প্রাণসখা পর্ব-৭+৮

0
3

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৭.
বিরহের সকাল বোধহয় সুন্দর হয়! আয়োজন করে ভোর হয়। মিষ্টি আলো ছড়ায় সময় নিয়ে। পাখিদের সে কি আনন্দ! আমার বিরহে তারা সকলে উচ্ছ্বাসিত। আমার দহন বাড়লো। এই সুন্দর সকালটাকেও বেদনার অধ্যায় মনে হলো। আমি এই নৃশংস অনুভূতি থেকে পালাতে সূর্য ওঠার পূর্বেই ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। আন্টি কত করে বললো বেলা হোক একটু তারপর না হয় যাওয়া যাবে। কিন্তু আমি শুনলাম না। শোনার মতো মানষিকতা নেই আমার। আন্টি হার মানলেন। হয়তো খানিক মন খারাপ ও করলেন। আমি বুঝেও বুঝতে চাইলাম না। আমার ভেতরে যে অনল বইছে তা বয়ে নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। আঙ্কেল আমাকে স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌছে দিতে চাইলেন। আন্টি বাঁধা দিলেন। তিনি নিজেই আমার সাথে স্ট্যান্ড পর্যন্ত এলেন। তখন সকাল প্রায় আটটা। শহরের রাস্তায় ততক্ষণে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। আকাশ চিরে সূর্যের মিষ্টি আলো নামতে শুরু করেছে। আমার বাস ঠিক নয়টায়। এই এক ঘন্টা আন্টি আমার সাথে বসে রইলেন। কোনো কথা বললেন না। ঠিক বাসে ওঠার আগ মুহূর্তে বললেন,

‘তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে আদ্রি। আবেগ দিয়ে কখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। তাই বিবেগ দিয়ে ভাবার চেষ্টা করবে। বোকা সিদ্ধান্ত নিবে না কখনো। একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনের চলার পথ বদলে দেয়। আশা করি আমার এই কথাগুলো স্মরণে রাখবে।’

আন্টির কথা তখন না বুঝলেও বুঝলাম দুদিন পর। সেদিন আমাদের বাড়িতে অতিথি আসার কথা। ছোট চাচীর বাবার বাড়ির লোকজন আসবেন। ছোট চাচা বিয়ে করেছেন মাস তিনেক হবে। এবারই প্রথম তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এ বাড়িতে আসতে চলেছে। নিজেদের খানদানি বংশের পরিচয় তুলে ধরতে বিশাল আয়োজন করে রান্নার আয়োজন হয়েছে। বাবুর্চি আনা হয়েছে। সকাল হতেই বাজার থেকে বড় একটা খাসি কিনে এনেছে বাবা। বাড়ির হেঁসেলে ও রান্না হচ্ছে। পায়েশ, সেমাই আর জর্দা ভাত। আশপাশের দু চার বাড়ি পর্যন্ত ঘ্রাণ ম ম করছে। সূর্য ওঠার আগেই এ বাড়িতে হাঁড়ির টুং টাং শব্দ শুরু হয়েছে। আমার ঘুম ভাঙল সবার হুড়োহুড়ির শব্দে। আমার ঘরটা দোতালার শেষ প্রান্তে। এ বাড়ির সকল‌ ছেলে মেয়েদের ঘর দোতলায়। নিচ তলায় বাড়ির মুরুব্বীদের ঘর অর্থাৎ বাবা, চাচা, মামা তাদের। কাজের লোকদের জন্য ও নিচ তলাতেই থাকার ব্যাবস্থা। আমরা মোট ভাই বোন বারোজন। আমার বাবারা চার ভাই। ফুপু আছেন দুই জন। তবে কোনো এক কারণে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। কেন নেই তা জানার বিন্দু আগ্রহ আমার মাঝে নেই। নিজের সাথে এই বাড়ির সম্পর্কেরই টানাপোড়া চলছে সেখানে অন্যেরটা ভাবার সময় কই?

আমার ঘুম ভাঙল ঠিক আটটায়। রাতে ঘুমিয়েছিলাম চারটা নাগাদ। অর্থাৎ মাত্র মাত্র চার ঘন্টা। মাথা ভার অনুভব করলাম। বাহির থেকে সামির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে চিৎকার করে কেউ একজনকে বলছে,’ ব্যাটা যা বলি তাই কর। এত বেশি বুঝোস ক্যান? বাড়ির পেছনে মেজ চাচাজান আছেন। তার কাছে দিয়ে আয়।’

আমি চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। ব্যর্থ চেষ্টা করলাম আরো কিছুটা সময় ঘুমানোর।‌ তখনি সাবিনা হুর মুড়িয়ে আমার রুমে ঢুকলো। আমি কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই ও শুকনো হেসে বললো,

‘আপা তোমার কাছে হেয়ার ড্রায়ার আছে? আমারটা নষ্ট হয়ে গেছে। নয়টায় ক্লাস আছে। চুল না শুকায়ে বের হতে দেবে না আম্মা।’

এ বাড়ির কেজি খানেক নিয়মের মাঝে অন্যতম নিয়ম হলো ভেজা চুলে বাহিরে না যাওয়া। এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবুও নিয়মের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমি উঠে বসলাম। এই পরিবেশে আর যাই হোক ঘুমানো সম্ভব না। হাত উঁচু করে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ইশারা করে বললাম,

‘ওখানে রাখা আছে। যাওয়ার আগে সুন্দর করে জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে যাবি।’

সাবিনার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। ব্যস্ত পায়ে ড্রায়ার নিয়ে বের হয়ে যেতে নিলে আমি ওকে পেছন থেকে ডাকলাম।

‘বাড়িতে এত হুড়োহুড়ি কিসের? কারো বিয়ে টিয়ে নাকি?’

‘ছোট চাচাজানের শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসবে শুনলাম। এই প্রথম আসছে কিনা তারা!’

আমি মাথা ঝুলালাম। মুখে বললাম,

‘হুহ। যা এখন। দরজা চাপিয়ে দিবি।’

আমি আবারো চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। সাবিনা চলে গেল কিন্তু দরজা চাপালো না। আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এসব অদ্ভূত প্রাণীদের মাঝে আমি কিভাবে ফেঁসে গেলাম? আমার মত স্বাভাবিক মানুষের জন্ম নেওয়া উচিত ছিল একটা স্বাভাবিক ঘরে। এত অবিচার কিভাবে হলো আমার সাথে!
রুমের জানালাটা বন্ধ। অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। বাহিরের আলো অল্পস্বল্প প্রবেশ করছে বারান্দার ভেঁজানো দরজার ফাঁকা থেকে। উঠে যেয়ে জানালা খুলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ইসস্! সাবিনাকে বলতে হতো জানালাটা খুলে দিতে।

ঘন্টা খানেক পর নিচে নামলাম। মিজান চাচা বালতি হাতে দৌড়াদৌড়ি করছেন। বাড়িঘর ঘসা মাজা করা হচ্ছে। বুয়া পান বানাচ্ছে। হয়তো বাবুর্চিদের জন্য। দেখলাম ভাবি টেবিলে খাবার দিচ্ছে। আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম,

‘সে কি! এখনো কেউ নাস্তা করেনি?’

ভাবি প্লেটে লুচি তুলে দিয়ে বললেন,

‘দু টেবিল নাস্তা শেষ হয়েছে। এটা তৃতীয় টেবিল। তুমি, মা আর বড় চাচিমা বাকি আছো। বাকি সবাই খেয়ে নিয়েছে। আমি তো বাপু লুচি ভাঁজতে ভাঁজতেই খেয়ে নিয়েছি। নয়তো ঘ্রাণে পরে আর খাওয়ার রুচি থাকে না।’

আমি ছোলার ডাল দিয়ে লুচি মুখে পুরে নিয়ে বললাম,

‘আমায় এক কাপ চা করে দিবে? মাথাটা যা ধরেছে!’

‘এখন হবে না গো। চুলা ফাঁকা নেই। এক ঘন্টা পর খেও। আমার ঘরে বাম আছে লাগাবে? বেশ কাজ করে। তোমার ভাই ইন্ডিয়া গেল যখন, তখন আনল।

আমি তিনটা লুচি খেয়ে উঠে গেলাম। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম,

‘ওসব মালিশ করে লাভ নেই। আমার অসহ্য লাগে। এক কাপ চা যথেষ্ট আমার জন্য।’

রান্নাঘরে সত্যিই চুলা ফাঁকা নেই। মা পায়েশের জন্য দুধ জ্বাল দিচ্ছে। বড় চাচিমা জর্দা ভাত রান্না করছে। অন্য চুলায় গরম তেলে লুচি করা হচ্ছে। আমি চোখ ছোট করে বললাম,

‘এত লুচি দিয়ে কি হবে? সবার খাওয়া শেষ নাকি?’

সেজোমা আঁচলে মুখ মুছে জবাব দিলেন,

‘ঘরের লোকেদের খাওয়া শেষ। বাহিরে যারা কাজ করছে তাদের জন্য এগুলো। তোর বাপ চাচাদের ঢং দেখলে বাঁচিনা। কাজ করতে আসা লোকেদেরও তাদের গরম গরম লুচি খাওয়াতে হবে। বলি তারা কেন হেঁসেলে এসে লুচি বানাচ্ছে না?’

এত লোকের নাস্তা বানিয়ে সেজোমা ক্লান্ত। তাই এখন সে সব কথায় বাপ চাচাদের সাবান ছাড়াই ধুয়ে দেবেন। আমি আর আগুনে ঘি ধাললাম না। মায়ের গা ঘেঁষে বসলাম। মা ঘেমে চুপচুপে অবস্থা। যদিও টেবিল ফ্যান চলছে। কিন্তু গরম কমার নাম নেই। অনুভব করলাম মায়ের ঘামের গন্ধ আমার বিরক্ত লাগছে না। এই ঘামের গন্ধটাও কেমন আপন। একটু বেশিই আপন!

‘কি হয়েছে? এই গরমে বসে আছিস কেন?’

আমি মায়ের আরো গা ঘেঁষলাম। নিচু গলায় বললাম,

‘ঘুম হয়নি। মাথা ব্যাথা করছে খুব।’

‘বাহিরে যা। দেখ তোর বাপ চাচারা কি করছে। দুধটা জ্বাল হয়ে গেলেই আমি চা করে দিচ্ছি। এখান থেকে বের হ। গরমে মাথা বেশি ব্যাথা করবে।’

আমি নড়লাম না। আরো দু মিনিট ওভাবেই বসে রইলাম। কতদিন মা কে এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকা হয়না! বাড়িতে আসার পর মায়ের সাথে বসে এক কাপ চা খাওয়ার ও সুযোগ হয়নি।
আমায় না যেতে দেখে বড়মা ধমক দিলো।

‘তুই এখনো বের হলিনা কেন রে আদ্রি? এই গরমে অসুস্থ হয়ে পড়বি তারপর আরেক জ্বালা। এইখানে বসে মায়ের প্রতি অত ভালবাসা দেখানো লাগবে না। যা এখনি।’

চলবে…….

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৮.
মেহমান এলেন বেলা গড়িয়ে। আসার পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এতটা দেরী হলো। তাদের আপ্যায়নে কোনো ঘাটতি রাখা হলো না। আমি সেদিকে খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। সারাটাসময় ঘরে দরজা আটকে পড়ে রইলাম। মা এসে কয়েকবার ডেকে গেলেন অতিথিদের সাথে দেখা করবার জন্য। আমি সোজা মানা করে দিলাম। তা শুনে ছোট চাচি বিরক্ত ধরা গলায় বললেন,

‘এ কেমন শিক্ষা তোমার আদ্রিতা? মেহমানদের সাথে দু একটা কথা বলাও শিক্ষার অংশ। এভাবে অহংকার নিয়ে দরজা আটকে বসে থাকলে সেটাকে বেয়াদবি ছাড়া কিছুই বলা যায় না।’

এসব শুনেও জবাব দিলাম না। তবে বড় চাচিমা তাকে ধমক দিলেন। আমি নিরবে রুমে বসে রইলাম। দুদিন বাদে রাজশাহী ফিরে যাব। এখন বাড়িতে ঝামেলা করার নূন্যতম ইচ্ছা নেই আমার। এই দুটোদিন শান্তিতে কাটাতে চাই।

আহ! রাজশাহী, আমার প্রেমের শহর! আমার বিরহের শহর! যত্নে গড়া আবেগকে শূন্য হতে দেখার শহর। আবার যখন ও শহরে পা রাখব তখন কি তার সাথে দেখা হবে? দেখা হবে কি তার সেই ঝাঁকড়া চুল আর গা কাঁপানো হাসি? আমার হৃদয় মুচড়ে ওঠে। স্বল্প সময়ে ভালোবেসে ফেলা পুরুষটির জন্য হৃদয়ে কেঁদে ওঠে। দুর্বল করে দেয় আমায়। আমি কিভাবে একই শহরে তাকে অনুভব করে টিকে থাকব? আমার চোখ থেকে জল গড়ায়। গাল, গলা ভিজে যায়। কেবল আমার হৃদয়টা শুকিয়ে জলের জন্য ছটফট করতে থাকে। হাহ! আমার প্রেম!
_____________

আমাদের বাড়ির দক্ষিণে সান বাঁধানো ছোট্ট একটা পুকুর আছে। এ যায়গায় আগে ছোঠ একটা সবজি বাগান ছিলো। বাবার একটা পুকুর করার সখ ছিল খুব। সবজি বাগান করা হলো ছাদে। আর এখানে পুকুর। পুকুর হওয়ার পর থেকে সে কখনোই বাড়ির ওয়াশরুমে গোসল করেনি। সকালের পত্রিকাটাও তিনি পুকুর পাড়ে বসে পড়েন। আমার রুমের জানালা থেকে পুকুর দেখা যায়। স্পষ্ট না হলেও থলথলে বেরঙা জল নজরে আসে।
বিকেলে আমি ঘর ছেড়ে বের হই। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখি সাবিনা বসার ঘরে টিভি দেখছে। আমি যেয়ে ওর পাশে বসলাম।

‘কাউকে দেখছি না যে! মেহমান চলে গেছে?’

‘চাচির বাপের বাড়ির সকলে চলে গেছে। চাচি আর ছোট চাচাজান গেছেন তাদের গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিতে। মা রান্নাঘরে। আর কিছু আপাতত জানি না।’

আমি ছোট করে শ্বাস ফেললাম। বললাম,

‘তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?’

সাবিনা ছোট করে জবাব দিলো,

‘খারাপ না।’

‘হাত খরচ লাগলে আমায় বলিস।’

‘আদিব ভাই মাসের শুরুতে দুই হাজার দেন। তাতেই চলে। তুমি কিভাবে চলো? ভাই বললো তুমি নাকি তার থেকে হাত খরচ নেও না?’

আমি হাসলাম। বললাম,

‘টিউশন করি একটা। ও দিয়েই চলে যায়।’

সাবিনা বিজ্ঞদের মত মাথা ঝাঁকাল। পুনরায় টিভি দেখায় মনযোগ দিলো। আমি উঠে পড়লাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে পুকুর পাড়ের দিকে পা বাড়ালাম। এখানে আসা হয়না আমার তেমন। বিকেলের সূর্যের রাঙা আলো পুকুরে জলে পড়ায় জল চিকচিক করছে। কি সুন্দর দৃশ্য। আমার চোখ থমকালো। থেমে গেলো পা জোড়া। প্রকৃতির এই সুন্দর দৃশ্যকে পূর্ণতা দিতেই বোধহয় পুকুরের সিঁড়িতে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর লালচে গেঞ্জি পরিহিত ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা পুরুষের আবির্ভাব। সে এখানে কিভাবে? প্রশ্নে জর্জরিত হৃদয় উত্তর না খুঁজে সেদিকে ছুটে গেলো। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলে উঠলো,

‘আবারো দেখা হয়ে গেলো মিস অতিথি। নাহ! ভুল বললাম বোধহয়। আজ আমি আপনার অতিথি।’

বলেই সে হাসলো। সেই গা কাঁপানো হাসি। আমি দু সিঁড়ি নেমে এসে তার থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে বসলাম। বিকেলের লালচে আলোর লালচে কিরণে স্বচ্ছকে সুন্দর লাগছে। শ্যামা পুরুষদের রোদের কিরণে এতটা সুন্দর লাগে আগে জানা ছিলো না। আমি আমার ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করলাম। তবে তা চেপে রাখলাম। পুকুরের জলে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম,

‘আপনি আমাদের আত্মীয়?’

‘মনে তো হচ্ছে সেটাই।’

‘আপনায় আগে কখনো দেখিনি কেন?’

‘সুযোগ দেননি। আবার হয়তো আমাদের ভাগ্যে ছিল না তাই।’

‘আপনি সোজা ভাবে কথা বলতে কবে শিখবেন?’

সে জবাব দেয় না। উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে সামনে। হাসি মুখটা কেমন মলিন হয়ে এসেছে। আমি ছোট চোখ করে তাকাই। কিছু বলতে নিব তার পূর্বেই সে ভিষণ হতাশ গলায় শুধায়,

‘কেন পালালেন আদ্রিতা? সেদিনটা ওমন না হলে আজ হয়তো আমাদের জীবনটা ভিন্ন হতো। সবকিছু এতটা জটিল হতো না।’

আমি চমকে তাকাই। এই প্রথম স্বচ্ছর কঠিন কথাটা আমার বুঝতে সময় লাগলো না। মস্তিষ্ককের সাথে সাথে শরীরটাও যেন অবশ হয়ে আসতে চাইলো। স্বচ্ছ শুকনো হাসলো। উঠে যেতে যেতে বললো,

‘সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়িতে ফিরে যাবেন। যুবতী মেয়েদের সন্ধ্যায় এভাবে পুকুর পাড়ে থাকাটা খারাপ।’

আমি জবাব দেইনি। স্বচ্ছকে আটকাইনি। তার কাছে আর কিছু জানতেও চাইনি। মনে মনে কেবল একটা কথাই জপে গেলাম,

‘পাপ করেছি। ভিষণ বড় পাপ করে ফেলেছি। এর প্রায়শ্চিত্ত করব কিভাবে?’

___________

বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে স্বচ্ছকে দেখতে পেলাম না। মন কেমন করে ওঠে। চলে গেল বুঝি? সাবিনা তখনো টিভি দেখছে। আমি ওকে বললাম,

‘স্বচ্ছকে দেখেছিস?’

ও কেমন করে তাকালো। চোখ উল্টে বললো,

‘কে সেটা?’

আমি বিরক্ত হলাম। এই মেয়েটা টিভির সামনে বসলে দিন দুনিয়ার হিসাব ভুলে যায়। ওর সামনে থেকে গোটা বাড়িটা চুরি করে নিয়ে চলে গেলেও ও টের পাবেনা। সেখানে একটা মানুষকে টের পাওয়াতো দুষ্কর ব্যাপার-স্যাপার। আমি কথা পাল্টে বললাম,

‘বাড়িতে আর কারা এসেছে?’

‘চাচাজান তার কোন বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছেন নাকি। পারিবারিক ভাবে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো নাকি তাদের মধ্যে।’

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কিচ্ছুটি। অসহায় লাগলো নিজেকে। স্বচ্ছদের বাড়িতে স্বচ্ছর মায়ের ওমন আচরণের কারণটাও বোধগম্য হলো। এমন একটা কাজ করার পর আমাকে তার অপছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর স্বচ্ছ? সেও কি আমায় খুব বেশি অপছন্দ করে? আমার চোখ জ্বলতে শুরু করলো। কান্না পাচ্ছে খুব। সেদিনের হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য আজ কতটা ভুগতে হচ্ছে!

স্বচ্ছর সাথে আমার পুনরায় দেখা হলো সন্ধ্যায়। পুরোটা বিকেল সে কোথায় ছিল জানা নেই আমার। বসার ঘরে সকলকে সন্ধ্যার নাস্তার জন্য ডাকা হয়েছে। অন্যসময় আমি সবার আগে চলে এলেও আজ এলাম সবার শেষে। স্বচ্ছ আর তার মায়ের সামনাসামনি হতে অস্বস্তির থেকে ভয় হচ্ছে খুব। অনুভব করলাম আমার হাত পা কাঁপছে। চোখের পাতাও তিরতির করে কাঁপছে। আমি ভয় পাচ্ছি। স্বচ্ছকে পুরোপুরি ভাবে হারিয়ে ফেলার ভয়। নিজের ছোট্ট বোকামির নিষ্ঠুর পরিণতির ভয়। আমি এসে বসার ঘরের দরজার সামনে চুপটি করে দাঁড়ালাম। আশ্চর্য জনক ভাবে আমি আমার পরিবারের লোকেদের চোখে তাকাতেও ভয় পাচ্ছি। অপরাধ বোধ হচ্ছে খুব। বাবাকে হেনস্থ হতে হয়েছে ভাবতেই বুক ভারি হয়ে আসছে। এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হলাম আমি?

চলবে………