#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_১৬
#সুহাসিনি_মিমি
–“তুই এতক্ষন ধইরা যা কইলি সব কি সত্যিই রে সুবহা? ”
শিউলির চোখ দুটো বিস্ময়ে হতোবিহুল। এতদিন তাহলে নাওফিক ভাইয়ের মনের ভিতরে এমন কাহিনী ছিল আর ওর মত দুরন্ত চতুর হয়েও সেটা আন্দাজ করতে পারেনি? শিউলি গলা উঁচিয়ে ফের বলল,
–“এখন মনে পরসে ওইযে সেদিন তোরে যে বোরকা দেয়ার কথা বললি না শ্রেয়ান ভাই নাকি তোকে বোরকা কিনে দিসিলো? ঐটা শ্রেয়ান ভাই না বরং নাওফিক ভাই কিন্না দিসিলো রে বইন। এইবার আমি পুরা সিউর!”
–“দূর কি বলছিস? ওনি কেন আমায় বোরকা কিনে দিতে যাবেন?”
–“আরেহ বুন্ডি, বেয়াক্কল মাইয়া! ওনি তোরে পছন্দ করে। শুধু পছন্দ না মেলা পছন্দ করে। হেইয়া অনেক আগে থেইকাই হের লাইগাই তো তোরে এমন শাসন করতো সবসময়। দেখোস নাই তোর লাইগা কেমনে প্রতিদিন সকালে ঘাটের সামনে দাঁড়াইয়া থাকতো। আহ! তোর মত এমন একটা কপাল যদি আমার হয়তো। বইন আয়তো এদিকে আয় তোর কপালের লগে একটা ঘষা খাই।”
বলেই এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে থাকা সুবহার মাথার সঙ্গে ঠাস করে একটি বারি খেল শিউলি। ব্যথায় আহ শব্দ করে উঠল সুবহা। চোখ মুখ খিচে বলল,
–“আহ! শিউলির বাচ্চা! দিলি তো মাথা টা ফাটাইয়া।”
–“ছেড়ি! তোর তো নামাজ পইড়া শুকরিয়া আদায় করার দরকার। কি কপাল রে বইন তোর। ইশ নাওফিক ভাইয়ের মত এমন একটা জামাই পাইসোস। চেয়ারম্যান বাড়ির বউ তুই। আমি তো খালি ভাবতেসি মনি আপুর কথা। আহারে বেচারি শুনলে কি যে কষ্ট পাইবো!”
–“উফফ! শিউলি চুপচাপ থাক তো। আমার অমন কপাল চাইনা। আর না চাই ওই বদজাত বেটা নাওফিক কে। ওনাকে দেখলেই তো ভয়ে আমার হাটু কাপে। সবসময় ধমকের উপরেই তো রাখেন আমায়। ধমকিয়েই তো তখন কবুল বলিয়েছিল। নাহলে আমার কি ঠেকা পড়েছিল ওনাকে বিয়ে করতে? আর তুই বলছিস ভালোবাসে? ”
–“আরেহ ঐটা শাসন করে তোরে। অমন একটু একটি শাসন মানাই যায় বইন। এখন তুই কি সিদ্ধান্ত নিসোস? কি করবি?”
–“আমি আবার কি করবো। আব্বা আম্মা যা বলবেন তাই।”
–“হুরো ছেড়ি আকাইম্মা। তোর জায়গায় আমি হইলে ওই বাড়ি থেইকা আর বাহির হইতাম নাহ। আহা নাওফিক ভাই এখন আমাগো ধুলাভাই। ইশ! আমার এটা ভাবতেই তো কেমন কেমন জানি লাগতাসে। আল্লাহ!”
সুবহা বান্ধবীর এহেন রিয়েক্ট এ ভ্রু কুঁচকিয়ে নিলো বিরক্তি তে। এর মাঝে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সেদিকে তাকালো দুজনেই। সুবহা উঠে দাঁড়ালো। ভাবলো হয়তো তার মা এসেছে। দরজা খুলতেই এই মুহূর্তে নাওফিক কে নিজ কক্ষের দরজার সামনে উপস্থিত দেখে হতভম্ব সুবহা। সুবহা কে এভাবে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিউলি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো দরজা বরাবর। অমনি মেয়েটার মুখেও স্থিরতা পড়ল তৎক্ষণাৎ।
ওদিকে নাওফিক এতক্ষন যাবৎ ভেবেছিল তার বউটা বোধহয় একাই রুমে রয়েছে। তবে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলিকে দেখে মেয়েটার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই তৎক্ষণাৎ কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে গিয়ে শুষ্ক ঢুক গিললো শিউলি। পিছন থেকে চিমটি কাটলো সুবহা কে। ধ্যান ভাঙলো সুবহার। শিউলি কাচু মাচু করে মিনিমিন করে বলল,
–“আমি তাহলে আসছি রে সুবহা। মা চিন্তা করবেন। ”
বলেই বের হতে নিলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো নাওফিক। শিউলি কোনো রকম ভাগলো সেখান থেকে। ভরকাল সুবহা। মেয়েটা সুযোগ বুঝে পালালো আবারো। কিন্তু এই লোক সোজা ওর রুম পর্যন্ত কিভাবে আসল? এখন কি করবে ও? মনে মনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলো সুবহা। মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করতে যাবে অমনিই দরজার কপাট ধরে ফেলল নাওফিক। বাঁকা হেসে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
–“বরের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলি? নির্দয় নারী। বরের জন্য একটু মায়া হলোনা তোর? কাল বিয়ে হতে না হতেই মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে এসে বসে আছিস দিব্যি। ভেবেছিস পালিয়ে বাড়িতে আসতে পারলেই আমার হাত থেকে রেহাই পাবি?”
বলেই ভিতর ঢুকে পড়ল নাওফিক। ঢুকেই দ্রিম করে দরজা লাগিয়ে দরজার সঙ্গে হেলিয়ে দাঁড়ালো। সুবহা থত মত খেয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগলো। একটু আগেই শিউলি কে রেখেই গোসল সেরেছিল ও মায়ের ধমকে। মাথার চুলগুলো এখনো তেমন শুকায়নি। এখনো আধ ভেজা। পরনে আকাশি রঙা একটা থ্রি পিস। নাওফিক একবার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলো তার সদ্য হওয়া বউয়ের।
–“ব্যাপার কিরে! বিয়ের পর নাকি মেয়েদের মধ্যে আলাদা একটা গ্লো আসে। তোর মধ্যে তো তেমন কিছুই লক্ষ্য করতে পারছি নাহ।”
সুবহা খিচে দাঁড়িয়ে রইলো। নড়ার শক্তি টুকুও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এই লোকটা এভাবে সামনে আসলেই ভয়েরা ওকে আষ্ঠে পিষ্ঠে ধরে।
–“এই তোর কি মৃগো বেরাম আছে নাকি রে? এমনে কাঁপতাসোস কেন? আমি তোকে মারসি না বকসি? বাকি অন্য কিছুই করসি?কোনটা?
বলেই কয়েক কদম এগিয়ে এলো নাওফিক পকেটে দু হাত গুঁজে। সুবহা ভয়ে ভয়ে পিছাতে লাগলো। মেয়েটার এমন ভীতু চেহারা দেখে মনে মনে বেশ মজাই পাচ্ছে সে। বলল কপট রাগ দেখিয়ে,
–“এখানে এসেছি কেন জানিস? ”
সুবহা পিছাতে পিছাতে দু পাশে মাথা নাড়াল।মানে সে জানেনা। নাওফিক মুখটা গম্ভীর করে বলল,
–“তোকে পানিশমেন্ট দিতে। আমায় না বলে দিব্যি মায়ের সঙ্গে যে সকাল বেলা ঢেঙ্গ ঢেঙ্গ করে চলে এলি। জানিস না এখন যে তোর এমন জ্বলজেন্ত একটা হ্যান্ডসাম বর আছে?”
সুবহা কিছুই বলল নাহ। চুপচাপ শুনে গেল শুধু। নাওফিক আরেকটু এগিয়ে এলো। পিছনে আর জায়গা নেই সুবহার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। নাওফিক সুযোগ বুঝে আরো কাছে এলো মেয়েটার। সুবহার গলা শুকিয়ে চৌচির। এই মুহূর্তে এক সমুদ্র পানিও বোধহয় কম পরে যাবে মেয়েটার। কপালে চিক চিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। নাওফিক হাত বাড়িয়ে সুবহার কপালে জমা ঘাম টুকু আঙ্গুলের সাহায্য নিয়ে চুটকি মেরে ফেলে দিলো। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিলো সুবহা।
–“তোকে দূর থেকে দেখার নেশাই সামলাতে পারিনি এতদিন। ছটফট করেছি শুধু। এখন এতো কাছ থেকে দেখার পর এই অস্থিরতা কিভাবে সামলাবো রে প্রাণ?”
প্রাণ! ইশ কি শ্রুতিমধুর বাক্য খানা! তবে সুবহার কান ভেদ করল না এই নরম কণ্ঠে বলা বাক্যটি। মেয়েটা ভয়ে জমে। যাকে এতদিন যমের মত ভয় পেয়ে এসেছে তার মুখ থেকে নরম কথা শুনলেও আমাদের হৃদয় কেঁপে উঠবে স্বাভাবিক। সুবহার ক্ষেত্রেও তাই।
–“প্রাণ! তুই কি সত্যিই অবুঝ রে? এতটা অবুঝ কেন তুই? তুই বুঝিস নাহ কেন? নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছিস নাহ? দেখ এইযে এই বাম সাইডে শরীরের ভিতরে এই যন্ত্রটা আছেনা ওটা কিভাবে ধুকপুক করছে?
বলেই সুবহার হাত ধরে নিজের বুঁকের বা পাশে চেপে ধরলো নাওফিক। সুবহার হাত দুটো কাঁপছে অবিরাম। নাওফিক ফির বলল,
–“কিরে বুঝতে পারছিস নাহ? এটা কিন্তু তোকে দেখলেই এভাবে লাফায়। এমন কেন হয়রে প্রাণ? জানিস? জানিস নাহ। তবে আমি জানি। জানিস এটা কবে থেকে শুরু হয়েছে? ওইযে সেদিন তুই বাজারে কুকুরের তাড়া খেয়ে শ্রেয়ান ভেবে পিছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরেছিলি নাহ? বিশ্বাস কর সেইদিন থেকেই। ঠিক সেদিনের পর থেকেই তোকে দেখলে এই হৃদপিন্ড নামক যন্ত্রটা এমন লাফালাফি করে।”
–“সুবহা ওই সুবহা। দরজা খোল। ভিতরে কি করোস দরজা লাগাইয়া। সুবহা রে। ”
এমন সময় দরজার অপর প্রান্তে বিলকিস বেগমের কণ্ঠে দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলল নাওফিক,
–“সালার বিয়া কইরাও শান্তি নাহ। বউটার সঙ্গে দুইটা মিনিট পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করতে পারিনা। নিজের বাড়িতে আছে এক বাপ্ নামক মীরজাফর। আর শুশুর বাড়িতে এই শাশুড়ি নামক মাতারি!”
চলবে…..