#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২৫
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। আরবাজ আর মেহের এখন তাদের আগের বাড়িতেই থাকে।মেহেরের সাথে শেহনাজ পারভীনের সম্পর্কটা এখন এত সুন্দর হয়েছে যে মাঝেমধ্যে মেহেরের বেশ গর্ব হয়।আর বারংবার আল্লাহ তায়ালার কাছে সে শুকরিয়া করে এই ভেবে যে তার শ্বাশুড়ির পরিবর্তন তার জন্য ভালো কিছুই এনেছে।সে তো জানতই কষ্টের পরেই সুখ!
তাই তো আজ সে শেহনাজ পারভীনের এত ভালোবাসা পাচ্ছে। প্রথম দিকে আরবাজ কথা না বললেও ধীরে ধীরে মেহেরের অনুরোধে সে সবটা মানিয়ে নেয়!
আজ বাড়িতে বেশ তোড়জোড় চলছে।মীরাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।তাই জন্য এটা-ওটা রান্না হচ্ছে। শেহনাজ পারভীন স্পেশালি মেহেরকে দায়িত্ব দিয়ে বলেছেন,
-“তোমার রান্না বেশ ভালো।তুমিই আজ রান্না করবে।ছেলেটা খুব ভালো।মীরাকে ভালো রাখবে।আমি চাই না সম্মন্ধ টা হাতছাড়া হোক।”
তাই তো মেহের সকাল থেকে রান্নাঘরে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে।আর বেচারা আরবাজ তিন চার বার ডেকে এসেও কিছুতেই মেহেরকে পাচ্ছে না।মূলত সে জানে না যে মেহেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার ধারণা মেহের তার থেকে দূরে দূরে থাকতেই এসব করছে।
এবার শেষবারের মত আরবাজ ঘর থেকে বের হয়ে ধূপ ধাপ আওয়াজে এসে সোফায় বসে পড়লো।
তার বাবা পত্রিকা পড়তে ব্যস্ত।আর শেহনাজ পারভীন টেবিলে বসে কাটাকুটি করছেব।আরবাজ রান্নাঘরের দিকে কোণাচোখে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
-“আজ কি কফি পাবো না আমি?”
শেহনাজ পারভীন ছেলের কথা শুনে বলতে লাগলেন,
-“এটা তোর কোন বেলার কফি?বারোটার সময়।”
-“আমার মন চাচ্ছে খেতে।”
-“তাহলে একটু করে নিয়ে খেয়ে নে না বাবা।দেখছিস তো আজ কত কাজ।”
আরবাজ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“সে মহারাণী কই মা?”
শাহীন খান বলতে লাগলেন,
-“তোর মত তো বসে নেই।অপদার্থ একটা।”
-“বাবা তুমি আমায় অপদার্থ বললে!তোমার কথায় আজ আমি অফিস ছুটি নিয়েছি।”
-“নিতে তো হবেই।তোর বোনোর বিয়ে।তোকে থাকতে হবে।”
আরবাজ আর কিছু বললো না।চুপচাপ বসে রইলো।অপেক্ষা করতে লাগলো মেহেরের বের হওয়ার।কিন্তু মেহের বের হচ্ছে না।শেহনাজ পারভীন ফল কাটছিলেন।তাই করতে করতে বললেন,
-“গিয়ে রান্নাঘরে বানিয়ে নে।”
আরবাজ উঠে দাঁড়ালো।তারপর পা বাড়ালো রান্নাঘরে। মেহের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুন্তি নাড়ছিল।আচমকা পেটে তীক্ষ্ণ স্পর্শ অনুভব করতেই মেহের আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলো,
-“আউউ!”
আরবাজ তৎক্ষনাৎ মেহেরের মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
-“আমি আমি!আস্তে আস্তে!”
মেহেরের ভ্রু কুঁচকে গেল।আরবাজের বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তারপর বললো,
-“আপনি এখানে কি করছেন হ্যা?আর আমার পেটে চিমটি দিলেন কেন?”
-“তুমি সকাল থেকে এখানে কি করছ?”
-“কাজ করছি দেখতে পারছেন না?আজ মীরাকে দেখতে আসবে।অনেক কাজ আমার।যান তো যান।বিরক্ত করবেন না।”
আরবাজ অবাক হয়ে বললো,
-“আমি তোমায় বিরক্ত করছি?তুমিই তো সকাল থেকে আমায় দেখা দিলে না।”
-“ঢং করবেন না তো।অনেক কাজ।যান।”
বলে মেহের আবার খুন্তি নাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল।আরবাজের বেশ রাগ হলো।মেহের কেন তাকে পাত্তা দিচ্ছে না?আরবাজ মেহেরের কোমড়ে হাত দিয়ে মেহেরকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
-“সুন্দর করে আমার কফি বানিয়ে আমার ঘরে চলে আসবেন।অপেক্ষা করছি।”
মেহের কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আরবাজ তার সুযোগ দিল না।মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
-“এক্ষুণি আসবে। রাইট নাউ!”
বলেই সে চলে গেল।অগত্যা মেহেরকে আরবাজের কথামত কাজ করতে হলো।কফি হাতে মেহের প্রবেশ করলো আরবাজের ঘরে।আরবাজ তখন বসে বসে ফোন দেখছিল।মেহেরকে আসতে দেখে বলতে লাগলো,
-“দরজাটা লাগিয়ে দিও।”
মেহের ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-“দরজা লাগাতে হবে কেন?এইযে আপনার কফি।আমি গেলাম।”
বলে মেহের চলে যাচ্ছিলো।আরবাজ তাড়াতাড়ি করে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।মেহের ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরবাজের দিকে। তারপর বললো,
-“কি হলো?সরুন।”
আরবাজ দরজা লাগিয়ে দিলো।মেহের কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
-“দেখুন আরবাজ!একদম ফাজলামো করবেন না কিন্তু আমার সাথে।সরুন না!”
আরবাজ মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-“ফাজলামো আমি না তুমি করছো?”
মেহের পিছাতে পিছাতে বললো,
-“আমি ফাজলামো কখন করলাম? ”
আরবাজ মেহেরকে টেনে নিজের কাছে এনে বললো,
-“এইযে তোমায় আমি সকাল থেকে খুঁজে মরছি সেই খেয়াল কি তোমার আছে?”
মেহের আরবাজের বুকে হাত রেখে ধীর গলায় বললো,
-“আমি তো আপনাকে বলিনি আমায় খুঁজতে আরবাজ!”
-“এত কথা বলো না তো।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।”
মেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর আরবাজ মেহেরকে দেখতে ব্যস্ত।মেহের বিরক্ত হয়ে বললো,
-“হয়েছে আপনার ফাজলামো?প্লিজ এবার ছাড়ুন আমাকে।”
আরবাজ বাঁকা হাসলো।মেহের চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরবাজের দিকে। আরবাজের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।মেহের বলতে লাগলো,
-“দেখুন আমার কিন্তু কাজ আ…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মেহের নিজের অধর জোড়ায় ভেজা স্পর্শ অনুভব করলো।মেহের যথাসম্ভব নিজের হাত দ্বারা আরবাজকে আঘাত করার মাধ্যমে আলাদা করার চেষ্টা করলো।কিন্তু আরবাজ নাছোড়বান্দা। সে তার হাত মেহেরের কোমড় থেকে সরিয়ে তার দুইহাত চেপে ধরলো।এবং মেহেরের হাত জোড়া আটকে গেল। মেহেরের মন চাচ্ছে এই মুহুর্তে আরবাজকে মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলতে।এই লোকটা তাকে সবসময় যন্ত্রণা দেয়।সেই রাগেই মেহের এক ভয়াবহ কাজ করে বসলো।আরবাজের নরম ওষ্ঠে কামড় বসিয়ে দিলো। আরবাজ মেহেরকে ছেড়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“এটা কি হলো?”
মেহের বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-“যা হওয়ার ছিল তাই হলো।”
-“এটা কিন্তু একদম ঠিক হলো না।”
-“দেখি সরুন এবার।আমায় যেতে দিন।”
বলে মেহের যেতে নিলে আরবাজ মেহেরকে আবারো আটকে দিয়ে বললো,
-“এত সহজে তো তোমায় আমি মু্ক্তি দিচ্ছি না।তেমার শাস্তি গ্রহণ করতে হবে।”
-“আইছে রে!আপনি সরবেন কি না!”
আরবাজ কিছু বলার আগেই দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
-“মেহের ভাবী! আমি শাড়ি পড়তে পারছি না। তাড়াতাড়ি এসো।
মেহের আওয়াজ দিলো,
-“আসছিইইই।”
কিন্তু আরবাজের জন্য সে মোটেও যেতে পারছে না।আরবাজ তাকে আটকে রেখেছে। এদিকে এত বড় হয়েও আরবাজের এ ধরণের বাচ্চামো মেহেরের মোটেই সহ্য হচ্ছে না।আরবাজ তখনো মেহেরকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
।
সেদিনই আরবাজের বন্ধু রাদিফের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল মীরার!মীরা নিজের মন থেকে সম্মতি জানালে বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেল।রাদিফের বড় বোন স্নেহা আরবাজকে বেশ পছন্দ করেন।একদম ছোট ভাইয়ের মত মনে করেন। তিনি পেশায় একজন ডাক্তার।এজন্যই সেদিন মেহেরের সাথে কথা বলার পর বাচ্চার কথা উঠলে মেহেরের কান্না দেখে উনি বলেছিলেন যেন ওনার চেম্বারে নিয়ে যায় আরবাজ মেহেরকে।আরবাজের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও যেতে বাধ্য হয়।আরবাজ চাচ্ছিল না মেহের মন খারাপ করুক এসব নিয়ে।তাই যেতে চাইছিল না।আরবাজ একদিন সোফায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে কাজ করছিল।ঠিক তখনই মেহেরের আগমন।সে এসে আরবাজের পায়ের কাছ দিয়ে বসে বলতে লাগলো,
-“আমার মন খারাপ!”
আরবাজ লেপটপে নজর রেখেই বললো,
-“কি মন খারাপ শুনি।আবার কি হলো?”
মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“আপনি আমার কোনো কথাই শুনেন না।”
-“কোনটা শুনি না মেহের?সবই তো শুনছি।বলো তুমি।”
-“আপনি এখনো লেপটপে ডুবে আছেন।”
বলে মেহের মুড অফ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।আরবাজ লেপটপ টা সাইডে রেখে সোজা হয়ে বসলো।সোফার মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
-“বলো শুনি!কি নিয়ে রাগ!”
-“আপনি কি শুনবেন আমার কথা?”
-“বলে দেখো।”(কাঁধে ঠোঁট ছুইয়ে)
-“বলছিলাম যে সেদিন যে স্নেহা আপু বলেছিল….”
আরবাজ মেহেরকে ছেড়ে দিলো। গম্ভীর গলায় বললো,
-“আমরা যাচ্ছি না।”
-“দেখলেন তো!না করে দিলেন।আপনি শোনেন আমার কথা?”
বলেই মেহের কাঁদতে বসলো।আরবাজ থতমত খেয়ে গেল।আবারো মেহেরকে পিছন থেকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,
-“দেখে মেহের,তুমি সেখানে যাবে।তারপর আবারো এসব শুনবে।তারপর আবারো কাঁদবে।আমার চাই না বাচ্চা।তুমি হলেই চলবে আমার।”
-“কিন্তু আমার তো চাই।”
-“তারমানে তোমার আমাকে চাই না তাই তো!”
-“সে কথা কখন বললাম আমি?আপনি ইচ্ছে করে কথা ঘোরাচ্ছেন। চলুন না যাই।”
-“কেন জেদ করছো মেহের?এরপর তুমি কাঁদবে।তোমার কান্না আমার ভালো লাগবে না।”
-“কাঁদব না সত্যি।”
-“আমি যাচ্ছি না।”
মেহের এক প্রকার জোর করেই আরবাজকে নিয়ে যায়। বেশ কিছু টেস্ট করিয়ে স্নেহার সামনে এসে বসলো আরবাজ আর মেহের।স্নেহা রিপোর্ট গুলো চেক করতে করতে বললো,
-“আচ্ছা মেহের,তুমি যে মা হতে পারবে না এ কথাটা তোমায় কে বলেছিল?”
মেহের একনজর আরবাজের দিকে তাকালো।আরবাজ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।তার ভাবটা এমন যে,
-“অনেক না করেছি আসতে।এখন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদলে আমার কিছু করার নেই।”
মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আপনাকে তো বললামই আপু।আমার বিয়ের দিন হঠাৎ এইযে এই রিপোর্ট টা এনে বলেছিল যে এখানে নাকি দেয়া আমি মা হতে পারব না।”
স্নেহা হাসলো।তারপর বলতে লাগলো,
-“মা হতে পারবে না কেন?অবশ্যই হতে পারবে।এসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গেলে তো উল্টাপাল্টা রিপোর্ট দিবেই।”
মেহের অবাক হয়ে গেল।খুশিতে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।আরবাজ একবার মেহেরের দিকে তাকালো।তারপর স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সত্যি মা হতে পারবে?”
-“হ্যা পারবে।তবে ওর চিকিৎসা করতে হবে।”
-“চিকিৎসা? ”
-“হ্যা।ওর এন্ডোমেট্রিওসিস হয়েছে। তবে সেটা মাঝারি।চিকিৎসা করলেই সফলতা আসা সম্ভব।তবে খুব দ্রুত করতে হবে। নাহলে বেড়ে গেলে পরে বাচ্চা নেয়া ডিফিকাল্ট।”
মেহেরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।আরবাজ কি বলবে বুঝতে পারছে।সে শুধু স্নেহার সাথে কথা বলে কবে কি করতে হবে তাই জানতে চাইছে।মেহের মনে মনে শুধু ভাবছে,
-“এতদিনে আমার বন্ধ্যা নামটা ঘুচলো।”
চলবে….