#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২৪
সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আরবাজের বুকের মধ্যে আবিষ্কার করলো মেহের।পিটপিট করে চোখ খুলে আরবাজের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আরবাজ গভীর ঘুমে মগ্ন।
তার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ মেহের শুনতে পারছে।নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো মেহের।নিজের গা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল টা নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে মেহের এসে দাঁড়িয়ে গেল আয়নার সামনে।মেহের চুল ঝাড়তে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আরবাজ কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে টেরও পায়নি।মেহের চুল ঝাড়তে ঝাড়তে পিছনে ফিরতেই চুলের পানির ছিটা পড়লো আরবাজের মুখের উপর।আরবাজ চোখ বন্ধ করে ফেললো।মেহের অবাক হয়ে বললো,
-“আপনি!”
আরবাজ চোখ খুলে মেহেরের আঁচল টেনে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
-“আমি নয়ত কে?”
মেহের নিজের আঁচল টা টেনে নিলো।আবারো চুল ঝাড়তে ব্যস্ত হয়ে বললো,
-“উঠেই যেহেতু গেছেন তাহলে ফ্রেশ হয়ে….”
এতটুকু বলতেই আরবাজ মেহেরের হাত টেনে মেহেরকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।কোমড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে মেহের আরবাজের খানিকটা কাছে চলে এলো।আমতাআমতা করে বললো,
-“ক..কি হচ্ছে!”
আরবাজ মেহেরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মেহেরের ভেজা চুলের কিছু অবাধ্য চুল তার গাল বেয়ে গলা স্পর্শ করেছে।মেহের আরবাজের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।অদ্ভুত লজ্জা হচ্ছে তার।আরবাজের চোখের ভাষাটাই যেন বদলে গেছে। আরবাজ বিনাবাক্যে একটু একটু করে মেহেরের দিকে এগিয়ে আসছে।মেহের ধীর গলায় বললো,
-“আ..আপনি…”
-“শশশ।ডোন্ট ডিস্টার্ব!”
মেহের আরবাজের দিকে তাকালো। আরবাজের চোখে চোখ পড়তেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে।আরবাজের চোখে মায়ায় বশ হতে লাগলো।পরমুহূর্তেই ঠোঁটে ভেজা স্পর্শ অনুভব করতেই মেহেরের চোখ বন্ধ হয়ে গেল।হাতে টাওয়াল টা পড়ে গেল।কাঁপা কাঁপা হাতে আঁকড়ে ধরলো আরবাজের নগ্ন পিঠ।আরবাজের হাত মেহেরে কোমড় ছাড়িয়ে গালে গিয়ে পড়লো।আরবাজের মনে হলো,মুহুর্তটা এখানেই থেমে যাক।আর মেহেরের মন চাইছে লজ্জায় আরবাজের বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে।
।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রান্না করছিলো মেহের।সেই কখন থেকে আরবাজ তাকে জ্বালিয়েই যাচ্ছে।সে নাকি এসেছে মেহেরকে সাহায্য করতে।মোটেও সে মেহেরকে সাহায্য করছে না।মেহেরের কাজে আরো সময় লাগাচ্ছে। এই গাল ধরে টানছে তো এই চুল ধরে টানছে।কোমড়ে চিমটি কাটছে।এ নিয়ে বেজায় রেগে মেহের।শেষমেশ খুন্তি উঁচিয়ে বললো,
-“আপনি কি চুপ করে দাঁড়াবেন না আমি এটা লাগিয়ে দিব?”
মেহেরের এহেন রূপ দেখে আরবাজ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।তারপর ঢোক গিলে বললো,
-“এমন করছ কেন?”
-“তো কেমন করব শুনি?আমাকে একটা কাজও করতে দিচ্ছেন আপনি বলুন তো?কি শুরু করেছেন!”
-“আমি কি করলাম তোমায়?একটু তো পাশে দাঁড়িয়েই আছি।”
আরবাজকে প্রশ্রয় দেয়াটাই উচিত হয়নি।এখন মেহেরকে জ্বালিয়ে মারছে।এই ভেবেই মেহের বারবার কপাল চাপড়ে চলেছে। আরবাজ চুপচাপ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরের পাশে।আর মেহের রান্না করছে।হঠাৎ মেহেরের চোখ পড়লো আরবাজের উপর।আরবাজকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে? মুড অফ কেন?”
-“তুমিই তো বারণ করলে।”(গম্ভীর গলায়)
-“আমি দুষ্টুমি করতে বারণ করেছি আরবাজ। কথা বলতে নয়।”
-“হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না তোমার।”
মেহের আড়চোখে তাকাচ্ছে আরবাজের দিকে।আরবাজ ভ্রু কুঁচকে হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আর কি কিছু খাবেন?নাকি এগুলোতেই হবে?”
-“দেখো তুমি যা ভালো বুঝো।”
-“এমন অফ মুডে গেলে হবে?”
-“তোমার কি?তোমাকে তো আর জ্বালাচ্ছি না।”(গাল ফুলিয়ে)
-“ওহ আচ্ছা তাইইইই?”(মজা করে)
আরবাজ মেহেরের দিকে রাগী চোখে তাকালো।আর মেহের হেসে দিলো।তারপর গ্যাস টা বন্ধ করে আরবাজের দিকে তাকালো।আরবাজকে নিজের দিকে ফিরিয়ে গলায় হাত বাঁধতেই আরবাজ গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।মেহের হাসলো।আরবাজের গাল বরাবর ঠোঁট ছোঁয়াতেই আরবাজ অবাক চোখে তাকালো মেহেরের দিকে। মেহের লাজুক হাসি হাসলো।আরবাজ এগিয়ে এলো মেহেরের দিকে।গালে হাত দিয়ে মেহেরকে কাছে টেনে নিতেই অমনি কলিং বেল বেজে উঠলো। এর শব্দে আরবাজ মেহেরকে ছেড়ে দিলো। মেহের আরবাজের দিকে না তাকিয়েই বললো,
-“কে এলো এখন?”
আরবাজ মাথা চুলকে বললো,
-“আসার আর সময় পেল না।”
মেহের চাপা হেসে কাজে মন দিল।আরেকবার কলিং বেল বাজতেই আরবাজ এগিয়ে গেল দরজার দিকে।দরজা খুলতেই শেহনাজ পারভীন কে দেখতে পেয়ে আরবাজের হাসিটা মিলিয়ে গেল।পাশে শাহীন খানও রয়েছে। কিন্তু কিছু বলছেন না।শেহনাজ পারভীন এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন,
-“কেমন আছিস তুই বাবা?”
আরবাজ তার বাবার দিকে তাকালো। শেহনাজ পারভীন হু হু করে কাঁদছেন। মায়ের এমন কান্না আর সহ্য হচ্ছে না আরবাজের।তাই পিছনে ঘুরে গেল সে।মেহের এগিয়ে আসতে আসতে বলছে,
-“কে এসেছে আরবাজ?”
বলতে বলতে দরজার সামনে এসে থেমে গেল মেহের।
শেহনাজ পারভীন কে দেখে সে চুপ হয়ে গেল।চোখ পড়লো আরবাজের উপর।আরবাজ অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে।শেহনাজ পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
-“মেহের!আমাকে মাফ করে দাও না মা।আমি পারছি না আমার ছেলেটাকে ছাড়া থাকতে।এ কদিনে তোমার প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছে আমার।পুরো ঘর শূন্য লাগে আমার।যেই মেয়েটা সারাঘর ঘুরে বেড়াত,সেই ঘরের লক্ষ্মী নেই।আমার পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।পুরো নিরব!”
মেহের চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আরবাজ ঘরের ভিতর চলে যাচ্ছে এটা দেখে শেহনাজ পারভীন ছুটে গিয়ে ছেলের হাত জড়িয়ে বলতে লাগলেন,
-“বাবা তুই এমন করিস না বাবা।এভাবে মায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিস না।এইযে এতগুলো দিন আমার থেকে তোরা দুজন দূরে থেকে যে শাস্তি দিলি এটা কি কম কিছু বাবা?”
আরবাজ গম্ভীর গলায় বললো,
-“এখানে কেন এসেছ মা?”
-“তোদের জন্য এসেছি।আমি পারছি না তোদের ছাড়া থাকতে।তোর বাবা আমায় আনতে চায়নি।আমি জোর করে এসেছি। আমায় ফিরিয়ে দিস না বাবা।চল না আমাদের সাথে বাড়ি চল।”
তারপর মেহেরের কাছে এসে বলতে লাগলেন,
-“চলো না মেহের।আমার বাড়িতে চলো।”
মেহের তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
-“আমার মত অলক্ষ্মী কে আপনি কেন ঘরে ঢোকাবেন?”
-“এ কথা বলো না মা।তুমিই তো আমার ঘরের লক্ষ্মী। তুমি চলে যাওয়ার পরেই আমার পুরো ঘরে কেমন একটা নিরবতা,কেমন খা খা করছে।আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।”
মেহের চুপচাপ আরবাজের দিকে তাকিয়ে আছে। আরবাজ তার মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে ঘরে চলে যেতে চাইছে।কিন্তু তবুও পারছে না।শেহনাজ পারভীন আবার বলতে লাগলেন,
-“রাতে আমি ঘুমাতে পারি না।আমার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে দেখো।ঘুমালেই সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে।তুমি যে বলেছিলে তোমার জায়গায় আমার মেয়েকে বসাতে!আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি মা।
নাজমার কথায় এসে আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আসলে সংসারে তৃতীয় ব্যক্তি থাকলেই ঝামেলা।আমি এটা এতদিন বুঝিনি।প্রথমে যখন নাজমা এটা ওটা বললো আর বললো যে তুমি বাচ্চা দিতে পারবে না হ্যানত্যান তখন আমি রেগে তোমাকে যা নয় তাই বলেছি।কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তোমার প্রতি আমার মায়া জন্মে।কিন্তু এরপর যখন আবার আসে তখন আমার মনে এমন একটা কথা ঢুকায় যাতে আমি তোমাকে ভুল বুঝি।ও এবার এটা বলে ব্রেইন ওয়াশ করে যে তুমি আমার ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছ।”
মেহেরের চোখ ভরে আসছে নিজের প্রতি করা অন্যায়গুলো মনে করছে।তবুও নিজেকে সামলে আঁটকে আসা গলায় বললো,
-“ছেলেকে কি কেউ কখনো কেড়ে নিতে পারে?”
-“না মা কেউ পারে না।আমিই ওকে দূরে সরিয়েছি।
মা তুমি ঘরে ফিরে চলো।এসব বাচ্চা-কাচ্চা সব মনগড়া।আমার এসব চাই না।আমার চাই একটা সুখী পরিবার।তুমি আমার মেয়ে আর আমি তোমার মা।এটাই যথেষ্ট আমার জন্য। আমাকে মাফ করে দাও মা।”
কথাটা শেষ হতেই মেহের শেহনাজ পারভীনের হাত ধরে আরবাজের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,
-“আর কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবেন?মা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে আরবাজ।দেখুন মা কত কাঁদছে। যতই হোক!আমরাও তো সন্তান।মায়ের কান্না কি করে সহ্য করছেন আপনি?”
শাহীন খান এতক্ষণ চুপ ছিলেন।এবার বলতে লাগলেন,
-“শেহনাজ কোনোদিন কারোর সাথে অন্যায় করেনি।কিন্তু হঠাৎ মেহেরের প্রতি এমন আচরণে আমি অবাক আর অসন্তুষ্ট ছিলাম। ওর থেকে এটা আশা করিনি।ভেবেছিলাম না বলে বিয়ে করিয়ে এনেছি,তাই হয়ত।হয়ত আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু পরে বুঝলাম নাজমা চেয়েছে আনিয়ার সাথে বিয়ে দিতে।দিতে পারেনি,তাই এসব ঢুকিয়েছে মাথায়।
তোর মা অনেক কষ্ট পাচ্ছে রে আরবাজ।মেহের?
শেহনাজ তোর বাবার কাছে গিয়েও মাফ চেয়েছে।আমি চাইয়েছি ওকে দিয়ে।এটাই উচিত।ও নিজের ব্যবহারে অনুতপ্ত।”
শেহনাজ পারভীন নিজের চোখ মুছে বলতে লাগলেন,
-“আমি কালনাগিনী টাকে বের করে দিয়েছি।আর কোনোদিন ঢুকতে দিব না বাড়িতে।জানি না তোরা আমার কথা শুনে আমার সাথে আর থাকবি কিনা।কিন্তু পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস।
জীবনের আর কয়টা দিনই বা আছে বল তো আমার।
এইত অসুখে পরেছি।কয়েকদিন পর হয়ত….”
মেহের বলতে লাগলো,
-“আন্টি প্লিজ এসব বলবেন না।এখনো তো পুরো সংসার সাজানো বাকি আপনার।এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন কেন আপনি?এভাবে বলবেন না।”
মেহেরের বেশ মায়া হচ্ছে শেহনাজ পারভীন কে দেখে।আজ যদি তার মা এভাবে বলত?কেমন লাগত?
ভাবতেই মেহেরের খারাপ লাগছে।আর আরবাজও তো কষ্ট পাচ্ছে। একে তো একমাত্র ছেলে।তার উপর প্রথম সন্তান।মেহের খুব করে চাইছে যেন আরবাজ তার মাকে মাফ করে দেয়।কেননা মেহের শেহনাজ পারভীনের চোখে অপরাধবোধ টা দেখতে পারছে।মেহের কি পারবে না সবাইকে নিয়ে একটা সুখের সংসার সাজাতে?
চলবে…..