প্রাণসখা পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
3

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

শেষ.
দেখতে দেখতে কেমন করেই যেন কেটে গেল চারটি মাস। টার্ম ফাইনাল চলছে। এতদিনের গছিয়ে রাখা পড়া এখন সব কাঁধে চেপে বসেছে। পড়ার টেবিল, চেয়ার,বেড সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বই। চোখের নিচে মোটা কালো দাগ। শান্তির ঘুম সেই কবেই ভুলে গেছি। অগোছালো চুল নিয়ে হল, লাইব্রেরি, বইয়ের দোকানে ছোটাছুটি। এর ওর কাছ থেকে নোট কালেকশন। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর জীবন পার করছি। এর মাঝে যখন পরীক্ষার হলে প্রশ্ন দেখে চোখ বড় হয়ে যায় আর অবচেতন মন বলে ওঠে,’এগুলো আবার কি?’ সেই অনুভূতি বুঝিয়ে বলার মতো না।
আমার এই বিভৎস দিনের এক বিভৎস সন্ধ্যায় হঠাৎ এক অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো। হলে তখন বিদ্যুৎ নেই। চার্জার লাইটের আলোয় জোরপূর্বক বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। আগামীকাল হিস্ট্রি এক্সাম। সিলেবাস ভিষন লম্বা। হাতে সময় অল্প। এটায় পাস করে যেতে পারবো কিনা সন্দেহে আছি। এর মাঝে অপরিচিতের কল বিরিয়ানির মাঝের এলাচির মতো লাগলো। আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু কতক্ষন? একাধারে বেজেই চলছে। রুমমেট মেয়েটা ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো,

‘আদ্রি কল ধরার হলে ধরো নয়তো বালতির পানিতে চুবিয়ে রাখো মোবাইল। আমাকে ঘুমাতে দাও‌।’

রুমমেটের ঘুম নষ্ট না করতেই কলটা রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। যেন কলদাতা চাইছেন আলাপটা আমি শুরু করি। আশ্চর্য! আমি কেন তা‌ করতে যাব? আমার জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে কল দাতা নিজ থেকেই বলে উঠলো,

‘কেমন আছেন?’

হায়, হ্যালো ব্যতীত সরাসরি কেমন আছেন প্রশ্ন করা ব্যক্তিটার কন্ঠস্বর আমি ঊট করে ধরে ফেললাম। এতদিনে এই মানুষটাকে আমি প্রায় ভুলে বসেছিলাম। জীবনের এত সমস্যার মধ্যে হৃদয়ে আটকে থাকা ব্যাথাটা লঘু হয়ে এসেছিল। তবে আজ কেন আবার তাকে সাড়া দিতে হলো?
আমি ভাবনাগুলোকে পাশে রেখে উত্তর করলাম।

‘বেশ ভালো। আপনি?’

আমার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো লোকটা ব্যর্থ প্রেমিকদের মতো ভাঙা গলায় উত্তর দিবে, ’’যেমনটা রেখেছেন!” মনে‌ মনে কড়া কিছু উত্তর সাজিয়ে রাখলাম। হৃদয় ভাঙা প্রেমিকদের মতো আচরণ করলেই তাকে ছাই মাটি দিয়ে ধুয়ে দিব। কিন্তু মানুষটা সর্বদাই আমার চিন্তার থেকে কয়েক শত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি আমার কথায় স্বল্প হাসলেন বোধহয়। বেশ ঝড়ঝড়ে গলায় শুধালেন,

‘যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেকটা বেশিই চমৎকার আছি।’

তার এই চমৎকার থাকার বিষয়টা আমার পছন্দ হলো না। পরীক্ষার পড়া অব্যাহত রেখে আমি নিশ্চয়ই তার চমৎকার থাকার কথা জানতে বসে নেই! কিন্তু ভদ্রতা বজায় রাখতে মুচকি হেসে বললাম,

‘বেশ! তো হঠাৎ কি মনে করে কল করলেন?’

‘দু মাস যাবত দেশের বাহিরে ছিলাম। ব্যস্ততার মাঝে দু এক মিনিটের জন্য আপনায় বিরক্ত করতে চাইনি। তাই আপনার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। আজ ফিরেছি দেশে। এখনো বাসায় পৌঁছাতে পারিনি। আপনার হল থেকে চার মিনিটের পথ পার হলেই যে লাল সবুজ রঙের বাঁশের রেস্তোরাঁটা ওখানে বসে আছি। দুপুরের খাবারটা খাওয়া হয়নি। এখন গরম ভাত আর গরুর মাংস খাব। একা একা খেতে কেমন কেমন লাগছে। একজন সঙ্গী হলে খারাপ হয়না। তাই ভাবলাম আপনায় কল করি। যেহেতু নাগালের ভেতরেই আছেন!’

তার এমন কথায় কেমন প্রতিউত্তর করবো ভেবে পেলাম না। তবে উপলব্ধি করলাম আমার কান ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। যেন যখন তখন রেলের ইঞ্জিন থেকে ধোয়া ছাড়ার মতো করেই ধোয়া ছড়াবে। একটা মানুষ কতটা ইডিয়েট হলে এমন কাজ করে। বিগত চার মাস যোগাযোগ না করে আজ হঠাৎ করে কিনা গরম ভাত আর মাংস খেতে আহ্বান করছে! সিরিয়াসলি?

আমি সবিনয়ে তার আহ্বান ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ বলে বসলেন,

‘তাহলে পার্সেল নিয়ে আপনার হলের সামনে আসি? আপনি দুটো প্লেট আর এক বোতল পানি নিয়ে নিচে আসেন। রাস্তার পাশে বসে নাহয় একসাথে খাব। ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ হয়না! রাস্তায় চলতে থাকা যানবাহন আর হরেক রকমের মানুষ দেখতে দেখতে খাবার উপভোগ করা যাবে। আমি নাহয় একটা শীতল পাটিও কিনে নিয়ে আসছি!’

আমি বাকরুদ্ধ। জবাব দিতে পারলাম না। তবে স্বচ্ছকে যতটুকু চিনি এমন একটা কান্ড ঘটানো তার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। দেখা গেলো সত্যি সত্যি হলের সামনে এসে দারোয়ানকে বলে বসলো,

‘মামা আদ্রিতাকে ডেকে দেন তো। আমরা আজ রাস্তার পাশে গরম ভাত আর গরুর মাংসের পার্টি করবো।’

আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। খুলে রাখা বইটা বন্ধ করে ছোট করে জবাব দিলাম,

‘আসছি।’

ঘরির কাটায় সন্ধ্যা সাতটা। আমি আমার পড়নের জামা পরিবর্তন না করেই চুলগুলো হাত খোঁপা করে বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে সবসময় পড়ার এক জোড়া স্যান্ডেল। এ অবস্থায় যখন রেস্তোরাঁয় পৌঁছালাম তখন আমার চোখ আকাশে। আমি এভাবে বের হয়েছিলাম স্বচ্ছকে হতাশ করতে। কিন্তু স্বচ্ছকে দেখে আমি নিজেই হতাশ। সাদা রঙের ফর্মাল শার্টের সাথে ট্রাউজার এবং পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল। গলায় এখনো টাই ঝুলছে। পাশেই বিশাল ল্যাগেজ। আমি থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমায় দেখতে পেয়েই সে ঝলমলে হাসলো। বললো,

‘মাত্রই চেন্জ করেছি। গেন্জি গুলো ল্যাগেজের অনেক ভেতরে রাখা। তাই শার্টটা চেন্জ করতে পারিনি।’

আমি না চাইতেও ফিক করে হেসে ফেললাম। চেয়ার টেনে বসতেই তিনি বললেন,

‘অনেক দেরী করে ফেলেন আদ্রিতা। ক্ষুধায় আমি সবকিছু অন্ধকার দেখছি। খাবার শেষ করে নাহয় কথা বলবো। এখন খাবারে মনোযোগ দিন।’

আমি এই প্রথম অসময়ে ভাত খেলাম পেট ভরে। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটেই কাছের এক খোলামেলা পার্কে পৌঁছালাম। পার্কের চারপাশ ঘুরে ভিন্ন রকমের ভাজার দোকান। মানুষের ভীড় ও কম নয় তাতে। আমরা কিছুটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসলাম। এখানে আসার পর স্বচ্ছ প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো,

‘চটপটির ঘ্রাণ পাচ্ছেন আদ্রিতা? আমার ক্ষুধা পেয়ে যাচ্ছে!’

আমি নিরবে তার কথা এড়িয়ে গেলাম। লোকটা বড্ড চতুর। কথা বলার প্রসঙ্গ খুঁজতে এলোমেলো কথা বলছে। তার এই এলোমেলো কথার ফাঁদে পা বাড়াবো না আমি।

‘আদ্রিতা?’

‘শুনছি।’

‘এখনো রেগে আছেন?’

আমি উত্তর করলাম না। স্বচ্ছ খানিক হাসলো।

‘আমি প্রথম যেদিন আপনায় দেখলাম, মনে হয়েছিলো ফুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক স্বচ্ছ মানবী! আপনার এই রূপ না দেখলে হয়তো কখনো জানতেই পারতাম না সেই মানবীটা রাগতেও জানে।’

‘লেইম জোক করছেন আপনি স্বচ্ছ।’

‘সত্যি বলছি!’

‘বেশ তবে। এখন উঠছি। কাল এক্সাম আছে।’

আমি উঠে দাঁড়ালাম। পা বাড়াতে নিলেই স্বচ্ছ বলে ওঠে,

‘সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত আদ্রিতা। মা কিছুটা মাসিক ভাবে অসুস্থ। আসলে বড় ভাইয়া যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ঠিক সেদিন থেকেই মা যেন কেমন বদলে গেল। আমায় সবসময় নিজের নজরে রাখতে শুরু করলো। আমার বাইরে পড়তে যাওয়া হলো না। ঘরে ফিরতে সামান্য দেরী হলে ভাঙচুর শুরু করতো। পাগলের মতো আচরণ করতো। হয়তো ভাইয়ার মতো আমাকেও হারিয়ে ফেলার ভয় ঢুকে গেছে তার মনে। আমি যদি সেদিন আপনার হয়ে কথা বলতাম মা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ত। আমার আপনার উপর ভরসা ছিল আদ্রিতা। ভেবেছিলাম আপনায় বুঝিয়ে বললে বুঝবেন। আপনিও বুঝলেন না আমায়। আমায় নিজেকে একবার ক্লিয়ার করার সুযোগ অব্দি দিলেন না। আপনায় এত কঠিন রূপে দেখতে চাইনি আমি আদ্রিতা।’

আমি অবাক হলাম। স্বচ্ছর বড় ভাই আছে এ কথা আমি জানতাম না। আর কোথায় বা চলে গেছে? প্রশ্ন সরিয়ে রেখে আমি বললাম,

‘আন্টি কেমন আছে এখন?’

‘মায়ের অবস্থা আগের থেকে অনেকটাই ভালো। কিন্তু মাঝে মাঝে এখনো পাগলামি করে। এইতো আমি বাইরে যাওয়ার আগেও কতো পাগলামি করলো। কিন্তু পরে আবার স্বাভাবিক। নিজেই আমার ল্যাগেজ গুছিয়ে দিলো।’

‘আর ভাইয়া? কোথায় সে?’

‘ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় সাত বছর। ভাইয়া লন্ডনে পড়াশোনা করত। ওখানেই এক খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে। দেশে এসেছিল হঠাৎ করে বউকে সাথে নিয়ে। বাবা মেনে নেননি। সেদিনই সম্পর্ক ছিন্ন করে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে যায়। আর কখনো যোগাযোগ করেনি আমাদের সাথে। আমি অবশ্য কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়নি।’

স্বচ্ছর কন্ঠে অসহায়ত্ব। আমি স্পষ্ট তার চোখে জল দেখতে পাচ্ছি। মানুষটা না বললে হয়তো লুকানো এই ব্যাথার কথা কখনো জানতেই পারতাম না। কখনোই বুঝতে পারতাম না এক গাল হাসির পেছনেও ভয়ংকর অতিত লুকিয়ে থাকে। আমার কষ্ট হলো আন্টির জন্য। মা হয়ে কতটা ব্যাথাই না সে সহ্য করেছে। এখনো হয়তো করছে। কখনো দেখা হলে মাফ চেয়ে নিব তার কাছে।

‘আদ্রিতা?’

‘শুনছি।’

‘আপনি‌ আর একবার মায়ের সাথে দেখা করবেন প্লিজ? আমি মায়ের অমতে যেয়ে আপনাকে চাইনা। আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকেও চাইনা। আর না চাই অন্য কাউকে আপনায় দিতে। বুঝতে পারছেন আদ্রিতা? আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চেয়েছি আপনাকে।’

মনে হলো স্বচ্ছর গলা কাঁপছে। সেও কি ভয় পাচ্ছে? কিসের ভয়? আমাকে হারানোর? আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্বচ্ছর জলে ঘেরা গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকালাম। কিন্তু তার এই সমুদ্র সমান গভীর চোখ দুটোর ভাষা আজো বুঝে উঠতে পারলাম না। এই মানুষটার চোখের ভাষা এত কঠিন কেন? আমি চোখ ফিরিয়ে আকাশ পানে চাইলাম। আকাশে চাঁদ নেই। তবে কিছু সংখ্যক নিভু তারা দেখা যাচ্ছে। আমি স্বচ্ছর পানে না তাকিয়েই বললাম,

‘কখনো প্রেমিকার হাত ধরেছেন স্বচ্ছ? আপনি চাইলে আমার হাত ধরতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।’

সমাপ্ত