প্রাচীর পর্ব-০৫

0
743

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৫

সুর্বণা ভিলায় ওয়াহিদ এলো আজ দু- দিন পরে। মায়ের উপরে অভিমান করেই আসে নি। স্নেহ, ভালোবাসাকে কখনো শেকল হিসেবে ব্যবহার করতে নেই। ব্যবহার করলেই ছিঁড়ে ফেলার একটা প্রবণতা আসে। আর তার মায়ের সব ভালো গুণের মধ্যে একটা খারাপ দিক হলো, তিনি সব কিছু নিজের মতো চান। প্রথমে বলবেন, তারপর রাগ দেখাবেন তারপর বাধ্য করবেন। যে কোন উপায়ে। বাবা কখনো মায়ের উপরে কিছু বলেনি, ওয়াহিদও বলে না। বাবা মারা যাওয়ার পরে আরো না। একজনতো চলেই গেছে, মা চলে গেলে বাঁচবে কি নিয়ে। এটা মা জানে, জেনেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ভালোবাসাকে কখনো হাতিয়ার বানাতে নেই। হাতিয়ার, হাতিয়ার’ই হয়। সেটা ভালোবাসার তৈরি হোক আর লোহার। ছিন্নভিন্ন করবেই। তাই আজও আসার কোন ইচ্ছে ছিল না। নিতু ফোন করে ফোনের ভেতরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, — মায়ের যদি কিছু হয়, তোমার ভাব আমি ছুটিয়ে ফেলবো বলে দিলাম ভাইয়া।

মায়ের প্রেশারের সমস্যা আছে। হঠাৎ করেই অবস্থা খুব খারাপ হয়। নিশ্চয়ই এই দু- দিন কোন ঔষুধ নেয়নি। মায়ের উপরে যতো অভিমান’ই থাক। অসুস্থতার কথা শুনে কোন সন্তানের পক্ষেই বসে থাকা সম্ভব না। আর ওয়াহিদের পক্ষে তো আরো না। সে এগিয়ে মায়ের পাশে বসলো। সেই দিন তার মায়ের মতোই আলতো করে, সেও তার মায়ের মাথায় হাত রাখলো।

সুর্বণা ছেলেকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ছেলে অভিমান করে সেইদিন মাথা থেকে হাত সরিয়ে দিলেও, সে হাত টেনে বুকে নিলো। মেয়েরা বড় হতে হতে ঘরকুনো হয়। ছেলেরা যায় বাহিরে। সেই বাহির থেকে ফেরাতে সুতোর প্রয়োজন হয়। অনেক আগে ভুল করে ভুল সুতোয় তারা ছেলেকে বেঁধেছিল। এখন না পারছে কাটতে, না পারছে সইতে।

এমন এক ভুল সুতোয় ফেসে গিয়েছিল তার ছোট বোন । তার কাছেইতো বড় হয়েছে। সন্তানের মতো আগলে রাখতেন, সব আবদার মুখে আসার আগেই পূরণ করতেন। ছোট্ট একটা ভুল! সেই ভুলে তার আদরের বোন আজ অন্য জগতে। আর যার জন্য আজ আদরের বোন অন্য জগতে, তার মেয়েকে কিভাবে সে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেবে? অনেক দিন পর সুর্বণা হেরে গেলেন। মমতার কাছে হারলেন। সন্তান হারানোর চেয়ে হেরে যাওয়া ভালো। তবে এই হারার মধ্যেও জিৎ আছে। কেননা নিজে থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না।

______

নিশাত তার আরামের চাকরির আরামের অফিসে এসে পৌঁছালো সারে দশটারও পরে। ঠান্ডা লাগবে কি না কে জানে? মাথা ভার হয়ে আছে, নাক গলা চেপে আসছে। সে এক কাপ আদা চা বলে নিজের জায়গায় বসলো। বসলেও অবশ্য আজকে শান্তি নেই। হাতের কাজ জানা দরিদ্র মহিলাদের জন্য দশটা সেলাই মেশিন পাস হয়েছে। মেশিন দশটা, মহিলা এসে হাজির হয়েছে দুনিয়ার। এমনিতেই ছোট্ট অফিস তার মধ্যে এমন হইচইয়ে নিশাতের মাথা ধরে যাচ্ছে। তবুও ভাগ্য ভালো হাসিব ভাই সামলাচ্ছে। তার দ্বারা আজ এসব হতোই না। সে গা এলিয়ে বসতেই ফোন বাজলো। আননোন নাম্বার! আজকেও অবাক হলো না। না সেই নাম্বার থেকে আর কল আসেনি। অবশ্য আসার রাস্তা সে রাখেইনি। বাসায় ফিরেই আগে ব্লক। এসব অতি ভদ্র ছেলেদের ভালো করেই জানা আছে তার। মেয়েদের কন্ঠ শুনলেই ইচ্ছে করে বানিয়ে বানিয়ে অন্য নাম বলবে। এক কথায়, দু- কথায় কথার মালা গাঁথবে। তারপর’ই তো শুরু হয়, রেলগাড়ির ঝক ঝকা ঝক, ঝক ঝকা ঝক। সে বাবা এসব ঝক ঝকা ঝকে নেই। আগেই সব রাস্তা ক্লোজ। পুরোপুরি ক্লোজ!

তাই আগের মতোই অতি ভদ্র সত্তা কে জাগিয়ে সুন্দর ভাবে রিসিভ করলো। কাজের ফোনও তো হতে পারে। কিন্তু তাকে হতাশ করে সেই আগের কন্ঠই তার চেয়েও গলে গিয়ে বললো, — আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।

নিশাত বড় একটা শ্বাস ফেললো! শ্বাস ফেলে বললো, — ওয়া আলাইকুমুস সালাম জনাব। আমি সাদিয়া বলছি না। এটা রং নাম্বার বলেই ফট করে আজকেও কাটলো।

আসিফ অসহায় ভাবে ওয়াহিদের দিকে তাঁকালো। আজকে অবশ্য সে ল্যাপটপে ডুবে নেই। সে অফিসের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আসে। দৃষ্টি আসিফের উপরেই।

আসিফ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ছেলেটার সাথে তো খাপে খাপেই সব মিলছে। ফোন করতেই ধরলো। কথাও বললো সুন্দর করে। স্যারের কথাও জিজ্ঞেস করলো । তবে এর বেলায়’ই এমন গড়বড় হচ্ছে কেন? বারবার থানায় গিয়ে ঘুরে ফিরে এই নাম্বার’ই আনছে। আবার যেই ঠিকানা দিয়েছে। সেখানে কোন বাড়ি’ই নেই। আবার তার নাম্বার করে রেখেছে ব্লক। বাধ্য হয়েই সব বললো স্যারকে। তার স্যারও কম কি? নাছোড়বান্দা শেষ সীমানা ! নিজের মোবাইল দিয়ে বললো, “এটায় থেকে করো। ” করলোও তাই। এখন দেখো জ্বালা।

ওয়াহিদ ঝট করে উঠল! উঠে মোবাইল এগিয়ে নিজেই কল দিলো।

নিশাত এবার মহা বিরক্ত হলো! কাজের সময় অযথা ঝামেলাা। বলছে না, তবুও এক রেকোর্ড বাজাচ্ছে। কোথাকার কোন সাদিয়া, পাদিয়া। সে বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়েই ফোন রিসিভ করে প্রায় ঝেড়ে বললো, — হ্যালো!

— হ্যালো!

নিশাত থামকালো ! সে ভেবেছিল আগের লোকই। সে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নাম্বার দেখলো। নাম্বার তো আগেরই দেখাচ্ছে। নাকি ভুল হলো কোথাও। কেমন ভারী ভয়ংকর কন্ঠ! এই কন্ঠে যদি কাওকে একবার ধমক দেয়। বাপরে, এক ধমকেই কাজ কাম খালাস । সে সাথে সাথেই গলে গেলো। নরম কন্ঠে বললো, — স্যরি! কে বলছেন?

— সাদিয়াকে দেওয়া যাবে ?

নিশাতের ইচ্ছে করলো, দেয়ালে নিজের মাথা নিজেরই ঠুকতে। আল্লাহ! তার ধারণা ছিল তার ভেতরে অসীম ধৈর্য্য । তবে আজ বুঝলো, ধৈর্য্য অসীম হোক আর সসীম। দুনিয়ার প্যারার কাছে কিছুই কুলোয় না । সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, — হ্যাঁ রে ভাই আমিই সাদিয়া। বলেন কি দরকার?

ওয়াহিদ এক সেকেন্ডের জন্য থমকালো! সেই দিন এক্সিডেন্টের পরে তার তেমন কিছু মনে নেই। তবে আবছায়া একটা মুখ। অন্য কোন মুখ হলে সমস্যা ছিল না। দেখেছে… সে জানে এটা তার ভ্রম! যে মেয়ে তাকে হসপিটালে এনেছে সে পূর্ণবয়স্কা নারী। আর সে দেখেছে সেই দশ বছরের ছোট্ট একটা মুখ। এই মুখ তার মাথায় সেট করা। তাই এমন অবস্থায় হয়ত ভ্রম তৈরি হয়েছে। তবুও কেন জানি তার মনে অন্য রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এটা শেষ করা দরকার। আর শেষ করার জন্য হলেও এই মেয়েটাকে একবার দেখা দরকার। সে নিজেকে সামলে বললো, — কিছুক্ষণ আগে তো অন্য কথা বললেন।

— আর বলা বলি রে ভাই। অভাবের সংসার, মাতাল স্বামী। এর মাধ্যে কি আর মাথা ঠিক থাকে। আপনি বলেন? আপনার বিবেচনায় কি বলে?

— আপনি বিবাহিত?

— বিবাহিত না হলে স্বামী পাবো কোথায়? ভাড়া আনবো এমন কোন দোকানও তো নেই।

— পুলিশ তো অন্য কিছু বললো। অ্যানম্যারিড, কিসে নাকি জব করেন।

পুলিশের কথা শুনে নিশাত আবার থমকালো! ব্যাপার ট্যাপার কি? পুলিশ আসলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে।

সে সাথে সাথেই সোজা হয়ে বসলো। অতি বিনয়ের সাথে বললো — কিসের পুলিশ?

— আপনাদের পুলিশ স্টেশনের।

নিশাতের ভ্রু কুঁচকালো! তাদের থানা পুলিশের সাথে তার কাজ কি? কোথাকার কোন সাদিয়া পাদিয়া। কোন আকাম কুকাম করে রেখেছে কে জানে? এখন নিজের ঘাড়ে টেনে আনছে। সে সাথে সাথেই বললো,– দেখুন ভাইয়া, আমি ফাজলামি করছিলাম। আমি কোন সাদিয়া না। এটা রং নাম্বার। এতবার ফোন দিচ্ছিলেন তাই এইটুকু করলাম। কিছু মনে করবেন না। স্যরি! বলেই আবারো নিশাত ফট কল কাটতে গেলো।

ওয়াহিদ সাথে সাথেই বললো, — ওয়েইট।

নিশাত সাথে সাথেই থামলো! ধুর, দেখতো কোন ঝামেলায় পড়লো।

— পুলিশ স্টেশন থেকে এই নাম্বার দিয়েই বলা হয় এটা মিস সাদিয়ার নাম্বার। তারা সাথে সাথেই চেক করেছে । তো মিস হোয়াট? এনিওয়ে বাই চান্স আপনি এই মোবাইল চুরি করেন নি তো। তাই হয়তো এমন তালবাহানা করছেন।

নিশাত হাল ছাড়লো! ছেড়ে বললো, — ভাই মাফ করেন। আমি তো ভালোই আমার পুরো গুষ্টিতে কোন সাদিয়া নেই। আর এই নাম্বার আমি গত পাঁচ ছয় বছরের উপরে চালাচ্ছি। পারলে খোঁজ খবর নিন গিয়ে।

— তাহলে স্বীকার করছেন না কেন?

— কি স্বীকার করবো?

— আপনি সাদিয়া! পুলিশকে এই নাম্বার আপনিই দিয়েছেন।

নিশাত বিরক্ত আর ভেতরে চাপতে পারলো না। কতো চাপবে? সব কিছুর’ই তো একটা লিমিট আছে নাকি? সে বিরক্ত মাখা কন্ঠেই বললো — আমি দিয়েছি? কবে দিয়েছি। আমার নাম্বার তোর শীতের দিনের কম্বল মনে ফাজিলের ফাজিল। যে নিজে গিয়ে বিলিয়ে আসবো। তোর কোন পুলিশ বাপে বলেছে বল?

ওয়াহিদের রাগ হওয়ার কথা। কেউ তাকে তুই তোকারি করছে। তবুও কেন জানি হাসি পেয়ে গেলো। সে হাসি চেপে বললো, — সেদিন গাড়ি এক্সিডেন্টে দু- জন মানুষ আমাকে হসপিটালে নিয়ে আসেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনি কি তাদের মধ্যে থেকে একজন?

নিশাতের তো আজ ঝটকার উপরে ঝটকা খাওয়ার দিন। ওরে বাবা, এই কাহিনী তাহলে। সেদিন রাত্রে পুলিশ তাদের নাম, ফোন নাম্বার, ঠিকানা সব রেখেছিল। আইডি কার্ড ও চেয়েছিল। আইডি কার্ড সব সময় তার ব্যাগে’ই থাকে। তবুও বলেছে, সাথে নেই। নাম ঠিকানা বলেছে এলোমেলো। কি দরকার অযথা ঝামেলার। সে ভালোই করেই জানে রোগীর জ্ঞান ফিরলেই তাদের আর প্রয়োজন পরবে না। তাই দেখতে আসছে কে? কিন্তু নাম্বারটা বানিয়ে বলতে পারে নি। শয়তান পুলিশ ব্যাটা মোবাইলে কল দিয়ে এমন ভাবে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিলো যেন আমরা খুন করে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার। নাম কি সাদিয়া বলেছিল নাকি? কি জানি তখন মাথায় যেটা ছিল সেটাই বলেছে।

সে নড়ে চড়ে বসে অতি ভদ্র ভাবে বললো, — আচ্ছা! এই কাহিনী তাহলো।

— আপনার কি মনে পড়েছে?

— জ্বি ভাই সাহেব পড়েছে।

— সত্যিই পড়েছে? নাকি আগের মতো দুষ্টুমি করছেন।

— নারে ভাই, এবার করছি না। আপনার খবর কি? যে রক্ত গিয়েছে রে ভাই। আমার এক জামা শেষ। ধুতে গিয়ে দেখি আনারের দানার মত রস বের হচ্ছে।

ওয়াহিদ এবারো নিজেকে সামলালো। আসিফ তার দিকে হা করে তাঁকিয়ে আছে। হাসলে প্রেস্টিজ থাকবে না। এই মেয়ের মাথার স্ক্রু যে ঢিলা তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে নিজেকে সামলে বললো, — আপনি ভালো আছেন?

— জ্বি ভালো।

— আপনাদের কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আপনার কি একদিন একটু সময় হবে?

— না না সেরকম কিছুর দরকার নেই। তাছাড়া ধন্যবাদ আমার সাথে যে লোক ছিল তার প্রাপ্প্য। আপনি বরং তার সাথে যোগাযোগ করুন। আমি শুধু সাথে ছিলাম।

— তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি ও আসবেন। আপনার কি একটু সময় হবে। প্লিজ!

— এসবের প্রয়োজন নেই। তবে এতো কষ্ট করে নাম্বার খুঁজে বের করে কৃতজ্ঞতা থেকে ফোন দিয়েছেন। এর জন্য অসংখ্যা ধন্যবাদ। আজকাল বিপদ ফুরোলে কয়জন আর মনে রাখে। যাই হোক এর পরে গাড়ি চালালে রাস্তাকে বাপের রাস্তা মনে না করার অনুরোধ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষরাও তো চলাচল করে। তাই ভালো থাকবেন! দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থতা দান করুক। বলেই নিশাত আস্তে করে ফোন কেটে দিলো। জীবন বাঁচালেও আজকাল কত প্যারা। ধুর! ভদ্র ভাবে কথা বলতে বলতে চাপা ব্যথা হয়ে গেছে। সে তার আদা চা এগিয়ে নিলো। ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। ধুর! ধুর! সকাল টাই খারাপ।

চলবে…….