#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ছাপান্ন
–ভাই তোমার মনে হয় না বিয়ে-শাদী নিয়ে ভাবা উচিত? আর কতকাল তুমি স্পর্শ আপুকে অপেক্ষা করাবে? তারও তো বয়স হচ্ছে। তুমি কি আবারো হারিয়ে ফেলে পরে বুঝবে?
বেশ রেগেমেগে কথাগুলো কথা হানিয়া তার একমাত্র ভাইকে। কিন্তু হানিয়ার এই রাগকে আবরার পাত্তাই দেয় না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কফির কাপে একের পর এক সিপ নিচ্ছে। হানিয়ার ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে যায়। সে বসা থেকে উঠে টেবিলে দুই হাত দিয়ে শব্দ করে বলে—
–ভাইইইইইইইইই। মাথা গরম হচ্ছে আমার এবার।
হানিয়ার কথাগুলো বেশ উচ্চস্বরেই হয়ে যায়। আশেপাশের টেবিলের লোকেরা তাদের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। এই পর্যায়ে আবরার আর নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। অনেক হয়েছে বোনকে জ্বালানো,এবার সিরিয়াস হওয়া যাক। আবরার হানিয়াকে পুনরায় বসিয়ে আশেপাশের মানুষের উদ্দেশ্য সরি বলে। তারপর বোনের জন্য একটা আইসক্রিম অর্ডার দেয়। হানিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আবরারের কাজগুলো দেখতে থাকে। আবরার তার বিপরীত পাশের চেয়ারটা বসে বলে—
–তোর কি মনে হয় তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর আমার আর স্পর্শের বিয়েটা হবে? এটা কি সম্ভব?
হানিয়া অবাক হয়ে বলে—
–সম্ভব নয় কেন? আমার সাথে হওয়া ঘটনার জন্য তোমাদের বিয়ে কেন হবে না?
–অনেকগুলো কারণই আছে যার কারণে এই বিয়ে সম্ভব নয়।
–সেগুলো কি আমি জানতে চাই।
–দেখ হানিয়া বিষয়টা যতটা সহজ মনে করছিস ততটা সহজ নয়। তোকে তারা মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে বলে মেনে নেয় নি আমায় কীভাবে মেনে নিবে সেই পরিবারের ছেলে হওয়ার পরও?
–এর উত্তর হিসেবে আমি বলবো— তুমি ঘর করবে স্পর্শ আপুকে নিয়ে,,স্পর্শ আপু তোমার বাসায় আসবে নাকি তুমি আমার মতো তাদের বাসায় গিয়ে সংসার করবে। তাদের সাথে তোমার কালেভদ্রে দেখা হবে। আমার মতো না বিষয়টা। আর তোমায় মানবে না কেনো? আমার ভাই কম কিসের? ভালো চাকরি,,গাড়ি আছে,,কয়েকদিন পর বাড়িও হবে। তখন তোমার আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায় থাকবে?
আবরার বোনের মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে। তার কথায় যুক্তি আছে। স্পর্শ তার সাথে ঘরে করবে,,তাকে হানিয়ার তো সেই টক্সিক মানুষগুলোর সাথে ঘর করতে হবে না। তাও একটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। সে যে ডিভোর্সি। আর স্পর্শ? সে কেনো একজন ডিভোর্সিকে বিয়ে করবে। তারও তো অধিকার আছে কারো জীবনের প্রথম নারী হওয়ার। হ্যাঁ,, স্পর্শ তার মনের ও প্রণয়ের প্রথম নারী কিন্তু তার জীবনের তো না। সামাজিক দৃষ্টিতে সে দ্বিতীয়।
আবরার বলে উঠে —
–আমি ডিভোর্সি হানিয়া। এইটাই বড় কাটা আমাদের বিয়ের। সেও তো অধিকার রাখে কারো জীবনের প্রথম নারী হওয়ার।
হানিয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন উদ্ভট কথাবার্তা বলছে তার ভাই। ডিভোর্সি কি সে নিজ ইচ্ছেতে হয়েছে? আর প্রথম নারী মানে? আবরার তো স্পর্শকেই প্রথম ভালোবেসেছিলো। নাকি তার জানায় ভুল আছে? সে সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে আবরারকে প্রশ্ন করে–
–ভাই তুমি স্পর্শ আপুর আগেও কি কাউকে ভালোবেসেছিলে? সত্যি করে বলবে কিন্তু।
আবরার হানিয়া কথা ও দৃষ্টি দু’টোতেই হকচকিয়ে যায়। সে তড়িঘড়ি করে বলে—
–একটাকে ভালোবেসেই আমি দেবদাস হয়ে ঘুরছি আজ তিন বছর তুই আরো কাউকে ভালোবাসতে বলছিস? দেবো টেনে এক চড়।
হানিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলে—
–তাহলে প্রথম নারীর কথা বললে যে।
–আরে গাধার নানী,, প্রথম নারী বলতে অর্ধাঙ্গিনীকে বুঝিয়েছি।
–ওহ্হ😑
হঠাৎই পেছন থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলে উঠে —
— অর্ধাঙ্গিনী জায়গা তাকে দেওয়ার সাথে সাথে কি মনের জায়গাটাও তাকে দিয়ে দিয়েছেন?
আবরার আর হানিয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নারীটি হলো স্পর্শ। হানিয়ার ঠোঁটে একটা সুক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে। স্পর্শকে সেই ফোন দিয়েছিলো। স্পর্শ এগিয়ে এসে হানিয়ার পাশের চেয়ারটায় বসে পরে। তারপর আবরারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে পুনরায় শুধায়–
–বলছেন না কেনো?
স্পর্শ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে আবরার থতমত খেয়ে যায়। সে নিজেকে সামলে বলে–
–মনের দাড় একজনের জন্যই উন্মুক্ত করেছিলাম,, সে আসলো,, নিজের জায়গায় বসলো। তারপর থেকে অন্য সব নারীর জন্য সেই দাড় আবার বন্ধ হয়ে গেলো। আমার মনের ঘরে তাঁর জায়গা এখনো খুব যত্ন করে রেখেছি আমি,, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাখবো।
স্পর্শর মন ভরে উঠে আবরারের কথা শুনে। সে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। দৃষ্টি নত রেখে হানিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পায় সে এক গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের দিকে। প্রচন্ড বিস্মিত হলে যেমনটা করে না মানুষ,, তার ভাব অনেকটাই সেরকম। স্পর্শ হাতের কনুই দিয়ে তার হাতে ধাক্কা দিলে হানিয়া নিজের ধ্যাণে ফিরে। সে একবার স্পর্শ দিকে তাকায় তো আরেকবার আবরারের দিকে তাকায়। তারপর স্পর্শকে সে বলে —
–আপু বুঝলা,, বিয়ের পর তোমায় আর কষ্ট করে ভাইকে রোমান্টিক বানানো লাগবে না। সে যথেষ্ট রোমান্টিক
শেষের কথাটা একটু টেনে বলে হানিয়া। মুখে তার দুষ্টু হাসি। আবরার বোনের এমন কথায় একটু লজ্জাই পায়। মেকি ধমক দিয়ে বলে–
–হানিয়া! আমি তোমার বড় ভাই ভুলে গিয়েছো?
–নাহ। কিন্তু আমি যে তোমার ছোট বোন সেটা হয়ত তুমি ভুলে গেছো ভাই। (মুখ ভেঙচি দিয়ে কথাটা বলে)
যাই হোক,, এবার বলো তোমাদের বিয়ে কবে খাচ্ছি?
আবরার অসহায় হয়ে বলে–
–হানিয়া! তোমায় কি বুঝালাম আমি?
হানিয়া খানিক রেগে বলে–
–তুমিও বুঝালে আমিও বুঝলাম। সব বুঝলাম কিন্তু এটা বুঝলাম না এতো সবের মধ্যে আপুর দোষটা কই? সে কেন বারবার ভালোবাসায় ব্যর্থ হবে? এমন তো না যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো? তাহলে সমস্যা কই ভাই? তুমি এতো সেকেলে চিন্তা করছো কেন? যেখানে আপুর কোন সমস্যা নেই তোমায় বিয়ে করতে সেখানে তোমার এতো কিসের চিন্তা?
আবরার স্পর্শর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে–
–তোমার আপু কি একবারও বলেছে,,সে এই ডিভোর্সিকে বিয়ে করবে? কই আমি তো শুনলাম না।
স্পর্শ আবরারের কথা শুনে ঝট করে তার দিকে তাকায়। আবরার দেখতে পায় তার মায়াবিনীর চোখে অশ্রুদের আনাগোনা চলছে। বুঝতে বাকি থাকে তার সম্মতির বিষয়টা। হানিয়া একবার দু’জনের দিকে তাকায়, তারপর স্পর্শকে বলে–
–আপু তোমার এই মিডেলক্লাস,,ডিভোর্সি ছেলেকে বিয়ে করতে কোন সমস্যা আছে? থাকলে এখনি বলে দাও,, আমি চাই না তোমাদের পরিণতি আমার আর মি. তালুকদারের মতো হোক।
স্পর্শ একবার আঁড়চোখে আবরারের দিকে তাকায়। তারপর দৃষ্টি ঝুকিয়ে, মাথা নামিয়ে দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে বলে–
–সে যদি আমায় ভালোবাসে আমার কেন কোন অসম্মতি থাকবে? আমি তাঁকে ভালোবেসেছিলাম,, তার স্ট্যাটাসকে নয়। আর ডিভোর্সের বিষয়ে সব জানার পরও আমি যদি তাঁকে ফিরিয়ে দেই তাহলে আমার নিজেকে বিবেকহীন উপাধি দিলেও আমার জন্য কম হবে।
–ভালোবেসেছিলাম? তারমানে কি এখন আর ভালোবাসো না আমার ভাইকে?
সরাসরি ভালোবাসে কিনা প্রশ্ন করায় স্পর্শ বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। স্পর্শ তাকিয়ে দেখে দুই ভাই বোনই তার উত্তর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শ লজ্জা লাগছে ভীষণ,, ভীষণ,, ভীষণই। ফর্সা গাল গুলো হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। হানিয়া বিষয়টা খেয়াল করে,,তাও সে হবু ভাবীকে একটু জ্বালানোর জন্য পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করে–
–কি হলো আপু? বলো।
স্পর্শ চোখ এদিকসেদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই লজ্জাজনক অবস্থা থেকে বাঁচার রাস্তা খুঁজে। না, আজ যেনো সব রাস্তাই তার জন্য বন্ধ। শেষে উপায় না পেয়ে চোখ বন্ধ করে বলেই দেয়–
–ভালোবাসি বলেই উন্মাদ হওয়ার পরও শুধু তাঁকেই খুঁজেছি। ভালোবাসি বলেই এতো সবের পরও তার জীবনের দ্বিতীয় নারী হতে চাচ্ছি। ভালোবাসি বলেই তার হাতটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরার অধিকার চাচ্ছি।
হানিয়া খুশিতে বেশ জোরেই “ইয়াহু” বলে ফেলে। আশেপাশের টেবিলের সকলে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার দিলে তাকিয়ে থাকে। হুট করে বেশি উত্তেজিত হয়ে যাওয়ায় এই কাজটা করে এখন নিজেই পস্তাচ্ছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের কাছে ক্ষমা চায়। তারপর খুশিতে গদগদ হয়ে বলে–
–আমার না তোমাদের জন্য খুব খুশি লাগছে। ভাই তাহলে বিয়েটা ডেট কবে ঠিক করতে আপুদের বাড়ি যাবে?
আবরার কয়েক মিনিট সময় কিছু একটা ভাবে। তারপর হানিয়াকে প্রশ্ন করে–
–তোর আর সোনিয়ার ইয়ার ফাইনাল এক্সাম কবে?
–একমাস পরেই। সোনিয়ারও এমনই। কিন্তু কেনো?
–তোদের এক্সামের পরই হবে বিয়ে তাহলে।
হানিয়া অবাক হয়ে বলে–
–ও মাহ্ কেনো?
–আমি চাই আমার বিয়েতে আমার দুই তোতাপাখি থাকুক। আর বিয়েটা আমি ঘরোয়া ভাবে করতে চাইলেও স্পর্শর ক্ষেত্রে হয়ত তা তার বাবা-মা চাইবে না। তারা তাঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট ইচ্ছে পোষণ করে বলে আমি মনে করি। তাঁদের ইচ্ছেকে সম্মান করবো আমরা। তাই আমি চাই না,,তোরা পরীক্ষার চিন্তা মাথায় রেখে বিয়েটা এটেন্ড কর। আর এতে তোদের রেজাল্টে প্রভাব ফেলবে। তোমার কোন সমস্যা আছে আমার সিদ্ধান্তে?
স্পর্শ ভেবে দেখে আবরারের কথাগুলো শতভাগ সত্য। আর বাবার তার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। আবরারের আগের বিয়ের সব কথাই তার বাবা জানে। আবরারকে যে তার বাবা অপছন্দ করবে না এটাও সে জানে। তার মা একটু ঝামেলা করতে পারে কি সে সামলে নিবে। সে মাথা নাড়িয়ে আবরারের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে–
–না আমার কোন সমস্যা নেই।
–কিন্তু ভাই….
আবরার হানিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–কোন কিন্তু টিন্তু না। যা বললাম তাই হবে। এছাড়া আমার অফিসের দিকটাও আমায় একটু সামলে নিতে দাও। বাবার অসুস্থতার জন্য বেশ কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলাম,,এখন যদি আবারও ছুটি চাই তাহলে বুঝতেই পারছো বিষয়টা কেমন দেখায়।
–সব বুঝলাম কিন্তু আমি বাসায় যাবো না। এতে আমায় জোর করবে না কেউ এটা আগেই বলে দিচ্ছি।
–আমার বিয়েতেও তুই বাসার বাহিরে থাকবি?
–কিছু করার নেই। আমার ভাগ্যই এমন। এ নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। এখন বাকি কথা তোমরা শেষ করে নাও। আমার ইনায়াদের বাসায় যাওয়া লাগবে। আমি উঠলাম।
হানিয়া বসা থেকে উঠে পরে। তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে সে রেস্টুরেন্টে থেকে বের হয়ে আসে। আজ বিকেলে তার দু’টো টিউশনি ছিলো না। তাই ভাইকে ডেকে ঝুলে থাকা এই বিষয়টা সমাধান করে নিলো। মেইন রাস্তায় এসে দেখে তার কাঙ্ক্ষিত বাসটি এসে পরেছে। পাবলিক বাসে সে উঠতে পারে না,গা গুলিয়ে বমি পায় কিন্তু কিছু করার নেই। এখন কিছুটা সয়ে গেলো পুরোপুরি ঠিক হয়নি সমস্যাটা। তারউপর নারী পুরুষ নির্বিশেষে ঠাসাঠাসি করে ট্র্যাভেল করা। ভীড়ের মধ্যে পুরুষদের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ। বিষয়গুলো ভাবলেই তার কান্না পায়। দোয়া পড়তে পড়তে বাসে উঠে পরে। ভাগ্য ভালো থাকায় মাঝের সারিতে একটা উইন্ডো সিটও পেয়ে যায়। সেখানে গিয়ে বসে পরে।
বসার চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে সেখানে বসে সে কতটা ভুল করেছে। তার পাশেই তার বাবার বয়সী এক বুড়ো লোক বসেছে। একটু পরপরই তার গায়ের সাথে লেগে হাতটা আস্তে আস্তে ঘষছে। আবার ঘুমের ভান করে ঘাড়ে মাথা রাখছে। কয়েকবার সরিয়ে দেওয়ার পরও যা তাই। ঘুমের ছুতায় নিজের একটা হাত হানিয়ার পায়ের উপর এনে রাখছে। কয়েকবার একটু দূরে সরে বসতে বলার পরও এমন করছে। এবারও দূরে সরে বসতে বললে,,লোকটা কর্কশ গলায় বলে–
— এত সমস্যা হলে নেমে পরছেন না কেনো? দেখছেন না কতো ভীড়। এতো সরে বসতে পারবো না।
হানিয়া আর কিছু বলে না। কোনা চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখে,,লোকটা কেমন শয়তান মার্কা হাসি দিচ্ছে। বুঝতে পারে ইচ্ছে করেই এমন করছে সে। এবার হানিয়ার মেজাজের বাড়ন্ত পারদ কমায় কে? ব্যাগ খুঁজে হেডফোন বের করার ছুতায় একটা বড়সড় হিজাব পিন বের করে তা লুকিয়ে হাতের মুঠোয় রাখে। তারপর বুকে হাত বেঁধে নিষ্পাপ হয়ে বসে থাকে। লোকটি আবারও তার গা ঘেঁষতে চাইলে তখন হানিয়ার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বের করে রাখা পিনটার অর্ধেকটা লোকটার শরীরে ঢুকে যায়। লোকটা আর্তনাদ করে উঠলে বাসের বাকি পাবলিক তাদের দিকে তাকায়। লোকটি রেগেমেগে জিজ্ঞেস বলল–
–এই মেয়ে! এই। আমার হাতে কিসের গুতা দিলে তুমি?
হানিয়া নিষ্পাপ মুখ করে বলে–
–আমি তো কিছু করি নি আঙ্কেল।
–মিথ্যা বলবে না একদম। তুমি যদি কিছু দিয়ে গুতা নাই দাও তাহলে আমার হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কেন?
নিজের কাটা জায়গাটা দেখিয়ে বলে লোকটি। লোকটির চিৎকার চেঁচামেচিতে কন্ডাক্টর আসলে হানিয়া এবার সকলের উদ্দেশ্য বলে–
–এই লোকটি আমার সাথে অসভ্যতামি করছে। আমার গায়ে,,পায়ে হাত দিয়ে ঘষছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত ভুলে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু একসময় দেখি সে হাসছে।
বাসের অন্য নারীরা এবার বেশ ক্ষেপে যায়। লোকটি হানিয়ার অপবাদ মিথ্যা বললে হানিয়াও জোর গলায় বলে–
–আমায় তো পাগল কুকুরে কামড়িয়েছে না? নিজের চরিত্রের দাগ লাগাবো আমি? একটা মিথ্যা কথা বলবেন আপনার বয়সের কথা ভুলে যাবো আমি। জুতা দিয়ে এমন দেওয়া দিবো নিজের নামও ভুলে যাবেন। লজ্জা করে না অপকর্ম করে আবার মিথ্যা বলছেন?
হানিয়ার দৃঢ় গলায় বলা কথাগুলো শুনে সবাই বুঝতে পারে হানিয়া মিথ্যা বলছে না। পরবর্তীতে বাসের সবাই বলায় লোকটিকে তার স্টোপেজের আগেই নামিয়ে দেওয়া হয়। তার পাশে অন্য আরেকজন নারী বসে পরে। একটু সেও নেমে পরলে আরেকজন পুরুষ এসে আসে হানিয়ার পাশে। হানিয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলেও না। পাবলিক বাস এটা৷ সকলেই বসতে পারবে।।
হানিয়া খেয়াল করে এই লোকটিও তার গা ঘেঁষে বসেছে। লোকটিকে সরে বসার জন্য তার দিকে দৃষ্টি ঘুরালে দেখে লোকটি আর কেউ না তারই নিষ্ঠুর স্বামী মহোদয়। পাবলিক বাসে জাভিয়ানকে দেখে সে যথেষ্ট অবাকই হয়। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলে–
–সরে বসেন।
–কেনো?
— আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
— আমার তো হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে। এতোদিন পর বউয়ের পাশে। আহ্!
হানিয়া দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছু না বলেই ধপ করে উঠে দাঁড়ায়। জাভিয়ানও কম নাকি। সে-ও হানিয়ার হাত টান দিয়ে তাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়,, তারপর দুই হাত দিয়ে হানিয়ার কোমড় চেপে ধরে। হানিয়া ঘটনা বুঝার আগেই যেন সব হয়ে যায়। ধ্যান ফিরলে চেচিয়ে বলে–
–সাহস তো কম না। ছাড়ুন বলছি অসভ্য লোক।
তার চিৎকারে আবারও কন্ডাক্টর দৌড়ে আসে। হানিয়াকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কন্ডাক্টর রেগে বলে–
–এই ভাই সমস্যা কি? আপা রে এমনে ধইরা রাখছেন ক্যা?
–আমার বউকে কেমনে ধরে রাখবো সেটা কি তোমার থেকে জানতে হবে স্টুপিড? যাও নিজের কাজে যাও।
–বউ?
–হ্যাঁ বউ।
কন্ডাক্টর হানিয়াকে এই কথা জিজ্ঞেস করলে হানিয়া সাফসাফ মানা করে দেয়। জাভিয়ান হানিয়ার কথায় আহত হয়। হানিয়াকে কোলে বসিয়ে রেখেই কোর্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওয়াল পেপারে তার আর হানিয়ার বিয়ের দিনের ছবিটা দেখায় কন্ডাক্টরকে। লোকটা বুঝে নেয়,, মিয়া বিবির ঝামেলা চলছে। সে একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
জাভিয়ান এবার হানিয়াকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে–
–মানা করলে কেন? আমার বউ না তো কার বউ তুমি? এখনও কিন্তু আমাদের ডিভোর্স হয়নি এটা কেন ভুলে যাচ্ছো তুমি?
হানিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে–
–এই ভুলে যাওয়া আমায় স্বস্তি দেয়। তাছাড়া এমন কোন কারণ নেই যার জন্য আপনাকে মনে রাখবো। ছাড়ুন মি. তালুকদার আমার স্টোপেজ এসে পরেছে।
স্টোপেজ এসে পরেছে শুনে জাভিয়ান হানিয়াকে ছেড়ে দিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। তারপর হানিয়ার হাত ধরেই তাঁকে বাস থেকে নামায়। বাস থেকে নামার সাথে সাথেই হানিয়া নিজের হাতটা ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। জাভিয়ানও তার পিছু নেওয়া শুরু করে। বিভিন্ন কথা বলে তাঁকে জ্বালাতে শুরু করে। হানিয়া নিরুত্তর থাকে পুরোটা সময়। ইনায়াদের বাসার কিছুটা দূরে থেকেই হানিয়া পেছন ঘুরে জাভিয়ানের দিকে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে বলে–
–এসব কাজ আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে জায়গা মি.তালুকদার। নিজের জায়গাটা ধরে রাখুন। আর প্লিজ আমায় মুক্তি দেন। ডিভোর্সের বিষয়টা আপনার দিক থেকেও আগাচ্ছে না আমাকেও কিছু করতে দিচ্ছেন না। এমন করলে সত্যিই হয় না। আপনার ফিউচার পরে আছে,, সাথে আমারও। আমি আর সেই সংসারে ফিরে যেতে চাই না,,যেখান থেকে আমি একবুক কষ্ট নিয়ে চলে এসেছি। আমায় মুক্তি দিয়ে নিজের লেভেলের কাউকে জীবনসঙ্গী করে নিন। আপনার আমার পথচলা ওই পর্যন্তই ছিলো। (হাত দু’টো এক করে বলে) হাতজোড় করে বলছি, আমায় আমার মতো বাঁচতে দিন। প্লিজজজ।
জাভিয়ান নির্বাক হয়ে কথাগুলো শুনে। হানিয়া কথা গুলো বলে পুনরায় হাঁটা শুরু করে,,এবার আর জাভিয়ান তার পিছু নেয় না। নিজের পেছনে জাভিয়ানের অনুপস্থিতি টের পেয়ে হানিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। হুট করে হাতে টান পরায় হানিয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। জাভিয়ান তার হাত টেনে নিজের দিকে ফেরায়। মুখে তার একটা বাঁকা হাসি। হানিয়ার গাল দু’টো আলতো টেনে দিয়ে বলে–
–ওহ আমার বধূয়া! এই জীবনে আমার থেকে মুক্তি তুমি পাচ্ছো না। না আমি তোমায় ডিভোর্স দিবো না তোমায় দিতে দিবো। আর তুমি যখন এতোই বলছো আমার ক্লাসের কাউকে খুঁজে নিতে,,তোমার কথা আমি রাখবো। এই প্রথম আমার বধূয়া আমার কাছে কিছু চাইলো আমি কি না দিয়ে পারি। খুব শীঘ্রই তোমার সতিন আনবো বউ। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
কথাটা বলে হানিয়ার দু’গালে হাত রেখে তার কপালে টুক করে একটা চুমু দিয়ে জাভিয়ান উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। হানিয়া আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখতে থাকে।
____________________
হানিয়া ইনায়াদের বাসায় এসে আসরের কাযা নামাজ পড়ে মাত্রই বসে। ইনায়ার আম্মু তাঁকে দেখে খুশিতে আটখানা। কিচেনে ছুটোছুটি করছে তার জন্য নাস্তা বানানোর জন্য। হানিয়া তার কাছে গিয়ে তাকে এতো ছুটোছুটি করে রান্না করতে নিষেধ করে। সে বলে–
–জানিস হানিয়া,,আজ আমার ভাই আসবে বিদেশ থেকে দীর্ঘ ২৬ বছর পর। তার জন্যই এতো আয়োজন চলছে। তোর আঙ্কেল তাঁকেই আনতে গিয়েছে।
হানিয়া কথাটা শুনে বেশ অবাকই হয়। তারপর বিষয়টা নরমালভাবে নিয়েই ইনায়ার মায়ের হাতে হাতে টুকটাক কাজ করতে থাকে। মাগরিবের নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হলে বুঝতে পারে সেই অতিথি এসে পরেছে। এটা তাদের ফ্যামিলি টাইম কথাটা ভেবে সে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার পিঠ তার দিকে করা তাই হানিয়া তার মুখ দেখতে পারছে না। কথা বলতে বলতে একসময় ইনায়ার মায়ের চোখ যায় সিঁড়িতে দাড়িয়ে থাকা হানিয়ার দিকে। সে হানিয়াকে হাত দিয়ে ইশারা করে সেখানে যেতে বলে। হানিয়া মানা করলে সে জোরেই বলে উঠে —
–হানিয়া এদিকে আয়। কথা বল ভাইয়ার সাথে।
সকলে তার দিকে ঘুরে তাকায়। আর কোন উপায় না পেয়ে হানিয়া গুটি গুটি পায়ে তাদের কাছে যায়। দৃষ্টি অবনত রেখেই হানিয়া তাকে সালাম দেয়। লোকটি সালামের জবাব দেয় তার ভারী গম্ভীর গলায়। হানিয়া আঁড়চোখে লোকটি একবার দেখার চেষ্টা করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার সময় পুনরায় ঝট করে লোকটির দিকে তাকায়। নিজের দৃষ্টিকেও যেন আজ তার মিথ্যা মনে হচ্ছে। এ কি করে সম্ভব??
____________________
হোটেল সানরাইজের রেস্টুরেন্টে এরিয়া আপাতত ঘন্টা দুয়েকের জন্য বন্ধ। সেখানে অবস্থান করছে তালুকদার বাড়ির লোকেরা আর হানিয়া। আধাঘন্টা ধরে অপেক্ষা করার পর মিসেস তালুকদার খেঁকিয়ে উঠে বলে–
–আরে এই মেয়ে শুধু শুধু আমাদের টাইম ওয়েস্ট করছে। আজাইরা,, ফাউল মেয়ে।
জাভিয়ানের রাগ হয় মায়ের কথায়। সে হানিয়ার হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হানিয়া বলে–
–এই বয়সেও পার্লারে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রূপচর্চায় ব্যস্ত থাকেন তখন মনে হয় না এই সময়টা ওয়েস্ট না করে একটু ইবাদত করি? আমি একটা কাজের জন্য আপনাদের এখানে ডাকিয়েছি,, নাহলে আমার কোন ইচ্ছে নেই আপনাদের সাথে পুনরায় সাক্ষাতের।
হানিয়ার এমন খোঁচা শুনে মিসেস তালুকদার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। কর্কশ গলায় চিল্লিয়ে বলে
–দেখলে স্পর্শ বাবা কেমন বেয়াদব মেয়ে ও। আর তুমি কি না ওর জন্য আমার সাথে কথা বলো না।
মি. তালুকদার ফেন চালানের বাহানায় বলে–
— কি সময় আসলো রে স্পর্শ। সত্যি কথা বললেও মানুষ নাকি বেয়াদব হয়ে যায়। আসলে সবাই মুখের উপর বলা সত্যি কথা মেনে নিতে পারে না।
স্পর্শ আর জাভিয়ান,, আর কুলসুম মি.তালুকদারের কথা শুনে জোরে হেঁসে দেয়। হানিয়াও মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে হেঁসে দেয়। মিসেস তালুকদার বুঝতে পারে সবগুলো একি নায়ের মাঝি। সে চুপ করে রাগে ফসফস করতে থাকে। তাদের এই হাসাহাসির মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি এসে পরে। হানিয়া রেস্টুরেন্টের দরজায় তাকিয়ে দেখে সে এসে পরেছে।
লোকটি হেটে রেস্টুরেন্টের মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। হানিয়া রোজি বেগমের হাত ধরে তাকে বসা থেকে দাঁড় করায়। তারপর লোকটির সামনে নিয়ে গিয়ে তাদের মুখোমুখি দাড় করিয়ে বলে–
–দেখো তো মনি,, নিজের হিরোকে চিনতে পারছো নাকি?
রোজি বেগম সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখে কথা বলতে ভুলে যায়। মি. এন্ড মিসেস তালুকদারও তাই। জাভিয়ান-স্পর্শের ক্ষেত্রেও তাই হয়। রোজি বেগম হানিয়ার কাছ থেকে লোকটির সামনে এসে তার গালে আলতো করে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে–
–আদিব……
শব্দসংখ্যা~২৮৫০
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_সাতান্ন
–আমার সেই বারের মিশন’টা একটু বেশিই রিস্কি ছিলো। বাঁচা-মরার চান্স ফিফটি ফিফটি। আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরই মিশন টার খবর আসে। বিয়ের আগে আসলে আমি রোজকে আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়াতাম না। মিশনের খবরটা পাওয়ার পর আমি একবার মানাও করে দিয়েছিলাম,, পরে আমার সিনিয়ররা বুঝালো নিজের পরিবারের আগে নিজের দেশ। মেনে গেলাম। রোজকে বলে গেলাম নরমাল একটা মিশন। চট্টগ্রামে পাহাড়ি অঞ্চলে ছিলো মিশনটা। ঐখানে মাদক আর নারী পাচার স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বেড়ে গিয়েছিলো। আমি ও আমার সহকর্মীরা খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে সবকিছু হ্যান্ডল করেছিলাম। কিন্তু ইতিহাসের আমরা যেমন দেখেছি নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলো তার কাছে মানুষেরাই, আমাদের সাথেও তেমনটাই হয়েছিলো। আমাদেরই এক সহকর্মী টাকার লোভে আমাদের সাথে বেঈমানী করে বসলো। আমাদের সব প্ল্যান শত্রুপক্ষের কাছে পাচার করতে লাগলো। আমরা ধরা পরে গেলাম। আমার সাথে কাজ করা বাকি তিনজনকে আমারই চোখের সামনে নির্মমভাবে গলায় ছু”’ড়ি চালিয়ে হ””’ত্যা করা হলো। আমায় কি মনে করে যেনো বুকের বাম পাশে একটা গুলি করে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেয়। পাহাড় থেকে নিচে একটা নদীতে পরি আমি। সেটায় ভেসে ভেসে নদীটার কাছাকাছি একটা গ্রামে পৌঁছাই। সেখানকার কিছু ছেলে আমায় মাছ ধরতে গিয়ে উদ্ধার করে সেখানকার একটা হসপিটালে নিয়ে যায়। ছ’মাস কোমায় ছিলাম। ছয় মাস পর যখন চোখ খুলি তখন আমার সামনে ফারহানা আর সাজিদকে দেখি। ফারহানা আমার ছোট বোন আর ওই আমার চিকিৎসা করছিলো।
মি.তালুকদার অবাক হয়ে আদিব সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন —
–এই কি সেই ফারহানা যে কিনা স্কুলের গন্ডি পেরিয়েই তোর চাচাতো ভাইয়ের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো পরিবারের অমতে??
আদিব মাহবুব মাথা নাড়িয়ে তার কথার সম্মতি জানায়। ইনায়ার মা-বাবা অর্থাৎ ফারহানা মাহবুব আর সাজিদ মাহবুবকে দেখিয়ে বলেন–
–ফারহানা আর সাজিদ একে অপরকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায় কথাটা আমাদের পরিবারে জানানোর পর কেউ তাদের এই সম্পর্ক মেনে নেয় না। জোর করে ফারহানার বিয়ে বাবা অন্য জায়গায় ঠিক করলে বিয়ের দিন ফারহানা আর সাজিদ পালিয়ে যায়। পাত্রপক্ষের সামনে বাবাকে অনেক অপমানিত হতে হয়। সেই অপমান সইতে না পেরে বাবা মারা যান। মা তো আমাদের ছোট বেলাতেই মারা গিয়েছিলো,,বাবা মারা যাওয়ার পর আমি একদম একা,,এতিম হয়ে যাই। ওই শহর পরিবর্তন করে আমি ঢাকায় এসে নিজের মতো থাকা শুরু করি। তো এবার আমার ঘটনায় আসি। চোখ খুলে প্রথমে ফারহানা আর সাজিদকে না চিনতে পারলেও আস্তে আস্তে চিনতে পারি। ফারহানাকে বিয়ের পর সাজিদ ডাক্তার বানায়েছিলো,, ওদের সহায়তায় আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলে ঢাকায় এসে আমাদের ফ্ল্যাটে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি ফ্ল্যাট খালি, রোজ সেখানে নেই। আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় আমি চলে যাওয়ার তিন মাস পর্যন্ত রোজ এখানেই ছিলো,,পরবর্তীতে আরসাল গিয়ে তাকে আমাদের ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে আসে। আমার মৃত্যুর গুজব উঠায় তালুকদার বাড়ির সবাই সেটা বিশ্বাস করে নেয় আর রোজকে নাকি আবারও অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়েছে। এই কথা শোনার পর মানসিক ভাবে প্রচন্ড ভেঙে পরেছিলাম। উন্মাদ হয়ে ছিলাম কয়েকমাস। এমনিতেই শারীরিক ভাবে তো অসুস্থ ছিলামই তারপর এই কথা শুনে মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পরি। পরবর্তীতে ফারহানা আর সাজিদ সিদ্ধান্ত নেয় আমায় নিয়ে দেশের বাহিরে চলে যাবে। দুই মাসের মধ্যে ভিসার কাজ শেষ করে আমরা তিনজন পাড়ি দেই জার্মানিতে। সেখানে তিনবছর থেকে আমায় সুস্থ করে তুলে ফারহানা আর সাজিদ। এর মধ্যে আদিয়াত জন্মায় সেখানেই। সাজিদ’রা নিজের দেশ ছেড়ে থাকতে চাই ছিলো না আর। ফেরার প্রস্তাব দিলে আমি তাদের বলি আমি আর দেশে ফিরবো না। কার জন্য ফিরবো? যার জন্য আমার সব বাঁধা পেরিয়ে ঘরে ফেরার তাগিদ ছিলো সেই তো অন্যের ঘরণী তখন। তারা আমায় অনেক বুঝায়,, আমি বুঝি না। একসময় তারা মেনে যায়। আমায় ওখানে রেখেই চলে আসে। তারপরের দিনগুলো আমার কাটে নিঃসঙ্গ,, একাকী। কাল এতোগুলো দিন পর দেশে ফিরি। হানিয়া কাল রাতেই আমাদের সকলকে বলে আজ বিকেলে নাকি সে আমাদের কারো সাথে দেখা করাতে চায়,,বিশেষ করে আমায়। তারপরের ঘটনা আপনাদের সবার জানা।
আদিব মাহবুব নিজের কথা শেষ করে তার বুকে মাথা রেখে বসে থাকা মাঝ বয়সী অর্ধাঙ্গিনীর দিকে আবারও দৃষ্টি দেন। যার বিয়ের কথা শুনে সে উম্মাদ হলো,, মাতৃভূমি ত্যাগ করে বছরের পর বছর অন্য দেশে পরে রইলো সেই নাকি তার জন্য এতগুলো বছর চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে। এর চেয়ে সুখের কথা দ্বিতীয়টি নেই আদিব মাহবুবের কাছে। নিজেকে আজ হুট করেই প্রচন্ড সুখী মনে হচ্ছে। সে পেরেছে তার মনের মানুষটিকে সীমাহীন ভালোবাসা দিতে,,এরই ফলস্বরূপ তার ভালোবাসার মানুষটি দুই যুগের বেশি সময় ধরে তার আসার প্রতীক্ষা করছে সে মৃত জানার পরও।
উপস্থিত সকলেই এতক্ষণ এক আকাশ পরিমাণ বিস্ময় নিয়ে আদিব মাহবুবের কথা শুনছিলো। এ-ও সম্ভব? কেনো সম্ভব নয়,, উপরওয়ালা যেটা লিখে রেখেছেন সেটা না হয় যাবে কোথায়। ইনায়ার বাবা-মা,, ভাই,,ইনায়া ও তার স্বামীও এসেছে। হানিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের ধ্যাণ নিজের দিকে নেয়। সকলে উদগ্রীব হয়ে তার কথা শোনার জন্য তাকায়। হানিয়া বলা শুরু করে–
— মনি যেদিন প্রথম আমায় আদিব আঙ্কেলকে দেখায় সেদিনই আমি উনার চেহারার সাথে একজনের মিল পাই। ইনায়াকেও জানাই। কিন্তু ইনায়া আমায় ভুজুংভাজুং বুঝ দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু আমি শান্ত হতে পারি না। স্পর্শ আপুর ঘটনা শেষ হওয়ার পর আমি যখন রাজশাহী থেকে ইনায়াদের বাড়িতে উঠি তখন যেনো আমার সন্দেহ আরো গভীর হয়। আদিয়াত স্যারের সাথে আমি অনেকটাই মিল পাই। সাজিদ আঙ্কেল আর আদিব আঙ্কেলের চেহারায় অনেকটাই মিল আছে যেটা আপনারা খেয়াল করেছেন নাকি জানি না।
তার কথা শুনে সকলেই আদিব আর সাজিদ মাহবুবের দিকে তাকায়। হ্যাঁ,, চোখ আর থুতনির দিকে অনেকটাই মিল। হানিয়া আবারও বলা শুরু করে–
–এই চেহারার মিলটা আদিয়াত স্যারও পেয়েছেন জেনিটিক্যালি। কাল যখন আদিব আঙ্কেলকে আমি দেখলাম এক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে আন্টির (ইনায়ার আম্মু) কাছে আদিব আঙ্কেলের নাম আর তার এত বছর বিদেশে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে সরল মনেই আমায় সব জানায়। সাজিদ আঙ্কেল আর ফারহানা আন্টি আমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না,,শুধু জানতেন আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে সেপারেশনে আছি আর এই শহরে আমার থাকার মতো কেউ নেই সেই জন্য তাদের বাড়িতে আমি প্রায়ই দুই মাসের মতো ছিলাম। যাই হোক,, এত কথার এক কথা মনি তার ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।
কথাটা শেষ করে হানিয়া লম্বা করে একটা শ্বাস নেয়। হুট করে ইনায়া ডা.এহসানকে বলে উঠে —
–দেখেছো তোমায় বলেছিলাম না তোমায়? হানিয়াকে শার্লক হোমসের ফিমেল ভার্সন। ওর রগে রগে বুদ্ধি।
গুমট একটা পরিবেশ ইনায়ার এই দুই লাইনের কথাই যথেষ্ট ছিলো সকলকে হাসানোর জন্য। সকলে তার কথা শুনে হেঁসে দেয়। হানিয়া নিজেও কিছুটা হেঁসে দেয়। মেয়েটা তাকে ঐ ঘটনাগুলোর পর থেকে শার্লক হোমসের ফিমেল ভার্সন বলে ক্ষেপায় মাঝে মধ্যেই। আদিয়াত আর জাভিয়ান দুই জনই হানিয়ার হাসি মাখা মুখটা দেখতে থাকে। সকলে হালকা পাতলা স্ন্যাক্স অর্ডার দিয়ে কথা বলতে বলতে খেতে থাকে। হানিয়া নিজের জায়গা থেকে উঠে স্পর্শকে ইশারায় একটা ফাঁকা জায়গায় যেতে বলে। বিষয়টা জাভিয়ানের দৃষ্টি গোচর হয় কিন্তু সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তারা দু’জন কথা সেড়ে আসলে স্পর্শ তার বাবার কাছে গিয়ে কানে কানে কিছু একটা বলে। মি.তালুকদার মেয়ের কথা শুনে জায়গা ছেড়ে উঠে হানিয়ার কাছে গিয়ে কথা বলতে থাকে। এবার বিষয়টা জাভিয়ানকে ভাবায়।
সে নিজের জায়গায় বসে থেকেই সবটা ঘটনা দেখতে থাকে। সে দেখে মি. তালুকদার হানিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। হানিয়া তাঁকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু একটা বুঝায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। তারপর মি. তালুকদারের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে হানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে পরে। হানিয়া বের হয়ে যায় রেস্টুরেন্টে থেকে। জাভিয়ান ভাবে হানিয়া হয়ত চলে যাচ্ছে এখান থেকে তাই সে তড়িঘড়ি করে উঠে হানিয়ার পেছন যেতে চায়। কিন্তু তাঁকে আটকে দেয় তার বাবা। সে গম্ভীর মুখে সকলকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে। জাভিয়ান আমতা আমতা করে হানিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে মি.তালুকদার বলে সে একটা ফোনকল করেই আসছে।
তাই হয়। হানিয়া মিনিট দুয়েক পর হাসি হাসি মুখে পুনরায় রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। তারপর ইনায়ার কাছে গিয়ে তার কানে কানে কিছু একটা বলে স্পর্শর কাছে এসে বসে পরে। ইনায়াও তাদের কাছে এসে হেসে হেসে কথা বলতে থাকে। তারা দু’জন মাঝে মাঝে কিছু একটা বলছে আর স্পর্শ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। জাভিয়ানের কাছে বিষয়টা বড়ই অদ্ভুত লাগে।
মিনিট ত্রিশেক পর সেখানে এসে উপস্থিত হয় আবরার তার বাবা-মা,, আর সোনিয়া। আর কেউ বুঝতে না পারলেও জাভিয়ানের বুঝতে বাকি থাকে না তাদের আগমনের কারণ। মি. তালুকদার সাদরে তাদের বসতে বলে। কুশল বিনিময় শেষে মি. তালুকদার বলা শুরু করে–
–দেখেন বেয়াই সাহেব আর বেয়ান,,আপনারা তো সবই জানেন। তেমনি আমরাও সবই জানি। আমার একটাই কথা আমার মেয়ে যার সাথে ভালো থাকবে তার সাথেই আমি তার বিয়ে দিবো। আমার মেয়ে আর আপনার ছেলে যেহেতু একে অপরকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে,,তাই আমি চেয়েও আর এই সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। জাভিয়ান-হানিয়ার মধ্যকার বোঝাপড়া তারাই করুক। কিন্তু তাঁদের এই ছাড়াছাড়ির সিদ্ধান্তে আমি আগেও একমত ছিলাম না আজও নেই। কিন্তু যে থাকতে চায় না তাকে কি জোর করে রাখা যায়। সেইসব কথা বাদ দিলাম আজ,, আমার স্পর্শ আর আবরারের বিয়েতে কোন অমত নেই। ছেলে হিসেবে আবরার যথেষ্ট ভালো আমার দেখা মতে। এখন আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমরা ওদের দুজনের বিয়ের ডেট ঠিক করে রাখতে পারি।
উপস্থিত সকলে বেশ অবাক হয় মি. তালুকদারের কথা শুনে কিন্তু তার চেয়েও বেশি খুশিই হয়। কারন তারা কম বলি সবটাই জানে। আবরারের বিয়ে কেমনভাবে হয়েছিলো তাও জানে। সকলে হাসি মুখে তাঁদের আলোচনা শুনলেও একজন ব্যক্তি তা মানতে পারে না। তিনি হলো মিসেস তালুকদার,, স্পর্শ-জাভিয়ানের মা। সে তড়াক করে বসা থেকে উঠে গিয়ে বলে–
–তোমার আপত্তি না থাকলেও আমার আপত্তি আছে। আমি এই ডিভোর্সি,, মিডেলক্লাস ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না কিছুতেই।
অপমানে আবরারের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। হানিয়াও রেগে যায় ভাইয়ের অপমানে। কিন্তু সে চুপ থাকে,,শুনতে চায় তালুকদার বাড়ির বাকি সদস্যদের মন্তব্য। স্পর্শ নিজেও বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। খানিকটা শক্ত গলায়ই বলে–
–আম্মু তুমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে এমন অপমান করতে পারো না।
মিসেস তালুকদার ধমক দিয়ে বলে–
–তুমি চুপ করো বেয়াদব মেয়ে। কিসের ভালোবাসার মানুষ? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? ওদের ক্লাস দেখো আর আমাদের ক্লাস দেখো? তারপর কথা বলতে আসবে।
–ক্লাস দেখেই কথা বলছি। আবরার একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার পদে আছে। মাস শেষে এক লক্ষ টাকার মতো বেতন তার। গাড়ি,,ফ্ল্যাট আছে নিজেদের। এখন বলো তারা আমাদের থেকে কম কিসের?
মেয়ের কথা শুনে মিসেস তালুকদার থতমত খেয়ে যায়। জবাব দেওয়ার জন্য কোন কথা খুঁজে পায় না। মি. তালুকদার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে–
–হয়েছে নিজের বেইজ্জতি করানো? নাকি আরো বাকি আছে?
মিসেস তালুকদার রেগে গিয়ে বলেন–
–আর ডিভোর্সি? সেটার কি সাফাই দিবে তুমি? এটা তো আর অস্বীকার করতে পারবে না সে পূর্ব বিবাহিত।
এবার স্পর্শ আর কোন উত্তর দিতে পারে না। কথা তো মিথ্যা বলে নি মিসেস তালুকদার। স্পর্শ নরম গলায় আমাকে বলে–
–আমার উনি পরিস্থিতির চাপে বিয়েটা করেছিলো। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার তো কোন সমস্যা নেই এই বিয়েতে।
মিসেস তালুকদার কড়া গলায় বলেন–
–তোমার না থাকলেও সমাজ তো এসব বুঝবে না। যখন সবাই জানতে পারবে একজন ডিভোর্সি ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে তখন বুঝতে পারছো আমাদের কতটা অপমানিত হতে হবে?
–তুমি সমাজের কথা ভাবছো আর নিজের মেয়ের কথা ভাবছো না আম্মু?
ভীষণ করুণ স্বরে কথাটা বলো স্পর্শ। মিসেস তালুকদার চোখমুখ শক্ত করেই বলে–
–মেয়ের কথা ভেবেই আমি বিয়েতে অমত জানাচ্ছি। মতামতটা আমার জানানো উচিত ছিলো বলে আমি জানিয়েছি,তোমরা মানবে কি মানবে না সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আর যাকেই এই বিয়েতে পাও না কেন আমাকে তুমি পাবে না এটা জেনে রেখো।
–আম্মু এমন করো না প্লিজ।
কথাটা বলতে বলতে স্পর্শ চোখের পানি ছেড়ে দেয়। মাকে ছাড়া বিয়ে,,কোন মেয়ে কি তা কল্পনাতেও আনতে পারে? মি. তালুকদার,,রোজি বেগম আর জাভিয়ানও এসে মিসেস তালুকদারকে বুঝালো।কিন্তু কেউ তার না’কে হ্যা’তে রূপান্তরিত করতে পারলো না। আবরার এবার আর বসে থাকলো না। বেশ উচ্চস্বরে হানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো–
–হানিয়া বাসায় চলো। আমি আগেই তোমাকে এই বিষয়ে বলেছিলাম,,তুমি শুনলে না। আমি জানতাম এই বিয়েতে অনেক কমপ্লিকেশন আসবে। এটা চাইনি আমি। এখন হলো তো আমার সাথে বাবা-মাকেও অপমান করিয়ে। চলো সবাই এখান থেকে।
কথাটা বলেই আবরার বাবাকে বসা থেকে উঠায়। হানিয়া একবার মিসেস তালুকদারের দিকে তাকিয়ে সে-ও চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। স্পর্শ কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পায়ের কাছে বলে গুঙিয়ে বল উঠে–
–মা মা আবরাররা চলে যাচ্ছে। ওদের আটকাও আম্মু। ওকে ছাড়া আমি আবার উন্মাদ হয়ে যাবো।
মিসেস তালুকদারের কি জানি হলো। সে আবরারকে পেছন ডেকে বলে–
–আমি এই বিয়েতে সম্মতি দিতে পারি যদি আমার একটা শর্ত মানা হয়।
সকলে উদগ্রীব হয়ে তার দিকে তাকায়। হানিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করে–
–কি শর্ত?
–তোমার আর জাভিয়ানের ডিভোর্স হবে আর জাভিয়ানকে আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। এই শর্ত রাজি থাকলে আমি এই বিয়েতে রাজি আছি।
স্পর্শ-জাভিয়ান এমনকি উপস্থিত সকলে যেন তার এমন শর্তে হতভম্ব হতেও ভুলো গেলো। এমন কেমন শর্ত? আরেক মেয়ের সংসার ভেঙে নিজের মেয়ের সংসার গড়ার কথা বলছে মিসেস তালুকদার। আবরার রেগে না’ করতে যাবে তার আগেই হানিয়া বলে–
— আমরা রাজি। ডিভোর্স তো আমি আপনার ছেলেকে এমনিতেও দিবো। আপনার ছেলেই আমায় কোন আইনি পদক্ষেপ নিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমি কথা দিলাম আমি আর জীবনেও আপনার ছেলের সংসার করবো না। ওই বাড়িতে আমার সংসারের পাঠ চুকে গেছে। এখন আপনার ছেলে আপনার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে কিনা সেটা নিতান্তই আপনাদের ছেলের সিদ্ধান্ত।
জাভিয়ানের কি হলো বুঝা গেলো না,,সে একদম স্বাভাবিক ভাবেই বলে–
–আমি বিয়ে করবো আম্মুর পছন্দের মেয়েকেই আর হানিয়া কেও ডিভোর্স সেদিনই দেবো।
সকলে ফাটা চোখ নিয়ে তাঁদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তারা দু’জন ব্যস্ত চোখে চোখে নিজেদের মনের অবস্থা জানাতে।
শব্দসংখ্যা~২০৩৪
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_সাতান্ন(বর্ধিতাংশ)
বিধ্বংসী রাগ নিয়ে জাভিয়ানের অফিসে প্রবেশ করে হানিয়া। রিসেপশনিস্টের কাছে গিয়ে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে–
–আপনার স্যার অফিসে আছে এখন?
রিসেপশনিস্ট তার আগমন ও থমথমে গলার জিজ্ঞাসায় বেশ অবাক হয়। সেই যে হানিয়া একদিন এসেছিলো আর কখনোই আসেনি। জাভিয়ানও তাকে আসতে বলে নি বা আনেনি। আর স্ত্রী হয়ে স্বামীর অফিসে এসে জিজ্ঞেস করছে সে আছে নাকি? যাই হোক,, রিসেপশনিস্ট তাকে হাসিমুখে ব’লে–
— জ্বি ম্যাম আছেন। এবং সে ফ্রি’ই আছেন। বাই দ্যা ওয়ে,, আপনি কেমন আছেন ম্যাম?
একজন হাসিমুখে “কেমন আছেন” জিজ্ঞেস করলে তার সাথে কি খারাপ ব্যবহার করা যায়? হানিয়া করতে পারে না খারাপ ব্যবহার রিসেপশনিস্ট মেয়েটির সাথে। সে গলাটা স্বাভাবিক করে বলে–
–জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
–আলহামদুলিল্লাহ ম্যাম। আপনি যান ম্যাম, স্যার তার কেবিনেই আছেন।
হানিয়া রিসেপশন থেকে লিফটে উঠে পরে। কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে এসে কারো দিকে না তাকিয়েই সোজা জাভিয়ানের কেবিনে বিনা নক করে ঢুকে পরে। কিন্তু এটাই যেন তাকে আরো একবার মৃত্যুর ন্যায় অনুভূতি দেয়। জাভিয়ান তার বস চেয়ারে বসে আছে আর তার কোলে তারই হবু বধু সোহা বসে আছে। যেনতেন ভাবে না চুম্বনরত অবস্থায় আছে তারা।
হুট করে দরজা খোলার আওয়াজে জাভিয়ান-সোহা দুইজনই দরজার দিকে তাকায়। দরজার সামনে স্তব্ধ হয়ে হানিয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সোহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অন্যদিকে জাভিয়ানের বুকটা প্রচন্ড ভাবে কেপে উঠে। জাভিয়ান মুখ খুলে কিছু বলবে তার আগেই সোহা প্রচন্ড অবজ্ঞা নিয়ে বলে–
–সামান্য ম্যানারসটুকু অব্দি নেই তোমার? কারো কেবিনে প্রবেশ করার আগে পারমিশন নিতে হয় এটা জানো না? ম্যানারসল্যাস গার্ল কোথাকার!
জাভিয়ান সোহাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কোল থেকে উঠিয়ে দেয়। তাঁকে ধমক দিয়ে বলে–
–জাস্ট শাটআপ ষ্টুপিড। কাকে কি বলছো মাথায় আছে? ওপর রাইট আছে আমার কেবিনে বিনা পারমিশনে ঢোকার। ও এখনো আমার ব……
–এক্সট্রিমলি সরি। রিসেপশনিস্ট বলেছিলো আপনি ফ্রি আছে তাই…. দুঃখিত আবারো। আপনাদের কাজ শেষ হলে আমায় ডাক দিবেন। আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।
কথাটা বলে হানিয়া এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করে না। সেখান থেকে চলো যায়। জাভিয়ান পিছু ডাকলেও শুনে না। পেছনে যেতে চাইলে সোহা তাঁর হাত ধরে আটকে দেয়। আবেদনময়ী ভাবে অঙ্গভঙ্গি করে বলে–
–ছাড়ো তো ওকে জাভিয়ান। যত্তসব ফাউল। যেই কাজটা অসম্পূর্ণ ছিল আসো সেটা করি।
কথাটা শেষ করতে দেরি জাভিয়ানের দাবাং হাতের থাপ্পড় সোহার গালে পরতে দেরি হয় না। এমন এক থাপ্পড় দিয়েছে সে সোহা মেঝেতেই পরে গেছে। জাভিয়ান রাগে পাগল হয়ে যাচ্ছে একপ্রকার। হানহয়া মেয়েটা শুধু তার আর তার ফ্যামিলির মেম্বার দ্বারা কষ্ট পাওয়ার জন্যই কি তালুকদার বাড়িতে এসেছে? যা করতে চায় না তাই হয়ে যায় হানিয়ার সাথে।
জাভিয়ান সোহার বাম হাতের বাহু শক্ত করে ধরে নিচ থেকে উঠায়। একহাত দিয়ে ওর চোয়াল চেপে ধরে রাগে হিসহিসিয়ে বলে–
–ফাউল কাকে বলিস হ্যা? ওর পায়ের নখের যোগ্য তুই? আমার বউ আমার অফিসে এসেছে,,সে পারমিশন ছাড়া আসবে নাকি পারমিশন নিয়ে আসবে তার জন্য আমি ছিলাম না? তুই আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলতে গেলি কেন?
সোহা মার খেয়ে থমকে যায়। জাভিয়ান মারলো তাকে? তাও এতো জোরে? মাথা ঝিমঝিম করছে তার। তার উপর জাভিয়ানের এতো রাগ দেখে সে ভয় পেয়ে গেছে। ভীষণ হিংস্র দেখাচ্ছে জাভিয়ানকে। সোহা ভয়ে কোন জবাব দিতে পারে না। জাভিয়ান আবারও বলে–
–বলেছিলাম না আমার কোল থেকে উঠে যা। না উঠে কি করলি? তোর কলিজা দেখি দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে রে। আমার মুখের দিকে ঝুকে আসছিলি কেন?
আসলে ঘটনাটা হয়েছে কি,, জাভিয়ান সারাদিন মিটিং করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পরেছিলো। তিন নম্বর মিটিংটি শেষ করে নিজের কেবিনে এসে ক্লান্ত হয়ে চেয়ার হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো। কখন যে নিদ্রা ভাব চলে আসে সে বুঝতে পারে না। হুট করেই নিজের কোলে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে চোখ খুলে তাকালে সোহাকে দেখতে পায়। প্রথমে ভালোভাবেই বলে তার কোল থেকে উঠে যেতে। কিন্তু সোহা উঠে না। তার কোলে বসেই আজাইরা প্যাচাল পারতে থাকে। জাভিয়ান বিরক্ত হয়ে যখন হাত উঠিয়ে সোহাকে উঠানোর চেষ্টা করে সোহা জাভিয়ানের দুই হাত নিজের দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে হুট করেই তার মুখটা জাভিয়ানের মুখের সামনে নিয়ে আসে কিস করার জন্য। ঠিক তখনই হানিয়া কেবিনে প্রবেশ করে তাদের এমন অবস্থায় দেখে ভুল বুঝে।
সোহা ভয়ে ভয়ে বলে–
–আমি তোমার হবু বউ জাভ…..
জাভিয়ান রুম কাপিয়ে সোহাকে ধমক দিয়ে বলে–
–হবু বউ তুই আমার,,বউ তো না। আর ওই মেয়ে আমার বউ। ওর সাথে আমার এখনো ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় নি। তোর সাহস কি করে হয়ে ওকে ম্যানারসলেস আর ফাউল বলার? এখন বিয়ের এক সপ্তাহ আগে যদি ভেঙে যায়, তাহলে তোর বাবার সম্মান কই যাবে বুঝতে পারছিস? কি রে করবো বল?
সোহা এবার সিরিয়াস ভয় পেয়ে যায়। বিয়ে ভেঙে দিলে একে তো তার প্ল্যান ফেইল হয়ে যাবে। দুয়ে, তার বাবার মানসম্মানও শেষ হয়ে যাবে। ভয়ে সোহা চোখের পানি ছেড়ে দেয়। জাভিয়ানের যেই হাতটা তার গাল চেপে ধরে আছে সেটার ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে–
–না না,,প্লিজ এমনটা করো না। আই এম সরি। প্লিজ তুমি বিয়েটা ভেঙে দিও না। বাবার অনেক অসম্মানি হবে। প্লিজ জাভিয়ান।
জাভিয়ান ঝটকা দিয়ে সোহাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। পেছন ঘুরে একহাত কোমড়ে রেখে বড়বড় করে শ্বাস ফেলে বাড়ন্ত রাগটা কমাতে চায়। এক মিনিট পর সোহার দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বলে–
–হানিয়াকে ডাকছি। ও ঢোকার সাথে সাথে সরি বলবি।
সোহা ভয়ে ভয়ে মাথায় নাড়ায়। জাভিয়ান রাশেদকে কল করে হানিয়াকে কেবিনে পাঠাতে বলে।
______________
অন্যদিকে হানিয়া কেবিন থেকে বের হয়ে একটু দূরেই ওয়েটিং রুমে বসে পরে। বুকের ভেতরে অসহনীয় পীড়া হলেও মুখ দেখে তা বুঝার জো নেই। একটা সিটে বসে পরে পেছনের দেওয়ালের মাথা লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে কয়েক ঘন্টা আগের কথা।
কয়েক ঘন্টা আগে~~
সেদিন রেস্টুরেন্টের ওই ঘটনার পর কেটে গেছে দেড় মাস। আর এক সপ্তাহ পরই স্পর্শ-আবরার আর সোহা-জাভিয়ানের বিয়ে। দুটো বিয়ে একই দিনে একই সেন্টারে হবে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় হানিয়া এখন অবসর সময়ই কাটাচ্ছে। গোসল করে,,জোহরের নামাজ পড়ে খেয়ে টিউশনির জন্য বের হয়। দু’টো থেকে পড়ানোর শুরু করে। ওই বাচ্চাকে পড়িয়ে আসার সময় বাচ্চার মা তার হাতে চলতি মাসের বেতনটা ধরিয়ে দেয়। হানিয়া একটু অবাকই হয়। কারন এই স্টুডেন্টরা একটু দেরি করেই বেতনটা দেয়। হানিয়া হাসি মুখে বাচ্চার মা’কে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাচ্চার মা গুরুগম্ভীর গলায় বলে–
–কাল থেকে তোমার আর আসা লাগবে না হানিয়া।
হানিয়া বেশ অবাক হয় মহিলার কথা শুনে। সে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে–
–কেনো আন্টি? আপনারা কি কোথাও যাচ্ছেন?
–নাহ। তোমার কাছে আমার মেয়েকে আর পড়াতে চাচ্ছি না।
–কেনো আন্টি? আমার দ্বারা কি কোন ভুল হয়েছে? তাহলে বলুন আমি শুধরে নিবো।
–নাহ কোন ভুল হয়নি। কিন্তু তাও তোমার কাছে পড়াবো না। তুমি এবার যেতে পারো।
হানিয়ার স্টুডেন্ট ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া রাইসা তার মায়ের কথা শুনে কান্না করে দেয়। এই দুই মাসে রাইসার সাথে হানিয়ার বেশ জমে গেছে। হানিয়া তার পছন্দের শিক্ষকও বলা চলে। সেই পছন্দের শিক্ষককেই নাকি তার মা তাকে পড়াতে নিষেধ করে দিচ্ছে? রাইসা দৌড়ে এতে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে–
–না আম্মু,,হানিয়া মিস’কে বাদ দিও না। তার মতো করে সুন্দর করে কেউ আমায় বুঝায় না পড়া। প্লিজ আম্মু। সে আমার ফেভারিট টিচার।
রাইসার আম্মু রাইসাকে হানিয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে ধমকে বলে–
— হ্যাঁ এমন চরিত্রের মেয়েরা সহজেই সকলের ফেভারিট হয়ে যায়।
হানিয়া রাইসার আম্মুর কাছে নিজের চরিত্র সম্পর্কে কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। কি এমন করলো সে যার জন্য ভদ্রমহিলা তার চরিত্র নিয়ে কথা বললো? হানিয়া এবার রেগেই যায়। সেও কঠিন গলায় বলে–
–এমন চরিত্র বলতে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন আন্টি? আপনার কি রাইট আছে, আমার চরিত্র সম্পর্কে কথা বলার?
রাইসার আম্মু খ্যাক খ্যাক করে বলে–
–এমন চরিত্র বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছি বুঝো না? চেহারা সুরুত দেখে তো সহজসরলই মনে হয়। কিন্তু চরিত্রের এমন দোষ কেন বাপু?
হানিয়া মহিলার কথা শুনে থমকে যায়। সে রাইসার আম্মুকে জিজ্ঞেস করে–
–আমার চরিত্রে কি এমন দোষ পেলেন যে, আমার চরিত্রে আঙুল তুলছেন?
–সেটা আমি বলতে পারবো না। তুমি এখন বিদায় হও তো।
–আমি যাবো না আমার জবাব না পাওয়া পর্যন্ত। আপনি যদি আমায় না বলেন আমি তাহলে আশেপাশের মানুষ জড়ো করবো। বিষয়টা কিন্তু তখন বিশ্রী পর্যায়ে চলে যাবে। তাই ভালোয় ভালোয় বলেন।
রাইসার আম্মু ভয় পেয়ে যায় তার কথায়। মহিলা মেয়ে নিয়ে একা থাকে বিশাল ফ্ল্যাটে। স্বামী বিদেশে থাকে। তার স্বামী ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। এখন হানিয়া যদি প্রতিবেশী ডেকে ঝামেলা করে তাহলে তার স্বামী তাঁকে ইচ্ছে মতো ঝাড়বে। তার চেয়ে ভালো বলেই দিক। মহিলাটি বলতে শুরু করে–
–তুমি যে স্বামী সংসার ত্যাগ করে কখন ভাইয়ের বাসা,, কখনো বান্ধবীর বাসায় থাকো এটা কি ভালো চরিত্রের মেয়েরা করে?
হানিয়া অবাক হয়ে যায় এই কথা শুনে। সে এতো কিছু জানল কিভাবে? সে থমথমে গলায় বলে–
–আপনি আপনার ভাইয়ের বাসায় যান না আন্টি? এতে কি আপনার চরিত্রও খারাপ হয়ে গেছে? আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি এসব জানলেন কীভাবে?
মহিলা হানিয়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায়। সে এদিকসেদিক তাকাতে তাকাতে বলে–
–কে বলেছে সেটা আমি বলতে পারবো না। তুমি এখন আসো।
–বলতে আপনাকে হবেই। নাহলে এবার আমি সত্যি সত্যিই আশেপাশের মানুষ ডেকে আপনার এমন আচরণ সম্পর্কে জানাবো। আঙ্কেল যদি একবার জানতে পারে তাহলে বুঝতে পারছেন কি হবে?
মহিলা যে স্বামীকে বাঘের মতো ভয় পায় সেটা সে নিজেই একদিন কথার ছলে ছলে হানিয়াকে বলেছিলো। আজ হানিয়া সেটারই সুযোগ নেয়। মহিলাটি বলে —
–কাল আমার বাসায় তোমার ননদ এসেছিলো। তোমার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে বলে গেছে। ছিঃ ছিঃ এমন একটা খারাপ চরিত্রের মেয়ের কাছে আমার মেয়ে পড়ছিলো।
স্বামী আর ননদ বলতে জাভিয়ান আর স্পর্শ এসেছিলো? হানিয়া অবাক গলায় বলে–
–কে এসে ছিলো?আমার ননদ?
–হ্যাঁ।
হানিয়ার মহিলার কথা বিশ্বাস হয় না। তাই সে তার ফোনটা বের করে যেটা কিনা কয়েকদিন আগে মির্জা বাড়ি থেকে আনিয়েছে সেটায় স্পর্শের ছবি খুঁজে বের করে তাকে দেখায়। মহিলাটি জানায় এই মেয়ে না। অন্য কেউ এসেছিলো। হানিয়া কি মনে করে ফেসবুকে সোহার আইডি সার্চ দিয়ে বের করে তার ছবিটা দেখায়। তখন মহিলাটি বলে হ্যাঁ এই সেই মেয়েটি।
হানিয়া মহিলাটিকে আর কিছু বলে না। আসার সময় শুধু একটা কথাই বলে আসে–
–অন্যের কথায় শুনে আমার চরিত্রে আঙুল না তুলে আমায় একটু জিজ্ঞেস করতে পারতেন। দুই মাস হতে চললো আজ পর্যন্ত কখনো দেখেছেন আপনার মেয়ের চরিত্র খারাপ হয় এমন কোন কথা বলতে বা কাজ করতে?
মহিলা কোন উত্তর দিতে পারে না। হানিয়া দূর থেকে রাইসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে যায় অন্য দু’টো টিউশনি করাতে। তারাও পর্যায়ক্রমে হানিয়াকে বাদ দিয়ে দেয়। কারণ জানতে চাইলে যেনতেন একটা বুঝ দেয় হানিয়াকে, কিন্তু হানিয়া বুঝতে পারে তারা কেন তাকে বাদ দিচ্ছে। হানিয়া তাদের সোহার পিকটা দেখিয়ে একটা কথাই জিজ্ঞেস করে–
–আমাকে বাদ দেওয়ার কারণ কি এই মেয়েটির বলা কিছু কথা?
মহিলা দুটো মাথা নিচু করে হানিয়ার কথার নিরব সম্মতি দেয়। হানিয়া তাদের উত্তর বুঝতে পেরে এসে পরে তাদের বাসা থেকে। তারপরই সে জাভিয়ানের কাছে এসেছিলো তার হবু বউয়ের এমন কান্ড করার কারণ জানতে। আর জানতে সে কেনো এমনটা করলো।
বর্তমান~~
রাশেদের ডাকে হানিয়ার ধ্যাণ ফিরে। সে বসা থেকে উঠে জাভিয়ানের রুমের দিকে যায়। এবার নক করেই প্রবেশ করে। জাভিয়ান তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। হানিয়া ভেতরের প্রবেশ করার পর দেখতে পায়,,জাভিয়ান তার চেয়ারে বসে আছে আর সোহা দাড়িয়ে আছে। হানিয়া হেঁটে জাভিয়ানের ডেস্কের সামনে গেলে জাভিয়ান হানিয়াকে বসতে বলে। হানিয়া গম্ভীর গলায় বলে–
–বসতে আসি নি। শুধু আপনার হবু বউয়ের করা কিছু কর্ম সম্পর্কে জানাতে আর জানতে এসেছি সে কেন এমন করলো আমার সাথে?
জাভিয়ান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে–
–কি করেছে সে তোমার সাথে?
হানিয়া জাভিয়ানকে বিষয়টা খুলে বলে। সোহা হানিয়ার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। মহিলা গুলো এমন ভাবে তার কথা ফাঁস করে দিবে সে কল্পনাও করতে পারেনি এমন হবে। সে নিজেকে বাচানোর জন্য হানিয়ার আনা অভিযোগ অস্বীকার করে।হানিয়া তার কথার প্রমাণ দিতে একজন স্টুডেন্টের মা’কে ভিডিও কল দিয়ে সোহাকে দেখালে বলে মহিলা বলে এই মেয়েটিই হানিয়ার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে তাকে। সবটা শুনে দেখে জাভিয়ানের নিভে যাওয়া রাগটা যেন আবারও দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। জাভিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই হানিয়া বেশ উচ্চস্বরে বলতে শুরু করে–
— আমার সাথে আপনাদের সমস্যা কি রে ভাই? আমায় কি আপনারা এবার কবরে নিয়ে গিয়ে শান্তি পাবেন? আমি তা কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে সে এমনটা করলে আমার সাথে? এন্সার মি মি. তালুকদার।
এতো প্রমাণ থাকার পরও সোহা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বলে–
–জাভিয়ান বিশ্বাস করো আমি কিছু করি নি। এই হানিয়া তোমার চোখে আমাকে খারাপ করতে,আমাদের বিয়েটা ভেঙে দিতে ও নিজেই এসব করেছে।
হানিয়া আর নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না। সোহার সামনে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারে,,যেই গালে কিছুক্ষণ আগে জাভিয়ান থাপ্পড় মেরে ছিলো। একই গালে পরপর দু’বার এমন দাবাং থাপ্পড় খেয়ে সোহার ঠোঁট কেটে যায়। হানিয়া সোহার চুলের মুঠি ধরে বলে–
— তুই কে বে তোর জন্য এত কিছু করতে যাবো? নিজ ইচ্ছায় নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছি,,নাহলে তোর যোগ্যতা আছে তালুকদার বাড়ির বউ হওয়ার?
–আহ ছাড় হানিয়া।
হানিয়া সোহাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে–
–আমার সাথে লাগতে আসবি না। এমন হাল করবো তোর পেয়ারের স্বামীও চিনতে পারবে না।
তারপর জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে–
–আপনার বিচারের অপেক্ষা করলাম না। নিজের বিচার নিজেই করতে শিখে গিয়েছি। দুঃখিত আপনার হবু বউয়ের গায়ে হাত তোলার জন্য। কিন্তু সে এটা প্রাপ্য। আপনার বউকে বলবেন আমার থেকে দূরে থাকতে।
কথাটা বলে হানিয়া হনহনিয়ে জাভিয়ানের কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। জাভিয়ান হা করে হানিয়ার এমন রুদ্রানী রূপ অবলোকন করে। সোহা এই কাজটা করেছে হানিয়ার মনে স্পর্শ সম্পর্কে নেগেটিভিটি ঢুকাতে। কিন্তু সে নিজেই বাজে ভাবে ফেঁসে যায়
____________________
–শুনো জয়,, আজ আমার আর জাভিয়ানের রেজিষ্ট্রি পেপারের নিচে প্রপার্টির পেপারস রেখে দিবে। তালুকদার প্রপার্টির ৬০% জাভিয়ানের নামে লিখে দিয়েছে আরসাল তালুকদার। বোকা শায়লা তালুকদার আমায় নিজেই সব বলেছিলো। জাভিয়ানের নামের সম্পত্তি পেলেই আমাদের বাকি জীবন চলে যাবে। বিয়ের তৃতীয় দিন জাভিয়ানের সাথে আমাদের বাসায় যাবো,,সেদিন রাতে আমি আর তুমি পালিয়ে যাবো। তার পরের দিনই আমরা বিয়ে করে নিবো। আমার ভয় করছে জয়,,বাবুর কথা( নিজের পেটে হাত রেখে বলে) জানাজানি হয়ে গেলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বউ সাজে বসে থাকা প্রিয় ভাতিজির মুখে মারাত্মক প্ল্যান শুনে মিসেস তালুকদারের হাতে পায়ে কাঁপন ধরে যায়। হাতে ধরে রাখা খাবারের প্লেটটা পরে যায় মেঝেতেই। হুট করে কিছু পরার শব্দে সোহা পেছন ঘুরে তাকালে দেখতে পায় তার হবু শ্বাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সোহা ঘাবড়ে যায়। ফোন কেটে তড়িঘড়ি করে মিসেস তালুকদারের সামনে এসে দাড়ালে মিসেস তালুকদার দিকবিদিক ভুলে তাকে একটা থাপ্পড় লাগায়। সোহার বাহু ধরে তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে–
— এতো খারাপ মেয়ে তুই? আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এমন প্ল্যান করেছিস? ছিঃ আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে তোর জন্য আমি হানিয়ার মতো মেয়েকে এতো কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আর না,,আমি এখনি বাহিরে গিয়ে সবাইকে সব সত্যি জানাবো। আর এই বিয়েও আমি ভেঙে দিলাম।
কথাটা বলে মিসেস তালুকদার রুমটা থেকে বেরহতে যাবেন তখনই তার মাথায় একটা ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে সোহা। মিসেস তালুকদার “আহ” শব্দ করে মাথার ব্যথায় শরীর ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। সোহা তাকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জয়কে ফোন করে। মিসেস তালুকদারের জেনে যাওয়ার বিষয়টা জানালে জয় বলে সে আসছে,,ততক্ষণে মিসেস তালুকদারের মুখ-হাত-পা বেঁধে দিতে বলে। সোহা তার কথানুযায়ী কাজটা করে। কিছুক্ষন পর জয় আরো দু’জন ছেলে এসে মিসেস তালুকদারকে নিয়ে সেন্টারের পেছনের দিকে চলে যায়। আপাতত কয়েকদিন তাঁকে লুকিয়ে রাখবে,,তারপর সব সম্পত্তি নিজেদের নামে পাওয়ার পর ভেবে দেখা যাবে তার বিষয়টা এমনটাই জয় আর সোহা প্ল্যান করে।
শব্দসংখ্যা~২৩০৩
চলবে?