প্রাণসখা পর্ব-০১

0
11

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.
‘বাড়ি থেকে পালিয়েছেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে যখন তখন জ্ঞান হারাবেন। আমি কি সাহায্য করতে পারি?’

আমি পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করলাম। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চুলের আড়ালে চশমা পড়িহিত একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। মোটা চশমার উপর থেকেও তার তীক্ষ্ণতা স্পষ্ট। দেখে ভদ্র পরিবারের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার সন্দিহান মন তাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলো না। তাই বললাম,

‘আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ।’

ছেলেটা আমার কথা বুঝলো কিনা কি জানি। সে আশপাশে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো,

‘আপনার সাথে কেউ নেই? আপনার প্রেমিক বা বয়ফ্রেন্ড যেটাই বলুন। তিনি কোথায়?’

আমি বেশ বিরক্ত হলাম তার কথায়। আমার সাথে কেউ থাকুক বা না থাকুক তা দিয়ে তার কি? আশ্চর্য! আমি বেশ জোরালো গলায় বললাম,

‘আমার প্রেমিক নেই।’

‘আপনায় ফেলে পালিয়ে গেছে নাকি কখনো ছিলোই না!’

এবার আমি রোষাত্বক দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,

‘আগ্গে কখনো ছিলোই না। কেন? না থাকায় অন্যায় হয়েছে?’

ছেলেটা এই প্রথম হাসলো। নিরবে গা দুলিয়ে। হাসির সাথে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো দুলে উঠলো। ভিষণ স্নিগ্ধ একটা দৃশ্য। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এই স্নিগ্ধতা আমার অসহ্য ঠেকলো। আমি অন্যদিকে চেয়ে বসলাম। আমার থেকে বেশ দূরত্ব রেখে সে স্টেশনের বেঞ্চে বসলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘একটু পানি খেয়ে নিন। আপনার ভালো লাগবে।’

ছেলেটা যে কথা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বুঝলাম। আমি নিলামনা তার দেওয়া বোতল। এভাবে অচেনা কারো দেওয়া কিছু খেয়ে নিজের সর্বস্ব হারাতে চাই না আমি। আজকাল কতো গ্যাং বেরিয়েছে যারা ছলেবলে মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। যদিও আমার কাছে তেমন কিছুই নেই। কেবল পার্সে হাজার খানেক টাকা আর মোবাইল ছাড়া। তবুও সেই রিস্ক আমি নিতে চাইলাম না। দেখলাম ছেলেটা উঠে স্টেশনের চায়ের দোকানে গেলো। এক কাপ চা খেলো সময় নিয়ে। তার চা খাওয়ার ধরণ বেশ সুন্দর। প্রতি চুমুকের পর সে চোখ বুঝে তা উপভোগ করে। বিল পে করার সময় এক বোতল পানি কিনে ফিরে আসলো। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় বললো,

‘এটা দোকান থেকে এনেছি দেখেছেন নিশ্চয়ই? আমি মোটেও কোনো অজ্ঞান দলের সদস্য নই। আপনায় সিক লাগছে তাই সাহায্য করতে চাইছি। যতদূর জানি আমার পাশের ছিটটা আপনার। গাড়ি চলতে শুরু করার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার যাত্রাপথটা আপনায় সেবা করতে করতে কেটে যাবে। সেটা চাচ্ছিনা বলেই এখন আগ বাড়িয়ে সাহায্য করলাম।’

বোতলটা আমার পাশে রেখে চলে যেতে নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পরলো সে। পেছন ফিরে বললো,

‘পানিটা খেয়ে নিবেন। আমায় ধন্যবাদ দিতে হবে না। অসুস্থ মেয়ে লোকের ধন্যবাদ আমি পছন্দ করি না।’

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অনুভব করলাম আমার শরীরে হুরহুর করে জ্বর বাড়ছে। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সকালে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। বাড়িতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার খোঁজ পড়ে গেছে। তালুকদার বাড়ির মেয়ে বিয়ে থেকে পালিয়েছে এই সংবাদ যখন মহল্লায় ছড়িয়ে পড়বে তখন কেমন রিয়্যাক্ট করবে বাবা ভেবে চিন্তাগ্রস্থ হলাম। বিয়ে শাদি নিয়ে আগ্রহ আমার কোনো কালেই ছিলো না। একাকী জীবনে ঝামেলা ঝনঝাটের শেষ নেই সেখানে বিয়ে করে আরো ঝামেলা বহন করার মতো সাধ্য আমার নেই। আমাদের বাড়িতে পুরোনো এক নিয়ম আছে। আমাদের বিশাল জনসংখ্যার বাড়িটিতে কখনো আয়োজন করে বিয়ে হয় না। দু মাস বসে পাত্র দেখা তারপর পছন্দ হলে বিয়ে দেওয়া এই নিয়মের বাহিরে ছিলেন আমার দাদু। তার মতে এই অপ্রয়োজনীয় জিনিসে সময় নষ্ট না করে জীবন জীবনের মতো চলুক। কখনো চোখের সুপাত্র বা পাত্রী পেলে টুপ করে বিয়ে দেওয়া যাবে। দাদু বেঁচে নেই। তিনি গত হয়েছেন বছর ছয়েক হয়েছে। তবে তার রেখে যাওয়া রীতি এখনো চলছে। আমার বিয়েটাও বাবা হঠাৎ করেই তিনদিন আগে ঠিক করেছেন। পাত্র সম্পর্কে তার এক বন্ধুর ছেলে। অতিব গুণ সম্পন্ন পাত্রকে দেখতেই তার মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ হয়ে গেলো। এমন যোগ্য পাত্র হাত ছাড়া করার কথা তিনি একবার ও ভাবতে পারলেন না। বাড়িতে এসে সবাইকে ডেকে জানালেন আমার বিয়ের কথা। আমি রিতিমত থ। বাবার কথার উপর কথা বলার নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিছু বলতে পারলাম না। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছি আমি পালাবো। আমার এই প্লানে সাহায্য করলেন আমার একমাত্র মামা। তবে তিনিও এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। মাস দুয়েকের মাঝে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না। হয়তো পাহাড় কিংবা সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে। বাড়িতে আমাকে খুঁজে না পেলেই সন্দেহের তীর মামার দিকে ছুটবে। বাবা হয়তো মামার সেই দশ বছর আগের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে এলেকায় এলাকায় লাগিয়ে দিবেন। সামান্য পরিমাণ প্রাইজ মানির কথাও উল্লেখ থাকবে তাতে। বাবা এটা যেনে বুঝেই করেন। টাকার লোভ সবথেকে বড় লোভ। কেউ না কেউ টাকার লোভে ঠিক তাকে বাড়ির মানুষ রূপি গাধাটাকে খুঁজে বের করবে বলেই তার বিশ্বাস।

এবার আসি আমার কথায়। আমি আদ্রিতা আনজুম। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমি মূলত ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। রাজশাহীতে থেকে পড়াশোনা করি। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তায়। আমার থেকে বড় দুজন ভাই রয়েছে। বড় ভাই আদিব এবং মেজ ভাইয়া আকিব। বড় ভাইয়া বিবাহিত। মেজ ভাইয়া বিয়ে থেকে পালাতে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। মেজ ভাইয়ার পর আমিও একমাত্র সাহসী ব্যক্তি যিনি বিয়ে থেকে পালিয়েছি। পালিয়ে মামার সাথে ছোটখাটো ট্যুরে যেতে চাইলেও সে চিন্তা আপাতত বাদ দিয়েছি। আমার উদ্দেশ্য এখন রাজশাহী। হোস্টেলে ওঠার চিন্তা আপাতত করছি না। আমাকে খোঁজার জন্য বাবা সর্বপ্রথম আমার হোস্টেলে হানা দিবেন। সে কথা আমা জানা। বর্তমানে আমার যাওয়ার জন্য সেফ জায়গা হচ্ছে রিক্তা আন্টির বাসায়। বাবা কখনোই সেখানে আমায় খুঁজতে যাবেন না। এর পেছনে বিশাল এক রহস্য রয়েছে। রিক্তা আন্টির সাথে কোনো এক কালে বাবার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। তবে সাহসের অভাবে বাবা দাদুকে তার এই পছন্দের কথা জানাতে পারলেন না। বাবার বিয়ে হয়ে গেল আমার মায়ের সাথে। রিক্তা আন্টি সেকথা জানতে পেরে সোজা আমার দাদুর সাথে দেখা করলেন। দাদুর সামনেই বাবার গালে কষে থাপ্পড় মেরেছিলেন। এর সপ্তাহ খানেক বাদেই নাকি রিক্তা আন্টিরও বিয়ে হয়ে যায়। এই সবটা আমি মায়ের থেকে শুনেছি। কিন্তু কোনো এক কারণে আন্টি আমাকে ভিষণ পছন্দ করেন। এখন ভাবছেন আমার সাথে রিক্তা আন্টির পরিচয় কিভাবে হলো তাইতো? আসলে রিক্তা আন্টি আমার বাবার চাচাতো বোন। সে সূত্রেই আমাদের পরিচয়। আমি এখন আন্টির বাসাতেই যাচ্ছি। আন্টির বাসার ঠিকানা মামা ম্যানেজ করে দিয়েছে। আন্টি আমায় দেখে কেমন রিয়্যাকশন দিবে তা ঠিক জানা নেই আমার। এটাও জানা নেই তার বাড়িতে থাকার পারমিশন পাব কিনা। তবে আমি আশাবাদী। এক সপ্তাহ তার বাড়িতে থাকতে পারলেই বাকিটা ম্যানেজ করে নিতে পারবো।

বাস এসে পড়েছে। ঝাঁকড়া চুল ওয়ালাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আশপাশে উঁকি দিয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। দেখলাম কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে স্মোক করছেন তিনি। নাক কুঁচকে নিলাম। দেখতে ভদ্র হলেও স্বভাব দেখছি মোটেও ভালো না। আমি দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়ালাম। পাশ থেকে জামাকাপড়ের ব্যাগটা তুলে সোজা বাসে উঠে পড়লাম। আমার সিট নম্বর ষোলো। জানালার পাশের সিটটা পনেরো নং। এটা নিশ্চয়ই ঝাঁকড়া চুল ওয়ালার। আমি জানালার পাশেই বসলাম। যতটুকু মনে হচ্ছে এই সিট নিয়ে তিনি খুব একটা ঝামেলা করবেন না। তিনি উঠলেন সবার শেষে। বিনা বাক্যে এসে পাশের সিটে বসলেন। সিট বদলানোর ব্যাপারে কোনো কথা বললেন না। আমার একটু অস্বস্তি হলো। যতই হোক তার সিট এভাবে দখল করার জন্য একটা সরি বলা উচিত। বাস ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। আমি বেশ সময় নিয়ে বললাম,

‘আপনিকি সিটের জন্য রাগ করেছেন? আসলে আমি জানালার বাইরে না তাকিয়ে বাস জার্নি করতে পারি না। মাথা ঝিম ধরে যায়। বমি হয়। আপনাকে অসুবিধায় ফেলতে চাইনা আমি। এজন্যই আপনার পারমিশন ছাড়াই এখানে বসেছি।’

কোনো উত্তর এলো না। এবার আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম। ছিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন তিনি। কানে হেডফোন। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। কতগুলো কথা অযথা ব্যয় করলাম। তার প্রতি হওয়া সামান্য অপরাধ বোধটা মুহূর্তেই ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো। ঠিক করলাম একে আর সরি বলে লাভ নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। কিন্তু তখনি তিনি বললেন,

‘আপনি খুব অধৈর্য নারী। নারীদের ধৈর্য হবে আকাশ সমান কিন্তু আপনার ভেতর ছিটেফোঁটাও নেই। এটা দুঃখজনক।’

চলবে…..!?