#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ষষ্ঠ
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুই যুবকের দিকে। যাদের মধ্যে একজনের চোখে প্রচন্ড ক্রোধ তো আরেকজনের চোখে তৃপ্তি। যুবকটি নিজের কলার থেকে জাভিয়ানের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে–
–এখানে সাহসের কিছুই নেই,,যা আছে তা হলো অধিকার।
জাভিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে—
–ওর উপর আমার থেকে আপনার অধিকার বেশি এটা বুঝাতে চাচ্ছেন মি.?
যুবকটি একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বলে–
–আমরা দু’জনই সমান অধিকার আছে ওর উপর। কিন্তু আপনার আগে সেই অধিকারের দাবীদার আমি।
জাভিয়ানের মুখ দেখে তাকে প্রচন্ড রাগী মনে হলেও তার বুকের মধ্যে কেন যেনো কালবৈশাখীর ঝড় চলছে। বুকের বা পাশের হৃদপিণ্ড নামক বস্তুটা অস্বাভাবিক ভাবে বিট করছে। শুধু একটা কথাই মন হচ্ছে,, কে এই যুবক যে কিনা আমার আগে ওর উপর দাবীদার?? জাভিয়ান যুবকটিকে প্রশ্ন করে–
–কীভাবে? কে হোন আপনি হানিয়ার?
–আপনার কি মনে হয়,,কে হতে পারি আমি??
যুবকটির এমন হেয়ালি পূর্ণ কথায় জাভিয়ানের রাগ যেনো তরতর করে বাড়ে। সে তাকে ধমক দিয়ে বলে–
–মস্করা করছেন? আপনার সাথে কি আমার সেই সম্পর্ক আছে যেটার জের ধরে মস্করা করবেন?
–আছে তো সেই সম্পর্ক।
জাভিয়ান আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারে না। যুবকটির কলার ছেড়ে তার গালে একটা পাঞ্চ বসাতে যাবে তার আগেই হানিয়া তার হাত ধরে আটকিয়ে দেয়। অল্প চিৎকার করে বলে–
— আরে কি করছেন? ভাইয়াকে মা//রছেন কেন?
জাভিয়ানের পাঞ্চ করা দেখে রোজি বেগম,,জাভিয়ানের মা মিসেস তালুকদারও এগিয়ে আসেন হুড়মুড় করে। রোজি বেগম তাড়াতাড়ি করে বলে–
–কি করছো জাভিয়ান? স্ত্রীর বড় ভাইকে কেউ
মা/রে? ও হানিয়ার ভাই আবরার। তোমাদের বিয়েতে সে ছিলো না বলে তুমি তাকে চিনতে পারছ না।
রোজি বেগমের কথা শুনে জাভিয়ানের রাগটা পরতে পরতেও পরে না। জাভিয়ান আবরারের কলার থেকে হাত সরায় কিন্তু কিছু একটা কারণে এখনো রাগী দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আবরার হেসে বলে–
–বুঝলে কেন আমি হানিয়ার উপর আগে অধিকারের দাবীদার। যাই হোক,,কেমন আছো তোমরা??
জাভিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে–
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
–আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। আর এখন আরো ভালো আছি কারণ নিজ চোখে বোনের সুখটা দেখতে পেলাম যে।
কথাটা বলে আবরার একটা তৃপ্তিময় হাসি দেয়। হানিয়া মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভাবে–
–সুখ.?! সে যে এক অলীক বস্তু আমার জন্য ভাই। তুই জানিস না ভাই,, তোর বোন সুখের অসুখে কতটা অসুস্থ। আদোও আমার এই অসুখ ভালো হবে কি না তাও জানি না।
হানিয়া নিজেকে জাভিয়ানের বাহু থেকে ছাড়িয়ে তার ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলে–
–ভাই ভাবীকে নিয়ে আসলে না?
আবরারের মুখের হাসিটা হালকা কমে যায়। না চাইতেও বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
–তোমার ভাবী ট্র্যাভেল করে এসে একটু অসুস্থ হয়ে পরেছে। আমরা রাজশাহী ফিরে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাবে তোমার সাথে তোমার ভাবী।
তাদের কথা শুনে কেন জাভিয়ান যেনো আরো রেগে যায়। আবরার আরো কিছু বলবে তার আগেই জাভিয়ান হানিয়াকে বলে–
–আমার ভালো লাগছে না,,আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে উপরে আসো।
কথাটা বলে সে গটগটিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। আবরারের সাথে আর একটা বাক্যও ব্যয় করে না। বিষয়টা ভীষণই অপমানজনক লাগে হানিয়ার কাছে। তাও সে স্বামীর টান টেনে বলে–
–আসলে ভাই,,উনার কাল জ্বর এসেছিলো তাই হয়তো ভালো লাগছে না। তুমি বসো না,,আমি তাকে ব্রেকফাস্টটা দিয়ে আসছি।
কথাটা বলে হানিয়া তার ভাইকে হালকা নাস্তা দিয়ে জাভিয়ানের ব্রেকফাস্ট নিয়ে যায়। রোজি বেগম আগেই চলে গিয়েছে,, যখন কিনা সে হানিয়ার মুখে জাভিয়ানের অসুস্থতার কথা শুনেছে তখনই।
সন্তান অসুস্থ হলে স্বাভাবিক ভাবে মায়েরা বেশ চিন্তিত হন। সন্তানকে সুস্থ করে তোলার জন্য বেশ তৎপরও হয়ে উঠেন কিন্তু এক্ষেত্রে জাভিয়ানের মা একদমই ব্যতিক্রম। হানিয়ার কাছ থেকে জাভিয়ানের অসুস্থতার কথা শুনেও তার কোন হেলদোল নেই। সে তার মতো করে আবরারের সাথে আর দুই-একটা টুকটাক কথা বলে নিজের রুমে চলে যায়। সোহা তখনও ড্রয়িংরুমে বসে বসে ফোন চালানোর বাহানায় আঁড়চোখে আবরারকে দেখছে। প্রথম দেখাতেই তথাকথিত ক্রাশ খেয়ে ফেলেছে সে। ক্রাশ খাবেই বা না কেনো? আবরার দেখতেই ক্রাশ খাওয়ার মতো। ছোট ছোট চোখজোড়া চশমার আড়ালে লুকানো,,মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি যা কিনা সুন্দর করে কেটে ছোট করে রাখা আর আবরারের সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা হলো তার হাসি। সদাসর্বদা তার মুখে লেপ্টে আছে একটা মিষ্টি হাসি।
হানিয়ার কাছ থেকে আবরারের বউয়ের কথা শুনে বুঝতে পারে আবরার বিবাহিত। তাও সে একটা চান্স খুঁজছে তাকে পাটানোর। ভিন্ন ভাবে তাকে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে চাইছে কিন্তু আবরার তার ফোনে কিছু একটা করছে বিধায় তার দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের কাজে ব্যর্থ হয়ে সোহাও চলে যায় নিজের রুমে। হানিয়া জাভিয়ানের ব্রেকফাস্টটা রোজি বেগমের কাছে দিয়ে নিচে ভাইয়ের পাশে এসে বসে। রোজি বেগমই নিজে বলেছেন, তার কাছে জাভিয়ানের ব্রেকফাস্টটা দিতে সেই খাইয়ে দিবেন জাভিয়ানকে।
আবরার ঘন্টা দুয়েকের মতো তালুকদার বাড়িতে থাকে। বোনের সাথে মন খুলে কিছুক্ষণ কথা বলে। সে হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–তুই সুখী তো বোন?
হানিয়া তার প্রশ্ন শুনে থমকে যায়। কি বলবে সে তার ভাইকে? না ভাই আমি সুখী না। কোন এক অজানা কারণে আমার স্বামী আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। একথা শুনলে যে তার ভাই এক মুহূর্ত অপেক্ষা করবে না তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। এমনিতেই তার ভাইয়ের এই বিয়েতে মত ছিলো না,,এ নিয়ে তার বাবা আর ভাইয়ের মধ্যে এক নিরব যুদ্ধ চলছে। এখন যদি সে এই কথাগুলো তার ভাইকে বলে তাহলে শুরু হবে আরেক অশান্তি। হানিয়া চায় না তার জন্য কোন অশান্তি হোক তাই সে বুকে পাথর চেপে বলে—
–আলহামদুলিল্লাহ ভাই আমি ভীষণ সুখী।
আবরার তার মাথায় হাত রেখে বলে–
–তোরা দুই পায়রা সুখী থাকলেই আমি সুখী বোন। কখনো যদি কোন সমস্যা হয় বাবাকে বলার আগে আমাকে বলবি। তোদের ভাই সবসময় তোদের পাশে ছিলো,,আছে ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে।
–আচ্ছা ভাই।
আর অল্প কিছু কথা বলে আবরার চলে যায়। রোজি বেগম তাকে কয়েক বার বলেছে দুপুরের লাঞ্চ করে যেতে কিন্তু তার একটু তাড়া থাকা সে লাঞ্চ করতে পারে না। হানিয়া ভাইকে বিদায় দিয়ে লেগে পরে নিজের কাজে। বাসায় একটা কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও হানিয়াকে একা হাতে ধোয়া,,কাটা-বাছা সব নিজেকেই করতে হয়। এটাও তাকে কষ্ট দেওয়ার একটা মাধ্যম। রান্নাবান্না শেষ করতে করতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ায় তার শাশুড়ী প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। সে চিল্লাতে চিল্লাতে বলে–
–তা মহারানী আজ কি দুপুরের খাবার রাতে পাবো? নাকি রোজা রাখতে হবে? কয়টা বাজে খেয়াল আছে আপনার?
হানিয়া মিনমিনিয়ে বলে–
–দুঃখিত আম্মু। একটু লেট হয়ে গিয়েছে। আপনারা ডাইনিং টেবিলে বসুন আমি খাবারগুলো নিয়ে আসছি।
–লেট হবে কেন? বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখে আসো নি নাকি? নাকি ভাইকে দেখে সাহস বেড়ে গেছে। চিন্তা করো না বাড়া সাহস কীভাবে কমাতে হয় আমি শায়লা তালুকদার তা ভালো করেই জানি।
তার কথা শুনে সোহা ডাইনীর মতো কিটকিটিয়ে হাসতে থাকে। মিসেস তালুকদারের চিৎকার চেচামেচি শুনে জাভিয়ানেও নিচে নেমে আসে। হানিয়া আঁড়চোখে একবার তার দিকে তাকায় এই আশায় যদি জাভিয়ান তার হয়ে কিছু বলে কিন্তু নাহ। এমন কিছুই হয় না। হানিয়া মন খারাপ নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে খাবারের বাটি গুলো আনতে থাকে। সব আনা হলে সবাইকে ডাক দেয় খাওয়ার জন্য। হানিয়া সকলকে পাতে বেড়ে দিয়ে নিজে দাড়িয়ে থাকে। বিয়ের পর থেকে একদিনও সে সকলের সাথে বলে খায়নি। কেউ বলেও নি তাকে সকলের সাথে বসে খেতে।
হানিয়া খেতে বসে না বলে রোজি বেগমও বসে না খেতে। জাভিয়ান খেতে খেতে লক্ষ্য করে মনি খেতে বসে নি তাই সে তাকে বলে–
–মাম্মাম তুমি খাবে না? বসো নি কেন খেতে?
রোজি বেগম তাকে বলে–
–আমি পরে খাবো তুমি খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি করে। নাহলে আবার কিন্তু জ্বর আসবে।
–পরে কেন এখনি বসো সকলে একসাথেই খাই।
–আমাকে বললে খেতে অথচ তোমার বউ কে তো একবারও বললে না।
তার কথা শুনে সকলে খাওয়া থামিয়ে দেয়। শায়লা তালুকদার কটমট করে রোজি বেগমের দিকে তাকান। সোহা একবার তাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নিজের খাওয়া শুরু করে। জাভিয়ান একবার কোণাচোখ করে হানিয়ার দিকে তাকায়। তারপর রোজি বেগমকে বলে–
–এখন কি জনে জনে ইনভাইট করা লাগবে খেতে? যার ক্ষুধা লাগবে সে খেয়ে নিবে। ওর হয়তো ক্ষুধা লাগেনি তাই বসে নি খেতে।
তার কথা শুনে হানিয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। তারপর রোজি বেগমের উদ্দেশ্য বলে–
–হ্যাঁ মনি,, আমার ক্ষুধা লাগে নি। তুমি বসে পরো সকলের সাথে,, আমার ক্ষুধা লাগলে পরে আমি খেয়ে নিবো।
রোজি বেগম তাকে পাত্তা না দিয়ে জাভিয়ানকে বলে–
–ও খেতে না বসায় তুমি যেমন ধরে নিলে ওর ক্ষুধা লাগে মি তেমনি আমিও তো বসি নি খেতে তার মানে আমারও ক্ষুধা লাগে নি। লাগলে খেয়ে নিবো।
হানিয়া কিছু বলতে গেলে রোজি বেগম তাকে চোখ রাঙায়। জাভিয়ানের আর কিছুই বলার থাকে না। সে একবার রোজি বেগম তো আরেকবার হানিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার খেতে শুরু করে।
~চলবে?