#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)
আরুশা মুখ গোল করে একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তবুও লাগতে যাস না। দিনকাল বেশি একটা ভালো না। কখন কার মনে কি চলে বলা কঠিন!”
রোজ মুখ বাঁকিয়ে বসে বসে পা নাড়াতে লাগলো।
শেষের আরো দুটো ক্লাস করে বাসায় ফিরলো রোজ। বাসায় এখন মা আর ভাবী আছে। বাকি সবাই যে যার কাজে বাহিরে গেছে। রোজ ফিরতেই দেখলো বাড়িতে ভাবী আর মা দুইজন মিলে রান্না করছে। রোজ সেদিকে একবার টুকি দিয়ে রুমে গেলো শাওয়ার নিতে। মাথাটা ধরে আছে। রোজ ব্যাগ রেখে জামা কাপড় নিয়ে শাওয়ার নিতে গেলো।
লম্বা একখানা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো সারা বিছানায় কোণায় বসে পা নাড়াচ্ছে আর গুনগুন করছে। রোজ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
“আরে ভাবি গুনগুন করছো যে। তোমার তো এখন মন খারাপ করে থাকার কথা। তিনদিনের জন্য তোমার একমাত্র প্রেমিক পুরুষ টুরে গেছে।”
সারা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“প্রেমিক পুরুষ নাকি ছাঁই। প্রেমিক পুরুষ হলে আমাকে সাথে করেই নিয়ে যেতো। সে কথা বাদ দেও তো। তোমার জন্য চা বানিয়ে এনেছি। খেয়ে নেও তো তাড়াতাড়ি।”
রোজের মুখ চিকচিক করে উঠলো। মনটা তো তার চা চা ই করছিলো। খুশিতে সারাকে গিয়ে ধরে বলল,
“আই লাভ ইউ ভাবিজান।”
সারা মুচকি হাসলো।
“আই লাভ ইউ টু প্রিন্সেস।”
রোজ চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ফু দিয়ে খেতে লাগলো। তখনি ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে জান্নাত বেগম রোজের রুমে এলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“সারা তুমি গোসল করে নেও। আর রোজ তুই ভাতটা খেয়াল করিস। আমিও ফ্রেশ হয়ে আছি। একটু পরেই নুহান এসে খেতে চাইবে।”
রোজা মাথা নাড়াতেই জান্নাত বেগম চলে গেলেন। সারাও নিজের রুমে গেলো আর রোজ রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
————
অডিটোরিয়াম রুমের পিছন দিকটার একটা হাইব্রেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে আছে জুবায়ের। হাতে একটা স্কেল আর কিছু কাগজ পত্র। আবিদ, নাফি, রাইসা, ইলিনা,উৎসব, তুষার সহ প্রায় দশবারো জন মিলে নবীনবরণে বিভিন্ন পারফরমেন্স করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জুবায়েরকে বসে থাকতে দেখে আবিদ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কিরে বসে আছিস কেন ডাকাত সরদারের মতো? কিছু করবিনা তুই?”
জুবায়ের বাঁকা হেসে বলল,
“সে তো করবোই এক ঢিলে দুই পাখি মারবো। আমার সাথে লাগতে এসেছিলো না।”
নাফি কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কিরে কি বলছিস ফিসফিস করে?”
জুবায়ের লাফ দিয়ে নেমে স্কেলটা ঘুরাতে ঘুরাতে কুটিল হাসলো। উৎসব নাফির কাঁধে হাত রেখে জুবায়ের দিকে তাকালো।
“ওর মাথায় কিছু চলছে। না জানি কি করে?”
জুবায়ের তার কপালে পড়ে থাকা সিল্কি চুলগুলো বামহাতের সাহায্যে পিছনে ঠেলে দিলো। কি যেন ভেবে সবার উদ্দেশ্য হাত তুলে বলল,
“বন্ধুগণ আমি গেলাম। আবার কাল হবে সব। আবিদ, নাফি আর উৎসব তোরা বিকালে দেখা করিস।”
ইলিনা জুবায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“আমিও তোদের সাথে যাবো।”
জুবায়ের হাসলো। কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে গেলো।
————-
রোজ চুলা থেকে ভাত নামাতে নিবে তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। রোজ ভাতের পাতিল নামিয়ে দরজার কাছে গেলো। দরজা খুলতেই নুহান ভিতরে আসলো। নুহানকে বেশ চুপচাপ লাগছে। নুহান তো প্রতিদিন বাড়ি ফিরে রোজকে বিরক্ত করে আজ কেন করলো না। সেটা ভেবেই রোজের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো।
নুহান সোফায় গিয়ে ঠাস করে বসলো। রোজ ও গুটি গুটি পায়ে নুহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নুহান ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“পিচ্চু আমাকে একগ্লাস পানি দে তো।”
রোজ দ্রুত পায়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে নুহানের কাছে নিয়ে এলো। নুহান পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক পানি শেষ করে দিলো। রোজ নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে গড়গড় করে বলতে লাগলো,
“কি হয়েছে ভাইয়া? কোনো সমস্যা?”
নুহান তাকালো রোজের মুখের দিকে। মেয়েটার মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাঁপ ফুটে উঠেছে। নুহানের ওর এই ফেস দেখে বেশ হাসি পেলো। আর একটু হলেই কেঁদে দিবে মেয়েটা।
নুহান ইশারায় কাছে ডাকলো রোজকে। রোজও গিয়ে বসলো ভাইয়ের পাশ ঘেষে। নুহান একহাত দিয়ে বোনকে আগলে ধরে বলল,
“জীবনে অনেকসময় আসে যখন মানুষ আর আগের মতো চলতে পারে না। চাইলেও পারে না। বাস্তবতা তাকে চলতে দেয় না। যেমন ধর আগে তুই স্কুল থেকে ফেরার সময় দোকান দেখলে দাঁড়িয়ে যাইতি যতক্ষণ না পর্যন্ত তোকে চিপস বা চকলেট কিনে দেওয়া হতো তুই নড়তি না। এখন কি তা করিস?”
রোজ মনোযোগ দিয়ে ভাইয়ের কথা শুনছিলো। ভাইয়ের প্রশ্নের পিঠে সে দ্রুত নাবোধক জবাব দিলো। নুহান একই ভঙ্গিতে আবারো বলে উঠলো,
“তেমনি সময়ের সাথে সাথে মানুষের স্বভাব পাল্টে যায়। সময় সময় চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায় পলকের মাঝেই।”
রোজ কি বুঝলো কে জানে? হুট করে ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। নুহান বুঝতে পারলো না রোজের কান্নার কারণ। তবুও স্নেহের সাথে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রোজ নাক টেনে বলতে লাগলো,
“না ভাইয়া তোরা পাল্টে যাস না। তোরা পাল্টে গেলে আমি হারিয়ে যাবো বলে দিলাম।”
নুহান হাসলো। রোজকে বুক থেকে তুলে রোজের চোখ থেকে পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“ধুর পাগলি আমরা কেন পাল্টাতে যাবো। আমি তো জাস্ট কিছু কথা বলছিলাম। আসলে আমার একবন্ধুর প্রেমিকা ওকে ঠকিয়ে দুইদিন আগে বিয়ে করে ফেলেছে অন্য একটা ছেলেকে তাই বন্ধুর জন্য একটু মন খারাপ ছিলো।”
রোজ বাচ্চাদের মতো করে বলল,
“সত্যি তো!”
নুহান এবার হেসে দিলো। রোজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম বাবা সত্যি। এবার হাসি দে দেখি।”
রোজ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। দুই ভাই তাকে ছোট থেকেই বেশ আদর দিয়ে মানুষ করেছে। দুইজনেরই ছোট কালের বাচ্চা পুতুল হচ্ছে রোজ। যাকে তারা সবকিছু থেকে আগলে রেখেছে। তাই তো দুইভাইয়ের কাছে রোজ এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছে।
নুহান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“হয়েছে এবার উঠে খাবার দে তো। ক্ষুধায় পেটটা চুইচুই করছে।”
রোজ হেসে রান্নাঘরে গেলো। জান্নাত বেগম আড়াল থেকে সবটা দেখে মুচকি হাসলেন।
অন্যদিকে সারা কেবলি শাওয়ার থেকে বের হয়েছে তখনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। নেহাল যাওয়ার পর থেকে বিছানায় অযত্নে পড়ে আছে ফোনটা। সারা চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। নেহাল কল করেছে। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই নেহাল কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,
“ফোন কোথায় রাখো? সকাল থেকে কতবার কল করেছি তার ঠিক আছে? বাসায় তো থাকো তাহলে কল ধরতে কি সমস্যা হয়?”
সারা কিছু বলতে নিবে তার আগেই নেহাল আবারো বলে উঠলো,
“সমস্যা কি তোমার? তুমি কি এখনো ছোট বাচ্চা?দেখতেছো কাজে আসছি এখানেও কি তুমি আমায় শান্তি দিবে না?”
সারার চোখের কোণে পানি জমা হলো নেহালের শক্ত কথা শুনে। তবুও মুখে হাসি নিয়ে বলল,
“সরি, আসলে ফোনটা রুমে ছিলো। আমাকে নিয়ে যখন এতোই সমস্যা আগে বললেই হতো। চিন্তা করো না শান্তিতে থাকো। আমি কিছু বলবো না আর।”
বলেই কলটা কেটে দিলো সারা। নেহাল ফোনের দিকে তাকাতেই ওর আরো মেজাজ খারাপ হলো। আবারো সারার নাম্বারে ডায়েল করলো কিন্তু বন্ধ। রাগে ফোনটাকে বিছানার উপরে ছুড়ে ফেলে নিজের চুল টেনে ধরলো।
সারা ফোনটাকে বন্ধ করে উদাস মুখে তাকালো জানালার দিকে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ঠিক তার চোখ নিয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলের মতো।
রোজ সারাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে সারাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো। সারার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে ভাবি?”
সারা নিজের চোখের পানি আড়াল করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কই কিছু না তো। কিছু বলবে?”
রোজ হাসলো। সারার পাশ ঘেষে বসে বলল,
“কিন্তু তোমার চোখমুখ তো অন্য কিছু বলছে।”
সারা উত্তর দিলো না। রোজ একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা রাখো এসব চলো তো খেতে।”
সারা উদাসীন হয়ে বলল,
“তুমি যাও আমি পরে খেয়ে নিবো।”
রোজ সারাকে টেনে ধরে খাবার টেবিলের কাছে নিয়ে গেলো। নুহান খাওয়া শুরু করেছে কিছুক্ষণ আগেই। সারা আর রোজ এসে বসতেই জান্নাত বেগম ওদের প্লেট এগিয়ে দিলো। নুহান সারার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাবি তুমি নাকি দাদাইয়ের কল ধরছো না?”
সারা নীচু গলায় বলল,
“ফোনে চার্জ নেই তো।”
নুহান খেতে খেতেই বলল,
“ভাইয়া তোমাকে ফোন ধরতে বলেছে।”
সারা কিছু বলল না। রোজ সারার উদাসীনতা খেয়াল করলেও এখন কিছু বলল না।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রোজ নিজের রুমে গেলো। ফোন করলো নেহালকে। কিন্তু নেহাল কল ধরছেনা। বিরক্ত হলো রোজ। ফোনটাকে টেবিলের উপরে রেখে মায়ের কাছে গেলো। দুপুরের খাবারের পরে একটু বিশ্রাম করার জন্য জান্নাত বেগম বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই তার রুমে এসে হাজির হলো রোজ। রোজকে দেখে জান্নাত বেগম বললেন,
“কিছু কি বলবে নূর?”
রোজ সারার কথা জান্নাত বেগমকে জানাতেই তিনি চিন্তায় পরলেন। রোজের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বলল,
“এখন কি করবো বল তো? ছেলেটা যে কেন এমন করে কে জানে?”
রোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“দাদাই আসলে তুমি একটু বুঝিয়ে দিবে তো ভালো করে। জানোই তো ভাবি একটুতেই মন খারাপ করে বসে থাকে। তার উপরে ও যদি এমন করে তাহলে কিভাবে হবে বলো তো?”
“হুম ওকে কিছু বলতে হবে। আচ্ছা তুই যা আমি দেখছি ব্যাপারটা।ওও ভালো কথা, তুই না হয় সারাকে নিয়ে একটু বাহিরে থেকে ঘুরে আয়। নুহানকেও নিয়ে যা।”
রোজ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। নুহানকে রেডি হতে বলে সে গেলো সারার রুমে। সারা বসে ছিলো বারান্দায়। রোজ ওকে তাড়া দিয়ে রেডি করলো। নিজেও রেডি হয়ে নিলো। আকাশী রঙের কুর্তি,জিন্স আর গলায় আকাশী আর সাদা মিশ্রিত স্কার্ফ। হাতে বেসলেট, কানে ছোট ছোট কানের দুল। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে সামনে দুটো ক্লিপ লাগলো। চোখে কাগজ দিলো গাঢ় করে। ঠোঁটে লিপবাম দিয়ে ব্যাগ আর ফোন নিয়ে বের পরলো। সারা বোরখা আর হিজাব বেঁধেছে। নুহানও রেডি। তার পরনে কালো টিশার্ট আর জিন্স। তিনজন মিলে বের হয়ে পরলো ঘুরতে।
অন্যদিকে জিনিয়া বেশ কিছুক্ষণ ধরে জুবায়েরের সাথে জিদ করছে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জুবায়ের কিছুতেই ওর কথা শুনছেনা। জিনিয়া এবার একটা চুইমগাম এনে বলল,
“ভাইয়া তুই যাবি নাকি বল ভালো করে। না হলে কিন্তু তোর চুলে আমি এটা লাগিয়ে দিবো।”
জুবায়ের চোখ ছোট ছোট করে জিনিয়ার দিকে তাকালো।
“আমি কি তাহলে তোকে ছেড়ে দিবো ভাবছিস। তোর চুলে আমি তেলাপোকা ছেড়ে দিবো। তোর সব চুল তেলাপোকা কেটে দিবে। আর জীবনেও তোর চুল হবে না দেখে নিস।”
জিনিয়া হাত পা ছুড়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“ভাইয়ায়য়য়য়!”
#চলবে