প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-০৭

0
170

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৭ম_পর্ব
#বর্ষা
১৯।

তিনদিনে কিছু জিনিসে আমুল পরিবর্তন এসেছে।অদ্রিতা নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়েছে।জেনিয়া ফিরোজের পছন্দের খাবার মোরগ পোলাও আর ফিরনির কম্বিনেশন।অদ্রিতা নিজের মায়ের পছন্দের খাবারই পছন্দ করে।এটা ভেবেই সে হতবাক।যে নারীর ছায়া অব্দি সে চায়নি তার পছন্দকেই কিনা সে এতো পছন্দ করে!

অদ্রির রাত আটটার পর থেকে সে এখন মুখিয়ে থাকে কখন জেনিয়া ফিরোজ আসবে।প্রতিদিন রাত আটটায় সে আসে।গত তিনদিন ধরে আসছে।অদ্রি শুনুক বা না শুনুক সে কতো কিছু বলে।গল্প করে।অদ্রির থেকেও শুনতে চায় বোধহয়।অদ্রি বলেনা।সে তার খুব পছন্দের মানুষ ব্যতীত আর কারো সাথে কথা বলতে পারে না।পরিবারে সে চঞ্চল।রিয়ানের সাথে সে মাফিয়া টাইপ গার্ল হয়ে ঘুরে। কিন্তু একাকী? একদম নিরব।

রাত আটটা তিন।জেনিয়া ফিরোজ আসেন।হাতে আইসক্রিমের দু’টো কাপ।অদ্রির আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছিলো আজ।তবে আলসেমির দরুন সে আর কষ্ট করে নিচে যায়নি।ফ্রিজে তাদের জন্য সবসময় আইসক্রিম রাখা হয়।আর লিয়ন তো প্রায়ই রাতবিরেতে বায়না করে।তখন হাতের কাছে না দিলে গড়াগড়ি করে কান্না করে।

‘’কি ব্যাপার সুইটহার্ট কি ভাবছো?’’

জেনিয়া ফিরোজ ওকে এই অব্দি ওর নাম ধরে ডাকেনি। সুইটহার্ট বলেই সম্বোধন করছে।অদ্রি মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝায় সে কিছু ভাবছে না।জেনিয়া ফিরোজ আইসক্রিম এগিয়ে দেয়।অদ্রি নেয়।

‘’লং ড্রাইভে যাবে সুইটহার্ট?’’

অদ্রির অনেকদিনের জমানো ইচ্ছে সে লং ড্রাইভে যাবে।খোলা আকাশে তাঁবু গেড়ে রাত্রি যাপন করবে।বিনা সংকোচে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যেতে পারবে নিজের সুখী পরিবারের কাছে!অদ্রির ইচ্ছে একটা সুন্দর পরিবারের।ও জানে ও কখনো বাবা-মা আর নিজেকে নিয়ে পরিবার কল্পনা করতে পারবে না।তবে নিজের পরিবার তো গড়তে পারবে।সেখানে সে,ওর ভবিষ্যৎ প্রিয়তম আর … ।

‘’না, আমাদের দেশে মেয়েদের লং ড্রাইভ এর মিনিং কি দাঁড়ায় জানেন?’’

জেনিয়া দুইদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝায়।অদ্রি হালকা হেসে বলে ওঠে,

‘’কলঙ্ক,ধর্ষণ, আত্মহত্যা অথবা জটিলতা’’

ধর্ষণের ঘটনা অহরহ।এদেশ এদিক দিয়ে এতো আগিয়ে বলার বাইরে।পাগলিরও সন্তান হয়।সাহেবের সন্তান বোধহয় তাইতো টলটলা গায়ের রং।স্বামীকে বেঁধে তার সামনেই নির্মম ধর্ষণ,হত্যা।কি একটা দুনিয়া!স্বামীর সাথেও স্ত্রী নিরাপদ নেই।সেখানে দুইজন নারী একাকী নিরাপদ কিভাবে!

জেনিয়া ফিরোজের হঠাৎ এক কালো অধ্যায়ের কথা মনে পড়ে।তার এতো অল্প বয়সে বিয়ে হতো না। আদ্রের সাথে বিয়ের কথা ছিলো তবে তাই বলে এতো আগে না।জেনিয়া আর আদ্র একই স্কুলে-কলেজে পড়েছে।জেনিয়া যখন কেবল দশম শ্রেণীর ছাত্রী তখনই আদ্র ইন্টারে পড়ছে।একই স্কুলে‌। পার্থক্য কেবল ভবনের।সেখানকারই একটা মেয়ে বিয়ে ছাড়াই প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।আবার তার কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়।যা বাকিদের পরিবারেও প্রভাব ফেলে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে যেন বাচ্চাকাচ্চা বিগড়ে না যায় তাইতো জেনিয়া আর আদ্রের হুট করে বিয়ে দেওয়া।

‘’আপনি কি ঘুমাতে যাবেন?আমি অনলাইন থেকে পড়বো’’

‘’আমি তোমায় হেল্প করি?’’

অদ্রি একদম মুখোমুখি তাকায়।কেউ কখনো তাকে সাহায্য করতে চায়নি। অবশ্য মোয়াজ কিংবা মারিয়ামের কাছে গেলে তারা সাহায্য করতো।অদ্রির হ্যা বলতে সংকোচ লাগে।সে উঠে গিয়ে ফিজিক্স প্রথম পত্র বই নিয়ে আসে।ভেক্টরের অংকে এখনো তার সমস্যা আছে।কি যে এক ঝামেলা!

জেনিয়া ফিরোজ বোঝেন মেয়ের সায় আছে।তিনি এগুলো ভালো মতোই পাড়েন। যেভাবে তিনি পড়েছিলেন ওমনি করেই অদ্রিকেও বুঝাতে লাগেন।অদ্রি পড়া বোঝা বাদ দিয়ে নিজের জন্মদাত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে…।হয়তো ভাবে জীবন তার সাথে খুব কঠোর হয়নি।

২০।

রবিবার হওয়ায় কলেজে যেতেই হবে।লাস্ট বুধবার কলেজে গেছে সে।এতো গ্যাপ দেওয়াটা ঠিক না। কিন্তু নুহানের ওই ধোকার পর সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। অদ্রি আর রিয়ান রিক্সা করেই যাচ্ছিলো।তখনই রিক্সার সামনে হুট করে এক গাড়ি এসে দাঁড়ায়।একটুর জন্য পড়তে গিয়েও পড়েনি অদ্রি।রিয়ান ধরে ফেলেছে। আকস্মিক ঘটনায় সে হতবাক হলেও পরবর্তীতে সম্বতি ফিরতেই খেপে রিক্সা থেকে নেমে আসে।গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার আগেই গাড়ি থেকে বের হয় নুহান।

অদ্রি চমকে যায়।এই সকাল সকাল আপদের মুখ কে দেখতে চেয়েছিলো!নুহান এসে অদ্রির হাত ধরতে নেয়।অদ্রি পিছিয়ে যায়।নুহান অসহায় কন্ঠে বলে ওঠে,

‘’অনন্যা আমায় মিথ্যে বলেছে অদ্রি‌।ও কখনো মা হতে পারবে না।প্লিজ অদ্রি আমায় ক্ষমা করে দিয়ে ফিরে আসো,প্লিজ’’

নুহানের কথাটা বলতে দেরি হলেও রিয়ানের আক্রমণ করতে দেরি হয়নি।সজোরে ঘুষি মেরেছে সে। একদম মুখ বরাবর।অদ্রি কিছু করার সুযোগ পায়নি।যখন নুহানও হাত তুলতে নিবে তখন রিয়ানকে সরিয়ে দেয় অদ্রি।নুহানের হাতে ধারালো কিছু ছিলো।যার ফলে অদ্রির হাত কেটে যায় অনেকটা।তবুও সে চুপ থেকে রিয়ানকে সরে যেতে বলে।সে আসছে।

রিয়ান অদ্রিকে কিছু বলতে পারেনা।জিদে নুহানের গাড়ির চাকায় লাত্থি মেরে একটু দূরে এসে ফোন বের করে।আজলান বেহরানের আইডিটা ওর কাছেও আছে।তাইতো দ্রুত সেই আইডিতে ঢুকে রিয়ান লেখে,

‘’মনে হয় না আপনি অদ্রির জামাই হইতে পারবেন।অদ্রিরে জ্বালাইতে আরেক ছোকড়া অলরেডি রাস্তায় নাটক শুরু করছে’’

ব্যস এতো টুকু লিখেই লাইভ লোকেশন শেয়ার করে রেখে দেয় সে।রিয়ান নিজেও জানে না সে এমন কেন করলো! হঠকারিতার পরিণাম ভুল হয়।

অদ্রি একপ্রকার বাধ্য হয়েই নুহানের সাথে রেস্টুরেন্টে এসেছে।নুহান অদ্রির হাত কেটেছে তো কেটেছেই।এখন আবার সুইসাইড করার হুমকি দিচ্ছে।আবার বলছে সে মরলে নাকি নোটে অদ্রির নাম লিখে যাবে।মানসিক রোগিদের লক্ষণ এগুলো। সাধারণ মানুষ এমন করতে পারেনা।তাইতো অদ্রি গেলো।রিয়ান যায়নি।আবার বোনকে একাও ছাড়েনি।দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

রিয়ান রাগে ঠোঁট কামড়ে যখন রেস্টুরেন্টের দরজা দিকে উঁকি দিচ্ছে তখনই কেউ ওর কাঁধে হাত রাখে।ও পেছনে ফিরে দেখে আজলান বেহরান।সাদা জিন্স আর হালকা ব্রাউন রঙের টি-শার্ট পড়ে এসেছে।কোমড়ের বা’পাশটা কেমন যেন একটু উঁচু উঁচু।চোখ মুখ শক্ত।কপাল আর হাতের রগগুলো সব দাঁড়িয়ে আছে।কি একটা অবস্থা!

‘’জাবিন কোথায়?’’

‘’ওই যে ভাইয়া ভেতরে’’

আজলান সুরসুর করে ভেতরে চলে আসে।সোজা অদ্রিদের কাছে গিয়ে কোমড়ে গুঁজে রাখা বন্দুক বের করে।ট্রিগারে হাত রেখে নুহানদের দিকে তাকিয়ে অদ্রিকে বলে ওঠে,

‘’তোকে বলেছিলাম না কোনো ছেলের আশেপাশে যাবি না!এর আশেপাশে কোন সাহসে আসছোস?কথা বল ডেমিট ‘’

অদ্রির গলা শুকিয়ে এসেছে।নুহানের অবস্থা ভয়ে শেষ।অদ্রির হাতে চেপে রাখা শুভ্র রুমালটায় লাল লাল ভাব ফুটে আছে।রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে।আজলানের কিলিং এন্ট্রি দেখে রেস্টুরেন্টে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।পুলিশেই ফোধ দিবে কিনা!হেল্প লাইন তো ৯৯৯।ম্যানেজার সেই নাম্বারে কল দিতে থাকে।তবে ওপাশ থেকে কাউকে খুঁজেই পাওয়া যায়না।

২১।

অদ্রির আর লাইব্রেরী যাওয়া হলো না।আজ ঘন্টা এক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো লাইব্রেরী যাবে বলে। কিন্তু তা আর হলো কই।ঝামেলায় ঝামেলায় ওর সময় গেলো।আজলান নুহানকে বেশ কিছু হুমকি দিয়ে অদ্রিকে টানতে টানতে বেরিয়ে এসেছে।অদ্রিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে বসে।রিয়ানকেও উঠতে বলে।

‘’রিয়ান..’’

‘’হ্যা ব্রো’’

‘’তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।একদম শালা ম্যাটারিয়াল তুমি।এখন থেকে এই মেয়ের সব খবর আমায় দেবে’’

‘’অবশ্যই ব্রো’’

অদ্রির রাগে শরীর কাঁপছে।এই বদ লোককে তাহলে রিয়ান ডেকেছে! অবশ্য আজলান বেহরান ওর কাছে ধন্যবাদও পায়।ওকে বের করে না আনলে আরো কি কি যে হুমকি দিতো ওই নুহান কে জানে!ড্রাইভ করছে আযান।আর তার পাশেই মূলত রিয়ান বসেছে।পেছনের সিটে অদ্রি আর আজলান।

আজলান অদ্রির কোমড় শক্ত করে ধরে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বসে আছে।যেন একটু ছুট দিলেই পালিয়ে যাবে।অদ্রির মোচড়ামুচড়ি করারও যেন সুযোগ নেই।আজলান অদ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ওঠে,

‘’মুনশাইন এতো সহজ না আমার লাইফ থেকে বের হওয়া।যখন একবার আটকে পড়েছো তখন তো আমার মৃত্যু অব্দি ছাড় পাবে না!’’

‘’ছাড়ুন আমাকে।মনে তো হয় মুসলমান।তাহলে জানেন না বিবাহিত বহির্ভূত সম্পর্ক হারাম। স্পর্শ করছেন কেন আমায়?’’

আজলান হুট করে অদ্রির কোমড় ছেড়ে চোয়াল শক্ত করে ধরে ফেলে।অদ্রি-রিয়ান দুইজনই ভয় পেয়ে যায়।এখনই তো ভালো ছিলো।রিয়ান কিছু বলার আগেই তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।আজলান অদ্রিকে গাড়ির সাথে চেপে ধরে বলে ওঠে,

‘’তুইও তো মুসলিম ঘরের মেয়ে।নিয়ম তো পর্দা করা।চুল দেখিয়ে বেড়াস কেন! তুই আমার।তোর সব দেখার অধিকারও কেবল আমার।আজ থেকেই তুই পর্দা করবি।আর বিয়ে ওইটার জন্য তুই অপেক্ষা কর।দিন দুয়েকের মধ্যে যদি তোকে বিয়ে না করছি তাহলে আমিও আজলান বেহরান না’’

অদ্রিকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিয়ে আজলান আযানকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

‘’আযান, শপিং মলে চল তো।আগে পর্দা শিখবো।তারপর কলেজ।’’

চলবে?