#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১০
-“আমার তো ইচ্ছে ছিল আমাদের আনিয়া কে ছেলের বউ করে আনব।কিন্তু তা আর হলো কই!ছেলের বাবা না জানিয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। আমার কি কোনো দাম আছে এ সংসারে?”
শ্বাশুড়ির কথাগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে মেহের। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না সে।কিইবা বলবে সে।প্রতিদিন এসব শুনতে শুনতে তো সে অভ্যস্থ!
তবে ‘আনিয়া’ নামটা সে প্রথম শুনলো।
-“কিছু বলতে গেলে ছেলের বাবা ক্ষেপে যায়।বলি তোমার মা-বাবারও তো কোনো ঠেকা নেই গো তোমার প্রতি।একবারো কল করেছিল?”
মেহেরের ইচ্ছে হলো বলতে যে তার ফোনটা ফেলে এসেছে। কিন্তু সাহস হলো না।
-“করেনি!করবেই বা কিভাবে!জন্জাল দূর করে এখন চাপমুক্ত।দিয়েছে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে।”
মীরা কলেজ থেকে ফিরে দেখলো তার মা টেবিলে বসে ফল কাটছেন আর মেহেরকে এটা ওটা শোনাচ্ছেন। আর মেহের চুপচাপ শুনছে। মীরা এসেই বলতে লাগলো,
-“কি হয়েছে মা?”
শেহনাজ পারভীন মীরার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
-“কি আর হবে!কপাল তো পুড়লোই।”
মীরা এসে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো।মেহের মীরার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।মীরার বেশ মায়া হলো।শেহনাজ পারভীন আবার বলতে লাগলেন,
-“কি আর হবে!পাড়া-মহল্লায় খবর রটেছে শাহীন খানের ছেলের আরবাজ খানের বিয়ে হয়েছে তাও নাকি লুকিয়ে।এখন সবাই আজ বউ দেখতে চলে এসেছে।”
-“হ্যা তো?”
-“তো মানে!তোর কাছে সামান্য হতে পারে আমার কাছে না।আমার মাশাল্লাহ এত সুন্দর ছেলে।বউ হবে শিক্ষিত,মার্জিত আর গুণের জুড়ি থাকবে না।এসব বুঝেই না আনিয়া কে বউ বানাব ভেবেছিলাম। কিন্তু হলো টা কি!”
এবার মেহের মুখ খুললো।বেশ ধীর গলাতেই বললো,
-“মাফ করবেন আন্টি।এই কথাটা আমি মানতে পারলাম না।আমি কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি যে আপনি আমাকে বলবেন আমি মার্জিত নই।আর আরেকটা কথা হলো,আমি যথেষ্ট শিক্ষিত।মাস্টার্স কম্প্লিট করা একটা মেয়ে।আর যাই করুন!আমার শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে কিছু বলবেন না দয়া করে।”
বলেই মেহের চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। শেহনাজ পারভীন মেহেরের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন মেহেরের যাওয়ার দিকে।
মীরা তা দেখে শেহনাজ পারভীন কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“এবার একটু চুপ করো মা!আর কত কি বলবে তুমি।”
বলে সেও মেহেরের পিছনে চলে গেল।গিয়ে দেখতে পেল মেহের বিছানায় বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মীরা জানত মেহের এটাই করবে।যে নরম মনের মেয়ে!মীরা গিয়ে মেহেরের পাশে বসতেই মেহের বলতে লাগলো,
-“আমি এসব বলতে চাইনি,কিন্তু বেরিয়ে গেল না চাইতেও।”
-“ভুল তো কিছু বলোনি।”
-“কিন্তু এভাবে বলাটা উচিত হয়নি! ”
-“হয়েছে কান্না বন্ধ করো!এখন নিজেকে শক্ত করো ভাবী।কথায় কথায় কাঁদলে হয়?”
-“আমি পারি না নিজেকে সামলাতে!”
-“চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। চোখ মুছো।”
মেহের চোখ মুছে ফেললো।তারপর বললো,
-“আন্টি কি কিছু মনে করলেন!”
-“নাহ।আর করলেও বা কি!তোমায় তো কম শোনাচ্ছে না।আমার মা হয়েছে তো কি হয়েছে। ইদানীং নিজের মা কেই চিনতে পারছি না।”
-“হুহ।”
-“মন খারাপ করো না।”
-“আচ্ছা মীরা!আনিয়া কে?”
-“নাজমা খালার মেয়ে। পেশায় তো একজন ডাক্তার। মা আর নাজমা খালা বিয়ের কথা বলছিল দুজনের।”
মেহেরের মুখটা কালো হয়ে গেল।শত হোক!নিজের স্বামীর এমন একটা বিয়ের কথা চলছিল শুনে মেহেরের মন খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। মীরা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বললো,
-“মেয়েটা বেশ ভালোই।মিশুকও।আর ভাইয়াকে তো ভীষণ পছন্দ তার।তাছাড়া ভাইয়ারও….”
-“ভাইয়ারও?”(চোখ বড় বড় করে)
-“একি ভাবী ভয় পেলে নাকি!”
বলেই ফিক করে হেসে দিল মীরা।মেহের চোখ নামিয়ে বললো,
-“ন..না!কি নিয়ে ভয় পাব।”
-“হাজার হোক!তোমার স্বামী বলে কথা!”
-“ভয় পাচ্ছি না।আসলে অবাক হচ্ছি।উনি নাকি মেয়েদের পিছনে যান না।”
-“তো আমি কখন বললাম ভাইয়া ওর পিছনে গিয়েছে। ”
-“তাহলে?”
-“ওরা ভালো বন্ধু। দুজনের বেশ জমে আরকি।”
-“ওও।”
মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবতে লাগলো।মীরা বুঝলো!তবুও চুপ করে রইলো। কিছু কিছু সময় কথা না বলে চুপ করে থাকাই উত্তম।তাই তো ধীর পায়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।সেই কখন বাসায় এসেছে কিন্তু এখনো গোসল করতে পারলো না।
মেহের মনে মনে বলছে,
-“এখন বুঝতে পারছি আমাকে কেন পছন্দ না। আগের থেকে একজনকে পছন্দ করে রেখে দিয়েছেন।ডাক্তার বলে কথা!আবার নাকি সুন্দরীও।বাহ ভালোই তো।
সেদিন আবার বলে কিনা মেয়েদের পিছনে ঘুরে না।
এত মিথ্যুক কেন রে!বাজে লোক।সব ছেলেরা একইরকম।কত বড় খাটাস।আমাকে বলে মেয়েদের পিছনে নাকি ঘুরে না।তাহলে এসব কি?চক্কর চলছিল।আর আমারই বা কি!আমারো এত শখ নাই বউয়ের মত আচরণ করার বা লোকটার বউ হওয়ার।ভুলে হয়ে গেছি মনে হয়।বয়েই গেল আমার!”
ভেবেই মেহের মুখ ভেংচি কাটলো। কেননা তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন হচ্ছে সেটা জানে না।তবে আনিয়া চরিত্রটা তার মনে ধরেনি।তাই এখন বারান্দায় বসে বসে নিজের রাগ কমাবে।
।
এদিকে সারাদিন কাজ করে লান্চ টাইমে ফ্রী হলো আরবাজ।নেট অন করে ফেসবুকে ঢুকলো।এড ফ্রেন্ড করায় মেহেরের ছবিগুলো বারবার আসছে সামনে।আরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল।এখনো রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট হয়নি! মেয়েটার এত বড় সাহস!আরবাজের রিকুয়েষ্ট ঝুলিয়ে রাখে!আরবাজ নিজে নিজেই বিরবির করলো,
-“আমারই বা কি হলো যে আমি ওকে এড দিলাম।ঠেকা পড়সে আমার!ঘুমের ঘোরে হয়ত চাপ লেগে গেছে।”
আরবাজ জানে যে সে ইচ্ছে করেই এড দিয়েছিলো।কিন্তু তবুও সে নিজের কাছে নিজেি চোরের মত বললো যে সে ভুলে দিয়েছে।
অবশেষে আরবাজ রিকুয়েষ্ট ক্যানসেল করবে ভাবলো।ক্যানসেল এ চাপ দিবে এমন সময় আরবাজের ফোনটা ভাইব্রেট করতে লাগলো।উপরে নাম ভেসে উঠছে, ‘আনিয়া’
আরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল।আনিয়া কল করেছে!ফোনটা পিক করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে আনিয়ার হাসিমাখা গলা ভেসে এলো,
-“আ’ম কামিং টু বাংলাদেশ।”
-“ওয়াও দ্যাটস গ্রেট!”(হেসে)
-“ইয়াহ!আমি খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে আসছি।”
-“খালামণি নিশ্চয়ই জানে।”
-“নো ইয়ার!মাকে সারপ্রাইজ দিব।”
-“খালামণি তো তাহলে ভীষণ খুশি হবে।”
-“তা তো হবেই।আর তুমি?”
-“আমি?”
-“হ্যা।তুমি!তুমি খুশি হওনি শুনে?”
-“হ্যা অবশ্যই। খুশি হব না কেন।”
অপরপাশ কিছু সময় নীরব রইলো।তারপর বলে উঠলো,
-“আমার একটা আর্জি আছে।”
-“কি বল।”
-“আমাকে নিতে তুমি আসবে।”
-“আমি…”
-“হ্যা তুমি।কোনো না শুনব না।এতদিন পর আমি আসছি।আর আমার এই আবদার টা রাখতে পারবে না তুমি!”
-“আচ্ছা রাখব।”(হেসে)
।
কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বাজলো আরবাজের।এসে দেখলো সবাই খেতে বসে পড়েছে।সবাইকে টেবিলে পেলেও আরবাজ আশেপাশে তাকিয়ে মেহেরকে পেলো না।বুঝলো,মেহের হয়ত রান্নাঘরে।শেহনাজ পারভীন আরবাজকে বললেন ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে।আরবাজ বলতে লাগলো,
-“কাল শুক্রবার। আজ এত তাড়া নেই মা।পেট ভরা আছে,আমি ফ্রেশ হয়ে এসে ধীরেসুস্থে খাব।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে বাবা।তাহলে তুই যা।”
-“আমার খাবারটা কাউকে দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিও।”
আরবাজ ওয়াশরুমে চলে গেল।বের হয়ে দেখতে পেল মেহের আজও জামাকাপড় সেভাবেই রেখে দিয়েছে। আজ আরবাজের বেশ রাগ হলো।এমন করার মানে কি?তাকে কি আরবাজ বলেছে এত ফর্মালিটি পালন করতে?আরবাজের এত সেবাশুশ্রূষা করতে?
যেহেতু মেহের এ ঘরে থাকে না সেহেতু আরবাজের জন্য এসব করতেও হবে না।এসব ভাবতে ভাবতে আরবাজ গেঞ্জি আর ট্রাউজার পড়ে নিল।হঠাৎ তার দরজায় নক করলো কেউ।আরবাজ পিছনে ঘুরে দেখলো মেহের দাঁড়িয়ে আছে।আরবাজ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি চাই?”
-“আসব?”
-“কেন?”(ভ্রু কুঁচকে)
আরবাজ ভাবলো মেহের হয়ত এখানে শুতে এসেছে।কিন্তু সেই ভাবনায় পানি ঢেলে মেহের বলে উঠলো,
-“আপনার খাবার।”(ধীর গলায়)
আরবাজ এবার খেয়াল করলো যে মেহেরের হাতে খাবার।আরবাজের রাগ হলো।এগিয়ে গিয়ে হাত থেকে প্লেট নিয়ে বললো,
-“আসতে হবে না তোমার।প্লিজ বাহিরেই থাকো।”
বলেই মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল।আচমকা আরবাজের এহেন কান্ডে মেহের রিতীমত নির্বাক!
তার হতে না চাওয়া থেকে হয়ে যাওয়া জামাইয়ের হলো টা কি!পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি?
এবার মেহেরের এটা ভেবে রাগ হলো যে তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে আরবাজ।মেহের রাগে বিরবির করলো,
-“আমাকে অপমান করলো!দেখে নেব আপনাকে।!
মেহেরও খায়নি।তাই চটজলদি খেয়ে নিলো।তারপর মীরার ঘরে গিয়ে দেখলো মীরা বসে বসে ফোনে কথা বলছে।কথার গতি দেখে বুঝলো যে সে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।মেহের এগিয়ে যেতেই মীরা কল কেটে দিল।তারপর বলতে লাগলো,
-“ভাইয়ার সাথে খেলে?”
-“কচু!”
-“কচু খেয়েছ?আজ তো কচু রান্না হয়নি।”
-“মজা করো না মীরা।তোমার ভাইয়া আমার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে অপমান করলো।”
মীরা হাসতে হাসতে বললো,
-“আহারে!আসলেই বড্ড বেশি খারাপ হয়ে গেল বিষয়টা।”
-“আমারো সেটা ভেবেই রাগ হচ্ছে।”
-“বাদ দাও।আনিয়া আসছে।”
-“মানে!”(ভ্রু কুঁচকে)
-“হ্যা দেশে ফিরছে।এইত মাত্র কথা বলছিলাম।ভাইয়ার সাথেও তো কথা হয়েছে।”
মেহের চুপ হয়ে গেল।মনে মনে আওড়াল,
-“ও!এজন্যই মনে হয় মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। একা একা প্রেমিকার সাথে কথা বলবে।তো বল না!আমার কি!আমাকে কেন এভাবে বললো।
মনে হয় আমি ঘরে যাওয়ার জন্য বসে আছি।”
মীরা মেহেরকে ভাবতে দেখে মেহেরের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-“কই থেকে কই চলে যাও। ”
-“না আছি।বলো।”
-“এত ভেবো না।ঘুমাও।”
-“হু।শোও তুমি।আমি আসছি।”
বলেই মেহের মীরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল।মীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“এরা যে কবে প্রেমে পড়বে আর কবে সংসার করবে।আমার কি ফুপি ডাক শোনা হবে না?মনে হয় না।!
মেহের আস্তে আস্তে গিয়ে আরবাজের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় কান দিলো।ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে।মেহেরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
মেয়ে গলা!আরবাজ কি ভিডিও কলে কথা বলছে!
মেহের বিরবির করলো,
-“ছিহ!রাত-বিরেতে ভিডিও কলে ইসসি।”
মেহের চুপচাপ শোনার চেষ্টা করছে।এত ভালো করে শোনা না গেলেও অস্পষ্ট শব্দ আসছে।হঠাৎ মেহেরের মনে হলো দরজায় কেউ হাত রাখলো ভিতর থেকে।কিছু বুঝবার আগেই দরজা খুলে গেল।আর মেহের গিয়ে পড়লো ঠিক আরবাজের উপর!
চলবে…..