#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#Season_2
#পর্ব_১৪
“সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না– বহুল পরিচিত এই প্রবাদটি আমাদের সবার জানা। সময় কারো কথা শুনে না,,সে বয়ে চলে প্রবাহিত নদীর পানির মতো। দুঃসময় গুলো যেমন যেতেই চায় না, তেমনি সুখের সময় গুলো যেনো চোখের পলকেই শেষ হয়ে যায়।
শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির স্নেহ আর স্বামীর অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে বেশ ভালোভাবেই দিনগুলো কাটছে হানিয়ার। তার কাছে দিনগুলো একদম স্বপ্নের মতো। এত সুন্দর আর মিষ্টি অনুভূতি এগুলো যা সে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি। দিনকে দিন জাভিয়ানের পাগলকরা ভালোবাসায় হানিয়া এতটাই আসক্ত হয়ে পরেছে যে সে ভুলেই বসেছিলো আর কিছুদিন পর তাঁকে বিদায় নিতে হবে এই শহর থেকে।
দেখতে দেখতে হানিয়ার ট্রেনিং শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আর তিনটা দিন সে থাকতে পারবে ঢাকায় তারপর চট্টগ্রাম ফেরত যেতে হবে। বিষয়টা নিয়ে হানিয়া জাভিয়ান দু’জনেরই মন ভীষণ খারাপ। এত কষ্টের পর স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে হানিয়া লোভী হয়ে পরেছে এই সংসারের প্রতি। একদিন রাতে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে কেঁদেই দেয়। জাভিয়ানের বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে বলে সে জাভিয়ান আর তার সংসার ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। সে চাকরি ছেড়ে দেবে।
জাভিয়ান তখন তাঁকে মাথা ঠান্ডা করে বুঝায় এমন পদক্ষেপ না নিতে। নিজের যোগ্যতা থাকার পরও যদি সে সেটা কাজে না লাগায় তাহলে এমন যোগ্যতা অর্জন করে লাভটা হলো কি? আজ আবেগে পরে এমনটা বলছে,, জীবনের একটা সময় গিয়ে এর জন্য আফসোস করবে হানিয়া এটাও জাভিয়ান তাঁকে বলে। পূর্ণবয়স্ক হানিয়ার অনুভূতিকে জাভিয়ান আবেগ নাম দেওয়ায় সে রেগে জাভিয়ানের গাল খামচে ধরে। রাগে দাত কিড়মিড়ি করতে করতে বলে–
—আমারে কি তোর ১৬/১৭ বছরের কিশোরী মনে হয় যে আমার ভালোবাসা,,অনুভূতিকে আবেগ বলিস? বুঝিস না কত কষ্টের পর আমি এসব পেয়েছি,,তোকে পেয়েছি এসব ছেড়ে আমি কীভাবে ওখানে থাকবো? আপনার মুখ না দেখে দিন শুরু করতে পারি না। রাতে আপনি আমার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না। আমি কীভাবে থাকবো এসব ছেড়ে?
–এতবছর যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে। তোমরা মেয়েরা বড্ড বোকা। তোমরা শুধু স্বামী-সংসার এসবের কথা ভাবো, এদের জন্য জান দিতে বললে বিনাবাক্যে তা দিতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু নিজের জন্য কিছু করতে গেলে তখন তোমরা সেটা গুরুত্ব দাও না। এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে এত বড় একটা পজিশন এচিভ করে কি হলো? সেই সংসারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাচ্ছো। আমি বলছি না সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাও। আমি বলতে চাইছি তুমি সংসারও করো আবার নিজের জন্যও কিছু একটা করো। এই সমাজ তোমায় যেন আমার নামে না,, আমায় যেন তোমার নামে চেনে। বেশির ভাগ স্ত্রী’রাই তো নিজেদের স্বামীর নামে পরিচিত পায়,, আমি না হয় আমার স্ত্রীর নামে পেলাম। বিশ্বাস করো বিষয়টা আমায় কতটা সুখ আর সম্মান দিবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না জান।
জাভিয়ানের কথায় হানিয়া অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জাভিয়ানকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে তাও ফুপাচ্ছে। কত কষ্টের পর সে জাভিয়ানকে পেয়েছে তাই তার হারানো ভয় বেশি। হানিয়ার কান্না থামানোর জন্য জাভিয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
—কাঁদছো কেন? এত বুঝানোর পরও নিজের মূল্যবান চোখের পানি ঝড়িয়ে আমার বুকে আগুন জ্বালানোর সাহস দেখাচ্ছো মেয়ে? আজকাল দেখছি বেশি সাহস হয়ে যাচ্ছে। কান্না থামাও। নাহলে কি আদর করা শুরু করবো।
হানিয়া জাভিয়ানের টি-শার্টে বুকের কাছের কাপড়ে নাক মুছে। জাভিয়ান বিষয়টা দেখেও এমন একটা ভাব নেয় যেনো হানিয়া কিছুই করেনি। হানিয়া একটু শান্ত হয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে–
— ভয় হয় জাভিয়ান। ভাগ্য যদি আবার আমাদের আলাদা করে দেয়? এবার আমি সত্যি সত্যি মরে যাবো না হয় পাগল হয়ে যাবো। বিচ্ছেদ সহ্য করার মতো শক্তি আমার আর অবশিষ্ট নেই।
কথাগুলো বলে হানিয়া আবারও ঠোঁট উলটে কেঁদে দেয়। জাভিয়ান হানিয়ার কথা ও কান্না দেখে তাকে গভীর ভাবে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। তারপর ধরা গলায় বলে–
—ইনশা আল্লাহ এমন কিছু হবে না। আচ্ছা তাও যদি তোমার সন্দেহ হয় এমন হতে পারে তাহলে চলো আমরা একটা চুক্তি করি।
—চুক্তি?
—হ্যাঁ চুক্তি। এগ্রিমেন্ট।
—তা কেমন চুক্তি।
—চুক্তিটা এমন হবে,, আমরা একে পরের সাথী হয়ে থাকার ওয়াদা করা করবো। আমাদের এই দূরত্বের কারণে যদি আমাদের মন একে অপর থেকে ঘুরে যায় বা অন্য কারো প্রতি দূর্বল হয়ে পরি তাহলে এটা আমরা একে অপরকে জানিয়ে দিবো। বিষয়টা যখন আমরা জানতে পারবো তখন যার মন ঘুরে যাবে তাঁকে মেরে ফেলবো। যে আমার না তাঁকে অন্যেরও হতে দিবো না। তাকে মেরে ফেলার পর হত্যাকারীকে যাতে পুলিশি ঝামেলা পোহাতে না হয় সেই জন্য এটা আমরা আগে থেকেই লিখে রেখে যাবো। বলো আইডিয়াটা কেমন?
হানিয়া হা করে জাভিয়ানের কথাগুলো শুনে। তার কাছে তেমন একটা ভালোও লাগে নি আবার খারাপও না বুদ্ধিটা। এত ভালোবাসা দেওয়ার পরও যদি আমার পার্টনারের মন ঘুরে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে সে একজনে আসক্ত না। আর যে একজনে আসক্ত হতে পারে না সে ভবিষ্যতে অনেক গুলো জীবন নষ্টের কারণ হয়ে দাড়ায়। এমন ব্যক্তিকে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
হানিয়া চুপ করে আছে দেখে জাভিয়ান তাকে আবারও প্রশ্ন করে–
—বললে না কেমন আইডিয়াটা?
—ভালো।
—তাহলে চলো এখনি কাজটা করে ফেলা যাক।
জাভিয়ান হানিয়াকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর একটা নোটখাতা আর পেন নিয়ে এসে কথাগুলো লেখে। এমন দু’টো কাগজ বানায়। একটা হানিয়ার কাছে থাকবে আরেকটা জাভিয়ানের কাছে। তারপর দুই জনই কাগজ টায় স্বাক্ষর করে নিজেদের কাছে রেখে দেয়।
_______________________
আজ হানিয়া চলে যাবে। সকাল সাড়ে দশটায় তার গাড়ি ছাড়বে। সে তার টিম মেটদের সাথেই যাবে বলে ঠিক হয়েছে। হানিয়াকে বিদায় দিতে মির্জা বাড়ির লোকেরাও তালুকদার বাড়িতে এসেছে।
হানিয়া নিজের পরিহিত শাড়িটা আরেকবার ঠিক করে আয়নায় একবার চোখ বুলায়। সম্পূর্ণ তৈরি সে। এবার রওনা হওয়ার পালা। হানিয়া আয়নার মাধ্যমে জাভিয়ানের গম্ভীর করে রাখা মুখটা লক্ষ্য করে। কাল রাত থেকে মুখটা এমন করে রেখেছে জাভিয়ান। মুখে যতই হানিয়াকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বলুক,, হানিয়াকে ছাড়া যে সে নিজেও থাকতে পারবে না তা জাভিয়ান নিজেও ভালো করে জানে। এছাড়া আরেকটা কারণও আছে।
জাভিয়ান হানিয়াকে দিয়ে আসতে চেয়েছিলো,, কিন্তু হঠাৎই জাভিয়ানের ড্রিম প্রজেক্টটার ব্যাপারে কথা বলতে ক্লায়েন্টরা আজ সকাল এগারোটায় মিটিং ডেকেছে। মি.তালুকদারকে পাঠানো যেতো মিটিংটা এটেন্ড করার জন্য কিন্তু সে এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছুই জানেন না আর তার শরীরটাও ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। তাই মিটিংটা জাভিয়ানকেই করতে হবে।
হানিয়া আয়নার সামনে থেকে সরে এসে জাভিয়ানের সামনে দাঁড়ায়। জাভিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে–
—তৈরি তুমি? যাওয়া যাক তাহলে? দেরি হয়ে যবাে তোমার আবার।
কথাটা বলে জাভিয়ান বসা থেকে উঠতে গেলে হানিয়া তার কাঁধে হাত রেখে আবার বসিয়ে দেয়। জাভিয়ান তার এমন কাজে অবাক হলেও কিছু বলে না। সে দেখতে চায় হানিয়া ঠিক কি করতে চায়।
হানিয়া জাভিয়ানকে বসিয়ে তার মুখটা নিজের হাতের আজলে নেয়। সময় নিয়ে পুরো মুখ টায় কয়েকবার চোখ বুলায়। তারপর মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে জাভিয়ানের মুখের কাছে। সন্তপর্ণে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয় তার প্রিয় পুরুষ টির ললাটে। পরপর জাভিয়ানের দুই চোখ,,চিবুক সব জায়গায় নিজের ভালোবাসা দেয়। ওষ্ঠের কাছে মুখ এনে থেমে গেলে জাভিয়ান হানিয়ার কোমড় চেপে ধরে নিজের উরুর উপর বসিয়ে নিজেই অসম্পূর্ণ কাজটা করে দেয়। সময় নিয়ে একে অপরকে আদর করে তারা।
হানিয়া জাভিয়ানের ওষ্ঠ থেকে সরে এসে তার গালে পুনরায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে–
—জাভিয়ান! আমার ভালোবাসা,, আমার প্রিয় পুরুষ বিদায় কালে আপনার এই বিষাদময় মলিন মুখটা আমার বুকে কতটা আঘাত করছে আপনি কি জানেন? বিচ্ছেদে কষ্ট থাকে,,কিন্তু আপনার এই মলিন মুখটা আমার কাছে ভীষণই বিষাক্ত লাগছে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে,, লাগবে না আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব ছেড়ে আপনার কাছেই পরে থাকি। নিজেকে মেরুদণ্ডহীন প্রমাণ করি। অন্য আর পাঁচটা বউদের মতো শুধু আপনার কথাই ভাবি। কিন্তু আপনি তো আমায় সেই সুযোগ দিবেন না। আমার নামে আপনি পরিচিত হতে চান বলে আমার কাঁধে এক গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। আপনি যা চান আজ পর্যন্ত আমি পালন করার চেষ্টা করেছি। এটাও করবো ইনশা আল্লাহ। কিন্তু এর জন্য আমাকে আপনার চাই,আপনার সহায়তা চাই। আপনার হাসি মুখের উৎসাহ চাই। আপনার মলিন মুখটা আমায় বারংবার পিছিয়ে দিচ্ছে,, নিজেকে কেমন দোষী মনে হচ্ছে।
জাভিয়ান হানিয়ার ললাটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে–
— মন খারাপ করে থাকবো না রানী সাহেবা আর আপনাকেও নিজেকে দোষী মনে করতে হবে না। চলুন এবার যাওয়া যাক। দশটা বেজে গিয়েছে।
—চলুন রাজা সাহেব।
জাভিয়ান একহাতে হানিয়ার লাগেজ ধরেছে আরেক হাত দিয়ে হানিয়ার হাত। তারপর দু’জন নিচে নেমে আসে। হানিয়া সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয় বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্য।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে হানিয়া জাভিয়ানের থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে ওয়েটিং রুমে চলে যায়। জাভিয়ান চলে যায় নিজের অফিসে। হানিয়া ওয়েটিং রুমে এসে তার কলিগদের থেকে জানতে পারে বাস নাকি তিন ঘন্টা দেরি করে আসবে। যে বাসে তারা যাবে সেটার ড্রাইভার নাকি বাস নিয়ে কি ঝামেলা করছে এরজন্য তাদের যেতে দেরি হবে। কথাটা শুনে হানিয়া একটু খুশি হয় এই ভেবে যদি এই তিন ঘন্টার মধ্যে জাভিয়ানের মিটিং শেষ হয়ে যায়। আবার এটা ভেবে মনটা খারাপ করে ফেলে,, লোকটা এতক্ষণ মিটিং করে ক্লান্ত শরীরে আবার এতটা জার্নি করবে? থাক সে বিষয়টা জাভিয়ানকে বলবে না। মুখ গোমড়া করে বসে থাকে বাসের।
~চলবে?