প্রাচীর পর্ব-১৯+২০

0
582

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৯

নিশাত বাসে বসেই জানালা দিয়ে ওয়াহিদের গাড়িটা দেখলো। বাস থামতেই সে চোখে সানগ্লাস টানগ্লাস লাগিয়ে একশো পার্সেন ভাবওয়ালা ভাব নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। গায়ে কালো টিশার্ট, জিন্স। দৃষ্টি বাসের দিকে। সে চেলচেলিয়ে নিচু হয়ে গেলো।

আজকে তার ফেরার কথা ওয়াহিদ জানে। তবে কখন জানার কথা না। তার সব খবরা খবর এই লোকের হাতে থাকে। থাকুক! সেও দেখতে চায় কত খবরা খবর নিতে পারে। নিয়ে কোন ঘোড়ার ডিম করতে পারে।

তার পাশে বসেছে সুজানা নামের একটা মেয়ে। এখনো বিয়ে হয়নি। এই বাস ভর্তি তাদের’ই মতো বিভিন্ন ব্রাঞ্চের লোক। এই তিনদিনে অনেকের সাথেই ভালো পরিচয় হয়েছে। সুজানাও সেই দলের। সে চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে বললো, — লোকটা কে গো। দৃষ্টিততো আমাদের বাসের পানেই। বলেই পুরো বাসে একবার চোখ বুলালো। বুলিয়ে বললো, — কারো ভাই টাই নাকি? এমন মালদার পাটি হয়ে এই সামান্য চাকরিও কেউ করে আমার তো জানাই ছিল না।

নিশাত উত্তর দিলো না। মোবাইল বের করে মোবাইলে ধ্যান দিলো। সবাই নামুক! ধীরে সুস্থে নামা যাবে। তাছাড়া এই বেটাকে সবার সাথে পরিচয় করার কোন ইচ্ছা তার নেই। তাই সে সিটটা নামিয়ে আরেকটু আরাম করে বসলো।

সুজানার ধ্যান জ্ঞান সব ওয়াহিদের দিকে। অবশ্য শুধু তার না। যারা যারা নামছে সবাই একবার হলেও তাঁকাচ্ছে। সবাই মোটামুটি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির। এমন ভাবওয়ালা দেখলে তাঁকাবে এটাই স্বাভাবিক।

সুজানা জিনিস পত্র গুছাতে গুছাতে আফসোস নিয়ে বললো, — দুনিয়ার সব হ্যান্ডসামরাই টাকা পয়সার কুমির হয়ে বসে আছে। আমাদের মতো গরীবদের কি হবে বলো তো?

নিশাত মোবাইলে চোখ রেখেই বললো, — হ্যান্ডসাম হতে কখনো টাকা লাগে না বরং টাকা পকেটে থাকলেই যদু, মদু, কদু সবাই হ্যান্ডসাম।

— বলেছে তোমাকে! এই বান্দাকে দেখো, আমার তো ধারণা ছেঁড়া লুঙ্গিতেও একে গরম তাওয়ার মতো হট মনে হবে। আর তার অ্যাডামস অ্যাপল! উফ! সব ছেলেকে কিন্ত মানায় না। একে কেমন মানিয়ে গেছে।

নিশাত চোখ তুলে তাঁকালো! ওয়াহিদ তাদের এক স্যারের সাথে হাত মিলিয়ে হেসে কথা বলছে। তার অ্যাডামস অ্যাপেল তার হাসি, ঠোঁটের সাথে উঠানামা করছে। আশ্চর্য! এতদিন হলো তার তো কিছু চোখেই পড়েনি। সে ভাবার চেষ্টা করল। চেষ্টা করে যা বের হলো তা হলো, সে এই বান্দার সাথে একই বাড়িতে, একই রুমে তাছাড়া মারামারি টাইপ জাপটা জাপটিও হয়ে গেছে। তবুও এখনো ভালো ভাবে নোটিশ ও করেনি। আহারে বেচারা! কতো মেয়ে পাগল, আর এমন বিয়ে করলো, বউ পাগল হবে দূরের কথা সামান্য নোটিশও করছে না।

সে আফসোস করতে করতেই আবার মোবাইলে ধ্যান দিলো। সুজানা গুছিয়ে উঠতে উঠতে বললো, — আসি নিশাত! ভালো থেকো।

নিশাত হেসে বিদায় জানালো। সুজানা বের হবে তখনি ওয়াহিদ বাসের ভেতরে এসে দাঁড়ালো! এসে বললো, — নিশাত?

সুজানা হা হয়ে গেলো। হা হয়েই বললো, — আপনি নিশাতের রিলেটিভ নাকি?

ওয়াহিদ হালকা হাসলো! হেসে বললো, — হাজবেন্ড।

সুজানার হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো। সুজানা কোন রকম উঠিয়ে নিশাতের দিকে তাঁকালো। কি মেয়েরে বাবা। সে উঠেই তাড়াহুড়ো করে নামলো। ছি ছি কি লজ্জার ব্যাপার। বউয়ের সামনে জামাইয়ের দিকে কু- নজর। আল্লাহ মাফ করো।

বাস প্রায় ফাঁকা! ওয়াহিদ এসে বললো, — নামার ইচ্ছে নেই?

— ছিল! তবে আপনাকে দেখে ইচ্ছা মরে গেলো।

— ভালো! বলেই নিশাতের পাশের ছিটে বসলো।

সাথে সাথেই নিশাত দাঁড়িয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে বললো, — চলুন যাওয়া যাক।

— বসো নিশাত।

— বাসতো আমার মামার বাড়ির না। বউ নিয়ে আরামে বসে থাকবেন।

— মামার বাড়ির হোক আর নিজের আরামে বসবো সেই কপাল আমার নেই।

— একদম সত্য বাণী। কোন ভেজাল নেই। এবার উঠুন।

ওয়াহিদ হাত ধরে টেনে বসালো। নিশাত হাতের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — কোন চান্স মিস হতে দেন না, না ?

— বউয়ের হাত ধরার জন্য আবার চান্স প্রয়োজন হয় নাকি। আমার নামে দলিল, আমার ঘরে, আমার রুমে বসবাস। তাকে ছোঁয়ার জন্য চান্স না, ওয়াহিদের ইচ্ছেই যথেষ্ট।

— নিজের নাম, দাম নিয়ে এতো অহংকার কেন আপনার? যখন, তখন হাজার কিলো ওজন নিয়ে ওয়াহিদ! আবরার ওয়াহিদ বলে বলে আমার ঘাড়ের উপরে ফেলতে থাকেন। শাহরুখ খানের টুকু আর বাদ রাখেন কেন? ওয়াহিদ, আবরার ওয়াহিদ সাথে বলবেন, নাম তো সুনাই হোগা।

— আমার সব কিছুতে তোমার এতো এলার্জি কেন?

— থাকবে না? এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে, চাকরি করে আমরা ভাব ধরতে পারি না। আর বসেন তো বাপের অফিসে। এত ভাব আসে কোথা থেকে বলেন?

ওয়াহিদ ফুস করে শ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — আমার কোন জিনিস তোমার পছন্দের তালিকায় আছে?

— একদম না। আবার পরেছেন সানগ্লাস। সানগ্লাস তো ঠিক আছে ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ডের। তবে যখনি আপনার মুখের দিকে তাঁকাচ্ছি এটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। খুলেন, এক্ষুনি খুলেন। এত দামী একটা সানগ্লাস কোন সময় আমার হাতে ভেঙে যায়। আল্লাহ না করুক। আমার কাছে টাকার পয়সার মূল্য আছে।

ওয়াহিদ খুললো না, তবে উঠে দাঁড়ালো। নিশাতও উঠতে উঠতে বললো, — আপনি এসেছেন কেন? আমি বলেছি আপনাকে আসতে।

ওয়াহিদ উত্তর দিলো না। গত তিনদিন এই মেয়ে একবারের জন্য তার ফোন ধরে নি। তখন তার ইচ্ছে করেছে সোজা গিয়ে তুলে নিয়ে আসি। তবে কতো কষ্টে নিজেকে দমিয়েছে সে জানে।

সে এক হাতে নিশাতের ব্যাগ আরেক হাতে নিশাতের হাত ধরেই বাস থেকে নামলো। নিশাত বিরক্ত নিয়ে বললো, — এমন বাচ্চা পুলাপানের মতো হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? আপনার কি ধারণা, আমি রাস্তা- ঘাটে চলাচল করতে পারি না?

— তুমি সবই পারো নিশাত। বরং আমি যা পারি না তাও পারো। আর সেটাই ভয়। বলেই নিশাতকে গাড়িতে বসালো। বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে নিজে গিয়ে বসলো।

বসতেই নিশাত বললো, — আজকে আপনার পেয়াদা কই? সব সময় তো বগলতলায় নিয়ে ঘুরেন।

ওয়াহিদ গাড়ি এক টান মেরে বললো, — আমি আমার বউয়ের কাছে, তাই তাকেও পাঠালাম বউয়ের কাছে।

— আজকে না রিসিপশন। এর জন্য না এতোদিন মরে গেলেন। এখন আবার একেক জন, একেক জনের বউয়ের জন্য এতো মরে যাচ্ছেন কেন?

— আপাতত সেটা ক্যানসেল।

— যাক! বাঁচলাম। এতো ঢং আমার গায়ে সয় না।

— নেক্সট উইকে।

— ধুর! বলেই হাই তুললো! ভোরে রওনা দিয়েছে। ঘুম ঘুম লাগছে। তার হাই দেখে ওয়াহিদ বললো, — ঘুমালে খবর আছে?

নিশাত ভ্রু কুঁচকে বললো, — ঘুমালে খবর আছে মানে কি? আমি এখন নিজের ইচ্ছায় ঘুমাতেও পারবো না?

— না।

— তো কি করবো? বসে বসে আপনার চেহেরা দেখবো।

— দেখতেও তো পারো।

নিশাত মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে জানালার দিকে একটু কাত হলো। তার ঘুমের কোন ইচ্ছা ছিল না। তবে খবরের কথা শুনে ঘুম তো অবশ্যই দরকার। সে আরাম করে শুলো। শুতে শুতে বললো, — গুড নাইট আবরার ওয়াহিদ। নাম তো সুনাই হোগা।

ওয়াহিদ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে এমন এক ইউটার্ন নিলো। নিশাত এক জটকায় ওয়াহিদের গায়ের উপরে এসে পড়লো। ওয়াহিদ সাথে সাথেই এত হাতে জাপটে ধরলো। নিশাত স্তব্ধ হয়ে আছে। স্তব্ধ হয়েই বললো, — একবার অ্যাক্সিডেন্ট করে মন ভরেনি?

— ভরেছিল তবে তুমি বললে আবার হানিমুনে জাহান্নামে যাবে। ব্যবস্থা তো করতে হবে তাই না। বউয়ের স্পেশাল চয়েজ বলে কথা।

নিশাত দাঁতে দাঁত পিষলো। ওয়াহিদ সেইদিনের মতোই আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। নিশাত আগের মতোই বললো, — এই না শরীর লাগবে না।

ওয়াহিদ নিশাতকে আস্তে করে সিটে বসিয়ে দিলো। দিতে দিতে বললো, — লাগলো কোথায়? এটা মহব্বত ছিল। এতো কিছু বোঝ আর কোনটা মহব্বত এটা বোঝ না।

চটাং চটাং উত্তর দেওয়া নিশাত আজ উত্তর দিলো না। আগের মতোই কাত হয়ে জানালার দিকে তাঁকালো। স্বচ্ছ আকাশে রোদ ঝিলমিল করছে। সেই ঝিলমিল করা রোদের দিকে এক পলকে তাঁকিয়ে রইল। তাঁকাতে তাঁকাতেই চোখ বন্ধ করলো। করতেই চোখের সামনে ভাসলো, সেই এগারো বছরের নিশাত। ঝুম বৃষ্টি, ক্যারেন্ট নেই, অন্ধকার রাত। সেই অন্ধকার ঢেলে সিঁড়ি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। জোরে জোরে কড়া নাড়ছে আর কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলছে, ” দরজা খোল আন্টি, দরজা খোল। মা মরে যাচ্ছে। ”

নিশাত সাথে সাথেই চোখ খুললো। খুলে ওয়াহিদ যেখানে ঠোঁট রেখেছে সেখানে হাত দিয়ে মুছে ফেললো।

_____

সুর্বণার চোখটা লেগে গিয়েছিল, ঘুমটা ছুটে গেলো দরজায় কারো নক পড়তে। সে চোখ খুলে দেখলো নিশাত দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চোখ খুলে তাঁকিয়ে দেখতেই ভেতরে এসে গদগদ হয়ে বললো, — এখন কেমন আছেন মা? এটা কোন কথা, শুকনো মাটিতে পড়ে মাথা ফাটিয়েছেন। দেখো কান্ড! এই কথা শুনে আর টেকা যায় বলেন? খেতে পারি না, ঘুমতে গেলে বুক ধড়পড় করে। আহারে! বয়স্ক মানুষ! এ বয়সে হাড্ডি ভাঙলে আর জোড়া লাগে? সারা জীবনের জন্য কুক্কর কু। ও তো আল্লাহর রহমত মাথার উপর দিয়ে হালকা গেছে। চার দিনের কোর্স! তিন দিনে কোন রকম করে দৌড়ে এলাম। জানে পানি আছে আমার। এই যে এখন আপনাকে দেখে একটু আত্মাটা ঠান্ডা হলো।

সুর্বণা উত্তর দিলো না। সে নিশাতের দিকে একপলকে তাঁকিয়ে রইল। তখনি আফসানা হক এলেন। মেয়ের এই অবস্থা তারা না এসে পারে। সে ধীরে ধীরে মেয়ের পাশে বসলেন। বসে বললেন, — এতো ঢংয়ের অভিনয়ের ট্রেনিং কে দিয়েছে তোমার মা?

নিশাত আগের মতোই বলল, — কি যে বলেন না নানু। সে যদি এতো ছলা কলার অভিনয় জানতো তাহলে আজ তার এই দশা হয়?

— তা ঠিক! বেটা মানুষকে বাঁধতে ছলা কলাই লাগে। এই যে কি সুন্দর আমার নাতিরে বেঁধে রাখছো। বউ যা বলে তাই ঠিক।

— আপনাদের মতো পারি কই নানু? শুধু জামাই হাতে রাখলে চলে, রাখতে হয় পুরো গুষ্টিকে। যেমন মা রাখেন। ইশ! কত কিছু যে শেখার আছে তার কাছ থেকে।

— চুপ কর অপয়া মেয়ে কোথাকার। বাড়িতে আসতে না আসতেই ধ্বংস শুরু হয়েছে। তোমার জন্য আমার মেয়ের জন্য আজ এই অবস্থা।

নিশাত শান্ত ভাবে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল! তারপর সব সময়ের মতো হাসলো। হেসে বললো, — একদম ঠিক।

— মানে?

— মানে আপনি একদম ঠিক বলেছেন নানু। আমি’ই হয়তো অপয়া। বলেই চোখের কোণা মুছলো।

সুর্বণা আগের মতোই তাঁকিয়ে রইলো। ওড়নার কোণা দিয়ে মুছা চোখের কোথাও পানির ছিটাফোঁটাও দেখা গেলো না। বরং তার জন্য এসব হওয়ায়, সুর্বণার কাছে খুশি খুশি’ই মনে হলো। তাই যেমন ছিলেন তেমনি রইলেন। তবে আজ এতোটুকুও রাগলেন না ।

তখনি সুন্দর মতো একটা মেয়ে ট্রে করে স্যুপ নিয়ে এলো। সুর্বণার পাশে বসে বললো, — ওঠতো খালামণি! ঔষুধের সময় হয়েছে। স্যুপটা খেয়ে ঔষুধটা খেয়ে নাও। তা না হলে ওয়াহিদ ভাই কিন্তু খুব রাগ করবেন। আমাকে পই পই করে বলেছেন। একটু ঊনিশ বিশও যেন না হয়।

সুর্বণা হেসেই উঠে বসলেন! তার চোখ মুখ থেকে এখন খুশির ঝিলিক ছলকে ছলকে পড়ছে। সেই পড়ার মাঝেই বললেন, — নিশাত এটা লামিয়া। আমার চাচাতো বোনের মেয়ে। ঐ যে একদিন বললাম। ওয়াহিদের জন্য আমার খুব মনে ধরেছিল। তবে কপাল! বাবা, মা ছেলেমেয়ে কে সব সময় দিতে চায় বেষ্ট জিনিস। আর ছেলেমেয়েরা.. যাক সেসব বলে আর লাভ কি? মেয়েটা আমার কথা শুনে দৌড়ে এসেছে। এই তিনদিন আমি তো ভালো’ই পুরো সংসারটা আগলে নিয়েছে। আর তোমার একটু ফোন করারও সময় হলো না। যাক হয়ত আমার ছেলেই নিষেধ করেছে। না পেয়ে, বউ পেয়েছে। তার জন্য সাত খুন মাফ। বলেই স্যুপের বাটি এগিয়ে নিলেন। মুখে তুলে বললেন, — ইশ! তোর হাতের তুলনা হয় না রে মা। বেঁচে থাক! আল্লাহ মনের সব আশা পূরণ করুক।

নিশাত আগের মতোই হাসলো! হেসে বললো, — ভালো আছো লামিয়া?

লামিয়াও হাসলো! হেসে বললো, — একদম।

চলবে……

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২০

নিশাতের বিবাহিত জীবনের একেক সকাল হচ্ছে একেক রকম। জীবনতো না যেন স্টার জলসার সিরিয়াল। আজকে সকাল হলো অতি গুণধারী লামিয়া সুন্দরীর গুণ দেখে। সে নাস্তা টাস্তা বানিয়ে একাকার করে ফেলেছে। আর তার শাশুড়ি মা অর্ডার দিয়েছে আজকে সবাই একসাথে খাবে। কখন বাঁচেন মরেন। তাই যখন সবাই বাসায় থাকবে এক সাথেই খাবেন।

নিশাত এসে বসেছে সবার আগে। এই বাড়িতে আর যাই হোক ঘুম ভালো হচ্ছে। খেয়ে দেয়ে কমফোর্টার জড়িয়ে শুতেই ঘুম। অবশ্য অতীত ইতিহাস ঘাটলে ঘুমের সমস্যা তার কখনোও ছিল না। তাবে অচেনা বাড়িতে একটু উপর নিচ হওয়ার কথা। তবে সেই রকমও কিছু হচ্ছে না। তাই ঘুমায়ও আগে উঠেছেও আগে।

সে উঠেই বসেছে ড্রইং রুমে। আজকে তার অফিস নেই। একদিন রেস্ট! কলকে থেকেই আবার শুরু করবে। তবে আজকে দিন মাটি করার অবশ্য কোন ইচ্ছে টিচ্ছে নেই। সজল ভাইয়ের সাথে বের হবে। জায়গা দেখা হয়েছে। সে গিয়ে কনফার্ম করবে। বাকি যা আছে সব দায়িত্ব সজল ভাইয়ের।

সুর্বণাও তার পাশেই বসা। আজকে তাকে পুরোই ঝরঝরে লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে ফুরফুরে মেজাজেও আছেন। থাকবে না কেন? বোনের মেয়ে এনে এমন ভাব নিচ্ছেন তোপ নিয়ে এসেছেন। আরে বাবা তোপ নিয়ে আয় আর বোম নিয়ে আয় নিশাতের কি? সেই ওল্ড ফ্যাশন শাশুড়িগিরি। আরে বাবা কোন বউ এখন রান্নাঘর চায়, আর সে কোন গুড বউ হওয়ার জন্য মরে যাচ্ছে।

মরে যাক আর না যাক তার ধারণা সে যতক্ষণ সামনে থাকে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে পুরো স্ক্যান করতে থাকে। এতো করে টরে লাভ কি? যতোই তীক্ষ্ণ নজরে’ই তাঁকাও, মানুষের ভেতর তো আর দেখা সম্ভব না। যদি হতো কেঁপে উঠতে গো শাশুড়ি মা। আপনের জমানায় আপনি বুনো ওল থাকলে, আমি আমার জমানায় বাঘা তেঁতুল। ইতিহাস সাক্ষী! পুরাতন যত শক্তিশালী’ই হোক। নতুন প্রজন্মের কাছে হার মানতেই হয়।

— তুমি রান্না- বান্না কিছু জানো?

নিশাত গলে গিয়ে বললো, — জ্বি না মা। আমি জানি না।

— জানো টা কি? শুধু চাটাং চাটাং জবান চালাতে।

— এক হিসেবে বলতে গেলে সেই রকম’ই।

— কেন, সুলতানা কিছু শেখায়নি?

— জ্বি না! দুঃখের হিসেব নিকেশ করেই কুল পায়না। মেয়ের দিকে নজর দেবে কি?

— তা ঠিক! দিন দুনিয়ার কোন জিনিসের প্রতি’ই তার নজর ছিল। নিজেও তো কোন কাজের ছিল না। দুনিয়া চেনার খবর নেই। এক জনের হাত ধরে আরেক জনের ঘাড়ে এসে বসা। শেখালামতো সব বলে বলেই।

— জ্বি অবশ্যই! তবে যত যত্ন করে অন্যের বউকে শিখিয়েছেন তত যত্ন করে নিজের মেয়েকে যদি শেখাতেন, অন্তত স্বামীর মনের মতো হতো।

— কিছু শেখাই আর না শেখাই জামাইকে কিভাবে ধরে রাখতে হয়। সেটা ঠিকিই শিখিয়েছি।

— একদম ঠিক! অন্যের জামাইকে কিভাবে টানতে হয় সেটাও কি শিখিয়েছিলেন?

সুর্বণা কঠিন চোখে তাঁকালো! নিশাত দেখেও দেখলো না। নিনিত এসে আস্তে করে তার পাশ ঘেঁষে বসলো। নিশাত হেসে নাক টিপে দিলো। তার সাথে সাথেই মাহফুজ এলো। আসতেই সুর্বণা বললো, — নিশাত যাও লামিয়ার হাতে হাতে একটু হেল্প করো। সে মেহমান মানুষ একা একা করছে। দেখতে কেমন দেখায়।

নিশাত উঠে গেলো! দু- মিনিটের মাথায় আবার ঘুরে এলো! হাতে তার চায়ের ট্রে। রাখতে রাখতে বললো, — সে একাই একশো মা। তার নাকি কোন হেল্প লাগবে না। বলেই হেসে মাহফুজের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো।

মাহফুজ হেসেই চায়ের কাপ হাতে নিলো। সকালে এক কাপ চা ছাড়া তার দিন ভালো যায় না। এই কয়দিনেই কি সুন্দর খেয়াল করেছে। আর তার বউ বলতেও পারবেনা কি খায় না খায়।

সুর্বণা থমথমে মুখে বসে রইল। চেঁচিয়ে এক কাজের লোককে বললো, — নিতু কে টেনে তুলতে। বেয়াদবের বেয়াদব! জামাই অফিসে যাবে তার খবর নেই।

মাহফুজ শাশুড়ির আচরণে অবাক’ই হলো। তিনি তার ছেলে মেয়ে বলতে অন্ধ। তাদের কোন কিছুতেই কোন দোষ নেই। সে অবাক হয়েই বললো, — আমাকে ফিরতে হবে মা।

সুর্বণা সব সময় মাহফুজ ফিরতে চাইলেও দু-একদিন এমনিতেও জোর করেই রাখেন। আজকে হেসে বললো, — বিয়ের ঝামেলা গেলে নিতুকে এসে নিয়ে যেও। আমি বেয়াই বেয়ানের সাথে কথা বলে নেবো। তারা যেন আগেই আসে।

মাহফুজ এবারো অবাক হলো। নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে দেখলো নিতু ঘুম ঘুম চোখেই হেলেদুলে নামছে। সে মুখ কালো করে বললো, — এটা কেমন কথা বললেন মা। দু’দিন পরেই রিসিপশন এখন কেন ভাইয়া চলে যাবে। জামাই মানুষ সে থাকবে সবার আগে। আপনি তাকে যেতে দিচ্ছেন কিভাবে?

নিতুর ঘুম উবে গেছে। সে ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে বললো, — কি হয়েছে?

সুর্বণার কি আর সুযোগ আছে, নিশাত সাথে সাথেই বললো, — ভাইয়া নাকি চলে যাবে। মা একটু থাকার জন্য বললোও না। আবার বলছে বিয়ের ঝামেলার শেষে নিতুকে এসে নিয়ে যেতে। কেন মা? নিতু কি আমাদের উপরে এতোই বোঝা?

নিশাতের কথা শেষ হতে দেরি নিতুর কথা ধরতে দেরি হয়নি — তুমি এসব বলেছো মা?

— নিতু চুপ!

— ওহ! এখন আমি চুপ। বোঝা হয়ে গেছি আমি। আর আমার জামাই এখন পর।

মাহফুজ এগিয়ে বললো, — এরকম কিছু না নিতু।

— তো কি রকম? এটা আমার বাবার বাড়ি। এখানে আমি যেমন মন চায় থাকবো। আমাকে ডেকে তোলা হলো কেন? কেন তোমাকে এই কথা বললো? কেন আমাকে নিয়ে যেতে বললো?

নিশাত আবারো মুখ খুলতে যাচ্ছিলো। সুর্বণা সাথে সাথেই হাত তুলে থামালেন। এই মেয়ের মুখ না জানি কবে সে নিজ হাতে সেলাই করে দেয় । সে বিরক্ত চেপে বললেন, — এমন কিছু না। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। লামিয়া অনেক কষ্ট করে নাস্তা তৈরি করছে। আমরা সবাই এক সাথে খাবো।

— তোমার লামিয়া বাবুর রান্না তুমিই খাও। ঢং দেখে আর বাঁচি না। নাস্তা তৈরি করেছে। কে করতে বলেছে ওকে? কাজের লোক নেই।

লামিয়ার মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। তার কোন দরকার আছে এসব করার। খালামণি মাকে কি বলেছে কে জানে? ঠেলে পাঠালো।

সুর্বণা শ্বাস ফেললো! এই মেয়েকে তিনি সত্যিই বেয়াদব বানিয়ে ফেলেছেন। বড় ভাইয়ের মুখের উপরে কথা বলেছে। তখন কিছু বলেনি, সেই বলা এখন নিজের উপরে পড়ছে। সে মাহফুজের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — বাবা আসো নাস্তা করবে। আর এসবের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।

মাহফুজ আছে স্তব্ধ হয়ে। কি থেকে কি হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তাই স্তব্ধ হয়েই বললো, — না মা আজকে আর নাস্তা করার সময় হবে না। আপনারা বরং করুণ। আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। বলেই বেরিয়ে যেতে গেলো।

নিশাত আফসোস মাখা কন্ঠে বললো, — আহারে জামাই মানুষ। লজ্জা পেয়েছে! মেয়েদের জীবন’ই এমন। বিয়ের পরে না থাকে মা – বাপ, না থাকে বাপের বাড়ি। সবই পর, শুধু সময়ের অপেক্ষা।

নিতু আবার ফুঁসে উঠল! ফুঁসে তার মাকে বললো, — মাহফুজ যদি রাগে আর না আসে। আমি আগুন জ্বালিয়ে দেব বলে দিলাম।

— তুমি একদম ভেবোনা নিতু। এই দায়িত্ব আমার। আমি থাকতে ভাইয়া রাগ করে আসবে না। এটা হতেই পারে না। আমি দরকার পড়লে অফিসে গিয়ে নিজে নিয়ে আসবো।

সুর্বণা আগুন চোখে তাঁকালো! নিশাত অসহায় মুখ করে তাঁকালো! যেন ভয় পেয়ে গেছে। নিতু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উপরে চলে গেলো। সুর্বণা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ করে কোথা থেকে কি হলো, সে ভেবে পেলেন না। তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। নাস্তার কথা তার মাথাও রইল না। ধীরে ধীরে উপরে গেলেন। আর যেতে যেতেই নিশাতের দিকে আবার ফিরে তাঁকালেন। অনেক অনেক দিন পরে সে রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। আর তার রাগের এক সমস্যা। রাগলে না কাওকে চোখে দেখে না হিতাহিত জ্ঞান থাকে।

সবাই যেতেই নিশাত লামিয়ার দিকে তাঁকালো। একটু হেসে বললো, — মন খারাপ করো না লামিয়া। কেউ না থাক আমি আছি না। বলেই টেবিলে গিয়ে বসলো। খাবার এগিয়ে নিতে নিতে বললো, -” জায়গা বুঝে গুণ দেখাতে হয় লামিয়া। অপাত্রে ঘি ঢালো আর মধু। কোন কাজে আসবে না।”

লামিয়া নিতুর মতো হনহনিয়ে চলে গেলো। নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে আরামছে বসে বসে নাস্তা করলো। এক কাপ চা নিয়ে গুন গুন করতে করতে রুমে এলো।

ওয়াহিদ সেই আগের মতোই শুভ্র চাদরে কুশন বুকে চেপে শুয়ে আছে। নিশাত এসেছে পর থেকে এখানেই ঘুমাচ্ছে সে। ঘুমাক! ভাব বেশি হলে এই দশাই হয়।

নিশাত গুন গুন করতে করতে পর্দা টেনে সরালো। এই বাড়ির কারো শান্তি তার সহ্য হয় না। আর এতো আরামের ঘুম ?

ওয়াহিদ চোখ মুখ কুঁচকেই বললো, — পর্দা টানো নিশাত।

— না।
— কেন?
— এমনিই।

ওয়াহিদ ওপাশে ফিরে শুলো। কুশন মাথার উপরে চাপলো। নিশাত হাসলো! হেসে এক গাদা কাগজ পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাটে বসলো। কতক্ষণ কাজ করলো কে জানে। তার ধ্যান ভাঙলো ফোনের শব্দে। ফোন করেছে সজল ভাই। সে হেসে রিসিভ করলো। করে কানে রাখতেই হাসিটা মলিন হলো। মুখটা হলো শান্ত, টলমলে দিঘীর মতো। ফোন রেখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। তারপর শান্ত ভাবেই ফোন, পার্সটা নিয়ে রুম থেকে বেরুলো। যেতে যেতে একবার সুর্বণার দরজার দিকে তাঁকালো। তাঁকিয়ে শান্ত ভাবেই বেরিয়ে গেলো।

সে বেরুতেই ওয়াহিদের ফোন বাজলো। সে ঘুম ঘুম চোখেই রিসিভ করলো। করতেই চোখ খুললো। খুলতে দেরি উঠতে দেরি হয়নি। গায়ে তার ঘরোরা সিম্পল টিশার্ট, টাউজার। সেগুলো পরেই দৌড়ে বেরুলো।

নিশাত রাস্তার পাশ দিয়েই ধীরে ধীরে হাঁটছে। এটা অভিজাত এলাকা! রিকশা পাওয়া যাবে না। দারোয়ান দৌড়ে ড্রাইভারকে বলতে বলতেই সে বেরিয়ে এসেছে।

তার হাঁটার মাঝেই ওয়াহিদ গাড়ি নিয়ে এলো। নিশাত দেখেও দেখলো না। ওয়াহিদ গাড়ি রেখে নিজে বের হয়ে এলো। এসে হাত ধরতে গেলো। নিশাত হাত সরিয়ে শান্ত ভাবে বললো, — আপনার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে যেমন আমি ছিলাম না। খোঁজ খবরও নেই নি। তাই আমার মায়ের কাছ থেকেও দূরে থাকুন।

ওয়াহিদ এগিয়েই হাত ধরলো। ধরে বললো, — আমি কোন বিনিময়ের জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি নিশাত। আমার জন্য রাঁধতে হবে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আমার সেবা করতে হবে। এসব কোন কিছুর’ই আমার দরকার নেই। তোমার ইচ্ছে হলে করবে, না হলে নেই। আমার টুকু তো আমি অবশ্যই করবো।

নিশাত হাসলো! তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিয়ে নিজেই গাড়িতে উঠে বসলো।

সুলতানা বের হয়েছিল সবজি নিতে। সাইডেই তো ছিল। কোথা থেকে এক সিএনজি এসে দিলো ধাক্কা। সে উল্টে পড়লো। বেশি আঘাত অবশ্য পায়নি। তবে পড়ার জন্য মাথায় একটু আঘাত পেয়েছে।

নিশাত ডাক্তারের সাথে কথা বলে, মায়ের কাছে এলো। এসে অবশ্য কিছু বললো না, শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। সুলতানা মেয়ের হাত ধরে বললো, — তোর চোখে পানি আসে না কেন রে নিশাত? ঐ দেখ সাবা হাপুস নয়নে কাঁদছে। মায়ের জন্য এতটুকুও মন পুড়েনা বুঝি।

— না মা পুড়ে না। কারো জন্যই না।

— আমার জন্যও না?

— না।

— কেন?

— ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের উপরে বিশ্বাস রাখতে হয়।

— আমি রাখিনি?

— না।

সুলতানা হাসলো! হেসে বললো, — তুই রাখিস! আমি যেই যেই ভুলগুলো করেছি। সেই ভুলগুলো তুই করিস না।

— আমি করিও না মা। তাই তো কাঁদিনা। দেখনা তোমার মেয়ে শুধু হাসে আর হাসে।

সুলতানা মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষল তাঁকিয়ে রইলেন। তারপর প্রথম বার ওয়াহিদকে নিজে থেকে কাছে ডাকলেন। ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, — মেয়ের জামাইয়ের কাছে সব মায়ের চাওয়া থাকে, মেয়েটাকে সব সময় হাসি খুশি রাখুক। তবে তোমার কাছে আমার চাওয়া রইলো। আমার মেয়েটা একটু কাঁদুক! প্রাণ ভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁটে তার বুকের জমানো বরফ গলে নিঃশেষ হোক।

ওয়াহিদ সুলতানার হাত মুঠোপুরে নিশাতের দিকে তাঁকালো। আর নিশাত তার মতোই চোখ ফিরিয়ে নিলো।

চলবে…..