প্রাচীর পর্ব-১১+১২

0
701

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১১

সুর্বণা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসলো! নিজের অহম দমানো এতো সোজা কথা না। সে মনে মনে নিজেকে শান্ত করলো। তার আর তার ছেলে এমনিতে শান্ত, ভদ্র, চুপচাপ কিন্তু রাগলে.. তাই মনের রাগ, জেদ মনের মধ্যেই দমালো। কেননা আপতত সে কোন ঝামেলা চাচ্ছে না। যা করবে ঠান্ডা মাথায়। সে শান্ত হয়েই বললো, — কাঁদছে কে?

নিশাত আগের মতোই বললো, — আমার মামি।
— কেন?

— তার একমাত্র ছেলে রাগ করে চলে গেছে।

— কেন?

— আমি জানি টানি না। তাছাড়া আমার হাতে সময় কম। মেইন টপিকটা যদি তাড়াতাড়ি বলতেন আমার খুব উপকার হতো। আমার অফিস আছে।

— তুমি চাকরি করো?

নিশাত বড় একটা শ্বাস ফেললো! এই মহিলা তো খেজুরে আলাপ শুরু করেছে। সে শ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাঁকালো। আজকে কি সে অফিসে যেতে পারবে? সে বিরক্ত চেপে বললো, — হ্যাঁ, করি।

সুর্বণা শান্ত চোখেই নিশাতের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। নিশাতের বিরক্ত, নিশাতের স্বাভাবিকতা সবই সে খেয়াল করলো। মেয়েটার এতো নির্লিপ্ততা তার হজম হলো না। সুলতানার মতো এই মেয়েরও অবস্থা হওয়ার কথা ছিল। তারপর আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো, — কায়সার আর নাজিম দু-জনে মিলে ফ্রুট এক্সপোর্ট বিসনেস টা শুরু করেছিল। তোমার মনে আছে কি না জানি না। তবে যেহেতু অনেক কিছু হয়ে গেছে, তাই এতোদিন যে ভাবেই থাক। এখন ফিরিয়ে দিতে চাই। আর.. বলেই সুর্বণা একটু থামলো, থেমে আবার বললো, — যেহেতু তুমি চাইছো তোমার সাথে কথা বলি । তাই তোমাকেই সোজা বলছি। বিয়েটা নিয়ে কিছু কি ভেবেছো?

নিশাতও সুর্বণার মতো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইলো। তারপর বললো, — কি ভাববো?

— বিয়েটা কি তুমি রাখতে চাও?

— এতোদিন পরে হঠাৎ এই বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ব্যথার কারণ কি ?

— হঠাৎ না! তোমাদের খোঁজা হয়েছে।

— খুঁজতে হবে কেন? নানা পাওয়ার হাউজে চাকরি করতেন। সেখানে খোঁজ নিলেই তো গ্রামের ঠিকানা পাওয়া যেতো। আর সেখানের সবাই জানে সুলতানের ছেলে মেয়ে বর্তমানে কোথায় আছে।

সুর্বণা আবারো শান্ত চোখে নিশাতকে দেখলো! এই বিয়েটা তার কাছে কোন মানেই রাখে না। তবে তার স্বামীর কাছে ছিল, ছেলের কাছে ছিল, আছে। তাই সে ভালো করেই জানতো, তার ছেলে দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করবে। তাই তো অতি নিখুঁত ভাবে সব সরিয়েছে। সে আগের মতোই বললো — তুমি না বললে তাড়াতাড়ি বললে তোমার সুবিধা হয়। আমি সেভাবেই বললাম। এখন বলো কি করতে চাও?

নিশাত একটু হাসলো! হেসে তাদের রুমের দরজার দিকে তাঁকিয়ে বললো, — মা জননী আপনার কি কিছু বলার আছে?

সুলতানা হকচকিয়ে গেলো! সে যে কান পেতে আছে এই মেয়ে ঠিক জানে। সে কি করবে দিশে পেলো না। এত্তো ফাজিল এই মেয়ে। তাই সে মাথায় ঘোমটা টানলো! অনেক হয়েছে! সে ঘোমটা টেনেই সোজা বেরিয়ে এলো। সুর্বণার দিকে অবশ্য তাঁকালো না। অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে বললো, — আমাদের কিছুর দরকার নেই। আর কিসের বিয়ে? কোন বিয়ে টিয়ে নেই। আপনি আসুন।

সুর্বণা ঠোঁট টিপে হাসলো। এটাইতো চেয়েছে সে, আর এটাই তো এতোক্ষণ মিস করছিল । সে ঠোঁট টিপে হেসে বললো, — বললেই তো আর হয় না। তবে যেহেতু রাখতে চাইছো না । তাহলে পুরোপুরিভাবেই শেষ হোক। তাছাড়া আমারো তোমাদের বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে নেই। বলেই আসিফের দিকে তাঁকালো। যার মানে শুনেছো আসিফ।

— আপনাদের যা খুশি করতে পারেন তবে আমাদের রেহাই দিন। আমরা যেভাবেই আছি ভালো আছি।

সুর্বণা মনে মনে আবারো হাসলো। সুলতানা এখনো কত বোকা। যাক এজন্যই বলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এখন সে যা চাইবে তার ছেলে তাই করবে। সে হেসেই কিছু বলবে তখনি নিশাত বললো, — তখন ছোট থাকতে পারি এখন তো না। তাই যা ডিসিশান নেওয়ার এবার আমি নেব। পুতুল পুতুল নাচ অনেক হয়েছে। এখন সুতো কাটার পালা।

সুলতানা, সুর্বণা দু’ জনেই নিশাতের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই নিশাত একটু হেসে বললো, — আমি বিয়েটা রাখবো। আর বাপের বদনাম ঘাড়ে নিতে পেরেছি, সম্পত্তি নিতে পারবো না কেন? আপনি সব ব্যবস্থা করুন।

সুলতানা হা হয়ে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো। কি বলে তার মেয়ে। যে ঘৃণা মনে চেপে ফিরে তাঁকায়নি। তার মেয়ে সেই দিকেই যেতে চাইছে।

নিশাত মায়ের হা করা মুখের দিকে তাঁকালো না। সুর্বণা দিকে তাঁকিয়ে বললো, — আপনি সব ব্যবস্থা করুন আন্টি। উপস্! শাশুড়ি মা।

সুলতানা এতো বছরে যা করেনি। তা আজ করলো। নিশাতের বলতে দেরি তবে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে চড় মারতে দেরি হয়নি । দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছে সে।

সুর্বণা নিজেও থমকে আছে। এরকম কিছু সে ভাবেনি। সুলতানা তার ভাবার মতোই কাজ করেছে তবে নিশাত.. সে ভেবেছিলো ঘৃণায় সে কথাই বলবে না। তবে সব উল্টে গেলো কেন? সে থমকেই আসিফের দিকে তাঁকালো। সে ভালো করেই জানে এখানে যা হবে আসিফ পাই টু পাই ওয়াহিদের কানে দেবে। সে নিজেকে সামলালো। আপতত রাগ, জেদ কিছুই সে চাচ্ছে না। এখানে তার ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপার। কোন একটা ভুল পদক্ষেপ তার মা, ছেলের সম্পর্কে চিরদিনের জন্য ফাটল ধরাবে। তাই সে কোন রকম বললো, — আমি আমার কথা রাখলাম। তোমরা ভেবে চিন্তে ডিসিশান নাও। বলেই তিনি হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সে বেরিয়ে যেতেই মা দৌড়ে গিয়েই তার গুনধর ভাইকে ফোন দিলেন। এমন ভাব! এই ডুবে যাওয়া নৌকার পাল একমাত্র তার ভাই’ই ধরতে পারবে। তবে তার সাদাসিধে মা তো জানে না, তার মেয়ে সাধারণ পালতোলা নৌকা না। জাহাজ! বিশাল জাহাজ। আর এই জাহাজকে থামানো এতো সোজা না।

____

সাবা ফিরলো সাড়ে দশটার একটু পরে। এতক্ষণে নিশ্চয়’ই আপু বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে বড় এক গাড়ি যেতে দেখে আবার উল্টো দৌড় দিচ্ছিলো। এবার তো সে কিছুই করেনি। আর ঐ ফোনের কারণে যদি আবার কোন কাহিনী হয়। সে তো শেষ! একদম শেষ। কেননা নিশাত আপু তো যেমন তেমন বাবার কানে গেলে চুলের মুঠি ধরে ঘুরিয়ে ছুড়ে মারবে। তার কাছে ছেলে কি আর একমাত্র মেয়ে কি? তিনি নিজে নিজেই একা একশো।

তখনি তাদের নিচের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া রুমার মা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললো, — এই সাবা। তোদের বাড়িতে হয়েছেটা কি ? সাত সকালে সজল বেরুলো ডান বাম না দেখে। বের হয়েছে তো হয়েছে, যাবার সময় গেইট এমন জোরে বাড়ি মেরে গেছে, ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই তোর মায়ের চিৎকার। আবার এলো ইয়া বড় এক গাড়ি। এখন আবার জালাল ভাই এলো এই সময়ে। ব্যাপারটটা কি বলতো?

সাবা হা হয়ে তাঁকালো । বলে কি রে? তাদের বাড়িতে এতো কিছু হচ্ছে আর সে জানেই না। সে বুলেট ট্রেনের গতিতে ঘরে গেলো। দরজা হাট করে খোলা। আল্লাহ! আবার কোন কাহিনী হলো। কানে ধরলাম জীবনে আর কারো মোবাইল ধরা তো দূর ফিরেও দেখবো না। সে ঢোক গিলেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। যেতেই দেখলো তাদের বাড়ির অবস্থা থমথমে। তার মা কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে খাটের এক সাইডে চুপচাপ বসে আছে। ফুপু দাঁড়িয়ে আছে তাদের রুমের দরজা ধরে। চোখ মুখ কঠিন। ফুপুর এই রুপ তো সে জীবনেও দেখেনি। আর এদের মধ্যে নির্বিকার বসে আছে নিশাত আপু আর বাবা। তার মনে হয় বাবার ফিমেল ভার্সন হলো নিশাত আপু। আবার মাঝে মাঝে তো মনে হয় বাবার চেয়েও দু- ডিগ্রী উপরে। কেননা বাবা চিৎকার চেঁচামেচি করেন, রাগের বহিঃপ্রকাশ করেন। তবে নিশাত আপু সব সময় ঠান্ডা। ঠান্ডা ভাবে অনায়াসেই যেমন অনেক কিছু বলতে পারে আবার অনেক কিছু করেও ফেলতে পারে। আবার নতুন করে কি করলো?

সে আস্তে করেই ভেতরে এলো! সবার মতো এক সাইডেই চুপচাপ দাঁড়ালো। কাহিনী টা কি?

তখনি জালাল উদ্দিন বললো, — তুই কি বলছিস তুই জানিস?

নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বললো, — হ্যাঁ! এতো জানাজানির কি আছে। বিয়েতো এমনিতে তোমরা আমাকে দেবে। তো যেটা বেশি ভালো অপশন সেটার কাছেই যাই।

— টাকা পয়সা তোর কাছে সব হলো?

— টাকা পয়সা সবার কাছেই সব মামা।

— তোর মা যে তোর জন্য এতো কষ্ট করলো, সে সব তোর কাছে কিছু না?

— এই বিয়ের গিট্টু তো তারাই পাকিয়েছে।

— তো তাদের উপরেই ছেড়ে দে। এখন তুই নাক গলাচ্ছিস কেন?

— না গলিয়ে উপায় কি মামা! যার এক বিয়েতে সুখ নাই, তার নাকি আর দশ বিয়েতেও নাই । তাই রিস্ক নেই কি করে বলেন তো? সারা জীবনের ব্যাপার স্যাপার।

জালাল জীবনে প্রথম বার হাল ছাড়লো। এই ফাজিল মেয়ের সাথে কথা বলা মানে সময় নষ্ট। তাছাড়া এই মেয়ে বিদেয় হলেই সে বাঁচে। যার ঘরেই যাক তার কি? ভালো হলে এক কথা। বাপের মতো অসভ্য এই মেয়ে। তাছাড়া এমনি গেলে খরচা কমে। কেননা যেই ঘরেই দিক কিছু খরচা তো যেতোই।

সুলতানা ভাইয়ের নিস্পৃহতায় ফুঁপিয়ে উঠলো। কার কাছে যাবে সে? নিজের পেটের মেয়েই তার সাথে বেইমানি করলো। সে ফুঁপিয়েই বললো, — এই বিয়ে মেনে নিলে আমার মরা মুখ দেখবি নিশাত।

নিশাত এবার উঠলো। না, এবার না গেলেই না। সে উঠে যেতে যেতে বললো, — এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কমন জিনিস হলো মৃত্যু । সেটা একদিন আগে হোক আর একদিন পরে সবাইকে মরতে হবে । তাই তুমি চাইলেও দেখবো, না চাইলেও দেখবো । এটা আবার এতো হুমকি ধামকি দিয়ে বলার কি হলো? এমনতো না তুমি সারা জীবন বাঁচবে, এখন আমার এই বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছো। তাই হুমকি দেবে ভালো কিছুর দাও। এই মরা মুখের কসম টসম খুবই পুরানো ফ্যাশন। নতুন কিছু বলতে পারলে এসো। বলেই নিশাত চলে গেলো।

জালাল উদ্দিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললো, — আরো বেশি বেশি করে পড়ালেখা করা। কতো বললাম বিয়ে দিয়ে দে, বিয়ে দিয়ে দে। ভাই তো দুশমন। এখন নে যাদের জন্য তোর এই দশা, তাদের ঘরেই মেয়ে নেচে নেচে যাচ্ছে। এখন বসে বসে কপাল চাপড়া। বলে তিনিও বেরিয়ে গেলন। দোকানে বসিয়ে রেখে এসেছেন এক ছেলেকে। ক্যাশে থেকে টাকা সরালো কি না কে জানে। যদি সরায় রে সজল, তোর বিয়ের সাদ মিটিয়ে দেব রে হারামজাদা।

বসে রইলো হেনা। সে এতোক্ষণ কেঁদে কেঁটে অস্থির হলেও, এখন তার ভালোই লাগছে। কেননা অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে গেলে সজল গিট্টু দিতো । এখন নিশাত’ই যেহেতু চাইছে, আর কোন প্যারা নেই। তিনি হেসেই রান্না ঘরের দিকে গেলেন। সকাল থেকে না খাওয়া। পেট চোঁ চোঁ করছে।

তার পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করলেও সাবার পেট চোঁ চোঁ করছে এতো কাহিনী শুনে। সে আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। তবে এই টুকু ঠিক বুঝলো আপু এবার বিরাট গিরিংগি খেলছে। তাই সে দৌড়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে কানে ধরা কসম এক্ষনি ভুলে গেলো। গিয়ে ফুরুৎ করে ফুপুর বাটন মোবাইল হাতিয়ে নিলো।

চলবে…..

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১১

সুর্বণা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসলো! নিজের অহম দমানো এতো সোজা কথা না। সে মনে মনে নিজেকে শান্ত করলো। তার আর তার ছেলে এমনিতে শান্ত, ভদ্র, চুপচাপ কিন্তু রাগলে.. তাই মনের রাগ, জেদ মনের মধ্যেই দমালো। কেননা আপতত সে কোন ঝামেলা চাচ্ছে না। যা করবে ঠান্ডা মাথায়। সে শান্ত হয়েই বললো, — কাঁদছে কে?

নিশাত আগের মতোই বললো, — আমার মামি।
— কেন?

— তার একমাত্র ছেলে রাগ করে চলে গেছে।

— কেন?

— আমি জানি টানি না। তাছাড়া আমার হাতে সময় কম। মেইন টপিকটা যদি তাড়াতাড়ি বলতেন আমার খুব উপকার হতো। আমার অফিস আছে।

— তুমি চাকরি করো?

নিশাত বড় একটা শ্বাস ফেললো! এই মহিলা তো খেজুরে আলাপ শুরু করেছে। সে শ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাঁকালো। আজকে কি সে অফিসে যেতে পারবে? সে বিরক্ত চেপে বললো, — হ্যাঁ, করি।

সুর্বণা শান্ত চোখেই নিশাতের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। নিশাতের বিরক্ত, নিশাতের স্বাভাবিকতা সবই সে খেয়াল করলো। মেয়েটার এতো নির্লিপ্ততা তার হজম হলো না। সুলতানার মতো এই মেয়েরও অবস্থা হওয়ার কথা ছিল। তারপর আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো, — কায়সার আর নাজিম দু-জনে মিলে ফ্রুট এক্সপোর্ট বিসনেস টা শুরু করেছিল। তোমার মনে আছে কি না জানি না। তবে যেহেতু অনেক কিছু হয়ে গেছে, তাই এতোদিন যে ভাবেই থাক। এখন ফিরিয়ে দিতে চাই। আর.. বলেই সুর্বণা একটু থামলো, থেমে আবার বললো, — যেহেতু তুমি চাইছো তোমার সাথে কথা বলি । তাই তোমাকেই সোজা বলছি। বিয়েটা নিয়ে কিছু কি ভেবেছো?

নিশাতও সুর্বণার মতো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইলো। তারপর বললো, — কি ভাববো?

— বিয়েটা কি তুমি রাখতে চাও?

— এতোদিন পরে হঠাৎ এই বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ব্যথার কারণ কি ?

— হঠাৎ না! তোমাদের খোঁজা হয়েছে।

— খুঁজতে হবে কেন? নানা পাওয়ার হাউজে চাকরি করতেন। সেখানে খোঁজ নিলেই তো গ্রামের ঠিকানা পাওয়া যেতো। আর সেখানের সবাই জানে সুলতানের ছেলে মেয়ে বর্তমানে কোথায় আছে।

সুর্বণা আবারো শান্ত চোখে নিশাতকে দেখলো! এই বিয়েটা তার কাছে কোন মানেই রাখে না। তবে তার স্বামীর কাছে ছিল, ছেলের কাছে ছিল, আছে। তাই সে ভালো করেই জানতো, তার ছেলে দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করবে। তাই তো অতি নিখুঁত ভাবে সব সরিয়েছে। সে আগের মতোই বললো — তুমি না বললে তাড়াতাড়ি বললে তোমার সুবিধা হয়। আমি সেভাবেই বললাম। এখন বলো কি করতে চাও?

নিশাত একটু হাসলো! হেসে তাদের রুমের দরজার দিকে তাঁকিয়ে বললো, — মা জননী আপনার কি কিছু বলার আছে?

সুলতানা হকচকিয়ে গেলো! সে যে কান পেতে আছে এই মেয়ে ঠিক জানে। সে কি করবে দিশে পেলো না। এত্তো ফাজিল এই মেয়ে। তাই সে মাথায় ঘোমটা টানলো! অনেক হয়েছে! সে ঘোমটা টেনেই সোজা বেরিয়ে এলো। সুর্বণার দিকে অবশ্য তাঁকালো না। অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে বললো, — আমাদের কিছুর দরকার নেই। আর কিসের বিয়ে? কোন বিয়ে টিয়ে নেই। আপনি আসুন।

সুর্বণা ঠোঁট টিপে হাসলো। এটাইতো চেয়েছে সে, আর এটাই তো এতোক্ষণ মিস করছিল । সে ঠোঁট টিপে হেসে বললো, — বললেই তো আর হয় না। তবে যেহেতু রাখতে চাইছো না । তাহলে পুরোপুরিভাবেই শেষ হোক। তাছাড়া আমারো তোমাদের বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে নেই। বলেই আসিফের দিকে তাঁকালো। যার মানে শুনেছো আসিফ।

— আপনাদের যা খুশি করতে পারেন তবে আমাদের রেহাই দিন। আমরা যেভাবেই আছি ভালো আছি।

সুর্বণা মনে মনে আবারো হাসলো। সুলতানা এখনো কত বোকা। যাক এজন্যই বলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এখন সে যা চাইবে তার ছেলে তাই করবে। সে হেসেই কিছু বলবে তখনি নিশাত বললো, — তখন ছোট থাকতে পারি এখন তো না। তাই যা ডিসিশান নেওয়ার এবার আমি নেব। পুতুল পুতুল নাচ অনেক হয়েছে। এখন সুতো কাটার পালা।

সুলতানা, সুর্বণা দু’ জনেই নিশাতের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই নিশাত একটু হেসে বললো, — আমি বিয়েটা রাখবো। আর বাপের বদনাম ঘাড়ে নিতে পেরেছি, সম্পত্তি নিতে পারবো না কেন? আপনি সব ব্যবস্থা করুন।

সুলতানা হা হয়ে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো। কি বলে তার মেয়ে। যে ঘৃণা মনে চেপে ফিরে তাঁকায়নি। তার মেয়ে সেই দিকেই যেতে চাইছে।

নিশাত মায়ের হা করা মুখের দিকে তাঁকালো না। সুর্বণা দিকে তাঁকিয়ে বললো, — আপনি সব ব্যবস্থা করুন আন্টি। উপস্! শাশুড়ি মা।

সুলতানা এতো বছরে যা করেনি। তা আজ করলো। নিশাতের বলতে দেরি তবে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে চড় মারতে দেরি হয়নি । দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছে সে।

সুর্বণা নিজেও থমকে আছে। এরকম কিছু সে ভাবেনি। সুলতানা তার ভাবার মতোই কাজ করেছে তবে নিশাত.. সে ভেবেছিলো ঘৃণায় সে কথাই বলবে না। তবে সব উল্টে গেলো কেন? সে থমকেই আসিফের দিকে তাঁকালো। সে ভালো করেই জানে এখানে যা হবে আসিফ পাই টু পাই ওয়াহিদের কানে দেবে। সে নিজেকে সামলালো। আপতত রাগ, জেদ কিছুই সে চাচ্ছে না। এখানে তার ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপার। কোন একটা ভুল পদক্ষেপ তার মা, ছেলের সম্পর্কে চিরদিনের জন্য ফাটল ধরাবে। তাই সে কোন রকম বললো, — আমি আমার কথা রাখলাম। তোমরা ভেবে চিন্তে ডিসিশান নাও। বলেই তিনি হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সে বেরিয়ে যেতেই মা দৌড়ে গিয়েই তার গুনধর ভাইকে ফোন দিলেন। এমন ভাব! এই ডুবে যাওয়া নৌকার পাল একমাত্র তার ভাই’ই ধরতে পারবে। তবে তার সাদাসিধে মা তো জানে না, তার মেয়ে সাধারণ পালতোলা নৌকা না। জাহাজ! বিশাল জাহাজ। আর এই জাহাজকে থামানো এতো সোজা না।

____

সাবা ফিরলো সাড়ে দশটার একটু পরে। এতক্ষণে নিশ্চয়’ই আপু বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে বড় এক গাড়ি যেতে দেখে আবার উল্টো দৌড় দিচ্ছিলো। এবার তো সে কিছুই করেনি। আর ঐ ফোনের কারণে যদি আবার কোন কাহিনী হয়। সে তো শেষ! একদম শেষ। কেননা নিশাত আপু তো যেমন তেমন বাবার কানে গেলে চুলের মুঠি ধরে ঘুরিয়ে ছুড়ে মারবে। তার কাছে ছেলে কি আর একমাত্র মেয়ে কি? তিনি নিজে নিজেই একা একশো।

তখনি তাদের নিচের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া রুমার মা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললো, — এই সাবা। তোদের বাড়িতে হয়েছেটা কি ? সাত সকালে সজল বেরুলো ডান বাম না দেখে। বের হয়েছে তো হয়েছে, যাবার সময় গেইট এমন জোরে বাড়ি মেরে গেছে, ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই তোর মায়ের চিৎকার। আবার এলো ইয়া বড় এক গাড়ি। এখন আবার জালাল ভাই এলো এই সময়ে। ব্যাপারটটা কি বলতো?

সাবা হা হয়ে তাঁকালো । বলে কি রে? তাদের বাড়িতে এতো কিছু হচ্ছে আর সে জানেই না। সে বুলেট ট্রেনের গতিতে ঘরে গেলো। দরজা হাট করে খোলা। আল্লাহ! আবার কোন কাহিনী হলো। কানে ধরলাম জীবনে আর কারো মোবাইল ধরা তো দূর ফিরেও দেখবো না। সে ঢোক গিলেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। যেতেই দেখলো তাদের বাড়ির অবস্থা থমথমে। তার মা কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে খাটের এক সাইডে চুপচাপ বসে আছে। ফুপু দাঁড়িয়ে আছে তাদের রুমের দরজা ধরে। চোখ মুখ কঠিন। ফুপুর এই রুপ তো সে জীবনেও দেখেনি। আর এদের মধ্যে নির্বিকার বসে আছে নিশাত আপু আর বাবা। তার মনে হয় বাবার ফিমেল ভার্সন হলো নিশাত আপু। আবার মাঝে মাঝে তো মনে হয় বাবার চেয়েও দু- ডিগ্রী উপরে। কেননা বাবা চিৎকার চেঁচামেচি করেন, রাগের বহিঃপ্রকাশ করেন। তবে নিশাত আপু সব সময় ঠান্ডা। ঠান্ডা ভাবে অনায়াসেই যেমন অনেক কিছু বলতে পারে আবার অনেক কিছু করেও ফেলতে পারে। আবার নতুন করে কি করলো?

সে আস্তে করেই ভেতরে এলো! সবার মতো এক সাইডেই চুপচাপ দাঁড়ালো। কাহিনী টা কি?

তখনি জালাল উদ্দিন বললো, — তুই কি বলছিস তুই জানিস?

নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বললো, — হ্যাঁ! এতো জানাজানির কি আছে। বিয়েতো এমনিতে তোমরা আমাকে দেবে। তো যেটা বেশি ভালো অপশন সেটার কাছেই যাই।

— টাকা পয়সা তোর কাছে সব হলো?

— টাকা পয়সা সবার কাছেই সব মামা।

— তোর মা যে তোর জন্য এতো কষ্ট করলো, সে সব তোর কাছে কিছু না?

— এই বিয়ের গিট্টু তো তারাই পাকিয়েছে।

— তো তাদের উপরেই ছেড়ে দে। এখন তুই নাক গলাচ্ছিস কেন?

— না গলিয়ে উপায় কি মামা! যার এক বিয়েতে সুখ নাই, তার নাকি আর দশ বিয়েতেও নাই । তাই রিস্ক নেই কি করে বলেন তো? সারা জীবনের ব্যাপার স্যাপার।

জালাল জীবনে প্রথম বার হাল ছাড়লো। এই ফাজিল মেয়ের সাথে কথা বলা মানে সময় নষ্ট। তাছাড়া এই মেয়ে বিদেয় হলেই সে বাঁচে। যার ঘরেই যাক তার কি? ভালো হলে এক কথা। বাপের মতো অসভ্য এই মেয়ে। তাছাড়া এমনি গেলে খরচা কমে। কেননা যেই ঘরেই দিক কিছু খরচা তো যেতোই।

সুলতানা ভাইয়ের নিস্পৃহতায় ফুঁপিয়ে উঠলো। কার কাছে যাবে সে? নিজের পেটের মেয়েই তার সাথে বেইমানি করলো। সে ফুঁপিয়েই বললো, — এই বিয়ে মেনে নিলে আমার মরা মুখ দেখবি নিশাত।

নিশাত এবার উঠলো। না, এবার না গেলেই না। সে উঠে যেতে যেতে বললো, — এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কমন জিনিস হলো মৃত্যু । সেটা একদিন আগে হোক আর একদিন পরে সবাইকে মরতে হবে । তাই তুমি চাইলেও দেখবো, না চাইলেও দেখবো । এটা আবার এতো হুমকি ধামকি দিয়ে বলার কি হলো? এমনতো না তুমি সারা জীবন বাঁচবে, এখন আমার এই বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছো। তাই হুমকি দেবে ভালো কিছুর দাও। এই মরা মুখের কসম টসম খুবই পুরানো ফ্যাশন। নতুন কিছু বলতে পারলে এসো। বলেই নিশাত চলে গেলো।

জালাল উদ্দিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললো, — আরো বেশি বেশি করে পড়ালেখা করা। কতো বললাম বিয়ে দিয়ে দে, বিয়ে দিয়ে দে। ভাই তো দুশমন। এখন নে যাদের জন্য তোর এই দশা, তাদের ঘরেই মেয়ে নেচে নেচে যাচ্ছে। এখন বসে বসে কপাল চাপড়া। বলে তিনিও বেরিয়ে গেলন। দোকানে বসিয়ে রেখে এসেছেন এক ছেলেকে। ক্যাশে থেকে টাকা সরালো কি না কে জানে। যদি সরায় রে সজল, তোর বিয়ের সাদ মিটিয়ে দেব রে হারামজাদা।

বসে রইলো হেনা। সে এতোক্ষণ কেঁদে কেঁটে অস্থির হলেও, এখন তার ভালোই লাগছে। কেননা অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে গেলে সজল গিট্টু দিতো । এখন নিশাত’ই যেহেতু চাইছে, আর কোন প্যারা নেই। তিনি হেসেই রান্না ঘরের দিকে গেলেন। সকাল থেকে না খাওয়া। পেট চোঁ চোঁ করছে।

তার পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করলেও সাবার পেট চোঁ চোঁ করছে এতো কাহিনী শুনে। সে আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। তবে এই টুকু ঠিক বুঝলো আপু এবার বিরাট গিরিংগি খেলছে। তাই সে দৌড়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে কানে ধরা কসম এক্ষনি ভুলে গেলো। গিয়ে ফুরুৎ করে ফুপুর বাটন মোবাইল হাতিয়ে নিলো।

চলবে…..