প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-০৮

0
40

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৮ম_পর্ব
#বর্ষা
২২।
দুপুর সাড়ে বারোটায় অদ্রিদের বাড়িতে দেখে প্রায় হকচকিয়ে যায় সবাই‌।ওদের কলেজ তো এগারোটা থেকে দুপুর দুইটা হয়।এতো দ্রুত আসার কারণ কি!আবার অদ্রি রিয়ানের হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ।বাড়ির পুরুষেরা এই সময় একজনও বাড়িতে নেই।ফাতেমা জোহরা রান্না করছেন।ওনার সাথেই দাঁড়িয়ে কাজ করছিলো জেনিয়া ফিরোজ।দুইজনেই বেরিয়ে আসেন রান্নাঘর থেকে।কাজের লোক দু’টোকে পাঠান রান্না দেখতে।

‘’কিরে এই অসময়ে বাড়িতে কেন তোরা?আর হাতে কি এসব ‘’

রিয়ান অদ্রির পেছনে ছিলো।পা দিয়ে অদ্রির পায়ে লাত্থি মেরে আস্তে করে বলে ওঠে,

‘’কি বলবি বল। আমি কিছুই জানি না কিন্তু।আমার মাথা ঘুরছে’’

‘’শয়তান তুই প্রেগন্যান্ট নাকি তোর মাথা ঘুরে!বালের কাজকাম করছ আর আমি ভেজালে পড়ি’’

অদ্রি আর রিয়ানকে গুজুরফুসুর করতে দেখে জেনিয়া ফিরোজ এবার কিছু বলতে আরো কিছুটা এগিয়ে আসেন।এই বাড়িতে আসার পর থেকে উনি ওরনা জড়ানো শুরু করেছেন। অবশ্য তা হয়েছে মৌসুমী বেগমের কথায়। তিনি খুব একটা সংসারের খোঁজখবর রাখেন না।ঘরে বসেই তজবি গুনেন।আজ কি হলো কে জানে বেরিয়ে এলেন।

‘’কিরে তোরা কি কথা কছ?জুড়ে ক আমরাও শুনমু ‘’

অদ্রি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে ওঠে,

‘’বিয়ে ভাঙার পরদিন তো বড় আব্বু আমায় কিছু টাকা দিয়েছিলো।ওইটা দিয়েই কেনা কাটা করেছি।দুটো বোরকা আর কয়েকটা হিজাব’’

রিয়ানও তাতে সায় দেয়।দুইজন দ্রুত দৌড়ে ঘরে চলে যায়। মৌসুমী বেগম হাসেন। ইদানিং মনে একটা ছক কষেছেন।আজ এই নিয়েই কথা বলবেন।অদ্রি আর রিয়ান দুটোকে একসাথে কি সুন্দর মানায়!মৌসুমী বেগম এসব ভাবতে ভাবতেই চলে যান।

২৩।

বিকেল সাড়ে তিনটা কি চারটার সময়।জেনিয়া ফিরোজ এক অনলাইন মিটিং এ ব্যস্ত। হঠাৎ ওনার চোখ পড়লো দরজার দিকে।অদ্রিতা যেন মনের সাথে সংঘর্ষ করছে। বোধহয় ভেতরে আসতে চাইছে আবার আসতেও পারছে না।দ্বিধা কাজ করছে ওর।তিনি কিছু বললেন না। মিটিং শেষ করলেন খুব দ্রুত।এসে দরজা খুলতেই দেখলেন মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

‘’সুইটহার্ট বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?ভেতরে আসো’’

‘’না,না।এমনি আরকি’’

জেনিয়া ফিরোজ অনেক খুশি।ওনার মেয়ে নিজ থেকে ওনার দুয়ারে এসেছে।তিনি একপ্রকার টেনেই অদ্রিকে ঘরে আনলেন।বিছানায় বসালেন।অদ্রির সাথে আলাপ করতে চাইলেন।মনে হচ্ছে অদ্রি যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।

অদ্রি বুঝতে পারছে না আজলানের ঝামেলা থেকে সে কিভাবে মুক্তি পাবে।আজলানকে ও অপছন্দ করে না কিংবা আবার পছন্দও করেনা।অদ্রির কাছে আজলান কেবলই একজন অযাচিত হস্তক্ষেপ করা মানুষ যেন।অদ্রি এই নিয়ে বড় কারো সাথে ডিসকাশন করতে চায়।মা ব্যতীত সন্তানের আপন কেউ হয়না।সে হিসেবে ধরতে গেলে জেনিয়া ফিরোজ ওর মা। কিন্তু ওকে পেলে পুষে বড় করেছেন ফাতেমা জোহরা।রিয়ানের সাথে একসাথে মানুষ করেছেন।

‘’অদ্রি কি ভাবছো?’’

‘’না মানে আসলে..’’

‘’কিছু বলতে চাও তুমি?’’

‘’আসলে..’’

‘’আরে বাবা আমি তোমার নিজের মাম্মা হই।এতো সংকোচের কি আছে!’’

অদ্রির বুকে কাঁপুনি ধরেছে।জেনিয়া ফিরোজকে জড়িয়ে ধরছ কাঁদতে মন চাচ্ছে।তবে পারছে না।ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগে।মেয়েকে এভাবে বিধ্বস্ত হতে দেখে জেনিয়া ফিরোজ অবাক হোন।ওনার মেয়ে তো ভেঙে পড়ার মতন হতে পারে না।সে অদ্রিকে বুকের মধ্যে আগলে ধরেন।অদ্রির কান্না আরো বাড়ে।জীবনে প্রথমবার বোধহয় রিয়ান ব্যতীত ও কারো কাছে নিজেকে উম্মুক্ত করছে!

‘’কি হয়েছে আমার হার্টের?হ্যা বলো বেবি’’

‘’মাম্মা..’’

অদ্রির কন্ঠ কেমন জড়ানো।প্রথমবার সে মাম্মা বলে ডেকেছে।জেনিয়া ফিরোজ নিজেও কেঁদে দেন।ওনার তো খুশি ধরছে না।তিনি অদ্রির গাল ছুঁয়ে বলে ওঠেন,

‘’হ্যা বেবি সুইটহার্ট।মাম্মা আছি তো’’

‘’মাম্মা আমার লাইফে এতো ঝামেলা কেন?কেন ওই লোকটা আমার ওপর অধিকার খাটাচ্ছে?আমি কিছু করতে পারছি না।কাউকে কিছু বলতে পারছি না’’

‘’কে বেবি?কে তোমার ওপর অধিকার খাটাচ্ছে?’’

‘’আজলান বেহরান।সত্যি বলছি আমি চিনি না’’

অদ্রি সব ঘটনা খুলে বলে।জেনিয়া ফিরোজ রেগে যান আরিয়ার ওপর। অবশ্য তিনি আজলান কে তাও দেখে নিবেন বলে আশ্বাস দেন মেয়েকে।আর আজ একটা হেস্তনেস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন আরিয়ার সাথে।ওই মেয়ের জন্য ওনার মেয়ের জীবনে এমন ঝামেলা এলো।

হঠাৎ জেনিয়া ফিরোজের মনে পড়ে দুপুরের কথা।অদ্রি বিয়ে ভাঙা নিয়ে কিছু বলেছিলো।এই বাড়িতে বিবাহ উপযুক্ত তো কেউ নেই।মোয়াজকে তো এতো আগে বিয়ে দেওয়ার কথা না।আর রিয়ান-অদ্রি তো এখনো কত ছোট।যদিও জেনিয়া ফিরোজের বিয়েটা অদ্রির বয়সেরও আগেই হয়েছিলো।

‘’বার্ড কার বিয়ে ভেঙে ছিলো?’’

অদ্রি অবিশ্বাস্য নজরে তাকায়।তার মা তবে জানে না তার বিয়ে ভাঙার কথা!অদ্রির আবারো কান্না পায়।সেও তো তার বাবা-মা নিয়ে কিছুই জানে না।কোথায় কি স্ক্যান্ডাল করছে কিংবা হচ্ছে কিছুই না।

‘’আমার’’

‘’হোয়াট?তুমি তো এখনো আমার ছোট্ট বাচ্চা।তোমায় বিয়ে দেওয়ার সাহস করে কি করে ওরা’’

‘’তোমরা চলে যাওয়ার পর তো বড় আব্বুরাই আমায় আদরে বড় করেছে। ওদের যে অধিকার আছে’’

অদ্রির শেষ কথাটা যেন জেনিয়া ফিরোজের কলিজায় লাগে।এই প্রথম বোধহয় ওনার মনে হয় এমন ভাবে চলে যাওয়া ওনার ঠিক হয়নি।বাবা চলে গেলেও সন্তান ভালো থাকে। কিন্তু মা চলে গেলে যে সন্তান গুমড়ে গুমড়ে বড় হয়। অদ্রি যে তার উজ্জ্বল প্রমাণ।আরো ঘন্টা খানেক থেকে অদ্রি চলে আসে নিজের ঘরে।আগামী সপ্তাহ থেকেই পরীক্ষা। কিন্তু কত যে গ্যাপ হয়ে গেলো!পড়তে হবে ওর।

২৪।

আজলানের আজ শেষদিন বাংলাদেশে। ইমার্জেন্সি হওয়ায় তাকে যেতে হচ্ছে তুরস্কে।নিজ বাসস্থানে।মন যদিও তাকে তাকে আটকে রাখতে চাইছে। কিন্তু যাওয়াটা জরুরি।আযান তাকে বিদায় দিতে এতো দূর এসেছে।তার জানতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করে তার স্যারের চলে যাওয়ার কারণ।তাইতো আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,

‘’স্যার হঠাৎ করে চলে যাচ্ছেন কেন?’’

‘’শুনে কি করবে?’’

‘’না এমনি স্যার’’

আযান গাড়ি চালাতে থাকে।আযানের নিজের বয়সই পঁচিশ।সেখানে আজলানের বয়স উনত্রিশ।তাও কিছু আচরণ একদম বাচ্চাদের মতন।কমন সেন্স ছাড়া।আযান আল্লাহ আল্লাহ করে যেন এই পাগলের সাথে ওই পিচ্চি মেয়েটার জীবন না জড়ায়। হঠাৎ আজলানের ফোনে কল আসে।মোবাইল চার্জে।তাই লাউড স্পিকারেই আজলান ফোনটা ধরে।

‘’পাপা….’’

ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা পাপা ডেকে আরো কতকিছু যেন বললো।আযান একদম স্পষ্ট শুনেছে পাপা ডাকটা।ওর তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না।স্যার যদি বিবাহিত হয় তাহলে এখানে অদ্রিতা জাবিনের পিছনে পড়ে আছে কেন!আযান সত্যিই জানে না।

২৫।

দক্ষিণ কোরিয়ায় রাতগুলো সুন্দর হয়। তাঁবু খাটিয়ে ওখানেই থাকাটা যেন এডভেন্চারাস।তবে গত দুইদিন সানের মুড অনেক বাজে যাচ্ছে। ডিরেক্টর লিও তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এখানে।তার মেয়েটা বারবার চিপকে যাচ্ছে ওর সাথে।ঘটনা বিরক্তিকর।তার চেয়েও বিরক্তিকর তার মেয়েকে কোনো বার্তা পাঠাতে না পারাটা।সান তো খুঁজেই পায়না সে কি পাঠাবে।

ডিরেক্টর লিও এর মেয়ে লিজা‌ সানের দিকেই এগিয়ে আসছে।ও ওখান থেকে বেরনোর কথা ভাবছিলো তখনই ফোন বেজে ওঠে। স্পষ্ট ফুটে আছে জেনিয়ার নাম। হঠাৎ করে জেনিয়ার নামটা দেখেও যেন ওর ভালোলাগা প্রসারিত হয়।ফোনটা তুলে কানে লাগায়।

‘’আদ্র?’’

‘’হ্যা বলো ‘’

‘’আদ্র আমরা ভুল করেছি।যার মাসুল আমাদের মেয়ে দিচ্ছে ‘’

‘’কি বলছো জেনি?ঠিক আছে আমার সুইটি?’’

‘’জানো আমি এখানে আসার কিছুদিন আগেই ওর বিয়ে ভেঙেছে।ভাবো একবার এতটুকু বয়সে ওর বিয়ে দিচ্ছিলো তোমার পরিবার। আমাদের মেয়ে সেই যন্ত্রণা এতোদিন কিভাবে সহ্য করেছে আদ্র!’’

জেনিয়া ওপাশে কাঁদছেন। আদ্রের নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।তার নিজেরও কাঁদতে মন চাচ্ছে।বাবা সন্তানদের থেকে দূরে থাকুক, যোগাযোগ না রাখুক তাও একটা না একটা সময় পর গিয়ে এদের বুকটা চলে।সন্তানের জন্য কষ্ট লাগে।বুকটা ব্যথা করে।আদ্রের কাছে এসে লিজা বলে ওঠে,

‘’ওহ সান তুমি এখানে?আমি তোমায় কত জায়গায় খুঁজে এলাম।আই মিস ইউ’’

লিজার বলা প্রতিটা কথা ছিলো ইংলিশে।তাইতো ওপাশ থেকে জেনিয়া সব শুনতে পায়।কল কেটে দেয়। আদ্রের যেন এই প্রথমবার জেনির হঠাৎ করে কল রেখে দেওয়ায় খারাপ লাগে। প্রচন্ড মন খারাপ হয়।তাইতো রাগ নিয়ে লিজার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

‘’ইউ নো হোয়াট…আ’ম ম্যারিড।আই হ্যাভ এ ডটার উইথ হার।জাস্ট গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার’’

চলবে?