প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব-১৮

0
2

#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১৮

আরবাজ এখনো মেহেরের হাত ধরে আছে।আর মেহেরের চোখটা সেখানেই আটকে গেছে। আরবাজ শক্ত করে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল।গাড়ির পিছনে সবাই চেপে বসলো।সবাই মিলে এটা ওটা বলছে মহিলাটার নামে।আরবাজ কোনোমতে রাগটা কন্ট্রোল করে ড্রাইভ করছে।মেহের বারবার আরবাজের দিকে তাকাচ্ছে।না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে আরবাজ ঠিক কিভাবে তার হাতটা ধরে রেখেছিল।আর বারবার বলছিল, ‘আমার বউ থেকে দূরে থাকবে।’
মেহেরের মনের ভিতর কেমন অজানা একটা অনুভূতির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। আরবাজ আজ প্রথম তার হয়ে কথা বললো।আরবাজ গম্ভীর গলায় বললো,

-“বারবার তাকানোর কি আছে?”

মেহের হকচকিয়ে গিয়ে বললো,

-“আমাকে বললেন?”
-“আর নয়ত কাকে?”

মেহের ঠোঁট ফুলিয় চুপচাপ বসে রইলো।আরবাজ সেদিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।তিতলি,পিউ আর বাবলু নিজেদের মত কথা বলতে ব্যস্ত।আরবাজ পিছনে ঘুরে বলতে লাগলো,

-“শোনো,বাসায় কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে।”
-“আপনি কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”(পিউ)
-“আমরা আজ ব্যাক করছি।”

মেহের আরবাজের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বললো,

-“মানেটা কি!”

আরবাজ গাড়ি চালাতে চালাতেই গম্ভীর গলায় বললো,

-“আমি যা বলব তাই হবে।”
-“আরে!বললেই হলো নাকি?”

আরবাজ মেহেরের দিকে রাগ নিয়ে তাকালো।মেহের ঢোক গিললো।তারপর মুড অফ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। আরবাজ বলতে লাগলো,

-“তিনদিন তো হলোই।আবার অন্য কোনোদিন আসব।”
-“তাই বলে আজই চলে যাবেন ভাইয়া?”(তিতলি)
-“হ্যা।এখানে আর এক মুহুর্তও না।আর শোনো,ওনারা এলে ভয় না পেয়ে আমায় জাস্ট একটা কল করবে।মনে হয় না আসার সাহস করবে।আর এসব নিয়ে কিছু হবেও না কারণ রেস্টুরেন্টের মালিক আমার বন্ধু। বলেছিলাম না?”
-“জ্বী ভাইয়া।”

আরবাজ চুপ করে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।তারপর একটা মলের সামনে গাড়ি থামালো।অনেক অনেক শপিং করে সবাই আবারো গাড়িতে চেপে বসলো।তিতলি পিউর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

-“আমি এটাই বুঝলাম না যে জায়ান এলো কেন ওর কাছে?না মানে ও না আসলে তো এত বড় কাহিনী হতি না।”
-“এক্সেক্টলি।”(পিউ)
-“বিয়ের দিন যখন মেহের অসহায় হয়ে গেছিল সেদিন কই ছিল?”(বাবলু)

বাবলুর কথাতে তিতলি একমত প্রকাশ করলো।বাবলু মজা করেই বললো,

-“সেদিন যদি ভাইয়া বিয়ে না করত তাহলে তো আমিই করে নিতাম।”

বাবলুর কথা শেষ হতেই গাড়ি থেমে গেলো।মেহের সামনের দিকে ঝুঁকে গেল।আর আরবাজ হাত দিয়ে ধরে ফেললো।মেহের প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। বুকে থু থু দিয়ে বললো,

-“এমন করার মানে কি?”

আরবাজ মেহেরের দিকে না তাকিয়েই বললো,

-“এসে গেছি।”

মেহের আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আসলেই এসে গেছে।সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।বাসায় ঢুকার পর আরবাজ সবার হাতে গিফট তুলে দিয়ে একটা প্যাকেট হাতে ঘরে চলে গেল। চোখ এড়ায় না মেহেরের।মনে মনে ভাবলো হয়ত তার মায়ের জন্য কিছু কিনেছে।আর তিতলি, পিউ ওরা সমস্ত ঘটনা বলতে লাগলো।
মেহের চুপচাপ বসে শুনছে শুধু। আজ আরবাজ আলাদা ছিল।আরবাজের মধ্যে আলাদা কিছু দেখতে পেয়েছিল মেহের।এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই মেহের পৌঁছে গেল নিজের শ্বশুরবাড়ি!

বাসায় ঢুকতেই মেহের চমকে গেল পরিচিত মুখ নাজমা বেগম কে দেখে।উনি বেশ হাসি-খুশি ভাবে সোফায় বসে গল্প করছিলেন শাপলা বেগমের সাথে।
দরজায় অনেকগুলোই জুতা।মানে অনেক মানুষ এসেছে। মেহেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরবাজ পিছন থেকে বলে উঠলো,

-“ভিতরে যাও না কেন?”

মেহের আরবাজের দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালো।আরবাজের গলা শুনে শেহনাজ পারভীন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

-“এইত আরবাজ এসে গেছে।”

আরবাজ নাজমা বেগম কে বসে থাকতে দেখে মেহেরের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকালো।মেহের চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে নাজমা বেগম কে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“আন্টি ভালো আছেন তো?”
-“হ্যা আছি।”

বলে আর কথা না বলে আরবাজের দিকে এগিয়ে গেল।আরবাজকে জিজ্ঞেস করছে,

-“তোর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কেমন আপ্যায়ন করলো রে?এত ভালো না নারে?”

মেহের মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলো।আরবাজ সেটা লক্ষ্য করে বললো,

-“আমি ওখানে খেতে যাইনি খালামণি।খাওয়ার জন্য আমি বেড়াতে যাই না।”

বলে ঘরের দিকে চলে গেল।মেহের দাঁড়িয়ে থেকে কথাটা শুনলো।অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠলো।ব্যাগ টেনে পা বাড়ালো ঘরের দিকে।ব্যাগ থেকে কাপড়গুলো বের করে করে গুছিয়ে রাখতে লাগলো।আরবাজ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বললো,

-“তোমাকে আমি বলেছি এক্ষুণি এসব গুছিয়ে দিতে?”
-“তাহলে কখন করব?”
-“আগে গিয়ে ফ্রেশ হও যাও।”

মেহের মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে নিলে আরবাজ বলে উঠলো,

-“কই যাও!”
-“আপনি না বললেন ফ্রেশ হতে যেতে।তাই তো ঘরে যাচ্ছি।”
-“চুপচাপ এই ওয়াশরুমে যাও।আর আজ ভালোই ভালোই সমস্ত কাপড়চোপড় এ ঘরে গুছিয়ে রাখবে।আমার মাথা এমনিই গরম।আর কথা বলিও না আমাকে দিয়ে।”

মেহের আরবাজের কথাগুলো শুনলো মনোযোগ দিয়ে। তারপর মাথা নাড়ালো। সেও তো চায় আরবাজের সাথে থাকতে।হাজার হোক!আরবাজ তো তারই স্বামী। মেহের নিজের ফোনটা বিছানায় রেখে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে।
আরবাজ চুল মুছে টাওয়াল টা রাখার সময় খেয়াল করলো বিছনার উপর মেহেরের ফোন।আরবাজ বুঝলো যে মেহের আসার সময় হয়ত ফোনটা নিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই এখন সারাদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকবে। আরবাজ বিরবির করে বললো,

-“ভালো করে মেশাচ্ছি এসব ফ্রেন্ডদের সাথে দাঁড়াও!”

ভেবে আরবাজ ঘুরতেই একটা মেয়ে এসে আরবাজকে জড়িয়ে ধরলো।আরবাজ আচমকা এমন হওয়ায় শকড খেলো।মেহেরও বের হলো ওয়াশরুম থেকে।আর এই দৃশ্য দেখে তো মেহেরের চোখ যেন বের হয়ে আসবে। আরবাজ মেয়েটাকে সরাতেই একইসাথে অবাক আর খুশি হয়ে বললো,

-“আনিয়া তুই!ওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। ”

আনিয়া বেশ খুশি হয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।আরবাজ ফোন চেক করতে করতে বললো,

-“ওহ হো!আজ তিন তারিখ।আমার একদমই মনে ছিল না! ”
-“হ্যা।আমায় আনতে যাওয়ার কথা ছিল।”
-“সরি ইয়ার।একদম মনে ছিল না আমার।”
-“ওকে ওকে ইটস ওকে।কিন্তু তোমার শাস্তি আছে।”
-“কি শাস্তি?”
-“এইযে আমায় আনতে যাওনি এজন্য তোমার শাস্তি হলো আমাকে শপিং করতে নিয়ে যাবে। আর সামনে তো বউমণির সাধের অনুষ্ঠান।এজন্যই তো আমরা সবাই এখানে এসেছি। বেশ বড় করে খালামণি নাকি বউমণির সাধের অনুষ্ঠান করবে।”
-“ওও!”
-“হ্যা।বলো না নিয়ে যাবে।বলো না বলো না।”

বলে হাত ঝাঁকাতে লাগলো আরবাজের।আর না পেরে আরবাজ বলে উঠলো,

-“আচ্ছা আচ্ছা যাব।”

দরজা থেকে মীরাও বলে উঠলো,

-“ওহ আচ্ছা! আর আমার বেলায় কিছু না?”
-“মনে হচ্ছে আমার পকেটের সব টাকাগুলো গচ্ছা যাবে।”
-“আমাকে তো…”

বলতে বলতে মীরা থেমে গেল।মেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে।মীরা খুশি হয়ে মেহেরকে ঝাপটে ধরে বলতে লাগলো,

-“ভাবীইইই! তুমি এসেছ আমায় বলবে না?আমি তোমায় কখন থেকে খুঁজছি।”

মেহের জোরপূর্বক হেসে বললো,

-“আমি ফ্রেশ হচ্ছিলাম।”
-“আমি তোমাকে কত্ত মিস করেছি জানো!”

মেহেরের চোখ বারবার আরবাজ আর আনিয়ার দিকেই যাচ্ছে। আরবাজ কি সুন্দর হাসছে।অথচ একটু আগে মেহেরকে বললো মেজাজ গরম।মেহেরের মনের মধ্যে কেমন একটা করে উঠলো।কেমন খারাপ লাগতে শুরু করলো।মীরা মেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে আনিয়ার সামনে এনে বললো,

-“এসো এসো পরিচয় করিয়ে দিই।এইযে এটা হলো আনিয়া আপু।নাজমা আন্টির মেয়ে।আর আনিয়া আপু,এটা হলো মেহের ভাবী।আমার ভাইয়ের একমাত্র বউ!”

আনিয়া হেসে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ভালো আছো?”
-“জ্বী।”

আনিয়া আর কিছু না বলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আরবাজের সাথে কথা বলায়।সাথে মীরাও ব্যস্ত হয়ে হেল।মেহের ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হতে হতে চিন্তা করলো,

-“এখন তো আমার এঘরে আসতেই হবে।নয়ত আমার ঘর দখল নিয়ে বসে থাকবে।”

পরক্ষণেই নিজের কথাতে নিজেই অবাক মেহের।তার ঘর?কি ভাবছে সে!মেহের নিজের উপরই মূলত বিরক্ত।ড্রয়িংরুমে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলো
শেহনাজ পারভীন নাজমা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলছেন,

-“অনেক আয়োজন বাকি রে।এত এত সব রান্না কিভাবে কি শেষ হবে?”

মেহের এগিয়ে এসে বলতে লাগলো,

-“আন্টি আপনি এত চিন্তা করছেন কেন?আমি সব রান্না পারি।”

শেহনাজ পারভীন আর নাজমা বেগম এমনভাবে তাকালেন যেন তারা আকাশ থেকে পড়েছেন।শেহনাজ পারভীন নাক-মুখ কুঁচকে বললেন,

-“ওসব দক্ষতা তুমি তোমার কাছেই রাখো।অন্তত সাধের অনুষ্ঠানে এসব দেখাতে এসো না!”

মেহের কি বলবে বুঝতে পারছে না।সে কি ভুল কিছু বলেছে নাকি তাও তার বোধগম্য হচ্ছে না।নাজমা বেগম বলতে লাগলেন,

-“এসব নিয়ম-কানুন মেনে করতে হয়।”
-“আমি নিয়ম মেনেই করব আন্টি।একবার বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়ে দেখুন ই না।”
-“হ্যা তোমার মত বন্ধ্যা করে দায়িত্ব দেই আর আমার বউমার অকল্যাণ হোক।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই মেহের চোখ জলে ভরে গেল।এমন সময় বাকি সবাই ও কথা বলতে বলতে আরবাজের ঘর থেকে এসে এখানে উপস্থিত হলো।কিন্তু শেহনাজ পারভীনের কথা শুনে সবার মুখের হাসি চলে গেল।কেননা উনি বললেন,

-“দেখো মেয়ে,আমার কোনো সাহায্য দরকার নেই।তুমি বরং সাধের দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরে চুপচাপ বসে থেকো।ভুলেও এদিকে এসো না।এটাই আমার জন্য বড় সাহায্য! ”

-“এসব কি বলছ মা?”

মীরার কথা শুনে নাজমা বেগম চোখ বড় বড় করে চোখ রাঙিয়ে বললেন,

-“বড়দের কথার মাঝে কথা বলিস না মীরা।জানিস না বন্ধাদের সাধের অনুষ্ঠানে থাকতে হয় না?এতে বাচ্চার ক্ষতি হলে তারপর কি হবে?”
-“কিসব কুসংস্কার!”(মীরা)

মেহের আর নিজেকে আটকাতে পারলো না।ডুকরে কেঁদে উঠলো।তারপর দৌড়ে ঘরে চলে গেল।আরবাজ মেহেরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…..