প্রাচীর পর্ব-১০

0
686

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১০

নিশাত দুটো টোস্টের একটাতেও এখনো হাত দেয়নি। সময় পেলো কোথায়? তার আগেই ঘন্টা বেজে গেছে। ঘন্টা বাজুক আর যাই করুক, সে আগেই বলেছে এখন সে বোরোচ্ছে না।

তাই মায়ের চিন্তিত মুখটা উপেক্ষা করেই একটা টোস্ট হাতে নিলো। নিয়ে আরামছেই চায়ের কাপে ডোবালো। কোন আগুন লেগেছে কে জানে? ঝড়, ঝাপটা কুলানোর জন্যও তো শক্তি দরকার। তাই আগেই খেয়ে নেওয়া যাক। আগে পেট পূজা তার পর দুনিয়ার বোঝা।

সে চায়ে ডুবিয়ে মুখে পুরে বললো, — কোন সমস্যা মা? অবশ্য সমস্যা হলেও আমার সমাধান তোমার পছন্দ হবে বলে মনে হয় না । তাই এখানে সময় নষ্ট না করে বরং মামাকে ফোন দিতে থাকো। ধরলে ধরতেও পারে। মেয়ে তোমার ঘাড়ের বোঝা। এখন ঠেলে ফেলতে পারলেই তো বাঁচো। তাই সব গুটুর গু ভাইয়ের সাথেই করো।

সুলতানার চোখে পানি চলে এলো। ভাইয়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে শোনার জন্য মেয়েটার মনে যে খুব অভিমান সে জানে। তবে উপায় কি? দুনিয়া দারি সে যে বড়ই কঠিন। পুরুষের সমাজে একা নারী কতটা অসহায় একমাত্র চৌকাঠ পেরুলেই বোঝা যায়।

সে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতেই খাটে বসলো। বসে বলল, — সুর্বণা ভাবি এসেছে।

নিশাতের ভ্রু কুঁচকে গেলো। ভ্রু কুঁচকেই বললো — সুর্বণা ভাবি কে?

সুলতানা সাদাসিধে মহিলা। পরের বাসায় মাথা গুঁজতে গুঁজতে রাগ জেদ সবই গুঁজে গেছে। তবুও অনেক দিন পরে তিনি মেয়ের দিকে রাগি চোখে তাঁকালো।

নিশাতের মাথায় বাজ পড়লেও এতোটা অবাক হতো না যতোটা মায়ের রাগি চোখে হলো। তার মা রাগতেও জানে? ওরে বাবা! সকাল তো না, যেন হিন্দি সিরিয়ালের এপিসোড চলছে। নতুন করে একেক জনের নতুন নতুন রুপ দেখছে। ঘুম থেকে উঠে দেখলো মামির এখন আবার মায়ের। আজকে আরো কি কি দেখতে হবে কে জানে। সে অবাক হয়েই বললো, — আশ্চর্য! রাগছো কেন? পৃথিবীতে সব মানুষকে সবাই চিনবে এমন কথা আছে?

সুলতানা চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার কেন রাগ হচ্ছে সে নিজেও জানে না। সেখান থেকে যখন চলে আসে নিশাতের বয়স এগারো। এতো দিন পরে মনে না থাকাই স্বাভাবিক। তবে তার তো আছে। তাই চোখে বারবার পানি এসে পড়ছে। কিছু কিছু আঘাতের ক্ষত কখনো শুকিয়ে যায় না। শুধু ব্যথা কমে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, সুযোগটা পেলেই টাটিয়ে উঠে। সে পানি আবার মুছে বললো — কায়সার ভাইয়ের স্ত্রী।

দেখতো! এই কায়সার ভাইটা আবার কে? তাদের জীবনতো না । নাট্যমঞ্চ! যার যখন মন চায় এন্ট্রি নিচ্ছে। সে বিরক্ত মুখেই বললো, — কাঁদছো কেন? আর পেটে কথা রেখে একটা একটা করে শব্দ বের করছো কেন? খুলে বলো?

সুলতানা এবার নিজেও বিরক্ত হলো। এই মেয়েতো সব ধুয়ে মুছে খেয়ে বসে আছে। সে বিরক্ত মাখা কন্ঠেই বললো, — তোর বাপের এক সময়ের বড় ভাই আর তোর শ্বশুর কায়সার ভাই।

নিশাত হা হয়ে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল। তার শ্বশুর ! বিয়ে হলো তার আবার কবে? বলতেই তার ব্রেইনের দরজা ঝট করে খুলে গেলো। আচ্ছা! এই তাহলে কাহিনী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিশাত এক কথাই শুনে এসেছে। তার বিয়ে হবে বাবার এক বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে। না রক্তের কোন ভাইটাই না। এলাকার ভাই! মাকে নিয়ে পালিয়ে তার কাছেই সাহায্য চেয়েছিল বাবা। তারাই আশ্রয় দিয়েছিল। সেই আশ্রয়’ই রক্তের সম্পর্ক ও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন তারা ঠিক করেছিল ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক আরো মজবুত করবে। করুক! সে তখন নাকে প্যান পড়া পুলাপান মানুষ। বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবার সময় আছে নাকি? তখন তো তার সব চিন্তা, কার গলা ধরে ঝুলে চকলেটের আবদার করা যায়, কাকে ফাঁসিয়ে দু- একটা খেলনা কেনা যায়। মায়ে চোখে কিভাবে ফাকি দিয়ে লিপস্টিকের পুরো মাথা মুখে ঘষা যায়।

সেই চকলেট, খেলনা, পুরো মুখে লিপস্টিক ঘষা ঘষির যুগে পুতুল বিয়ের মতো তাদের বিয়ের ছোট্ট আয়োজন করা হলো। পুতুল যেমন জানেনা তাদের সাথে কি হচ্ছে। তারাও তেমন জানে না। সবাই যেমন বললো, তেমনি নাকি করেছে। বউ সেজেছে, বর সেজেছে, কবুল বলেছে। দুজকে পাশে বসে ছবি তুলা হয়েছে। সেই ছবিই বড় করে বাঁধাই করে দু’জনের বাড়ির ড্রইং রুমে টানানো হয়েছে। নিশাতের সকাল থেকে সন্ধ্যা হতো তার বিয়ের ছবি দেখতে দেখতে।

তার কিছুদিন পরেই এক ঝড়। পুরো ঝড়ে তারা লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। সেই ঝড়ে নিশাতরা তাদের সব হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়ল। সেই সাগরে ভাসতে ভাসতে চলে এলো এ বাড়িতে। সেই আসায় আজ চৌদ্দ পনেরো বছর। তো এখন? এখন এই চৌদ্দ পনেরো বছর পর নতুন করে আবার শাশুড়ি কোথা থেকে উদয় হলো? দেখোতো কান্ড! বলেই সে দ্বিতীয় টোস্টটা হাতে নিলো, নিয়ে চায়ে ডুবালো। এজন্যই বলে আপদ, বিপদ সাত ভাই। কাওকে ছাড়া কারো উপায় নাই। আসে গলাগলি ধরে ধরে। যাদের দুয়ারে আসে, তারা দুয়ারে বসে পা ছড়িয়ে কাঁদে। এখন কথা হলো, কাঁদবে টা কে?

সুলতানা বসে বসে মেয়ের কান্ডকারখানা দেখলো। যতো ধাক্কা সে খেয়েছিল, ভেবেছিল নিশাত তার মতোই খাবে। তবে তার ছিটেফোঁটারও লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং সে সব ধাক্কা ধুক্কাকে বাকি টোস্টের সাখে আরামছেই চিবিয়ে খেলো। খেয়ে বাকি চাটুকু ফুরুৎ করে খেয়ে বললো,

— আসলে এসেছে । হাজার হলেও বেয়াই বাড়ি। বেয়াই বাড়ি আসবে না তো কোথায় যাবে? যাও হাতি ঘোড়া সাজিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। একমাত্র মেয়ে তোমার।

— কিসের বেয়াই বাড়ি?

— তোমরাই জানো! আমরা তো ভাই সুতো কাপড়ের পুতুল ছিলাম।

— বাজে বকবি না নিশাত।

— তোমরা করতে পারো আমি বললেই বাজে বকছি।

— তুই কোন সাইড হয়ে কথা বলছিস?

— আমি আমার সাইড হয়ে কথা বলছি।

— নিশাত!

নিশাত হাল ছাড়লো। দশটা প্রায় বেজে চললো। এখন তার উঠতে হবে। হালকা পাতলা গুছিয়ে রেডি হতে হবে। সে হাল ছেড়ে বললো, — মাফ করো গো মা জননী। যা খুশি করো। তবে আমাকে রেহাই দাও।

— কিসের রেহাই? তুই ওঠ। আমি কথা টথা বলতে পারবো না।

— না পারলে নেই। মামাকে ফোন করো।

— তোর মামা ফোন ধরবে এখন? সজল গেছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে। দেখনা কি চায়।

নিশাত শাশুড়ির আগমনে অবাক না হলেও, সজলের কথা শুনে অবাক হলো। অবাক হলেই বললো, — সজল ভাই কোথায় গেছে?

— রাগ করে চলে গেছে।

— কেন?

— সেটা তোর জেনে লাভ নেই। তোকে যেটা বলছি সেটা গিয়ে কর।

— আমি গিয়ে করবোটা কি? বোঝার আগেই এক বিয়ে দিয়ে বসে আছো । এখন নতুন করে বিয়ের জন্য আবার উতালা হয়েছো। আরেক দিকে আগের শাশুড়ি এসে হাজির। এখন বলো আমি গিয়ে করবোটা কি? সব তো তোমরা তোমরাই করছো।

সুলতানা ক্লান্ত ভাবে বললো, — নিশাত দোয়াই লাগে তোর! মুখ বন্ধ কর। যা গিয়ে কিছু কর।

— দোহাই টোহাই দিয়ে তো লাভ নেই মা। আমি গিয়ে মতব্বরি করে কিছু করলাম। তোমার ভাই এসে লাগিয়ে দেবে এক থাবড়া। বয়সের ধার তো তিনি জীবনেও ধরেন না। তখন তো আবার মুখে তালা মেরে বসে থাকবে। মাঝখান থেকে আমার গালের বারোটা বাজবে।

সুলতানা অসহায় বোধ করলো। পেটে রেখে কি খেয়েছিল কে জানে? এমন বিটলা ফাজিল হয়েছে কেন? তার মধ্যে ভাবি দরজা দিয়ে বসে আছে। ভাইকে ফোন দিতে তার সাহস হচ্ছে না। যদি দোষে ফেলেন। বলে ফেলেন তুই মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছিস। তবুও ভালো ভাই ভাবি এখনো আঙুল তুলছে না। সে অসহায় ভাবেই মুখ, গলা, কপালের ঘাম মুছলো। নিজেকে নিয়ে তার ভাবনা নেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে তার যতো চিন্তা। তার মতো জীবন না হোক। আর সুর্বণা ভাবি’ই এতোদিন পরে কেন এসেছে?

নিশাত কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে মায়ের অবস্থা দেখলো। এই মহিলা কিভাবে পালিয়ে বিয়ে করার মতো সাহস করেছিল কে জানে? সব কিছুতেই ভয়, টেনশন আগেই দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। সে উঠে দাঁড়ালো! দুনিয়ার সব সে সহ্য করতে পারে তবে এই যে তার মা। এর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সে দাঁড়িয়ে বললো , — আরামছে বসো তো। এতো ভয় পাওয়ার কি হলো? আমি কি এখনো দশ এগারো বছরের অবুঝ মেয়ে নাকি। আমার সামনে আমার মাকে কিছু বলবে আর আমি চুপচাপ তোমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো।

সুলতানা চমকালো! নিশাতের মনে আছে? নিশাত হাসলো! সুলতানা অবাক চোখেই তাঁকিয়ে রইল। সন্তান বড় হলে মায়েদের কাছে এতো অচেনা লাগে কেন?

মাকে চমকে রেখেই নিশাত সোজা এলো তাদের ড্রইংরুমে। সেই কু কু আওয়াজের চেয়ারে সুন্দর গোছানো মার্জিত ভাবে অফ হোয়াইট রঙের সুতি শাড়ি গায়ে একজন মধ্যবয়সী নারী বসে আছে। বসে থাকাই বলে দিচ্ছে তার অভিজাত্য। গায়ের রং ফর্সা না হলেও, তার কাপড়, চাউনি, বসার ঢং সবকিছুই বলে দিচ্ছে এই জায়গায় সে বড়ই বেমানান।

নিশাত এগিয়ে এলো স্বাভাবিক ভাবেই। এগুতে এগুতেই সে আসিফের দিকে তাঁকালো। তখনি সে বুঝলো সেই দিন ফোনের আবরার ওয়াহিদ কে ছিল। নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো! তখনি তার মায়ের সুর্বণা ভাবি তার দিকে ফিরে তাঁকালো!

তার তাঁকানো, গায়ে গড়িয়ে পড়া অভিজাত্য নিয়ে নিশাতের তেমন বিচলিত মনে হলো না। তার গায়ে জলপাই রঙের মলিন জামা। কোঁকড়ানো চুল টেনে চান্দি বরাবর খোঁপা। সেই খোপা ফুলে ফেঁপে আছে। ম্যাগি নুডুলসের মতো কিছু চুল এদিক ওদিক দিয়ে ঝুলছে। গলায় কুঁচানো ওড়না। সে ওড়না দিয়েই মুখের ঘাম মুছতে মুছতে খাটে বসে বললো, — মামা বাসায় নেই, মা আপনার সাথে কথা বলবে না। এখন কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। তবে তাড়াতাড়ি বললে আমার একটু সুবিধা হতো।

সুর্বণা শান্ত চোখে নিশাতকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। কিছু কিছু মানুষের গায়ের রং অনেক ফর্সা না হলেও মায়াবী হয়। মিষ্টি হয়! এই মেয়েকে সেই কাতারে অনায়াসেই ফেলা যায়। মায়ের মতো হয় নি। বাবার মতো গড়ন হয়েছে। লম্বাও হয়েছে বাবার মতো। তবে ছোট বেলায় চেহেরায় একটা বোকা বোকা ভাব ছিল। এখন সেটা নেই। সুর্বণা মানুষ চেনে। তবে সামনে বসা দেখতে এই আলাভোলা মেয়েটাকে কেন জানি ধরতে পারলো না। কিছু কিছু মানুষ তাদের সামনে মোটা প্রাচীর তুলে রাখে। তার মনে হলো, এই মেয়েটার সামনেও মোটা এক প্রাচীর। এই প্রাচীর ভেদ করা এতো সোজা না।

সে তাঁকিয়ে’ই শান্ত ভাবে বললো, — তুমি নিশাত?

— জ্বি! আমি’ই নিশাত। নাজিম উদ্দিনের মেয়ে নিশাত।

সুর্বণা আস্তে করে হাত মুঠো করলো। নিশাত সেই মুঠো করা হাতের দিকে তাঁকিয়ে আগের মতোই ঠোঁট টিপে একটু হাসলো।

চলবে…..