#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৯]
~আফিয়া আফরিন
অনিতা সে রাতে ডায়েরীটা বহুত খুঁজল, এমনকি তার ফুপির ব্যাগেও। কিন্তু কোথাও পেল না। সবসময় তো চোখের সামনেই থাকে, আজ আবার কোথায় গেল? ফুপি কি কোনোভাবে তার লুকিয়ে ডায়েরী পড়ার ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে? কিংবা বুঝে ফেলেছে? এইরকম তো হওয়ার কথা নয়। আর মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকি ছিল। অবশ্য অনিতার যেটুকু জানির ছিল, সে জেনে নিয়েছে তবুও মনের মধ্যে একটা খচখচানি থেকেই যায়।
অনিতাকে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করতে দেখে অনু বলল, ‘কী সমস্যা তোর? যা তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’
‘ঘুম আসছে না তো। আমি ঠিক বিয়ে বিয়ে ফিল’ও পাচ্ছি না। কী করি বলো তো?’
‘এই তোর কান্না পাচ্ছে না, কাল তুই চলে যাবি? একবারও তো মন খারাপ করতে দেখলাম না। উল্টো নাচতেছিস, গান গাচ্ছিস; সব’ই ঠিক আছে কিন্তু তোর কান্না পাচ্ছে না কেনো? আজব।’
অনিতা গালে হাত দিয়ে বলল, ‘আমিও তাই ভাবছি। আমার কেনো একটুও খারাপ লাগছে না কেন? এরপর তো মানুষ বলবে, কী নির্লজ্জ বউ রে বাবা একটুও কান্নাকাটি না করে বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নিল। ছিঃ ছিঃ!’
অনু হো হো করে হেসে উঠল। অনেকদিন পর মনে হয় এমন একটা মজার কথা শুনেছে।
অনিতাকে বলল, ‘আমি বাবা কখনোই মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। তাই তো বিয়েই করলাম না। তোর মত তো আর আমি আবেগ বিসর্জন দিয়ে বসে থাকি নাই যে কান্নাকাটি করব না।’
‘এখন করো। আমি আর আহির মিলে তোমার জন্য পাত্র খুঁজব। বলো, কেমন বুড়ো তোমার পছন্দ?’
অনু হেসে ফেলল। বলল, ‘বুড়ো? কেনো রে আমি কোনো হ্যান্ডসাম ড্যাশিং ছেলে পাব না?’
অনিতা বিস্ময়ের ভাব নিয়ে বলল, ‘ওমা! তোমার মনে এই চলে তাইনা? দাঁড়াও দাঁড়াও, দাদীকে বলছি। দ্রুত তোমাকে বিয়ে দিতে হবে। সমস্যা নাই, কাল আমার অনেক দেওর প্লাস আহিরের বন্ধুরা আসবে ওদের মধ্যে থেকে কাউকে পছন্দ করে নিও। তোমার কাজ হচ্ছে শুধু পছন্দ করা, বাদবাকি সব দায়িত্ব আমাদের। দরকার পড়লে আমাদের বিয়ের কাজি সেই লগ্নে তোমাদের’ও বিয়ে পড়িয়ে দিবে।’
‘হয়েছে। আমার বিয়ের চিন্তা তোমার করতে হবে না। তুমি গিয়ে ঘুমাও। কাল তোমার বিয়ে। বিয়ের দিন কনে যদি পড়ে পড়ে ঘুমায় তাহলে তো সমস্যা। যা যা, শুয়ে পড়।’
‘তুমি ঘুমাবে না?’
‘হুম। আসতেছি। তুই যা আগে।’
অনিতা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়ল। অনু অনেকক্ষণ যাবত জেগে থেকে মাঝরাতে ঘুমাতে গেল।
.
সকাল সকাল বাড়িতে শোরগোল। রুবির কোনো কাজে মন বসছে না, মন খারাপ সাদাত হাসানের’ও। তাদের এই একটাই মেয়ে, আজ পর হয়ে যাবে। ছোটো বেলা থেকে মেয়েটাকে কোলেপিঠে, আদরে, আহ্লাদে বড় করে আজ অন্যজনের হাতে তুলে দিতে কেমন যেনো লাগছে।
বিয়ে শাদীর দায়িত্ব যে যার মত কাঁধে তুলে নিয়েছে। রুবি সেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘরে বসে আছেন। কাজের কাছে গিয়ে একবার দেখেনও নাই। মেয়ের মায়েদের নাকি সবসময় শক্ত থাকতে হয়, কিন্তু তিনি পারছেন না। অনিতার মুখের দিকে তাকালেও চোখে পানি চলে আসছে। এতদিন ভেবেছেন, মেয়ে বড় হয়েছে। তার বিয়ে দিতে হবে।
আজ আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কী হবে মেয়েটাকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিলে? ওমনি ডাক পড়ল শাশুড়ির। তিনি এগিয়ে গেলেন। অনিতাকে দেখতে পেলেন সেখানেই। মেয়েটার মুখটা কেমন শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। সবার সাথে কাজে হাত লাগালেন। অভ্যাসবশত অনিতাকে একটা কড়া ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কি করছিস? যা, নিজের ঘরে যা। একটু পর বের হতে হবে তো নাকি সবাইকে। সবাই দ্রুত হাতের কাজ শেষ করো।’
অনিতা সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল। অনু বলল, ‘আজকের দিনেও তুমি মেয়েটাকে বকাবকি করছ?’
আরেকজন পাশ থেকে বলে উঠলেন, ‘ওই তো এরপর আর বকাবকি করতে পারবে না, তাই এখুনি করে নিচ্ছে। তাই না?’
তারপর হাসির ঢল। রুবি গজগজ করতে লাগলেন। অনু বলল, ‘তোমার মন খারাপ বুঝেছি। আর মন খারাপে তুমি যে সবাইকে ধমকাধমকি করো, সেটাও আমি জানি। আজ আর মেয়েটাকে কিছু বলো না। কাল রাত পর্যন্তও ঠিকঠাক দেখেছি, আজ সকাল থেকে মন খারাপ। কথাও তো বলল না। চুপচাপ মায়ের পাশে এসে বসে ছিল। তুমি বরং অনির কাছে যাও। আমরা এইদিকে সবটা সামলে নিচ্ছি। এখানে তো আর কাজ তেমন কিছু নাই। তুমি ওর সাথে কথা বলে এসো, তারপর আমরা সবাই মিলে ওকে সাজাতে নিয়ে যাব। যাও।’
রূবি উঠলেন। তার আসলেই মেয়ের কাছে যাওয়া উচিত। আজ সারাক্ষণ অর্থাৎ মেয়ে যতক্ষণ নিজের আছে ততক্ষণ মেয়েকে কাছে কাছে রাখা।
সকাল থেকেই অনিতার মনটাও খারাপ। রাতে কীসব কীসব স্বপ্ন দেখেছে। মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছে। মা কতবার কত বকাবকি করেছে, সেও মন খারাপ করেছে, জেদ ধরে বসে থেকেছে, অভিমান করেছে, বাবার কাছে অভিযোগ করেছে। কিন্তু আজ যেই মুহুর্তে মা এসে একবার ডাকল ‘অনি’ বলে, একবার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল; ওমনি সবকিছু কোথায় যেনো উধাও হয়ে গিয়ে সেখানে ভর করল একরাশ হাহাকার। অনিতার মনে হলো সে জনম জনম এভাবে কাটিয়ে দেয়। ভালো হয়েছে, ফুপি বিয়ে করে নাই। তাই এই নিঃশ্বাস বন্ধ করা কষ্টের সাথেও তার পরিচয় হয় নাই।
সাদাত হাসান’ও এলেন। বললেন, বাবা-মা হিসেবে তারা যদি কোনো দায়িত্ব পালনে কমতি রাখেন; তবে যেনো মেয়ে হিসেবে সে ক্ষমা করে দেয়। অনিতা কান্নার দমকে কথাই বলতে পারল না। অথচ যার মনের মধ্যে কতশত কথা জমা রয়েছে। এই কান্নাকাটির পর্ব’ই চলছিল। অনু এসে সকলকে থামাল। অনিতাকে বলল, ‘তোকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছি, নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নে।’
তারপর ভাই-ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা কি গো? কোথায় মেয়েটাকে সাহস দিবে তা না করে আরোও ইমোশনাল করে দিচ্ছ। সন্তানের কাছে আবার মা-বাবার কোনো দায়িত্ব কমতি মনে হয় নাকি? যা করো তাই অনেক বেশি। তোমাদের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ, তোমাদের উচিত হাসিখুশি থাকা। ভাবি তুমিও আমাদের সাথে পার্লারে চলো। আর ভাইয়া, তোমার তো নিশ্চয়ই পার্লারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার দায়িত্বে যেসব কাজ সেসব করো গিয়ে।’
.
অনুকে আবার ওই মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে, এটা ভাবতেই কেমন লাগছে। যখন একনজর দেখা পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজেছে, তখন ভুলেও তার দর্শন মিলে নাই আর যখন দেখার প্রয়োজন নেই তখন বারবার সামনে আসছে। এখন সে অন্যজনের সম্পত্তি, কোনো অধিকার নেই তার উপর। অথচ মনটা তবুও নিজের অজান্তেই ব্যাকুল হয়ে যায়, অস্থির হয়ে উঠে।
বিয়েতে না গেলেও নয়। যেতেই হবে বাধ্যতামূলক। কিছু কিছু সময় তো আমাদের কাছের মানুষের জন্য নিজের ভালো থাকা/মন্দ থাকা বিসর্জন দিতেই হয়।
অনুও কোনোরকম রেডি হয়ে গেল। জাঁকজমক তার কখনোই পছন্দ ছিল না। অনেক আগে থেকে সাধারণ সাজগোজ পছন্দ, এখনও তাই। অনিতার বিয়েটা হয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি রাজশাহী পাড়ি জমাবে। এই শহর ছেড়ে পালাতে হবে। যেখানে গিয়ে থাকবে সেখানেও স্মৃতি। বেঁচে থাকতে কখনোই এই স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। একবার সে বলেছিল, কাঁচা হলুদ রঙে তোমাকে খুব মানায়। তারপর থেকে অনু বেশিরভাগ জামা-কাপড় ওই রঙের কিনত। তারপর সে যখন জীবন থেকে হারিয়ে গেল, ওই রঙটাও ফিকে হয়ে গেল। যে নেই, তার পছন্দ’ও থাকা উচিত নয়। গতকাল হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে নিজের একটা শাড়ি কাঁচা হলুদ রঙের কিনে ফেলেছে। কেনো বা কি কারণ, সেটা নিজে জানে না। হয়ত বা অনেকদিন বাদে সেই সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন।
শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে রয়েছে সে। এই শাড়ি সে কিছুতেই পড়তে পারবে না। অন্য একটা শাড়ি নিল, সেটাও পছন্দ হচ্ছে না। আজকালকার মেয়েদের মত তার’ও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, ‘মা আমার কোনো কাপড় নাইইইইইইই।’ কিন্তু বলা হলো না, তার আগেই মা এসে দারুণ একটা শাড়ি বাছাই করে দিলেন।
.
বিয়ে পড়ানোর কথা ছিল দুপুরে। কিন্তু বিয়ে পড়াতে পড়াতে বিকাল হয়ে গেল। সবার উপস্থিতিতেই বিয়ে পড়ানো হয়েছে, অনিতার কিছু আত্মীয় আসতে দেরি করায় তাদের’ও দেরি হয়ে গেল। বিয়ের পর শুরু হলো ফটোসেশন।
বরং বউ দু’জনকেই দারুণ লাগছিল। তবে অনিতার কান্নাকাটি এখনও চলছে। ‘কবুল’ বলার সময় মা-মেয়ে দু’জন মিলে একধাপ কান্নাকাটি করে ফেলেছে, এখনও চলমান। অনু নিজের মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘মা দেখেছ, কেনো আমি বিয়ে করতে চাই নাই। তখন তো কত কথা শুনিয়েছিলে আমায়, এখন দেখো।’
‘কেনো? কেনো বিয়ে করলি না?’
‘এইতো এইরকম কান্নাকাটি করতে হবে তাই। কী ঝামেলা বলো তো? এত সুন্দর করে সাজগোজ করে কান্নাকাটি করে তা নষ্ট করতে হবে। কী দরকার বলো তো? তোমাদের’ও কষ্ট আমার’ও।’
‘নাটকীয় কথাবার্তা। সব মেয়েদের’ই একদিন না একদিন বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়। তুই তোর আজাইরা কথা বলিস না তো। বুড়ো বয়সে এসব শুনলে গা জ্বলে।’
‘ওমা, গা জ্বলার কী আছে? তোমাকে বলব না তো কাকে বলব?’
‘চুপ কর কথা বলিস না। কত করে বলেছিলাম, বিয়েটা কর। অন্তত নিজের একটা অবলম্বন তো থাকবে। এই যে একা একা থাকিস, সঙ্গে তো কেউ না কেউ থাকত। আমাদের সাথে তো আর তুই থাকিস না। কোনো একটা বিপদে আপদে আমরা ছুটেও যেতে পারি না। বিয়ে মানে তুই বুঝিস না। তোকে এসব বলাও বেকার। সব মানুষের’ই নিজেদের সংসার নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। তোর কিছুই নাই। মানুষের মধ্যেই পড়িস না তুই। সর সর, সামনে থেকে সর।’
মাকে ভালো একটা কথা বলতে এসে উল্টো মায়ের বকুনি শুনতে হলো। আজব! মা এমনই, এখনও বকাবকি করে ঠিক আগের মতই। বাহিরে গেলে ফোন করতে করতে অস্থির করে ফেলবে।
এইতো মায়ের এই ভালোবাসাটুকু জীবনে আছে এখনও, এই বয়সেও। বাবার শাসন আছে। আর কিছুর দরকার নেই।
এইতো একটু দূরেই ওই মানুষটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভরা সংসার তার। কোনোকিছুর অভাব নেই, কমতি নেই কিন্তু অনু নিশ্চিত ভেতরে ভেতরে একটু হলেও অপরাধবোধ রয়েছে তার।
অনুর সেসবের চিন্তা নেই। সে অন্যায় করে নাই, শান্তিতে আছে বেশ, ভালো আছে। অনিতার শাশুড়ির সাথেও কথা হয়েছে, বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হলো। এখন অনিতা ভালো থাকলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়!
.
.
.
চলবে…….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৪১৫