প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব-১৩

0
6

#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১৩

শেহনাজ পারভীনের এমন ঝাঁঝ মেশানো কথায় শাহীন খান সিদ্দিক আলমের সামনে অনেক লজ্জা পেলেন।আরবাজ ভাবতেও পারেনি যে তার মা এভাবে সবার সামনে এসব বলে বসবে।শাহীন খান চোখ রাঙিয়ে বললেন,

-“শেহনাজ!চুপ করো।”
-“আর কত চুপ করে থাকব বলোতো?ভুল টা কি বলেছি আমি।”

শেহনাজ পারভীনের কথা শুনে সিদ্দিক আলমের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তার মেয়ে ঠিক কি অবস্থায় আছে এখানে। সিদ্দিক আলম মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।মেহের অসহায় চোখে শেহনাজ পারভীনের দিকে তাকিয়ে আছে।হয়ত বলতে চাইছে,’দয়া করে আমার বাবাকে এসব বলবেন না।উনি কষ্ট পাবেন।’
কিন্তু বলতে পারছে না।শাহীন খান আবার বলে উঠলেন,

-“এবার চুপ করো।সবার আগে সিদ্দিক আমার বন্ধু। এরপর বাকি সব সম্পর্ক। আমার বন্ধু এতদিন পর বাসায় এসেছে আমার।তুমি গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করো।”

শেহনাজ পারভীন মুখ ভেংচি দিয়ে বললেন,

-“হ্যা তা তো করতেই হবে।অতিথি কে তো খালি মুখে ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।”

বলে শেহনাজ পারভীন যেতে নিলেন।সিদ্দিক আলম পিছন থেকে বলে উঠলেন,

-“না লাগবে না।আমি এখানে খেতে আসিনি।আর তাছাড়া আপনি যে আমার উপর বিরক্ত সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি ভাবী।এখন আমি চাই না আপনাকে আর বিরক্ত করতে।”

শেহনাজ পারভীন কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাহীন খান বলতে লাগলেন,

-“আরে সিদ্দিক ও তো এমনি আরকি বলে ফেলেছে। তুই কিছু মনে করিস না।শেহনাজ তুমি যাও তো।”
-“আমি যা বলেছি সত্যি আর সঠিক কথাই বলেছি।”

শেহনাজ পারভীনের এমন কড়া কথা শুনে সিদ্দিক আলমের মন চাইলো উঠে চলে যেতে।এত অপমানিত উনি কোনোদিন হননি।শাহীন খান স্ত্রীর এমন আচরণে লজ্জায় পড়ে গেলেন। মেহের না পারছে সইতে আর না পারছে কিছু বলতে।এদিকে মীরা চাইছে না সিদ্দিক আলমের সামনে তার মায়ের উপর কোনো কথা বলতে।এতে সিদ্দিক আলম তাকে বেয়াদব ভাবতে পারে।অথবা তার মা তাকে কি থেকে কি বলে বসেন!
বলা যায়না।তার মায়ের মাথা ঠিক নেই।
শাহীন খান আবার বললেন,

-“শেহনাজ! কেন এত কথা হচ্ছে। ”
-“তুমি কেন আমায় চুপ করতে বলছ।আমি ভুল কি বলেছি?সিদ্দিক ভাই নিজের বন্ধ্যা মেয়েকে আমাদের ছেলের ঘাড়ে দিয়ে বসে আছেন।না কোনো খবর আর না কোনো কিছু। বেশ আরামে আছেন।”

আরবাজ এতক্ষণ চুপ ছিল।আর না থাকতে পেরে প্রথম বারের মত সে তার মায়ের উপর মুখ খুললো,

-“মা!কি হচ্ছেটা কি।সবসময় কিন্তু সব কথা মানায় না।”

শাহীন খান অবাক হলেন না।কেননা শেহনাজের এসময় এসব কথা কারোরই সহ্য হচ্ছে না। আরবাজেরও হবে না এটাই স্বাভাবিক।শেহনাজ পারভীন বলতে লাগলেন,

-“আরবাজ!বাবা তুই তোর মাকে ভুল বুঝিস না।আমি তো তোর ভালোই চাই।”
-“সেটা আমি জানি মা।কিন্তু এখন এসব কথা বলে তো কোনো লাভ নেই।এবারে শান্ত হও।”

শেহনাজ পারভীন মেহেরের দিকে রাগী চোখে তাকালেন।মনে মনে ভাবলেন,

-“আমার ছেলেটাকেও নিজের দলে নিয়ে নিচ্ছে।”

শাহীন খান বলতে লাগলেন,

-“যাও তো যাও।রান্নার ব্যবস্থা করো।”

সিদ্দিক আলম আরবাজের প্রতিবাদ দেখে একটু শান্ত হলেন।হেসে বললেন,

-” না রে।আমি আসলেই খাব না।ভাবী মাফ করবেন।
আর শোন,আমি এখানে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”

শেহনাজ পারভীন ভ্রু কুঁচকে বললেন,

-“কিসের প্রস্তাব?”

শাহীন খান হাত দিয়ে থামিয়ে বললেন,

-“প্রস্তাব টস্তাব পরে শুনব।আগে তুই বস,
খাওয়া-দাওয়া কর।তারপর সব শুনব।”
-“না রে।আমার সময় হবে না।আমি চলে যাব।”

মেহের বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

-“এখনই চলে যাবে বাবা?”

আরবাজও অবাক হলো।আর বলতে লাগলো,

-“একি!এখনই যাবেন কেন আংকেল।”
-“আমার অনেক কাজ আছে যে।মেয়ে আর জামাই প্রথমবারের মত শ্বশুরবাড়ি যাবে মানে আমার বাড়িতে আসবে।আমার বাজার করতে হবে না?”

মেহের আর আরবাজ অবাক হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।তারপর দুজনে একসাথে বলে উঠলো,

-“মানে!”

শেহনাজ পারভীনও একই প্রশ্ন করতেই সিদ্দিক আলম বলতে লাগলেন,

-“আসলে মেহের চলে আসার পর ওর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়।এর কারনে মেহেরের খোঁজ খবর নিতে আসতে পারিনি।একবার যে কল করব তারও সুযোগ হয়নি।মেহের ফোনটাও ফেলে এসেছে।”

এতটুকু শেষ হতেই মেহের বলতে লাগলো,

-“কি বলছ বাবা!মায়ের কি হয়েছে?”

সিদ্দিক আলম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“চিন্তা করিস না,চিন্তা করিস না।এখন ঠিক আছে।
এখন তোর মা চাইছে তোরা বাসায় এসে কদিন থাক।
এটার তো নিয়মও আছে।আর তাছাড়া তোর মা তোকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে।”

শাহীন খান খুশি হয়ে বললেন,

-“খুব ভালো কথা।যাক দুজন।”
-“হ্যা,এখন আমার প্রস্তাব হলো আমি দুজনকে আজই নিয়ে যেতে চাইছি।”
-“নিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু তুই আজকের দিনটা থাক।কালকে নাহয় একসাথে যাস।”
-“না রে।তোর ভাবী বাসায় একা আছে।”
-“তাহলে বরং দুপুরে খেয়ে বিকালে রওনা হয়ে যা।
আরবাজ?তুমি তিনদিনের ছুটি নিয়ে নাও।আমি কথা বলছি।”

সিদ্দিক আলম বলতে লাগলেন,

-“আমি তাহলে মেহেরের মাকে জানিয়ে দি।”

বলে ফোন নিয়ে অন্য পাশে চলে গেলেন অনেকটা দূরে।
আরবাজ আর কি বলবে!মেহেরের দিকে কড়া চোখে তাকালো।এর মানে হলো,তোমার জন্য আমাকে এখন কাজে ফাঁকি দিতে হচ্ছে। মেহের মুখ ভেংচি কাটলো।সে তো বেশ খুশি।এতদিন পর যাচ্ছে নিজের বাড়ি।
এত খুশির মাঝে শেহনাজ পারভীন হঠাৎ বলে উঠলেন,

-“মানেটা কি!সব কথা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আমার পারমিশন না নিয়ে।”

শাহীন খান বুঝলেন যে শেহনাজ পারভীন আবারো ক্যাচাল করবেন।তাই ওনাকে আটকাতে হবে।আবারো তিনি লজ্জায় পড়তল চান না।তাই উঠে দাঁড়ালেন।শেহনাজ পারভীনের হাত ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,

-“তোমার কিছু বলতে হবে না চলো।”
-“আরে কি করছ।ছেলে-মেয়ে সামনে ছাড়ো আমাকে।”
-“চলো চলো।”

মেহের আর মীরা হো হো করে হাসতে লাগলো।আরবাজ হাসি আটকাতে চেয়েও পারছে না।মীরা এসে মেহেরের পাশে বসতে বসতে বললো,

-“দেখলে আমার বাবা কিন্তু এখনো হেব্বি রোমান্টিক।”
-“ছি কি সব বলো।”
-“আরে এটা এখন কমন কথা।”

সিদ্দিক আলম আসায় সবাই চুপ হয়ে গেল।উনি বলতে লাগলেন,

-“শাহীন আর ভাবী কোথায় গেল?”
-“আংকেল,মাকে বোঝাতে নিয়ে গেছে বাবা। মা তো একটু পাগল টাইপের।দেখলেনই তো।”

মীরার কথা শুনে সিদ্দিক আলম হালকা হাসলেন।তারপর বললেন,

-“আচ্ছা। তাহলে মেহের?যাও গিয়ে তৈরী হতে থাকো।”

আরবাজও ঘরে চলে গেল।তাকে এখন কল দিয়ে ছুটি নিতে হবে।মীরা বলতে লাগলো,

-“ধূর!ভাবীকে অনেক মিস করব।”
-“তাহলে তুমিও চলো।”
-“না আমার তো ভার্সিটি আছে।”
-“ওহ হ্যা তাই ত।”

মীরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।মীরা আর মেহের অনেকক্ষণ গল্প করলো সিদ্দিক আলমের সাথে।কিছু সময় কর শাহীন খান এসেও যোগ দিলেন। মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন,

-“তোর মাকে সামনে বসিয়ে বুঝিয়েছি অনেক্ক্ষণ। হয়ত এখন একটু শান্ত থাকবে।যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।”
-“যাক বাবা!”

সিদ্দিক আলম বলতে লাগলেন,

-“আমার ভাবতেও অনেক খারাপ লাগছে,আমি তোকে আর ভাবীকে অনেক বড় একটা বোঝা দিয়ে দিয়েছি,তাই না রে?আমার মেয়েটা আমার প্রাণ।আমার একটা মাত্র মেয়ে।ওর কষ্ট আমি নিতে পারি না।এজন্যই তোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছিলাম।”
-“এভাবে কেন বলছিস। আমি যদি তোর বিপদে পাশে না থাকতে পারি তাহলে কেমন বন্ধু হলাম।আর তাছাড়া মেহের তো আমার মেয়েই।ওকে আমার ছেলের বউ হিসেবে পেয়ে আমি অনেক খুশি।আগে জানলে আমি তোকে কবেই প্রস্তাব দিতাম।”

মেহের শাহীন খানের কথা শুনে বেশ তৃপ্তি পেল।এই মানুষ টার মধ্যে সে তার বাবাকে দেখতে পায়।কি সুন্দর করে আগলে রাখে তাকে।এই অল্প দিনে বেশ মায়া জন্মেছে মেহেরের এই মানুষ টার উপর।

গাড়িতে বসে আছে আরবাজ।আর পাশেই সিদ্দিক আলম। আর মেহের পিছনে বসে আছে বেশ এক্সাইটেড হয়ে।আরবাজ গাড়ির লুকিং গ্লাসে বারবার মেহেরকে দেখছে।মেহের তার বাবা কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে।আরবাজ মনে মনে ভাবছে,

-“খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র ওর জন্য আমার আজকের দিনটা আর আরো বাকি দুদিন ফাঁকি।”

মেহের কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ গেল লুকিং গ্লাসে।আরবাজের চোখ দুইটা!মেহেরের কথা থেমে গেল,চোখ আটকে গেল। আরবাজ চোখ সরালো না।মেহের চোখ নামিয়ে নিলো।সিদ্দিক আলম বলতে লাগলেন,

-“কিরে!থেমে গেকি কেন রে মা।”

আরবাজ লুকিং গ্লাসে মেহেরকে দেখতে দেখতেই বললো,

-“মনে হয় চার্জ শেষ আংকেল।চার্জ করে তারপর আবার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসবে।”

সিদ্দিক আলম হেসে ফেললেন।মেহের প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,

-“আপনি কি আমাকে বাঁচাল বললেন?”
-“না তো।”
-“মনে হলো…”

আরবাজ আর কিছু বললো না।মেহের মুখ ভেংচি কাটলো।চোখ এড়ায় না আরবাজের।অজান্তেই সে হেসে ফেললো।বাহিরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মেহের পৌঁছে গেল তার নিজের বাড়িতে।
বাড়িতে সামনল আসতেই সিদ্দিক আলম গাড়ি থেকে বের হয়ে আগে আগে চলতে লাগলেন।
আর মেহের খুবই খুশি।তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে মাথায় একটা বাড়ি খেল।এটা দেখে আরবাজ তাড়াতাড়ি বের হলো গাড়ি থেকে।পিছনে গিয়ে দরজা খুলে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“তুমি কি একটু স্থির থাকতে পারো না?”

মেহের নিজের কপাল ঘষতে ঘষতে বললো,

-“আমি কি জানতাম নাকি এমন হবে।”
-“ঠিক হয়েছে। খুশি হয়েছি।আরো জোরে খাওয়ার দরজার ছিল।”
-“কি বললেন!”(রাগী গলায়)
-“বের হও।”

আরবাজ মেহেরের হাত ধরে বের করে আনলো।মেহের এখনো কপাল ঘষছে।সিদ্দিক আলম পিছনে ঘুরে বললেন,

-“কিরে!কি হলো?আয়!”

মেহের আসছি বলে আরবাজের দিকে একবার তাকিয়ে হাঁটা ধরলো।আরবাজও গাড়ি লক করে পিছনে পিছনে গেল।সিদ্দিক আলম কলিং বেল দিলেন।মেহের বেশ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু দরজা খুলতেই তার হাসিটা মিলিয়ে গেল।আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মেহের।এটা তো সে ভাবেনি।অবাক হয়ে নিজের বাবার দিকে তাকালো সে!

চলবে….