প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব-০৬

0
3

#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৬

খাবার টেবিলে বসা মাত্রই আরবাজ খেয়াল করলো মেহের অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।সবাই খেতে বসে গেছে। আরবাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাহীন খান বলে উঠলেন,

-“মেহের?তুমি দূরে কেন!তুমিও এসে বসে পড়ো মা!”

মেহের একবার তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো।উনি বেশ গম্ভীর ভাবে খাবার বাড়তে ব্যস্ত।নাজমা বেগম তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের প্লেটে রুটি দিচ্ছেন।মেহের জোরপূর্বক হেসে বললো,

-“না আংকেল আমি পরে খেয়ে নিব।মীরাও তো বাকি এখনো।”

বলেই মীরার ঘরের দিকে চলে গেল।শাহীন খান আর কিছু বললেন না।তিনি ভালোই বুঝতে পারলেন যে মেয়েটা শেহনাজ পারভীনকে ভয় পেয়েই খেতে বসেনি।কেননা কথার জ্বালা বড় জ্বালা!এরচেয়ে দুবেলা না খেয়ে থাকা ভালো।কিন্তু খেতে বসে কথা শুনলে সেটা এমনভাবে আঘাত করে যে কলিজা ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হয়।
আরবাজও আর কিছু না বলে খাওয়া শুরু করলো।
শাহীন খান বলতে লাগলেন,

-“আরো কয়েকদিন থাকতে পারতে তোমরা শরিফ।”

নাজমা বেগম খুশি হয়ে বললেন,

-“আমিও কিছুদিন আমার বোনের সাথে থাকতে….”

নাজমা বেগমের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আয়শা বলে উঠলো,

-“আমাদের এবার বাসায় যাওয়া উচিত।এমনিতেও আমার অনেক ধকল গেছে।”

নাজমা বেগম চুপ হয়ে গেলেন।শরিফ বলতে লাগলো,

-“আমারো ছুটি শেষ প্রায়। আর বাকি দুদিন আমি ভাবছি আয়শাকে সময় দিব।”

শাহীন খান হেসে সায় দিলেন।নাজমা বেগম আর কিছু বললেন না।মীরা আর মেহের গল্প করতে করতে এসে উপস্থিত হলো টেবিলের সামনে।এদিকে আরবাজের ঘাড় খানিকটা বাঁকানো দেখে শরিফ বলেই বসলো,

-“তুই এমন ঘাড় বেঁকিয়ে আছিস কেন ভাই?”

মেহের সেখানেই ছিল।হঠাৎ মুখ ফসকে বলে বসলো,

-“আসলে উনি ঘাড়ত্যাড়া তো!তাই আল্লাহ সত্যি সত্যি…”

এতটুকু বলে জিভে দাঁত কাটলো মেহের।মীরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।তারপর ফিক করে হেসে দিলো।এমনকি আয়শা,শরিফ আর শাহীন খান হেসে ফেললেন।নাজমা বেগম মুখ চেপে হাসছেন।আরবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেহেরের দিকে।দেখা গেলো শেহনাজ পারভীন রাগ নিয়ে বললেন,

-“তুমি আমার ছেলেকে ঘাড়ত্যাড়া বলো কোন সাহসে?”

মেহের চুপ করে মাথা নিচু করে ফেললো।শেহনাজ পারভীন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“তুই খা তো বাবা।”

আরবাজ মেহেরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো।আয়শা তবুও হাসি হাসি মুখে সুধালো,

-“এই আরবাজ!বলছি তোমার ঘাড়টা বেঁকে গেছে কিভাবে?মানে কারণটা কি?”

কথার মাঝেই মীরা এসে মেহেরকে চেয়ারে বসালো।নিজের পাশে বসতে বসতে বললো,

-“মনে হয় রগে টান খাইছে।তাই না ভাইয়া?”

আরবাজ গম্ভীর গলায় বললো,

-“এক সাইড হয়ে শুয়েছিলাম!”

বিষয়টা এখানেই স্টপ হয়ে গেল।সবাই যে যার মত খেয়ে উঠে গেল।শরিফ তার স্ত্রী কে নিয়ে ঘরে চলে গেল,কেননা ওর রেস্টের প্রয়োজন।শুধু মীরা আর মেহের খাচ্ছে। আর গল্প করছে।শেহনাজ পারভীন ছেলেকে বিদায় দিয়ে টেবিলের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।শাহীন খান তখনো সোফায় বসে টিভি দেখছেন।শেহনাজ পারভীন টেবিলে থাকা প্লেটগুলো তুলতে তুলতে বললেন,

-“বলছি,আজ তো বিকেলে ওরা চলে যাবে।তাই বাজার থেকে একটা বড় দেখে ইলিশ মাছ এনো তো।”

নাজমা বেগম তখন সেখানেই ছিলেন।উনিও সায় দিয়ে বললেন,

-“হ্যা রে আপা,আমার না সর্ষে ইলিশ খেতে মন চাইছে।”

মীরা কি যেন কথা বলছিলো মেহেরকে উদ্দেশ্য করে।মেহের হাত দিয়ে ইশারা করে সেটা থামিয়ে নাজমা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“আন্টি,আমি রান্না করে দিব?”

নাজমা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

-“তুমি সর্ষে ইলিশ রাঁধতে জানো?”
-“জ্বী মোটামুটি সব রান্নাই জানি।”

নাজমা বেগম তার বোনের দিকে তাকালেন।শেহনাজ পারভীন ভ্রু কুঁচকে তখনো প্লেট তুলছেন।প্লেট তোলা শেষে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

-“আমি আমার রান্নাঘরে কাউকে ঢুকতে দিব না।”

মেহেরের হাসিটা মিলিয়ে গেল।সে মাথা নিচু করে ফেললো।শাহীন খান তখন টিভি থেকে চোখ সরিয়ে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“তুমি আসলেই রাঁধতে পারো মা?”
-“জ্বী আংকেল।”
-“শেহনাজ!ওকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো।”

শেহনাজ পারভীন রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিলেন,

-“আমি আমার রান্নাঘরে কাউকে ঢুকতে দিব না বললাম তো!আর মেহেরের রান্না করা খাবার আমি আয়শাকেও খেতে দিব না।”

মীরা পাশ থেকে বলে উঠলো,

-“মা!বলছি যে খেয়েই দেখি না কেমন রাঁধতে পারে নতুন ভাবী।আর এসব কুসংস্কার মানার তো কোন মানে নেই।”

শেহনাজ পারভীন রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে মীরাকে বকতে লাগলেন।মীরা চুপ হয়ে গেল।নাজমা বেগম আর কিছু বলছেন না। নিজের মত করে টিভি দেখছেন সোফার পাশে দাঁড়িয়ে ।শাহীন খান উঠে এসে বললেন,

-“বাজারের ব্যাগ দাও।আমি ইলিশ আনছি।আজ মেহেরই রান্না করবে।”
-“আমি….”
-“আর একটা কথাও বলবে না শেহনাজ।”

শেহনাজ পারভীন স্বামীর মুখের উপর আর কিছু বললেন না। এতে ক্ষতি তারই।ছেলের সামনে তার মুখ নষ্ট!কিন্তু মেহেরকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিতেও তার মন চাইছে না।
মেহের আর মীরা খেয়ে উঠে গেল।মীরার সামনে পরীক্ষা তাই মেহের চলে গেল মীরাকে সাহায্য করতে।
প্রায় দুই ঘন্টা পর শাহীন খান বাসায় এলেন।
মেহেরকে ডেকে তার হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বললেন,

-“এরমধ্যে অনেককিছুই আছে।তুমি তোমার মনমত রান্না করো,কেউ কিছু বলবে না।কিন্তু একটা কথা…”
-“কি আংকেল?”
-“তোমার শ্বাশুড়ি যেন তোমার গাল-মন্দ করতে না পারে তেমন রান্নাই কিন্তু চাই।আমার মুখ রেখো।!
-“জ্বী আংকেল।”

শাহীন খান মেহেরের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। প্রথম বারের মত মেহের পা রাখলো তার শ্বাশুড়ির রান্নাঘরে।সবকিছু অনেক পরিপাটি করে সাজানো,গোছানো।আর অনেক নিট আর ক্লিন।
দেখে বোঝাই যাচ্ছে তার শ্বাশুড়ি বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে রান্না করেন।এজন্যই এতটা সুস্বাদু হয়।মেহের বাজারগুলো বের করলো। এরমধ্যেই শেহনাজ পারভীন এসে উপস্থিত হলেন নাজমা বেগম কে নিয়ে তারপর বলতে লাগলেন,

-“শোনো, আজ তোমাকে কেউ কিছুই বলে দিবে না।দায়িত্ব যখন নিয়েছ ভালো করেই রান্না করবে।”

নাজমা বেগম সায় দিয়ে বললেন,

-“হ্যা আমরাও দেখি তুমি ঠিক কেমন রান্না পারো।”

মেহের মাথা নাড়ালো।শেহনাজ পারভীন আর নাজমা বেগম চলে গেলেন।অনেক দিন পর রান্নার কাজ থেকে ছুটি পেয়ে শেহনাজ পারভীন আর নাজমা বেগম বের হয়ে গেলেন কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে।এমনিতেও বোন আজকে চলে যাবে,তাই শেহনাজ পারভীন বেশ সময় কাটাচ্ছেন বোনের সাথে।
এবার মাছ কাটতে গিয়ে মেহের পড়লো বড় বিপত্তিতে।
রান্না তো করতে জানে কিন্তু মাছ তো কাটতে জানে না।মেহের ঢোক গিললো।এবার কি হবে?ইউটিউব দেখে কি কোনোভাবে মাছ কাটা যায়?
মেহের পায়চারী করতে করতে ভাবলো,

-“কি করা যায়, কি করা যায়।”

এমন সময় মীরা এসে উপস্থিত হলো।কিন্তু মাছের গন্ধ তার সহ্য হয় না।তাই সে বাইরে দাঁড়িয়েই বললো,

-“কি হয়েছে ভাবী?এমন করে পায়চারি করছ কেন?আরে জলদী রান্না করো।পরে তো শেষ হবে না।আর শেষ না হলে মা কিন্তু আবার কথা শোনাবে।”
-“কাহিনী হয়ে গেছে!”(নখ কামড়াতে কামড়াতে)
-“কি হয়েছে আবার?”(অবাক হয়ে)
-“আমি তো মাছ রাঁধতে জানি,কিন্তু কাটতে তো জানি না।”
-“হায় খোদা!আগে বললেই তো হয়ত।বাবা একেবারে মাছ কেটে আনত বাজার থেকে।”
-“ধূর,আমার তো মনেই ছিল না।”
-“মনটা ভাইয়ার কাছে থাকলে এখানে বসবে কি করে।”
-“চুপ করো তো।”(মুখ ভেংচি কেটে)
-“ভুল কি বললাম আমি।”
-“হয়েছে, এখন আইডিয়া দেও তো।”

মীরা তার বাবাকে ডাকার জন্য চলে যাচ্ছে। এমন সময় আয়শা আস্তে আস্তে এসে উপস্থিত হলো রান্নাঘরের সামনে। আর বলতে লাগলো,

-“মা,বলছিলাম যে…”

এতটুকু বলে আটকে গেল।মেহেরকে দেখে বললো,

-“ওমা তুমি এখানে!ওহ হো।তোমাকে তো মা আজ রাঁধতে বলেছে।”
-“হ্যা! ভাবী।কিন্তু বিপদে পড়ে গেছি।”
-“ওমা কেন?”

ঠিক তখনই মীরা এসে দাঁড়ালো।আর বলতে লাগলো,

-“ভাবী,বাবা মনে হয় বাহিরে গেছে। আয়শা ভাবী,জানো কি হয়েছে! মেহের ভাবী রাঁধতে জানে কিন্তু মাছ কাটতে জানে না।”
-“এ বাবা!এমন হলে তো আজ খালামণি তোমাকে রেহাই দিবে না।”
-“ধূর!তোমরা শুধু নেগেটিভ ভাবো।এরচেয়ে একটু বলে দাও না কিভাবে কি করব।”

মেহেরের কথা শুনে আয়শা মীরাকে বললো একটা চেয়ার আনতে।চেয়ার নিয়ে আসতেই সে দরজার সামনে বসে গেলো।আর মেহেরকে বলতে লাগলো,

-“নাও শুরু করো।আমি বলে দিচ্ছি!”

আয়শা মেহেরকে বলে বলে দিলো।অতটা না পারলেও মোটামুটিভাবে পারলো।কেননা এক দুবার বাসায় থাকতে কেটেছিল।কিন্তু অতটা ভালো করে পারে না।বিধায় কয়েকটা পিসের সাইজ কেমন যেন হয়েছে। তা দেখে আয়শা আর মীরার সে কি হাসাহাসি!

শেহনাজ পারভীন আর নাজমা বেগম সবে এসে ঘরে ঢুকেছেন।ওদের হাসির শব্দ শুনে রান্নাঘরের সামনে এসেই শেহনাজ পারভীন বলতে লাগলেন,

-“এই তোমার রান্না তাই না?বড় বউমা বলে বলে দিচ্ছে।”
-“না খালামণি তুমি ভুল বুঝছো।আমি তো দেখছিলাম যেন মেহের কারোর থেকে হেল্প নিতে না পারে।কিভাবে কি রাঁধছে তাই দেখছি।”

বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে কোনোমতে আয়শা বললো,

-“চলোতো দেখি কি কি কিনে এনেছ।”

এভাবে বলেকয়ে বিষয়টাকে পাত্তা না দিয়ে সবাই বের হয়ে গেল রান্নাঘর থেকে।মেহের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।এই মাত্রই তাকে কতগুলো কথা শুনতে হত!বেঁচে গেল একটুর জন্য। মনে মনে আয়শাকে থ্যাংকস জানালো।

চলবে…..