#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১
“আজ বুঝলাম, ভার্সিটির টয়লেটই একমাত্র নিরাপদ জায়গা, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা পাওয়া যায় না!”
এই লাইনটা লিখেই নিজের ডায়েরি বন্ধ করলো নূর-এ-জান্নাত রোজ।
বাইরে বৃষ্টি। ক্যান্টিনে প্রেম। লাইব্রেরিতে প্রেম। সিনিয়রের নোটের ভেতরে প্রেম।
আর সে? সে কাদায়,সে লজ্জায়, সে রাগে। ভাবতেই হতাশ সে। হতাশ, তীব্র হতাশ।
ঘটনাটা ঘটেছিল দুপুরে। ভার্সিটির মূল ফটকের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো রোজ। আজ একটু বেশিই সাজগোজ করে এসেছে সে। আসবেই না বা কেন? তার মন চেয়েছে সাজতে তাই তো সেজেছে। সাদা কামিজ, ম্যাচিং চুড়ি, একটুখানি কাজল, ঠোঁটে লিপবাম দিয়েছে শুধু।
সকালটা ভালো মতো শুরু হয়েছিলো বলে মনে করেছিলো দিনটাও ভালোই যাবে, কিন্তু ভাগ্য… ভাগ্য বলে কিছু থাকলে সেটা রোজের সাথে নিশ্চয়ই রিলেশনশিপে নেই।
পেছন থেকে একটা ধাক্কা, হঠাৎই দুই পা পিছলে পড়লো একেবারে কাদার ভেতরে।
আর চোখ খুলতেই যা দেখলো তার জন্য সে মটেও প্রস্তুত ছিলো না। তার সব সাজগোজ ধুয়ে গেলো চরম অপমানের স্রোত।
জুবায়ের ইব্রাহিম সায়েম।ডিপার্টমেন্টের ক্রাশ অফ দ্য সেঞ্চুরি। পরিপাটি গেটআপ, আর সেই ভয়ংকর সুন্দর দাঁত, মনমাতানো হাসি,সব মিলিয়ে ছেলেটাকে দেখলেই গানের লাইনে মন যায়, “তোমার হাসতে থাকা মুখটা দেখে আমার লজ্জা লাগে।”
কিন্তু আজ সে হেসে ফেলেছে রোজকে দেখে। একেবারে দাঁত কেলিয়ে।এইবার বুঝো কান্ড! কিন্তু একমিনিট তাকে ধাক্কাটা দিলো কে? এখানে তো জুবায়ের ছাড়া আর কেউ নেই। দুইয়ে দুইয়ে যেন চার হয়ে গেলো।
রোজ উঠে দাঁড়িয়ে কিছু না ভেবেই গিয়ে জুবায়েরের সাদা শার্টে নিজের হাতের কাদাটুকু লেপে দিলো।
জুবায়ের হতভম্ভ হয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে, কি করলে এটা?”
রোজ চিবোতে চিবোতে বলল,
“আপনি কি কানা নাকি। দেখলেই তো আমি কি করলাম। তারপরেও প্রশ্ন করছেন কেন?”
জুবায়েরের তো মাথাই কাজ করছে না। সে এখনো ভরকে যাওয়া ভাব ত্যাগ করতে পারেনি। রাগে তার ফর্সা মুখ লালচে হয়ে উঠছে।
“তোমার সাহস কি করে হয় আমায় কাদা মাখানোর? আমি তোমার সিনিয়র!”
“তাই নাকি? সিনিয়র বলেই ধাক্কা দেবেন, আর আমি কাদায় ভিজবো?”
জুবায়ের অবাক হয়ে বলল,
“আমি ধাক্কা দেইনি!”
রোজ কোমরে হাত রেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আপনি ছাড়া তো কেউ ছিলো না! আপনি না হলে ভূত ধাক্কা দিছে নাকি?”
রাগে ফুসে ওঠা জুবায়ের আঙুল তুলে কিছু বলবে, তার আগেই রোজ তাকে ধাক্কা দিলো।
জুবায়ের কাদায় পরে যাবে ভেবে হাত বাড়িয়ে ধরলো রোজের হাত এবং পরিণামে দুজনই আবার পড়ে গেলো।
ঠিক তখনই গর্জন করে উঠলো একটা গম্ভীর কণ্ঠ:
“কি হচ্ছে এখানে?”
সবার প্রিয় না হলেও সবার ভয় জাহানারা ইসলাম ম্যামকে দেখে রোজ ঢোক গিললো।প্রথমদিন এসেই একটা রাম ধমক খেয়েছিলো। তখনি মানুষের মুখে শুনেছে এই ম্যামের ব্যাপার। উনি আবার এই বিটকেল জুবায়ের নানার মা।
জাহানারা বেগম কর্কশ ভঙ্গিতে বললেন,
“জুবায়ের! তোমার প্রেজেন্টেশন কোথায়?”
“আম্মু, আমি তো… মানে এই মেয়েটা কাদা মাখায় দিছে!”
জাহানারা বেগম চোখ কুঁচকে রোজের দিকে একপলক তাকালেন। মেয়েটা কাদায় বেশি মাখামাখি করেছে হয়তো। সাদা কামিজ কাদাময় হয়ে গেছে একেবারে।
“এই মেয়েটা কি তোমার থেকে ছোট না?”
“মানে… ছোটই তো…”
“তাহলে ওর সাথে এইসব করে বেড়াও কেন?”
রোজ দাঁড়িয়ে মুখে হালকা হাসি নিয়ে মাথা নিচু করে রাখলো। তার মনে হচ্ছে, কাদা দিয়ে ব্যাটাকে চুবিয়ে ভালোই করেছে। কি সুন্দর বকা খেয়ে আমতা আমতা করছে।
জাহানারা ম্যাম রোজকে বললেন,
“তুমি আজ ক্লাসে যেও না। শারীরিক অবস্থা দেখছি ভালো না। আর হ্যাঁ, আরেকবার বড়দের সাথে তর্ক করলে তোমাকেও ছাড়বো না।”
রোজ মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে মনে মনে বললো,
“আজ তো আপনি ধুয়ে গেছেন। কালকে কেমনে শুকাবেন, সেটা ভাবেন!”
—
একটু পর…
হুট করেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। রোজ কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। আশেপাশে যে দুই চারজন ছিলো তারা এতক্ষণে আশপাশের দোকানের দিকে ছুটে গেছে আশ্রয়ের জন্য। মুষুলধারে পড়তে থাকা বৃষ্টি রোজের গায়ের কাদা গুলো ধুঁয়ে দিচ্ছে। আশেপাশে একপলক চোখ বুলিয়ে রোজ দুইহাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে মুখটাকে আকাশের দিকে মেলে ধরলো। বৃষ্টির ফোঁটায় শ্যামবর্ণের মুখটা মুক্তর দানার মতো চিকচিক করছে। চোখের কাজল এতোক্ষণে ধুয়ে গেছে। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। রোজ মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো।
অন্যদিকে জুবায়ের কেবলি একটা কালো রঙের শার্ট পড়ে দোকান থেকে বের হতে নিবে তখনি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জুবায়ের বেশ বিরক্ত হলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই আটকা পরেছে। হঠাৎ করেই তার চোখজোড়া আটকে গেল এক বৃষ্টিবিলাসীর দিকে। যে বর্তমানে বৃষ্টি উপভোগ করতে ব্যস্ত। খোলা লম্বা চুলগুলো দিয়ে টুপটাপ পানি পরছে। চোখ মুখে বৃষ্টির পানি পরছে অঝোরে। পাতলা গোলাপি ঠোঁট জোড়া হালকা কাঁপছে। চোখের পাঁপড়িগুলো তিরতির করে কাঁপছে বৃষ্টির ঝাপটায়। আশ্চর্য তাদের মাঝে দূরত্ব তো বেশ অনেকটাই তবুও এতো পরিষ্কার কেন দেখছে সে?জুবায়ের চোখ সরিয়ে নিলো। পরমুহুর্তেই আবারো ঘুরে তাকালো। কেন যেন চোখ সরাতেই পারছেনা সে।
চোখ বুজে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস টানলো জুবায়ের। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো দুইহাত দিয়ে ঠেলে পিছনে দিয়ে মাথা দুইপাশে নাড়ালো। ক্লাসে যেতে হবে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে কিন্তু সেদিকে সে এখন মন দিতে পারছেনা। জুবায়ের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনি ছাতা নিয়ে দৌড়ে এলো আবিদ। আবিদ জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে কি করছিস তুই? তাড়াতাড়ি চল।”
জুবায়ের উত্তর দিলো না আবারো সামনে তাকালো কিন্তু মেয়েটাকে আর দেখতে পেলো না। কোথায় গেল মেয়েটা? এখানেই তো ছিলো!
আবিদের ডাকে সেসব বাদ দিয়ে ওর ছাতার নিচে দাঁড়ালো জুবায়ের।
এদিকে রোজ ব্যাগ থেকে রেইনকোটটাকে টেনেটুনে বের করলো।
——–
ভদ্র মেয়ের মতো রেইনকোট পড়ে বাড়ি আসলেও তার মা একদেখায় সব বুঝে গেছে। তারপর তার ভাষণ শুনে ঘরে এসে শাওয়ার নেওয়ার পর থেকে এই নাতে সেই হাঁচি পরছে।
রোজ মেজাজ বিগড়ে আছে বিধায় অনলাইনে ঢুকেছিলো সে। আজ হয়তো পুরো ভার্সিটি প্রেমিক প্রেমিকায় ভরে গেছিলো। নিউজফিড দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। আমতলা, বটতলা, লাইব্রেরি, ক্যান্টিন সব জায়গায় কাপলের ভিড়। শুধু ভার্সিটির টয়লেটে হয়তো কাপল নেই। কারণ প্রায় সব জায়গায় তারা ছবি তুলে ফেলেছে। এতো নিক নিক করে প্রেম করার কি আছে তাই বোঝেনা রোজ। এগুলো দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় তার।তাই আর ফেসবুকে না থেকে ডায়েরি নিয়ে বসেছিলো সে।
দুইলাইন লিখে আবারো সেটা বন্ধ করে রেখে দিলো। নাকের পানি মুছতে মুছতে নাজেহাল অবস্থা তার। তার উপরে জুবায়েরের দাঁত কেলিয়ে হাসার কথা বারবার মনে হচ্ছে তার। রাগে দুঃখে কান্না করতে মন চাচ্ছে।
রোজ নিজের ভাবনায় মত্ত ছিলো তখনি ফোন বাজতে লাগলো বিরক্তিকর সুরে। রোজ ফোন হাতে নিয়ে কপাল কুচকে কল রিসিভ করে কানে ধরলো। অপরপাশ থেকে কি যেন বলল তা চুপচাপ শুনে রোজ উত্তর দিলো,
“আমার আরো সময় লাগবে কাজটা করতে। কাজ শেষ হলে আমি একাই জানাবো। তাই অযথা ফোন দিবেন না।”
বলেই কল কেটে দিলো রোজ। মেজাজ এমনিতেই খারাপ তার উপরে এখন আবার আরেক প্যারা। আবারো রোজের ফোন বাজতে লাগলো। না দেখেই রিসিভ করে বলল,
“সমস্যা কি বললাম তো কল না দিতে!”
রোজের কথায় কপালে ভাঁজ পরলো রোজের বান্ধবী আরুশার।
“কি হলো কে কল দিচ্ছে আবার তোকে?”
রোজ চোখ বুজে বড় একটা শ্বাস টানলো।
“কিছু না বল কি বলবি?”
#চলবে কি?