প্রাচীর পর্ব-০৬

0
686

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৬

দরজায় নক পড়তেই ওয়াহিদ ফিরে তাঁকালো! সে দাঁড়িয়েছিল ব্যালকনিতে। হাতে কফি মগ। কফির বাজে একটা অভ্যাস আছে তার।

কফির মগটা সাইডে রেখে এগিয়ে এলো। বাজে রাত নয়টা। কিছু সময় হলো সে বাসায় ফিরেছে। ফিরতেই দেখলো ড্রইংরুম তাদের রিলেটিভে ভরে আছে। এসব নতুন না! তাদের গুষ্টিতে মা পীর বাবার মতো। এরকম অবশ্য একজন সব গুষ্টিতেই থাকে, যার ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে সবার চেয়ে বেশি, তিনি সব পাতি হাঁসের মধ্যে চলাফেলা করেন রাজ হাঁসের মতো। যে কোন অকেশানে সবার আগে তাকে জানাতে হয়, যে কোন কাজে তার সাথে পরামর্শ করতে হয়। আর সেই একজন যদি অসুস্থ হয়, দল বেঁধে দেখতে আসবে এটাই স্বাভাবিক।

সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো! এমন না দরজা লক। তার রুমে কারো আনাগোনা সে একদম পছন্দ করে না। রেগুলার ক্লিনিং করা হয় সে যখন বাইরে থাকে। এটা এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ’ই জানে। শুধু মায়ের জন্য ভিন্ন তবে নিতুর জন্য আরো কড়া নিয়ম। তার অ্যাবসেন্টও প্রবেশ একদম নিষেধ। সে অবশ্য নিষেধ শোনার মেয়ে না। প্রায়’ই আসবে, ইচ্ছে করে এটা ওটা এলোমেলো করবে।

ওয়াহিদ কড়া চোখে তাঁকালে বলবে, — হয়তো নিনিত গিয়েছে। এখন ওর সাথেও এমন করবে তুমি? মামার রুমে যাওয়ারও কি ওর হক নেই? দুনিয়ায় মামা, ভাগ্নের কতো সুন্দর সুন্দর গল্প আছে । লোকে বলে মামা – ভাগ্নে যেখানে, আপদ নেই সেখানে। আর আমার ছেলের এমন ভাগ্য মামার ধারের কাছে ঘেঁষতেই পারে না।

ঘেঁষতে পারে না, কথাটা একদম সত্য না। এই পুরো বাড়িতে ওয়াহিদের সবচেয়ে পছন্দের মানুষটা হলো নিনিত। বয়স পাঁচ! একেবারে শান্ত, কোমল, ভদ্র একটা ছেলে। এই রুমে আসা যাওয়ার তার কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এই রুমে আসলে কোন বিরক্ত করবে না। মামার পাশ ঘেঁষে চুপটি করে বসে থাকবে।। ওয়াহিদের তো মাঝে মাঝে মনে হয়, তার বাবা ফিরে এসেছে। তার বাবাও ছিল এমন! একেবারে শান্ত, কোমল, নরম মনের মানুষ।

ওয়াহিদ দরজা খুলে দেখলো লামিয়া দাঁড়িয়ে আছে। লামিয়া তার মায়ের চাচাতো বোনের মেয়ে। অনেকটা সময় সে এই বাড়িতেই ছিল। ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এসেছিল। হোস্টেলে না যাওয়া অবধি এখানেই ছিল। বর্তমানে সে পড়ছে থার্ড ইয়ারে। মা, নিতুর সাথে খুব ভাব। হোস্টেলে থাকলেও যখন তখন এই বাড়িতে তার আনাগোনা চলে।

লামিয়া তাকে দেখে হেসে বললো, — শুনলাম মা, ছেলে একসাথে অসুস্থ হয়ে বসে আছেন?

ওয়াহিদের গায়ে এখন সাদা সিম্পল টিশার্ট, কালো টাউজার। টাউজারের পকেটে দু- হাত পুরে সোজা দাঁড়ালো! ওয়াহিদ হাতে গনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া কারো সাথেই ফর্মালিটিজের বাইরে কথা বলে না। আজও বললো না। সে হালকা হেসে বললো — কেমন আছো?

লামিয়ার মুখটা একটু নিভলো! এমন না সে গায়ে পড়া, বা তার জন্য ছেলের অভাব আছে। তবে কিছু কিছু মানুষের ব্যক্তিত্ব যে কোন মানুষকেই খুব আর্কষণ করে। ওয়াহিদের টাও তেমন। আর এই যে কথা বলার সময় অ্যাডামস অ্যাপলের উঠা নামা । দেখলেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অবশ্য তার এই অনুভূতি কখনো প্রকাশ করার চেষ্টা করতো না। তবে খালামণিই চাচ্ছে তাদের মধ্যে চেনা জানা হোক। তার বাবা, মায়েরও খুব ইচ্ছে। তাইতো ঘুরে ফিরে আসতে হয়। আসতেই খালামণি ঠেলে পাঠায় ছেলের খোঁজ খবর নিতে। অথচ ছেলেকে দেখো। পাহাড়ের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুম তো না যেন গুপ্তধনের দরজা। ভেতরে গেলেই কিছু যেন চুরি করে নিয়ে আসবে। অবশ্য তার খুব ইচ্ছে এই রুমে যাওয়ার। সেকেন্ড ফ্লোর এর প্রায় অনেকটা অংশ নিয়ে এই রুম। অবশ্য নিতুর আপুর মুখে শুনেছে খুবই সিম্পল ইন্টেরিয়র। জাঁকজমকপূর্ণ কোন কিছুই নাকি এই মহাশয়ের পছন্দ নয়।

সে নিজেকে সামলে বললো, — ভালো!

— কখন এসেছো?

— এই তো এক্ষুনি । আপনার কি অবস্থা ?

— ভালো!

লামিয়া ভালো করেই জানে ওয়াহিদ কখনো তাকে ভেতরে যেতে বা বসতে বলবে না। তবে চলেও যাবে না। যা জিজ্ঞেস করবে অতি ভদ্র সুন্দর ভাবেই উত্তর দেবে। তাই নিজে থেকেই বললো, — সবাই নিচে গল্প করছে, আসুনা বসি।

— তোমরা গল্প করো। আমি টায়ার্ড!

— সবার সাথে বসলে ভালো লাগবে। আসুনা প্লিজ!

— আমি এমনিতেই ঠিক আছি।

লামিয়া আর কি বলবে ভেবে পেলো না। সে এমনিতে খুব চটপটে তবে এই মহাশয়ের সামনে এলেই কথা খুঁজে পায় না, গলা শুকিয়ে আসে। তবুও ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, — ঠিক আছেন আপনি? মানে কোন সমস্যা? এতো বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলো।

ওয়াহিদ আগের মতোই বললো, — আমি ঠিক আছি।

লামিয়া জোরপূর্বক একটু হাসলো! হেসে বললো,– আচ্ছা তাহলে আজ আসি। ভালো থাকবেন।

ওয়াহিদ এর বিপরীতে একটা শব্দও বললো না। তবে হালকা একটু হাসলো। এই হাসির অর্থ লামিয়া কি ধরবে বুঝতে পারলো না। সে মুখ ফুলিয়েই চলে এলো।

সুর্বণা আড়াল থেকে সবই দেখলেন। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিতু বিরক্ত মুখে বললো, — এমনিতে তো খুব কথার খই ফুটে। ভাইয়ার সামনে গেলেই ঠুস। আরে বাবা, পুরুষ মানুষ। একটু রং ঢং কর। গলে গলে পড়। তা না, দেখে মনে হয় ভয়ে জমে যাচ্ছে। ভাইয়া বাঘ না ভাল্লুক। যে খেয়ে ফেলবে। এই রকম জমাজমি ভাব দেখলে তো তার নিজেরই বিরক্তি লাগে। ভাইয়া যে ধৈর্য্য ধরে সহ্য করে এই তো কতো। নেকুঢেকু যত্তোসব!

সুর্বণা রাগি চোখে নিতুর দিকে তাঁকালো। নিতু রাগের ধার ধরলে তো? সে যেতে যেতেই বললো, — এই জীবনে ছেলের বউ দেখার সাধ ভুলে যাও। ছেলে তোমার একা একাই মহাসুখী। তো নিজে নাকে তেল দিয়ে আরামছে ঘুমাও। অযথা শুধু শুধু ঘুম হারাম করে বিপি হাই করা।

_____

সাবা প্রায় নেচে নেচে এলো ছাদে। একা আসেনি, লুকিয়ে সাথে নিয়ে এসেছে নিশাত আপার মোবাইল। নিশাত আপা আছে রান্না ঘরে। ফুপুর সাথে। বাসায় যতক্ষণ থাকে ফুপুর অর্ধেক কাজ নিশাত আপা’ই করে। আর এরকম সুযোগ পেলেই সে টুপ করে যে কারো মোবাইল’ই হাতিয়ে নেয়। নিয়ে গেইম খেলে, সাথে মাঝে মাঝে একটু এদিক, ওদিক উঁকি- ঝুঁকিও মারে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের মোবাইলের পাসওয়ার্ড তার জানা। নিশাত আপা বাদে এটা কেউ জানে না। আপা জানে তবুও তার মোবাইলের পাসওয়ার্ড সবচেয়ে সহজ। এই কোনা থেকে ঐ কোনা পর্যন্ত শুধু লম্বা একটা টান। ব্যস কাম খতম! এই পাসওয়ার্ড মোবাইল কিনেছে পর থেকে চলছে। চলছে তো চলছে। মোবাইল শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মনে হয় না বদলাবে।

তখনি মোবাইল বেঁজে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে কেটে দিলো। মোবাইল এখনো সাইলেন্ট করেনি। তাদের বাড়ির দু- পাশেই অন্য বাড়ির প্রায় লাগোয়া ছাদ। এক ছাদ থেকেই অন্য ছাদে সহজেই টপকানো যায়। রাতের বেলা, কেউ থাকলে বোঝার উপায়ও তো নেই। বাবার কানে যদি একবার যায়, থেবড়ানো হাতের একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পড়বে না।

সে ফোন কেটেই তাড়াতাড়ি করে সাইলেন্ট করল। করতেই আবার বাজলো। অচেনা নাম্বার! ধরবে? অবশ্য ধরলেও সমস্যা নেই। নিশাত আপা তরল পদার্থ মানুষ। একেক সময় একেক ম্যুডে থাকে। কোন ডান বাম ছাট কাট নেই। মেজাজ ভালো থাকলে শুধু হাই তুলে বলবে, — যা ভাগ আর খারাপ থাকলে একশ বার কানে ধরে উঠাবসা করা থেকে শুরু করে লাথি পর্যন্তও দিতে পারে। তার দ্বারা সবই সম্ভব। রোবটের মতো হেসে হেসে ভয়ংকর ভয়ংকর দুনিয়ার কাজ কর্ম সে করে ফেলতে পারে।

আপার দ্বারা সব সম্ভব হলেও তার দ্বারা তো আর সম্ভব হয় না। সে চিকনা চাকনা ফড়িং টাইপ মানুষ। কানে ধরা তার জন্য কোন ব্যাপার না। তবে লাথি বহুত ভারী পরে। তাই ধরবে কি না একটু ভাবলো। তারপর রিসিভ করেই ফেলল। হাতে মোবাইল থাকলে হাত নিসপিশ করে। না ধরে উপায় আছে? ধরেই মিষ্টি সুরে বললো, — হ্যালো।

আসিফ আছে বহুত প্যারায়! এই দু’দিন সাদিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। এখন আবার তার ঠিকানা চাই। আরে বাবা, যেই মেয়ে সামান্য নাম বলতে গিয়ে দুনিয়া ঘুরিয়ে ফেলেছে, সে বলবে আবার ঠিকানা। তার তো ভাই মাথা ঘুরছে। এই মেয়ের জন্যই আজকে নতুন সিম কিনেছে। আগের টা তো করে রেখেছে ব্লক। বারবার তো আর স্যারেরটা নেওয়া যায় না। তাই এই ব্যবস্থা। আর এই এতো ব্যবস্থার টেনশনে বেচারা আসিফ কন্ঠ ধরতেই পারলো না। তাই নিজেন স্বভাব মতো অতি অতি ভদ্র ভাবে বলল, — আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। চিনতে পেরেছেন? ঐ যে আমার স্যারের সাথে কথা বললেন।

সাবা ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বলল, — ওয়া আলাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।

— আপনি ভালো আছেন ম্যাডাম?

— জ্বি ভালো।

— ম্যাডাম একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

— কিসের রিকোয়েস্ট?

— আপনিতো দেখা করার জন্য রাজি হলেন না । আমরা আপনার ইচ্ছাকে খুবই সম্মান করি। তবে স্যার খু্বই কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতা থেকেই সামান্য কিছু গিফ্ট পাঠাতে চাই, যদি অনুমতি দিতেন।

— কিসের গিফ্ট?

আসিফ অবাক হলো! এতো সহজে গলবে সে তো ভাবেই নি। কয়েকদিন ধরে যে যে রং দেখাচ্ছে রে ভাই! গিরিগিটি ও ফেল খেয়ে যাবে। সে নিজের অবাক সামলে বললো — এই তো সামান্য কিছু…

আসিফ কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই সাবা বললো, — আপনার কৃতজ্ঞতা আপনার কাছেই রাখেন। আমাদের এই সামান্য গিফ্টের প্রয়োজন নেই।

আসিফ ঘাবড়ে গেলো। সামান্য বলায় আবার রাগ করলো নাকি? সে সাথে সাথেই বললো, — ম্যাডাম প্লিজ! সামান্য ভদ্রতার খাতিরে বলা হয়েছে । আপনার কি কোন বিশেষ চয়েজ আছে? মানে গিফ্ট যেহেতু টাকা দিয়ে কিনবো। পছন্দ মতো হওয়াই ভালো। টাকা টা কাজে আসে। দেখা গেলো আমাদের মতো আমরা দিলাম, আপনার পছন্দ’ই হলো না। আপনি ফেলে রাখলেন। টাকা টা নষ্ট হলো তাই না। তাই দয়া করে যদি বলতেন?

— তা না হয় বললাম। তবে আপনাদের বাজেট কত?

— সেটা নিয়ে ভাববেন না ম্যাডাম। আপনি বলুন! সাথে ঠিকানা ক্লিয়ার করে বললে আমাদের খুব সুবিধা হতো। মানে পাঠাতে গিফ্ট..

সাবা হাসলো! আহারে! গিফ্ট দেওয়ার কতো গরজ। আজকে তো ডুবে যাবিরে বাবা। জীবনে আর কাওকে সেঁধে গিফ্ট পাঠাতে চাইবি’ই না। সে হেসেই বললো, — আমি বরং ঠিকানার সাথে লিখে পাঠিয়ে দেই?

— অবশ্যই ম্যাডাম। কোন সমস্যা নেই। আপনি শুধু সেন্ড করুন। বাকি সব আমরা দেখছি।

— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এবার রাখুন। আমি পাঠাচ্ছি।

— ধন্যবাদ ম্যাম! অসংখ্যা ধন্যবাদ।

সাবা হেসেই ফোন রাখলো! অকাজ টকাজ করে তার দুনিয়ার খুশি খুশি লাগে আজকে লাগছে। কেন জানি বেশি বেশি’ই লাগছে। সে বেশি বেশি খুশি মনেই ম্যাসেজ টাইপ করলো, সাথে তাদের বাড়ির ঠিকানা। অবশ্যই ভালো করেই জানে এই গিফ্ট কখনো আসবে না। গিফ্টের লিস্ট দেখেই তো ব্যাটা তব্দা খেয়ে যাবে। হার্ট অ্যাটাক ও করতে পারে। নিজে সেঁধে এসেছে তার বাবা কোন দোষ নেই।

সে ম্যাসেজ সেন্ড করেই দরজার দিকে তাঁকালো। সজল ভাই ছাদে এসেছে। সাবা ফট করে মোবাইল লুকিয়ে ফেললো।

সজল ভাই ছাদে আসার একটাই কারণ। সিগারেট খাওয়া। ছোট বাড়ি তাদের। ঢেকুর তুললেও এক রুম থেকে আরেক রুমে শোনা যায়। সিগারেট খাওয়া সেখানে বিপজ্জনক। তাই সেইভ জায়গা হলো ছাদ। খেয়ে টেয়ে ধোঁয়াকে আরামছে হাওয়ায় মিশিয়ে দাও। বাবা আবার বয়সের ধার টার দেখেন না। যদি জানতে পারে দেবে সোজা এক চটকানা।

অবশ্য সে ছাড়া এই খবর বাড়ির কেউ’ই জানে না । শুধু এই কথা কেন? এই বাড়ির অনেক কথাই সে জানে যা অনেকেই জানে না। এ যে যেমন সজল ভাই নিশাত আপাকে পছন্দ করে। কেউ তার ব্যবহারে বুঝে? বুঝে না! তবে সাবা ঠিক জানে। সাবা এও জানে নিশাত আপার বিয়ে হয়ে গেছে। অনেক আগে। ছোট্ট বেলায়। ফুপু এই বিয়ের কথা ভুলেও মনে করতে চায় না। আর নিশাত আপু। সে তো ভাই সে, সে দুনিয়ার কিছুই মনে করতে চায় না। আরামছে চাকরি করবে, আরামছে কয়টা খাবে, আরামে একটু শান্তির ঘুম দেবে। ব্যস শান্তি!

চলবে…..