#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#Season_2
#পর্ব_১২
হানিয়ার ঘুম ভাঙে দুপুরে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই বালিশের পাশ হাতড়ায় ফোনে খুঁজতে। বালিশের নিচে পেয়েও যায়। স্ক্রিন অন করলে দেখতে পায় দুপুর একটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। নাহ এখন উঠে ফ্রেশ না হলে নামাজ কাজা হয়ে যাবে তাদের। বিকেলে আবার শ্বশুর বাড়িও ফিরতে হবে। হানিয়া ফোনটা আগের জায়গায় রেখে বুকের উপর বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকায় জাভিয়ানের দিকে নজর দেয়।
জাভিয়ানের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে তার অন্তকর্ণে চিনচিনের ব্যথা শুরু হয়। কি দরকার ছিলো কাল ওমন পাগলামি করার? কষ্টটা এখন হচ্ছে কার? হানিয়া নিজের মাথা একটু উঠিয়ে জাভিয়ানের চুলের উপর আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তারপর আবার আগের জায়গায় মাথায় দিয়ে জাভিয়ানের চুল গুলোয় আলতো হাতে বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
—জাভিয়ান,,উঠুন। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়তে হবে না?
কানের কাছে মিহি স্বরে কারো ডাকাডাকিতে জাভিয়ানের ঘুমটা ছুটে যায়। চোখ মেলে নিজের অবস্থান কোথায় সেটা বুঝতে পেরে জাভিয়ানের মুখে হাসি ফুটে। হানিয়ার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। সেই অবস্থাতেই বলে–
—কয়টা বাজে?
—দু’টো বাজতে চললো। উঠুন এবার। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে খেতে হবে। বিকেলে আবার ওবাড়ি যেতে হবে,, ভুলে গেছেন?
—নাহ ভুলি নি। কিন্তু উঠতেও মন চাচ্ছে না। আরেকটু থাকি না এভাবে।
— আজ্ঞে না। আলসেমিতে ধরে গেছে আপনার। দেখি উঠুন তো।
হানিয়া ঠেলেঠুলে জাভিয়ানকে শোয়া থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসে। চুল গুলো হাত খোঁপা করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কাবার্ড থেকে জাভিয়ানের কাপড় বের করে সেগুলো ওয়াশরুমে রেখে ফিরে আসে জাভিয়ানের কাছে। জাভিয়ানের পোড়া হাতটায় একটা পলিথিন পেঁচিয়ে দিয়ে টি-শার্ট খুলে তাঁকে নিয়ে যায় ওয়াশরুমে। জাভিয়ানকে শাওয়ার নিতে সাহায্য করে সে।
শাওয়ার শেষ হলে জাভিয়ানকে রুমে এনে শরীর,,চুল মুছিয়ে দিয়ে সুন্দর করে পরিপাটি করে দেয়। নিজে শাওয়ারে ঢোকার আগে জাভিয়ানের কপালে আদর দিয়ে বলে–
— আপনি নামাজ পড়ে ফেলুন। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে হানিয়া চলে যেতে নিলে জাভিয়ান তার হাত ধরে আটকে দেয়। হানিয়া পেছন ফিরে তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালে,, জাভিয়ান খানিকটা আদেশের স্বরেই বলে–
—তুমি শাওয়ার নিয়ে আসো তাড়াতাড়ি করে। একসাথে পড়বো।
জাভিয়ানের কথার উপর হানিয়া আর কোন কথা বলতে পারে না। সে চলে যায় শাওয়ার নিতে। যত তাড়াতাড়ি করা যায় তত তাড়াতাড়ি করে শাওয়ার শেষ করে হানিয়া। তারপর দু’জন একসাথে নামাজ পড়ে নিচে নেমে আসে। দেখে সকলের লাঞ্চ করা শেষ শুধু তারা দু’জন আর স্পর্শ বসে আছে। আবরার একটার দিকে অফিসে চলে গিয়েছে।
তারা তিনজন একসাথে লাঞ্চ করে নেয়। আসরের নামাজের পর তারা রওনা হয় তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্য। হানিয়ারা আসার সময় আশিয়ানের সে কি কান্না। এতদিন পর বড় মাম্মামকে পেয়েছে,, আবার চলে যাচ্ছে। তার সেই কান্না থামানোর সাধ্যি কার। শেষে না পারতে তাঁকেও সাথে নিয়ে নেয় হানিয়া জাভিয়ান। বলা হয় আবরার অফিস থেকে ফেরার সময় তালুকদার বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে আসবে।
________________________
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর হানিয়া পুনরায় শ্বশুর বাড়িতে পা দিলো। একদিন সীমাহীন কষ্ট আর ভঙ্গন হৃদয় নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে ছিলো,,ভেবেছিলো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বোধহয় তার ফেরা হবে না তার এই সংসারে। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য অন্যকিছু লিখে রেখেছিলো। যেই বাড়িতে একদিন সে অবহেলায় আর দুঃখ নিয়ে বেঁচে ছিলো আজ সেখানে তাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। এজন্যই হয়ত বলা হয়,, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
রোজি বেগম আদিব সাহেবের সাথেই থাকেন। বুড়াবুড়ির ছোট্ট সংসার। তারা তালুকদার বাড়ির থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। আজ হানিয়া আসবে বলে তারা দু’জনও এসেছে এ বাড়িতে।
হানিয়ারা তালুকদার বাড়িতে এসে পৌঁছায় বিকেল পাঁচটায়। গাড়ি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে হানিয়া গাড়িতে বসেই দেখতে পায় মি. এন্ড মিসেস তালুকদার,, রোজি বেগম আর আদিব মাহবুব এবং কুলসুম সদর দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের মুখে একটা পবিত্র মিষ্টি হাসি। গাড়ি থামলে তারা তিনজনই বের হয়ে আসে। কুলসুম আর রোজি বেগম এগিয়ে এসে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে। আশিয়ান লাফ মেরে ছোট নানা ভাই মানে আদিব সাহেবের কোলে উঠে পরে। টুকটাক কথা বলে তারা সকলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
হানিয়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে যায়। তার সেই ফেলে যাওয়া সংসারে একটা বস্তুও এদিক সেদিক হয় নি। সে যেমন রেখে গিয়েছিলো একদম তেমনই আছে। মনে হচ্ছে এই বাড়িতে সময়টা থেমে গিয়েছিলো যার কারণে কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি।
বড়রা সোফায় বসে কথা বলছিলো তখনই আদিব সাহেবের চোখ পরে জাভিয়ানের ব্যান্ডেজ করা বাম হাতটার দিকে। সে চমকে যায় পুরো হাতটা এভাবে ব্যান্ডেজ করা দেখে। সে জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে–
—জাভিয়ান তোমার হাতে কি হয়েছে বাবা? এভাবে পুরো হাত ব্যান্ডেজ করা কেনো?
আদিব সাহেবের কথায় সকলের নজর পরে জাভিয়ানের দিকে। জাভিয়ানের মা-ফুফু তো তার হাতের এমন অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে যায়। জাভিয়ান কি বলবে ভেবে না পেয়ে অসহায় চোখে হানিয়ার দিকে তাকালে হানিয়া মুখ ভেঙচি দিয়ে কুলসুমের সাথে অন্যদিকে চলে যায়। জাভিয়ান পরে যায় ফ্যাসাদে। বলবে না বলবে না করে জাভিয়ান শেষে না পেরে বলেই দেয় তার হাতে কি হয়েছে। তারপর তাঁকে বকা খাওয়া থেকে থামায় কে। মি. তালুকদার ভীষণ রেগে যায় তার এমন কান্ডে। মিসেস তালুকদার কথা বলতে না পারলেও যতটুকু পারেন তাতেই কতক্ষণ বকাবকি করে কাঁদতে শুরু করে দেন।
রোজি বেগমও বাদ যান না। জাভিয়ান তিনজনের বকা খেয়ে অসহায় ফিল করলে আদিব মাহবুবের দিকে করুণ চাহনি নিয়ে তাকায়। মানে বুঝায়– আঙ্কেল আমায় বাঁচাও।আদিব সাহেব তার মনের কথা যেন বুঝে যান। সে তাঁদের তিনজনকে থামিয়ে দিয়ে জাভিয়ানকে পাঠিয়ে দেয় উপরে ফ্রেশ হওয়ার বাহানায়। জাভিয়ান তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে কেটে পরে।
নিজেদের রুমে আসার পর দেখে রুম খালি,, হানিয়া রুমে নেই। অথচ নিচ থেকে সে শুনে এসেছে হানিয়া রুমে এসেছে। বউকে খুঁজতে খুঁজতে জাভিয়ান তাদের রুফটপে এসে পরলে সেখান পায় তার প্রিয় রমনীকে। রুফটপের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরন্ত বিকেল দেখছে। মাথায় ঘোমটা দেওয়া থাকলেও সেটা কখন যে হানিয়ার অজান্তে পরে গিয়েছে হানিয়া খেয়ালই নেই। চোখে এক আলাদা মুগ্ধতা নিয়ে হানিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁঠ নাড়িয়ে কিছু একটা বলছে আবার হাসছে।
জাভিয়ান বিড়াল পায়ে হেঁটে হানিয়া পেছনে গিয়ে উপস্থিত হয়। এমন দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায় যে হানিয়ার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো সে শুনতে পায়। হানিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে–
—আলহামদুলিল্লাহ,,সকল প্রশংসা আপনার রাব্বুল আলামিন। একদিন যেই বাড়ি থেকে অবহেলা আর কষ্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলাম আজ সেখানে আমার ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। আলহামদুলিল্লাহ,, জাভিয়ানের মতো একজনকে আমায় অর্ধাঙ্গ হিসেবে দেওয়ার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ,, আমার কষ্ট শেষে এতো সুখ দেওয়ার জন্য। আমার সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
কথাগুলো বলতে বলতে হানিয়ার অজান্তেই তার চোখের কোন বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। এ যে অসম্ভব সুখী হওয়ার প্রমাণ তা তার ঠোঁটের কোনের মিষ্টি হাসিই বলে দিচ্ছে। জাভিয়ান এগিয়ে এসে আলতো করে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে। হুট করে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে হানিয়া হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীতে ব্যক্তিটির স্পর্শ চিনতে পেরে নদীর পানির মতো শান্ত হয়ে যায়। নিজের শরীরের অর্ধেকভার ব্যক্তিটির উপর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
জাভিয়ান হানিয়ার কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে–
—আলহামদুলিল্লাহ,, আমায় এই রমনীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে দেওয়ার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ,, এই পাপীর উপর অসীম রহম করে তার জীবনের সুখকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ,, আমায় এত সুখী করার জন্য। আমার সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
কথাটা শেষ করে জাভিয়ান হানিয়ার কপালের একপাশে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তারপর মাগরিবের আজান পর্যন্ত তারা ঐভাবে ঐখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করে। এই সূর্যাস্তের সাথে সাথে যেন তাদের জীবনের সকল দুঃখ কষ্টও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
____________________
আজ রাতের খাবার হানিয়া নিজের হাতে বানিয়েছে। তাকে সাহায্য করেছে কুলসুম। রোজি বেগম করতে চেয়েছিলো কিন্তু হানিয়া তাঁকে করতে দেয় নি। আগের মতো কি আর বয়স আছে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করার। রাতে সকলে একসাথে খাবার খায়। এর মধ্যে আবরার এসে আশিয়ানকে নিয়ে যায়। আশিয়ান তো যাওয়ার সময় হানিয়াকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেক দফা কান্না কাটি করে। আবরার অনেক কষ্টে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিয়ে যায়। রোজি বেগম’রা আজ তালুকদার বাড়িতে থেকে গিয়েছেন।
রুমে এসে দেখে জাভিয়ান কাউচের উপর বসে একহাত দিয়েই ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। কাল দু’জনেরই অফিস আছে। জাভিয়ান অফিসেরই কিছু একটা করছে। হানিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে জাভিয়ানও তার কাজের সমাপ্তি দেয়। দরজা লক করে লাইট নিভিয়ে বেডের দিকে পা বাড়ায়। জাভিয়ান বেডের দিকে আসছে দেখে হানিয়া তার দুই হাত মেলে দিয়ে তাঁকে নিজের কাছে আসার আহ্বান করে বলে–
—আসুন।
জাভিয়ান যেন এমনই এক আহ্বানের অপেক্ষায় ছিলো। চপল পায়ে হেঁটে এসে হানিয়ার বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে পরে৷ হানিয়াও দুইহাতে প্রাণপ্রিয় স্বামীকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে একে অপরকে অনুভব করে।তারপর হানিয়া বলে–
—আমার কলিগরা হয়ত আমার জন্য টেনশন করছে। কারো ফোন নাম্বারও মুখস্থ নেই যে ফোন দিয়ে সবটা জানাবো।
জাভিয়ান আগের অবস্থায় থেকেই বলে–
—যেই হোটেলে উঠেছিলে সেই হোটেলের নাম জানলে সেখানে গিয়ে দেখা করে আসলেই তারা এত টেনশন করত না। কি সেটাও নাকি জানো না।
—জানবো কিভাবে। যেটায় চেক-ইন করার কথা ছিলো সেটায় তো যেতেই পারলাম না। লাগেজ গুলো ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে ট্রেনিংয়ে চলে গিয়েছিলাম। আর বিকেলে তো আপনিই চিলের মতো ছো দিয়ে নিয়ে আসলেন। খারাপ লোক কোথাকার।
জাভিয়ান হানিয়া গলা ও বুকের মাঝ বরাবর জায়গাটায় আলতো আলতো করে কামড় দিয়ে বলে–
—যা করেছি বেশ করেছি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমায় যদি এর চেয়েও বেশি খারাপ হতে হয় তাহলে আমি করবো। আমার অনেক কষ্টের ফল তুমি। এত সহজে ছাড়ছি না।
হানিয়া চোখ বন্ধ করে জাভিয়ানের চুলগুলো খামচে ধরে বলে–
—ছেড়েন না। এবার ছাড়লে আর পাবেন না কিন্তু।
________________
বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠে হানিয়া সকলের জন্য ব্রেকফাস্ট বানায়। বেশ প্রফুল্লতার সাথেই সে কাজ গুলো করছে। ব্রেকফাস্ট শেষ করে তারা দু’জনই একসাথে বের হয়। জাভিয়ান হানিয়াকে তার ট্রেনিংয়ের জায়গায় ড্রপ করে তারপর নিজের অফিসে যাবে।
হানিয়া তার ট্রেনিংয়ে আসলে তার কলিগরা সকলে তাঁকে জেঁকে ধরে। একেকজন তাঁকে প্রশ্ন করে করে মাথায় খেয়ে ফেলছে। সে শুধু একটা কথাই বলে–
—আমি যেখানে ছিলাম ভালো ছিলাম। আমার কোন ক্ষতি করা হয়নি।
সকলে হাফ ছেড়ে বাঁচে। সকলে ট্রেনিং সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলে হানিয়া তাঁদের থামিয়ে দেয়। সে বলে–
—আমার লাইফের একজন ইমপোর্টেন্ট ব্যক্তির সাথে তোমাদের দেখা করাবো। একটু দাঁড়াও।
সকলে তার কথা মতে দাড়িয়ে যায়। জাভিয়ান হানিয়াকে ড্রপ করে চলে যেতে চাইলে হানিয়া জেদ ধরে সে তার কলিগদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। জাভিয়ান মেনে নেয় তার কথা। তারা যখন গাড়ি থেকে বের হয় তখনই রাশেদ জাভিয়ানকে ফোন করে। অফিসের কোন ফাইল নাকি পাওয়া যাচ্ছে না এটা নিয়ে কথা বলার জন্য জাভিয়ান হানিয়াকে এগোতে বলে,, সে কথা শেষ করে আসছে।হানিয়া তাই করে।
জাভিয়ান কথা শেষ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেনিং সেন্টারের দিকে আসে। কয়েক কদম হেঁটে আসার পর একটা দৃশ্য দেখে জাভিয়ানের হাঁটা থেমে যায়। নিমিষেই তার চোখ লাল হতে শুরু করে,,কপালের পাশের রগগুলো ফুলে উঠে। কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে। জাভিয়ান স্পষ্টত দেখতে পায় একজন পুরুষ হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হানিয়া তাকে নিজের থেকে সরানোর জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। জাভিয়ান লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁদের কাছে এগিয়ে গিয়ে ঝট করে লোক টিকে হানিয়ার থেকে দূরে সরিয়ে এনে তার মুখে একটা পাঞ্চ করে। আকস্মিক আক্রমণে লোকটা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। জাভিয়ান তৎক্ষনাৎ হানিয়ার ডান হাত টেনে ধরে নিজের বুকে নিয়ে আসে।
লোকটি জাভিয়ানকে না দেখেই পুনরায় হানিয়ার কাছে আসতে গেলে জাভিয়ান আরো একটা পাঞ্চ করে। এবার লোকটি নিচেই পরে যায়। জাভিয়ান তার বুকে পাড়া দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে–
—কু**ত্তার বাচ্চা তোর সাহস কি করে হয় আমার বউকে জড়িয়ে ধরার। প্রাণে মায়া নেই বুঝি?
ঘটনা গুলো এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যায় যে হানিয়া আর বাকিরা বুঝে উঠার আগেই সবটা ঘটে যায়। তারা সকলে হতভম্ব হয়ে ঘটা প্রত্যক্ষ করতে থাকে।
শব্দসংখ্যা~১৭৩০
~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#Season_2
#পর্ব_১৩
[পর্বটা রোমান্টিক।যাদের রোমান্টিকতা ভালো লাগে না,, প্লিজ স্কিপ করবেন। ]
হানিয়া জাভিয়ানের বুক থেকেই নিচে পরে থাকা রাহাতের দিকে তাকায়। জাভিয়ান রাহাতের বুকে পাড়া দিয়ে থেমে থাকেনি,, পা দিয়ে রাহাতের বুকটা পিষে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় রাহাত আর্তনাদ করে উঠছে। হানিয়ার অন্যান্য কলিগরা জাভিয়ানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
হানিয়া অস্থির হয়ে জাভিয়ানকে বলে–
—জাভিয়ান কি করছেন? উনাকে ছাড়ুন।
জাভিয়ান এতোটাই রেগে গিয়েছে যে ফসফস আওয়াজ বের হচ্ছে। জাভিয়ান হানিয়ার কথা শুনে আরো জোরে রাহাতের বুকে পা দিয়ে চাপ দেয়। রাহাত ব্যথায় চিৎকার করে উঠে। রাহাতের এমন চিৎকারে উপস্থিত সকলের ধ্যান ভাঙে। সোহাগ আর আরেকজন ছেলে তাড়াতাড়ি করে রাহাতের কাছে আসে। হানিয়াও জাভিয়ানকে টেনে রাহাতের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়। জাভিয়ান হানিয়াকে সরিয়ে রাহাতের কাছে যেতে চাইলে হানিয়া তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
—জাভিয়ান শান্ত হোন। প্লিজ এমন করবেন না। আমার কথাটা শুনুন।
জাভিয়ান আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে। সে জোর করে হানিয়াকে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় তারপর রাহাতের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়৷ কিন্তু হানিয়া ব্যথাসূচক শব্দ শুনে থেমে যায়। জাভিয়ান পেছন ফিরে দেখে হানিয়া নিচে পরে আছে আর গত পরশু যেই হাত পুড়ে ছিলো সেই হাতটা অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। ব্যথায় মুখ চোখ কুঁচকে গিয়েছে।
জাভিয়ানের রাগ পরে যায়। সেখানে ঠায় নেয় কষ্ট,, স্তব্ধতা। হানিয়াকে সে আবার কষ্ট দিলো। জাভিয়ান হানিয়ার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। হানিয়ার ব্যথা হাতটা নিজের কাছে এনে দেখতে থাকে। হানিয়ারও বাম হাত পুড়ে গিয়েছিলো সেদিন,, জাভিয়ান হানিয়াকে জোড় খাটিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় হানিয়া টাল সামলাতে না পেরে পরে যায়। আর পরে গিয়ে আগে বাম হাত টাতেই ব্যথা পেয়েছে। হাতটা লাল হয়ে গেছে।
জাভিয়ান অস্থির হয়ে হানিয়াকে বলে–
—হানি বেশি ব্যথা পেয়েছো? আই এম সরি জান। আমি আবার তোমায় ব্যথা দিয়ে দিলাম।
লাস্টের কথাটা ভীষণ করুণ গলায় বলে জাভিয়ান। হানিয়া বুঝে যায় জাভিয়ান আপাতত শান্ত হয়ে গেছে। সে জাভিয়ানের হাত ধরে বলে–
—বেশি ব্যথা পায় নি। আপনি একটু শান্ত হোন। আমার কথাটা শুনুন। কাল আপনি আমায় প্রমিজ করেছিলেন আমার কথা শুনবেন,, সেই কথা রাখছেন না কিন্তু।
জাভিয়ান হানিয়ার কথা শুনে ফস করে একটা শ্বাস ফেলে৷ তাদের এই চিল্লাপাল্লার জন্য ট্রেনার আর গার্ডরাও এসে পরেছে৷ হানিয়া তাড়াতাড়ি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সকলের কাছে ক্ষমা চায় অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার জন্য। আর বলে কিছুক্ষণের মধ্যে তার টিমমেটরা সহ সে ট্রেনিংয়ে উপস্থিত হচ্ছে। হানিয়া সকলকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের ভেতর প্রবেশ করে এবং ক্যান্টিনে চলে যায়। সোহাগ আর আরেকজন ছেলে রাহাতকে ধরে ধরে তাদের সাথে নিয়ে যায়।
হানিয়া একজন স্টাফকে দিয়ে ডাক্তার ডাকায়। তারপর হানিয়া জাভিয়ানের হাত ধরে সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে–
—তোমাদেরকে আলাদা করে সরি বলছি গাইজ। এই পাগল লোকটা(জাভিয়ানকে দেখিয়ে বলে) আমার বেলায় একটু বেশিই পাগলামি করে। (রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে) রাহাত ভাইয়া আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ফর দিস ইন্সিডেন্ট।
রাহাত বুঁজে আসা চোখ নিয়ে হানিয়ার দিকে তাকায়। হানিয়ার হাতের মাঝে জাভিয়ানের হাত দেখে তার পুরো শরীর যেন বিষ ব্যথায় জ্বলে উঠে। সে হানিয়ার মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পায় হানিয়া কতটা হ্যাপি জাভিয়ানকে ফিরে পেয়ে। রাহাত শুনতে পায় হানিয়া বলছে–
—গাইজ তোমাদের বলেছিলাম না আমার লাইফের একজন ইমপোর্টেন্ট ব্যক্তির সাথে তোমাদের পরিচয় করাবো। ইনিই সে। আমার হাসবেন্ড জাভিয়ান তালুকদার।
বেশ হাসি মুখ ও প্রফুল্লচিত্তে কথাগুলো বলে হানিয়া। সকলে অবাক হয়ে যায় এই দুই দিনের মধ্যে হানিয়ার বিয়ে করা নিয়ে। সকলের অবাক মুখ দেখে হানিয়া বুঝে যায় তারা বিষয়টা বুঝতে পারে নি। একে তো,, হানিয়ার কিডন্যাপ হয়েছিলো। দুইয়ে, তার হাসবেন্ড। হানিয়া জাভিয়ানকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে পরে। এর মধ্যে সোহাগ তো প্রশ্নই করে ফেলে–
—তুমি কিডন্যাপ হয়েছিলে নাকি বিয়ে করতে এমনটা করেছিলে?
হানিয়া হেসে ফেলে তার কথা শুনে। হানিয়া তখনও জাভিয়ানের বাহু ধরে রেখেছে৷ হানিয়া সকলের কৌতূহল আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলে–
—বিয়ে তো আমার সাড়ে পাঁচ বছর আগেই হয়ে গিয়েছে সোহাগ ভাই।
সকলে আরো একদফা অবাক হয়ে যায়। তাদের কেউ এতদিন হানিয়ার বিয়ের কথা জানত না। বিয়ে সংসার নিয়ে কথা উঠলে হানিয়া হয় এভয়েড করত নাহয় জায়গা ছেড়ে চলে যেতো কোন একটা বাহানায়। তারা ভেবেছিলো হানিয়া হয়ত কোন বড়সড় ছ্যাকাট্যাকা খেয়েছে যার কারণে এই টপিকে কথা উঠলে সে এমনটা করত। কিন্তু হানিয়ার যে এমন একটা পাস্ট আছে তারা ভাবতেও পরে নি।
হানিয়ার এক কলিগ শান্তা সে বলে–
—তাহলে এতদিন যে আমরা জেনে এসেছি তুমি সিঙ্গেল। এটা কি তাহলে ভুল?
—আমি নিজেও জানতাম আমি সিঙ্গেল। এখানে এসে জেনেছি আমি সিঙ্গেল না বরং এই পাগলের বউ।
সবার মাথায় যেন আরো প্যাচ লেগে যায়। হানিয়া তাদের জ্বালাতে এই কথাগুলো বলছে। জাভিয়ান তার দুষ্টুমি বুঝে যায়। সে শান্ত ও গম্ভীর গলায় বলে–
—স্টপ ইরেটেটিং দেম হানি। তারা কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা খুলে বলো তাঁদের।
কিছুক্ষণ আগে আর এখনকার শান্ত জাভিয়ানের মধ্যে বিস্তর তফাত। সকলে অবাক চোখে একবার হানিয়ার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার জাভিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। হানিয়া জাভিয়ানের আদেশ মতো বলতে শুরু করে–
—আচ্ছা অনেক মজা হয়েছে। এখন ঘটনা বলি। সাড়ে পাঁচ বছর আগে আমার আর জাভিয়ানের বিয়ে হয়। কিছু ঘটনার কারণে আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়,,আমি অভিমান করে তাঁকে আর আমার পরিবারকে ছেড়ে চলে যাই অজানায়। সকলকে ছেড়ে এসে আমি যখন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় রাস্তায় হাঁটছিলাম তখন আমার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়। (এক্সিডেন্টের কথা শুনে জাভিয়ান নিজের ঘাবড়ে যায়,,হানিয়ার ধরে রাখা হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে সে।) আমার এক্সিডেন্টটা রাহাত ভাইয়াদের গাড়ির সাথে হয়েছিলো। তারা আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলো। তারা আমায় হসপিটালে নিয়ে যায়। গুরুতর না হওয়ায় কিছুক্ষণ পরেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তারা আমার এমন উদ্ভ্রান্তের মতো চলার কারণ জানতে চায়,,আমার থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় তারা জাভিয়ানকে ফোন দিতে চায়। তখন আমি তাদের আমার দূরাবস্থার কথা জানাই এবং এ-ও বলি আমি আর জাভিয়ানের সাথে সংসার করতে চাই না। মিসেস চৌধুরী মানে রাহাত ভাইয়ার মা সবটা শুনে আমার পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে। তারাও সেদিন একেবারের জন্য চট্টগ্রামে শিফট করছিলো। আন্টিরা আমায় সেদিন তাদের সাথে নিয়ে যায়। তারপর তারাই আমায় বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে আমায় এই পর্যন্ত আসার জন্য। আর সেদিন আমায় জাভিয়ানই কিডন্যাপ করেছিলো। ভাগ্যিস করেছিলো। নাহয় আমি বাকি জীবনটাও হয়ত ভুলের মধ্যে থেকে যেতাম।
কথাটা শেষ করে হানিয়া জোরে একটা শ্বাস ফেলে। উপস্থিত সকলে হা হয়ে যায় হানিয়ার জীবন কাহিনি শুনে। তারা জানত হানিয়া এতিম আর রাহাতরা হানিয়ার একমাত্র আত্মীয়। তারা আগে দুই একবার রাহাতের সাথে দেখা করেছে। আজ জানতে পারল এসবের কিছুই না। হানিয়ার নিজেরই দু’টো পরিবার আছে।
হানিয়া কলিগরা সকলেই বেশ ফ্রি মাইন্ডের। সে সকলকে পরিচয় করিয়ে দেয় জাভিয়ানের সাথে। জাভিয়ান হাসিমুখে তাদের সাথে পরিচিত হয় এবং কিছুক্ষণ আগের ঘটনার জন্য সেও মাফ চায়। ডাক্তার এসে রাহাতকে চিকিৎসা দেয়। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে হানিয়া সকলকে চলে যেতে বলে এবং সে একটু পরে আসছে বলে দেয়। তারা হানিয়ার কথা মতো চলে যায়।
হানিয়া রাহাতের সামনে এসে বিনয়ী ভাবে বলে–
—দুঃখিত ভাইয়া এতদিন আপনাদের চিন্তায় রাখার জন্য। আসলে আপনাদের জানানোর কথাটা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। আর এই লোকটা আমায় যখন কিডন্যাপ করে তখন আমার ফোন-পার্সও গাড়িতে ছিলো।
রাহাত নিশ্চুপ হয়ে হানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের উজ্জ্বল ভাবটাই বলে দিচ্ছে সে জাভিয়ানের সাথে কতটা গভীরভাবে জড়িয়ে পরেছে। রাহাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক ভাবে বলে–
—তুমি খুশি তো জাভিয়ানের সাথে হানিয়া?
হানিয়া একবার জাভিয়ানের দিকে তাকায়। তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে বলে–
—ভীষণ খুশি এবং সুখী আমি উনার সাথে ভাইয়া। তার মধ্যে আমার সব সুখ নিহিত।
হানিয়ার প্রশ্নের একজনের বুকে সুখের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে তো আরেকজনের বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রাহাত তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে চাইলে বুকের ব্যথায় আবার ধপ করে বসে পরে। হানিয়া বিচলিত হয়ে বলে–
—ভাইয়া উঠবেন না। আরো কিছুক্ষণ রেস্ট করুন। আমাদের বাসায় চলুন,,জাভিয়ান উনাকে বাসায় নিয়ে যান। (জাভিয়ানের দিকে ফিরে বলে)
—না হানিয়া,,আমায় এখন উঠতে হবে। চট্টগ্রাম রওনা হতে হবে। কাল অফিস থেকে ফিরে তোমার নিখোজের কথা শুনেই রওনা হয়েছিলাম। ভোররাতে এসে পৌছেছি। অফিসের অনেক কাজের চাপ। অন্য একদিন যাবো না হয়।
—এই শরীর নিয়ে যেতে পারবেন? আজকের দিনটা না হয়…
—চিন্তা করো না। ড্রাইভার আছে আমার সাথে।
—আচ্ছা। বাসায় পৌঁছে ফোন দিয়ে আমায় জানাবেন পৌঁছানোর কথা। আর আন্টিকে বিষয়টা একটু খুলে বলেন। নিশ্চয়ই ভীষণ চিন্তা করছেন উনি।
—হ্যা। কাল দেখে এসেছিলাম কান্না করছে।
—ইশশ আমার জন্য আপনাদের সবসময় ঝামেলায় পরতে হয়।
হানিয়া মন খারাপ নিয়ে কথাটা বলে। রাহাত আর জাভিয়ান দু’জনের কারো কাছে হানিয়ার মলিন মুখটা ভালো লাগে না। রাহাত হানিয়ার মন খারাপ দূর করার জন্য বলে–
—মন খারাপ করে না সুন্দরী। তুমি যখন মন খারাপ করে মুখ কালো করে রাখো তখন তোমায় একদম পেচার মতো লাগে।
রাহাত হানিয়াকে সুন্দরী বলে সম্বোধন করায় জাভিয়ানের মাথা আবার জ্বলে উঠে। রাহাতকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য জাভিয়ান বলে–
—হানি তোমার লেট হয়ে যাচ্ছে। আমি রাহাতকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি গাড়ি পর্যন্ত।
—আচ্ছা।
জাভিয়ান রাহাতের সামনেই হানিয়ার কপালে নিজের ওষ্ঠের স্পর্শ দেয়। জাভিয়ান এমনটা করায় হানিয়াও থতমত খেয়ে যায় সেই সাথে লজ্জাও পায়। রাহাত বসা থেকে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। জাভিয়ান হানিয়ার গালে হাত রেখে বলে–
—ছুটির পর নিতে আসবো। অপেক্ষা করবে আমার জন্য।
—আমার ছুটি তো পাঁচটা হবে আর আপনার ছয়টায়। আপনার আসা লাগবে না। আমি সবার সাথে চলো যাবো।
জাভিয়ান গম্ভীর গলায় বলে–
—যা বলেছি তাই হবে। এখন আসি। আল্লাহ হাফেজ।
হানিয়া পুরো ক্যান্টিনে একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নেয়। রাহাত হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টিনের দরজা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। ক্যান্টিনে তেমন কেউ না থাকায় সে জাভিয়ানের এক গালে হাত রেখে অপর গালে আদর দিয়ে বলে–
—যেমনটা যাচ্ছেন তেমনটাই যেন আমি ফেরত পাই। নিজের সাথে কোন উল্টা পাল্টা করলে আমি কিন্তু একদম বাপে বাড়ি চলে যাবো।
অনেকটা হুমকির সুরে বলে কথাটা বলে হানিয়া। জাভিয়ান হেঁসে দেয় তার এমন হুমকিতে। নিজেকে ও হানিয়াকে এখন আর পাঁচটা স্বাভাবিক হাসবেন্ড ওয়াইফ মনে হচ্ছে। জাভিয়ান মাথা নেড়ে বলে–
—যথা আজ্ঞা রাণী সাহেবা। এখন আসি।
হানিয়া জাভিয়ানকে বিদায় নিয়ে নিজেও চলে যায়। জাভিয়ান বাহিরে এসে দেখে রাহাত নিজের গাড়িতে উঠছে। জাভিয়ান পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠে। রাহাত থেমে গেলে জাভিয়ান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ চোখ কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলে–
—তোমাদের কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে থাকব। জীবনে কোন সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমায় বলবে। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করবো।
—ধন্যবাদ। আশা করি তার প্রয়োজন পরবে না।
—প্রয়োজন পরবে কিনা সেটা উপরওয়ালাই জানেন। এই সাহায্যকে করুণা মনে করে ভুল করবে না। আমার প্রাণভোমরাকে এতদিন যত্নে রেখেছো এটার প্রতিদান আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দিয়ে যাবো। আর একদিন সময় করে পরিবারের সকলকে নিয়ে এসো। আমাদের ভালো লাগবে।
—আচ্ছা। এখন তাহলে আসি।
—হুম। আরেকটা কথা,, এই জাভিয়ান তালুকদারের ভাবনা খুব কমই ভুল হয়। আমি চাচ্ছি এবার যেন আমার এই ভাবনাটাও ভুল প্রমাণিত হয়। এটা আমাদের সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
রাহাত জাভিয়ানের চোখের দিকে সরাসরি তাকায়। প্রচন্ড হিংস্রতা ভরপুর চোখজোড়া কিন্তু কন্ঠ একদম স্বাভাবিক এবং শান্ত। রাহাত কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে সে গাড়ির সিটে শরীর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকে তার। কতই তো সাধনা করলো তাও ভাগ্য আজ তাকে খালি হাতে ফেরাচ্ছে।
অন্যদিকে জাভিয়ান সেখানে দাড়িয়েই মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরটা দাবানলের মতো পুড়ছে কিন্তু বাহিরটা সম্পূর্ণ শান্ত।
______________________
জাভিয়ান হানিয়া বাসায় পৌছায় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। দু’জনে একসাথে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। হানিয়া জাভিয়ানকে বিছানায় বসিয়ে তার চুল মুছে দিচ্ছে আর জাভিয়ান তাকে বিভিন্ন ভাবে জ্বালাচ্ছে। হানিয়া জাভিয়ানের কথা মতো একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়িটা কোন মতো পেচিয়ে জাভিয়ানকে রেডি করাচ্ছে কিন্তু জাভিয়ান তাকে নানাভাবে খোঁচাচ্ছে।
হানিয়া জাভিয়ানের মাথা মুছিয়ে দেওয়ার জন্য হাতটা উচু করায় তার উন্মুক্ত কোমড় জাভিয়ানের চোখে ধরা পরে। জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে হানিয়ার কোমড়ে একটা চিমটি কাটে। হানিয়া লাফিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। একদম কারেন্টর শকের মতো লেগেছে তার চিমটিটায়। হানিয়া ব্যথা জায়গাটায় হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে–
—এমন দুষ্টুৃমি করছেন কেন আজব তো? এমন করলে কিন্তু নিজের কাজ নিজেই করে নিবেন,,আমাকে ধারে কাছেও পাবেন না।
মনের মধ্যে দুষ্টুমি লুকিয়ে রেখে জাভিয়ান নিষ্পাপ মুখ নিয়ে বলে–
—আচ্ছা আর করবো না। চুপ করে বসে থাকবো। মাথা মুছিয়ে কিছু পরিয়ে দাও। ঠান্ডা লাগছে।
হানিয়া একটা টি-শার্ট এনে তা পাশে রেখে পুনরায় জাভিয়ানকে মুছিয়ে দিতে নেয় তখনই হানিয়ার ফোনটা বেজে উঠে। জাভিয়ান হানিয়ার ফোনটা বেডসাইড টেবিল থেকে উঠিয়ে হাতে নিয়ে দেখে “রাহাত ভাইয়া” নামে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসছে। হানিয়া জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–
—কে কল দিয়েছে?
—রাহাত।
—ওহহ দেন। হয়ত পৌঁছে গিয়েছে এটা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছে।
জাভিয়ান ফোনটা হানিয়াকে দিয়ে দেয়। হানিয়া ফোনটা একহাতে দিয়ে রিসিভ করে কানে লাগায়। মিসেস চৌধুরী ফোন দিয়েছে। হানিয়া ফোনটা কান আর কাধ দিয়ে চেপে ধরে জাভিয়ানকে টি-শার্ট পরিয়ে দেয়। পরানো শেষ হলে হানিয়া জাভিয়ানের সামনে থেকে আসতে চাইলে জাভিয়ান এক হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখে। হানিয়া সেই অবস্থায় দাঁড়িয়েই মিসেস চৌধুরীর সাথে কথা বলতে থাকে।
মিসেস চৌধুরীর সাথে কথা বলা শেষ হলে সে যখন রাহাতের নামটা নেয় জাভিয়ানের ভেতরে নিভে যাওয়া রাগটা আবার জ্বলে উঠে। হুট করে সে হানিয়ার বুকে মুখ গুঁজে কামড়ে ধরে। বেশি জোরে ধরে নি আবার তেমন আস্তেও না। হানিয়া আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে যায়। একহাত দিয়ে জাভিয়ানের চুল খামচে ধরে “আহ” বলে উঠে।
ফোনের অপর পাশে থাকা রাহাত তার এমন ব্যথাসূচক শব্দ শুনে বিচলিত হয়ে পরে। অস্থির কণ্ঠে সুধায়–
—হানিয়া কি হয়েছে তোমার? ব্যথা পেলে নাকি আবার?
ব্যথা তো পেয়েছে কিন্তু সেটায় যে সুখ মিশে আছে সেটা তো সে রাহাতকে বলতে পারবে না। জাভিয়ানও হানিয়ার আর্তনাদ শুনে নিজের দাঁত সরিয়ে নিয়ে জায়গাটায় নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিতে থাকে। জাভিয়ানের স্পর্শ গুলো গভীর হতে শুরু করলে হানিয়াও বেসামাল হয়ে পরতে থাকে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে–
—তেমন কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি রাহাত ভাইয়া।
—তাহলে তখন ওমন আর্তনাদ করলে কেন?
—একটা মশা কামড়ে ধরেছিলো তাই।
হানিয়া জাভিয়ানকে মশা বলায় জাভিয়ানের বোধহয় রাগ হয়। সে হানিয়ার কান থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় কিন্তু হানিয়া ফোনটা সরিয়ে ফেলে। তারপরও উত্যক্ত করায় হানিয়া বিরক্ত হয়ে বলে–
—জাভিয়ান কথা বলছি তো আমি। এমন করছেন কেনো?
রাহাত বুদ্ধিমান ছেলে। সে বুঝে যায় হানিয়ার তখনকার আর্তনাদের কারণ। সে নিজেই বলে–
—আচ্ছা রাখছি। পরে কথা হবে। ভালে থেকো।
—আপনিও ভাইয়া। আল্লাহ হাফেজ।
—আল্লাহ হাফেজ।
রাহাতের শেষ উক্তিটি শুনতে পায় না হানিয়া। তার আগেই জাভিয়ান তার থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে আরো গভীরভাবে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ধপ করে শুইয়ে দেয়। হানিয়া কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠে–
—জাভিয়ান এখন না প্লিজ। দরজা লক করা না।
—এখনই জান প্লিজ।
পাগল জাভিয়ান হানিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না। নিজের ওষ্ঠ দিয়ে আঁকড়ে ধরে হানিয়ার ওষ্ঠ। হানিয়াও একসময় তার সাথে তাল মেলাতে শুরু করে। তারা যখন নিজেদের ভালোবাসায় ব্যস্ত আরেকজন তখন ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। রাহাত জাভিয়ানের পাগলামির সবটাই শুনেছিলো কারণ ফোনটা তখনও কাটে নি। জাভিয়ান-হানিয়ার শেষ উক্তিটি শোনার সাথে সাথে সে ফোন কেটে দূরে ছুঁড়ে মারে। হাঁটু ভেঙে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে সে। জেনে বুঝে সে নিজেকে এমন কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছে।
শব্দসংখ্যা~২২৫০
~চলবে?
[ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স ]