#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২১
রিসিপশনের আয়োজন ভালো ভাবেই হচ্ছে। নিশাত অবশ্য জানে না কেমন ভালো। সব আয়োজন কনভেনশন হলে। কনভেনশন হলে, হলেও অনুমান করা যাচ্ছে বেশ দ্রুত বেগেই এগিয়ে যাচ্ছে। কেননা সে আছে নিজের মতো দৌড়ের উপর। তবে দৌড়ে টৌড়ে বাড়ি ফিরলে নতুন নতুন মানুষের টেরা বাঁকা মুখ দেখছে। এই টেরা বাঁকা মুখই বলে দিচ্ছে তাদের বউ পছন্দ হয়নি। বউ থাকবে বাসায়, তাদের পা লেজ টেপাটেপি করবে। তারা একটু খোঁচাখোঁচি করবে। তবেই না মজা কোন অনুষ্ঠানের। এতো মজা এই বউ দিচ্ছে না, সেই বউ খারাপ তো হবেই।
তাই এই খারাপ বউ আরো খারাপ হয়ে অফিস থেকে ফিরলো বলতে গেলে প্রায় সন্ধ্যায় একটু আগে। না এতো সন্ধ্যা পর্যন্ত সে অফিস করে না। তবে সেই আফিয়া মেয়েটার খোঁজ করতে গিয়ে দেরি হলো। যেই ভাতা টার জন্য মেয়েটার এতো আগ্রহ ছিল। ফোন দেওয়ার পরও মেয়েটা নিতে আসছে না। তাই একটু খোঁজ খবর করলো। মেয়েটার বাবার মোবাইলে কোন কারণে কল যাচ্ছে না, ঠিকানা অবশ্য পেয়েছে। যাবে কি না বুঝতে পারছে না।
নিশাত ড্রইংরুমে পা রাখতেই দেখলো তার শাশুড়ির পুরো গুষ্টি চায়ের আড্ডায় মেতেছে। নিশাতের ধারণা এই মানুষগুলো এই বাড়িতে আসার বাহানা খোঁজে। পান থেকে চুন খসলেই দৌড়। দৌড়ে এসে আপাগো, সোনাগো, ময়নাগো বলে তেল মারতে থাকে। কোন লাভে করে আল্লাহপাক’ই জানে। আর এই তেল মারার বাহিনীর মধ্যমণি হলো তার শাশুড়ি। তিনি বসে আছেন ঝাঁসি কি রাণীর মতো। নিশাত দেখেই গদগদ হয়ে লম্বা এক সালাম দিলো। না দিয়ে উপায় কি? শাশুড়ি বলে কথা, এ যে সব শান্তির মাথা। আর শান্তির ব্যাপারে নিশাতের কোন আগ পিছ নেই।
সালাম দাতার দিকে সাবাই তাঁকালো। গুষ্টির কোণা কাঞ্চিতে কেউ মনে হয় আর বাকি নেই। সব এসে হাজির। একেই বলে যার বিয়ে তার খবর নেই পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। তবে এই মানুষগুলোর মধ্যে কয়েকজন আছে অন্য রকম। আর এই অন্য রকম মানুষ গুলো হলো তার শ্বশুরের আত্মীয় তরফের। তারা বিনা কারণেই নিশাতকে স্নেহ করছে। বাড়িতে ফিরলে আদর মাখা কন্ঠে কথা বলছে। তাদের মধ্যে থেকেই একজন হেসে বললো, — কি খবর নিশাত? ছুটি ছাটা নেবে না নাকি?
নিশাত হাসলো! হেসে এগিয়ে গেলো। এটা তার এক চাচি শাশুড়ি। যেতেই তিনি টেনে পাশে বসালেন। বসিয়ে বললেন, — কাজ তো সারা জীবন করবেই তবে কিছু কিছু সময় নিজের জন্য রাখতে হয়।
নিশাত আগের মতোই হাসলো! লামিয়ার মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, — যে চাকরি, এই নিয়ে আবার এতো ঢং। আপার কাজের লোকের বেতনও এর চেয়ে বেশি। অথচ এমন ভাবে দৌড়ে বেড়ায় যেন মহাকাশ টহাকাশ ফুঁড়ে ফেলছে।
নিশাতের খিদে পেয়েছে। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়নি। পেটে না থাকলে কি আর পিঠে সয়। তাই তাদের সামনেই নিসংকোচে হাত বাড়িতে একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিলো। নিয়ে কামড় বসাতে বসাতে বললো, — মহাকাশ ফুঁড়ি আর যাই ফুঁড়ি। অন্যের বাসায় অযথা বেগরা খাটতে যাই না।
— কে বেগরা খাটছে?
— এটা উদাহরণ ছিল খালামণি।
— কিসের উদাহরণ?
— আহা খালামণি এতো মনে লাগান কেন বলেন তো? আমি কোন ভাবেই লামিয়ার কথা বলিনি। কেন বলবো? যদি আমার কোন খালামণি অসুস্থ হতো আমি বেগরা কেন বুয়াগিরিও গিয়ে করতাম। মায়ের চেয়ে ভালা সে তো হলো গিয়ে খালা। তার বেলা কোন হিসেব নিকেশ আছে, বলেন?
লামিয়া, লামিয়ার মা আগুন চোখে তাঁকালো। নিশাত দেখে হেসে বললো, — ওমা লামিয়া দেখি। কখন এসেছো? একদম খেয়াল করিনি। সেই দিন গেলে আর তো খবরও নিলে না। তোমার ভাইয়া কত আফসোস করলো। আহারে মেয়েটা এত খেটে খুটে রান্না করলো, কিছুই মুখে তুলতে পারল না।
লামিয়ার মুখটা একটু ঝিলিক দিলো। দিয়ে বললো, — ভাইয়া এই কথা বলেছে?
— হ্যাঁ! বলবে না কেন? সেই কয়দিন মায়ের জন্য কত কষ্ট করলে। আমি বউ হয়েও কি পারলাম। বলো? তার এক বন্ধুর জন্যতো তোমার কথাও বললো? তারা নাকি এমন সংসারী মেয়ে চায়।
লামিয়ার ঝিলিক সাথে সাথেই নিভলো! সুর্বণা এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও। এবার বললো, — সেই দিনের কথা শুনে মনে পড়ল সুলতানার খবর কি? শুনলাম অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। জীবনে আর কোন কাজ ঠিক মতো করতে পারলো না।
— অ্যাক্সিডেন্ট তো আপনারও হলো।
— আমার টা হলো বলেই তো হলো।
নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো! স্যান্ডউইচ রেখে পানির গ্লাস হাতে তুলে নিলো। নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে বললো, — ছোট বেলায় আমরা একটা গল্প শুনতাম। এক শক্তিশালী দৈত্যের জান থাকে ছোট্ট একটা পাখির ভেতরে। সেই দৈত্যেকে শেষ করতে হলে পাখিকে শেষ করতে হবে। এই গল্পটার মতো আমার পাখি আমার মা। কিছু কিছু মানুষ শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে পিঠ পিছে ছুরি মারতে পারে। মেরে নিজেকে খুব উস্তাদ মনে করে। তবে আমি যা করি চোখে চোখ রেখেই করি।
সুর্বণা শান্ত চোখেই নিশাতের দিকে তাঁকালো। এই মেয়ের বুদ্ধি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না।
নিশাত পানির গ্লাস রেখে বললো, — আমার মায়ের খবরটুকু নেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ মা। আপনার দিল অনেক বড়। তা না হলে আমার মা কি আর আপনার খবর নিয়েছে। সে সত্যিই ঠিক ঠাক মতো কোন কাজ পারে না। আর আপনি যা পারেন, তা তাকে দিয়ে ইহজীবনেও হবে না। তাই আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি যে সব ভুলে এই যে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। দেখুন এই খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে।
সুর্বণা আগের মতোই শান্ত ভাবে নিশাতের চোখে চোখ রাখলো! সেখানে কৌতুক ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না।
— আপনার পাখিও সামলে রাখবেন না মা। কখন না জানি কেউ গলা টিপে ধরে বলা তো যায় না।
সুর্বণা কোন উত্তর দিলো না। সবাই তাদের দিকে তাঁকিয়ে আছে। সে পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য হাসলো। তখনি নিশাতের ফোন বাজলো। সে বের করতেই দেখলো ওয়াহিদ। অন্য সময় হলে রিসিভ করতো না। তবে এখন একগাল হেসে বললো, – আপনার ছেলে! দিনে তার কতবার ফোন দিতে হয় বলুন তো? বিরক্ত হয়ে মরি। বলেই উঠল! বেশি দূরে অবশ্য গেলো না। একটু সাইড হয়ে আহ্লাদ করে বললো, — হুম বলেন।
ওয়াহিদ কান থেকে মোবাইল নামিয়ে চেক করলো। নাম্বার ঠিক আছে তো! এতো মধুর কন্ঠ? সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, — নিশাত।
— হ্যাঁ রে বাবা, বলেন।
ওয়াহিদের এবার ভ্রু কুঁচকে গেলো। নিশ্চয়ই কোন গড়বড় আছে। সে সন্দেহের কন্ঠে বললো, — তুমি ঠিক আছো?
— আছি রে বাবা। এতো টেনশন করলে চলে। মাত্রই বাসায় ফিরলাম। কেন বলুন তো?
— সময় হবে?
— আপনার জন্য কখন আবার সময়ের অভাব হবে?
ওয়াহিদ হাল ছাড়লো! ছেড়ে বললো, — মেহুল, আমার বন্ধুর ওয়াইফ। আমাদের যাবতীয় ড্রেস সেই ডিজাইন করছে। ট্রায়ালের জন্য আমাদের একটু যেতে হবে। তাছাড়া ডিনারে ইনভাইট করেছে।
নিশাত একটু থামলো! তারপর আগের মতোই বললো, — এটা এভাবে বলার কি হলো? আমি এক্ষুনি রেডি হচ্ছি।
— শিউর।
— হ্যাঁ রে বাবা রাখেন তো। বলেই নিশাত ফোন কাঁটলো। একরাশ লজ্জা মাখা মুখে এগিয়ে বললো, — আমরা একটু বেরোবো মা।
সুর্বণা রাগে জেদে ফেটে যেতে চাইল। ওয়াহিদের চাচি কি বুঝলো কে জানে, সে তাড়া লাগিয়ে বললো, — এটা তো খুবই ভালো কথা। যাও, যাও রেডি হয়ে নাও।
নিশাত আগের মতোই হাসলো। হেসে আধা খাওয়া স্যান্ডউইচ আবার তুলে নিলো। নিয়ে খেতে খেতেই উপরে চলে গেলো।
সুর্বণা বসে রইল কাঠ হয়ে। আফসানা হক মেয়ের মুখ দেখলেন। স্বামী আছে, রাজত্ব আছে, বাহাদুরি আছে। স্বামী চোখ বুঝলেই তখন হয় বোঝা। সে বিরক্ত মুখে বললেন, — এই নোংরা মেয়েকে ওয়াহিদ নিজের ঘরে কিভাবে রাখছে আল্লাহ’ই জানে। হাত ধোয়া নেই, পা ধোয়া নেই। নেচে নেচে খেয়ে বেড়াচ্ছে।
ওয়াহিদের চাচি হেসে বললো, — আমরা যাকে ভালোবাসি তার সবকিছুকেই ভালোবাসি খালাম্মা।
— কিসের ভালোবাসা? নতুন বউ চাকের মধু। মধুর পিছে পিছে মৌমাছি তো ঘুরবেই। বছর ঘুরুক তখন ঠিক বোঝা যাবে।
ওয়াহিদের চাচি আবারো হাসলেন। তবে আর কিছু বললেন না।
—
ওয়াহিদ বাসায় ভেতরে গেলো না। মানুষের শোরগোল তার ভালো লাগে না। সে বাড়ির সামনে থেকেই নিশাতকে ফোন দিলো। নিশাত রিসিভ করলো না। তবে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠালো, “আমার সময় লাগবে। ”
কি সময় লাগবে ওয়াহিদের মাথায় এলো না। তবে কি আর করার, গাড়ি সাইড করে মোবাইলে মনোযোগ দিলো। দিলো তো দিলো, এই মেয়ের আর খবর নেই। প্রায় ঘন্টা হয়ে এলো। ওয়াহিদের ধৈর্য্যের দফারফা হয়ে সে গাড়ি থেকে নামতে গেলো। এই মেয়ে নির্ঘাৎ যাবে না। শুধু ঘোল খাওয়ানের জন্য বসিয়ে রেখেছে। তাই তো বলি এতো মধুর সুরে বলছে কেন?
তখনি দাঁরোয়ান গেইট খুললো। খুলতেই চোখ মুখ কুঁচকে নিশাত বের হলো। তার গায়ে কালো জামদানি শাড়ি। কোঁকড়ানো চুলগুলো আজ বাঁধনছাড়া। টেনে কঠিন শাসনে ঘাড়ের এক সাইডে ফেলে রেখেছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক।
ওয়াহিদ গাড়ির সিটেই শক্ত হয়ে বসে রইল। নিশাত এগিয়ে ভ্রু কুঁচকে জানালায় কয়েকটা টোকা দিলো। এই বান্দা ঘুমিয়ে গেছে নাকি? সব সময়তো তাকে দেখলেই স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে নামে। আজ কি হলো।
ওয়াহিদ রোবটের মতো ভেতর থেকেই দরজা খুলে দিলো। নিশাত বসতে বসতে বললো, — কি করছিলেন ভেতরে বসে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন নাকি? এসেছি দেখেন নি?
ওয়াহিদ চোখ তুলে সোজা নিশাতের দিকে তাঁকালো! নিশাত ভ্রু কুঁচকে বললো, — এজন্যই আসার আগে আয়তুল কুরসি পড়ে ফু দিয়ে এসেছি। পুরো শরীর বন্ধ। কারো বদ নজরে কিচ্ছু আসবে যাবে না।
ওয়াহিদ হেসে ফেললো! নিশাত বিরক্ত মুখে অন্য পাশে তাঁকালো। শাশুড়ির মাথা ঘোরানোর জন্য আয়োজন করেছে, এদিকে ছেলের মাথা ঘুরে বসে আছে।
ওয়াহিদ হেসেই ডাকলো — নিশাত।
নিশাত মুখ ফেরালো না! বাইরে তাঁকিয়েই বললো, — এতো ডেকে টেকে লাভ নেই। শাড়ি আমি আপনার জন্য পরি নি। তাই তাড়াতাড়ি রাস্তা মাপেন।
— মেহুল ভাবির বাড়িতে এখন না যাই।
নিশাত সাথে সাথেই ফিরলো! ফিরে বললো, — না যাই মানে কি? এতো কষ্ট করে রেডি হলাম। আপনার মুখের কথার দেখি কোন ঠিকঠিকানাই নেই। আবার বললেন ডিনারের জন্য বলেছে। এই আশায় আমি খাবারটা পর্যন্ত খেলাম না।
ওয়াহিদ উত্তর দিলো না। আবারো হাসলো! হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। দিতে দিতে মেহুল ভাবিকে কে ম্যাসেজ করল। ভাবি লেহেঙ্গা ক্যানসেল, রিসিপশনের জন্য শাড়ি চাই আমার। একেবারে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি।
চলবে….
#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২২
নিশাত গাড়ি থেকে নামলো ভ্রু কুঁচকেই। এই বেটার হাবভাব তার ভালো ঠেকছে না। কোথাকার ডিনারের কথা বলে কোথায় নিয়ে এলো কে জানে? তার মধ্যে কেমন কেমন করে তাঁকাচ্ছে। নজর’ই বলে দিচ্ছে গড়বড়, বিশাল গড়বড়।
সে গড়বড় গোটালা নিয়ে দাঁড়াতেই হালকা শীতল একটা বাতাস নিশাতকে ছুঁয়ে গেলো। ছুঁয়ে যেতেই নিশাত আকাশের দিকে তাঁকালো। রাতের আকাশ, মেঘ জমেছে কি না বোঝার উপায় নেই। তবে গাঢ় ঝমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝেই শহরের লুকানো ঐশ্বরিক এক সৌন্দর্য। যেই সৌন্দর্য একমাত্র সন্ধ্যা নামার পরেই দৃশ্যমান হয়। যেখানে যতদূর চোখ যায় শুধু টিমটিম করা কৃতিম আলো আর আলো।
সেই আলোর দিকে দৃষ্টি রেখেই নিশাত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। জায়গাটা একদম নিরিবিলি। মাঝে মাঝে শো করে গাড়ি দৌড়ে যাচ্ছে। সে এগিয়েই ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে নিচে উঁকি দিলো। কৃতিম আলোর প্রতিচ্ছবি নদীর পানিতে ঝিকিমিকি করছে। এই ঝিকিমিকিতে ক্ষুদ্র মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে না। উঠে বিশাল বিশাল ইট – পাথরের প্রাচীর। যেই প্রাচীর ঘিরে জোনাকিপোকার মতো টিমটিম করে জ্বলতে থাকে আলো। আর সেই জ্বলতে থাকার আলোর দিকেই নিশাত একপলকে তাঁকিয়ে রইল। দেখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে স্বপ্নে বিচরণ করছে। এই যে হাত বাড়ালেই মনে হবে জোনাকিগুলো হাতে এসে পড়বে।
ওয়াহিদও নিশাতের পাশে দাঁড়ালো! তার দৃষ্টি অবশ্য আশে পাশে কোথাও নেই। কোথায়? সেটা বলা বাহুল্য রাখে না?
নিশাত জানে! কেউ কারো দিকে তাঁকিয়ে থাকবে সেই মানুষ বুঝবেনা এটা হয় না। দৃষ্টি হচ্ছে অদৃশ্য এক তীর। এই তীর অদৃশ্য ভাবেই একজন ছুড়ে আর অদৃশ্য ভাবেই আরেকজনের গায়ে গিয়ে লাগে। আর এই খেলা এই দু’জন ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারে না।
যেমন অনুভব করছে এই যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অনেক অনেক দূরের দু’টো মানুষ। দু’টো মানুষের একজন দূর্রত্ব বাড়াতে ব্যস্ত আরেকজন কমাতে।
যেই জন ব্যস্ত কমাতে তারই গরজ বেশি। সেই গরজ থেকেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে তার শান্ত গম্ভীর কন্ঠে ডাকলো, — নিশাত।
আর নিশাত সে তো নিশাত’ই। তাই ফিরেও তাঁকালো না। এই ডাক তার প্রাচীর ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছায় না। তাই কৌতুক মাখা সুরে বললো — মুখ খুলে এতো সুন্দর সময়টা নষ্ট করতে চাইছি না। কেননা মুখ খুললে আপনার এই রোমান্টিক ওয়েদারের বারোটা বেজে যাবে।
ওয়াহিদ হাসলো! হেসে বললো, — রোমান্টিক হতে পারছি কই? বউতো মহাব্যস্ত মানুষ। জায়গা টায়গা কিনে উড়িয়ে ফেলছে।
— হিংসে হচ্ছে?
— হচ্ছে?
— কেন? আপনার টাকায়তো আর কিনছি না।
— সেটাই কিনছো না কেন?
— আমি চাই না আমার কোন কিছুতে আপনি থাকুক।
— তুমি চাও আর না চাও, আমি থাকবোই।
— দেখা যাবে মায়ের ছেলে।
ওয়াহিদ ভ্রু কুঁচকে তাঁকালো। নিশাত তখনি ফিরে তাঁকালো! তাঁকাতেই চোখে চোখ পড়ল। নিশাত অবশ্য চোখ ফিরিয়ে নিলো না। সে ফিরিয়ে নিতে জানেও না। তাই ওয়াহিদের মতোই তাঁকিয়ে রইল। পাশাপাশি দাঁড়ানো, তবুও যেটুকু দূরত্ব আছে সেইটুকুও মিটিয়ে বললো, — সব খবর থাকে আপনার কাছে তাইনা? আমি কোথায় যাই, কি করি, কোথায় কোথায় ঘুরি। সব। তবে মায়ের খবর কি রাখেন মামাস বয়?
ওয়াহিদ বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে দু’হাত পকেটে পুরে বললো, — আমি জানি আমাদের মাঝে তিক্ত একটা অতীত আছে নিশাত। যেই অতীতের সুতো ধরে মা, বা তুমি হয়ত দু’জন দুজনকে মেনে নিতে পারছো না। তবে একবার সব ভুলে ভালো থাকার চেষ্টা করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
— আপনি কিছু জানেন না। কিছুই না।
— হয়তো। তবে তুমি একটা ট্রমায় আটকে গেছো নিশাত। অনেকটা সময় পেঁরিয়ে গেছে। একবার এখান থেকে বেরোয়। দেখবে দুনিয়া কত রঙিন।
— আচ্ছা?
— হ্যাঁ।
— আর আপনার মা?
— মায়ের কথা থাক নিশাত।
নিশাত ঠোঁট টিপে হাসলো, হেসে আঙুল তুলে ওয়াহিদের গালে স্লাইড করতে গেলো। ওয়াহিদ সাথে সাথেই মুঠো করে ধরে ফেললো। শুধু মুঠো না শক্ত করে চেপে ধরলো। এতোটাই শক্ত নিশাতের চোখ মুখ কুঁচকে গেলো।
সেই কুঁচকানো চোখের দিকে তাঁকিয়ে ওয়াহিদ বললো, — আমাকে ছুঁতে হলে ভালোবাসতে হবে নিশাত।
নিশাত আগের মতোই ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বললো, — এটা কখনোই সম্ভব না।
— কেন?
— আমি আপনাদের ঘৃণা করি।
— তাহলে বিয়ে করলে কেন?
— সেটা আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
— আমি আজ’ই শুনতে চাই।
— আগেই তো বললেন, মায়ের কথা থাক। আমার সব কথায় আপনার মা, শুনতে পারবেন মামাস বয়?
— নিশাত, আমার মা তুমি, তোমরা দুজনেই ভিক্টিম। আমার মা যা করেছে বোনের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে। আর তুমি এখন যা করছো তাও তোমার বাবার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে।
নিশাত কথার আর উত্তর দিলো না। টেনে হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিয়ে সরতে গেলো। ওয়াহিদ কোমর জড়িয়ে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো।
নিশাত শান্ত, চুপচাপই রইলো। আগের মতোই বললো, — এখন ভালোবাসা লাগছে না, না?
— কেন লাগবে না? আমিতো বললাম’ই আমাকে ছুঁতে হলে ভালোবাসতে হবে। এখন তো তুমি না, আমি ছুঁইছি। আর আমার তরফ থেকে ভালোবাসার কোন কমতি নেই।
নিশাত আবারো সরতে চাইলো! ওয়াহিদ রেলিংয়ের সাথেই চেপে ধরলো। নিশাতের লাল টুকটুকে ঠোঁটের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — যদি একটা চুমু খাই, তো মাহামন্য তাসনিম নিশাত, আপনার কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?
নিশাত নিজে সব সময় সোজা সাপ্টা কথা বলে। তবে ওয়াহিদের এই সোজা কথায় সে প্রথম বার থমকালো। অবশ্য সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো। নিয়ে বললো, — তুষের আগুন চেনেন। এই আগুন সহজে নিভে না। এমন আগুনে জ্বলতে না চাইলে দূরে থাকুন।
ওয়াহিদ দূরে গেলো না। আরো এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো, — আমি জ্বলতে চাই। আমার নিশাতের সব, দুঃখ কষ্টের যতো আগুন, সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হতে চাই।
ওয়াহিদকে অবশ্য নিঃশেষ হওয়ার সুযোগ দিলো না। তার তপ্ত শ্বাসের সাথে মিশেও নিশাত হেসে ফেললো। ওয়াহিদ বড় একটা শ্বাস ফেলে নিশাত থেকে সরে এলো। এসে আর নিশাতের দিকে ফিরে তাঁকালো না। সোজা গাড়িতে গিয়ে বসলো।
তখনি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামলো। নিশাত গাড়ির দিকে গেলো না। দু- হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তার গায়ে ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগলো।
_____
হেনার গায়ে লাল, সবুজ মিলিয়ে এক কাতান শাড়ি। শাড়িটা তার না, তার বোনের! এই শাড়িটা তার এতো পছন্দের। তাই চেয়ে নিয়ে এলো। এত বড় রিসিপশন পার্টি। এমনি এমনিই যাওয়া যায়।
সে শাড়ির আঁচলে পিন মারতে মারতেই রুম থেকে বেরোলো। সুলতানা, সজল কেউই নাকি যাবে না। না যাক! তার কি? সে তো ভাই যাচ্ছে। সকাল বেলাই জামাই বাবাজি গাড়ি পাঠিয়েছে। এসি ওয়ালা বড় কালো গাড়ি। সে তো ভাই ডাট বাট নিয়েই যাবে।
তাদের বাড়ির দরজা হাট করে খোলা! সাবা হয়তো নিচে গেছে। সেই হাট করা দরজা দিয়ে দেখলো, নিশাত হেলে দুলে আসছে। তার কলিজা খাবলে উঠল। সন্ধ্যায় রিসিপশন! আর এখন এই মেয়ে বিয়ে টিয়ে ফুটবলের মতো লাথি মেরে চলে আনে নি তো। অসম্ভব কিছু না। এই মেয়ে দ্বারা সবই সম্ভব। আল্লাহ গো! রিসিপশনটা আর খাওয়া হলো না।
নিশাত তার মামিকে দেখে বললো, — এমন লাল, সবুজের পতাকা হয়ে কোথায় যাচ্ছো?
— কোথায় যাচ্ছো মানে? তুই এখানে কি করছিস সেটা বল?
— আমি তো এলাম মাকে নিতে। মা নাকি যাবে না। বললেই হলো। পুরো গুষ্টিকে যেতে হবে। সজল ভাই কই?
হেনা হাঁফ ছাড়লো। যাক বাবা বেঁচেছে। সে হাঁফ ছেড়েই বললো, — তোর মা রুমে, সজল কই জানি না।
নিশাত সাথে সাথেই ফোন দিলো। সজল রিসিভ করতেই বললো, — ডানে বামে কোন কথা না। আমার রিসিপশনে যদি না আসো। এই জীবনে আর মুখ দেখবে না।
সজল বড় একটা শ্বাস ফেলে বললো, — কেন এসব করছিস?
— বলেছিনা ডান – বাম না। সোজা বাড়িতে আসো রেডি হবে।
— এসব বন্ধ কর নিশাত।
— কি বন্ধ করবো? বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন পোলাও রোস্ট খেতে সমস্যা কি?
— রাখ তো নিশাত।
— তুমি আসবে কি না বলো?
সজল ফোন কেটে দিলো। নিশাত ভোঁতা মুখেই দেখলো সুলতানা বেরিয়ে এসেছে। নিশাত হেসে বললো, — চলো মা, সারা জীবন স্বপ্ন দেখলে মেয়ের ঘর সংসার। সেই ঘর সংসার নিজের চোখে দেখবে না?
সুলতানা বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আবার রুমে ঢুকে গেলো। সুর্বণা ভাবির সামনে তার যেতে ইচ্ছে করে না। এই মেয়ে শুনলে তো? পেটে রেখে কি জ্বালায় যে পড়লো। এমন জ্বালা দুনিয়ার আর কারো ঘাড়ে না পড়ুক।
চলবে…..