প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-০৪

0
623

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চতুর্থ

তারা বের হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই হানিয়া প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পরে। বলতে গেলে এক প্রকার চিৎকার করে কাঁদছে সে। জাভিয়ানের ফুফুমনি রোজী বেগম তখন সেই রুমের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন,,সে হানিয়ার এমব কান্না শুনে ছুটে তার কাছে আসে। এই বাড়িতে হানিয়ার দুটো সেভ প্লেস আছে। সেগুলো হলো–তার শ্বশুর আর জাভিয়ানের ফুফুমনি। জাভিয়ান তার ফুফুকে ভীষণ ভালোবাসে। আর জাভিয়ানের বাবা এখনো জানেন না তার ছেলে যে নিজের স্ত্রীর সাথে এমন
প//শুর মতো আচরণ করেন। জানবেন কীভাবে আরসাল তালুকদার যে জাভিয়ানের বিয়ের দু’দিন পরই বিজনেসর কাজে উড়াল দিয়েছেন সুদূর বিদেশে। এখনো সেখানেই আছেন।

জাভিয়ানের ফুফুমনি হানিয়াকে ভীষণ আদর করেন। তার কোন সন্তান না থাকায় সে জাভিয়ানকেই নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখেন,,ভালোবাসেন। হানিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। ভদ্রমহিলা তাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে কান্নার কারণ কিন্তু হানিয়া এক মনে কাঁদছে তো কাঁদছেই। মিনিট পাঁচেক পর সে একটু শান্ত হয়। ফুফুমনি তাকে নিচে থেকে উঠানোর জন্য তার ডান হাত ধরলে হানিয়া ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। ফুফুমনি তার হাত ছেড়ে দেয় তাড়াতাড়ি করে আর দেখতে থাকে হাতে কি হয়েছে যার কারণে হানিয়া এমন আর্তনাদ করে উঠলো। ফুফুমনি তার হাত দেখে আঁতকে উঠে। ডান হাতের অনেকটা জায়গা লাল হয়ে আছে। ফোস্কা পরবে ভাব হাত টায়। সে আলতো করে হানিয়াকে নিচের থেকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। তারপর কল ছেড়ে কলের ঠান্ডা পানি দিতে থাকে। পানি দেওয়া শেষ হলে তাকে বের করে নিয়ে এসে কাউচে বসিয়ে দেয় আর বার্নার এনে হানিয়ার হাতে লাগিয়ে দিতে থাকে। হানিয়া তখনও ফুপিয়ে যাচ্ছে। হাতে মলম লাগানো শেষ হলে সে পুনরায় মাতৃস্নেহে আগলে নেয়। হানিয়া তার বুকে মাথা রেখে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলে–

–মনি,,তোমার ছেলে এমন কেন গো? আমাকে কিসের জন্য এতো কষ্ট দিচ্ছেন সে? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। ছোট থেকে বাবার অবহেলা পেয়ে এসেছি,,ভেবেছিলাম বিয়ের পর বরের ভালোবাসা পেয়ে বাবার বাড়ির কথা ভুলে যাবো কিন্তু আমার ভাগ্য দেখো এতোটাই খারাপ যে বরের ভালোবাসা তো দূরের কথা প্রতিনিয়ত তার মা/র,, অবহেলা-অপমান সহ্য করছি। কেন মনি আমার সাথেই এমন হচ্ছে? কীসের জন্য? আমি তো তাকে বিয়ের আগে কখনো দেখিই নি। আমার ভাগ্য এতো খারাপ কেন গো মনি?? জীবনে কি আমি কারো ভালোবাসা পাবো না? কারো প্রিয়জন হতে পারবো না শুধু প্রয়োজনই হয়ে থাকবো? বলো না মনি,, প্লিজ বলো।

হানিয়া এমন আকুতি ভরা কান্নায় ফুফুমনিও কেঁদে দেয়। তার যে কিছুই করার নেই। সে নিজেই থাকে ভাইয়ের সংসারে,,ভাবীও তাকে তেমন পছন্দ করেন না। সেখানে সে কীভাবে হানিয়ার হয়ে কথা বলবে? কীভাবে সে হানিয়াকে সাপোর্ট দেবে?

হানিয়া আর কিছু বলার আগেই দরজার বাহিরে থাকা ব্যক্তিটি চলে যায়। মনি(ফুফুমনিকে শর্ট করে মনি বলছি) তালে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–

–ধৈর্য ধর মা। সব প্রশ্ন,,সব কেন-র তো উত্তর হয় না। শুধু এতটুকুই বলবো সবকিছুর জবাব একদিন তুই পাবি কিন্তু সেটা অন্য কেউ না তোকেই খুজে বের করতে হবে। আর জাভিয়ান,,সে এক হিং//স্র খেলায় মেতে উঠেছে। এই খেলার সমাপ্তি তোকেই করতে হবে। বলে পারবি না এর সমাপ্তি করতে??

হানিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে–

–কীভাবে করবো বলো মনি? তার খেলার যদি সমাপ্তি করতে হয় তাহলে যে আমাকে তার বিরুদ্ধে যেতে হবে,,কিন্তু আমি কীভাবে যাবো তার বিরুদ্ধে?? আমি যে এই অল্প কয়েকদিনই ওই পাথর হৃদয়ের লোকটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। তার বিরুদ্ধে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না মনি।

মনি ঠান্ডা মাথায় বলে–

–তার বিরুদ্ধে যাবি কেন মেয়ে? তাকে তোর মন মতো করে নিলেই তো হয়।

মনির এই কথা শুনে হানিয়ার কান্না থেমে যায়। কি বলছে মনি তাকে? জাভিয়ানকে তার মনের মতো করবে সে?কীভাবে?হানিয়া টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে মনিকে জিজ্ঞেস করে–

–আমার মনের মতো মানে? সেটা কি এই জীবনে আদোও সম্ভব??

–কেন সম্ভব নয়? তুই না ওর বউ? বউয়ের অধিকার নিয়ে একবারও তাকে জিজ্ঞেস করেছিস কেন সে এমন করছে? বা এইসব কাজগুলোর পেছনের উদ্দেশ্য কি?

আসলেই তো,,সে তো একবারও জাভিয়ানকে এইসকল প্রশ্ন করে নি। জাভিয়ান কেনই বা এমন করছে? সে মনিকেই জিজ্ঞেস করে–

–তুমি কিছু জানো মনি সে এমন কেন করছে??

–বেশি কিছু বলতে পারবো না রে মা। শুধু এটাই বলবো,,আজকের এই জাভিয়ান আর আগের জাভিয়ানের মধ্যে রাত-দিনের পার্থক্য। এই তালুকদার বাড়ি আগে এমন নিরবতায় আচ্ছন্ন থাকত না,,এখানে আগে সুখেরা মেলা বসাত। হাসির আওয়াজে দেওয়াল গুলোও সুখের কথা বলতো। কিন্তু একদিন এক ঝড়ে সব সুখ,,সব হাসি কেড়ে নিয়ে যায়। জাভিয়ানকে করে তুলে নিষ্ঠুর,,পাষাণ,, পাথর হৃদয়ের অধিকারী।

হানিয়া অবাক হয়ে শুনছে রোজি বেগমের কথাগুলো। রোজি বেগম পুনরায় বলে–

— মা রে,,আমার জাভিয়ান এমন ছিলো না। এই দুটো হাত দিয়ে ওকে বড় করে তুলেছি আমি। ওর মা আগে থেকে সন্তানদের প্রতি উদাসীন থাকতো। পার্টি-ক্লাব এইসব করেই জাভিয়ানের মায়ের দিন কাটতো। আমি যখন এই বাড়িতে আসলাম তখন জাভিয়ানদের পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে ওর মা আরো হাত-পা ছেড়ে দিলো। আমি ওর প্রতিটা নিঃশ্বাসের খবর রাখি। মা রে তুই আমায় কথা দে,,আমার জাভিয়ানকে তুই আগের মতো করে তুলবি। আগের মতো হাসতে শিখাবি,,,আনন্দ-উৎসবে মাতিয়ে রাখা সেই জাভিয়ানকে ফিরিয়ে দিবি আমায়। কথা দে আমায়।

রোজি বেগম বারবার অনুরোধ করতে থাকে হানিয়ার কাছে। হানিয়ার মনেও একসময় জেদ তৈরি হয়। সে ভাবে সে শুধু শুধু কেন অন্যের খেলার গুটি হবে। না অনেক হয়েছে। সেও বাঁচবে,, মন খুলে আবার হাসবে সাথে জাভিয়ানকেও হাসাবে। সে রোজি বেগমকে কথা দেয়–

–আমি তোমাকে কথা দিলাম মনি,,আমি তোমার আগের জাভিয়ানকে ফিরিয়ে দেবো। সে কেন এমন নিষ্ঠুর খেলা শুরু করেছে এর পেছনের কারণি খুজে বের করবো। সেই সাথে এই বাড়ি কেও আগের মতো প্রানবন্ত করে তুলবো। তুমি শুধু আমায় একটু সাহায্য করো,,নাহলে আমি যে পারবো না।

রোজি বেগম হানিয়ার কথায় ভীষণ খুশি হয়। সে হানিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে বলেন–

–আমাকে তুই সবসময়ই পাশে পাবি ইনশা আল্লাহ।

_____________________

মুন ক্লাব এন্ড বার~~

বারে বসে একের পর এক ওয়াইনের গ্লাস শেষ করছে জাভিয়ান,,তাও তার নেশা হচ্ছে না। কানে শুধু কিছু কথা বারবার বারি খাচ্ছে। এক রমনীর বুক ফাটা আর্তনাদ তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। তার বুকটা ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠছে। মন বলছে,, ওই রমণীর তো কোন দোষ নেই,,শুধু শুধু একজনের দোষের শাস্তি আরেকজনকে দিচ্ছিস কেন জাভিয়ান? কিন্তু মস্তিষ্ক তো তা মানতে নারাজ। সে বলছে,,ওই রমনী মির্জা পরিবারের সদস্য,, এই কারণেই ও শাস্তি গুলো পাচ্ছে। মন-মস্তিস্কের এই যুদ্ধে মস্তিষ্ক বারবার জয়ী হয়ে যাচ্ছে।

পাশে বসে থাকা সোহা এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেও জাভিয়ানের এতো পেগ নেওয়া দেখে আর চুপ থাকতে পারে না। সে জাভিয়ানের হাত ধরে থামিয়ে দেয়। ন্যাকা কন্ঠে বলে–

–জাভিয়ান বেব,,আর নিও না। পরে শরীর খারাপ করবে।

জাভিয়ানের মাত্রই একটু একটু করে নেশা চড়ছিলো এমন সময় তাকে থামিয়ে দেওয়ায় তার মেজাজ আসমানে চড়ে যায়। সে সোহার হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে–

–নিজের চরকায় তেল দাও সোহা। আজেই ফার্স্ট আর আজকেই লাস্ট বারের মতো বলে দিচ্ছি ফিউচারে আমার কোন কাজে বাঁধা দিলে এর পরিণাম কেমন হবে তা হানিয়াকে দেখে বুঝে নাও।

কথাটা বলে আরেক পেগ গিলে নেয়। তারপর এক বোতল ওয়াইন নিয়ে হেলতে দুলতে চলে যায় বারের বাইরে। সোহা আর তার পেছন পেছন যায় না। জাভিয়ানের কথায় ভালোই ভয় পেয়েছে। সে জাভিয়ানের চলে যাওয়া দেখে কয়েক মিনিট থম মেরে বসে থাকে,,তারপর ফোন লাগায় তার বয়ফ্রেন্ডকে। আজ তারা যবরদস্ত একটা পার্টি করবে এটাই তার প্ল্যান।

___________________

জাভিয়ান মাতাল অবস্থাতেই গাড়ি ড্রাইভ করে একটা সুনশান-নিস্তব্ধ জায়গা যায়। সেখানে পৌঁছানোর পর গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ডিকির উপর গিয়ে বসে পরে ম//দের বোতল নিয়ে। বিশাল সেই অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। ভাবতে থাকে কেন সে এতো নিষ্ঠুর হয়ে গেলো? এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে কয়েক ঘন্টার আগের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য।

চোখজোড়া বন্ধ করে মনে করতে থাকে হানিয়ার সেই হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলো। হ্যাঁ,,হানিয়া যখন রোজি বেগমকে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলো তখন জাভিয়ান তা শুনে ফেলে। মূলত সে তার মানিব্যাগ নিতে ভুলে গিয়েছিলো,,বাড়ি থেকে বের হওয়ার একটু পরেই তার মনে পরে সে মানিব্যাগ আনতে ভুলে গিয়েছে। তাই গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে আবার বাসায় এসেছিলো সেটা নিতে। কিন্তু ঘরে প্রবেশের পূর্বেই হানিয়ার ওই কথা আর কান্না দেখে সে আর ভেতরে ঢুকে না। মানিব্যাগ না নিয়েই সেখান থেকেই আবার ফিরে যায়।

সে আসমানের দিকে তাকিয়ে বলে–

–তাকে দেওয়া শাস্তি গুলো যেমন আমার বুকের
আ//গুনকে নেভায় তেমনি ভাবে তার ওই মলিন মুখ,,অশ্রুশিক্ত চোখ আমার বুকে ছু-রি চালায়। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। কথা ছিলো তাকে এবং তার পরিবারকে পুরো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আমার নিজেকে করা অঙ্গীকারের সমাপ্তি করবো। কিন্তু কি থেকে কি হচ্ছে,,কেন হচ্ছে কিচ বুঝতে পারছি না। মনটাও বড্ড বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন,, মস্তিষ্কের উপর দিয়ে কথা বলছে। তাকে আগলে নেওয়ার কথা বলছে,,কিন্তু এটা কি আদোও সম্ভব?

তার এই প্রশ্নের কোন জবাব আসে না। হঠাৎই ধরণী কাঁপিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি। জাভিয়ানের বৃষ্টি একদমই সহ্য হয় না,, অসুস্থ হয়ে পরে সে। তাই সে তাড়াতাড়ি করে গাড়ির ভেতরে চলে আসে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত করে নিজেকে,, তারপর গাড়ি চালাতে শুরু করে বাড়ির উদ্দেশ্য। হানিয়াকে বলে এসেছিলো আজ ফিরবে না বাড়ি,,কিন্তু মন আর বাহিরে টিকছে না। জাভিয়ান বরাবরই মস্তিষ্কের কথা শুনলেও আজ মনের কথা শুনতে বড্ড ইচ্ছে করছে তার। মনের কথা মেনে নিয়েই যাচ্ছে বাড়িতে। মনের এক কোণ থেকে কে যেনো বলছে,,কেউ একজন তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে।

~~চলবে..?