#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-০৪]
~আফিয়া আফরিন
অনিতার আজও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো। কিন্তু কোনোকিছুতে মন বসাতে পারল না। পড়তে বসা দরকার। সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিছে, অথচ সে তাও জানে না।
অনিতা অনেকক্ষণ বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করল। কিন্তু মাথায় কোনো পড়া যাচ্ছে না। তার মন ও মস্তিষ্ক জোরে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই ছেলেটা যে ফুপিকে ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করেছিল তখন ফুপি কি বলেছিল? আর তারপরেই বা কি হয়েছিল?
এমন একটা মুহূর্তে ডায়েরীটা রাখতে হয়েছিল যে, এখন আর উৎকণ্ঠা শেষ হচ্ছে না। না রেখেও তো উপায় ছিল না, ফুপি এ’পাশ ও’পাশ ঘুরছিল। যদি কোনোভাবে টের পেয়ে যেত? তাই অনিতা আর রিস্ক নেয় নাই।
তবে একটা বিষয় নিয়ে না চাইতেও ভাবতে হচ্ছে। ফুপির স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটির কোথাও রাজশাহী নেই, সব ঢাকাতেই। তবে কি সে পরীক্ষায় টিকল না? ওই ছেলেটার সাথে আর কি যোগাযোগ হয় নাই? নাহলে বড্ড খারাপ হবে। অনিতা আশা নিয়ে পড়া শুরু করেছে, মাঝে এইরকম খুচরো অনুভূতি তৈরি হলে তাকে নিরাশ হতে হবে।
অনিতা এখন দিনে যতক্ষণ সময় পায়, ততক্ষণ শুধু ওই সময়টার কথাই ভাবে। আফসোস হয়, একটা টাইম মেশিনের অভাবে। তাহলে আর কষ্ট করে লুকিয়ে, সবাইকে আড়াল করে ডায়েরী পড়ার জন্য তৃষ্ণার্ত থাকতে হতো না, নিজের চোখেই সমস্ত ঘটনা দেখে ফেলত।
সেদিন বিকালে সকলের সম্মুখে অনু বলল, সে ফিরে যেতে চায়। কাজকর্ম আটকে রয়েছে।
সবাই’ই অবাক! এতদিন পর এসে এক সপ্তাহ না থেকেই চলে যেতে চাচ্ছে! সকলে বাঁধা দিল। অনু অবশ্য বরাবরের মতো সকলের কথাই অগ্রাহ্য করল। শেষমেষ অনিতা বলল, ‘তুমি যে চলে যাচ্ছো, কতদিনের জন্য এসেছিলে শুনি?’
অনু নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘এইতো যতদিন ছিলাম। এর বেশি থাকতে পারব না রে বাবা। বহুত কাজ। তার মধ্যে ফার্স্ট ইয়ারদের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আমাকে যেতেই হবে।’
‘খুব দরকার ছিল দুই দিনের জন্য আসার? তারচেয়ে না এলেই ভালো হতো।’
অনিতার অভিমান ঠিকই বুঝতে পারল অনু। সে হেসে বলল, ‘রাগ করিস না। বিয়ে-শাদী তাড়াতাড়ি কর। একেবারে এসে এখানেও থাকব তোর শ্বশুরবাড়িতেও থেকে যাব। ভালো কথা, আহিরের কি খবর? ওর সাথে তো এবার দেখা হলো না। এইদিকে সবকিছু ঠিকঠাক হলে? তুই ওকে নিয়ে আমার ওখান থেকে বেরিয়ে আসিস।’
অনিতা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এই মুহূর্তে ফুপি চলে যাওয়াতে তার যতটা না খারাপ লাগছে তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, সে আর ওই ডায়েরীটা পড়তে পারবেনা এবং বাকি কাহিনীটুকু জানতে পারবে না।
অনিতা যাওয়ার আগমুহূর্তে আরও কয়েকবার রিকোয়েস্ট করল, ‘আর দুইদিন থেকে যাও ফুপি। আবার কবে আসবে, তার কোন ঠিক আছে? কতদিন পর আসলে। তুমি চলে যাচ্ছ বলে, দাদাভাই আর দাদীরও মন খারাপ। ওরা তো তোমাকে কিছু বলতেও পারছে না, তাই আমি তাদের হয়ে বলছি। প্লিজ প্লিজ আর মাত্র দুটো দিন থেকে যাও।’
‘শোন আমি বলি, আর যদি দুইদিন থাকে তাহলেও তো আমাকে চলে যেতে হবে তাই না? তখন যাওয়া আর এখন যাওয়ার সমান’ই।’ বিষয়টা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল অনু।
অনিতা ছেড়ে দিল। বুঝতে পেরেছে, আর বলেও কোন কাজ হবে না। ফুপিকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ানো বহুৎ মুশকিল। তার মতো চুনোপুটির পক্ষে এটা সম্ভব না।
অবশেষে বিকাল নাগাদ অনু বের হলো। সাদাত হাসান অনেকবার বাসট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন। কিন্তু তাতেও তার বাঁধা। বলে, ‘জীবনের প্রতিটা ধাপ একা একাই পেরিয়ে এসেছি। যতদিন বেঁচে আছি আমাকে একাই থাকতে হবে। একলা চলাফেরার অভ্যাস আছে। আগে সমস্যা হতো, এখন আর কিছু মনে হয় না। একলা চলার পথে, একলা জীবনে কাউকে সাথে নিতে ইচ্ছে করে না। আসছি আমি। ভালো থেকো তোমরা।’
যাওয়ার আগে এটাই অনুর লাস্ট কথা ছিল। অনিতা এতক্ষণ মন খারাপ করে থাকলেও ফুপিকে বিদায় দিল হাসিমুখেই।
.
অনু রাজশাহী এসে পৌছালেন আটটা নাগাদ। রাস্তার ভালো রকম জ্যামে পড়তে হয়েছিল। নিজের বাড়ি এসে পৌঁছাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আজকাল বড্ড ক্লান্ত লাগে। এই পরিচিত শহরটাকেও অপরিচিত মনে হয়। অথচ এই শহরটা একটা সময় কী আপন ছিল। এই শহরে থাকা একটা মানুষ তার জীবনের সাথে অদ্ভুত ভাবে জুড়ে গিয়েছিল। এ শহর ভালোবাসার ছিল, ভালোলাগার ছিল, মনের সমস্ত মাধুরী মিশে গিয়েছিল। আর এখন? সব কেমন ছন্নছাড়া, কিছু ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজের কাছে বোজা মনে হয়। নিজেকে বহন করতে ভীষণ কষ্ট হয়!
জীবন যদি এমন হতো—কেউ কারো না, কেউ কাউকে চেনে না, অন্য কারো কষ্ট দেখে নিজের কষ্ট হবে না, কোনো পিছুটান থাকবে না, ভালোবাসা থাকবে না, মায়া থাকবে না। এ শহরের প্রত্যেকটা মানুষ হবে স্বার্থপর, যারা নিজের স্বার্থ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাবতে পারবে না।
অনুর এইরকম একটা জীবন হলে বেশ হতো, সে ভালো থাকত। সময় অসময়ে স্মৃতিরা এসে হামলা দিত না। সে মানুষটা আগাগোড়া পুরোটাই তো ভঙ্গুর। বেঁচে থাকার তাগিদে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, এই যা! স্মৃতির আগুনে পুড়ে দগ্ধ হতে হয় বারবার। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সময়টাতে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সেই চেনা মানুষটার কাছে। কিন্তু উপায় নেই। সে জীবনের এমন একটা গন্ডির মধ্যে বাজেভাবে ফেঁসে গেছে যে ওই গণ্ডির মানে আজও বোঝেনা।
আগে খুব কান্না পেত। এখন দু’চোখ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। একটু কাঁদতে পারলে নিজেকে হালকা মনে হতো। আশ্চর্য! আবেগ চলে গেল অথচ ভালোবাসা থেকেই গেল।
অনু উঠে বসল। নাহ এভাবে শুয়ে বসে সারাদিন স্মৃতিচারণ করলে হবে না। যে গেছে সে গেছেই। ওতো মনে করে কী লাভ? অনু ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় বের করতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করল, তার ডায়েরীটা নেই। নেই তো নেই’ই, সবকিছু বের করে কোণাকুণি খুঁজেও পেল না। আজব! তার স্পষ্ট মনে আছে, সে ডায়েরীটা ব্যাগে নিয়েছিল। তবে গেল কোথায়? মনের ভুলে আবার বাড়িতে ফেলে আসে নাই তো? বাড়িতে থাকলে নিশ্চিত পাবে, কিন্তু যদি অন্য কোথাও পড়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায়? তাহলে তো আর জীবনেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়! ওটা ছাড়া তার একমুহুর্তও চলে না, চলবে না। জীবনের না পাওয়া অধ্যায় সে ওই ডায়েরীর পাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। সে বেঁচে আছে ওসবেই। যেকোনো মূল্যে তার ওই ডায়েরীটা চাই’ই চাই।
.
অনিতা গিয়ে সবার ঘরে উঁকি দিয়ে এলো। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কেউ আর তাকে ঘাঁটাতে আসবে না। সে ঘরে এসে প্রথমে দরজা বন্ধ করল। তারপর নাচতে নাচতে বিছানায় এসে বসল। বালিশের নিচে হাত দিয়ে ডায়েরীটা বের করে আনল। জানে, একটা অন্যায় করে ফেলেছে ফুপিকে না বলে তার ডায়েরীটা এভাবে লুকিয়ে রেখে। কিন্তু এই অন্যায়টা করতেই হতো। বাকি সব কাহিনী তার জানতেই হবে। তাই যখন অনু নিজের কাপড়চোপড়ের সাথে ডায়েরীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিল, তখনই অনুকে আড়াল করে অনিতা ডায়েরীটা নিজের কাছে অর্থাৎ বালিশের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। ফুপি টেরও পায় নাই। সে সবকিছু ভুলে ডায়েরীর বাকি অংশে নজর দিল—
‘লজ্জা! লজ্জায় আমার পা ওখানেই আটকে গেল। আমি থমকে গেলাম, থমকে গেল আমার পুরো পৃথিবী। পেছন ফিরে তাকাতে পারলাম না। অবশ্য সে নিজে আবার সামনে এসে দাঁড়াল। ফের বলল, কথা বলছ না কেনো? বলো?
আমি কি বলব? আমার সারা দুনিয়া আমায় চক্কর দিচ্ছিল। মনে হচ্ছে, আর একটু সময় দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাব। পা টলছিল।
তবুও আমি জবাব দিলাম। কোথা থেকে আচমকা একরাশ সাহস এসে ভর করল। বললাম, আপনাকে আমার ভালোলাগে।
সে বলল, সারাদিন দেখতে ভালো লাগে।
আমি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলাম, আমি জানিনা।
সে আমায় বলল, যাও বাড়ি যাও। এই বয়সে ভালোলাগা বা ভালোবাসার চিন্তা মাথায় এনো না।
ওর কথাটা আমার পছন্দ হলো না তর্ক করতে ইচ্ছে হলো। ভালো আমি বেসেছি তাতে তার কী? বলে বসলাম, আমি ভালবাসলে আপনার সমস্যা কি?
সে প্রফুল্লচিত্তে হেসে বলল, আমার সমস্যা নেই বলছ?
আমি বললাম, বলছি’ই তো। আপনার কি সমস্যা?
ওর কথায় আমার মধ্যেকার সকল জড়তা এক নিমিষেই কেটে গিয়েছিল। সেদিন’ই প্রথম ওর সঙ্গে এত কথা হচ্ছিল। স্বপ্নের মত ঘোর ঘোর মনে হচ্ছে!
সে বলল, আমার’ই তো সমস্যা।
আমি জিজ্ঞেস করি, কি সমস্যা?
ও পুনরায় সুন্দর করে হাসে। হেসে জবাব দেয়, তুমি আমার মনের মধ্যে গেড়ে বসে থাকলে সেটা আমার সমস্যা হবে না?
আমি সাথে সাথেই তার কথাটা বুঝি নাই। উল্টো জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি তেড়ে এসে বললাম, মনের মধ্যে গেঁড়ে বসা মানে….?
ঠিক তখনই আমার খেয়াল হলো সে কী বলেছিল! ফের লজ্জায় লাল নিল বেগুনি হলাম। তার দিকে তাকাতেই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আর এক মুহূর্তও থাকতে পারলাম না সেখানে। ছুট্টে চলে এলাম ঘরে। এসে দরজা বন্ধ করলাম। নিজেকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছে! প্রেম সমুদ্রে ভাসতে গিয়ে নতুন আমিকে আবিষ্কার করেছিলাম। লজ্জায় আয়নায় মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করছিল। সেদিন আর আমি কারো সামনে যাই নাই। যদি ধরা পড়ে যাই…!’
২৩ মে, ২০০০.
এইটুকু পড়া শেষ হতেই অনিতার মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করল ফোনের আওয়াজ। সে উঠে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল ফুপি ফোন করেছে। কোন কিছু না ভেবে অনিতা ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে অনুর কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল, ‘অনিতা?’
‘জ্বী ফুপি, বলো।’
‘আচ্ছা শোন, তুই কি ঘরে?’
‘আমি আমার ঘরেই আছি। কেনো গো? তুমি ঠিকঠাক মত গিয়ে পৌঁছেছে?’
‘হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই পৌছালাম। বলছিলাম যে, আমার ঘরে গিয়ে একটু দেখবি আমি একটা ডায়েরী ফেলে এসেছি কিনা? ওটা আমার কাজের আই মিন পরীক্ষার সিডিউলগুলো ওখানে নোট করে রেখেছি। একটু দেখ তো সোনা। মনে হচ্ছে, ফেলে এসেছি।’
অনিতা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, ‘আচ্ছা আমি তোমার ঘরে গিয়ে দেখছি। তারপর পেলে তোমার ফোন করে জানাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’
ফোন রেখে অনিতা মুচকি হাসল। তবে একটু একটু অপরাধবোধ হচ্ছে, অন্যের অনুভূতি এইভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে জানার অপরাধে।
সে ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। পরের প্যারাটুকু পড়তে শুরু করল,
‘ওর সাথে আমার দেখা করতে এখন এত লজ্জা লাগে, যা বলার মত না। এতদিন আমি যেই কাজ করেছি এখন ও সে কাজ করছে। বুঝতে পারছি, ও আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে।’
২৫ মে, ২০০০.
এইটুকু পড়া শেষ করে এইবার অনিতা ফুপিকে ফোন করল। ডায়েরীটার উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ ফুপি পেয়েছি। ওটা কি করব?’
‘তোর কিছু করতে হবে না। যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দে। আমার প্রয়োজন ছিল, এখন তো আর যেতে পারতেছি না। দেখি আমি!’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
দুজনের মধ্যে আরও টুকটাক কথা হলো। তারপর অনিতা পরীক্ষার পড়ার দোহাই দিয়ে ফোন কেটে দিল। বাকিটুকু অনিতা আর পড়ার সুযোগ পেল না। মা খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করতে লাগলেন। অনিতা ডায়েরীটা নিজের ঘরে নিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়ার পর আহিরের ফোন পেয়ে তার সাথে ঘন্টাখানেক কথাবার্তা বলে সময় কাটিয়ে দিল। ভাবছে, ডায়েরী তো আপাতত তার কাছেই আছে। ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করে ফেলবে। সেগুড়ে বালি! অনিতার বাকিটুকু পড়াও হলো না, জানাও হলো না। পরদিন সকাল সকাল অনু লোক পাঠিয়ে দিল। তিনি এসে বললেন, ‘ম্যাডাম কী যেনো একটা ডায়েরী ফেলে গিয়েছেন। সেটা আমাকে দিতে বলেছেন।’
অনিতা আর কী করে আটকাবে? সে ডায়েরীটা দিয়ে দিল, দিতে একপ্রকার বাধ্য হলো।
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫৯৪