প্রলয় পুতুল পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
34

#প্রলয়_পুতুল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৯(অন্তিম পর্ব)
কপি করা নিষিদ্ধ 🚫❌

জুবায়ের, আবিদ, নাফি, উৎসব সবাই মিলে বসে ছিলো। জুবায়ের ওদের সাথে কথা বলছিলো তখনি তার দৃষ্টি যায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রোজ আর রেদোয়ানের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে। আবিদ জুবায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো। কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ ফেলে বলল,
“আচ্ছা জুবায়ের একটা সত্যি কথা বলবি?”

জুবায়ার চোখ ঘুরিয়ে আবিদের দিকে তাকালো। সবার দৃষ্টি এখন আবিদের দিকে। আবিদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“রোজের সাথে তোর এতো শত্রুতা কেন একটু খুলে বলবি আমায়?”

জুবায়ের খানিকক্ষণ চুপ থাকলো। গলা খাকারি দিয়ে বলতে লাগলো,
“যেদিন ও আমাকে কাঁদায় ফেলে দেয় সেইদিন আমার পকেটে একটা পেনড্রাইভ ছিলো। যেটা দিয়ে আমি প্রেজেন্টশনের কাজ ব্যবহার করবো সেটা তখন আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। তোরা তো জানিসই। সেদিন যদি ওই মেয়ে আমাকে কাঁদায় না ফেলতো তাহলে আমার এতো কাঠখড় পুড়িয়ে স্যারদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে হতো না।

জুবায়ের একটু থেমে আবারো বলতে লাগলো, “আর পরবর্তী কারণ হচ্ছে সেদিন রেদোয়ানের চেয়ারে কি আমি এমনি এমনি চুইগাম লাগাতে গেছিলাম নাকি! সেদিন রেদোয়ার আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছিলো। আমি নাকি সব মেয়ের সাথে লাইন দিয়ে বেড়াই। এটা আমার আম্মুর কানে অব্দি চলে গেছে। আমি চাইলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম কিন্তু আমি জাস্ট ও যেমন আমার খিল্লি উড়িয়েছে ওরও খিল্লি উড়াইতে চাইছিলাম। সেখানেও ওই মেয়ে এসে বাঁধা। হ্যাঁ আমি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার জন্য দুইদিন ওর অপেক্ষা ছিলাম। আর ও তেই ভার্সিটিই আসে নাই।”

আবিদ তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ওর জ্বর ছিলো এতদিন। বেচারি কতটা ট্রমায় পরলে জ্বরে এসেছে তা ভাবতে পারছিস তুই। তাছাড়া সেদিন মেয়েটা দাবি করেছিলো তুই ওকে কাঁদায় ফেলে দাঁত কেলিয়ে হাসছিলো। ওর জায়গায় আমি হলেও তো তোকে কাঁদা চুবানি দিতাম। আর রেদোয়ান তো সবার সামনেই চিৎপটাং হয়ে নিচে পড়ে গেছে। তোর কাজ তো না হয়েও হয়ে গেছে।”

“আমি তো ওকে কাঁদা ফেলিনি।”

আবিদ জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই হয়তো ইচ্ছা করে ধাক্কা দিসনি। তবে তুই ছাড়া সেখানে কেউ ছিলো না। আমি জানতাম তুই একথা বলবি, তাই আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। সেখানে তুই ফোনে কথা বলছিলি। তোর মনোযোগ ছিলো না অন্যদিকে। তখনি তুই রোজকে পাশকাটিয়ে যেতে ধরিস তখনি রোজ পিছনে ফিরে দেখতে নেয় এবং টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। তুই সোজাসুজি যুক্ত না থাকলেও একদিক দিয়ে তো যুক্ত।”

নাফি এরমাঝেই আবিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওয়েট ওয়েট তুই এসব কেমনে জানলি?”

আবিদ নাফির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আরুশাকে ক্লাস টেনে পড়াইছিলাম। জুবায়ারের দুইদিন ধরে রোজকে খুঁজছিলো তাই আমি আরুশাকে জিজ্ঞাসা করছি কি হয়েছে? ওই বলছে সবটা।”

নাফি ঠোঁট গোল করে বলল,
“ওওও”

আবিদ এবার জুবায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন কি ভাবলি?”

জুবায়ের কিছু না বলেই চুপ করে বসে রইলো।

————–

দুটো ক্লাস শেষ করে মালিহা আর রোজ একসঙ্গে ক্যান্টিনে এলো। হাতে এখনো একঘন্টা বাকি পরবর্তী ক্লাসের জন্য। তাই রোজ খাতা বের জমে যাওয়া নোট গুলো লিখতে লাগলো। মালিহা চা আর পাউরুটি নিয়ে এলো মালিহা কথা বলছে আর রোজ সময় সময় হাসছে আর লিখছে।

তখনি একটা পুরুষালি কন্ঠে রোজের কলম থেমে গেলো।
“নূর!”

রোজ ভরকে গেলো নূর নামে শুধু তার মা ডাকে। চেনা পরিচিত যারা আছে সবাই রোজই ডাকে। রোজ ঘুরে তাকালো দেখলো জুবায়ের। মেজাজ খারাপ হলো তার। তবুও স্থির বসে রইলো। জুবায়ের রোজের সামনাসামনি চেয়ার টেনে বসলো। মালিহা রোজের পাশেই বসে ছিলো। একপলক মালিহার দিকে তাকিয়ে আবারো রোজের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
“শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ ছিলে?”

রোজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“শুনে খুশি হয়েছিলেন বুঝি।”

জুবায়ের অন্যদিকে তাকালো। এই মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা সে। চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বলল,
“ওসব বাদ দেও এখন। তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি।”

রোজ শান্ত ভঙ্গিতে কলমের হেড লাগিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে দুইহাত একসঙ্গে করে টেবিলের উপরে রেখে বলল,
“আমার সাথে আপনার কথা থাকার কথা না। যেহেতু আপনি আমাকে শক্রপক্ষ বলে মানেন। আর শক্রর সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলাটা বেশ বেমানান মিস্টার জুবায়ের ইব্রাহিম।”

জুবায়ের রোজের মতো করেই হাত টেবিলের উপরে রেখে রোজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।”

রোজ মুচকি হেসে বলল,
“জানি আমি। আসল কথা বললে বলুন। আপনার মতো অযথা সময় আমার কাছে নেই।”

জুবায়ের ফোস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আই এম সরি। আমার আসলে তোমাকে স্টেজে ডাকা সেই দিন উচিত হয়নি।”

রোজ হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। টেবিলে একটু আওয়াজ করে ব্যাগটা রেখে আস্তে কিন্তু কিছুটা রুক্ষ কন্ঠেই বলতে লাগলো,
“বাহ বাহ আপনার কথা শুনে হাসিতে আমার পেট গুড়গুড় করছে। সিনিয়র হয়েছেন দেখে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? আপনাদের ভদ্রতা, সম্মান, বিচারবোধ সবই শুধু ক্লাসে স্যারদের সামনে থাকে বুঝি? বাইরে এলেই আমি যা খুশি তাই করবো টাইপ ভাব!

একটা মেয়ে ভুল করলে ওকে অপদস্থ করতে হবে, কাঁদায় ফেলে দিতে হবে এটাকেই আপনি কি পুরুষসুলভ সাহস মনে করেন? যেদিন আপনি আমাকে কাঁদায় ফেলে দাঁত কেলিয়ে হাসছিলেন, আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল জানেন?সেদিন যখন স্পটলাইট এসে আমার উপরে পড়েছিলো তখন আমার ভিতরে কি চলছিলো জানেন? কতজোড়া চোখ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো দেখেছিলেন? এগুলো তো আপনাদের চোখেও পড়ে না। এগুলো নিয়ে ভাবেনও না।”

রোজ একটু দম নিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
“আমি যদি নাচতে না পারতাম তাহলে আমার কি হতো বুঝতে পারছেন সেটা? সারা ভার্সিটিতে আমি মজা করার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াতাম। আপনারও তাতে মজা পেতেন। কিন্তু আমার মানসিক চাপের ব্যাপারে একবারো ভেবেছিলেন? না এসব না ভেবে আপনাদের সো কল্ড মজা আর প্রতিশোধের জন্য আমাকে হাসির খোরাক বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।আপনার সরি শব্দটা বড্ড সস্তা হয়ে গেছে এখন। কষ্টটা শুধু শরীরে না, মনে লাগে জুবায়ের।”

জুবায়ের একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাগে লাল হয়ে যাওয়া রোজের মুখের দিকে। মালিহা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। রোজ জিভ দিয়ে তার শুষ্ক গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল,
আপনার কি ধারণা, আপনি সিনিয়র বলে যা খুশি করতে পারবেন? আপনি কি জানেন, কতজন শিক্ষার্থী আপনাদের এমন মজার শিকার হয়ে বিষ খায়, চলে যায় চিরতরে? বাংলাদেশে র‌্যাগিংয়ের কারণে মানুষ মারা গেছে, শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে। আপনার এসব জানার দরকার ছিলো, মিস্টার জুবায়ের।

আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা। কারণ আপনি যা করেছেন, সেটা শুধু আমার না আমার মতো আরো অনেকের ক্ষতির প্রতিচ্ছবি। আজ আমি মুখ খুললাম কারণ আমি চুপ করে থাকতে পারি না।”

জুবায়ের স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ভিতরের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না। রোজ ব্যাগে খাতা ঢুকিয়ে কাঁধে নিয়ে বলল,
“নেক্সট টাইম আমার সামনে আসবেননা দয়া করে। আপনাকে দেখলেই আপনার করা কাজ গুলো আমার চোখের সামনে ভাসে আর ট্রমায় চলে যাই আমি। আশা করছি কথাটা মনে রাখবেন।”

বলেই রোজ গটগট পায়ে চলে গেলো সেখানে থেকে। জুবায়ের এখনো তাকিয়ে আছে রোজের বসা সেই জায়গাটার দিকে। যেখান থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে রোজ।

মালিহা একপলক জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে ছুট লাগালো রোজ পিছনে। রোজ আর পিছনে ফিরে তাকায় না। সে তার মতো সামনে এগিয়ে যায়।

——————–

সময় বয়ে গেছে। বছর পাঁচেক।

শহর বদলে গেছে। মানুষ বদলে গেছে।
বদলায়নি কেবল সেই এক মুহূর্ত যেটা জুবায়ের আজও ভুলতে পারেনি। অফিসে যাওয়া আসা নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে।

তেমনি একটা ব্যস্ততম দিনে রাস্তার তীব্র জ্যামে বাইকে বসে আছে জুবায়ের। অফিস থেকে ফিরছিল, খুব ক্লান্ত শরীর, ঘাম সাদা রঙের শার্টটা ভিজে একাকার অবস্থা।

হঠাৎ করেই একটা অর্ধপরিচিত কন্ঠ কানে এসে লাগলো জুবায়েরের। জুবায়ের আশেপাশে তাকাতেই চোখে পরলো রিক্সায় একটা মেয়ে চরম বিরক্ত নিয়ে বসে আছে আর বলছে,
“মামা জ্যাম ছাড়ছে নাকি দেখুন তো। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমার।”

হাতে একটা বড় ফাইল, পরিপাটি চেহারা,মাথা হিজাব বাঁধা, কাঁচা হলুদ রঙের সিম্পল একখানা সালোয়ার কামিজ,চোখে চশমা।চেহারায় শান্ত, দৃঢ়, অথচ পরিচিত সেই আগুনভরা দৃপ্ততা এখনো আছে।

মেয়েটা আর কেউ না নূর এ জান্নাত রোজ। সেইদিনের পর একই ভার্সিটিতে দুইজন থাকলেও কোনো রকম কথাবার্তা হয় নি। এমনকি দুইজন দুইজনের সাথে দেখা হলেও বেশ ভালোভাবেই এড়িয়ে গেছে। অবশ্য সেইসব কাহিনীর পর জুবায়ের ভার্সিটি ছিলো খুব কম সময়ের জন্যই। পড়াশোনা শেষ হয়ে যায় তার।

একটু পর আস্তে আস্তে জ্যাম ছাড়তে থাকে। এরমাঝেই রোজের রিক্সাটা চলে যায়।

জুবায়ের দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক চালাতে লাগলো সে।লোকজন পাশ কাটিয়ে চলে যায়, কেউ তাকে চিনে না
কিন্তু সে চিনে তার চরম ভুলে ফেলে আসা ইতিহাসকে।

ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যায়। কত কিছু মনে পড়ে যায় রোজের প্রতিবাদ, দৃঢ় গলায় বলা শেষ কথাগুলো।

আর মনে পড়ে, তার জীবনে আর কেউ কখনো ওভাবে চোখে চোখ রেখে তাকে থামাতে পারেনি। রোজকে সে এখনো ভুলতে পারেনি। তার সেই অগ্নিঝড়া দৃষ্টি এখনো অযাচিত মনের কোণে ভেসে উঠে সময় সময়। সে জানে তার অযাচিত মনের ভাবনার পরিণতি জীবনেও হবে না। তবে মানুষ তবুও আশা করে। এটা শুধু জুবায়েরের ক্ষেত্রে না প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রেই হয়।

নিজের মনে হেসে ফেলে সে। আস্তে করে বলে,
“তুমি আসলে শুধু রোজ না তুমি ছিলে প্রলয় একেকটা কথায়, একেকটা চোখ তুলে তাকানোয়।”

“তুমি ছিলে প্রলয় পুতুল।
একটা পুতুল, যাকে সবাই সাজাতে চায়,
অথচ যেটা প্রতিবাদ করে নরম কাঠের মধ্যে লুকোনো আগুন হয়ে। তুমি ছিলে সেই আগুন, সেই প্রতিধ্বনির ন্যায় বাজতে থাকে সারা জীবনে।যেটা চুপ থেকেও বলে এবার আর না।”

জুবায়ের বাইক টান দিয়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে। হয়তো রোজও চলে গেছে নিজের প্রয়োজনে নিজ গন্তব্যে।

#সমাপ্ত