#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২০
আরবাজের ঘরে বেশ বড় বড় দুইটা জানালা।বিছানার পাশেই ইয়া বড় একটা জানালা।এজন্যই সকাল হতেই সেই জানালা থেকে অনেক রোদ এসে চোখমুখে পড়ে।
ঠিক তেমনই রোদ এসে মেহেরের চোখেমুখে পড়তেই মেহেরের ঘুম ভেঙে গেল।চোখ খুলে সে নিজেকে আরবাজের বুকের মাঝে আবিষ্কার করলো।শীতের চোটে আরবাজ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।
মেহের আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো যে ঠিক কয়টা বাজে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল মেহের।সকাল ৯ টা বেজে গেছে!
এতক্ষণ যাবত সে ঘুমাচ্ছিলো।মেহের চেষ্টা করলো আরবাজের হাত সরাতে।কিন্তু এত ভারী হাত সে কিছুতেই সরাতে পারছে না।অবশেষে আর না পেরে মেহের ডাক দিলো আরবাজকে,
-“আরবাজ?উঠুননন।”
আরবাজ শুনলোও না। নড়বে তো দূর।মেহের আরবাজের হাত ঝাঁকিয়ে ডাকলো,
-“উঠুন না আরবাজ?”
আরবাজ এবার একটু নড়ে উঠলো।আরো কয়েকবার ডাক দিতেই আরবাজ মেহেরের দিকে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তাকালো।কিন্তু মেহেরকে এতটা কাছে দেখে আরবাজের ঘুম উবে গেল।তৎক্ষনাৎ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে বললো,
-“তুমি এখানে?”
ছাড়া পেয়ে মেহের ঠিকঠাক হয়ে বসলো।তারপর বললো,
-“আমি.. মানে…”
-“কয়টা বাজে?”
-“৯ টা।”
আরবাজের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।ফোন চেক করতে করতে বললো,
-“ওহ শিট!আমার অফিস আছে আজকে।”
বলতে বলতে আরবাজ বিছানা ছেড়ে নেমে গেল।মেহের উদগ্রীব হয়ে বললো,
-“আমাকে আগে বলতে পারতেন।”
-“নিজেই তো উঠছো নয়টায়।”
মেহের চুপ হয়ে গেল।আরবাজ ওয়াশরুমে চলে গেল।আর মেহের বাইরে থেকে আওয়াজ পাচ্ছে।হয়ত বাইরে বেশ আয়োজন চলছে।আরবাজ বের হতেই মেহের ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।কিন্তু মেহের বের হওয়ার পর আরবাজকে পেল না।শুধু বিছানার উপর একটা প্যাকেট দেখতে পেল।মেহের সেটায় হাত দিত না যদি না উপরে তার নাম লেখা থাকত।প্যাকেট টা খুলে মেহের অবাক হয়ে গেল।কি সুন্দর কলাপাতা রঙের একটা জামদানী। আর সাথে মেচিং ব্লাউজ।
মেহেরের মনে পড়ে গেল সেম প্যাকেটটা সে সেইদিন আরবাজকে আনতে দেখেছিল।তারমানে সেটা মেহেরের জন্যই ছিল!
আরবাজের জন্য মেহেরের মনে একটা ভালো লাগা কাজ করলো।সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।নিজেকে চেনাই যাচ্ছে না।চোখে কাজল পড়তে পড়তেই হঠাৎ দরজা খুলে আরবাজ ঢুকলো।আর বলতে লাগলো,
-“মেহের তুমি কি….”
বলতে বলতে আরবাজের কথাটা মুখেই আটকে গেল।আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহেরের দিকে।আরবাজকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মেহের কাজল টা ড্রেসিংটেবিলে রেখে আরবাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিছু বলবেন?”
আরবাজ ঢোক গিললো।এক পা এক পা করে মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো,আর বলতে লাগলো,
-“তুমি এটা কেন পড়েছ?”
মেহের হাসার চেষ্টা করে বললো,
-“আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি?মানে..শাড়িটা কি আমার নয়?”
আরবাজ মেহেরের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল।আরবাজের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই মেহেরের।তাই চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।আরবাজ ধীর গলায় বললো,
-“শাড়িটা তোমার জন্যই ছিল।”
মেহের চোখ তুলে তাকালো আরবাজের দিকে।আরবাজের সেই চোখে আজ মেহেরের জন্য অন্যকিছু দেখতে পারছে মেহের।আরবাজ আবেশিত গলায় বললো,
-“এতটা আকর্ষণীয় লাগবে জানলে তোমাকে দিতাম না পড়তে।”
মেহের হাই ভোল্টের ঝটকা খেয়ে বললো,
-“জ্বীইই?”
আরবাজের হুশ এলো।চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি?কিছু বলবে নাকি?”
-“আপনিই তো কি সব বলছেন।”
-“আমি?কই কি বললাম আমি।”
আরবাজ আমতাআমতা করে কথা বলছে।মেহের চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“কিসব বলছেন।আকর্ষণীয় লাগছে।আবার বলছন কেন পড়লাম।আরে বাবা আমার জন্য আনসেন তাহলে পড়লে সমস্যা আছে?”
আরবাজ না চাইতেও বারবার মেহেরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। এই মেয়েটার এতগুলো রূপ কেন?
-“আপনি না অফিস যান?”
বলতে বলতে মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো।আরবাজ ঠিক মেহেরের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।ধীর গলায় বললো,
-“আমি আজ যাচ্ছি না।”
-“ওমা কেন?”
-“সেটা তোমাকে বলতে যাব কেন?”
মেহের আরবাজের সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা ওটা বলছে।কিন্তু আরবাজের কোনো পাত্তাই নেই।সে আয়না দিয়ে মেহেরকে দেখতে ব্যস্ত।এতটা ফিলিং তার কোনোদিন ই কারোর জন্য হয়নি।যতটা মেহেরের জন্য হচ্ছে। মেহেরের শাড়িটা যেন মেহেরের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরবাজকে চুপ করে থাকতে দেখে মেহেরও চুপ হয়ে গেল।আয়না দিয়ে আরবাজকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পেল।আর বিরবির করলো,
-“আবারো কেমন করে দেখছে।লজ্জা করে আমার।”
আরবাজ আরেকটু কাছে চলে এলো মেহেরের।মেহের বলতে লাগলো,
-“কিছু কি বলবেন আপনি?”
-“….”
-“মিস্টার আরবাজ?”(রাগ নিয়ে)
আরবাজ মেহেরের কাঁধে হাত দিলো।তারপর বলে উঠলো,
-“আমি তোমায় কিছু বলতে চাই মেহের।”
মেহের পিছনে ফিরলো।কৌতুহল নিয়ে বললো,
-“কি বলতে চান?”
-“আমি তোমাকে….”
মেহের উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো,
-“হ্যা বলুন না।”
-“আমি তোমাকে…”
-“আপনি কি বলবেন না আমি চলে যাব?”(বিরক্ত হয়ে)
-“আমি তোমাকে এটাই বলতে চাই যে তোমাকে পেত্নীর মত লাগছে।”
মেহের রাগ নিয়ে তাকালো আরবাজের দিকে।
আর আরবাজ হো হো করে হেসে উঠলো।মেহের রাগ করে বলে উঠলো,
-“থাকুন আপনি।গেলাম আমি।”
বলে যেতে নিলেই হাতে হাত অনুভব করলো মেহের।কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরবাজের বুকে এসে পড়লো।চোখ তুলে আরবাজের চোখে চোখ রাখতেই আরবাজ মুচকি হেসে বললো,
-“তোমার শাড়ির উজ্জ্বলতা যেন আলোকে চুপে চুপে হার মানায়। প্রতিটি পাতা, প্রতিটি আঁচল যেন এক নতুন গল্প বলে, আর তুমি সেই গল্পের প্রধান চরিত্র। তোমার নরম হাসি, কোমল চলনে এই পৃথিবী যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তোমার উপস্থিতি এমন এক অপূর্ব মায়াজালে বাঁধে, যে কেউ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য।”
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।আরবাজের কথাগুলো শুনে সে বেশ অবাক হলো।মনের মধ্যে ভালোলাগার ঢেউ বয়ে গেল।লজ্জায় গাল দুটো লাল হতে লাগলো।নিম্ন স্বরে বললো,
-“বাহ!আপনি এত সুন্দর করে প্রশংসা করেন জানতাম না তো?”
আরবাজ বাঁকা হাসলো।মেহেরের চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“তোমার চুল, সেগুলি যেন জগতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অঙ্গীকার। সেগুলি যেন ঝরঝরে রাতের অন্ধকারে ভেসে আসা এক চাঁদের আলো। যখন তুমি হেঁটে চলে, শাড়ির প্রতিটি প্রান্তের সঙ্গে তোমার চুলের ঝাঁকুনি যেন এক অনির্বচনীয় সঙ্গীত তৈরি করে। তোমার চোখের দীপ্তি আর চুলের মোহনীয়তা, শাড়ির সঙ্গে মিলে এমন এক মূর্তির জন্ম দেয়, যা মনকে অমোঘভাবে আকর্ষণ করে।”
মেহেরের মনটা কেমন করে উঠছে।আরবাজের বলা প্রতিটি লাইন মনের মধ্যে ভালো লাগা সৃষ্টি করছে।আর শুনতে মন চাচ্ছে।মেহের হালকা হেসে বললো,
-“আর?”
-“আর? হাহ!”(হেসে)
-“হাসার কি হলো?”
-“আর তোমার চোখ দুটি যেন গভীর মহাসমুদ্রের মতো, যেখানে ডুবে যাওয়ার মতো এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে থাকে, যেন প্রতিটি দৃষ্টি মূর্ত হয়ে ওঠে, আর আমি তা অনুভব করতে থাকি। তোমার চোখের সেই চাহনি, যেন এক নরম ঝর্ণার মতো, হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে যায়, আর মনে হয়, পৃথিবীর সব রং ওই চোখের মধ্যেই আবদ্ধ। যখন তোমার চোখ আমার দিকে তাকায়, তখন সময় থেমে যায়, আর আমি শুধু সেই চোখের অন্তরালে হারিয়ে যেতে চাই।”
-“ইশশ!”
বলেই মেহের চোখ বন্ধ করে নিল।আরবাজ ফু দিয়ে মেহেরের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিলো। আর মেহের নিজের অজান্তেই আরবাজকে জড়িয়ে ধরে বসলো।
।
মেহের ঘর থেকে বের হতে না চাইলেও আরবাজ মেহেরের হাত ধরে বের করে নিয়ে এলো।সবাই সোফায় বসে ছিল।মেহেরকে দেখে মীরা হা হয়ে গেল।আর বলতে লাগলো,
-“এ কি রূপে ধরা দিলে সখি।”
আনিয়া মীরার হাতে চিমটি কেটে বললো,
-“এই আস্তে বলো।”
মেহের আরবাজের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।শেহনাজ পারভীন রাগী গলায় বললেন,
-“তোমাকে না বলেছিলাম আজ না বের হতে।”
-“আসলে আন্টি….”
শেহনাজ পারভীন নিজেই বলতে লাগলো,
-“ওহ হ্যা।এখন তো আমি কিছু বলতেও পারব না।ছেলেও এখন বউয়ের আঁচল ধরা শিখেছে।”
নাজমা বেগম বলতে লাগলেন,
-“দেখো মেহের।তুমি এসেছো,আমরা কিছু বলব না।কিন্তু আমার বউমার থেকে দূরে থাকো।”
মেহের মাথা নিচু করে ফেললো।আরবাজ বলতে লাগলো,
-“আমরা আজ বাসায় থাকছি না।তাই এসব বাজে কথা বলারও কোনো মানে হয় না খালামণি।আমার বউ এখানে থাকবেই না তাহলে তোমার বউমার কাছে যাবে কিভাবে।”
-“মুখ সামলে কথা বলিস আরবাজ।গতকালও তুই আমায় অনেক কথা বলেছিস।বেশি বাড় বেড়েছিস তাই না রে?এত দেমাগ কিসের তোর এই বউ নিয়ে?আগে তো ছিল না।আগে তো তোরও সহ্য হত না।”
-“সহ্য হত না বিষয়টা এমন না।সহ্য হয়ত তোমার হত না।কেননা আমি তোমার মেয়েকে বিয়ে না করে ওকে করেছিলাম।”
আনিয়া এটা শুনে অবাক হয়ে বললো,
-“মানে!”
-“হ্যা।খালামণি চেয়েছিলো তোকে আমার বউ করতে।”
-“হোয়াট নন্সেন্স।আমি আরবাজকে বড় ভাইয়ের মত ভাবি।ছোট থেকে ভালো বন্ধু আমরা।”
নাজমা বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
-“বিয়ে দিতে চেয়েছি তো কি হয়েছে? অন্যায় করেছি আমি?আপা! তোর ছেলে কিন্তু আমায় বারবার অপমান করছে।”
আনিয়া বলতে লাগলো,
-“আমি যেদেশে থাকি ওখানে আমার ফিয়ন্সে আছে।মাকে এখনো জানাইনি।কিন্তু এখন জানাতে বাধ্য হলাম।”
-“মানেটা কি আনিয়া। না জানিয়ে তুমি… ”
-“আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে মা।অন্তত এসব বিষয়ে আমায় জোর করো না।”
বলে আনিয়া চলে গেল সেখান থেকে।নাজমা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“দেখলি আপা!আমি এজন্যই তাড়াতাড়ি করে বিয়েটা দিতে চেয়েছিলাম।”
-“কাঁদিস না।সব দোষ এই বন্ধ্যাটার।এর জন্য আজ আমার ঘরে অশান্তি।”
আরবাজ এটা শুনে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহের বলে উঠলো,
-“লজ্জা করে না আপনার?”
শেহনাজ পারভীন অবাক হয়ে গেলেন।রাগী গলায় বললেন,
-“মানে?কিসব বলছ?”
-“যা বলছি একদম ঠিক বলছি।লজ্জা করে না আপনার?আপনি আপনার এসবের জন্য নিজের ছেলের কাছে ছোট হচ্ছেন। কথায় কথায় আমাকে এসব বন্ধ্যা বলে ডাকেন কেন?কে দিয়েছে আপনাকে এই অধিকার?”
শেহনাজ পারভীন রাগ নিয়ে চেয়ে আছে।নাজমা বেগম বলতে লাগলো,
-“ও বাবা গো।বোবার মুখে কথা ফুটেছে।তুই কিছু বলবি না আরবাজ?”
আরবাজ হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইলো
।আজ সে মেহেরকে ফুল সাপোর্ট করবে।হোক তার মা!ভুল তো ভুল ই।এতে যদি তাকে বউয়ের আঁচল ধরা শুনতে হয়,শুনবে!
চলবে….
#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২১
-“যদি নুন্যতম লজ্জাবোধ আপনার থাকতো তাহলে আপনি বারবার আমাকে এসব বলার সাহস পেতেন না আন্টি।ঠিক কতবার আপনাকে আংকেল কতকিছু বলেছে।এমনকি আপনার ছেলে পর্যন্ত এখন আপনার সমস্ত অন্যায়কে আর সহ্য করতে পারছে না।”
এমন সময় শাহীন খান ও এসে উপস্থিত হলো ড্রয়িংরুমে। শেহনাজ পারভীন তখনো চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নাজমা বেগমও কিছু বলছে না।
-“আমি মানছি আমার একটা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আপনারা বারংবার আমাকে এটা নিয়ে এভাবে খোঁচা দিতে পারেন না।আমি শুরু থেকে যাচ্ছি, আন্টি আমাকে এত এত কথা শোনান।কেন আন্টি?আগে তো আপনি আমাকে ভীষণ আদর করতেন।আমি আপনার হাসবেন্ডের বন্ধুর মেয়ে বলে?নাকি আদৌ আমাকে নিজের মেয়ের মত ভাবতেন বলুন তো।”
শাহীন খান শেহনাজ পারভীনের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
-“কি হয়েছে আবার?আচ্ছা,ঘরে অশান্তি না করে কি তোমরা থাকতে পারো না?”
-“আজ আমার একটু কথা বলতে দিন আংকেল। প্লিজ।দেখুন আন্টি,চুপ করে থাকার মত মেয়ে আমি না।নিজের ঘরে রাজকন্যার মত বড় হয়েছি।চাইলে প্রথম দিন থেকেই উত্তর দিতে পারতাম।দিইনি দুটো কারণে।এক তো আপনি আমার বড়।আর দ্বিতীয়ত,আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমার মা আমাকে ফোন করে বলেছিল যেন আমি আপনাদের সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করে নিই।”
আরবাজ প্রশ্ন করে বসলো,
-“ফোন কোথায় পেলে মেহের?”
-“আমার একটা বাটন ফোনও আছে।সেটা সবসময় আমি আমার ব্যাগে থাকে।”
শেহনাজ পারভীন শাহীন খান কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তোমার সামনে কতকিছু বলছে।আজও ওর হয়েই কথা বলবে?”
শাহীন খান কিছু বলার আগেই মেহের বলতে লাগলো,
-“আপনি ভুল করছেন আন্টি।আমার সাইড নেয়ার কারোরি দরকার নেই।আর নাজমা আন্টি,আপনি আমাকে ঠিক যতটা মিডল ক্লাস মনে করেন,আমি কিন্তু ততটা নই।আপনি আমাকে একটু বেশিই নিচু মনে করেন।আফসোস,আজ আমি আপনার মত উচ্চবিত্ত হতে পারলাম না।পারলে তো নিজের বোনের বাড়িতে মাসের ২০ দিন থাকতাম।তাও আবার ছেলের বউ নিয়ে।”
নাজমা বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
-“তুমি আমাকে এত বড় কথা বললে!দেখলি আপা?তোর বাসায় থাকতেও আমাকে খোঁটা শুনতে হচ্ছে। আমি কি তোমারটা খাই যে তুমি আমায় কথা শোনাচ্ছ। ”
-“সে হিসেবে তো আমিও বলতে পারি আন্টি।আমিও কিন্তু আপনাদের টা খাই না।আমার বরের টাকায় চলি।আমার শ্বাশুড়ির কথা নাহয় বাদ ই দিলাম।আপনার কিন্তু কোনো অধিকার নেই আমাকে এতকিছু বলার।”
-“তুমি অতিরিক্ত কথা বলছো।আমার বোনকে এতকিছু বলছো।আরবাজ! তুই এখনো চুপ করে থাকবি?”
-“আরবাজকে কিছু বলতে হবে বা আন্টি।আমি আপনাকে জাস্ট কিছু কথা বলব।আজ এমনিতেও সাধের অনুষ্ঠান।আমি সময় নষ্ট করব না।একটু পর মেহমান আসবে।”
-“কি বলবে তুমি?কি বলতে বাকি রেখেছো?”
শেহনাজ পারভীনের এমন কথা শুনে মেহের হালকা হাসলো।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আন্টি,আপনি সবসময় চেয়েছিলেন ঘরে একটা ভালো বউ আনতে।মূলত ভালো বউ না,এমন বউ যে কিনা আপনাকে নাতি-নাতনি দিতে পারবে।”
-“দেখো মেয়ে,সব মায়েদের ই এমনই ইচ্ছে থাকে।বউমা আসবে, নাতি-নাতনি হবে।”
-“সেটা আমি জানি আন্টি।কিন্তু আমার দিকটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন আপনি?কখনো আমার জায়গায় নিজেকে একটু বসিয়ে দেখুন।যদি আপনার সাথে এমন হত আর আপনার বিয়ের পরদিন থেকে আপনার শ্বাশুড়ি এমন জরত তাও বাহিরের একজন মহিলা নিয়ে কেমন লাগত আপনার?”
নাজমা বেগম আবারো ফুঁসে ওঠে বললেন,
-“দেখলি,আবার আমাকে বাজে কথা বলছে।থাকবোই না আমি।”
কথাগুলো শেহনাজ পারভীনের কর্ণপাত হলো কিনা বোঝা গেল না।মেহের আবার বলতে লাগলো,
-“আল্লাহ না করুন,আজ যদি আপনার মেয়ের সাথে এমন হত?একটা বাচ্চাই কি সব আন্টি?আমি কি কম কাঁদি?আপনি যেমন রেগে আছেন,আমি তেমন কষ্ট পাচ্ছি। একজন মেয়ের জন্য সবচেয়ে সম্মানের হলো মা হওয়া।আর আমি সেই ফ..ফিলিং ট..টা ক..ক..কখনো পাব না।আ..আমার কি ক..কষ্ট হচ্ছে না?”
বলতে বলতে মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। শেহনাজ পারভীন তখনো চুপ করে রইলেন।মেহের নিজেকে সামলে নিল। তারপর চোখ মুছে বললো,
-“যাক গে সেসব। আপনারা মনে করেন যে মা হতে না পারাটা আমার ব্যার্থতা।কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে নিজের ভাগ্য লিখিনি।উপরওয়ালা আমার ভাগ্যে লিখেছেন।লিখেছেন আরবাজের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা।লিখেছেন, আমি ঠিক কিভাবে অপমানিত হব সেসব। কিন্তু নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ।আমি জানি,আল্লাহ হয়ত আমার জন্য ভালো কিছুই লিখে রেখেছেন।”
মীরারও চোখে পানি চলে এলো মেহেরের এমন কান্না শুনে। মেহেরের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে দুই হাত দিয়ে মীরা বলে উঠলো,
-“কেঁদো না ভাবী।”
মেহের নাক টেনে বললো,
-“যেখানে মায়েরা মেয়ের কষ্ট বোঝে না সেখানে মেয়েরা আর কতক্ষণ টিকবে?আমার জার্নিটা এই অবধিই ছিল।আপনারা ভালো থাকবেন আন্টি।আমি চলে যাব নিজের বাসায়।তাও আজই।আপনাদের শুভ কাজের মধ্যে আমি অশুভ হয়ে থাকতে চাই না।আপনারা ভালো থাকুন এটাই চাই।কারণ মেয়ে হয়ে তো মায়ের খারাপ চাইতে পারি না।এসেছিলাম তো বউ হয়েই।মুখে যতই আন্টি বলি,ভাবি তো মা-ই।”
নাজমা বেগম অবাক আর খুশি হয়ে বললেন,
-“সত্যি তুমি চলে যাবে?”
-“জ্বী আন্টি।চলে যাব আমি।”
মীরা অবাক হয়ে বললো,
-“এসব তুমি কি বলছো ভাবী?চলে যাবে কেন?”
-“এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে মেহের।”
শাহীন খানের কথা শুনে মেহের ওনার দিকে এগিয়ে গেলো।তারপর বললো,
-“আপনি সবসময় আমাকে নিজের মেয়ের মত ভেবেছেন।আপনার প্রতি আমার অনেক ঋণ।আপনি
চেয়েছিলেন আমি যেন হাজার অপমানের পরেও এখানে টিকে থাকতে পারি।কেননা এটা আমার সংসার।কিন্তু বাবা,যেখানে আমি অপয়া,অশুভ।আর সেটা মায়েরা নিজেরাই বলেন।মা হয়ে কষ্ট বোঝেন না।সেখানে আমি কি করে থাকব?”
-“তাই বলে তুই চলে যাবি মা?তোকে আমি কত আশা দিয়ে এনেছি।তোর বাবা-মায়ের কত আশা যে আমি তোকে আমার বাড়ির রাণী করে রাখব।”
-“রাণী তো হবই।হয়ত নিজের ঘরে।এটা তো আমার ঘর না।এতদিন ভাবতাম আমি আমার ঘর।কিন্তু আমার না।”
-“আমি কি বলব বুঝতে পারছি না।শুধু চাই,তুই যাস না।”
-“থেকে কি করব বাবা?”
-“সংসার করবি।আরবাজ আছে।”
-“সংসার টা আর আমার হবে না আংকেল।যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমি থাকব না।আমি এখনই লাগেজ আনছি।গোছানোই ছিল।”
বলতে বলতে মেহের চলে গেল ঘরের দিকে। শেহনাজ পারভীন চুপ করে বসে পড়লেন সোফায়।নাজমা বেগম বলতে লাগলেন,
-“আপা,এবার তো আরো ভালোই হলো।পথের কাটা নিজেই সরে গেল।”
শেহনাজ পারভীন হাতের ইশারায় ওনাকে থামিয়ে বললেন,
-“একটু চুপ কর।”
শাহীন খান বলতে লাগলেন,
-“এতকিছুর পরেও যদি তুমি ঘরের লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর মধ্যে পার্থক্য না করতে পারো শেহনাজ।আ
তাহলে বুঝে নেব এতদিন আমি একটা পাথরের সাথে সংসার করেছি।”
বলেই চলে গেলেন মেহেরের ঘরে।শেহনাজ পারভীন ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আরবাজ তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।মীরা আরবাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,
-“চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
-“…..”
-“তোরও তো আনন্দ হওয়ার কথা।”
-“মানে?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“তুই হয়ত মানবতার খাতিরে ভাবীর জন্য প্রতিবাদ করেছিস।কিন্তু কখনো কি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিস?”
-“ছোট, ছোটর মত থাক মীরা।”
-“এতটাও ছোট না আমি ভাইয়া।ভাবীকে রোজ কাঁদতে দেখেছি আমি।মেয়েটা তো তোর সাথে সংসার করতেই চেয়েছিলো।দেখ,বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এমনিতেও কোনোদিন তো বিয়ে করতিই।তখন কি মানিয়ে নিতিস না?তাহলে এই মেয়েটা কি দোষ করেছে?ওর দোষ কি ওই একটাই?মা হতে পারবে না।তুইও তো তাহলে আমার মায়ের মতই হলি।”
-“না জেনে না বুঝে কিছু বলবি না।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
-“আমি সবটাই জানি।তুই তোর অহংকারের জন্য নিজের ফিলিং টা প্রকাশ করছিস না।তুই কি ভালোবাসিস না ভাবীকে? আমি ছবি দেখেছি তোর ফোনে।”
আরবাজ আশ্চর্য হয়ে গেল মীরার কথা শুনে।মীরা হালকা হেসে বললো,
-“ভালো যদি বেসেই থাকিস,তাহলে বলে দেখ না।দেখ মেয়েটাও তোকে কতটা আপন করে নেয়।যদি তুই একবার ভালোবাসিস ওকে,তাহলে শত লাঞ্ছনার পরেও ও এখানে পড়ে থাকবে! ”
-“…..”
-“ভাবীর মত মেয়ে হয় না। ও চলে যাবে।তুই আটকাবি না?”
-“চলে যেতে চাইলে আমি আটকে কি করব?”
-“ওহ হ্যা তাই তো।তুই তো আর ভালোবাসিস না।কিন্তু আমি চাই মেহের আপুর জীবনে ভালোবাসার মানুষ আসুক।”
আরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল।তারপর বললো,
-“তুই ওকে আপু ডাকছিস কেন আবার?”
-“ও চলে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই কোনো একদিন না একদিন ওর জীবনে ভালো একজন মানুষ আসবে। তাই এখন থেকেই আপু ডাকার প্রেকটিস করছি।ভাবী তো ডাকতে পারব না।”
-“ভালো মানুষ আসবে মানে? “(অবাক হয়ে)
-“ন্যাকা সাজিস না ভাইয়া।ও কি তোর জন্য সারাজীবন বসে থাকবে নাকি?”
-“মানেটা কি?”
-“ও সংসার করবে না?”
-“…..”
-“আই ওইশ ওর জীবনে এমন কেউ আসুক যে ওকে মর্যাদা দিবে।সম্মান দিবে আর অনেক ভালোবাসবে!”
মীরার কথা শুনে আরবাজ চুপ হয়ে গেল।মেহের ওর সামনে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল।আরবাজ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুই বললো না।তবে মীরার কথাগুলো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মেহের যাওয়ার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে বললো,
-“আরবাজ?”
আরবাজ মাথা তুলে তাকালো মেহেরের দিকে।আরবাজ ভাবলো মেহের হয়ত তাকে ভালোবাসে।কিন্তু মেহের বলে উঠলো,
-“ভালো থাকবেন।আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না।আর ডিভোর্স লেটার টা পাঠিয়ে দিয়েন।আজ থেকে আপনাকে মুক্ত করে দিলাম।আর কোনোদিন আপনার আমার জন্য কিছু করতে হবে না।সেদিন আমার হয়ে কথা বলার জন্য থ্যাংকস।জানি,আপনি আমার সম্মান বাঁচাতে সেদিন এতকিছু করেছিলেন।আর আন্টি?”
শেহনাজ পারভীন মুখ তুলে তাকালো মেহেরের দিকে।মেহের চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-“হয়ত অনেক বাজে কথা বলেছি,অপমানও করে ফেলেছি।মাফ করে দিয়েন।আপনার ছেলে আপনারই থাকলো।আসি আংকেল।বায় মীরা।”
বলে মেহের কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।মীরা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।সবার সামনে দাঁড়িয়ে তার মা আর আরবাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“হয়েছে শান্তি?এবারে থাকো শান্তিতে।বাবা,আমি হোস্টেল যাচ্ছি,তুমি ব্যবস্থা করো।”
বলে মীরাও কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।আরবাজ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।আজ তার নিজেকে ভীষণ একা লাগছে।এতটা একা তার কোনোদিন লাগে নি।কেমন হচ্ছে এমনটা?বুকের ভিতরটা যেন কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ভারী পাথর রেখে দিছে।
চলবে….