#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৮
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌)
রোজ মৃদু হেসে বলল,
“এতো ব্যস্ত হতে হবে না। চাইলে নাস্তা পানি আনতে পারো।”
সারা এগিয়ে এসে রোজের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কিছু কি হয়েছে?”
রোজ সারার গাল টেনে বলল,
“ও বহুত কাহিনী। তোমাকে একদিন সময় করে বলবোনি।”
সারা আর ঘাটালো না। যেহেতু রোজ বলতে চেয়েছে সেহেতু সে বলবে। সারা চলে গেলো রোজের খাবার ব্যবস্থা করতে। রোজ সারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। ঝুম দৃষ্টি হচ্ছে। এতো জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে সামনের সবকিছু আবছা দেখাচ্ছে। রোজ তাকিয়ে রইলো বৃষ্টির দিকে। মাথা ঘুরপাক খেতে লাগলো আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। জুবায়েরের উপর আজকে ঘৃণা জন্ম হলো একরাশ। আচ্ছা তার এতো কি রাগ? সেটাই মাথা খেলেনা রোজের। কাঁদায় তো রোজকে সে ফেলেছে। সেই অনুযায়ী রাগ থাকার কথা রোজের।
রোজের ভাবনার মাঝে প্লেটে করে ভাত আর মুরগির তরকারি আর ডাল নিয়ে হাজির হলো সারা। জান্নাত বেগম সকালের নাস্তা বানিয়ে তার বোনের বাসায় গেছেন। সারাই আজ বাড়ির সব কাজ করেছে। নুরুল হোসেন সন্ধ্যায় ফিরবেন। উনি কলেজের টিচার। টিউশন পড়িয়ে আসতে দেড়ি হয়। আর নুহান ভার্সিটি গেছিলো আটকে পড়েছে হয়তো। নেহাল ঘুমাচ্ছে। বেচারার জ্বর, ঠান্ডা লেগেছে।
সারাকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে রোজ অবাক হলো। শুধু মনে মনে হাসলো। সারা কিছু না বলে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসলো। ভাত মাখাতে মাখাতে বলল,
“দেখো তো রান্না কেমন হয়েছে আজকে?”
রোজের মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরতেই সে হা করে মুখে নিলো। খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,
“আচ্ছা আমরা আপন বোন হলাম না কেন ভাবি?”
সারা তাকালো রোজের মুখের দিকে। ডাল দিয়ে রোজের ঠোঁটে পাশে মেখে আছে। চোখ গোল গোল করে বাচ্চাদের মতো এমন করে প্রশ্ন করায় হেসে ফেলল সারা। সারা আরেক লোকমা রোজের মুখে তুলে দিয়ে বলল,
“সমস্যা তো নেই। আমরা তো বোনই।”
রোজ সারার হাতেই পুরোটা খাবার খেলো বেশ তৃপ্তি নিয়ে।
—————
ঘড়িতে রাত তিনটা ছুঁই ছুঁই। তবুও চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই জুবায়েরের। চোখ বুঝলেই রোজের মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। রাগে নাকের পাটা ফুলানো থেকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকানো সবটা যেন একেবারে ঘিরে ধরছে তাকে। মনের মাঝে হঠাৎ করে এক অজানা ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের কারণ বা নাম কিছুই জানে না জুবায়ের।
জুবায়ের নিজের অস্থিরতা কমাতে না পেরে উঠে বসলো। বেডসাইট টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে টালমাটালপায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। বারান্দার গ্ৰিল বেয়ে এখনো টুপটাপ পানি চুয়ে পরছে। জুবায়ের সিগারেট ধড়িয়ে তার ঠোঁট জোড়ার মাঝে চেপে ধরলো। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে তাকালো নিস্তব্ধ রাতের আকাশের দিকে। আকাশে মেঘের টুকরোগুলো নিজ আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হুট করেই জুবায়ের এর রোজকে দেখতে মন চাইছে। যে সে দেখা না একেবারে সামনে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে মন চাচ্ছে। কেন এমন ভাবনা আসছে তাও জানে না জুবায়ের। মনের অস্থিরতা কমার বদলে আরো বেড়েই চলছে।
জুবায়ের কিছু না ভেবেই রুম থেকে বের হয়ে পরলো বাইকে চাবি হাতে নিয়ে। উদ্দেশ্য বাইক নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নিবে তখনি জাহানারা বেগমের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো,
“এতোরাতে কোথায় যাচ্ছো?”
জুবায়ের চোখ বুজে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলল।
“একটু লং ড্রাইভে যাচ্ছি।”
“এতোরাতে!মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমার?”
জুবায়ের কিছু বলল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমার রুমে আসো কথা আছে তোমার সাথে।”
জাহানারা বেগম নিজের রুমে গেলেন। জুবায়ের ও গুটিগুটি পায়ে মায়ের রুমে এলো। জাহানারা বেগম ইজি চেয়ারে বসলেন। জুবায়ের কিছু না ভেবেই মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
জাহানারা বেগম পরম স্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে বাবা?”
জুবায়ের মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারো কোলে মাথা রেখে বলল,
“মা কেন যেন অস্থির লাগছে! কিছু ভালো লাগছে না!”
জাহানারা বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। জুবায়ের এলোমেলো কন্ঠে বলল,
“আম্মু আজকে আমি হয় তো একটা ভুল কাজ করে ফেলেছি। সে অপরাধবোধ থেকে হয়তো এমনটা হচ্ছে।”
“সবটা খুলে বলো তো কি হয়েছে?”
জুবায়ের সকাল থেকে হয়ে যাওয়া সবকিছু বলল তার মাকে। শুধু আর যে রোজকে নিজের সামনে বসিয়ে দেখতে মন চাইছে তা বলল না। বলার মতোও কথা না এটা। জাহানারা বেগম মন দিয়ে জুবায়েরের প্রতিটা কথাটা শুনলেন। জুবায়েরের সব কথা বলা শেষ হতেই উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। জুবায়ের আগ্রহের সহিত মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
জাহানারা বেগম বেশখানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে বললেন,
“বাবা জানো তো মেয়েরা খুব আবেগপ্রবণ হয়। ওরা সামান্য যত্নে যেমন মুগ্ধ হয় তেমনি তোমার দু একটা খারাপ কথায় তাদের মনে ঘৃণা জমা হয়। আজকের কাজটা তুমি সত্যিই ঠিক করোনি। একবার ভাবো তো মেয়েটা যদি সত্যিই নাচতে না পারতো তাহলে কি হতো?”
জুবায়ের মুখে যেন অন্ধকার নেমে এলো। তা দেখে জাহানারা বেগম আলতো হাসলেন। জুবায়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“মানুষ মাত্রই ভুল। ভুল যখন করেছো ক্ষমা চাইতে কিসের লজ্জা। তাছাড়া মেয়েটার সাথে তুমি কেন এমন করলে বলো তো?”
জুবায়ের থমথমে গলায় বলল,
“মেয়েটা যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে আমার সব কাজে বাঁধা দিচ্ছে।”
“বাঁধা দিচ্ছে? সেগুলো কি ভালো কাজ ছিলো?”
জুবায়ের বাচ্চাদের মতো দুপাশে মাথা নাড়ালো। জাহানারা বেগম মুচকি হাসি দিয়ে জুবায়েরের কপালের চুলগুলো সরিয়ে একখানা চুমু দিয়ে বললেন,
“অনেক রাত হয়েছে যাও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবে ওর কাছ থেকে।”
জুবায়ের চুপচাপ মায়ের রুম থেকে নিজের রুমে চলে এলো।
————-
গতসাতদিন যাবত জ্বরের কারণে রোজ বিছানায় ছিলো। অনুষ্ঠানের পরে আর ভার্সিটি যায়নি। শরীরটা এখনো বেশ দুর্বল। তবুও আজ যেতেই হবে। কিছু দরকারি নোট নিতে হবে। সামনে পরীক্ষা আছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিলো রোজ। কালো কুর্তি,সাদা রঙের ডেনিম প্যান্ট আর গলায় সাদা রঙের স্কার্ফ। চুলগুলো তেল দেওয়া তাই বেনি করে ফেলল। ঠোঁটে লিপবাম দিয়ে হাতে ঘড়ি পরলো। মুখটা এখনো শুকিয়ে আছে।
কোনোমতে অল্প একটু খেয়ে রোজ নেহালের সাথে বের হয়ে পরলো। সারা রাস্তা নেহালের পিঠে ভর করেই ভার্সিটি এলো। নেহাল রোজকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“খারাপ লাগলে সাথে সাথে আমাকে কল করবি। আমি চলে আসবো তোকে নিতে।”
রোজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মাথা নাড়ালো। রোজ চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নেহাল সেখানেই ছিলো।
রোজকে প্রায় সাতদিন পরে ভার্সিটিতে আসতে দেখে কোথায় থেকে যেন দৌড়ে মালিহা ওর কাছে আসলো। এতোই জোরে দৌড় দিয়েছে যে কথা বলতে পারছেনা সে। রোজের হাসি পেলো মালিহাকে হাঁপাতে দেখে।
“কিরে পিছনে কি পাগলা কুত্তা ধরছে নাকি?”
মালিহা রোজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন কেমন আছিস?”
রোজ আর মালিহা পাশাপাশি হেঁটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে।
“আগের থেকে ভালো। তোর কি খবর?”
“আমার তো খবর ভালোই। আরুশার আসতে আরো কতদিন লাগবে?”
“আজ রাতেই রওনা দিবে। দাদা মারা যাওয়ার ওর দাদি বেশি ভেঙে পড়েছে। দাদিকে এখানে আসার জন্য রাজি করাতে করাতেই দেড়ি হচ্ছে।”
“বয়স্ক মানুষ তো গ্ৰামের মায়া ছাড়তে পারে না।”
ওদের কথার মাঝেই ওদের সামনে এসে হাজির হলো রেদোয়ান।
“হ্যালো বিউটিফুল লেডি!”
রোজ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো সামনের দিকে। ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেলো তার। রোজ কপালে ভাঁজ ফেলেই বলল,
“এই ক্যাবলাকান্ত মার্কা হাসি দিবেন না তো। কি সমস্যা কি চাই?”
রেদোয়ান দাঁত বের করে হাসছিলো। রোজের কথায় দাঁত গুলো লুকিয়ে বলল,
“এতোদিন আসোনি যে? অসুস্থ নাকি!”
রোজ নাক মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না বিয়ে করেছি তো তাই আসি নি।”
রোজের কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো রেদোয়ানের। রেদোয়ান অবাক হয়ে বলল,
“কি তুমি বিয়ে করে ফেলেছো?”
রোজ চোখ ছোট ছোট করে রেদোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন কোনো সমস্যা নাকি আপনার? নাকি ছোট হয়ে আপনার আগে বিয়ে করেছি বলে জেলাস?”
রেদোয়ান মাথা দুইপাশে নাড়িয়ে বলল,
“না না তা কেন হবে!”
রোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আর কিছু?”
রেদোয়ান আবারো মাথা নাড়িয়ে না বলতেই রোজ মালিহার হাত ধরে গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলো। এদিকে রেদোয়ানের থেকে সরে আসতেই মালিহা পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো।
“ভাইরে ভাই ব্যাটার মুখ দেখে আমার যে কি হাসি আসছিলো বলার বাহিরে।আমি যে কি কষ্টে হাসি দমিয়ে রেখেছিলাম।”
রোজ মৃদু হেসে বলল,
“আরে ব্যাটা ক্যাবলাকান্তকে একটু ক্যাবলা আলু বানালাম। ফ্লাট করতে আসছিলো। আবার কয় বিউটিফুল লেডি, তোর মুখে গোবরের গু।”
রোজের কথা শুনে মালিহার হাসির গতি যেন আরো বেড়ে গেলো। মালিহার হাসিতে আশেপাশের মানুষ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই রোজ ধুম করে এক কিল বসালো মলিহার পিঠে। মালিহা সাথে সাথে থেমে গেলো। রোজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তোর এই এক বদ অভ্যাস। তোরে বিয়ে দেওয়ার সময় তোর জামাইরে বলে দেওয়া লাগবে যখনি ও হাসবে ওর পিঠ ধুমধাম কিল দিবেন।”
মালিহা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“ভালো কথা তো জীবনেই বলবি না জানি আমি।”
রোজ গোপনে আলতো হাসলো।
#চলবে