প্রাণসখা পর্ব-০৯

0
4

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.
স্বচ্ছর সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হয় হঠাৎ করেই। কোনো প্রকার দেখাশোনা ছাড়া। স্বচ্ছর বাবার সাথে আমার বাবার বেশ পুরোনো দিনের সম্পর্ক। কোনো এক কালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চললেও দুজনের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ নেই বহু বছর। কিছুদিন পূর্বে মাছের বাজারে হঠাৎ তাদের দেখা। স্বচ্ছর ফুপুর বাড়ি কাছে পাশেই। বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন তাই বাজার থেকে বড় মাছ কিনতে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মাছ বিক্রেতা ছেলেটার বয়স চব্বিশের কাছাকাছি। বাজারের সবথেকে তাজা মাছগুলো পাওয়া যায় তার কাছে। বাবা সবসময় তার থেকেই মাছ নেয়। কাজেই ওর কাছে থাকা সবথেকে বড় মাছটা বাবর জন্য আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়। আজ বেশ বড় একটা রুই এনেছেন। ভদ্রলোক অত বড় মাছ খানা দেখে দাম জানতে চাইলেই মাছ বিক্রেতা ছেলেটা জানান,

‘এই মাছ বড় সাহেবের জন্য। অন্য কিছু দেখেন।’

ভদ্রলোক ফের বলেন,

‘তোমার বড় সাহেব কি মাছটা কিনেছেন? না কিনলে আমায় দেও। বোনের বাড়িতে যাচ্ছি, একটু বড়সড় মাছ নিতে পারলে ভালো হয়।’

‘আরে চাচা এত ক্যাচাল করেন ক্যান? অন্যতা নিবার হলে নেন নয়তো যান।’

ভদ্রলোক অপমান বোধ করেন। ঘুরে চলে যেতে নিলে বাবার সাথে দেখা। আলাপ বিনিময়ের এক পর্যায়ে মাছের ব্যাপার উঠলে বাবা তাকে মাছটা নিয়ে দেন। পরপর দুদিন বাবার সাথে ভদ্রলোকের বাজারে দেখা হয়। চায়ের দোকানে বসে ঘন্টা খানেক আড্ডা হয়। আমাদের বাসায় দাওয়াত করলে ভদ্রলোক জানান অন্য কখনো আসবেন। তার অফিসের কাজে আজই ফিরতে হবে। বাবা কিছুটা দুঃখ পায়। এতদিনের পুরোনো বন্ধুকে পেয়েও এক বেলা খাওয়াতে পারলো না ব্যাপারটা দুঃখজনক।

বাড়িতে খাওয়াতে না পারলেও বাবার জোরাজোরিতে বাজারের একটা হোটেলে সকালের নাস্তা করলো দুজন। কথায় কথায় পরিবারের কথা উঠলো। স্বচ্ছর বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়েশাদী করানো প্রয়োজন। বাবাও তখন চট করে আমার কথা বলে ফেলেন। মোটামুটি দুজনে নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। কেবল পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা ছিলো।

বড় চাচা মারা যাওয়ার পর থেকে যেহেতু বাবাই আমাদের বংশের মাথা সেহেতু তিনি কারো পরামর্শ নেওয়ার থেকে নিজের মতামত জানানোকে বেশি প্রাধান্য দিলেন। বাড়ির পরিবেশ তখন থমথমে। আমি কোনো কথা ছাড়াই নিজের রুমে ফিরে গেলাম। বিয়ে নিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত করলাম না। হিসাব নিকাশ করে তিনদিন পর মামার সাহায্যে বাড়ি ছাড়লাম। কিন্তু সেদিন স্বচ্ছ রাজশাহী থেকে এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে। গুরুজনদের মতামতে সে বিশ্বাসী নন। সে নিজ থেকে বিয়ের বিষয়ে আমার সাথে সামনাসামনি আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এ কথা আমার বাবা ছাড়া অন্য কেউ জানত না। কিন্তু স্বচ্ছর কষ্ট করে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসতে হলো না। স্টেশনেই আমার সাথে দেখা হয়ে গেলো। ততক্ষণে বাড়িতেও জানাজানি হয়ে গেলো আমার পালানোর কথা। স্টেশনে এক দেখাতে স্বচ্ছর আমাকে চিনে ফেলার কারণ একটাই, তাকে আমার ছবি দেখানো হয়েছিলো। একখানা নয় পাঁচ পাঁচ খানা‌।

বর্তমানে,

স্বচ্ছর বাবাকে এই প্রথম দেখলাম আমি। চেহারার গড়ন পুরোটাই স্বচ্ছ তার বাবার থেকে পেয়েছে। স্বচ্ছর একটা বোন আছে। নাম স্নিগ্ধা। বয়সের দিক থেকে হিসাব করলে আমার ছোট হবে। ওদের বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম তখন দেখা হয়নি আমাদের। মেয়েটা মিষ্টি। চেহারার ধরন অনেকটা স্বচ্ছর মায়ের মতো। গায়ের রংটাও তার মতোই। মেয়েটা দু এক পলক আমায় দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমার অস্বস্তি হলো। পছন্দ হয়নি নাকি!

‘বলছিলাম কিছু ভুলবোঝাবুঝি হয়ে গেল মাঝখানে। এখন সেটা নিজেদের মধ্যে গুছিয়ে নেওয়া ভালো কি বলিস ইমতিয়াজ?’

বাবার কথায় স্বচ্ছর বাবা তেমন একটা প্রতিক্রিয়া করলেন না। তবে স্বচ্ছর মা গমগমে কন্ঠে বলে উঠলে,

‘যা ঘটে গেছে তা থাক না ভাইজান। পুরোনো জিনিস ঘেটে দেখার কিছু নেই।’

তার কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে কোনো বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন না। হয়তো তিনি স্বচ্ছর সাথে আমাকে জড়াতে চাইছেন না কোনোভাবে। আমার জ্বলে ওঠা আশার আলো পুনরায় মৃদু হয়ে গেলো। হয়তো খানিক বাদেই ধপ করে নিভে যাবে।

মা বলে উঠলেন,

‘তা বললে হয় নাকি আপা। বাচ্চারা ভুল করবে স্বাভাবিক। ওদের ভুলটা সুধরে দিয়ে নিজেদের মাঝের দূরত্বও ঘুচিয়ে আনা অবশ্যই জরুরি।’

মায়ের কথায় সায় দিলেন বাবা। আমি তখনো চুপটি করে দাঁড়িয়ে। আড় চোখে স্বচ্ছকে দেখলাম। সে বরাবরের মতোই শান্ত। মানুষটা নিজেকে এতটা শান্ত রাখে কি করে? কোনো পরিস্থিতিই যেন তাকে টলাতে পারে না। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বড়দের মাঝে অনেক কথা হওয়ার পর আমার পালা এলো। স্বচ্ছর মা সবার সাথে অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও আমার সাথে সেভাবে কথা বললেন না। মুখের ভারী ভাব ধরে রেখে বললেন,

‘তোমার বিয়েতে মত নেই এটা বাড়িতে বললে না কেন?’

আমি ঠিক কিভাবে জবাব দিব খুঁজে পেলাম না। আসলেই তো কেন বাসায় জানালাম না? বাসায় জানানোর কথা তাখন আমার মাথায় আসেনি। রাগের বশীভূত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। মাথায় যেটা এসেছে সেটাই করেছি। সাথে আমার অকেজো মামা তো আছেই। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এতকিছু ঘটার কারণ কেবল মামা। মামার সাপোর্ট ছাড়া এতবড় কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বাড়িতে ফিরুক কেবল। মাছ কাটার বটি নিয়ে তাড়া করবো।

‘চুপ কেন?’

আমি নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে চাইলাম। আমায় সাহায্য করার মতো পরিস্থিতি নেই। তাই সকলে চুপ করে আছে।

‘বাবার কথার বিপরীতে কথা বলার সাহস ছিলো না। হঠাৎ করে ঝোঁকের বশে বেরিয়ে পরেছিলাম।’

‘একা নাকি কারো সাথে?’

আমি ছোট করে বললাম,

‘মামার সাথে।’

স্বচ্ছর মা তাচ্ছিল্য করে হাসলেন।

‘মামার সাথে নাকি প্রেমিকের সাথে? এধরণের কথা বললেই বুঝি সবাই বিশ্বাস করে নিবে! বর্তমানের ছেলেমেয়েরা ভালোই কাহিনী বানাতে পারে। তোমাদের বয়স পার করে এসেছি আমরা। তোমাদের পেটের কথা বুঝে ফেলার মতো ক্ষমতা আছে আমাদের।’

আমি স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। এমন কিছু হতে পারে ভাবনার বাহিরে ছিলো। দেখলাম বাবা, মা, ভাইয়া তারাও অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। হয়তো তারাও ভাবেননি তিনি এমন কিছু বলবেন। আমার চোখে ততক্ষণে জল চলে এসেছে। শেষে কিনা নিজের চরিত্রেও তকমা লাগিয়ে দিলাম!

‘আপনি ভুল ভাবছেন আপা। মেয়ে তো আপনার বাড়িতেই ছিল। আপনি তো তা বেশ ভালো করেই জানেন। তাছাড়া রাজশাহী পর্যন্ত তো আদ্রিতা স্বচ্ছ বাবার সাথেই ছিল। হয়তো আদ্রিতা স্বচ্ছকে চিনত না এই আরকি।’

বাবার কথায় স্বচ্ছর মা পুনরায় বললেন,

‘আজকাল তো এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে ভাইজান। প্রেমিকের জন্য ঘর ছাড়ছে মেয়েরা, প্রেমিক তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে আজকাল এমন ঘটনা। মাফ করবেন ভাইজান কিন্তু আমি এখানে এমন কিছু ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছি না।’

আমার বলার মতো কিছু রইলো না। বাবাকেও দেখলাম কেমন নিভে গেছে। হয়তো তিনিও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। এই প্রথম আমি বাবাকে হেরে যেতে দেখলাম। আমি তাকে হারিয়ে দিয়েছি। পরিবারের কাছে, আত্মীয়য়দের কাছে এবং গোটা সমাজের কাছে। আমি সবসময় চাইতাম বাবাকে হারাতে। কিন্তু আজ বাবার এই হেরে যাওয়া আমায় বিধ্বস্ত করে তুলছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আমি এভাবে কখনো হারাতে চাইনি তাকে। না চেয়েছি নিজেকে এভাবে বিলিন হতে দিতে।

আমি জলে ভরা চোখে স্বচ্ছকে দেখলাম। সে এখনো আগের মতোই বসে আছে। সে কী আমার হয়ে একটা শব্দ বলতে পারতো না? পারতো না আমায় এই মিথ্যা অপবাদ থেকে রেহাই দিতে? হয়তো পারতো। তবে সেটা তার প্রয়োজন মনে হয়নি। আমিই বোকা। মিথ্যা আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে ছিলাম। আমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখার আর প্রয়োজন বোধ করলাম না। ধীর পায়ে উল্টো ঘুরে চলে এলাম। নিজেকে অপবাদ থেকে মুক্তি দিতেও চেষ্টা করলাম না। কি দরকার? অন্যের কাছে নিজেকে খোলসা করা বৃথা।

স্বচ্ছরা সেদিন বাদে পরদিন চলে যেতে চাইলে বাবা বাঁধা দিলেন। ভুল বোঝাবুঝির সূত্র ধরে তারা চলে গেলে বাবার অপমান বোধ বাড়বে ভেবে বাড়ির সকলে তাদের প্রাপ্য খাতির যত্ন করলেন। আমি রুম থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। কেউ অবশ্য এ নিয়ে কোনো কথা বললো না। কখনো ভাবি কখনো সাবিনা এসে খাবার দিয়ে যায়। এর মাঝে অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটলো। সেদিন বিকেলের কথা। কোনো কাজ না থাকায় অধিকাংশ সময় আমি ঘুমিয়েই কাটাই। ঘুমে কোনো ক্লান্তি নেই আমার। আমি তখন ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। আমি বইয়ে নজর রেখেই বললাম,

‘হুম, আয়।’

ভেবেছিলাম সাবিনা এসেছে। এমন সময় সাবিনা ছাড়া অন্য কারো আসার কথা না। কিন্তু কেউ এলো না। পুনরায় ঠকঠক শব্দ। আমি কপালে ভাঁজ ফেলে উঠলাম। খানিকটা বিরক্ত হয়েছি বৈকি। দরজা লক করা নেই। অযথা নক করার কি প্রয়োজন? উঠে গিয়ে দরজা খুলেতেই খানিক চমকালাম। স্বচ্ছ দাঁড়িয়ে। পাশেই স্নিগ্ধা। এরা দু ভাই বোন আমার দরজার সামনে কি করছে? আশ্চর্য!

চলবে…..