#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৩
নিশাতের মামা বাড়ির সব কিছু আগের মতো চললেও নিশাতের মায়ের মুখ থমথমে। নিশাতের সাথে না কথা বলছে, না তার কোন কাজ নিশাতকে ধরতে দিচ্ছে । নিশাত বেশ কয়েকবার’ই গেলো। তিনি ঝাড়া মেরে নিয়ে সব নিজেই করছেন। নিশাত আর মাথা ঘামালো না। কালকে রাতে করেছিল ছোট মাছের চচ্চড়ি। অনেকটাই রয়ে গেছে। গরম করে মুড়ির সাথে নিয়ে তাদের বসার রুমের গড়াগড়ির খাটে বসতেই ফোন বাজলো।
ফোনটা কার সে জানে। মুড়ি মাখতে মাখতেই সে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই ভারী ভয়ংকর কন্ঠের হ্যালো। তার ধারণা এই হ্যালো আরেকটু জোরে বললে পুরো দুনিয়া হেলে যাবে। মানুষের কন্ঠ এমন ভয়ংকর হয় কিভাবে তার মাথায় আসে না। এই লোক কি কখনো হা হা করে হেসেছে? ভূমিকম্প হবে ভাই ভূমিকম্প। সে এক লোকমা মুখে পুরে বললো, — হুম।
ওয়াহিদের ভ্রু কুঁচকে গেলো। ভ্রু কুঁচকেই বললো, — নিশাত?
নিশাত ঠেলে মুড়ি গলার নিচে নামিয়ে বললো, — জ্বি আমিই নিশাত। আপনার বাল্য কালের হারিয়ে যাওয়া বউ। যাকে আপনারা নাকি চিরুনী তল্লাশি করে খুঁজেছেন।
ওয়াহিদ থমকালো! তার বাল্য কালের বউ! এই কথাটা তাকে থমকানোর জন্য যথেষ্ট। আর এই বউ তার কাছে পুরো একটা রহস্য। এই রহস্য হারিয়ে যাওয়ার সময় সে দেশে ছিল না। তার এক মামা বাহিরে থাকে। মায়েরও খুব ইচ্ছে ছিল বাহিরে পড়াবে। তখন বাবা, মা নতুন টাকার মুখ দেখছে। বাহিরে লেখা পড়া করাও তখন আলাদা একটা চার্ম। ব্যস! ধরে বেঁধে তাকেও পাঠানো হলো বাহিরে। সে এসবের কিছুই জানতে পারেনি। বাবা যাও জানাবে মা মৃত্যু হুমকি দিয়ে মুখ বেঁধে রেখেছিল। জানতে পারলো সব দেশে এসে। অথচ তার মস্তিষ্ক জুরে একটা জিনিস’ই গেঁথে ছিল। তার বিয়ে হয়েছে, ঐ সদূর দেশে তার একটা ছোট্ট বউ আছে। আর এই ছোট্ট বধু তার অন্য কোন মেয়ের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে পারেনি। এখনো পারে না।
সে থমকেই বললো — সময় হবে?
নিশাতও তার মতো বললো, — না।
— ক্লিয়ার ভাবে কিছু কথা বলা দরকার ।
— কোন দরকার নেই। আমি রাজি! ফুল অ্যান্ড ফাইনাল।
ওয়াহিদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো! তারপর বললো, — এখন?
— এখন আবার কি? আপনি জানতে চেয়েছেন আমি বলেছি। কেটা কালের বিয়ে গোনায় ধরেতো আর লাফ দিয়েই গলায় ঝুলে যেতে পারি না। মা রাজি না। এই বাড়িতে জামাই আদর আশা করে লাভ নেই। তাই যা করার আপনি’ই করেন। আমি বাবা কোন ঝামেলা টামেলায় নেই। শুধু টাকা আছে বলে রাজি হয়েছি, তা না হলে এরকম এক দুইটা কেটা কালের বিয়ে নিশাত গোনায় ধরে নাকি?
ওয়াহিদ মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। অফিসে গেলে সময় পাবে না। তাই ভাবলো এখন কথা বলে নেওয়া যাক। কিন্তু কথা বলে তার ঘুম টুম উবে গেলো। ডেঞ্জারাস মেয়ে! সে তার স্বভাব মতো শান্ত ভাবেই বললো, — শুধু টাকার ব্যাপার হলে আমার তো মনে হয় তোমার অংশই যথেষ্ট । ওয়াহিদকে তো বিয়ের প্রয়োজন ছিল না। মানুষকে এতো বোকা ভাবার কারণ কি?
নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে কথা ঘুরিয়ে বললো — আমি কিন্তু আমার অংশে প্রপার্টিজ আর ক্যাশ চাই। বিয়ে টিয়ের বেল আছে নাকি। আজ আছে কাল নেই। নিজের ভবিষ্যৎ আগে সেফটি। ভালো কথা কাবিন আমি দশ বিশ লাখে মানছি না।
ওয়াহিদ কিছু বললো না! উঠে পর্দা টানলো। টানতেই ঝিলমিল করা রোদ চোখে মুখে এলো। সে চোখ মুখ কুঁচকেই বললো, — তা শুভ কাজট কখন করতে চাচ্ছেন?
— আপনার যখন ইচ্ছে। কাজি টাজি রেডি করেন বান্দা হাজির।
— যদি বলি আজ’ই।
নিশাত একটু থামলো! তার মা কিচেন রুমের দরজায় চোখে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত সেই ছলছল করা দৃষ্টির দিকে তাঁকিয়ে আগের মতোই বললো, — ডান।
— এটা বিসনেজ ডিল না তাসনিম নিশাত।
— তাহলে কি বলবো? কবুল, কবুল, কবুল।
— কবুল।
— জ্বি?
— কিছু না তৈরি থেকো।
নিশাত আর কিছু বললো না। ফোন কেটে দিলো!দিয়ে চুপসে যাওয়া মুড়িকে ইচ্ছে মতো ভর্তা করলো। করে উঠে কিচেন রুমের দিকে যেতে যেতে মাকে বললো, — সংসার টংসার জীবনেও আমাকে দিয়ে হবে না। তাই এই এতো চোখের পানি নাকের পানি এক করে লাভ নেই। এই মেয়ে সারা জীবন তোমার ঘাড়েই থাকবে। বলেই হাত, প্লেট ধুয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো। একেবারে রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। সুলতানা কিচেন রুমের সামনেই পা ছড়িয়ে বসেছে। তার ভেতর ফেটে যেতে চাইছে। চোখের পানি নিয়েই বললো, — কোথায় যাচ্ছিস?
— কোথায় আবার অফিসে।
— তো ফোনে কি বললি?
— যা বলার বলেছি। নিতে আসলে বসিয়ে রাখবে। নতুন বউরা অপেক্ষা করাবে না কে করাবে। বলেই নিশাত বেরিয়ে গেলো। আজকে উপর থেকে স্যার আসবে। সময় মতো থাকতেই হবে।
__
সুর্বণা আজ অনেক দিন পর নিজের হাতে রান্না করেছে। এই বাড়িতে খাবারের লোক নেই। ওয়াহিদ তো খাবারের ধারের কাছেও নেই। নিতু থাকে নিজের মতো। সে বাচ্চা হওয়ার পরে খাবার দাবার খায় খুবই মেপে মেপে। নিজের জন্য কোন কিছু করতে ইচ্ছে না। করেও না! কায়সার জীবিত থাকতে রান্নাটা তিনি নিজের হাতেই করতেন। সে খেতে খুব পছন্দ করতো। আর যদি হতো তার হাতের তাহলেতো কথাই নেই।
ওয়াহিদ ফ্রেশ হয়ে একেবারে নিচে এলো! কাল রাতে ফিরেছে অনেক রাতে তাই মাহফুজের সাথে দেখা হয়নি। নিচে এসে দেখেই হালকা জড়িয়ে ধরলো। নিতু বলতে গেলে বেশিভাগ সময় এই বাসাই থাকে। মাহফুজদের নিজের ব্যবসা আছে। সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এই ব্যস্ততার মাঝেও এখানে দৌড়াতে হয়। নিতুর এই নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। সে থাকে তার মতো। সে জড়িয়ে ধরেই বললো, — সব কিছু ঠিক?
— জ্বি ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?
— হুম। এসো নাস্তা খাবে।
সুর্বণা বেগম আগেই বসেছে। তার কাছ ঘেঁষে নিনিত বসা। আরেক পাশে বসলো ওয়াহিদ। সামনে নিতু, মাহফুজ। তার চোখ খুশিতে ঝিলমিল করতে লাগলো। অনেক দিন পরে তার পুরো পরিবারকে এক সাথে পেয়ে। তখনি ওয়াহিদ বললো, — আজকে আমি বিয়ে করছি ।
নিতু মাত্রই কফি মুখে নিয়েছিল। মাথায় উঠে গেলো। মাহফুজ তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। তবে সুর্বণা শুনলো নির্বিকার ভাবে। যেন জানতো ওয়াহিদ এমন কিছুই বলবে।
— আমি আসিফ কে বলে দিয়েছি। সব ব্যবস্থা করে ফেলবে।
নিতু হা করেই বললো, — এতো তাড়াতাড়ির কি হলো?
— কেন সমস্যা কি?
— আত্মীয় – স্বজন আছে। ধীরে সুস্থে সব সুন্দর ভাবে কর।
— সব হবে! আগে বিয়ে হোক।
— আগে বিয়ে হোক মানে। বউ কি পালিয়ে যাচ্ছে?
— সেটাই গিয়েছিল! আর সুযোগ দিচ্ছি না।
নিতু বিরক্ত মুখে বললো, — মা তুমি কিছু বলবে না? তাছাড়া লামিয়ার কি হবে?
সুর্বণা আদর করে নিনিতের মুখে খাবার তুলে দিলো। দিয়ে বললো, — আমার ছেলের যেভাবে খুশি আমিও সে ভাবেই খুশি।
ওয়াহিদ মায়ের দিকে তাঁকালো! তাঁকালো সুবর্ণাও। ওয়াহিদ খুব কম হাসে। হাসলেও হালকা। তবে প্রায় সব সময়’ই চোখ, মুখ থাকে শান্ত, নিশ্চুপ। আজকেও তাই। তবে সুর্বণার মনে হলো, এই শান্ত নিশ্চুপটাও আজ অন্যরকম। নাকি তার মনের ভুল। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিতেই ওয়াহিদ সব সময়ের মতো হালকা পাতলাই খেলো। খাবারের প্রতি তার এমনিতেও খুব একটা আকর্ষণ নেই। আজ আরো নেই। তাছাড়া ইমার্জেন্সি সব কাজ ক্যান্সেল করেছে। তবুও কিছু আছে সেগুলো দুপুরের আগে সব শেষ করতে হবে। তাই উঠে পড়লো। আর ঐ দিকে যার জন্য এতো কিছু সে নেচে নেচেই অফিসে গেছে। সে উঠতেই নিতু চেঁচিয়ে বললো, — কোথায় যাচ্ছিস?
ওয়াহিদ বেরুতে বেরুতে বললো, — নিজের চরকায় তেল দে।
— ও বিয়ের নাম নিতে না নিতেই বোন এখন অন্য চরকা হয়ে গেছে।
ওয়াহিদ উত্তর দিলো না। নিজের মতো বেরিয়ে গেলো। নিতু রাগ নিয়ে মায়ের দিকে তাঁকালো। সুর্বণা অবশ্য আগের মতোই স্বাভাবিক। সে মাহফুজের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — হঠাৎ করে সব হচ্ছে। বেয়াই বেয়ানকে একটু জানিয়ে রেখো। মনে যেন কষ্ট না রাখে।
মাহফুজ হালকা হাসলো! এই বাড়ি নিয়ে তার বা তার বাবা মায়ের কোন মাথা ব্যথা নেই। বিয়ে করে ব্যাচেলরের মতো জীবন তার। অনেক আশা নিয়েই বিয়ে করেছিল। সেই আশার এখন ছিটেফোঁটাও নেই।
বিয়ে নিয়ে নিশাতের মাথা ব্যথা না থাকলেও। সুলতানা অস্থির হয়ে মরছেন। কি করে মেয়েকে ফেরাবেন তিনি দিশে পান না। নিজের জীবন শেষ তার মন বলছে মেয়েটারও শেষ হবে। সে টেনশনে কোন কাজে মনও দিতে পারছে না। থালাবাটি ধুতে গিয়ে এক গ্লাস ভেঙেছেন। হেনা কিছুক্ষণ গজগজ করল। আবার তরকারি কুটতে গিয়ে নিজের পুরো আঙুল ফালা করে ফেলেছেন। এখন সেটাই চেপে ধরে পানিতে চুবিয়ে বসে আছেন। তখনি কলিং বেল বাজলো। সে মাথা ঘামালো না। সাবা বাসায় থাকলে ঘরের যেই কোনায়’ই থাক সে দৌড়ে যাবে। গেলোও তাই। যে স্পিডে দৌড়ে গেছে সেই স্পিডেই দৌড়ে এলো। এসে হাঁপিয়ে বললো, — সেই দিনের ট্রাক ওয়ালা এসেছে। সাথে ইয়া লম্বা এক লোক। দুনিয়ার খাবার টাবার নিয়ে হাজির।
সুলতানা বারো টেনশনে বুঝতে পারলো না। আঙুল চেপে’ই বেরিয়ে এলো। আসতেই থমকালো। বয়সে চেহেরা অনেকটাই পরির্বতন হয়েছে তবে চিনতে সমস্যা হলো না। তার হাত থেকে আঙুল ছুটে গেলো। ছুটতেই রক্তে পুরো মাখামাখি হয়ে গেলো।
ওয়াহিদ এগিয়ে এসে আঙুল চেপে ধরলো। সুলতানা হকচকিয়ে গেলো। ওয়াহিদ আসিফের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — নিচে দোকান আছে। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ পাও কি না দেখো।
আসিফ বেরিয়ে গেলো। ফিরে এলো কিছু সময়ের মাঝেই। ওয়াহিদ সুলতানার হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বললো, — আমি জানি, আমার কোন শব্দে আপনার ঘৃণা কমবে না আন্টি। তবুও দোয়া চাইতে এলাম। প্রথমবার সেই বুঝ না থাক, এবার আছে। তাই সবার দোয়া নিয়েই এগুবো। বলেই নিচু হয়ে সালাম করলো। সুলতানা কিছু বললো না তবে আস্তে করে মাথায় হাত রাখলো।
রাখবে না কেন? সে তো সুবর্ণা না। না কখনো সুর্বণার মতো হতে পারবে। সে যে সুলতানা! সাদাসিদে সুলতানা। যে তার স্বামীকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো। করতো বলেই তাকে স্বামীর করা পাপের বোঝা বইতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে অনাগত সন্তানকে। সেই সন্তান নিষ্পাপ! নিষ্পাপ জেনেও সে সুর্বণা মতো হতে পারবে না। পারবে তার মতো প্রতিশোধ নিতে।
চলবে…..
#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৪
নিশাতের অফিসে আজ দুনিয়ার ব্যস্ততা। উপর থেকে স্যার এসেছে। বছরে দু’তিন বার এমন তারা আসেন! এটাও তাদের দায়িত্ব। তাদের কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তার রিপোর্ট দিতে হয়, রিপোর্ট অনুযায়ী বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, নিজেরা এসে চেক করেন।
এই ব্যস্ততার মাঝে সজল ভাই এসে হাজির। নিশাত বিরক্ত মুখে বললো, — আজকে আবার কোন প্ল্যান নিয়ে এসেছো?
সজল হালকা হাসলো! হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বললো, — এক ঘন্টা সময় দিলাম। যা যা কাজ করার কর। তারপর তুলে নিয়ে যাবো।
নিশাত কথা বাড়ালো না। কথা বাড়ানোর সময় অবশ্য নেই ও। যেই টিউবয়েলগুলো পাস হয়েছে সেগুলোর জন্য স্যাররা রাউন্ডে যাবেন। তাই দুনিয়া এখন জাহান্নামে যাক। সে বেরিয়ে গেলো।
ফিরলো ঘন্টাখানেক ফিরে। ফিরে দেখলো সজল ভাই সত্যি সত্যিই বসে আছে। আরে ভাই, কোন দরকার পড়ল আবার। সে এসেই বললো, — কাহিনী কি খুলে বলে তো? বিয়ের কথা শুনে আবার তারটার ছিঁড়ে যাইনি তো। আগেই বললাম কোন গন্ডগল করবে না।
সজল দাঁড়ালো! দাঁড়িয়েই মাথায় ঠাস করে একটা চাটি মারলো। মেরে বললো, — আর কোন কাজগিরি দেখিয়েছিস না খবর আছে তোর।
নিশাত মাথা ডলতে ডলতে বললো, — এতো জোরে মারে? মাথায় একটু আঘাতে কত ক্ষতি হতে পারে জানো?
— তোর আর নতুন করে কি ক্ষতি হবে? জন্মগত’ই তোর সব তারছেঁড়া।
— তারছেঁড়া থাক মহামূল্যবান এক ঘিলু আছে। সেটার কথাতো আমার’ই ভাবতে হয়।
— আর একটাও কথা না, চল।
— কোথায়?
সজল নিশাতের দিকে শান্ত চোখে তাঁকালো। দৌড়াদৌড়ির জন্য নেয়ে ঘেমে একাকার সে। তবে আর কোন কথা বললো না। হাত বাড়িয়ে হাত ধরলো। সজলের বুক কাঁপলো! সেই কেঁপে উঠা পুরো উপেক্ষা করে সে নিশাতকে টেনে নিয়ে গেলো।
নিশাত বাড়ির সামনে এসে বললো, — বাড়িতেই আনবে তো এতো টেনে ছিঁচড়ে আনার কি হলো? আমি ভাবলাম কিডন্যাপ টিডন্যাপ করছো নাকি আবার। ছ্য্যঁকা খেয়ে মানুষ কতো রকম আকাম কুকাম করে। কলিজা তো আমার ধক ধক করছিল।
— তোর আবার কলিজা আছে নাকি?
— নেই?
— না।
— তাহলে কি আছে?
— কিছুই নেই। তুই হচ্ছিস রোবট।
— ছ্যাঁকা খেয়ে তোমার মাথা সত্যিই গেছে।
— আমি ছ্যাঁকা খেয়েছি?
— কি জানি তুমিই জানো? আমি ভাই আগে পিছে নেই।
— এজন্যই তো বললাম তুই রোবট।
— রোবট রোবট করবে না, নাক ফাটিয়ে দেবো।
— এই ছাড়া পারিস কি তুই?
নিশাত আবারো কিছু বলতে যাচ্ছিলো! তবে তাদের বসার রুমে পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালো। রুমের চেহেরা আজ বদলেছে। কেন বদলেছে সে আন্দাজ করতে পারলো। সে দাঁড়িয়েই চোখ পাকিয়ে তাঁকালো। সজল জুতো খুলছে। খুলতে খুলতে বললো, — এই বাড়ির মেয়ে তুই। কাজি অফিসে বিয়ে করবি কেন? বাবা না থাক গার্ডিয়ান অবশ্যই আছে। তো বিদায় হলে এ বাড়িতে থেকেই হবি।
— আমাকে বিদায় করতে তোমার কলিজা কাঁপবে না?
— কাঁপলে কি করবি, আমার হবি?
— না।
— তাহলে এতো কথা বাড়াচ্ছিস কেন?
— এমনিই।
সজল বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে রুমের দিকে গেলো। নিশাতও আর দাঁড়ালো না। সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। এ রুমে এসেও টাস্কি খাওয়ার জোগাড়। বিয়ের শাড়ি টাড়ি থেকে দুনিয়ার কিছু এসেছে। সে কিছু ছুঁয়েও দেখলো না। তার মা কোথায়?
সুলতানা বসে আছে রান্না ঘরে। না এখন আর তার চোখে পানি নেই। বসে আছে শুষ্ক চোখে। হেনা সারা জীবন ঝিম মেরে থাকলেও আজ সে বড়ই উৎফুল্ল।অবশ্য মনে হয় না বিয়ের জন্য । দুনিয়ার বাজার সদাই এসেছে। সেগুলো নিয়েই তিনি মহাব্যস্ত। তার ভাইয়ের বউদের খবর দিয়ে এনেছে। তারাও হাতে হাতে করছে।
জালাল উদ্দিন গেছে আশে পাশের কয়েকজন মুরব্বি ডাকতে। যে বেয়াদব মেয়ে! সংসার করতে পারবে না সে জানে। তার মধ্যে আগুনের গোলা শাশুড়ি। ছয় মাস টেকে কিনা সন্দেহ। সেই তার ঘাড়ে এসেই জুটবে। অবশ্য দুনিয়ার সয়- সম্মত্তি পাচ্ছে। নাও জুটতে পারে। তবে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে তা তো না। দায়িত্ব নিয়েছে ফেলে দিতে পারে? তাই এই মুরব্বিদের নিয়েই তখন চেপে ধরতে পারবে। সংসার না করুক কাবিনের টাকা টা উসুল করা যাবে।
নিশাত রান্না ঘরে এসে দেখলো তার মা চুপচাপ বসে আসে। সে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসলো। বসতেই সুলতানা বললো, — আমি সব সময় চেয়েছি আমার মেয়ের জীবন আমার মতো না হোক। অবুঝ ছিলাম! মোহ পড়ে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে হাত ধরে পালিয়ে গেছি। কোন মুরব্বি নেই, কোন আত্মীয়- স্বজন নেই, গায়ে গয়না তো ভালোই সাধারণ একটা শাড়িও নেই। থ্রিপিসের ওড়নাটা মাথায় দিয়েই অচেনা এক কাজি অফিসে কবুল বলেছি। সাইন করেছি নিজের ধ্বংশের খাতায়। মেয়েদের বড় শত্রু কি জানিস? সে নিজে! চোখের সামনে সব থাকে তবুও তারা ভালোবাসে কল্পনার জগতে ঘুরতে। সেই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে এক সময় বাস্তবতার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। পড়ে কেঁদে মরে বলবে তার সাথেই কেন এমন হলো? অথচ সব কিছু তার সামনে ছিল, সে ইচ্ছে করেই দেখেনি।
সুলতানার চোখে পানি চলে এসেছে। সে আঁচল দিয়ে পানি মুছে বললো, — আমার কি আর সাধ্য আছে ভাগ্য বদলাবো। তবে কিছু কিছু জিনিস আমি বদলাতে পারি। আমার মেয়ের বিয়ে আমার মতো না হোক। তার বিয়ে হোক তার চেনা গন্ডির মধ্যে। তার গায়ে বিয়ের শাড়ি হোক, গহনা হোক বলেই সাইড থেকে হলুদের বাটি থেকে একটু হলুদ নিয়ে নিশাতের কপালে ছোঁয়ালেন। ছুঁয়ে আবার বললেন, — হলুদের ছোঁয়া হোক। হাতে মেহেদির রং হোক সাথে স্বপ্ন জোড়া রঙিন সংসার হোক।
নিশাত হাসলো! সুলতানা আলতো করে নিশাতের গালে চাপড় মারলো। মেরে বললো, — খবরদার হাসবি না। তোর এই হাসি দেখলে মেজাজ খারাপ হয়। মেয়ে মানুষ কথায় কথায় এতো ঠোঁট ভেটকাবে কেন?
নিশাত কিছু বললো না। মায়ের আঁচল নিয়ে কপালের হলুদ ঘষে মুছে ফেললো। সুলতানা শুধু তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে মেয়ের কান্ডকারখানা দেখলো। মেয়েটাকে তিনি কখনো বুঝতে পারে না। অবশ্য কাওকেই পারে না।
নিশাতের বর যাত্রী এলো রাতে। সুর্বণা আসে নি তবে নিতু এসেছে, এসেছে মাহফুজ, নিনিত। ওয়াহিদ তেমন কাওকে বলেনি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাঝে দু- জনকে বলেছে।
নিতু মুখ কালো করে বসে আছে। না এই বিয়ে নিয়ে আহামরি কোন আঙ্খাকা নেই। তবে নিশাতকে দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। নতুন বউয়ের কোন হাবভাব সে দেখলো না। এসে দেখলো স্বাভাবিক ভাবেই এই রুম থেকে ঐ রুমে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে দেখলো স্টিলের এক জগে চা নিয়ে কিচেন রুম থেকে হেঁটে নিজের রুমের দিকে গেলো। এখন অবশ্য গায়ে তাদের দেওয়াই বিয়ের শাড়ি গহনা। কোন রকম পরেছে দেখাই বুঝা যাচ্ছে। নিচ দিয়ে শাড়ির কোণা ফ্লোরে লুটোপুটি খাচ্ছে।
সে বিরক্ত চোখে ভাইয়ের দিকে তাঁকালো।ওয়াহিদের মনোযোগ মোবাইলে! নিশাতের ঘিয়ে রঙের শাড়ির সাথে তার গায়ে ম্যাচিং পাঞ্জাবি। সে কিনেনি! তার এক বন্ধুর বউ ফ্যাশন ডিজাইনার। বিয়ের কথা শুনেই গিফ্ট করেছে। নিশাতের যেমন নতুন বউয়ের মতো কোন হাবভাব নেই, তার ভাইয়ের মাঝেও নেই। সে সব সময়’ই শান্ত এখনো শান্ত ভাবেই আছে। এই যে নিশাত এসেছে পর থেকে তাদের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একবার ফিরে তাকিয়েছে কিনা সন্দেহ।
সে বিরক্ত মুখেই বসে রইলো। মাহফুজ এক কেটকে মেয়ের সাথে আলাপ জুড়েছে। এই মেয়েটারও হাব ভাব ভালো ঠেকছে না। একবার দেখলাম ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, — এতো লম্বার রহস্য কি?
কেমন বিটকা মেয়ে। লম্বা হওয়ার আবার রহস্য কি? বাবা, মা যে সাইজের সেই সাইজের’ই তো যাবে। তাদের সাইজ যদি হয় মটর দানা তারা কি আর আমের আঠি হবে?
কথায় আছে সাত ঝামেলা না লাগলে বিয়ে হয় না। তবে নিশাত আর ওয়াহিদের বিয়ে হলো পুরো নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে। নিশাত কুবুল বললো স্বাভাবিক ভাবে, ওয়াহিদও বললো তার মতো। তার মতো বললেও বিয়ে পড়ানোর শেষে চোখ তুলে প্রথম তার বধুর দিকে তাঁকালো।বাড়ির হাতের সাঝ। কোন বাড়তি আড়ম্বর নেই। বিরক্ত মুখে চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই আয়োজন পছন্দ হয়নি। সে মনে হয় শটকাটে ঝামেলা সারতে চেয়েছিল।
ওয়াহিদ চোখ ফিরিয়ে নেবে তখনি নিশাত তাঁকালো। আর ঠিক তখনি দু- জনের চোখে চোখ পড়ল। ওয়াহিদ চোখ ফেরালো না তবে নিশাত মুখ ফিরিয়ে নিলো। ফিরিয়ে নিলেও জানে ওয়াহিদের দৃষ্টি এখনো তার দিকেই। সে না তাঁকিয়েই মুখ বাঁকালো। বাঁকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — ছ্যাঁচড়া।
ওয়াহিদ হেসে ফেললো। আর কেউ খেয়াল না করলেও নিতু ঠিক দেখলো। দেখতেই তার মাথায় যেন ঠাটা পড়লো। তার ভাই হাসছে? সে সাথে সাথে তার মাকে ম্যাসেজ করলো। “তোমার ছেলে গেছে। মুখে তালা মেরে বসে রইলে তো। এখন দেখো এই মেয়ে কিভাবে মায়ের আঁচল থেকে টেনে নিজের আঁচলে বাঁধে। ”
বিদায়ের বেলা নিশাতের চোখে মুখে কোন বিষাদ দেখা গেলো না। সুলতানা, সজল দু’জনের একজনও রুম থেকে বের হলো না। নিশাতও না কাউকে খুঁজলো, না কাউকে বললো। নিজের মতোই বেরুলো। বেরুতে গিয়ে তাদের চিকন সিঁড়ি মধ্যে সেই বেরিয়ে থাকা শাড়ির কোণায় পা লেগে উষ্ঠা খেতে যাচ্ছিলো। ওয়াহিদ হাত ধরে ফেরালো! নিশাত সেই হাতের দিকে তাঁকালো। তখনি ওয়াহিদের এক বন্ধু বললো, — এক মিনিট! এক মিনিট। ওয়াহিদ এভাবেই থাক ভাই। বলেই মোবাইল বের করে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললো।
সুর্বণা ভিলায় নিশাত এলো তখন ঘড়ির কাটায় দশটা পেরিয়ে গেছে। নিশাত গাড়ি ভেতর থেকেই বাড়িটার দিকে তাঁকালো। নিশ্চুপ, শান্ত বাড়ি। তবে আলোতে ঝিলমিল করছে। সেই ঝিলমিল করা আলো পেরিয়ে তাদের গাড়ি বাড়ির সামনে যেতেই ওয়াহিদ নিজেই বেরিয়ে দরজা খুললো।
নিশাত কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসলো। তারপর নেমে দাঁড়াতেই দেখলো, বাড়ির মেইন ফটকে সুর্বণা দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে বেশ কয়েকজন মানুষ। এই মানুষ গুলো তার পরিচিত। সুর্বণার মা আরো কিছু আত্মীয়- স্বজন। বয়সের ভাজে পরিবর্তন এলেও নিশাতের চিনতে সমস্যা হলো না। সে সুর্বণার দিকে চোখ রেখেই এগুলো। এবার অবশ্য শাড়িতে পা বাজলো না। তবুও পড়ে যেতে নিলো।
এবারো ওয়াহিদ ধরলো! তার বন্ধুরা শিস বাজিয়ে বললো, — কোলে নাও বন্ধু। সময় সুযোগ করে দিচ্ছে। এই সময় আর ফিরে আসবে না।
ওয়াহিদ অবশ্য কোলে নিলো না। দরজায় মা, নানি, মামিরা দাঁড়িয়ে। সে নিশাত কে গুছিয়ে দাঁড় করালো। তবে হাত ছাড়লো না। নিশাত সেই ধরা হাতের দিকে তাঁকিয়ে সুর্বণার দিকে তাঁকালো। তাঁকালো সুর্বণাও। তার দৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় নেই। তার ভেতরে আগুন জ্বলছে, দাউদাউ করা আগুন। এক মমতায় হয়েছে সে হিংস্র আরেক মমতায় হতে হচ্ছে তাকে শান্ত।
চলবে……