প্রাণপ্রিয় পর্ব-১৭

0
51

#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৭]
~আফিয়া আফরিন

“ভাইয়ার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে, এত্তো কিউট দেখতে! মনে হয়, সারাক্ষণ কোলের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি। কিন্তু তার উপায় আছে কি? মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য একটুতেই কান্না জুড়ে দেয়। ভাবিকে বললাম, ‘ওর নামটা আমি রাখি?’
ভাবি বলল, ‘ঠিক করেছ নাম? শুনি তো।’
আমি বললাম, ‘মাহজাবিন নূর অনিতা।’
নামে কারো কোনো আপত্তি রইল না। নিজের নামের সাথে মিলিয়েই রেখে দিলাম।”
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬

“আমার অনি চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। আমার একাকীত্বের জীবনে সৃষ্টিকর্তা ওকে আশাসরূপ পাঠিয়েছেন। মেয়েটা আমার ন্যাওটা। সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুরঘুর করে। ওরে বাবা, আমার’ও তো কাজ আছে নাকি। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি না। কত্ত কাজ! তারমধ্যে নিজের জীবনের ঝামেলা তো আছেই। মা এখনো আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছে। দু’দিন পর পর একটা করে ছেলের ছবি দেখাবে আর বলবে, ‘এই ছেলেটা ভালো। সরকারি চাকরি করে। ওমুক ভালো, ডাক্তার। তমুক ভালো, ব্যাংকার।’ আমি পাগল হয়ে যাই। কাউকে আমার মনে ধরে না। ধরবে কী করে? মনের মধ্যে একজন যে গেড়ে বসে রয়েছে। মায়ের অত্যাচারে মনে হয়, বাড়িতে থাকতে পারব না। খুব শীঘ্রই চলে যেতে হবে এখান থেকে।”
০২ জানুয়ারি, ২০০৭.

“বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনলে মা কান্নাকাটি করে বুক ভাসায়, আমাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। আমাকে এতদিন মা ব্যতীত অন্যকেউ বিয়ের কথা বলত না। আজ ভাবি খুউব ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘অনু তুমি বিয়েতে রাজি কেনো হচ্ছো না? মা তোমাকে নিয়ে সবসময় কতো চিন্তায় থাকে জানো?’

‘আমাকে নিয়ে চিন্তার কি আছে ভাবি? আমি কি ছোটো? যথেষ্ট বড় হয়েছি, স্বনির্ভর হয়েছি, নিজেরটা নিজে বুঝি। তাহলে?’

‘এসব বাদেও, একলা জীবন কাটানো যায় না।’

‘আমার ওতো সংসার সম্পর্কে তোমাদের মত এক্সপিরেয়েন্স নাই। আমার দ্বারা ওসব হবে না।’ কথা কাটাবার চেষ্টা করলাম আমি।

ভাবি ফের বলল, ‘এক্সপিরিয়েন্স? এটা কার থাকে? আমার ছিল? আমি এখন সংসার করছি, অনিকে সামলাচ্ছি। এটা মেয়েদের জীবন, মানিয়ে নিতে হয়, একসময় অভ্যাস হয়ে যায়।’
আজ ভাবি আমাকে এসব বলছে, অথচ আমি সবটাই জানি, সবটাই বুঝি। সংসারের সাধ আমার’ও ছিল। সুন্দর একটা জীবন হবে, ছোট্ট একটা বাড়ি হবে, আমি আর ও থাকব। বর্তমানে শুধু আমি আর আমার স্বপ্নগুলো রয়ে গেছে। ও তো অন্যের সংসার সাজাতে ব্যস্ত।
ভাবিকে শুধু বললাম, ‘আমাকে সংসারের লোভ দেখিয়ো না। সংসারের ওজন আমি বইতে পারব না, এ আমার দ্বারা কখনোই হবে না।’
তারপর ভাবি আর কিছু বলল না। আমিও অনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলে, একদম বুকে গিয়ে লাগে। আমাকে কিন্তু সে ফুপি বলে ডাকে না, সবার দেখাদেখি অনু বলে ডাকে।’
১৬ আগষ্ট, ২০০৬.

“কাজের চাপ হু হু করে বাড়ছে। নিজেকে একটুও সময় দিতে পারছি না। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয়, এটা আসলেই আমি? একদম বদলে গেছি। অবশ্য বদলটা প্রয়োজন ছিল নিজের জন্য’ই। এখন একটু হলেও নিজেরটা বুঝতে শিখেছি। কাকে বিশ্বাস করা যায়, আর কাকে করা যায় না, তা এতদিনে বুঝেছি। আসলে মানুষ ধাক্কা খেয়েই সব শিখে। আমি তো আমার জীবনের বিনিময়ে বাস্তবতা শিখেছি….. তাও কত দেরিতে! যাইহোক, তবুও শিখেছি এটাই স্বার্থকতা। কোনো না কোনো একদিন তো কাজে লাগবে।”
২৩ অক্টোবর, ২০০৬.

“প্রতিটা মানুষের জীবনেই নির্দিষ্ট একটা জায়গা আছে। আশেপাশে মানুষজনকে দেখি তো! নির্দিষ্ট একটা মানুষ থাকায় তারা কত সুখী! এই সুখটা আমার কপালে ছিল না। হিংসে হয় মাঝেমধ্যে এই দুনিয়াকে। অভাববোধ করি ভালোবাসার, ভরসা দেওয়া মানুষের। আহা! এক জনমের আফসোস আমার। আমার একটা মানুষ হইলো, আমি একটু ভালোবাসা পাইলাম না। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে থাকি, বাহিরে পড়লে যদি ওর জীবনে কোনো ঝড় আসে? ও ভালো থাকুক, আমি মনেপ্রাণে তা চাই। হোক না অন্য কারো, একদিন তো আমিই ভালোবেসে ছিলাম….এখনও বাসি! আমার ভালোবাসা ভালো থাকুক, যত্নে থাকুক, মায়ায় থাকুক!”
১৮ জানুয়ারি, ২০০৭

“দেখতে দেখতে জীবন থেকে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল। স্মৃতিগুলো বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু বর্তমানে তা ঝাপসা। এখন আর নিজেকে মোটেও অসহায় মনে হয় না। আমি কেনো অসহায় হব? আমার জীবনে সব আছে…. সব! আর সবচেয়ে বড় কথা, এখন আমার অনি আছে। মেয়েটা আমাকে এতো ভালোবাসে কেনো বুঝি না। ভাবির কাছ থেকে শুনলাম, আজ যখন আমি অফিসে ছিলাম ও নাকি আমার কাপড়-চোপড় জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে। আমি বাড়ি আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘তুমি কেনো তালাতালি বারি আসো না ফুপ্পি? তোমাতে আমি অনেত বেশি মিছ কলি।’
আমি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাই। বাচ্চারা বুঝি এমনই হয়। এত নিষ্পাপ! এত প্রাণবন্ত!”
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১০.

“ফাইনালি পোস্টিং হয়েই গেল, সেই রাজশাহীতে। ফের ফিরে যেতে হবে সেই শহরে। ওই শহরটা আজ’ও ভীষণ প্রিয়, সযত্নে বুকের ভেতর রেখে দেওয়া মানুষটাও। বাড়ি ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগবে। মা আর ইদানিং বকাবকি করে না, বয়স হয়ে গেছে কিনা! অনি’টাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। কী আর করব? ওকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার মত অধিকার আমার নেই।
গ্রীষ্মকাল প্রচুর গরম পড়েছে। এই রাতের বেলাতেও ফ্যানের নিচে বসে থেকে ঘামতেছি। পৃথিবীটা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার সেই ১০-১৫ বছর আগের চেনা ঢাকা শহর কেমন বদলে গেল এক পলকেই। কত নিত্যনতুন আবিষ্কার…. মানুষকে মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। মানুষ এখন’ই অনেকটা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। এরপর কী হবে কে জানে? আমাদের সেই নব্বই দশক’টাই ভালো ছিল। অন্তত মানুষের জন্য মানুষ পাওয়া যেত। এখন যেদিকে তাকাই সবটাই কেমন অনুভূতিশূন্য, ভাবলেশহীন, ভোঁতা মনে হয়। কোনোকিছুতে আগের মত আনন্দ নেই, আন্তরিকতা নেই। দেখলে খারাপ লাগে, তবুও নিজের তাগিদে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে হয়…. বেঁচে থাকতে হয়।”
১৭ এপ্রিল, ২০১৩.

“সময়গুলো খুব একটা খারাপ কাটছে না। নিজেকে সবসময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখলে ওর কথা মনে পড়ে না। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে! একটা ছবিও কখনো রাখার প্রয়োজন বোধ করি নাই। তখন কি আর এখনকার মতো এতকিছু ছিল নাকি! একটা ছবি রাখতেও বহুত আয়োজন। তবে মনের মধ্যে একটা ছবি সযত্নে আমি নিজে এঁকে রেখেছি। ওটাই দেখি, ওল্টাতেই হাত বোলাই। আমি নিজের কাছে নিজে ঠিক রয়েছি! ওকে এখনও, আজও ভালোবাসি; তারমানে আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না, আমার ভালোবাসায় প্রতারণা ছিল না। নিজে নিজের কাছে ঠিক থাকলে আর কী লাগে? যার যা ইচ্ছে হয়, করুক!”
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫.

অনিতা ডায়েরীটা বন্ধ করল। মনটা বিষন্ন লাগছে, আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। ওই মানুষটা এমন কেনো করল? ভালোবাসলো একজনকে আর বিয়ে করল আরেকজনকে? মানুষ কীভাবে পারে? স্বার্থপর, নিষ্ঠুর মানুষদের বুঝি এত রূপ! অনিতা ডায়েরীর বাকি লেখাটুকু রাতে পড়বে বলে, এখন রেখে দিল। কিন্তু সে রাতে অনু আর আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়ল না। অনিতাকে দ্রুত ঘুমাতে বলল কারণ পরদিন তার মেহেদি ও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। অনিতা অবশ্য ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল। তার ফুপিকে দেখতে পেল ডায়েরীটা হাতে নিয়ে কিছু লিখতে! আশ্চর্য হলো, এখনো ফুপি ডায়েরী লেখে? কাল-পরশু, তার পরদিন ব্যস্ততা। তারপর অনিতা নিজের শ্বশুর বাড়িতেই। ডায়েরীটা সময় করে কাল পড়তেই হবে, শেষ করতে হবে। এখন আর সুযোগ নেই। সে অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।
অনু লিখছে তো লিখছেই, চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে লেখার ইতি টানল—
“তোমার প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই…. অধিকার নেই। সব হারিয়েছি আমি। এমনকি এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষাও! দেখা না পেলেই বোধহয় ভালো হতো, অপেক্ষায় থাকতাম আমি। অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার আগেই খায় দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিতে হতো। এই যে তোমার দেখা পেলাম, অন্যজনের সাথে তোমায় দেখলাম—সহ্য তো করতে পারছি না। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। এই ডায়েরীতে তোমাকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, এতদিন অন্য মানুষের জিনিস নিয়ে আমি এত আবেগ দেখিয়েছি। নিজেকে ভীষণ খারাপ মনে হচ্ছে, স্বার্থপর ‘ও।’
.
সকাল সকাল অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। প্রথমে মেহেদি পড়ানো হলো। তারপর গায়ে হলুদ! হলুদের অনুষ্ঠান বাসায় করা হয় নাই, কমিউনিটি সেন্টারে করা হয়েছে। ওখানেই দু’পক্ষের সবাই উপস্থিত হবে। দুপুরের পর সবাই বেড়িয়ে গেল। আহিরদের বাড়ির সবাই ‘ও সেই সময় রওনা দিয়েছে। ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে হয়, তাই অনিতা ফোন করে বকবক শুরু করে দিয়েছে, ‘এত দেরি কেনো? আমার বেলায় সবসময় তোমার দেরি করা লাগে। এখন বন্ধু-বান্ধব ডাকলে তো রকেটের গতিতে ছুটে যেতে।’

আহির বলল, ‘আরে বাবা কিছুতেই আসবে না, তাকে রাজি করাতে করাতেই দেরি হয়ে গেল। মনে হয়, বাবার শরীরটা একটু খারাপ। কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি অন্যমনস্ক থাকছে সবকিছুতে। বড় ছেলের গায়ে হলুদ, না এলে খারাপ দেখাবে না? তাই বহু কষ্টে ম্যানেজ করলাম।’

‘তাহলে আংকেল এখন আসছেন তো তোমাদের সাথে তাইনা?’

‘হুম।’
সবকিছুর বন্দোবস্ত আগে থেকেই করা হয়েছিল। এখন শুধুমাত্র ছেলে চলেই এলেই দু’জনকে হলুদ দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া হবে। অনু অনিতাকে এসে বলল, ‘কিরে আহিরকে ফোন দে। কখন আসবে শোন। তোর মামাতো ভাই/বোনদের তো তর সইছে না।’

‘আসছে ফুপি। আংকেল নাকি আসতে চায় নাই, ওনাকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসতেই একটু দেরি হয়ে গেছে। পথিমধ্যে আছে, আমাকে বলল আর ২০/২৫ মিনিটের মধ্যে নাকি পৌঁছে যাবে।’

‘তোর শশুর আসতে চাইছে না কেনো? কী সমস্যা?’

‘সমস্যা না, ওনার শরীর খারাপ শুনলাম।’

‘ওহ আচ্ছা, তুই এখানে একলা বসে কি করছিস? যা ওখানে যা। এখনও বসে প্রেম করতে হবে। আজকের এই দিনটুকু শুধু অপেক্ষা কর, কালকের পর তো এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে কথা বলতে হবে না। এখন উঠ দেখি, ওরা এলো বলে!’
অনিতা উঠে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই আহিরদের বাড়ির সবাই চলে এলো। তারপর সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনু দেখল, তার সেই বহু প্রতীক্ষিত মানুষটিকে!
চেহারা সুরত বদলায় নাই খুব একটা, শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। আচ্ছা ওর সাথে কী কথা বলা যায়? কিছু মনে করবে ও বা অন্যকেউ? না থাক! দূরের মানুষ দূরেই থাকুক, আলগা পিরিত দেখানোর কোনো দরকার নাই। অনু গিয়ে অনিতার পাশে দাঁড়াল। এক পর্যায়ে হলুদের ছোঁয়া দিয়ে দিল, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ কামনা করে নিজের জায়গায় ফিরে এলো।
উনি এখনও আগের জায়গায়’ই দাঁড়িয়ে। নাহ, এখানে থাকা যাবে না। অতীত বারবার পিছু ডাকছে। ওখানে সবাই কত্ত মজা করছে আর সে তার অতীত নিয়ে ব্যস্ত! নাহ, দরকার নেই এসবের। তবে সকলের এই ব্যস্ততার মাঝে তাকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত তো, কেনো সে এমন করল?
অনুর তাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল না। সে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। হঠাৎ আচমকা আকাশ বাতাস সব ছাপিয়ে কর্ণকুহরে ভেসে এই সেই চেনা পরিচিত কণ্ঠস্বর, ‘অনু……!’
অনু দাঁড়িয়ে গেল, থমকে গেল, স্তব্ধ হয়ে গেল!
.
.
.
চলবে……
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫১৭