প্রাণনাশিনী পর্ব-১৫

0
2

#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_১৫
#সুহাসিনি_মিমি

কাজী সাহেব তাজ্জবনে গেল নাওফিকের এহেন রূপ দেখে। লোক সম্মুখে কম বেশি এই ছেলের পাগলামি সম্পর্কে অবগত থাকলেও এহেন অবস্থা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ ভাবে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতেন না তিনি। ছেলে টা বড্ড বেপরোয়া, উন্মাদ আর নির্লজ্জ। একটু বেশিই নির্লজ্জ এই ছেলে। আজ পর্যন্ত কত শত বিয়ে পড়িয়েছেন তিনি। তবে এই ছেলের মত বেলাজ ছেলে ইহো জন্মেও দুটো দেখেন নি। পরপর সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন বাইরে। কাজী সাহেব কক্ষ হতে বেরোতেই সেখানে প্রবেশ করলেন তোফাজ্জল সাহেব। রুমে ঢুকে একবার সরাসরি তাকালেন খাটের উপর গুটিসুটি বেঁধে লাল বেনারসি পরে বসে থাকা সুবহা কে। মেয়েটার মাথা নিচু করে রাখা। এমনেতেই যতটুকু দেখা যাচ্ছে বলা যায় মেয়েটা নিঃসন্দেহে রূপবতী, মায়াবতী হলেও ভাগ্যবতী উপাধি দিতে পারলেন না আপাতত তিনি মেয়েটাকে।

এই মেয়েটার নিঃসন্দেহে আরো ভালো জায়গায়, ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারতো ওর পরিবার। হান্নানের বোনের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেও হয়তো শতগুনে ভালো থাকতো মেয়েটা। শুনেছে ছেলেটা নাকি ডাক্তার। আর কোথায় তার এই বেলাজ ছেলে! কোন কালে যে তার এই নালায়েক ছেলেটার নজরে পড়েছিল এমন ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটা কে জানে! তোফাজ্জল সাহেবের মতে এই নিষ্পাপ ছোট মেয়েটার জীবনের জীবনের মানে শেষ আপাতত তার এই ছেলের খপ্পরে পরে। তবে তিনি তা হতে দিবেন নাহ। ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছে করিয়েছেন। এর বেশি কিছু নয়। এই ছোট্ট মেয়েটার জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে দিবেন না তিনি।

–“ঝর্ণা তুমি ওকে সুস্মিতার রুমে দিয়ে আসো। আজ রাত টুকু ও সুস্মিতার সঙ্গে থাকবে।

এতক্ষন যাবৎ হাসিখুশি থাকা মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল নাওফিকের। উৎফুল্লতা হারিয়ে ধারণ করল বিবর্ণ, ফ্যাকাসে বর্ণ। হতোবিহুল চোখে তাকালো বাবার দিকে। তোফাজ্জল সাহেব উক্ত কথাগুলো বলে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম হতে। নাওফিক বাবার পিছু পিছু হাঁটা ধরে বলল,

–“এটা কি হলো আব্বা?”

তোফাজ্জল সাহেব যেন শুনেও শুনলেন না ছেলের কথা। উপরে নিজের কক্ষে উঠে যেতে লাগলেন। নাওফিক আবারো বলল,

–“আব্বা আমনে এটা কি বলে এলেন? আমার সদ্য বিয়ে করা বউ কেন ওই সুস্মিতার রুমে থাকবে? আমার এতো বড় রুম কি আপনার চোখে পরে নাহ? ”

ওদিকে নাওফিকের অবস্থা থেকে ঠোঁট টিপে হাসছে তনয়। ঝর্ণা বেগম নিজেও হতোভম্ব স্বামীর এহেন সিদ্ধান্তে। তবে মন্দ বলেনি তিনি। মেয়েটা সত্যিই ছোট। আরেকটু সময় দেয়া দরকার। বিয়ে যেহেতু হয়েছেই তাহলে এখন আর এতো তাড়া কিসের? নাওফিক নেমে এলো নিচে। মায়ের দিকে তাকিয়ে করুন সরে বলল,

–“এইটা বাপ্ না মীরজাফর এর বংশধর। দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব পড়সিলো আম্মা? আপনার বাইচ্ছা বাইছা এই মীরজাফর রেই বিয়ে করতে হইলো?”

ঝর্ণা বেগম মুখ চেপে হাসি বন্ধ করে বলল,

–“তোর নানার পছন্দ ছিল তোর বাবা। তবে যতটা খারাপ ভাবছিস ততটাও নয়। এক হিসাবে ঠিকই বলেছে তোর বাবা।”

নাওফিক হতাশ চিত্তে বলল,

–“তাইলে আজ থেইকা তুমিও আর আব্বার লগে থাকতে পারতা না আম্মা। আজ থেইকা তুমি দাদির ঘরে ঘুমাইবা। শুইনা রাখেন তোফাজ্জল সাহেব। যে পর্যন্ত আমার ঔ নাদুস নুদুস বউটা কে আমার ঘরে না পাঠাবেন সে পর্যন্ত আপনার বউ ও আপনার ঘরে যাওয়া নিষেধ। কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিলাম আমি এই তেজওয়ান নাওফিক চৌধুরী!”

**

রাত টুকু কোনো রকম পার করল নাওফিক জেগে জেগে কাটিয়ে। দু চোখে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই। ঘুম আসবে কি করে। মেয়েটাকে ভালোবাসে পাগলের মত। অবশেষে ধমকিয়ে ধামকিয়ে বিয়েও করেও লাভ কি হলো? বিয়ের প্রথম রাতেই তার বাবা তার নতুন বউটাকে আলাদা রুমে পাঠালো ঘুম পাড়াতে। তাও আবার ওই সুস্মিতার রুমেই পাঠাতে হলো? তবে খবর নিয়ে জেনেছে সুস্মিতা নাকি ওই রুমের ঘুমায় নি। তার বদলে ঝর্ণা বেগম ঘুমিয়েছেন সুবহার সঙ্গে। সারারাত জেগে জেগে কাটিয়ে শেষ রাতের দিকে কেবল চোখ দুটো লেগে এসেছে তার।

সকাল বেলা। এখনো পুরোপুরি সূর্যের তেজ প্রখর হয়নি। অমনিই বাড়িতে চেচামেচির শব্দে বিরক্তিতে ঘুম ছুটে গেল নাওফিকের। উগ্র মেজাজে উঠে বসলে খাটে। আচানক মস্তিস্ক ধপ করে জ্বলে উঠল ওর। মনে পরে গেল বউটার কথা। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। বের হয়ে আসলো রুম হতে। সোজা নিচে নামতেই দেখতে পেল সোফায় বসে থাকা হান্নান সাহেব সাহেব কে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়ান। মস্তক নিচে তাক করে। নাওফিক নিচে নামতে নামতে শ্রেয়ান এর দিকে একবার তাকালো চোখ রাঙিয়ে। শ্রেয়ান বাবার সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেনা। সামনেই আসনে বসে আছেন মীরজাফর খ্যাত তার বাবা তোফাজ্জল চৌধুরী। নাওফিক এর কাছে আপাতত বিষয়টা পানির মত স্বচ্ছ। এসব তার বাবার করা কান্ডকারখানা। গতকাল রাতে ছেলেকে বউ ছাড়া করে রেখে শান্তি পায়নি তার বাবা। তাইতো সকাল হতে না হতেই খবর দিয়েছে ওনাদের। নাওফিক নামতেই ওর উপর দৃষ্টি পড়ল সকলের।

তোফাজ্জল সাহেব বললেন,

–“যা বলার আগেই সব বলে দিয়েছি। নতুন করে আর কিছুই বলার নেই। তোহ সিদ্ধান্ত সেটাই থাক। সুবহা আজ থেকে তোমাদের বাড়িতেই থাকবে। তবে মনে রেখো ও কিন্তু তোমাদের মেয়ে হওয়ার পাশাপাশি এখন চৌধুরী বাড়ির বউও। ”

বাবার এহেন কথাই বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো নাওফিকের মাথার উপর। তার বউ কই? তার মানে তার বউটাকে কি তার বাবা আগে ভাগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে? তার এই মীরজাফর বাপটা কি করতে চাচ্ছে। তার বউ কে তার পারমিশন ছাড়া দিয়ে দিলো? গর্জে উঠল নাওফিক,

–“এসব কি বলতাসেন মীরজ… আব্বা। আমনে আমার বউকে আমার মত ছাড়া কিভাবে শশুর বাসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন?”

তোফাজ্জল সাহেব ছেলের কথার পাত্তা দিলেন না বিশেষ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝর্ণা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“ওদের নাস্তার ব্যবস্থা করো।”

–“আব্বা আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। আম্মা এসব কি হইতাসে? এখন কিন্ত বেশি বেশি হচ্ছে বলে দিলাম।”

–“তোমার বউ এর আগে সুবহা ওনাদের মেয়ে তেজ। এমনিতেই গতকাল তুমি ভুল করেছো। তোমার ভুল সিদ্ধান্তে আমরা সায় দিয়েও আমরাও তাতে শরিক হয়েছি। তবে আর নাহ। মেয়েটা এখনো পূর্ণ বয়স্ক নয়। অপেক্ষা করো। ধৈর্য ধরো। ”

–“অপেক্ষা করবো। ৫ বছর যাবৎ সেটাই তো করে যাচ্ছি আব্বা। এভাবে অপেক্ষা আর ধৈর্য ধরতে ধরতে আমাকে তো নিরামিষ হয়ে মরতে হবে শেষমেশ।”

–“নালায়েক মুখের ভাষা ঠিক করো। সামনে তোমার শুশুর আছে অন্ততঃ সেটা একটু মাথায় রেখো। ”

–“রাখেন তো আব্বা আপনি আপনার ম্যান সম্মান। বউ ছাড়া শুশুর দিয়ে আমি কি করবো। আমার বউ আইন্না দেন। নাইলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাইবো। ”

নাওফিকের হুমকি স্বরূপ বার্তা খানা আমলে নিলেন না তোফাজ্জল সাহেব। ভাবলেশহীন ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বললেন ছেলের উদ্দেশ্য,

–“নাটক বন্ধ করো তেজ। জীবন নিয়ে সিরিয়াস হও। নাহলে পরে পস্তাবে। ”

–“রাখেন আপনার লেকচার। এখানে আমার বউ নিয়ে টানাটানি আর আপনি আছেন জীবন নিয়ে পরে। মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি আব্বা। ”

–“ভালোবাসা? ওই মেয়েটার চোখে কি তুই ভালোবাসা দেখছিস? সে তো ভয়ে জমে আছে রে! বিয়ে শুধু ছেলে খেলা নয়। বিয়ে মানে দায়িত্ব। বিয়ে মানে সম্মান। আর তোর মধ্যে এসবের কোনোটারও ছায়াও নাই। যেদিন লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হতে পারবি। সেদিনই আমি নিজে গিয়ে মেয়েটাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবো কথা দিলাম।”

বলেই উক্ত জায়গা ত্যাগ করলেন তোফাজ্জল সাহেব। নাওফিক রাগে ড়ি ড়ি করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। যাওয়ার আগে অবশ্য একবার শ্রেয়ান এর দিকে তাকালো ও। শ্রেয়ান চট যলদি মাথা নিচে নামিয়ে ফেললো আবার। বন্ধুর জন্য তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আহারে! বেচারা!

**

পড়ন্ত বিকেল। সূর্যর কিরণ মলিন হয়ে এসেছে ধরণী জুড়ে। আসর এর আজান এর নামাজ পড়তে গেছেন হান্নান সাহেব। বাড়িতে আপাতত বিলকিস বেগম আর সুবহা। সুবহা কে সকাল বেলা বিলকিস বেগম তার সাথে করে নিয়ে এসেছে। তোফাজ্জল সাহেব আগে ভাগেই মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। শিউলি এসেছে ঠিক দুপুরের মাঝামাঝি সময়। সেইজে সুবহার রুমে ঢুকেছে আর বের হওয়ার নাম নেই। শ্রেয়ান ওর রুমে। সারাদিন রুম থেকে বের হয়নি আর। রুম জুড়ে পায়চারি করছে লাগাতার। খাটের উপর যান্ত্রিক ডিভাইস টা বেজে চলেছে সেই কখন থেকে। রিসিভ করার সাহস নেই শ্রেয়ান এর। সে জানে এই কল রিসিভ করা মানেই ঘোর বিপদ। বিপদ মানে পুরোই বিপদজনক। রিসিভ করবে না সে। তার বন্ধু যে পরিমান রেগে তার উপর কোন সময় বোম ব্লাস্ট করে কে জানে।

প্রতিবারের মত এবারও ফোনটা রিং হয়ে কেটে গেল। বিরক্তি আর রাগে দাঁত কিড়মিড় করে নিজের রাগ সংবরণ করল নাওফিক। শেষমেশ তার বন্ধু টাও মীরজাফর এর দলিলে নাম লেখিয়েছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো নাওফিক সে বাড়ির ভিতরে যাবে। বউটাকে দেখে না গোটা একটা দিন হতে চলল। বিয়ে হলে নাকি মেয়েদের মধ্যে আলাদা একটা সোন্দর্য ভর করে। তার নাদুস নুদুস বউটা তো এমনিতেই মাশাআল্লাহ। এখন বিয়ের পর চেহারায় কতটা সিন্গ্ধতা এসেছে সেটা দেখবে না সে নিজ চোখে? অন্তত এতটুকু দেখার অধিকার তো তার আছেই। ভেবেই বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়লো নাওফিক। একবার দুবার দরজায় নক করতেই খুন্তি হাতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বিলকিস বেগম। দরজা খুললেন চটা ভঙ্গিতে। অমনিই দরজার সামনে কালো থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর ধূসর রঙা টি শার্ট গায়ে সদ্য হওয়া মেয়ের জামাই উরুফে নাওফিক কে দেখে চটা মেজাজ আরো চটে গেলো বিলকিস বেগমের। কপালে পরপর মোটা দুটো ভাজ পড়ল মহিলার। বলল রুক্ষ কণ্ঠে,

–“কি চাই? ”

–“প্রথমে আপনার মেয়েকে এরপর ঘরে লুকিয়ে থাকা আপনার গুণধর ছেলেটাকে!”

যেমন প্রশ্ন তেমন জবাব। বিলকিস বেগম রাগ দেখাতে যেয়েও দমে গেলেন। যতই হোক তার মেয়ের জামাই।যদিও এই ছেলেটাকে কেন জানি পছন্দ নয় বিলকিস বেগমের। তবে আজ সম্পর্ক টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে তো। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন বিলকিস বেগম। সেই সুযোগেই নিজের জন্য জায়গা করে ভিতরে ঢুকল নাওফিক। প্যান্ট এর পকেটে দু হাত গুঁজে পিছু না ফিরেই শাশুড়ির উদ্দেশ্য বলল,

–“আম্মাজান। আমার বউটা কি ঘরেই আছে? ”

লজ্জায় নাক কাঁটা গেল বিলকিস বেগমের। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

–“আছে নিজের ঘরেই। তবে ওই ঘরে যাওয়া যাইবো না তোমার। নিষেধ আছে। তুমি নিচেই বও। আমি শ্রেয়ান রে ডাইকা দিতাসি। ”

বলেই হাঁক ছাড়লেন বিলকিস বেগম ছেলের উদ্দেশ্য,

–“শ্রেয়ান। ওই শ্রেয়ান। নিচে নাম। দেখ তোর প্রাণের পিয়ারের বন্ধু আইসে।”

বলেই রান্না ঘরে ছুটে গেলেন তিনি। নাওফিক ভড়কালো। এতদিন শুনে এসেছে নতুন জামাইদের শুশুর বাড়িতে নাকি সেই রকম ভাবে খাতির আপ্পায়ন করা হয়। কিন্ত তার পোড়া কপাল! শ্রেয়ান চমকিয়ে নিচে নেমে এল তৎক্ষণাৎ। মনে মনে যা ভেবেছিলো তাই। নামতে নামতে বলল,

–“শেষ পর্যন্ত বাড়িতেই এসে পরলি? ”

–“আমার কল ধরিস নাই কেন সালা। ”

–“সম্মান দিয়ে কথা বল ভাই। সম্পর্কে সম্মন্ধি হই তোর। সালা না। ”

–“তোর বোন কইরে? ”

–“রুমেই!”

–“আমার পাগলা শাশুড়ি টারে একটু সামলাতো। আমি তোর বোনটার সঙ্গে একটু বোঝাপড়া কইরা আসি। ”

বলেই শ্রেয়ান কে কিছু বলতে না দিয়েই উপরের দিকে ছুটলো নাওফিক।

চলবে….