প্রাণপ্রিয় পর্ব-০৯

0
7

#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-০৯]
~আফিয়া আফরিন

অনুর কথাটা কানে পৌঁছাতেই যা দেরি হলো, হৃদপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে ততটাও দেরি হলো না। অনিতা উপুর হয়ে শুয়েছিল, তৎক্ষণাৎ ডায়েরীটা পেটের নিচে চালান করে দিল। ওভাবেই শুয়ে থেকে বলল, ‘এইতো শুয়ে আছি। তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?’

‘কোথায় আর তাড়াতাড়ি আসতে পারলাম? ইচ্ছে ছিল আরেকটু আগে আসব। নে ওঠ এইবার, মামি ফোন করেছিল। বলল, ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে। স্নেহাও নাকি এসেছে। আমার’ও যাওয়া পড়ে না অনেকদিন হচ্ছে। তুই এসেছিস শুনে তো জোরাজুরি শুরু করে দিল।’

অনিতা বলল, ‘আমি রেডি হচ্ছি।’

‘একটু তাড়াতাড়ি করিস সোনা।’ অনু তাড়া দিয়ে ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। অনিতা এতক্ষণের চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা উগড়ে দিল। দরজার দিকে তাকিয়ে উঠে বসল। ডায়েরীটা তার জায়গা মতো রেখে দিল। আজকে দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গেছিল। আরেকটু হলেই একটা সর্বনাশ হয়ে যেত। ভাগ্যিস, ভাগ্যিস আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। হাজারবার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনিতা উঠে পড়ল।
বাড়ি থেকে বের হতে প্রায় দুটো বাজল। ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিনটা। অনুকে বহুদিন পর দেখলেন তার মামী সায়রা। তাদের দেখে যে মন থেকে খুশি হলেন, তা কথাবার্তা এবং ব্যবহারে বেশ ভালো করেই বোঝা গেল। বছর পাঁচেক আগে মামা মারা যাওয়ার পর মামি বাসা থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই দেখা সাক্ষাতের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। তবে ফোনে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আর এইদিকে স্নেহার বিয়ের পর, সেও নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাচ্চাদের সামলাতে হয়, তাদের পড়াশোনা সহ প্রতিটি দিকে নজর রাখতে হয়। তাই, সব মিলিয়ে মায়ের এইদিকে খুব একটা আসা হয়না। তিনি বর্তমানে একা হয়ে পড়েছেন। আজ ঘরভর্তি মেহমান দেখে বোধহয় মুখে হাসি ফুটল। অনিতা এবং তার নাতনীদের নিয়ে তিনি গল্পের আসরে বসলেন।
‘তুমি তো আসো না দাদুমণি, তোমার ফুপি তোমার বয়সটাতে আমার এখানে থাকতেই বেশি পছন্দ করত। মামা বাড়ি রসের হাড়ি, শুনেছ না? ওর ভাষ্যমতে, ওর মামা বাড়ির চেয়ে বেস্ট মামা বাড়ি পৃথিবীতে আর একটাও নেই।’

অনিতা মনে মনে ভাবল, ফুপির ভালোলাগার মানুষটার বসবাস’ই যে ছিল এখানে। তার টানে টানেই তো বারবার চলে আসা।
গল্প শুনতে শুনতে অনিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি যাবেন না আমাদের বাসায়? কবে যাবেন বলেন? আমি চলে যাব কিছুদিন পরেই, আপনি যাবেন আমার সাথে? সারাদিন তো একা একাই থাকেন।’

তিনি সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘তুমি বলেছ এতেই আমি খুশি দাদু। অভ্যাস হয়ে গেছে। এই দেখো, বুড়ো হয়ে গেছি কেমন! কবে আল্লাহ ডাক দেয়, ইচ্ছে আছে স্বামীর ভিটায় মরব। তাই আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আমার মেয়েটা সবসময় বলে, ওর সাথে গিয়ে যেন থাকি। মন টানে না রে দাদু, একদম মন টানে না।’ শেষের কথাগুলো তিনি বেশ করুন সুরে বললেন। অনিতার খারাপ লাগল শুনে। মানুষের জীবন কত ক্ষণস্থায়ী!
ভালোবাসার কত নিদর্শন দেখল এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে। এই মানুষটা, যার সামনে সুযোগ রয়েছে যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আরাম আয়েশে থাকার। অথচ তিনি সব বিসর্জন দিয়ে, স্বামীর ভিটে আগলে বসে রয়েছেন। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বিশেষ প্রয়োজন নেই। তবুও যার সাথে জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন, যার বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছেন, যাকে ভালোবেসেছেন, আপন হিসেবে গ্রহণ করেছেন—সেই মানুষটার জন্য মুঠো মায়া নিয়ে তিনি আজও বেঁচে রয়েছেন।
আবার তার ফুপির ক্ষেত্রেও একি ব্যাপার! অনিতা পুরো বিষয়টা জানেনা। কিন্তু সে ধারণা করতে পারে, তার ফুপির জীবনে ওই ছেলেটাই প্রথম আসে। ওইটাই প্রথম ভালোবাসা এবং শেষ ভালোবাসাও। কোনো একটা কারণে বিচ্ছেদ হয়েছিল, যার ফল এখনকার সময়টা। কেউ কেউ স্মৃতি বুকে আগলে বাঁচতে চায়, আবার কেউ কেউ সেই স্মৃতির মধ্যে নিজেকে একটা চরিত্র বানিয়ে নেয়। এখন তো আবার ভালোবাসার জন্য মানুষ আত্মহত্যা করে, স্মৃতি হত্যাও করতে চায়। দুনিয়াতে এত এত অনুভূতি, তারমধ্যে কার ভাগ্যে কোনটা আছে কে জানে?
.
মামী সায়রা সেদিন আর অনুকে ছাড়লেন না। অনুর’ও যেতে ইচ্ছে করছিল না। আসা হয় না অলসতার কারণে, আবার এলে যেতে ইচ্ছে হয় না মায়ার কারণে। অনিতাকে সাথে নিয়ে থেকে গেল। এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় তার স্মৃতি, ওই মানুষটার স্পর্শ। ছাদে উঠলে বা’পাশের রেলিংয়ের দিকে তাকালে অনুর মনে পড়ে যায় তার কথা! রাতের আঁধারে এইখানে দাঁড়িয়ে কত অব্যক্ত ভালোবাসার কথা বলেছে দু’জন।
সে হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল, ‘আমার জীবন থাকতে তোমার হাত আমি ছাড়ব না অনু। বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত আমি তোমার হয়েই থাকব, দেখে নিও তুমি।’

অনু উত্তরে কিছুই বলত না। সে শুধুমাত্র তার কথায় ভরসা খুঁজে বেড়াত। অনু এক লহমায় সেই মানুষটায় খুব বাজেভাবে মত্ত হয়ে গেছিল। সে যদি হাস্যরসে কখনো বলত, ‘মাছ পানিতে নয়, আকাশে থাকে।’ অনু সেটাও নিঃশব্দে বিশ্বাস করে নিত। তার কোনো অভিযোগ ছিল না, মাঝে মাঝে একটু আধটু অভিমান করত!
একটা ঘটনা মনে পড়ল তার—রোজার ইদের পর মা-বাবসহ সবাই বেড়াতে এসেছে মামার বাড়ি। ও তখন এখানে ছিল না, ইদের ছুটিতে বাড়িতে গেছে। তবে অনুর জানামতে, ফিরে আসবে শীঘ্রই। সে প্রতিদিন অর্থাৎ দিনের মধ্যে যখন’ই সময় পায় তখন’ই ছাদে এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার দেখা মিলে না। অবশেষে একদিন সন্ধ্যার পর তার দেখা মিলল। অনু ছাদে দাঁড়িয়েই নিচে দু’টো ঢিল ছুড়ে মারল, যাতে তার গায়ে না পড়ে। তারপর নিজে সরে গেল। গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়াল, চুলগুলো সামনে এনে পুরো মুখটা ডেকে দিল। এইদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। সিঁড়িঘর দু’তলার পর থেকে অন্ধকার। এইখানকার লাইটগুলো ফিউজ হয়ে যাওয়ার পর আর ঠিক করা হয় নাই।
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। তারমানে ও উঠে আসছে। অনু মাঝখানে দাঁড়াল। এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তাকে দেখে শ্যাওড়া গাছের পেত্নী মনে হয়। পায়ের শব্দ যখন কাছাকাছি এগিয়ে এলো তখন অনু বলে মোটা স্বরে বলে উঠল, ‘হাউমাউ খাই, মানুষের গন্ধ পাই। হিহিহি, কে রে তুই?’
সামনে থাকা মানুষটা হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। সে ধমক দিয়ে বলল, ‘এই এই, তুই কে?’

‘আমি বামনের বউ, হাহা হাহা। কতদিন মানুষের রক্তের স্বাদ পাইনা। আয় আজ তোর ঘাড় মটকে দেই।’
অনুর পরিকল্পনা পুরোটাই ভেস্তে গেল, যখন সে তার মামার কন্ঠস্বর শুনতে পেল। তারমানে এতক্ষণ মামা এখানে ছিল! অনু মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো সামনে থেকে সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিল। মামার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মামা তুমি?’

আফওয়ান রহমান বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘অনু তুই? তুই এতক্ষণ এসব করছিলি? তুই কি ছাদে ছিলি? ছাদ থেকে নিচে ঢিল কে ছুড়ে মেরেছে? আমার মাথায় এসে পড়েছে।’
অনু ততক্ষণে মামার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নাটের গুরুকে দেখতে পেল। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘মামা আমি তো মাত্র’ই নিচ থেকে এলাম। স্নেহাকে আসতে বলেছিলাম। ভেবেছি ও এসেছে, তাই ও মনে করে তোমাকে ভয় দেখিয়েছি। সরি সরি, আমি একদম বুঝতে পারিনি এটা তুমি!’

তিনি বললেন, ‘তুই কি ছাদ থেকে কাউকে নামতে দেখেছিস? আশ্চর্য, এভাবে অভদ্রের মত ঢিল কে মারল?’

অনু বলল, ‘আমি খেয়াল করি নাই মামা। আগে জানলে তো, দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম।’
মামা কিছুক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করলেন। তারপর অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এদিকে আর কী? যা ঘরে যা।’
তারপর পাশে থাকা ছেলেটাকে বললেন, ‘যাও তুমিও যাও। আমি দেখছি ঢিল ছোড়াছুড়ির বিষয়টা।’
মামা নিচে নেমে গেলেন। অনু চাপা স্বরে হাসল। সে এগিয়ে এসে বলল, ‘কবে এসেছেন আপনি?’
অনু হাতে গুনে গুনে দেখাল আজ নিয়ে ছয়দিন হবে তাদের এখানে। ও বলল, ‘বামনকে বিয়ে কবে করলেন?’

‘মানে?’

‘এইতো কিছুক্ষণ আগে আপনার মামাকে বললেন, আপনি বামনের বউ। কী দোষ ছিল আমার যে আমাকে রেখে আপনার বামনকে বিয়ে করে নিতে হলো। বলুন?’
সে এগিয়ে এসে অনুর মুখোমুখি দাঁড়াল। অনু দু’কদম পিছিয়ে যেতে নিলে সে হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। অনু মাথানিচু করে বলল, ‘আমি তো দুষ্টুমি করে বলেছি।’

‘তাই?’

‘হুমমম। এখন হাত ছাড়ো। মামা ডেকে গেল, নিচে যাই। কাল তোমার সাথে দেখা করব।’

‘আর যদি না ছাড়ি?’

‘কেনো ছাড়বে না?’
সে নিজের গাল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা চুমু দাও, তাহলে বিনা বাঁধায় ছেড়ে দিচ্ছি।’

‘কেনো চুমু দিব?’

‘ওমা! এতদিন মিস করেছি, আজ তা পুষিয়ে দিবে না? দাও দাও, জলদি দাও। নাহলে আজ আর ছাড়ছি না।’

অনু বলল, ‘না, দিব না।’

সেও একরোখা আর জেদি কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিও ছাড়ছি না।’

‘আমি তো চাইনা তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। তবে এত প্রেম বুকে নিয়ে আমিও যে হারিয়ে যাব। আমি তো আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তোমার সাথেই আবদ্ধ থাকতে চাই। আমার প্রতিটা আনন্দে তোমাকে পাশে চাই, আমার কষ্টে তোমার ভরসা চাই। তবে ছাড়বে কেন বলো?’
সে যদিও দুষ্টুমি করছিল অনুর সাথে, কিন্তু অনুকে এভাবে কথা বলতে দেখে আবেগে ত্বরান্বিত হয়ে উঠল। অনু ততক্ষণে ওর হাতের বাঁধন থেকে নিজের হাত আলগা করে নিয়েছে। সে একটু সুযোগ পেতেই দৌড়ে দূরত্বে চলে এলো। খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘হেহে, আমাকে আর ধরতে পারবে না।’

ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘আপাতত ধরব না। তবে আমার আবেগ নিয়ে খেললে তো? ঠিক আছে, আমিও তোমার মামাকে বলে দিব তুমি উপর থেকে ঢিল ছোড়াছুড়ি করছ।’
অনু হেসে উঠল সশব্দে। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় সে হাসিটা বারবার এসে বুকের মাঝ বরাবর ধাক্কা খেতে লাগল। অনু পিছিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘মামা তোমার কথা বিশ্বাস করবে নাকি? যাও গিয়ে এক্ষুনি বলো। আর হ্যাঁ, প্রমাণ অবশ্যই সাথে নিয়ে যাবে। আছে? নাই তো। হিহিহি, লবডঙ্কা।’
অনু নিচে নেমে গেল। সেও মুচকি হাসল। মনে মনে বলল, ‘পাগলী মেয়ে একটা!’
পাগলীই বটে! পাগলী বলেই তো পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল। নিজের জীবনের ভালো থাকা পুরোটাই তুলে দিয়েছিল অপর পক্ষেরই মানুষটার হাতে। অনু শুধু নিজেকে নিজে খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখত—এই যা। আর সে? তার নিঃশ্বাসের বিনিময়ে’ই অনুর বেঁচে থাকা।

আজকাল বড্ড মনে পড়ে সেসব স্মৃতি। কত আর পালিয়ে বাঁচবে? যতবার পালাতে চেয়েছে, ততবার ধরা পড়েছে। একটা সময় দরজা বন্ধ করে নিজেকে সম্পূর্ণ একা করে, হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেছে। সারারাত কেঁদে কেঁদে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়েছে, বুক ভাসিয়েছে। তাই এখন আর কান্না পায় না। শুধু বুকের ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে।
নিজেকে অগণিতবার বুঝিয়েছে, ফাঁকি দিয়েছে—কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। এই বাড়ির কোথায় যাবে সে? প্রতিটা আনাচে কানাচে তার স্পর্শ। সমস্ত অভিযোগ তো তার নিজের প্রতি। তার ভালোবাসায় খামতি রয়ে গিয়েছিল, তা না হলে তার’ই কেন শুধু মানুষ হারাল? এখন অবশ্য সবটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। আর কষ্ট লাগে না। শুধু মাঝে মাঝে নিজেকে একটু দুর্বল মনে হয়, তখন আর কিছু সহ্য করতে ইচ্ছে হয় না।
.
অনু অনিতাকে নিয়ে ওখান থেকে দু’দিন পর ফিরে এলো। মামী তবুও ছাড়ছিলেন না, এইদিকে অনুর কাজকর্ম রয়েছে। সে অবশ্য আসার আগে কথা দিয়ে এসেছে, যখনই সময় পাবে তখনই চলে আসবে। অনিতা সারাদিন তক্কে তক্কে থাকল, ডায়েরীটা হাতে পাওয়ার জন্য।
অবশেষে পরদিন সকালে অনু বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগটা এলো। আজ অনিতা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে বসল। তিনদিন পর….. তিনদিন পর সে ডায়রীটা স্পর্শ করল। তারপর সেদিনের পর থেকে বাকি অংশটুকু পড়তে শুরু করল—
…….. ওর নির্বিকার ভঙ্গি দেখে আমার রাগ তিরতির করে বাড়ছিল। আশ্চর্য একটা মানুষ। ইচ্ছে করছিল পাশের ড্রেনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। ওর সাথে কোথায় যাচ্ছি জানিনা। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমার তাড়া আছে আজ। মা দ্রুত বাসায় ফিরতে বলেছে, কোথায় যেন যাবে।’
ও থমকে দাঁড়াল, সাথে আমিও। দাঁড়িয়ে আছি একটা প্রকাণ্ড বটগাছের নিচে। কতক্ষণ আমার জানা নেই, তবে অনেকটা সময় পর্যন্ত ও পলকহীন আমার দিকে তাকিয়ে রইল। জানতে চাইলাম, ‘এইভাবে নির্লজ্জের মত তাকিয়ে আছো কেন?’

সে উত্তরে বলল, ‘দেখছি। পুরনো প্রেমকে নতুন রূপে আবিষ্কার করছি। আজ কেন এলাম বলো তো? এই যে তোমার চোখের মায়ায় আটকে গেলাম। টানা টানা চোখে গভীর কালো কাজল, গোলাপী রাঙা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি—সবটাই আমায় বেঁধে ফেলেছে। কি করে ফিরে যাই আর কি করে তোমায় ছাড়ি?’
এতক্ষণের রাগ অভিমান কর্পূরের মত উবে গেছে, সেখানে এসে ভর করেছে একরাশ লজ্জা। আমি এতটাও চাইনাই ওর কাছে। পথে চলতে চলতে ভেবেছিলাম, ওর দশ বাক্যের প্রশংসায়’ও হয়ত আমার কিছুই হবে না; কিন্তু এখন দেখছি কাহিনী পুরোই উল্টো। এত লজ্জা পাচ্ছি কেন আমি? ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। ও বোধকরি বুঝেছিল আমার পরিস্থিতি। নিজে থেকেই বলেছিল, ‘চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আমি বরং আজ তোমার মায়া নিয়েই ফিরে যাচ্ছি, তারপর অপেক্ষা করব। এই রূপেই একদিন আমার হয়ে ধরা দিবে। তখন আর কোন দ্বিধা থাকবে না, বাঁধা থাকবে না।’
আমিও হন্যে হয়ে অপেক্ষা করি সে দিনটির জন্য। আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি, সেই প্রতীক্ষিত দিনটি আসবে আমাদের জীবনে।”
০১ অক্টোবর, ২০০০.
.
.
.
চলবে…..