#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৫ (শেষ পর্ব)
সুলতানা এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে। তার শরীর কাঁপছে। সাবার হাত ধরেই তিনি নিশাতকে খুঁজলেন। মেয়ে কে দেখলেন তিনি একেবারে কর্নারে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এতো মানুষকে সরিয়ে তিনি নিশাতের কাছে পৌঁছুতে পারলেন না। তবে দাঁড়ালের একেবারে সোজা নিশাতের বরাবর। সে দাঁড়াতেই নিশাত তার দিকে তাকালো।
সে অসহায় ভাবে মেয়ের দিকে তাঁকালেন। তাঁকিয়েই দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করলেন। ধ্বংসের খেলায় নেমেছে তার মেয়ে। কি দিয়ে টেনে ধরবেন তিনি বুঝতে পারেন না। এই মেয়ে না ভালোবাসার দোহাই মানে না মানে মৃত্যুর। সে চলে তার মতো। সুর্বণা সারা দুনিয়ার মাঝে তাদের খারাপ বানিয়েছে, এখন সে সুর্বণাকে বানাবে। সুর্বণা তার জীবন থেকে তার প্রিয় বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, সে নেবে সুর্বণার প্রিয় দুই সন্তানকে। আজ থেকে তারা সুর্বণার নামকে ঘৃণা করবে। তাদের যেমন কেউ ছিল না। সুর্বণার ও কেউ থাকবে না। সে তো চায়না এমন কোন ধ্বংস। তাহলে সুর্বণা আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কি? সে জানে আজ সুর্বণার সত্য বের হলে তার দু’সন্তানের যে পরিণতি হয়েছে সুর্বণার দু’সন্তানেরও হবে। নিতু শুধু মাকে ঘৃণা করলেও ওয়াহিদ মরে যাবে। রাগ জেদ যত থাক ভেতরটা তো কায়সার ভাইয়ের মতো। সে তো পারবে না কোন সন্তানের এমন পরিণতি মেনে নিতে। শ্বাস নেওয়াই কি শুধু বেঁচে থাকা। না! এই যে তার মেয়ে, সে কি বেঁচে আছে? সে তো পারবে না সুর্বণার মতো হতে। সে তো পারবে না কারো ক্ষতি করে হাসতে, শান্তিতে থাকতে, ভাতের দানা গলা দিয়ে নামাতে। সুর্বণা তার বোনের ভালোবাসায় অন্ধ হতে পারে, বিবেক হারাতে পারে। সে তো পারে না। আর না দেবে তার মেয়েকে। তার মেয়ে হবে তাদের’ই মতো শুভ্র।
তিনি আশে পাশে সজলকে খুঁজলেন। সজল কই? কাকে বলবেন তিনি? তার মাথা আবার ঘুরতে লাগলো। কি করবে সে? কি করে এই ধ্বংস থামাবে। এত মানুষের মাঝে তিনি সজলকে পেলেন না। তবে আফসানা হককে পেলেন। পেয়ে এগিয়ে গেলেন।
নিশাত তার মায়ের হাবভাব সবই দেখলো। তবে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে ওয়াহিদের দিকে তাঁকালো। তার বাবাকে ভালোবাসা, বিশ্বাসের মূল্য যদি তাদের চুকাতে হয়, তাহলে এরা বাদ যাবে কেন? তারাও চুকাবে! যেই দিন এই ঘৃণার ধারদেনা শোধবোধ হবে। প্রমিস করছি ওয়াহিদ, সেই দিন আমাদের সন্ধি ঠিক হবে।
তখনি ওয়াহিদ নিশাতের দিকে তাঁকালো। নিশাত সব সময়ের মতো তাঁকিয়েই রইল। ওয়াহিদ নিশাতের চোখের ভাষা বোঝে না।
আসিফ এগিয়ে এসে বললো, — মাহফুজ স্যারকে এই লোক’ই ধাক্কা দিয়েছে। দিয়ে একবার দরজা লক করেছে, তার একটু পরেই আবার দরজা খুলেছে। মাহফুজ স্যার ভেতরে ছিল বড়জোর এক মিনিট। এই এক মিনিটের মাথায়’ই নিতু আপারা সেখানে গেছেন।
মাহফুজ বড় একটা শ্বাস ফেললো! আল্লাহ! তোমার দরবারে হাজারবার শুকরিয়া। নিতু ফঁপিয়ে উঠল। মাহফুজ ফিরেও তাঁকালো না। সে হনহন করে হল থেকে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে গেলো মাহফুজ দের বাড়ির সবাইও।
ওয়াহিদ চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শ্বাস ফেললো! নিজেকে শান্ত করে সোজা দাঁড়ালো। দু-হাত পকেটে পুরে শান্ত ভাবে বললো, — আমি একবার জিজ্ঞেস করবো। উত্তর এই একবার’ই আমার চাই। আমার ওয়াইফ, আমার বোনের হাসবেন্ড নির্দোষ সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। তাই তোর বাঁচা মরায় আমার কিছু আসবে যাবে না। তাই যদি বাঁচতে চাস, মুখ একবারেই খুলবি।
লোকটা এতক্ষণ ভয় পেলেও এবার সোজা দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই আশে পাশে থেকে আরো দু’ তিনজন তার পাশে এসে দাঁড়ালো। একজনের দিকে তাঁকিয়ে সুর্বণা হতম্ভব হয়ে গেলো। এদের সে চেনে, এখন না অনেক আগে থেকে। তখন এদের বয়স অল্প ছিল। এদের’ই সুলতানাদের পেছনে লাগিয়েছিল। এখন টাকার বিনিময়ে এরা সব করে। সুলতানার অ্যাক্সিডেন্টও সে এদের লোক দিয়ে করিয়েছে । টাকা, টাকার জন্য এরা সব করতে পারে। টাকার জন্য তার কাজ করেছে, এখন করছে বলেই সে নিশাতের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই তার কাছে সব ক্লিয়ার হয়ে গেল। মাকড়সার জালের মতো এই মেয়ে ধীরে ধীরে ফাঁদ তৈরি করেছে। আর সে বুঝতেই পারেনি। এখন এই লোকেরা সুর্বণা নাম নিবে অনায়াসেই, এটা করেছে কি না প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন’ই নেই। তারা প্রমাণ দেখাবে আগের কাজের। আর দিলে কেউ দেখতে আসবে না, এই ঘটনা কে ঘটিয়েছে।
সে ধপ করে নিচে বসে পড়লো। তার ছেলে, মেয়ে কখনো আর তার মুখ দেখবে না। এই যে তার এতো আত্মীয়- স্বজন কেউ আর তার দিকে সম্মান তো ভালোই ফিরেও তাঁকাবে না। আর এই যে কত মানুষ, সবাই সুর্বণার নাম নেবে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে। শেষ, সব শেষ।
সবাই তার দিকে ফিরে তাকালো। ওয়াহিদ দেখেই সাথে সাথেই এগিয়ে গিয়ে মাকে ধরলো। সুর্বণা কেঁদে ওয়াহিদের বুকে মাথা রাখলো। রেখে বললো, — আমি তোর সাথে একা কথা বলতে চাই ওয়াহিদ।
— এখন না মা পরে।
— গেইট খুলতে বল। সব বিদায় কর। আমি তোকে সব বলছি।
— না মা পরে! বলেই লোকটার দিকে তাকালো। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। কিছু বলবে তখন আফসানা হক এগিয়ে এসে বললেন, — এই লোকদের যেতে দাও ওয়াহিদ। আমি সব ক্লিয়ার করছি।
ওয়াহিদ আগের মতোই বললো, — না।
আফসানা হক বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আসিফের দিকে তাকালো। তাকিয়ে একটা চাবি বাড়িয়ে বললো, — আমার বাসায় যাও আসিফ। আমার লকারে কাঠের একটা বাক্স আছে সেটা নিয়ে এসো।
আসিফ ওয়াহিদের দিকে তাকালো। ওয়াহিদ মাথা নাড়তেই চাবি নিয়ে দৌড়ে গেলো। যেতেই আফসানা হক চেয়ার টেনে বসলেন। বসে ওয়াহিদের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, — যা হয়েছে, যা হচ্ছে, সব আমি করেছি।
পুরো হল রুম এই এক বাক্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো। স্তব্ধ হলো সুর্বণাও। ওয়াহিদের চোখ, মুখ সাথে সাথেই কঠিন হয়ে গেল। আর এই সবার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিশাত হেসে ফেললো।
সেই হাসির দিকে আফসানা হক তাকিয়ে রইলেন। আজকে অবশ্য এই তাকানোর মাঝে রাগ, ঘৃণা, আগুন কিছুই নেই। সে শুধু দেখলো লাল শাড়ি পরা শত মানুষের মাঝে অন্য রকম একটা মেয়েকে। যেই মেয়েটা তাদের সম্মানের জন্য একাই ঢাল, তলোয়ার, সৈন্য হয়ে যুদ্ধের ময়দানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আবারো বড় একটা শ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে বললেন, — আমার বাকি যা বলার আসিফ এলে বলবো।
আসিফ এলো সেই কাঠের বাক্সটা নিয়ে। আফসানা হক সেখান থেকে মলিন একটা কাগজ বের করে আসিফকে দিয়ে বললেন, — এটা সবার সামনে পড়।
আসিফ একবার ওয়াহিদের দিকে তাকালো। ওয়াহিদ চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। তার কাছে থেকে অনুমতি আশা করা যায় না। তাই আর অনুমতির অপেক্ষা করলোও না। পড়া শুরু করলো।
“সুলতানা,
জানি না এই চিঠি তোমার হাতে যাবে কি না। না যাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তবুও কেন লিখছি আমি জানি না। তবে কখনও যদি যায় তখন আমি হবো অন্য জগতের বাসিন্দা। এই জগতের বাসিন্দা হওয়ার ইচ্ছে ছিল তৃপ্তি নিয়ে, শান্তি নিয়ে। তোমার হাত ধরে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, নিশাতের একটা সুখের সংসার দেখে, আমার অনাগত সন্তানের সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দেখে। তবে আল্লাহ্ তা আমার কপালে লিখে নি। তবে আফসোস কি জানো? এই জগতের বাসিন্দা হলাম তোমার চোখে, হৃদয়ে অসীম ঘৃণা পাহাড় তৈরি করে। আমার জীবনে সবচেয়ে শুভ্রতম নারী হলো তুমি সুলতানা। যে দুনিয়া বুঝে না, প্যাচ বুঝেনা, মন্দ বুঝেনা, শুধু বুঝে ভালোবাসা। আর যার পুরো ভালোবাসার সত্ত্বা জুড়ে আমি। সেই আমিকে আমার সুলতানার চোখে তৈরি করলাম ঘৃণা হিসেবে। কি করে মানি বলতো? মৃত্যু আমার তখনি হয়েছে, যখন এই মুখ দিয়ে তোমার মনে ঘৃণার বিজ বুনেছি। তাই এখন শুধু বের হবে দেহ থেকে এই রুহ্টা । এটার জন্য আমার কোন আফসোস নেই। তবে বিশ্বাস করো, আমি বাধ্য ছিলাম। যদি না বলতাম, বাসায় ফিরে তুমি নিশাতকে পেতে না।
সারমিনকে আমি কখনো অন্য চোখে দেখিনি। এক সাথে দু ‘ফ্যামিলি উঠা বসা। একসাথে হেসেছি, দুষ্টামি করেছি, কত কত স্মৃতি আমাদের। এই স্মৃতিতে সে কখনোও আলাদা কেউ ছিল না। তবে তার কাছে আমি হয়ে গিয়েছিলাম বিশেষ একজন। সে হাব ভাবে বোঝাতো, আমি অনায়াসেই পাশ কাটিয়ে যেতাম, দূরত্ব মেপে চলতাম। তুমি মাঝে মাঝে খুব অভিমান করতে, এই বাড়ি ছাড়তে বলতে, আমি তোমাকেও বোঝাতাম। না বুঝিয়ে উপায় কি? ব্যবসা শেয়ারে হলেও, টাকা পয়সা তো সব কায়সার ভাইয়ের। আমি তো শুধু খেটে দাঁড় করাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম আর কয়েকটা বছর গুছিয়ে তারপর চলে যাবো।
আর এই চলার মাঝেই তার পাগলামি বাড়তেই লাগলো। কত দিন গেছে, তুমি নিশাতকে নিয়ে স্কুলে গেছো, সে এসে হাজির। আমাকে তার চাই, যে কোন ভাবেই তার চাই। সে দ্বিতীয় বউ হয়েও থাকতে রাজি। তাও তার চাই।
আমি ফেরাই, বার বার ফেরাই। শেষমেষ বিরক্ত হয়েই একদিন চড় বসিয়ে দিলাম। সেই চড়ে তার পাগলামি জেদে পরিণিত হলো। তবে আর সে আসে নি। সুর্বণার বোন সে। সুর্বণা গায়ে যতো রাগ, জেদ তার গায়েও ততটাই।
তাই এই নোংরা চাল চাললো । সুর্বণা ভাবির ভালোবাসাকে বানালো হাতিয়ার। ভেবেছে এই সব বললেই আমাদের সংসার শেষ। সংসার শেষ, আমি তার। তবে তুমি শক্ত করে আমার হাত ধরলে আর তার চাল তার উপরেই পড়ল। সে ভালো করেই জানতো এই সম্পর্ক প্রমাণ করতে হলে, প্রেগন্যান্সির প্রমাণ দরকার। যেটা তার কাছে নেই। একতো এই বদনাম, আবার যদি বের হয় মিথ্যা। মুখ দেখাবে কি করে। নিজের তৈরি ফাঁদে নিজেই আটকে গেলো। আটকেই আর কোন রাস্তা না পেয়ে জীবন দিয়ে দিলো।
মাঝখান থেকে আমি ফেসে গেছি সুলতানা। ভেবেছিলাম পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এলেই আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো। তবে রিপোর্ট ঘুরে গেছে। কিভাবে গেছে আমি জানি না। তাই সুর্বণা ভাবির সাথে অন্তত একবার কথা বলতে চেয়েছিলাম। শুধু যে সারমিন তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তা না। করছে অন্য কেউ। সে জানে না। বোনের ভালোবাসায় এতোটাই অন্ধ হয়েছে সে। তার কাছে এখন সত্য মিথ্যা কিছুই নেই। তার বোন মরেছে, এখন বাকি সবাই মরবে।
ভালো থেকো সুলতানা! আমার দু- সন্তানকে আগলে রেখো। তাদের বলো, ” তাদের বাবা নির্দোষ! তার এতো সুন্দর দুনিয়া থাকতে সে সুখ খুঁজতে যাবে কোন দুনিয়ায়। ”
সুর্বণা হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। সুলতানা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। সে ধ্বংস থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু এই খেলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। তার মেয়ে তো শেষ করতে নেমেছে।
ওয়াহিদ চোখ তুলে তাঁকালো নিশাতের দিকে। নিশাত দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই চুপচাপ। তবে তার চোখ থেকে গাল বেয়ে মুক্তো দানার মতো বৃষ্টির ফোঁটার মত টিপটিপ করে পানি ঝড়ে পড়ছে।
আসিফ থামতেই আফসানা হক বললেন, — পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট আমি ঘুরিয়েছিলাম। আমার মেয়ের জীবন গেছে, সম্মান আমি যেতে দেই কি করে। তাছাড়া আমার কাছে আমার মেয়ের খুনি এরাই। আমার মেয়ে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে আর তারা সুখের সংসার করবে? আমি তা দেখবো কি করে। তাই এক মেয়ের জন্য চাবি দিয়েছি আরেক মেয়ে পুতুলের মতো সব করেছে। তবে মেয়ে তো দু’টোই। একটা চোখের সামনে মরতে দেখেছি, আরেকটাকে দেখি কি করে? তাই আজকে কাহিনী সেটা কে করেছে তা না হয় থাক। তবে যেই সত্যের জন্য এতো কিছু তা আজ সবার সামনে। দাও যা শাস্তি দেওয়ার দাও। মায়ের মন তো দুনিয়ার যুক্তির কাছে খাঁটে না। যা করার করো। বলেই তিনি উঠলেন। ধীরে ধীরে হল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সুর্বণা কাতর ভাবে একবার সুলতানা, একবার নিশাতের দিকে তাঁকালো। কি করেছে সে? আল্লাহ! সে কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়াহিদের হাত জাপটে ধরে বললো, — ওয়াহিদ আমাকে ওদের কাছে নিয়ে যা। জানি ক্ষমা নেই, তবুও পা ধরে মাফ চাইবো। তা না হলে আমি বেঁচে থাকবো কি করে?
ওয়াহিদ এগিয়ে গেলো না। সে তাঁকিয়ে আছে নিশাতের দিকে। নিশাত একবারও ফিরে তাকালো না। সে এগিয়ে গেলো তার মায়ের দিকে।
________
সুর্বণা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো ভোর রাতে। ব্রেইন স্ট্রোক করলো। সবাই রাতেই ধরাধরি করে হসপিটালে নিলো। তার জ্ঞান আর ফিরেনি। আফসানা হক মেয়েকে বাঁচাতে যেই সত্যের পর্দা টেনে সরালো। সেই পর্দা’ই সুর্বণার গলার ফাঁস হলো। অনুতপ্তের আগুনের চেয়ে বড় আগুন কি আর দুনিয়াতে আছে।
আফসানা হক এক মেয়ের লাশ বুকে আগলে দাফন করেছেন তবে এই মেয়ের মুখও দেখতে পারলেন না। ওয়াহিদ, নিতু কেউ’ই তাদের মায়ের লাশের আশে পাশে ঘেঁষতে তো দূরের কথা, বাড়ির ত্রিসীমানায় ও যেন না আসে সেই ব্যবস্থা করলেন।
আফসানা হকের দিন যায় এক রুমের চার দেয়ালের ভেতরে। সেখানে তিনি কিছুক্ষণ গুনগুন করে কাঁদেন, কিছুক্ষণ একা একাই বিলাপ পারেন, আবার দেখা যায় এক একাই কথা বলছেন। কখনো সারমিনকে ডাকেন আবার কখনো ডাকেন সুর্বণাকে।
নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। দিনের মতো দিন যায়। বিছানায় পরে কাতরায়। পিঠে ঘা হয়, ঘাতে পোকা হয়। তবুও জান পাখি উড়াল দেয় না। রাত বারে, ভেসে আসে গুনগুন করে তার কান্নার সুর। তবুও আজরাইল ফিরে তাঁকায় না।
নিশাত ঘাসের মধ্যে পা ভাজ করে বসলো। বাতাসে কি মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। নিশ্বাস নিলেই মনে হয় মনের যতো তৃষ্ণা, সব মিলিয়ে যায়।
সজল দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক সামনে। তার হাত কোমরে। কোমরে রেখেই চোখ মুখ কুঁচকে আশপাশ দেখছে। দেখতে দেখতেই বললো, — জায়গা আরেকটু শহরের কাছাকাছি হলে ভালো ছিল। একটু দূর হয়ে গেলো না।
— উঁহু! একদম পার্ফেক্ট। তাছাড়া শহরে এত জায়গা কোথায়?
— তা ঠিক। বলেই নিশাতের পাশে বসলো। বসে বললো, — এখন, এখন প্ল্যান কি?
নিশাত এক দৃষ্টিতে পুরো জায়গায় চোখ বুলালো। বুলিয়ে বললো, — কোন বিল্ডিং তুলবো না, বুঝেছো সজল ভাই। পুরো দেয়াল ঘেরা হবে, হাফ বিল্ডিং করবো। উপরে থাকবে টিনোর চাল। বড় বড় টানা বারান্দা রাখবো। উঠান থাকবে, পুকুর থাকবে, বাগান থাকবে, খামার থাকবে। আর এগুলো কে দেখাশোনা করবে জানো?
সজল নিশাতের দিকে তাকালো। নিশাত অবশ্য তাকালো না। তার দৃষ্টি এখনো সামনে। যেন সব কিছু এক্ষুনি চোখের সামনে ভাসছে। সেই স্বপ্নের দিকে চোখ রেখেই নিশাত বললো, — এই দুনিয়ার যেই নারীদের কেউ নেই তারা। যাদের একটা ভালোবাসার সংসার নেই, নেই মাথা গোজার মতো একটা বাবার বাড়ি , নেই মাথার উপরে কোন আত্মীয়ের ছায়া। তাদের নিয়ে আমি আমার মা থাকবো এই বাড়িতে। আমার মায়ের খুব সখ। আমার সংসার দেখা। তাই আমি আমার সংসার গোছাবো আমার স্বপ্নের রংয়ে।
সজল হাসলো! হেসে বললো, — কাজে হাত দিচ্ছিস কবে?
— এই সপ্তাহ থেকেই, তুমি কিন্তু থাকবে।
সজল নিশাতের মাথায় চাটি মারলো। মেরে বললো, — এটা বলতে হয় নাকি। আমি না থাকলে কে থাকবে?
নিশাত মাথা ঘষলো। ঘষতে ঘষতে বললো, — এত জোরে মারে?
সজল হাসলো! হেসে উঠতে উঠতে বললো, — চল! সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাবা মাল আনতে যাবে আমাকে দোকানে বসতে হবে।
নিশাত উঠলো! উঠতে বললো, — বিয়ে করছো কবে? মামি সেইদিনও বললো।
— করবো! আরেকটু গুছিয়ে নিই।
— সত্যি তো।
— একদম।
নিশাত হাসলো! সজল সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। নিশাতের মুখের সাথে চোখও ঝিলমিল করছে। সে চোখ ফিরিয়ে বললো, – অন্য কোন কাজ আছে।
— হ্যা! একটু বিহারী কলোনিতে যাবো।
— কোন সমস্যা?
— আরে না! ঐ যে আফিয়া মেয়েটার কথা বলেছিলাম না। তার তো আট মাস শেষের দিকে। এখন এতদূরে আসতে পারে না। টাকা বাবা এসে নিয়ে যায়। তাই ভাবলাম একটু দেখে আছি।
— রিকশায় তুলে দেবো।
— লাগবে না। তুমি যাও।
সজল চলে গেলো। নিশাত ধীরে ধীরে এগুলো। সন্ধ্যার নির্জন প্রহর। তার মধ্যে জায়গাটা শহর থেকে একটু ভেতরে। দু’ পাশে সারিবদ্ধ গাছ। সে সবুজ গাছ ঘেরা পথে হাঁটছে হাঁটতেই নিশাত থমকে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরলো।
কালো রঙের একটা গাড়ি। এখনো সব খবর তার কাছে থাকে। কোথায় যায় না যায়। সে ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেলো। ওয়াহিদ সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি কোথায়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নিশাত দরজায় হাত রেখে বললো, — উঁহু! আমি যাবো না। ঐ যে, ঐ জায়গাটা দেখছেন, সেখানে আমাদের মা মেয়ের সংসার হবে। একজন কর্তা দরকার। যদি ইচ্ছে থাকে চলে আসবেন। এবার আমি রাঁধবো, সেবা করবো, বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। চাঁদনি রাতে গুনগুন করে গান শোনাবো। আসবেন?
ওয়াহিদ কিছু বললো না তবে গাড়ির ভেতর থেকেই হাত বাড়িয়ে দিলো। নিশাত হাসলো! সাবার ভাষায় রোবটিক হাসি না। সকালের সোনালি রোদের মতো ঝিলমিল করা হাসি।
#সমাপ্ত