প্রাচীর পর্ব-২৩

0
235

#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৩

ওয়াহিদ মাত্রই স্টেজে বসেছে। তার সোলো ফটোশুট হচ্ছে। এর মধ্যে আসিফ দৌড়ে এলো, তার হাতে মোবাইল। এর দৌড় দেখেই ওয়াহিদ অনুমান করতে পারলো কে? এই মেয়ে নিজে থাকে শান্ত তবে বাকি সবাইকে করে রাখে অশান্ত। এই যে অভিমান করে আছে। একবার জিজ্ঞেস করেছে? একবারও না। সে তার নিজের মতো আপন ভুবনে ব্যস্ত ।

আসিফ দৌড়ে কিছু বলবে তার আগেই ওয়াহিদ মোবাইল টেনে নিলো। নিতে কানে রাখতেই নিশাত বললো, — এই শাড়ির কথা আপনি বলেছেন?

— হ্যাঁ।

— কোন চোখ দিয়ে দেখে বলেছেন? রিসিপশনে কেউ এমন লাল গাদিসা শাড়ি পরে? এখন তো বিয়ের দিনেও কেউ পরে রা। আর উনি রিসিপশনে জন্য অর্ডার দিয়ে রেখেছেন। কেন? এই না শুনলাম সিম্পল সিম্পল জিনিস পছন্দ। তো আমার বেলা এই অত্যাচার কেন?

ওয়াহিদের বলতে ইচ্ছে করলো, — তোমার লাল টুকটুকে ঠোঁট দেখে। তবে সেইদিনের রাতের কথা মনে করে আর এমন কিছুই বললো না। বললো, ইচ্ছে না হলে পরবে না। মেহুল ভাবির স্টকে কালেকশনে তো আরো থাকার কথা।

— রিসিপশনে জন্য অর্ডার দেওয়া শাড়ি এখন নাকি পরব না। আপনার মতো দুমুখো মানুষ আমি?

— আমি দু- মুখো মানুষ?

— হ্যাঁ! সেই দিন রাতে আসলে তো আর এমন কাহিনী হতো না। আমি নিজের মতো বলে দিতাম।

— তুমি এখন এসবের জন্য ফোন দিয়েছো?

— দিলে সমস্যা কি?

ওয়াহিদ চুপচাপ বসলো। বসতেই নিশাত বললো, — চুলের তো বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। এই আপনার জন্য বসে বসে এখন আমার এতো কষ্ট করতে হচ্ছে। কি দরকার ছিল এই রিসিপশনের। বিয়ে করেছো ব্যস কাজ খতম। না সারা দুনিয়াকে ঢোল পিটিয়ে দেখাও। নিজে তো রয়েছে সুট বুট পরে। বউ চাই ক্যাটরিনা,আলিয়া।

ওয়াহিদ সাথে সাথে বললো,– মেহুল ভাবির কাছে দাও। আমিতো বলেছিলাম ন্যাচারাল রাখতে। খবরদার চুলে কিছু করবে না।

— আরে বা! কষ্ট করছি আমি, আবার খবরদারও বলে আমাকে?

ওয়াহিদ হাল ছাড়লো। ছেড়ে বললো, — কতক্ষণ লাগবে, সবাই ওয়েট করছে।

— করুক। বউ দিয়ে ধুয়ে পানি খাবে? খাবে তো সেই কাচ্চি, কাবাব, রোস্ট। মাঝখান থেকে বউ নিয়ে বসিয়ে রাখা। ভালো কথা আমার মায়ের খবর কি? তাদের যদি কোন সমস্যা হয়, খবরদার তো আমি দেখাবো বলে দিলাম।

— আমি নিজে তাদের খেয়াল রাখছি নিশাত।

— রাখবেন না। আমার মা নিত্তি এসে পড়ে থাকে আপনাদের বাসায়?

ওয়াহিদ ফোন কেটে দিলো। কেটে মেহুল ভাবিকে ম্যাসেজ দিলো। “ভাবি চুলে কোন কিছু না। ন্যাচারাল ভাবে খোঁপা করতে বলো।” এই পাগল মেয়ে কি জানে তার এই ম্যাগি নুডুলসের মত চুল, ওয়াহিদের কতো ভালো লাগে।

সে আসিফকে মোবাইল দিয়ে বললো, — সুলতানা আন্টিরা কোথায়?

— ভিআইপি কর্নারে আছে স্যার।

— গুড! তুমি তাদের কাছে যাও। কোন রকম অসুবিধা যেন না হয়।

— জ্বি স্যার।

নিশাত হলে পৌঁছালো আরো ঘন্টা তিনএক পরে। নিতু, লামিয়া সহ অনেক মেয়েরাই তার সাথে ছিল। তবুও ওয়াহিদ নিজিই এগিয়ে গেলো। তার বন্ধুরা হইচই করে উঠল। শিস বাজিয়ে বললো, — তুমি তো বন্ধু শেষ।

ওয়াহিদ মনে মনে বললো, — যে বউ আমার আমি এমনিতেই শেষ।

গাড়ির দরজা খুলতেই ওয়াহিদ হাত বাড়িয়ে দিলো। ফটো, ভিডিও হচ্ছে। নিশাত ঢং করেই ওয়াহিদের হাতে হাত রাখলো, মুখে তার সেই চিরচেনা হাসি।

ওয়াহিদ এগিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে নিশাত গাড়ি থেকে বের করলো। সোজা তার পাশে দাঁড়াতেই প্রায় ফিসফিস করে বললো, — আয়না দেখেছো?

নিশাত হেসেই কোনরকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — সকাল থেকে আয়নার সামনেই বসে আছি। আলাদা করে আরো কিছু দেখার বাকি আছে?

— আশা করি বুঝে গেছো কেন লাল শাড়ি বলেছি।

নিশাত উত্তর দিলো। সাজিয়েছে পর থেকে সবার মুখে এক কথাই শুনছে। অন্য কোন রঙে এর চেয়ে বেশি মানাতোই না। আরে বাবা লাখ টাকার শাড়ি আর লাখ টাকার মেকআপে রাস্তার জরিনাকেও সুন্দর লাগবে। সে আর কোন ছাতার মাথা। সে বিরক্ত চেপেই স্টেজে গিয়ে বসলো।

তার পরই শুরু হলো আসল অত্যাচার। দুনিয়ার মানুষের সাথে হেসে হেসে দুনিয়ান ছবি তুলো। ওয়াহিদ অবশ্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। কেন চলছে নিশাত জানে। সে ভাই আগেই বলেছে, তার যত কাছে আসবে তুষের আগুনের মতো জ্বলবে। তা ভাই জ্বলো।

তখনি দু পরিবারের মানুষকে আসতে বললো। এক সাথে ছবি তুলবে। ওয়াহিদ এবারো নিজেই উঠে গিয়েই সুর্বণাকে ধীরে ধীরে নিয়ে এলো। মা তার! রাগী, জেদি যাই থাক। মা তো! আর এই মা’ই তার অর্ধেক দুনিয়া। সে জানে নিশাতকে মানতে কষ্ট হচ্ছে। একমাত্র তার সুখের জন্যই, চুপচাপ সব করছে। এইটুকুই কয়জনে করে।

আসিফ গিয়ে সুলতানাকে নিয়ে এলো। এসেছে পর থেকে বলতে গেলে ইচ্ছে করেই সুর্বণার আশে পাশে আসে নি। সুর্বনাও তার মতো ছিল। কিছু কিছু জিনিস চাইলেও ভোলা যায় না। কখনো না! তাইতো পাশাপশি দাঁড়াতেই সুলতানার চোখে পানি চলে এলো।

একটা সময় এই মানুষটা খুব কাছের ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে। বলতে গেলে দিন দুনিয়া ভালো মন্দ কোন কিছুই জ্ঞান নেই। সব তো এই মানুষটার কাছেই শেখা। তাদের যে খুব খুশি মনে গ্রহণ করেছিল এমন না। তবে খারাপ ব্যবহারও করেনি। নিশাত যখন পেটে। বাবার বাড়ির মানুষ নেই, শ্বশুর বাড়ির কেউ নেই। পাশে ছিল শুধু এই মানুষটা। সব তো সেই বুঝিয়ে দিতো, দেখিয়ে দিতো।

তবে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যতোই ভালো থাক। রক্ত আর কবুলের উপরে যায় না। তাদের টাও যাইনি। সারমিন যখন একগাদা নোংরা অভিযোগ নাজিমের নামে আনলো। তার বিশ্বাস’ই হয়নি। কেন হবে? ভালোবাসা, বিশ্বাসের মানুষ তার। তাছাড়া সারমিনের চাল চলন তেমন তার পছন্দও ছিল না। কেমন গায়ে পড়া ছিল। না সবার সাথে না। শুধু যেন নাজিমের সাথেই। দিন নেই, রাত নেই। নাজিম ভাই, নাজিম ভাই। এই নিয়ে নাজিমের সাথে তার কত নীরব অভিমান চলতো।

তবে যারা এতকিছু করেছে তাদের বোনকে কিছু বলা যায় না। চোখের কাটা হলেও না। তাছাড়া সুর্বণার এই বোন সুর্বণার জান । মা বেশি ভাগ সময় অসুস্থের কারণে বলতে গেলে নিজেই সন্তানের মতোই মানুষ করেছে। সারমিনের সব আবদার, আহ্লাদ, রাগ, জেদ সব কিছুই ছিল তার আপা।

তাই যখন এই অভিযোগ আঙুল নাজিমের দিকে তাক করা হলো। সেই দিন প্রথম সে সুর্বণার মুখের উপরে কথা বললো। যেই আঙুল তার স্বামী দিকে তাক করা হয়েছিল, সেই আঙুল সে নিজেও তার বোনের দিকে তুলেছিল। আর তার স্বামী নির্দোষ এই বলে শক্ত করে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

সুর্বণা স্তব্দ হয়ে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে ছিল। তারপর আর তার মুখোমুখি হয়নি। কখনোও না। এর মধ্যে সারমিন আত্মহত্যা করলো। দুতালা বাড়ি। সুর্বণা নিজে পছন্দ করে এই বাড়িতে উঠেছিল। তার বারান্দা পছন্দ তাই তারা উপরে আর সুলতানারা নিচে।

এতো বছরের সম্পর্ক শুনে সুলতানা থাকতে পারেনি। দৌড়ো গেলো। সেই দিন সুলতানা আসল সুর্বণা কে দেখলো। ভয়ংকর সুর্বণা। তারপরেই শুরু হলো সুলতানার জীবনে ঝড়। সন্ধ্যায় এসে নাজিমকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো। সে কার কাছে যাবে দিশে পায় না। এই বিশাল শহরে এই সুর্বণাদের ছাড়া তো সে কাউকে চেনে না। আট মাসের পেট! এটা নিয়েই এখানে দৌড়ায়, ওখানে দৌড়ায়। সে অল্প শিক্ষিত দুনিয়া দারি না চেনা মানুষ। কোন কূল কিনার ঠাই পায় না। তার মধ্যে শুরু নতুন উৎপাত। সুর্বণা টাকা পয়সা ব্যবসা সব গুটিয়ে ফেললো। নাজিম নাকি আলাদা ব্যবসার জন্য লোন টোন নিয়েছিল। তারাও এসে হাজির। টাকা পয়সা কি আছে না আছে সুলতানা কিছুই জানে না। জানার প্রয়োজনতো কখনো পরেও নি। তার সব দায়িত্ব নিয়েছিল নাজিম। নাজিতো নিজেকে ছাড়া আর কোন দুনিয়া চেনায়নি। সে শুধু চিনতো এক নাজিম আর এই যে সুর্বণা নামের ভয়ংকর এক মানুষকে। যে তার অহমের জন্য সব করতে পারে।

নিশাত স্কুলে যেতে পারে না, এলাকায় বের হওয়া যায় না। বের হলেই টিটকারি শুরু হয়। কোথা থেকে একদল ছেলে জুটে গেলো কে জানে। তাদের নোংরা কথা, ইশারা, গান, ঢিল একটার পা একটা অত্যাচারে ঘরে টেকা যায় না। তারা তার এগারো বছরের বাচ্চা মেয়েটা কেও ছাড়ে না। একদিন দোকানে গেছে। সাদা জামার পেছনে লাল রং ছুড়ে মারলো। নিজেরা মেরে নিজেই কি অসভ্য নোংরা ইঙ্গিত। আরেকদিন তো টেনে ফ্রকের হাতা’ই ছিঁড়ে দিলো। মেয়ে ভয়ে দৌড়! আর বের’ই হতে চায় না। আর এই সব কিছু শুধু দুশ্চরিত্র স্বামীর হাত ধরেছি বলে। ধরেছি বলেই পুরো দুনিয়া তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিলো নর্দমায়। স্বামীর দোষ যে মেয়ে দেখেও দেখেনা। তার মতো মেয়ের জন্যই তো এমন ঘটনা ঘটে। এদেরও সমান শাস্তি দেওয়া দরকার। তাই তার শাস্তি চলতে লাগলো ভালো করেই।

এই চলাম শাস্তির মাঝেই গহনা টহনা যা ছিল সব বিক্রি করলো। করে অনেক কষ্টে নাজিমের সাথে একবার দেখা করার সুযোগ হলো। আহা! নাজিমকে চেনা যায় না। কি পরিমাণ অত্যাচার তার উপর দিয়ে গেছে। সেটা মুখে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুলতানার ভেতর ভেঙে গুড়ো গুড়ো হলো।

এই গুড়ো গুড়োর মাঝে নাজিম পাথরের মতো মুখ করে বললো, — সারমিন যা বলেছে সত্য। আমরা বিয়ে করেছিলাম। তার গর্ভে আমার’ই সন্তান ছিল। তার মৃত্যুর জন্য আমি’ই দায়ী। এখানে আর এসো না সুলতানা। যাও বাড়ি যাও।

সুলতানা স্তব্দ হয়েই তাঁকিয়ে রইল। তার তাঁকানোর মাঝেই নাজিম চলে গেলো। যেতে যেতেও আরেক বার ফিরে তাঁকালো। সেই তাঁকানোই শেষ।

কি ভাবে বাড়িতে এলো সে জানে না। কি ভাবে সময় গরালো তাও জানে না। টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই। এই যে এই বিশাল দুনিয়া। এখানে তাদের কেউ নেই। যার হাত ধরে পুরো দুনিয়া ফেলে চলে এসেছিল, সেও নেই। এত বড় ধোকা কোন মেয়ের সাথে না হোক। না হোক কোন মেয়ে তার মতো প্রেমে অন্ধ।

তখনি তার দুনিয়া দুলে উঠল। তারপর অসহ্য এক যন্ত্রনা। নিভু নিভু চোখে দেখলো। তার মেয়ে। আহা! এই যে হাসি হাসি মুখে বউ সেজে বসে থাকা, এই মেয়ে কাঁদছে। পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে। কখনো ঘর, কখনো রাস্তা, কখনো এই যে সুর্বণা নামের মানুষটা, এর ঘরের দরজায়। বৃষ্টির ঝিম ঝিম শব্দ আর অসহ্য ব্যথার মাঝেও তার কানে বাজে, — আন্টি! দরজা খুলো আন্টি। মা মরে যাচ্ছে।

কেউ আসে না, কেউ না। তাদের যে কেউ নেই। এই পৃথিবীতে তারা, একা! একদম একা। আর এই একা পৃথিবীতে তার আরেকজন সন্তান এই পৃথিবীতে আলো বাতাসে গা ভাসানোর আগেই অভিমান করে ফিরে গেলো। তার সাথে গেলো নাজিমও। সেই দিন রাতে সেও আত্মহত্যা করেছিল।

চলবে…..