প্রাণনাশিনী পর্ব-০৪

0
2

#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_০৪
#সুহাসিনি_মিমি

বুকজুড়ে একরাশ বিস্ময় চোখে অনাগত কৌতূহলের দীপ্তি নিয়ে সুবহা ধীরে ধীরে খাটের উপরে রাখা শপিং ব্যাগগুলো একে একে খুলতে লাগল। মনস্থির ভাবনায় ডুবে থাকা মেয়েটির বিস্ময় যেন আরও বাড়ল ব্যাগগুলোর ভিতরে রাখা জিনিসপত্র দেখতে না দেখতেই। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল এক সাথে।

পরপর সব গুলো ব্যাগ একত্রে খুলে ভিতরে থাকা জিনিস গুলো হাতে নিয়ে পরখ করে বার কয়েক বার। যেখানে মূলত বড় বড় ওড়নার ন্যায় স্কার্ফ আর বোরকা ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ছে নাহ তার। একে একে গুনে গুনে ৫ টা বোরকা সাথে এক ডজন হিজাব এর ন্যায় ওড়না খুঁজে পায় সুবহা। তার ভাই তার জন্য বোরকা আর ওড়না কিনে এনেছে কেন? সেতো বলেনি তার ভাইকে এসব কিনে দিতে! ভাইকে তো দূর! বাবাকেই তো বলেনি সুবহা। তাহলে তার ভাই জানলো কিভাবে এসব তার লাগবে? সুবহা বোরকা গুলো নিয়ে খাটের সাথে থাকা ড্রেসিং টেবিল টার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। খুঁজে খুঁজে একটা জাম রঙা বোরকা উপর থেকে শরীরের সাথে মেলে ধরে সাইজ মাপলো সে। নাহ! পুরো সাইজ মতোই তো আছে। যদিও সুবহা বোরকা পড়েনা তারপরও কাপড় গুলো দেখে বেশ দামি দামিই মনে হচ্ছে তার কাছে। কপালে মোটামুটি ভাজ পড়েছে সুবহার। যে পর্যন্ত ভাইয়ের কাছ থেকে না শুনবে ততক্ষন পর্যন্ত যে সস্থির নিঃশাস ফেলতে পারবে না তার ছোট্ট ছটফটা মনটা। খাটের উপর বসে পা দুটো লাগাতার নাড়াতে লাগল। ডান হাতের আঙ্গুল মুখে পুড়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে থাকলো গতকাল থেকে শুরু হওয়া আজ সকাল পর্যন্ত ঘটা সমস্ত ঘটনা। লোকটা তাকে বোরকা আর হিজাবের কথাই তো বলেছিলো সকালে! তাহলে কি শ্রেয়ান ভাই সে কথা কারো কাছ থেকে শুনতে পেয়েই বোরকা আর হিজাব কিনে এনে দিয়েছে তাকে? কিন্তু শ্রেয়ান ভাইতো গতকাল বিকেলেই তার মায়ের কাছ থেকে বকুনি খেয়ে টাকা নিয়ে গেলো। মা কত বকলো তাকে সেই নিয়ে! তাহলে এতো টাকা পেল কোথায় হঠাৎ করে তার ভাই?

প্রশ্নের পর প্রশ্ন জড়ো হতে থাকে সুবহার অবুঝ মনে। উত্তরহীন সেইসব প্রশ্ন একেকটা যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে যেতে থাকে বুকে। যতক্ষণ না নিজ ভাইয়ের মুখ থেকে সম্পূর্ণ টা না শুনবে ততক্ষণ পর্যন্ত মনটা যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবে না তার!

সুবহার চিন্তার দেয়ালে ছেদ পড়ে হঠাৎ করেই দরজায় টোকার শব্দে। পায়ের দোল থেমে যায় মুহূর্তে। চমকে উঠে পা দুটো মাটিতে ফেলে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। নিঃশব্দে কপাট খুলতেই সামনে ভেসে ওঠে শ্রেয়ানের মুখ। ভাইকে দেখে যেন বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা উৎকণ্ঠার পাহাড়টা খানিকটা গলে উঠে তার। ছটফটে মনটা পায় একরাশ প্রশান্তি। সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দেয় ভাইয়ের জন্য।

শ্রেয়ান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢোকে। চোখ পড়ে খাটের উপরে ছড়িয়ে থাকা বোরকা আর হিজাবের স্তূপের দিকে। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে তাকিয়ে থাকে সেখানটায়। সেসব দেখে চোখে খানিক বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। তারপর ধীরে সুস্থে বোনের দিকে তাকিয়ে সোজা কথা বলে বসে,

–কাল থেকে স্কুলে এইগুলা পরে যাবি।

সুবহা এক মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ থেকে যায়।যেন এমন কথা সে একেবারেই আশা করেনি তার ভাইয়ের মুখ থেকে। চোখে প্রশ্নের ঝিলিক নিয়ে অকপটে বলে উঠলো,

–এইসব তুমি এনেছো ভাইয়া?

–নিচে বলছিলাম, শুনস নাই বুঝি? যেহেতু বলছি আমি এনেছি, তার মানে তো আমিই এনেছি।”

–কিন্তু আমি তো বোরকা পড়িনা ভাইয়া। হঠাৎ তুমি এসব আনলে যে?

শ্রেয়ান এবার একটু গম্ভীর গলায় বলে,

–পরিস নাই, পড়বি। সমস্যা কী তাতে? গ্রামের পরিস্থিতি দেখতেছোস না? এখন থেইকা বাইরে যাইবি সবসময় বোরকা পইরা। বুঝছোস?”

সুবহা দ্বিধায় ভরা কণ্ঠে নিচু স্বরে বলে,

— কিন্তু আম্মা তো কিছু বলেনি। এভাবে হঠাৎ বোরকা পরতে দেখলে যদি আম্মা বকে?

–বোরকা পরা ভালো জিনিস। আম্মা কিছু বলব না। বরং খুশি হইবো। তুই কাল থেইকা স্কুলে বোরকা পইড়া যাবি। বুঝসোস? ”

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সুবহা। তারপর ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়ে। ভাইয়ের কথার প্রতি সম্মতির নিঃশব্দ স্বীকৃতি দিতেই শ্রেয়ান বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।

**

বিকেলের নরম রুদ্দুর এলিয়ে পড়ছে পশ্চিমায়। মাগরিবের আজান পড়বে পড়বে ভাব। বিলকিস বেগম গিয়েছেন বাবার বাড়িতে। পাশের এলাকার মেয়ে বিলকিস বেগম একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। পাশের গ্রামের সবথেকে শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে বিলকিস বেগম। নাম ডাক আছেন গোটা বেশ। বাড়িতে আপাতত সুবহা একাই। আব্বাস মিয়া গেছেন বাজারে। নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে পড়তে বসেছে সুবহা। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সুবহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই তাকে এই বিজ্ঞান বিভাগ নিতে হয়েছে মায়ের জোরাজোরিতে। সে নিতে চেয়েছিলো কমার্স। স্কুলের সব বান্দুবী রাইতো কমার্স এ ঢুকেছিল তার। শুধু এই পাজি শিউলি টা ছাড়া। তবে শিউলির থেকে মাথার ব্রেইন যথেষ্ট ভালোর সুবহার। এটা তার নিজের কথা নয় বরং স্কুলের স্যাররাই এই কথা বলেন। সেই স্যাররাই তো তার মাকে উস্কেছে এই বিজ্ঞান বিভাগ নেয়ার জন্য। ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেললো সুবহা। নবম শ্রেণি তো কোনোমতে টেনেটুনে পার করলেও সামনে যে বোর্ড পরীক্ষা! সেখানে তো আর ফাঁকিবাজি করলে চলবে না। পড়তে হবে। নিয়ম করে। গভীর মনোযোগে। পদার্থবিজ্ঞানে সূত্র মেলানো তার কাছে তুলনামূলক সহজ লাগলেও কেমিস্ট্রি বিষয়টা তার কাছে অভিশাপস্বরূপ। রাসায়নিক বিক্রিয়া, পারমাণবিক সংখ্যা আর অনুবিক্রিয়া সবই বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর লাগে সুবহার কাছে। অথচ ক্লাসের প্রায় সবাই এমনকি শিউলিও বলে কেমিস্ট্রি সহজ! পদার্থবিজ্ঞানই নাকি কঠিন!

টেবিলের উপর মেলে রাখা কেমিস্ট্রির বই। হাতে কলম দিয়ে অন্যমনস্কভাবে আঁকিবুকি করছে। টানা এক ঘন্টা যাবৎ পড়েছে সে। মা টা যে সেই কখন গেছে সন্ধ্যা নেমে আসতে চললো এখনো আসছেনা কেন ভেবেই বার কয়েক এদিক ওদিক তাকায় সুবহা। এমন সমসয় দরজায় ঠক ঠক শব্দে চমকে উঠে দরজা খুলে সুবহা। তবে দরজার সামনে শিউলি কে এই অসময়ে দেখে কপালে ভাজ পরে সরু। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় শিউলির দিকে। মেয়েটা কেমন যেন চোরের মত এসে টুপ্ করে ঢুকে পরে ঘরে। সুবহা হকচকায়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বান্ধবী শিউলির দিকে।

–“দরজা লাগা মাইয়া যলদি!”

শিউলি খাটের উপর বসে পড়েছে ইতিমধ্যে। একবার আড় চোখে শিউলিকে দেখে দরজা লাগায় সুবহা। বড় বড় পায়ে এগিয়ে আসে শিউলির দিকে। এর মধ্যেই ওড়নার আড়াল থেকে কিছু একটা বের করে বলে উঠে,

–“দেখ কি নিয়া আনসি আমি!”

বলেই ওড়নার আড়ালে থাকা একটি ধাতব জিনিস বের করে তুলে ধরে শিউলি। সুবহার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠে। জিনিসটা চিনলেও কখনো ধরে দেখার সাহস হয়নি সুবহার এই ১৬ বছর জীবনে। আশ্চর্য চোখে চেয়ে বলে,

–“এটা কার? কই থেইকা আনসোস তুই?

–“আরেহ মাইয়া গলা নিচে নামা!এমনে চিল্লাস কেন?

–“এটা বাসায় আনসোস কেন? কার এটা?”

–“মনি আপুর!”

সুবহা বিচলিত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে বলে,

–“তুই মনি আপুর ফোন আমাগো বাসায় আনসোস কেন? আম্মায় দেখলে আমার পিঠের ছাল তুলবো। যলদি লুকা।”

–“আরেহ এমন ভয় পাইতাসোস কেন ছেড়ি? মনি আপু এইডা আমার রুমের আইসা চার্জ লাগাইয়া গেসে। ওনাগো বাড়িতে কারেন্ট এর ডিসটার্ব। আমি লুকাইয়া নিয়া আনসি। আপু দেখে নাই।”

–“তো তোরে এটা লুকাইয়া আনতে বলসে কে? আম্মা দেখলে আমার খবর কইরা ছাড়বো। শিউলি তুই বাইর হো বইন আমার রুম থেইকা।”

শিউলি উঠে যাওয়ার বদলে হঠাৎই সুবহার হাত টেনে পাশে বসিয়ে নিলো নিজের। একরাশ গোপন উত্তেজনায় ভরা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,

–“আরেহ ভুন্দি! এইডা জানোস কি? এইডা হইলো মনি আপার প্রাণ ভোমরা! তুই মুখ চেটকাস কেন? চুপচাপ বো, দ্যাখ কী দেখাই আইজকা তোকে।”

বলেই শিউলি নিজের হাতের স্মার্টফোনটা গুঁজে দেয় সুবহার হাতে। কিছু বলার আগেই সুবহার হাতে থাকা অবস্থায় নিজের আঙুলে পাওয়ার বাটন টিপ দিতেই ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠে আলো। কিন্তু…

–এডা তো লক করা!”

মুখ কুঁচকে বলে সুবহা।

–সমস্যা নাই, আমি মনি আপারে ফোন খোলার টাইমে চেয়ে চেয়ে দেখসি। জানি কেমনে খুলতে হয়। দাড়া এখনি খুলতেসি।”

বলেই কিছু একটা টাইপ করতেই চট করে খুলে যায় ফোনের লক।সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে ফুটে উঠে একটি আপত্তিকর ভিডিওর থাম্বনেইল। কৌতূহল ছুঁয়ে যায় দু’জনের চোখেই। একটু তাকাতেই ভিডিওটি অটো-প্লে হয়ে যেতেই সাথে সাথে কানে বাজতে থাকে ছেলেমেয়ের অপ্রতিকর কিছু শব্দ। চমকে উঠে সুবহা। যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ছুঁয়ে নিয়েছে তার অন্তকরণ। তৎক্ষণাৎ ফোনটা ছুড়ে ফেলে দেয় খাটের ওপর। বিমূঢ় কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

–“আস্তাগফিরুল্লাহ! ছি ছি শিউলি, তুই এগুলা দেখাইতে আইসোস? ছি ছি!”

ঘৃণায় কুঁকড়ে আসে সুবহার কণ্ঠ। এদিকে শিউলি নিজেও হতভম্ব। চোখ বড় বড় করে তাকায় ভিডিওর দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু কণ্ঠে বলে,

–“আরেহ, আমি কি জানতাম নাকি মনি আপা এইরকম ভিডিও রাখে ফোনে? আর এমনে নাক চেটকাস ক্যান? এইডা তো আজকালকার দুনিয়ার সাধারণ বিষয়। সিনেমায় এডি কমন বিষয়!”

–“আস্তাগফিরুল্লাহ! শিউলি বইন, মুখ বন্ধ কর! নাওজুবিল্লাহ!

বান্দুবীর এহেন প্রতিক্রিয়ায় শিউলি যেন আরও উৎসাহ পায় বান্দুবী কে পরাস্ত করতে। ঠোঁটের কোণে কটাক্ষের হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে বলে,

–“এমন নাক উঁচু কইরো নাহ বুজসো? বিয়া দিলেই দুইদিন পর তুইও ওই লেদা-লেদা পোলাপাইন এর মা হইয়া যাইবি। মনে নাই শিমু আপার কথা? পনেরো বছরেই বিয়া দিয়া এখন দুইডা বাচ্চার মা!”

সুবহার মুখটা যেন নিস্তব্ধ সন্ধ্যার মতো থম মেরে যায়। কাঁপা ঠোঁট আর কুঁচকে যাওয়া ভ্রু তার জ্বলজেন্ত উদাহরণ!

সুবহা বুঝতে পারলো এই মেয়ের সঙ্গে যুক্তিতর্ক করে লাভ নেই। যতক্ষণ না নিজের ‘মিশন’ সম্পূর্ণ করে করবে ততক্ষণ এই মেয়ে কোনোভাবেই দম নেবে না। মনেমনে বিরক্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল শিউলির দিকে।

নিজেকে সংযত করে গিয়ে খাটের উপর বসালো। শিউলি পুনরায় ফোনটি হাতে তুলে নেয়। ব্যাক বাটনে চাপ দিতেই হোম স্ক্রিনে উদিত হয় একটি সুদর্শন যুবকের ছবি। একটি রেস্টুরেন্টে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা এই যুবক কে চিনতে দেরি হলো না কারোই।
চমকে উঠলো সুবহা,

–এটা… এটা নাওফিক ভাই না? তুই কি নাওফিক ভাইয়ার ফোন চুরি করে আনছোস শিউলির বাচ্চা?”

শিউলি রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সুবহার দিকে। হালকা করে কপালে টোকা মেরে বলে,

–“হেই আল্লাহ!এই মাইয়া বুঝোস কম চিল্লাস বেশি! নাওফিক ভাইয়ার ফোন আমার কাছে আসবে কেমনে বল?”

–“তাহলে ওনার ছবি এই ফোনে আসলো কিভাবে?”

সন্দেহের চোখে তাকায় সুবহা।শিউলি গলার স্বর নামায়। ফিসফিসিয়ে বলে,

–“মনি আপা সেইভ করসে মনে হয়।”

–“মনি আপা নাওফিক ভাইয়ের ছবি সেইভ করবো কেন? ”

শিউলি এবার যেন উৎসাহে জ্বলে ওঠে,

–“কেন আবার!আমার মনে হয় ওনাগো মধ্যে কিছু একটা চলছে। আমি একদিন দেখসি, আপা ফোনে কিজানি লিখে আবার মুচকি মুচকি হাইসা উঠে। বুঝলি? প্রেম টেম হইতেছে সিউর!”

সুবহা বিরক্ত হয়ে দাঁত চেপে বলে,

–তাতে তোর সমস্যা কি?ওনারা যা মন চায় তাই করুক গাঁ। তুই বইন আমার রুম থেকে বাইরে হো। আম্মা আইয়া পড়বো যেকোনো সময়।

শিউলি হেলান দিয়ে খাটে শরীর এলিয়ে বলে,

–“চাচি তো এখনই আইবো না। তোর মামীরে নিয়া ডাক্তার দেখাইতে গেসে। সময় লাগবো। তোর এত ভয় কিসের?

সুবহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে আরও একবার। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকায় সে। বুঝতে পারে সময় হয়তো এখনো হাতে আছে কিন্তু শিউলির মতো মেয়ের হাতে এই ফোন থাকার মানে ঝামেলা যেকোনো দিক থেকে বাঁক নিতে পারে। ভেবেই তপ্ত নিঃশাস ছাড়ে।

–শিউলিরে বইন দেখিস আমারে আবার আম্মার কাছে ফাঁসাইস নাহ। আম্মা যদি একবার জানতে পারে আমার খবর কইরা ছাড়বো।

শিউলি সুবহা কে কাছে এনে বসালো। পরপর ফোনের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললো,

–“আয় তোরে একটা জিনিস দেখাই।

বলেই সোজা ফোনের ফেইসবুকে ঢুকলো সে। ফেইসবুকে ঢুকে স্ক্রলিং করতে করতে হঠাৎ সামনে পেল একটা আইডি থেকে দেয়া পোষ্ট এর আপডেট। একটু আগেই দিয়েছে কেউ। কাঙ্খিত আইডি চোখে পড়তেই টুকুস করে সেই আইডি তে ঢুকে পরে শিউলি। আইডি তে বড় বড় অক্ষরে লেখা তেজওয়ান নাওফিক চৌধুরী। সাথে আবার পাশে ছোট করে লেখা তেজ। শিউলি কৌতূহল ভরা কণ্ঠে চেয়ে বলে,

–“পাইসি!”

বলেই আইডি ঘুরে ঘুরে পোষ্ট গুলো দেখতে লাগলো শিউলি। কয়েক টা পোষ্ট পার হতেই একটা ছবি তে আটকে গেলো তার আঙ্গুল দুটো। ছবিটা গত ৩ মাস আগের দেয়া। বিদেশে তুলা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। প্রতিটি পোষ্ট প্রতিটা ছবি তে লাভ রিয়েক্ট দেয়া। শিউলি ভরা কণ্ঠে বলে উঠে,

–“দেখসোস আমি কইসি না। ওনাগো মধ্যেই নিশ্চই কোনো চক্কর চলতাসে। এই দেখ নাওফিক ভাইয়ের সব ছবিতে মনি আপা লাভ দিসে।”

— ছবিতে লাভ দিলে কি হয়? ”

–“আরেহ ভুন্দি ছবিতে তারাই লাভ দেয় জাগো মধ্যে প্ৰেম চলে বুঝসোস? ঐদিন পিন্টু বাইরে দেখলাম হের গার্ল ফ্রেন্ড এর লগে ফোনে জগড়া করতাসে। বলতেসিলো তুমি আর এখন আগের মত আমারে ভালোবাস নাহ। আমার ছবিতেও লাভ রিয়েক্ট দাওনাহ। হেন টেন সেই কি জগড়া দুইজনের আহ!”

–“তুই সত্যিই বলতেসোস?

–“হ্যাঁ। এই দেখ নাওফিক ভাইয়ের সব পোস্টে মনি আপা লাভ দিসে। আবার ফোনের হের ছবি সেইভ করা। হের মানে বুঝোস নাহ? ”

**

মাগরিবের আজান শেষে নামাজ পরে সবেই বাড়িতে ফিরলেন তোফাজ্জল সাহেব। নিজ বাড়ির ড্রয়ইং রুমে আপাতত উপস্থিত ছোট ভাই আকরাম সাহেব। আজই শহর থেকে ফিরেছেন নিজ পরিবারের সহিত। পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর খাতিরে তিনি শহরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। আকরাম সাহেবের বড় দু মেয়ে পড়েন শহরেরই নামি দামি প্রাইভেট কলেজে। ভাইকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন সম্মানের খাতিরে। তোফাজ্জল সাহেব এসে বসলেন নিজের জন্য বরাদ্ধ কৃত চেয়ারে।

–“কখন এসেছো?

–“জি ভাই মাত্রই এলাম।”

–“এবার কিছুদিন থেকে যেও। এখানে কিছু দরকারি কাজ আছে । সিরাজ কে বলে দিয়েছি ওদিকটা আপাতত সামলাতে।

–“সমস্যা নেই ভাই। আমি সিরাজ কে সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।”

–“সুস্মিতা কোথায়? ওদের নিয়ে আসোনি?

পাশে থাকা বাড়ির বয়জেষ্ঠ আঞ্জু বেগম ছেলের কথায় পান চিবুতে চিবুতে বললো,

–“তোমার ভাইজি রে কি এখন এদিকে পাইবা। দেখো গিয়া নাওফিক এর রুমের সামনে ঘুর ঘুর করতাসে মনে হয়!”

মায়ের কথায় বিষম খায় আকরাম সাহেব। যদিও মায়ের কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। মেয়েটা যখন দেখে শুনেছে নাওফিক দেশে ফিরে আসছে তখন থেকেই তো তাকে তাড়া দিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে। তোফাজ্জল সাহেব ব্রু কুটি করে উঠে গেলেন সেখান থেকে। যেতে যেতে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলেন,

–“ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো। পাশের গ্রামে শালিস বসেছে। যাবে আমার সাথে।

**

দুতলার একটি কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত পায়চারি করছে সুস্মিতা। এইবার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুস্মিতা পরে শহরের এক নামি দামি প্রাইভেট ভার্সিটি তে। এই দু বছরে নিজ গ্রামের চৌকাঠ পেরোয় নি একবারও। বাবা মা শত করে বললেও আনানো যায়নি তাকে। তবে নাওফিক এর দেশে ফিরে আসার কথা শুনতেই আর আটকে রাখতে পারেনি কেউ তাকে। সেই ছোট বেলা থেকেই যাকে নিজের কল্পনায় সাজিয়ে এসেছে তাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণার লোভ সামলাতে পারেনি শত চেষ্টা করেও। তাইতো বাড়িতে আসা মাত্রই কাঙ্খিত মানুষটাকে দেখার জন্য সেই তখন থেকে বাইরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে সে। অবশেষে নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই একটা কড়া পুরুষালি ঘ্রান এসে নাকে মুখে আঘাত খায় সুস্মিতার। ভিতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পরে বেডের উপর এলোমেলো ভাবে ফেলে রাখা কমফোর্ট টায়। তার উপরে পরে আছে একটি কালো রঙা টি শার্ট। রুমে কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে না পেয়ে পরে থাকা টি শার্ট টি তুলে নাকে টেনে এনে ঘ্রান নেয় প্রাণ ভরে। ঠিক সেই সময় বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে নাওফিক। নিজ রুমের ভিতর অন্য কারো উপস্থিতি পছন্দ নয় এই ব্যক্তির। চোখে মুখে বিরক্তির রেশ প্রগাঢ় হলো নিজের টি শার্ট সুস্মিতার হাতে দেখা মাত্রই। পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট সাথে কালো টি শার্ট। নাওফিক কে আচানক এভাবে দেখে থতমত খায় সুস্মিতা।

–“নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েদের মত কবে থেকে হলি তুই? সোজা পরপুরুষের রুমে ঢুকে বসে আছিস? আমার রুমে আসতে নিষেধ করি নাই তোকে?

–“এভাবে বলছো কেন তেজ? তোমার সাথে দেখা করতেই তো সেই শহর থেকে ছুটে এসেছি।

–“আমি কি তোর ভা”তার লাগি?যে আমায় দেখতে এভাবে ছুটে আসছোস? আর কখনো আমার রুমের সামনে যেন তোরে না দেখি। বাইর হো!

-/এভাবে বলছো কেন তেজ?সম্পর্কে আমি তোমার কাজিন। আর এটা তো আমার ও বাড়ি। আমার অধিকার নেই তোমার ঘরে ঢুকার?

–“তুই পুরো গ্রামার সমস্ত ঘর বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখ। রাস্তায় যা। মাঠে যা। ঘাটে যা। তোর ইচ্ছা। তবে আমার রুমে ঢুকবি নাহ। এটাই শেষবার। আর যেন আমার এই কথা তোকে রিপিট করতে না হয়।

–এভাবে বলো নাহ। একদিন তো এই রুমে তুমি আর আমিই থাকবো। তখন তো তোমার রুম কেন তোমার উপরেও আমার অধিকার থাকবে। তখন কি করবে? ”

–“তোর বাপে আইসে বাড়িতে?”

আচানক এমন প্রশ্নে থত মত খায় সুস্মিতা। পরপর উত্তর করে,

–হ্যাঁ! কেন?

–“ঐটা তোর বাপরেই বলতেসি। আয় বাইরে। ”

বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যায় নাওফিক। নাওফিক বের হতেই পিছু পিছু ছুটে সুস্মিতা। লোকটা একবারে গিয়ে ড্রয়ইং রুমের হাজির। সেখানে এখনো বসে আছেন বাড়ির বয়জেষ্ঠ আঞ্জু বেগম।

–“আঞ্জু বেগম আপনার গুণধর ছোট ছেলে কই? ডাকেন ওনারে?”

আঞ্জু বেগম কেবলই পান মুখে পুড়েছেন। চিবুতে চিবুতে বললেন,

–“কি হইসে দাদা ভাই? আকরাম বাইরে গেসে তোমার বাপের লগে। চাচারে কি দরকার তোমার?

–“তোমার পোলারে বলবা মেয়ে রে বিয়ে দিতে। মাইয়ার বিয়ার বয়স পার হয়ে যাইতাসে বিয়ে দেয়না কেন? চৌধুরী বাড়ির খাম্বা বানাইয়া রাখার ইচ্ছে হইসে নাকি?

–“কেন দাদু ভাই? কি করসে দাদু মনি?

–“তোমার দাদু মনির যৌবনের জ্বালা উঠসে দাদু ভাই। বিয়ার ভুত মাথায় চাপসে। দিন্ দুপুরে অন্য পুরুষের রুমের ঢুইকা পরে হুস হারাইয়া। বিয়ার বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও মাইয়া বাড়িতে থাকলে তো এমন করবোই। আজ আমার ঘরে ঢুকসে কালকে দেখবা গ্রামের অন্য পোলাগো ঘরে ঢুকার বিচার আসবো। চাচারে বলো এডারে যলদি বিয়া দিয়া বিদায় করতে বাড়ি থেইকা।

বলে হন হন পায়ে সেখান থেকে চলে যায় নাওফিক। পিছনে দাঁড়িয়ে সুস্মিতা বিমূঢ় স্থগিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ঠাই। আঞ্জু বেগম আড় চোখে নাতনি কে দেখে পুনরায় পান চিবুতে লাগলেন। সুস্মিতা প্রচন্ড লজ্জায় আরষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঐভাবেই।

চলবে….