিয়া সোজা তার রুমে চলে যায়। বোরকা হিজাব না খুলেই শুয়ে পরে বেডে। ভাবতে থাকে জাভিয়ানের বলা কথাটা।
–কত সহজে বলে দিলো রাগ করে চলে এসেছি। কিসের জন্য রাগ? আদোও তার উপর রাগ করার অধিকার আমার ছিলো? কোন অধিকার ছিলো আমার তার উপর? একদিন অধিকার দেখিয়ে তার না হওয়া বউকে তার রুম থেকে বের করে দিয়েছিলাম বলে কেমন মার’টা মেরেছিলো। সে হয়ত ভুলে গেছে। কিন্তু আমি তো ভুলি নি। তার মারের দাগ গুলো এখনো আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার দাগগুলো কেউ দেখে না,,কিন্তু আমি কত সহজে সেগুলোর চিহ্ন বয়ে সকলের সাথে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করি। কেউ আমার ভেতরটা কখনো দেখতে চেয়েছে? জানতে চেয়েছে এই হানিয়া কি চায়? বুঝতে চেয়েছে আমার অনুভূতি গুলো? শুনতে চেয়েছে কি চাই আমি? এই সবের উত্তর যে “না” হবে সেটা তারা নিজেরাও জানে। সকলে শুধু আমার উপর চাপিয়ে দিতে জানে,,কিন্তু আমি কি চাই সেটা আর জানতে চায় না।
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে বিরতিহীন ভাবে অশ্রু ঝরতে থাকে। সেভাবেই শুয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।
অন্যদিকে জাভিয়ান হানিয়ার ফ্ল্যাটে ঢোকার আগ পর্যন্ত পেছন পেছন এসেছে। অপরাধবোধের আর লজ্জায় আর একটা শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। হানিয়া ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওয়ার পরও জাভিয়ান দাড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেও এসে পরে সায়মাদের ফ্ল্যাটে। রাতুলের রুমে ঢুকে চলে যায় বেলকনিতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় হানিয়ার রুমে লাইট বন্ধ করা। সে সেখানেই বসে পরে। অপেক্ষা করতে থাকে যদি তার রমণীর দেখা পায়।
সায়মা পার্কে হানিয়া না পেয়ে সেখানের কিছু মহিলাদের হানিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে তারা তাকে জানায়” সে তার স্বামীর সাথে চলে গেছে,,এর বেশি তারা কিছু জানে না”। স্বামীর সাথে চলে গেছে মানে জাভিয়ান এসেছিলো কি? সায়মা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে প্রথমে হানিয়াকে কল লাগায়। হানিয়া রিসিভ করছে না দেখে জাভিয়ানকে কল লাগায়। জাভিয়ান কলটা রিসিভ করে,,তারপর সায়মা কিছুটা রাগ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করে–
–এই তুই পার্কে এসেছিলি? আর হানিয়া কি তোর সাথে?
জাভিয়ান উত্তরে বলে–
–হুম পার্কে গিয়েছিলাম। কিন্তু হানিয়া আমার সাথে নেই।
সায়মা এবার অস্থির হয়ে বলে–
–তোর সাথে নেই তাহলে কই গেলো হানিয়া? ও এই শহরের কিছু চিনে না। ওকে এখন কই খুঁজবো আমি?
জাভিয়ান তাকে শান্ত করতে বলে–
— আরে আপু হাইপার হচ্ছো কেন? আমার সাথেই নেই মানে কি হারিয়ে গেছে নাকি। জাভিয়ান তালুকদারের বউ হানিয়া তালুকদার হারিয়ে যাবে আর আমি এত শান্ত হয়ে তোমার সাথে কথা বলবো বলে তোমার মনে হয়? হানিয়া বাসায় এসে নিজেদের ফ্ল্যাট চলে গেছে,, আর আমি আমাদের ফ্ল্যাটে।
সায়মা তার কথা শুনে একটু শান্ত হয়। সায়মা তাকে জানায় তারা বাসায় ফিরছে। জাভিয়ান ওকে বলে কল কেটে দেয়।
________________________
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে হানিয়া আবরারকে বলে–
–ভাই আমার ঢাকায় থাকার বিষয়ে কিছু বললে না।
আবরার তাঁকে ইনায়ার প্রস্তাবের কথা জানায়। হানিয়া আবরারের মতোই প্রথমে মানা করে দেয় কি পরবর্তীতে যখন জানতে পারে মাসের বাকি দিন গুলোর জন্য কোন সিট পাওয়া যাবে না এবং সে যদি ইনায়ার বাসায় না থাকে তাহলে তাকে একদম সামনের মাসে যেতে হবে। এটা তো সে করতে পারবে না তাই হানিয়া ইনায়ার বাসায় থাকার জন্য রাজি হয়ে যায়। সে বলে–
–আমি কালই যেতে চাই ভাইয়া। এই মাসের আর ১১ দিন আছে। আর আমার অনেক পড়া বাকি।
আবরার চিন্তিত হয়ে বলে–
–কিন্তু কাল তো আমায় ছুটি দিবে না রে বোন। ঢাকায় শিফট হওয়ার আগে এখানের আমার পোস্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টাফকে সব বুঝিয়ে দিতে হবে আমায় এই কয়েকদিনেট মধ্যে।
হানিয়া বলে–
–আমায় বাসে উঠিয়ে দিও। আমি জায়গা মতে নেবে যাবো। তোমার যাওয়া লাগবে না আমার সাথে।
আবরার তার কথা শুনে রেগে যায়। চোয়াল শক্ত করে বলে–
–এখনো এতো বড় হয়ে যাওনি তুমি যে একা একা তোমায় ট্র্যাভেল করতে দিবো। আমি যেভাবেই হোক কাল- পরশুর ছুটি ম্যানেজ করে তোমায় নিয়ে যাবো। এখন ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।
আবরার কথাগুলো শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। হানিয়া বুঝতে পারে ভাই তার সাংঘাতিক রেগে গিয়েছে। কিন্তু সে রেগে যাওয়ার বা কি বললো? সেও ভাইয়ের পেছন পেছন তার রুমে যায়। তারপর একপ্রকার আবরারের পায়ে ধরে তাঁকে রাজি করায় হানিয়া।
হানিয়া তাঁকে রাজি করিয়ে নিজের রুমে চলে এসে সব গোছগাছ করতে থাকে। ইনায়াকে ফোন করে কাল তার আসার কথা জানিয়ে দেয়। ইনায়া তাকে বলে —
–কাল আমি বাসস্ট্যান্ডে তোর জন্য অপেক্ষা করবো। ভাইয়াকে বলিস চিন্তা না করতে।
তারা কথা বার্তা শেষ করে ফোন কেটে শুয়ে পরে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে থাকে হানিয়া। অপেক্ষা করতে থাকে এক নতুন সকালের।
_____________________
আবরার হাফ বেলা ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। হানিয়ার সব গোছগাছ শেষ সেই কাল রাতেই,,সকালে উঠে শুধু নাস্তা বানিয়েছে। হানিয়া আবরারকে দিয়ে আহনাফ আর সায়মাকে ডেকে আনিয়েছে। সায়মার সাথে শেষবারের মতো কথা বলে আহনাফকে মন ভরে আদর করে। তাকে অনেকগুলো চিপস,,চকলেট দেয়। আহনাফ হানিয়ার ব্যাগপত্র দেখে বলে,–
–ওগুলো কাল মাম্মাম?
হানিয়া জানায় ব্যাগগুলো তার আর সে আজ চলে যাবে ঢাকায়। তারপর থেকে শুরু হয়েছে আহনাফের কান্না। আবরার,,সায়মা,,হানিয়া তাকে শান্ত করে ব্যর্থ হয়ে।এদিকে হানিয়ার বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। হানিয়া রেডি হয়ে আহনাফকে কোলে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়। ব্যাগগুলো আবরার নিয়েছে। আহনাফ কান্না করছে দেখে হানিয়া সায়মাকেও বলে তাদের সাথে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে। সায়মা রাজি হয়ে যায়। আবরারের গাড়িতে করে তারা চারজন রওনা হয় বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্য। পথে হানিয়া অনেক কষ্টে আহনাফকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চুপ করিয়েছে।
হানিয়া বাসে উঠার আগে সায়মার হাত ধরে অনেকটা অনুরোধ করে বলে–
–আপা! উনাকে জানাবেন না আমি যে ঢাকায় চলে যাচ্ছি। দেখা যাবে সেও সেখানে হাজির। আমি সত্যি তার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি। কিন্তু সে আমায় তা করতে দিচ্ছে না।আপনি প্লিজ তাঁকে বুঝায়েন যে,,তার আমার উপর কোন ভালোবাসা বা মায়া নেই। এতো দিন এক ছাদের তলায় থেকেছি তারউপর আমার উছিলায় তার বোন সুস্থ হয়েছে আর তার করা কৃতকর্মের জন্য সে হয়ত অনুতপ্ত এর চেয়ে বেশি কিছু না। আপনি প্লিজ তাকে বলবেন আমার পিছু যেন আর না নেয়। আমাকে আমার মতে বাঁচতে দিতে।
কথাটা বলার সময় হানিয়ার চোখে পানি থাকলেও কন্ঠ ছিলো শক্ত। হানিয়া সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসে তার জন্য বরাদ্দকৃত সিটে বসে পরে। কিছুক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করে। আবরার আর সায়মা দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত বাস তাঁদের চোখের আড়ালে চলে যায়। বাস তাদের চোখের আড়ালে হয়ে যেতেই তারাও বাসায় ফেরার জন্য রওনা হয়।
___________________
জাভিয়ান আজ তাদের রাজশাহীর ব্রাঞ্চে গিয়েছিলো। মাত্রই ফিরলো। রাতুলও তার সাথে ছিলো। দুই ভাই একে একে ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রয়িংরুমে এসে বসে। দুষ্টুর রাজা আহনাফ আজ চুপ করে বসে থাকায় দুই ভাইয়েরই কপালে ভাজ পরে। রাতুল সোফায় বসে আহনাফকে কোলে নিয়ে দুষ্টুমি করতে থাকে।কিন্তু আহনাফ আজ তার সাথে দুষ্টুমি করছে না দেখে তারা আরো চিন্তিত হয়ে যায়। জাভিয়ান রাতুলের কোল থেকে আহনাফকে নিজের কোলে নেয়,,তারপর আদর করে বলে–
–আমার চ্যাম্পের কি হয়েছে আজ? এতো চুপচাপ কেনো আমার দুষ্টুর রাজা?
আহনাফ চুপ করে তার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে বসে থাকে। জাভিয়ান অনেক খোঁচাখুঁচির পর হুট করে আহনাফ বলে বসে–
–হানি মাম্মাম তলে গেতে জাভ।
কথাটা বলে বাচ্চাটা ঠোঁট উলটে কেঁদে দেয়। রাতুল আর জাভিয়ান দু’জনই তার কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। জাভিয়ান কোন মতে আহনাফকে শান্ত করে বলে–
–কোথায় গেছে তোমার হানি মাম্মাম?
–বাচে কলে পলিক্কা দিতে চলে গেছে।
জাভিয়ান আর রাতুল অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়।
শব্দসংখ্যা~২০৭৭
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চুয়ান্ন
হানিয়া আজ ঢাকায় এসেছে পাঁচদিন হতে চললো। সে পুরোদমে পড়ালেখায় ডুবে গেছে। এটা তার ফাইনাল এক্সাম না হলেও সে চায় গত বছরের ধারাবাহিকতায় এই বছরও সবগুলো এক্সামে ভালো করতে। সময়টা এখন রাত দু’টো। হানিয়া বই থেকে মাথা তুলে। একটানা কয়েক ঘন্টা ধরে পড়ছিলো তাই ঘাড় ব্যথা করছে তার। ঘড়িতে সময় দেখার পর তার মনে হলো এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। বই খাতা গুছিয়ে বেডের কাছে আসলে দেখতে পায়,,বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা পানির জগটা খালি। ইনায়া রাতে একবার কি দু’বার ঘুম থেকে উঠে পানি খায় এটা সে এতদিনে জেনে ফেলেছে,, এছাড়া তারও পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। তাই জগটা নিয়ে গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে দরজা খুলে বাহিরে আসে,,উদ্দেশ্য কিচেন থেকে পানি নেওয়া।
সিড়ি দিয়ে নিচে নামার পর ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখতে পায় কিচেনের লাইট জ্বলছে। এতো রাতে কিচেনে কে? চোর? ইনায়াদের বাড়িতে যথেষ্ট সিকিউরিটি আছে,,চোর আসা সম্ভব না। তাহলে কে? হানিয়া তার চিন্তা ভাবনা ছেড়ে কিচেনে যায়। আদিয়াত স্যার? এতো রাতে কি রান্না করছে। আসলে আদিয়াত চুলায় কিছু একটা করছে। হানিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে আদিয়াতের ধ্যান ভঙ্গের চেষ্টা করে। সফল হয় সে তাতে। আদিয়াত পেছন ফিরে হানিয়াকে দেখে কিছুটা অবাক হয়।
হানিয়াকে আদিয়াত প্রশ্ন করে–
–আপনি এখানে কি করছেন হানিয়া?
হানিয়া তার হাতের জগটা দেখিয়ে বলে–
–পানি নিতে এসেছি স্যার।
–ওহ্হ।
আদিয়াত আবারও ব্যস্ত হয়ে পরে। হানিয়া জগে পানি ভরতে থাকে তখনি “আহ” জাতীয় একটা শব্দ তার কানে আসে। হানিয়া পেছন ঘুরে দেখে আদিয়াত তার হাত ঝাঁকাচ্ছে। হানিয়া জগটা রেখে আদিয়াতের কাছে গিয়ে দেখে গরম তেলে আদিয়াতের হাতের পানির ছিটা পরায় তেল আদিয়াতের হাতে ছিটকে এসেছে। হানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বোলে পানি এনে আদিয়াতের সামনে রাখে। তারপর আদিয়াতকে বলে–
–এটায় হাত দিয়ে রাখুন স্যার,,নাহলে ফোসকা পরে যেতে পারে।
আদিয়াত হাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হানিয়ার কথামতো কাজ করে। হানিয়া চুলার কাছে এগিয়ে এসে দেখে আদিয়াত নাগেটস ভাঁজছে। হানিয়া আদিয়াতকে সড়ে দাঁড়াতে বলে। আদিয়াত সরে দাড়ালে হানিয়া নিজেই নাগেটস গুলো ভাজতে শুরু করে। আদিয়াত তাঁকে কাজ করতে দেখে বলে–
–হানিয়া আমি করে নিচ্ছি। আপনি পানি নিয়ে শুতে চলে যান।
হানিয়া তার কথার উত্তর না দিয়েই নিজের মতো কাজ করতে থাকে। নাগেটস ভাজা শেষ হলে সেগুলো আদিয়াতের দিকে বাড়িয়ে দেয় হানিয়া। আদিয়াত প্লেটটা হাতে নিতে নিতে বলে–
–এত রাতে ঘুম বিসর্জন দিয়ে আমার কাজটা করে দিলেন,,সেই জন্য একটু তো আপনাকেও খেতে হয় হানিয়া।
হানিয়া টুকটাক গুছিয়ে,,হাত ধুতে ধুতে বলে–
–দুঃখিত স্যার। আমার পেট ভরা একদম। আপনি খান,,আমি আসছি।
–একটা অন্তত নেন। নাহলে আমার খারাপ লাগবে।
কি আর করার। হানিয়া একটা নাগেট নিয়ে সেটা খেতে খেতে পানির জগটা নিয়ে রুমে চলে যায়। আদিয়াত কিচেনের লাইট বন্ধ করে সে-ও হানিয়ার পেছন পেছন যেতে থাকে। হানিয়া রুমে ঢুকে দরজা লাগাবে তখন দেখে আদিয়াত এই রুমের দিকেই তাকিয়ে আছে। হানিয়া আস্তে করে বলে–
–শুভ রাত্রি স্যার।
আদিয়াতও মুচকি হাসি দিয়ে বলে–
–শুভ রাত্রি।
___________________
স্পর্শ শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। ভালো লাগছে না কেন জানি তার। ঘুম আসছে না তার আজকে। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎই “পিপোল ইউ মে নো” তে আবরারের আইডি দেখায়। বুকের ভেতরর রক্তকণিকা গুলো ছলাৎ করে উঠে। হুট করে তাঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে দেয়। আইডিটা লক করা তাই একটু ঘুরে দেখতে পারছে না। রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে আবার কি মনে করে সেটা উঠিয়ে নিতে যাবে তখনই দেখে আবরার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেছে। এবার যেন স্পর্শের বুকের ভেতরের হৃদপিণ্ড নামক বস্তুটা পাগলা ঘোড়ার ন্যায় দৌড়াতে শুরু করেছে।
স্পর্শ আবরারের আইডিটা দেখতে থাকে। তখনই মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ হয়। আবরার তাকে মেসেজ পাঠিয়েছে–
— “এতো রাত জেগে আছো যে?”
স্পর্শ কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করে–
–ঘুম আসছিলো না,,তাই।
আবরার মেসেজটা সাথে সাথেই সিন করে। শুরু হয় তাদের কথার ঝড়। কথা বলতে বলতে রাত পেরিয়ে ভোর হবে হবে,, তখন স্পর্শ হুট করে আবরারকে জিজ্ঞেস করে–
— তা জনাব পাশে বউ রেখে রাতভর একজন নারীর সাথে কথা বললেন। বউ আপনার জানলে রাগ করবে না তো?
কথাটা অনেকটা মজা করে আবার সিরিয়াসলিও বলে। আবরার তার জবাবে লেখে–
–যে নেই তার রাগ করা না করা দিয়ে আবরার ভাবে না।
আবরারের মেসেজটা দেখে স্পর্শের কপালে ভাজ পরে। নেই মানে? বাবার বাড়ি গিয়েছে হয়ত। সেও মজা করে লেখে–
–বউয়ের সাথে ঝগড়া করেছেন?
–নাহ।
–তাহলে??
–ডিভোর্স হয়ে গেছে আমাদের।
মেসেজটা দেখে স্পর্শের পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠে। ডিভোর্স? এমন পুরুষকেও কেউ ছেড়ে যেতে পারে? সেই নারীকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে স্পর্শের যে কিনা স্পর্শের ব্যক্তিগত পুরুষকে ত্যাগ করে চলে গেছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে সেই নারীকে–
–সমাপ্তিতে বিচ্ছেদ জানা সত্বেও সূচনা কেন করেছিলে হে রমণী? কেন আমার ব্যক্তিগত পুরষ টিকে নিজের নামে লিখে আমাদের ভালোবাসার মৃত্যুদান করেছিলে?
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে স্পর্শের চোখের কোণ বেয়ে একবিন্দু পানি গড়িয়ে পরে। স্পর্শ কোন রিপ্লাই করছে না দেখে আবরার নিজেই লেখে–
–ঘুমিয়ে যাও। ভোর হতে চললো তো। নিজের যত্ন নিও।
স্পর্শ মেসেজটা দেখে কিন্তু হাতের অসম্ভব কাঁপুনির কারণে ফোনটাই ধরতে অক্ষম হয়। আবরার কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে,, কিন্তু কোন রিপ্লাই না পেয়ে নেট অফ করে শোয়া থেকে উঠে পরে। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে,,এখন ঘুমালে নামাজটা মিস হয়ে যাবে। তাই অজু করে একটু কুরআন তেলাওয়াতের কথা চিন্তা করে। আজ সারা রাত না ঘুমিয়েও তার তেমন ক্লান্ত লাগছে না। বরং বুকের ভেতর সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে।
অন্যদিকে স্পর্শ এখনো থম মেরে বসে আছে। হুট করে বুকের ভেতর কে জানি বলে উঠে —
–স্পর্শ এখন বসে থাকার সময় না। ভাগ্য তোকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে তোর ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করার। চেষ্টা করবি না? দেখ না চেষ্টা করে,,যদি পেয়ে যাস তাঁকে নিজের নামে।
স্পর্শ কথাটা স্মরণ হতেই তড়াক করে শোয়া থেকে বসে পরে। চোখের পানি দু’হাত দিয়ে মুছে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস ভেতরে টেনে নেয় আর বাহিরে ছেড়ে দেয়। স্ট্রেস কমাতে এটা অনেক কাজ করে। কিছুটা শান্ত হওয়ার পর নিজেকে নিজেই বলে–
— আমি এবার হাল ছাড়বো না। আগের বার সেই নারী বিনা কষ্টেই আমার পুরুষটিকে পেয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এবার আর না। আমি পুরো দুনিয়ার সাথে লড়াই করবো,,তাকে আমার করেই দম নিবো আমি। আমি জানি সেও আমাকে এখনো ভালোবাসে। হসপিটালে আমায় ওই কথাটা বলার সময় তার কম্পনমান গলা আর চোখের কোণে জমা হওয়া পানি আমায় জানিয়েছে সেই কথা। আবরার শুধু স্পর্শের হবে,,শুধু মাত্র স্পর্শের। যে তার মতো পুরুষের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না তার মতো দুর্ভাগা নারী আর কেউ নেই আমার মতে। সে পারে নি কিন্তু আমি পারবো। আমায় পারতেই হবে। (একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে) আবরার জান,, গেট রেডি টু বি মাই গ্রুম বেইব(Get ready to be my groom babe)
______________________
আজ হানিয়াদের প্রথম এক্সাম শেষ হয়েছে। হল থেকে বের হয়ে হানিয়া লাইব্রেরির দিকে যেতে থাকে। কিছু টপিকের জন্য নোট করা লাগবে তাই। ইনায়াও তার সাথে যেতে চায় কিন্তু তখনই ডা.এহসানের ফোন আসে। বেচারার আজ ডিউটি না থাকায় সে একটু ঘুরতে যেতে চায় তার বেগমের সাথে। হানিয়ার কার সাথে বাসায় যাবে কথাটা ভেবে এহসানকে মানা করে দেয় ইনায়া।
হানিয়া এই মাসটাও ইনায়াদের বাড়িতে থাকবে। তাদের কলেজের কাছেই একটা গার্লস হোস্টেল পেয়েছিলো কিন্তু সে যেদিন হোস্টেল সিটে উঠবে সেদিন হোস্টেলের ইনচার্জ মহিলা জানায় তাকে সিটটা দিতে পারবে না। কেন পারবে না জিজ্ঞেস করলে সেটাও জানায় না।কল কেটে দেয়। এখন কই উঠবে খুঁজে না পেয়ে ইনায়াই তার কাছে রেখে দেয়। বলে তার বড় ভাইকে বলে আরেকটা হোস্টেলের সিটের ব্যবস্থা করে দিবে,ততদিন পর্যন্ত যাতে এখানেই থাকে। হানিয়া চলে যেতে চেয়েও পারে না। কই যাবে সে? ভাইকে জানালে তার ভাই আরেক পাগলামি শুরু করবে। আর ইনায়ার পরিবারও হানিয়াকে অনেকটা আপন করে নিয়েছে,,তারাও বলছে আরো কিছুদিন থেকে যেতে। অগত্যা তাকে থাকতেই হয়।
এহসানলে মানা করে দেওয়ার পর মুখ লটকিয়ে বসে আছে ইনায়া। হানিয়া বই থেকে মুখ উঠিয়ে ইনায়ার লটকানো মুখ দেখে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করে। ইনায়া কথা কাটিয়ে দিতে চাইলে হানিয়া তাঁকে চেপে ধরে তার পেট থেকে কথা বের করে তারপর ছাড়ে। ডা.এহসানকে তার জন্য মানা করে দেওয়ায় হানিয়া ভীষণ রেগে যায়। সে বই খাতা নিজের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলে–
–আমার জন্য সবার জীবন এলোমেলো হয়ে পরছে। আমি আজই চলে যাবো মির্জা বাড়িতে। তারা আমায় মারুক,, বকা দিক সেখানের মাটি কামড়েই পরে থাকবো। চল এখনি বাসায় যাবো। ব্যাগ গুছানো বাকি আছে আমার।
কথাটা বলে হনহনিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আসে। ইনায়া দৌড়ে তার পেছন পেছন এসে তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চায়। ইনায়া জানে হানিয়া শান্তশিষ্ট মেজাজের মেয়ে। কিন্তু একবার রেগে গেলে তাঁকে শান্ত করা মানে পাহাড় কাটার সমান। হানিয়া আজ ভয়াবহ রেগে গেছে। ইনায়া তাকে শান্ত করতে করতে বলে–
–আচ্ছা তুই শান্ত হ। আমি যাচ্ছি এহসানের সাথে ঘুরতে। তাহলে খুশি হবি তো?
হানিয়া তাকে জবাব না দিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। ইনায়া তার সামনেই ডা.এহসানকে কল করে ঘুরতে যাওয়ার কথা জানায়। হানিয়া তারপর একটু শান্ত হয়। ইনায়াকে কলেজের গেট পর্যন্ত ছেড়ে আবার লাইব্রেরিতে চলে আসে হানিয়া।একঘন্টার মতো পড়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখে পাঁচটা বাজে। বইখাতা গুছিয়ে কলেজের বাহিরে চলে আসে। কলেজ থেকে একটু দূরেই অতিপরিচিত একটা গাড়ি দেখতে পেয়ে মাথার ভেতর রাগেরা জমা হতে থাকে। এই গাড়িটাতেই তো গত কয়েকমাস সে কলেজে আসা যাওয়া করেছিলো। তালুকদার বাড়ির গাড়ি এটা। এখনো আসে কিন্তু কেন আসে সে জানে না।
হানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ো গাড়িটা ক্রস করে চলে যেতে নিবে তখনই একটা মেয়েলি কন্ঠের মিষ্টিডাক তার কানে আসে। হানিয়া হাঁটা থামায় কিন্তু পেছন ঘুরে তাকায় না। মেয়েটি নিজেই তার কাছে আসে। স্পর্শ দেখা করতে এসেছে হানিয়ার সাথে। কুশল বিনিময় শেষ করে স্পর্শ বলে তার সাথে একটু ঘুরতে যেতে। হানিয়া তাকে মানা করে দিয়ে বলে–
–আপু অন্যদিন যাই? আজ একটু বাসায় কাজ ছিলো? তার উপর এখন বাস না ধরলে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কাল এক্সাম নেই। কাল সকাল সকাল বের হবো নে,,অনেক সময় নিয়ে ঘোরাঘুরির করবো।
হঠাৎই একটা পুরুষালি ভারী কণ্ঠ বলে উঠে —
–আপু তাকে বলে দাও সময় মতো তাকে তার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে। সে যেন বাসের চিন্তা না করে ভালোয় ভালোয় তোমার সাথে ঘুরতে আসে।
হানিয়া স্পর্শের ঘাড়ের উপর দিয়ে তার মাথাটা একটু উচু করে দেখে তার বউ পেটানো স্বামী কথাটা বলেছে। এতক্ষণ যাও ভেবেছিলো অল্প কিছু সময়ের জন্য স্পর্শের সাথে যাবে কিন্তু জাভিয়ানকে দেখে সেই ভাবনা উল্টা রাস্তায় দৌড় দিয়েছে। সেও চোখ মুখ শক্ত করে বলে–
–আমায় নিয়ে কারো না ভাবলেও চলবে। দয়া চাই না কারো।
জাভিয়ান প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে–
–স্বামীর সাহায্যকে দয়া মনে হয় আর অন্যের দয়ায় তাদের বাড়িতে দিনের পর দিনে পরে থাকাকে সাহায্য মনে হয়। হায়রে দুনিয়ার!!!
তীব্র অপমানে হানিয়ার মুখ লাল হয়ে আসে। রাগে ঠোঁট তিরতিরিয়ে কাঁপতে থাকে। তার ইচ্ছে করছে রাস্তার পাশ থেকে বড়সড় একটা ইট তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে জাভিয়ানের চকচকে কপালটা ফাটিয়ে দিতে। হানিয়া হাত মুঠ করে দাত কিড়মিড়িয়ে বলে–
— স্বামী যদি অত্যাচারী হয় তাহলে বউকে অন্যের দয়া’ই গ্রহন করতে হয়।
জাভিয়ান হানিয়ার কথাট পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলবে তখনই স্পর্শ দু’জনকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। জাভিয়ানকে গাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে সে হানিয়ার হাত দু’টো চেপে ধরে বলে–
–চল না বোন। তোর সাথে কিছু কথাও আছে আবরারকে নিয়ে। ইটস ইমপোর্টেন্ট হানিয়া।
আবরারকে নিয়ে কথা বলায় হানিয়া যেতে রাজি হয়ে যায়। হানিয়া স্পর্শের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। জাভিয়ান তাকে দেখে একটা বাঁকাহাসি দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে। ঘুরতে যাওয়ার কথা থাকলেও জাভিয়ান তাদের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসে। হানিয়ার শুকনো চোখমুখই বলে দিচ্ছে তার পেটের মধ্যে দৌড়ানো ইঁদুরগুলোর কথা। হানিয়া আর স্পর্শ গাড়ি থেকে নেমে আসে। জাভিয়ান গাড়ি পার্ক করে আসলে সকলে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে।
পছন্দ মতো একটা টেবিলে বসে পরে তারা। জাভিয়ান দু’টো মেন্যু কার্ড তাদের দু’জনের উদ্দেশ্য দিয়ে বলে–
–কে কি খাবে এটা দেখে বলো?
হানিয়া জানায় সে কিছুই নিবে না। জাভিয়ান তাকে আর ঘাটায় না। স্পর্শ কয়েকটা আইটেম অর্ডায় দেয়। আর জাভিয়ানকে বলে–
–তুই একটু গিয়ে খাবার গুলো নিয়ে আয়। আমাদের একটু পারসোনাল কথা আছে।
জাভিয়ান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে–
–কি এমন কথা যা আমার সামনে বলা যাবে না?
–আছে। তুই যা এখন ভাই।
জাভিয়ান বোনের ধমক খেয়ে সেখান থেকে চলে যায়। স্পর্শ ব্যস্ত হয়ে পরে কথা বলতে। বিশ মিনিট পর জাভিয়ান খাবার গুলো একটা ওয়েটারের সাহায্যে টেবিলে নিয়ে আসে। জাভিয়ানের সাথে আরেকজনও আসে যাকে দেখে স্পর্শ-হানিয়া দু’জনই বিরক্ত হয়। ব্যক্তিটি হলো সোহা। জাভিয়ান জানায় সোহা নাকি তাট ফ্রেন্ডসদের সাথে এসেছিলো। স্পর্শ এসেছে শুনে তার সাথে দেখা করতে এসেছে।
হানিয়া আর স্পর্শ একপাশের দু’টো চেয়ারে বসেছিলো। জাভিয়ানের পাশের চেয়ারটা খালি থাকায় সোহা ধপ করে সেখানে বসে পরে। নিজের চেয়ারটা আরেকটু এগিয়ে নেয় জাভিয়ানের দিকে। বলতে গেলে একদম গায়ে লেগে বসে। হানিয়া আঁড়চোখে সবটাই দেখে কিন্তু কিছু বলে না। না চাইতেও তার খারাপ লাগছে,, বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু সে শান্ত হয়ে বসে আছে।
হানিয়াকে স্যান্ডউচ আর জুস খেতে দিলে হানিয়া মানা করে দেয়। স্পর্শ জোর করে তাকে খাবার গুলো খাওয়ায়। সেও বুঝতে পেরেছে হানিয়ার ক্ষুধার কথা। জাভিয়ান কফি খেতে খেতে তাদের কথা শুনছে। আর সোহা খাচ্ছে কম বেহায়াপনা করছে বেশি। হাসতে হাসতে জাভিয়ানের গায়ে ঢলে পরছে, জাভিয়ান সরিয়ে দিলেও আবারো একি কাহিনী করছে। হানিয়া বিষয়টা দেখে মনে মনে বলে–
–যা গলা বাজি সব আমার সাথেই চলে,,অন্য মেয়ের বেলায় গলায় মনে হয় ব্যঙ ঢুকে যায়। একটা কড়া করে ধমক দিলেই তো এমন ঘেঁষাঘেঁষি সাহস পায় না। কিন্তু সে তো আর সেটা করবে না। হবু বউ কষ্ট পাবে কিনা। হাহ্
হানিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসে থাকে। স্পর্শ-সোহা হানিয়ার মুখভঙ্গি খেয়াল না করলেও জাভিয়ান ঠিকই খেয়াল করেছে। হাসির তাচ্ছিল্যের হাসিও তার নজর এড়ায় না। জাভিয়ানের ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে। সে বিড়বিড়িয়ে বলে–
–“পাখি আমার, এবার খাঁচার দরজা খুলে তোমাকে বন্দী করার পালা। অনেক তো আকাশ ছুঁয়ে বেড়ালে, এবার আমার বুকে এসে ঝড় তুলো। তোমার উড়ান এবার আমার ভালোবাসার খাঁচায় বেঁধে রাখার সময় হয়েছে।”
কথাটা শেষ করেই জাভিয়ান ঠোঁট বাকিয়ে হেসে উঠে। সামনে যে কিছু একটা করতে চলেছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না।
শব্দসংখ্যা~২০৯৪
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চুয়ান্ন(বর্ধিতাংশ)
আবরারের ঢাকায় শিফট হওয়ার কথা এক তারিখে থাকলেও সেখানের সব দায়িত্ব তার পোস্টে আসা স্টাফকে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে আসতে আজ মাসের পাঁচ তারিখ হয়ে গেছে। তিনটা লাগেজ নিয়ে সে একা যখন বাসায় ঢুকে তখন মি. এন্ড মিসেস মির্জার কপালে ভাজ পরে। তাদের বউমা কই? আবরার কুশল বিনিময় করে নিজের রুমে প্রবেশ করবে তখন মিসেস মির্জা পেছন থেকে ডেকে বলে–
–আবরার হানিয়া আর এশা কই?
আবরার পেছন না ঘুরেই জবাব দেয়–
–হানিয়াকে নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না,সে তার জায়গা মতোই আছে। আর এশা,,সে তার স্বামীর সাথে আছে।
কথাটা বলেই আবরার রুমে ঢুকে পরে। মি. এন্ড মিসেস মির্জা ভাবেন হানিয়া হয়ত জাভিয়ানের কাছে ফিরে গেছে। আসলে তাদেরকে আবরার হানিয়ার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। তারা কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও আবরার বলেছে–
–হানিয়া যখন আমার জিম্মায় আছে তখন আমি জানি আমার বোনের খেয়াল রাখতে। অপ্রয়োজনীয় সেই মানুষটিকে নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে।
কিন্তু এশার ব্যাপারে মিসেস মির্জা ছেলের কথা বুঝতে না পেরে তার পেছন পেছন রুমে ঢুকে। আবরার বাহিরের জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে লাগেজ থেকে বাসায় পরিহিত জামাকাপর বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। ছেলে ক্লান্ত মুখ দেখে মিসেস মির্জা আর কোন প্রশ্ন করতে পারে না। ভাবে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়ার পর না হয় জিজ্ঞেস করা যাবে।
আবরারের মা রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চলে যায় খাবারের ব্যবস্থা করতে। বিশ মিনিট লাগিয়ে শাওয়ার নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয় আবরার। মুখহাত মুছে টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। দুপুরের সময় হওয়ায় সকলকেই ডাইনিং টেবিলে পায়। নিস্তব্ধতার মাঝেই তারা খাওয়াদাওয়া শেষ করে। খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে এসে বসে তারা। তখন মি. মির্জা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন–
— তখন এশার জিজ্ঞেস করায় বললে সে তার স্বামীর সাথে নাকি আছে? তোমার সাথে থাকলে কই সে? সে কি তার বাবার বাড়ি গিয়েছে?
–স্বামী বলতে যে আমিই হবো তার কোন মানে নেই। আর সে তার বাবার বাড়িও যায় নি। আসলে আমি নিজেও জানি না সে বর্তমানে কোথায়।
আবরারের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা উপস্থিত তিনজনের কারোরই বোধগম্য হয় না। মি. মির্জা কঠিন গলায় বলে–
–তুমি কি এসব হেয়ালি ছেড়ে বলবে এশা কোথায়? আর এশার স্বামী তুমি বাদে আর কে? মজা করতে হলে অন্য সময় করো। কিন্তু এখন যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও।
আবরারও কঠোর গলায় বলে–
–আমিও কোন মজা করার মুডে নেই। কেন তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু জানায় নি,, তার কন্যা আর আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে?
আবরারের দুই লাইনের বক্তব্যটি রুমটায় যেন বোমা ফাটানোর মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মি. এন্ড মিসেস মির্জা আর সোনিয়া হতভম্ব হয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডিভোর্স হয়ে গেছে তাদের ছেলের আর তারা এসবের কিচ্ছুটি জানে না। মি. মির্জা বসা থেকে উঠে অস্থির হয়ে বলে–
–মজা করতে মানা করেছি আবরার। এক চড়ে গাল লাল করে দিবো। ডিভোর্স হয়ে গেছে মানে? এশার সাথে কবে তোমার ডিভোর্স হলো? এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না।
আবরার গাছাড়া ভাব নিয়ে বলে–
–না করলাম না। তোমরা আমায় বিয়ে দেওয়ার সময় আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেছিলে? করোনি। আমিও আমার জীবনের একটা সিদ্ধান্ত নিতে তোমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।
মিসেস মির্জা ছেলের ডিভোর্সের কথা শুনে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেলেন। প্রথমে বড় মেয়ে এখন নাকি ছেলেটার সংসারও ভেঙে গেলো। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেমেয়ের সংসার ভাঙন কোন মা’কে পীড়া দেয় না? মি. মির্জা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে–
— তোমার লজ্জা করে না এমন ভালো একটা মেয়ের সাথে সংসার ভেঙে আবার বড় মুখে কথা বলছো। নিজের বোনের সময় তো বড়বড় কথা বললে,,এখন অন্যের বোনের জীবনটা নষ্ট করতে লজ্জা করলো না তোমার?
বাবার কথা শুনে আবরার একটুও বিচলিত হয় না। সে জানত সে একা ঢাকায় ব্যাক করলে এসব কথা বা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। হলোও তাই। সে মি.মির্জার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে দেয়। পেটে হাত দিয়ে হাসছে। ভাবটা এমন মি. মির্জা তাকে অনেক মজাদার কোন কথা বলেছেন। তারা তিনজন আবরারের এমন কান্ডে আরো অবাক হয়ে যায়। মি. মির্জা তাকে ধমক দিয়ে বলে–
–আবরার!! এখানে কোন হাসির কথা বলা হচ্ছে না। নিজের আচরণ সংযত করো। আর আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আবরার অনেক কষ্টে নিজের হাসি থাকায়। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চোখমুখ কঠিন করে বলে–
–এশার জীবন নষ্ট হয়নি। বরং আপনার জন্য আমার আর আমার বোনের জীবনটা নষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ,,আপনি বাবা হয়ে নিজের হাতে আপনার দুই সন্তানের জীবন নষ্ট করেছেন।
ছেলের কথা শুনে মি.মির্জা কয়েক কদম পিছিয়ে যান। মিসেস মির্জার কান্নাও অনেকটা থেমে গিয়েছে। আবরার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—
–কি থমকে গেলেন কেনো? কষ্ট পেলেন? এর চেয়ে হাজার গুণ কষ্ট আমরা দুই ভাইবোন সইয়েছি। গুমরে গুমরে কেঁদেছি আপনজনের থেকে ভালোবাসার বদলে কষ্ট পেয়ে। শুধু এবং শুধু মাত্র আপনার জন্য। আপনি বাবা হয়ে আমাদের সীমাহীন কষ্টের সাগের ঠেলে দিয়েছেন।
মিসেস মির্জা ছেলের কাছে এসে তার বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে ঝাঁজালো গলায় বলে—
–আবরার!! কাকে কি বলছো তুমি তোমার মাথায় আছে? এই মানুষটি তোমাদের বাবা ভুলে গেলে? কিভাবে নিজের বাবাকে অপরাধী বানিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছো?
–আমি তো করতে চাই নি মা। বাবাই তো জিজ্ঞেস করলো,,আর আমি তো শুধু তার প্রশ্নের উত্তর গুলো দিচ্ছিলাম। আপনি তো সবই শুনছেন।
–এগুলো প্রশ্নের উত্তর? নিজের বাবাকে একের পর এক অপবাদ দিচ্ছো। বাবা হয়ে সে কেন তার দু’টো সন্তানের জীবন নষ্ট করবে? কেন সে তার সন্তানদের কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিবে? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
আবরার অনেক কষ্ট করে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে রেখেছিলো। যতই অন্যায় করুক তারা দু’জন তাদের জন্মদাতা আর জন্মদায়িনী। তাঁদের কষ্ট দিলে উপরে বসে থাকা সর্বশক্তির অধিকারীর আরশও কেঁপে উঠে। কিন্তু এবার না চাইতেও আবরারের ভেতরে জমে থাকা এতদিনের ক্রোধ ঠেলে বের হয়ে আসে। সে তার মায়ের থেকে কয়েক কদম দূরে সরে গিয়ে কর্কশ গলায় বলে—
— সে হয়ত কষ্ট দিতে চায় নি কিন্তু দিয়ে ফেলেছে।কীভাবে শুনবেন? তাহলে শুনুন,,, সে আমার বন্ধু আয়মানের মিথ্যা কথায় প্রলোভিত হয়ে আমার থেকে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে দূর করে দিয়ে সেইখানে এমন একজন নষ্ট চরিত্রের মেয়েকে বসিয়েছে যে কিনা বিয়ের আগেই নিজের সতিত্ব অন্য পুরুষকে বিলি করে বেড়ায়। তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মেয়ের বিয়ের আগেই তাদের এলাকার এক বখাটের সাথে সম্পর্কে ছিলো। তাদের সম্পর্ক এতোটাই গভীর ছিলো যে তারা বেড পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো। সেই মেয়েকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করেছে আপনার স্বামী আর আমাদের বাবা। সেই মেয়ে আজ তিনবছর আমাকে জাস্ট সেলটার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ছয়মাস আগে তার প্রেমিকের চাকরি হয়েছে তাই আমায় ডিভোর্স দিয়ে তার কাছে চলে গেছে। শুনেছে মি. বাবা আপনি কিভাবে আমায় কষ্ট দিয়েছেন?
শেষের কথাটা আবরার তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে। মি. মির্জা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মিসেস মির্জা আর সোনিয়া হা করে তার কথা শুনছে। আবরার তাদের এমন অবাক হওয়া দেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে—
–এটা তো শুনলেন আমার কথা। এবার আপনাদের অপ্রিয়,, দুর্বল,, হেরে যাওয়া সন্তানটির কথা শুনবেন না? তার কাহিনী তো আরো চমৎকার।
সকলে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবরারের দিকে। আবরার তাঁদের থেকে কোন উত্তর আশা ছাড়াই বলা শুরু করে–
–তো আমি তো বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে বিয়ে করে ফেললাম কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষ। তার কি হলো জানেন? তার আগে আরেকটা কথা জানিয়ে দেওয়া ভালো আমার ভালোবাসার মানুষটিকে কে জানেন? সে সম্পর্কে হানিয়ার ননদ আর জাভিয়ানের ছোট বোন। (কথাটা শুনে তাঁরা তিনজন আরেক দফা চমকে যায়) আরমান,, আমার জানের বন্ধু আমায় পরামর্শ দেয় স্পর্শ মানে আমি যাকে ভালোবাসতাম তার থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য আমায় তার ভালোবাসার এমন অপমান করতে হবে যে সে যাতে নিজে থেকেই আমায় ঘৃণা করে। গাধা আমি তাই করলাম। একদিন স্পর্শকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওকে যা নয় তা বলে অপমান করলাম। তারপর চলে আসলাম। আমি চলে আসার পর আরমান স্পর্শকে কিডন্যাপ করে তাকে ধ//র্ষণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু স্পর্শ যেন তেন ভাবে তার থেকে বেঁচে রাস্তায় দৌড়াতে থাকে। সেইদিনই জাভিয়ান লন্ডন থেকে তার স্টাডি কম্পিল্ট করে ফিরছিলো। স্পর্শের এক্সিডেন্ট হয় জাভিয়ানের গাড়ির সাথে। স্পর্শ অজ্ঞান হওয়ার পর তাকে সবটা বলতে চাইছিলো কিন্তু মাথায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে শুধু আমার নামটা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। পরবর্তী আরমান জাভিয়ানের কাছেও আমার নামে মিথ্যা কথা বলে তার কাছে কালপ্রিট বানায়। জাভিয়ানকে উস্কে দেয় আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমায় জাভিয়ান পাবে কোথায়? আমি তো বউ নিয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম। তখন তার মনে হয়,, আমি যেমন তার বোনের ভালোবাসার অপমান করেছিলাম,,তার বোনকে আরমানের ভাষ্যমতে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম সে-ও আমার বোনের সাথে এমনটাই করবে। সে নিজে নিজেই এক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়,,যাকে #প্রতিশোধের_অঙ্গীকার ও বলা চলে। সে প্রায় ছয়মাস লাগিয়ে আমার ফ্যামিলি ডিটেইলস বের করে। তারপর তার বাবার মাধ্যমে হানিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। আমার আর্দশবান বাবা এইবারও নিজের মতামত আমার বোনের উপর খুব সুন্দর ভাবে চাপিয়ে দেয়। তাকে নিজ হাতে একটা মানুষ নামক জানোয়ারের হাতে তুলে দেয়। জানেন সে কি করেছিলো?
কেউ কোন উত্তর দেয় না। আবরার একটু দম নিয়ে আবারো বলা শুরু করে–
— সে এই সাত মাসে এমন কোন অত্যাচার নেই যেটা আমার বোনের উপর করে নি। জাভিয়ান ও তার মা আমার বোনের এই সাতটা মাস জাহান্নাম করে তুলতে কোন খুঁত রাখেনি। শারীরিক-মানসিক সব দিক দিয়ে তাকে এতো এতো অত্যাচার করেছে যেগুলোর চিহ্ন আমার বোন এখনো নিজের শরীরে বয়ে বেড়ায়। সবশেষে তার চরিত্রেও কালি ছোঁড়া হয়। অনেক অনেক কাহিনির পর হানিয়া সব সত্য বের করে,, আমাকে ও নিজের চরিত্রের পবিত্রতার প্রমাণ দিয়ে চিরদিনের জন্য ওই বাড়ি ছেড়ে এসেছিলো এই ভেবে আপনারা বাবা-মা তো,,সন্তান যতই ভুল করুক না কেন হয়ত আগলে নিবেন। ভেবেছিলো মায়ের কোলে মুখ গুঁজে নিজের কষ্টটা একটু কমাবে সে,, বাবার ভরসার হাতটা তো কখনোই তার মাথায় উঠেনি কিন্তু বাবা নামক মানুষটির ছায়া তার আশেপাশে থাকবে। বাবার ছায়া আশেপাশে থাকলে সন্তানের শরীরের এক কেজি রক্ত নাকি বেড়ে যায়। স্বামীর বাড়ি থেকে সীমাহীন কষ্ট পেয়ে আপনজন ভেবে আপনাদের কাছে এসেছিলো কিন্তু আপনারা তাকে আগলে নিবেন কি উল্টো তাকে মরার বিভিন্ন পন্থা বলে দিলেন। হারতে না চাওয়া আমার বোনকে আপনারা হারিয়ে দিলেন। তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন বাবা-মা নামক আপনারা দু’জন।
শেষের কথাটা একটু জোর দিয়েই বলে আবরার। তার চোখে অশ্রুরা ভীর করেছে। গড়িয়ে পরার আকুল অনুরো করছে আবরারের কাছে কিন্তু আবরার কি সকলের সামনে নিজের দূর্বলতা প্রমাণ করবে? আবরারের আর মন চাইলো না তাদের সামনে থাকতে। চোখের কোণ মুছতে মুছতে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। মিসেস মির্জা থম মেরে সোফায় বসে পরে। সোনিয়া হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে কান্না করতে থাকে। তার কান্নার কিছুটা আওয়াজ বাহির পর্যন্ত আসছে।
আর বাকি রইলো মি. মির্জা? তার কোন ভাব বুঝা যাচ্ছে না। সে আবরারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের সন্তানদের জীবন সে নিজের হাতে নষ্ট করলো। শেষে কিনা বিনা দোষ করা মেয়েটিকে নিজেদের কথা দ্বারা এতো আঘাত করলো যে মেয়েটি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলো। হুট করে মি. মির্জার কি জানি হলো। বুকের বা’পাশটা ডান হাত দিয়ে খামচে ধরেন,, ভেঙে আসতে চাওয়া পা দু’টোও নিজেদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। উল্টে পেছনে রাখা ডাবল সোফায় পরে যায়। মিসেস মির্জা একটা ভারী আওয়াজ শুনে পেছনের দিকে তাকালে দেখতে পান মি. মির্জার শরীর এমন থরথর করে কাঁপছে আর উনি বুকের বা’পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। মিসেস মির্জা বসা থেকে উঠে স্বামীর কাছে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে মি.মির্জা সেন্সলেস হয়ে পরেছে। মিসেস মির্জা চিৎকার করে বলে উঠে —
–আল্লাহহহহহহহ।
শব্দসংখ্যা~১৬৯০
~~চলবে?