#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৭
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)
এরমাঝেই সাফায়েত কিছু কথা বলে নিজের স্থানে বসলো। জুবায়ের আবারো স্টেজে উঠে একে একে যারা পারফরমেন্স করবে তাদের ডাকতে লাগলো।
মালিহা ঝালমুড়ি, বাটার বন, চিপস এগুলো নিচ থেকে গিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনজন মিলে ভালোই উপভোগ করছে। হাসাহাসি,খুনসুটির মাঝে স্টেজে উপস্থাপনা করতে উঠে এলো নাফি। জুবায়েরই তো এতক্ষণ করছিলো। রোজ বিষয়টাকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে চিপস খেতে লাগলো। তখনি নাফি বলে উঠলো,
“হেলো গাইস! এখন শুরু হতে যাচ্ছে আজকের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ! আপনাদের সবচেয়ে প্রিয় সিনিয়র ভাই জুবায়ের ইব্রাহিম সায়েম এবং তার গ্যাং, আজ একসাথে পারফর্ম করবে!”
সবাই একতালে তালি দিলেও রোজ মুখ ভেংচি কাটলো। আবারো নাফি বলে উঠলো,
“আরে শোনো শোনো! চমকের কথা এখন বলি জুবায়ের এর পার্টনার ঠিক হবে আজকের দর্শকদের মধ্য থেকেই! হ্যাঁ, ঠিক শুনছো! তোমাদের মধ্যেই হবে সেই লাকি একজন।”
পিছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“নির্ঘাত ওর গফকেই ডাকবে। হুদাই আশা দিচ্ছে।”
মালিহা রোজকে ধাক্কিয়ে বলল,
“দোস্ত আমারে যেন পছন্দ করে রে ভাই। প্রেম না করি নাচতে তো পারবো।”
রোজ মালিহার দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখানে কোনো বুড়া ব্যাটার ভাষণ চলছে। আর রোজের পিছনে কেউ অস্ত্র ধরে তাকে দেখতে বাধ্য করছে।
নাফি আবারো বলে উঠলো,
“সো গাইস, এখন সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে। আর যার উপরে স্পটলাইট থামবে, সেই উঠবে মঞ্চে! আর নাচবে দ্যা ক্রাশ বয় জুবায়ের সায়েমের সাথে!”
এরমাঝেই লাইট অফ হয়ে গেলো। চারপাশে হইচই শুরু হলো। কেউ কেউ চিৎকার করছে, কেউ আবার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে ভিডিও করছে। পুরো হল ঘরে শুধু একটাই আলো,স্পটলাইট। ধীরে ধীরে সেটা একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
রোজ যেন একমুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেললো। মালিহা পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো,
“দোস্ত…! যদি আমার উপরে থামে?আমি কি নাচতে যাবো?” তার কণ্ঠে উত্তেজনার ঝাঁপটা। রোজ এখনো চিপস খেয়েই যাচ্ছে।
স্পটলাইট একবার সাফায়েতের দিকে গেলো, সেখান থেকে পাশের বেঞ্চের দিকে। হঠাৎ করেই স্পটলাইট এসে থেমে গেলো রোজের উপর। রোজ চমকালো। স্টেজের পিছন থেকে রোজকে চমকাতে দেখে জুবায়ের বাঁকা হাসলো। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে বলল,
“এবার তুমি কি করো সেটাই দেখার পালা।খুব তো মুখ চালাও এবার তোমাকে হার মানিয়েই ছাড়বো।
খানিকক্ষণের নিঃশব্দতা, তারপর পুরো অডিটোরিয়ামে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো।এদিকে রোজের নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। বুকটা ধুকপুক করছে। সবার চোখ তার উপরে। আরুশা অবাক হয়ে বলল,
“রোজ এখন তুই কি করবি?”
রোজ মুখে থাকা চিপসখানা খুব কষ্টে গিলে তাকালো আরুশার দিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেলো। হার্টবিট এতো জোরে হচ্ছে যেন এখনি হার্টটা খুলে হাতে চলে আসবে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আরুশার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
“আমি তো নাচতে পারি না।”
আরুশার মুখখানাও ছোট হয়ে গেলো। মালিহাও চিন্তায় পড়ে গেলো।এই মুহূর্তে রোজের মনে আর কিছুই ঢুকছিল না। সে শুধু অনুভব করছিল শত শত চোখের ওজন যেন তার উপর চেপে বসেছে। হলঘরের শব্দ কেমন অস্পষ্ট হয়ে আসছিলো। কানে যেন ফিনফিনে গুঞ্জন।
এদিকে নাফি মাইকে ঘোষণা করলো,
“আমাদের আজকের লাকি গার্ল নূর এ জান্নাত রোজ। সবাই তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিন!”
সেই মুহূর্তে স্টেজের ব্যাকলাইট জ্বলে উঠলো। আলো রোজের মুখে এসে পড়তেই ওর চোখ কিছুক্ষণের জন্য ঝলসে গেলো। মালিহা ওকে কনুই দিয়ে ঠেলে বলল,
“যা রোজ এখন না গেলো আরো লজ্জায় পড়তে হবে। সবারটা দেখে কোনোমতে চালিয়ে দিস।”
রোজ দাঁত কিটমিট করে বলল,
“আমি কি এখন জামা পায়জামা পড়ে আছি বলদ যে নাচবো আর সেগুলো ঠিক জায়গায় থাকবে। চোখ ফেলে দেখ তোরা আমাকে শাড়ি পড়াইছিস। আজকে যদি কিছু হয় আমি এসে তোদের খবর নিবো বলে দিলাম। আর ওই লোককে আমি ক্ষমা করবো না।”
রোজ একরাশ রাগ নিয়ে ফুসতে ফুসতে এগিয়ে।চারপাশ থেকে উচ্ছ্বাস, মোবাইলের ক্যামেরা।রোজ যেন এক অনিচ্ছায় তৈরি নাটকের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে মুহূর্তেই।
মঞ্চের দিকে এগোতে এগোতেই রাগের উপরে সংকোচ কাজ করতে লাগলো। গলাটা শুকিয়ে গেছে একদম,পেটের ভিতর গুড়গুড় করছে। আরো একটু এগোতে নিবে ঠিক তখনই জুবায়ের হাত বাড়িয়ে দিলো।
তাকে দেখে মনে হলো যেন সে এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। রোজ হাত রাখতে না চাইলেও চারপাশের মানুষের চিল্লাচিল্লিতে বাধ্য হয়েই জুবায়েরের শক্ত হাতের উপরে হাত রাখতে হলো রোজের। রোজের কম্পিত নরম হাতটা ধরে জুবায়ের বাঁকা হেসে বলল,
“কেমন লাগলো চমক মিস শত্রুপক্ষ?”
রোজ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো জুবায়েরের দিকে। পাতলা গোলাপি ঠোঁটজোড়া কাঁপছে, চোখে একরাশ ঘৃণা, সঙ্গে গিলে ফেলা কিছুটা অপ্রস্তুত ভয়। চারপাশ থেকে উল্লাস আর ক্যামেরার ঝলকানিতে সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। কেবল বুকের ভেতরটা হাঁসফাঁস করছে, আর মনের ভেতর সেই একটাই কথা,
“এই লোকটা আমায় অপমান করার জন্যই এই পরিকল্পনা করেছে।”
তবুও সে নিজেকে টান টান করে রাখলো। মুখে হাসি না থাকলেও নিজেকে স্বাভাবিক করলো। না সে হেরে যাবেনা। শাড়ি পড়েছে তো কি হয়েছে এই লাল মহিষকে সে জিততে দিবে না। তাছাড়া আরো যে দুটো জুটি নাচবে সেই মেয়েরাও শাড়ি পড়েছে।
জুবায়ের তার হাতটা একটু টেনে বললো,
“চলো, সবাই তো তোমার প্রতিভা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে।”
রোজ ধীরে ধীরে স্টেজের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। হালকা ঝুলে থাকা শাড়ির আঁচলটা একটু সামলে নিলো, এক হাতে কানের পাশের চুলগুলো ঠিক করে চোখ সরালো সামনে। দর্শকদের কোলাহল তখন কিছুটা স্তিমিত।সবাই অপেক্ষা করছে, যেন রোজ কী করে সেটা দেখার জন্য নিঃশ্বাস আটকে আছে পুরো হলঘর।
মিউজিক শুরু হলো। শুরুটা হালকা বিটে, কিন্তু ক্রমে গতি বাড়তে থাকলো। জুবায়ের একটা স্টেপ নিয়ে এগোতেই রোজ ঠিক সময়ে নিখুঁতভাবে প্রতিক্রিয়া জানালো। তার পা দুটো যেন শব্দের সাথে ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছে।রোজের চোখের ভেতর স্পষ্ট জেদ, চিবুকটা উঁচু করে রেখেই নাঁচছে সে।
জুবায়ের বুঝতেই পারলো না কখন সে লিড দিচ্ছে, আর কখন রোজ নিজেই ছন্দের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। তার শরীরের প্রতিটা ভঙ্গি এতটাই নিখুঁত, আত্মবিশ্বাসী, আর দৃষ্টিনন্দন যেন সে জন্ম থেকেই মঞ্চে রাজত্ব করতে জানে। তার শাড়ির আঁচল দুলছে ছন্দে, হাতের মুভমেন্টে আছে অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
চারপাশের দর্শকশ্রেণি পুরো নীরব। ক্যামেরা থেমে গেছে, কারণ সবাই এখন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।
♪♪Kasam hai tumhe tum agar mujhse ruthe
Rahe saans jab tak yeh bandhan na toote
Tumhe dil diya hai yeh waada kiya hai
Sanam main tumhaari rahungi sadaa♪♪
জুবায়ের নাচতে নাচতেই অবাক হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি না বলছিলে তুমি নাচতে পারো না?”
রোজ আলতো হাসলো। চোখ তুলে তাকালো জুবায়ের এর দিকে। চোখে চোখ পরলো দুইজনের।
“কেন অপমান না করতে পেরে বুঝি আফসোস হচ্ছে?”
জুবায়ের চুপ করে তাকিয়ে রইলো রোজের দিকে। রোজও তাকিয়ে আছে তারদিকে। জুবায়ের পরনে সাদা পাঞ্জাবী আর রোজের বাদামি রঙের শাড়িতে দুইজনকে বেশ মানানসই লাগছে। তিনটা জুটি নাচছে তুষার-ইলিনা আর রাইসা-উৎসব। রাইসা উৎসব ভালো করে তালে তাল মিলালেও তুষারের সাথে ইলিনা ভালো মতো নাচছে না। এতে তুষার বিরক্ত হচ্ছে। কতবার প্র্যাকটিস করলো তার পরেও না পারলে তো জলে ডুবে মরা উচিত। জুবায়েরের সাথে মেয়েটা কত সুন্দর নাচছে প্র্যাকটিস না করেই। এদিকে ইলিনা ক্ষিপ্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। তুষার দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“নাচে মনোযোগ দে ইলিনা।”
ইলিনার কান অব্দি তুষারের কথা গেলো নাকি তা ঠিক বোঝা গেল না। ইলিনা মনে মনে বলল,
“ওই মেয়ের মধ্যে কি আছে যে সায়েম ওর নাচছে। আমি কত করে বললাম আমাকে নে।”
আবিদ আর নাফি স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে তালি দিচ্ছে। জুবায়ের আর রোজ বেশ সুন্দর করে নাচছে গানের তালে তালে।
♪♪Ye raatein yeh mausam
Nadee ka kinaara, yeh chanchal hawa
Kahaa do dilon ne
Ke milkar kabhi hum na honge jooda
hmm hmmm hmmm hmmm
hmmm hmm hmm hmmm♪♪
গান শেষ হতেই সবাই হৈচৈ করে উঠলো। সাথে হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো হলরুম। রোজ জুবায়েরের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“মেয়ে বলে দুর্বল ভাববেন না। মুখ যেমন চালাতে পারি তেমন সবকিছুই সামলাতে পারি। মনের জেদটাই আসল। তবে এর প্রতিশোধ তোলা রইলো।”
রোজ স্টেজ থেকে নেমে আর দাঁড়ালো না। সোজা বাহিরে চলে গেলো। জুবায়ের সেখানে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের নিচে একটু চুলকে বলল,
“আমি প্রস্তুত মিস শত্রুপক্ষ। তবে ভাবার বিষয় হচ্ছে আমাকে বিপদে ফেলতে গিয়ে নিজে না বিপদে পড়ে যাও।”
আবিদ এগিয়ে এসে বলল,
“তোর এটা করা ঠিক হয়নি!”
আবিদ সহ বাকি সবাই বিষয়টা জানতো না। একটু আগেই নাফিকে সে এব্যাপারে বলে। তাই সবাই বেশ অবাকই হয়েছে। জুবায়ের আবিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“Take it easy bro.”
জুবায়ের সাফায়েতের দিকে গেলো। অনুষ্ঠান শেষের পর্যায়ে।
————–
রোজের পিছনে পিছনে আরুশা আর মালিহা আসলেও রোজ রিক্সায় উঠার পর তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে।
রিক্সায় উঠতেই কান্না পেলো রোজের। রাগে, জেদে চোখটা টনটন করছে। এইবুঝি নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। রিক্সা চলছে আপন গতিতে আর জুবায়েরের উপরে জেদি মনোভাব যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ভালো যে সে নাচতে পেরেছিলো। তা না হলে এতো লাইট, এতো মানুষের সামনে সব চলে যেতো। ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে গেলো।
বাতাস উঠেছে প্রকৃতিতে। চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পরেছে। রোজ খিচে চোখ বুজতেই তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।
নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করেই বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো রোজ। দরজায় দুবার নক করতেই সারা এসে দরজা খুলে দিলো। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি হলো অনুষ্ঠান শেষ?”
রোজ ছোট করে বলল,
“হুম। মাথা ব্যাথা করছে এককাপ কফি ঘরে দিয়ে এসো তো ভাবি।”
বলেই আর দাঁড়ালো না রোজ। দ্রুত পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে। সারা প্রথমে খটকা লাগলেও পরে ভাবলো হয়তো মাথাব্যাথা তাই এমন করছে।
রোজ নিজের রুমে বিছানায় বসলো। বেলা অনেক হয়েছে। ভার্সিটি থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেও সে আগেই চলে এসেছে। বাসায় কিছু বললেও সবাই হাজারো প্রশ্ন করবে। এসব ভেবেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোজ।
জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজলো। মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো জুবায়েরের গভীর দৃষ্টি। দপ করে চোখ খুলে ফেলল রোজ। পানির ঝাপটা দিলো চোখ মুখে।
বেশকিছুক্ষণ যাবত শাওয়ার নিয়ে বের হলো রোজ। সারা রুমেই ছিলো রোজকে দেখে বলল,
“কিছু খাবি? বানিয়ে আনবো।”
রোজ চুল মুছতে মুছতে তাকালো সারার মুখপানে। এই মেয়েটা কেন যেন খুব সহজেই বুঝে যায় রোজের কখন কি লাগবে না লাগবে! ব্যাপারটা বরাবরই মুগ্ধ করে রোজকে।
#চলবে