প্রাণেশ্বর পর্ব-১৭+১৮

0
370

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।

মায়ের সিদ্ধান্তে মেহতাব ভীষণ সন্তুষ্ট। সন্তুষ্ট মেঝ কাকা আর মেঝ কাকীও। তবে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন রাহীলা। মুখ দেখে সহসাই অনুমান করা যাচ্ছে তা। মেহতাবের আদেশ মতো ছোট কাকা, মতিব মজুমদার সেখানে অনুপস্থিত। থাকলে হয়তো কিছু তীক্ষ্ণ বাণী ছুড়তে তিনি আর বিলম্ব করতেন না।

সবার সম্মতি পেয়ে তনুকা কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করল। আর তাছাড়া মনে হলো, মেহতাবের কাছ থেকেও বড়ো রকমের সাহায্য সে পাবে, তাই আর সে এসব নিয়ে চিন্তা করল না।

নিজের খাওয়া শেষ করে খাবার নিয়ে গেল শ্বশুরের কক্ষে। এবার দরজায় দাঁড়ান প্রহরী দুজন অপরিচিত ঠেকল তার। প্রহরী দুজন তনুকাকে দেখেই মাথা নত করল। তনুকা জিজ্ঞেস করল,

‘আপনারা কারা?’

‘জমিদার বাবু আজই আমাদের কাজে রাখলেন।’

তনুকার তখন মনে পড়ল, সে মেহতাবকে সেবক বদলানোর কথা বলেছিল। তার কথার বিপরীতে মেহতাবের এত দ্রুত পদক্ষেপ দেখে খুশি না হয়ে পারল না সে। বলল,

‘ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি।’

তনুকা ভেতরে চলে আসে। বিছানার পাশের টেবিলে খাবার রেখে নিজে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। তারপর আস্তে করে ডাকে,

‘বাবা।’

মোহন লাল মজুমদার চোখ মেলে চাইলেন। মুখে কিছু না বললেও চোখ দেখে বোঝা গেল, তিনি তনুকাকে দেখে তৃপ্ত হয়েছেন। তনুকা মৃদু হেসে বলল,

‘আপনার খাবার নিয়ে এসেছি, বাবা।’

তনুকা যত্ন সমেত খাইয়ে দিল তাঁকে। খাবার শেষ করে বলল,

‘খাবারের পর ঔষধ আছে নিশ্চয়ই? আপনার ঔষধগুলো কোথায় রাখা?’

প্রশ্ন করে নিজেই খুঁজতে আরম্ভ করল। কিন্তু রুমে কোথাও পেল না ঔষধ। তাই হাঁক ছাড়ল,

‘শুনছেন, একজন ভেতরে আসুন।’

তড়ঘড়ি করে তখন একজন প্রহরী ভেতরে আসে। মাথা নত অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু লাগবে, ছোট মাতা?’

“ছোট মাতা” সম্বোধনে অবাক হলো তনুকা কিন্তু, বলল না কিছু। শুধু বলল,

‘মেহতাবকে একটু ডেকে নিয়ে আসুন।’

প্রহরী মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে সেদিকেই ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহতাবকে নিয়ে হাজির হলো সে। মেহতাব জিজ্ঞেস করল,

‘কোনো সমস্যা, বিবিজান?’

‘বাবার ঔষধ পাচ্ছি না।’

‘ঔষধ আম্মার কাছে। আম্মা একটু পর এসে ঔষধ দিয়ে যাবেন।’

তনুকা এক পল ভেবে বলল,

‘ঠিক আছে তবে, আমি বরং মা’কে ডেকে নিয়ে আসি।’

‘আম্মা সময় হলে চলে আসবে, তনু। তুমি এখন ঘরে চলো। আর আব্বারও বিশ্রামের প্রয়োজন।’

তনুকা শ্বশুরের মুখপানে চাইল। তিনি চোখ পিটপিট করে কথা বলতে চাইছেন যেন। চোখের অস্থিরতা যেন অন্য কিছু বলতে চাইছে কিন্তু, মূর্খ মানুষ কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। তনুকা বলল,

‘আচ্ছা, চলুন।’

তনুকা বাইরে যাওয়ার আগে দক্ষিণের জানলাটা আটকে দিয়ে গেল। রুমে এসে কাপড় ভাঁজে মনোযোগ দিল সে। ছাদের কাপড় লতা নিয়ে এলেও তনুকা তাকে আর ভাঁজ করতে দেয়নি। কিছু কাজ অন্যকে দিয়ে করালে ঠিক মনঃপূত হয় না, এই যেমন এই কাজটাও।

কাপড় ভাঁজ করে আলমারির সামনে দাঁড়াল তনুকা। আলমারির পাশেই রুমের বড়ো জানলাটা। যেখান দিয়ে প্রত্যহ বাতাস আসে খুব। এখনও তাই। আলমারিতে কাপড় তুলে জানলার মুখে দাঁড়ায়। মেহতাব ফোনে কী যেন করছে। তনুকা বিভ্রান্তের মতো আকাশ পানে চায়। একটা চ্যাপ্টা রূপালি চাঁদের অংশ সেখানে প্রতীয়মান। তাতেই আকাশতল ঝলমল করছে যেন। তনুকা বিভোর চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ বলে উঠে,

‘অপনার প্রতি মনে এত দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও কেন যেন আপনাকেই বড্ড ভরসা করতে ইচ্ছে করছে। কী অদ্ভুত অনুভূতি! দ্বিধা কাটাতে পারছি না, এইদিকে মন সব আশা ভরসা আপনার উপরেই বর্তাতে চাইছে। কী করি বলুন তো? যদি বিশ্বাস করে ঠকে যাই, ভয় হয় তো।’

মেহতাব বিমূঢ় চেয়ে রয় কতক্ষণ। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে,

‘এত অবিশ্বাস তোমার? তাহলে আজীবন থাকবে কী করে?’

‘অবিশ্বাস না করে কি আর কোনো উপায় আছে? আমার বিয়েটাই আমার জীবনে এক চরম অবিশ্বাস্য মুহুর্ত। হুট করেই নিজেকে অচেনা অজানা একজন মানুষের সাথে জড়িয়ে ফেলাটা কি অবিশ্বাস্য কিছু না? আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জিজ্ঞেস করল,

‘তবে কী চাও তুমি? ছেড়ে দেই তোমায়? মুক্ত হতে চাও?’

অকস্মাৎ বক্ষঃস্থলের কম্পন বাড়ে তনুকার। অস্থির গলায় বলে,

‘না না, আমি তা কখন বললাম। আপনি আমার বিশাল দ্বন্দ্ব হলেও আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই না, মেহতাব।’

ব্যস এইটুকুই। আর কিছু শোনায প্রয়োজন নেই মেহতাবের। মনের সমস্ত সংশয় নিমিষেই উবে যায়। প্রকান্ড সাহস ঝলমলিয়ে ওঠে। মনে হয়, এই তো এই কথাগুলো শুনতেই তো এত প্রতীক্ষা তার। অবশেষে সে সফল।

বাইরের বাতাসে তনুকার ওড়না উড়ছে। উড়ছে খোঁপা ভাঙা নিকষ কালো চুলও। তাকে পেছন থেকে দেখেও মন বড্ড আশকারা পেতে চাইছে মেহতাবের। সে উঠে এগিয়ে এল। পেছনে না ফিরেও মেহতাবের উপস্থিতি ঠিকই টের পেল তনুকা। মেহতাবের হাতের বাঁধন সহসাই জড়িয়ে নিল তাকে। তার চিবুক নিয়ে ঠেকাল ঘাড়ের উপর। প্রশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়ায় তনুকার শরীরে জাগল শিহরণ। মেহতাব বিলম্ব করে না আর। চুল সরিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়াল ঘাড়ে। কেঁপে উঠে তনুকা। নিজেকে পরক্ষণেই শক্ত করে ফেলে। না, ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি তার নেই। স্বামী তার, অধিকার আছে। তনুকা চোখ বুজে। মেহতাব তার খোলা চুলে চুম্বন করে। তারপর সরে এসে সাথে দাঁড়ায়।

‘যেদিন তোমার মনে হবে, আমার ভালোবাসায় খাদ আছে সেদিন আমি নিজেই তোমাকে মুক্ত করে দিব। তবে তার আগ অবধি নিজের সবটুকু দিয়ে এইটুকু জাহির করে যাব যে, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা খাদহীন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই।’

তনুকা চেয়ে দেখল, লোকটার চোখগুলো চিকচিক করছে। সত্য বলছে, তা প্রমানিত। কারণ মানুষের হৃদয়ের সবচেয়ে বড়ো দর্পন তার চোখ। চোখ দেখলেই মন পড়া যায়।
প্রসন্ন হাসল তনুকা। সামনে চেয়ে বলল,

‘আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনার চোখ দেখে বিশ্বাস না করার উপায় নেই। তবে আপনি চাইলেই স্বামী অধিকার খাটাতে পারেন, আমি বাঁধা দিব না।’

কিঞ্চিৎ হাসল মেহতাব। বলল,

‘আমার সুখ হবে সেদিন, তুমি নিজ থেকে সন্নিধানে ডাকবে যেদিন। তার আগ অবধি, আমি তোমার নিকটস্থ কখনোই হব না।’

এই কথা শুনে তনুকা ফ্যালফ্যাল করে চাইল। পুরুষ মানুষ সম্পর্কে ধ্রুব ধারণার ব্যাঘাত ঘটল যেন। হুট করেই মনে হলো, সে পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার পুরুষের বিবি নয়তো? যাকে কাছে পেয়েও মর্ম দিচ্ছে না?
তনুকা চেয়ে রইল কেবল, কিছু বলল না। মেহতাব হাই তুলে বলল,

‘শু’তে আসো, বিবিজান। ঘুম পাইতেছে খুব।’

মেহতাব বিছানার দিকে পা বাড়ায়। তনুকা ফিরতে নিয়েও হঠাৎ কী দেখে যেন দাঁড়িয়ে যায়। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখে, বেশ দূরে দুজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। তনুকা অবাক হয়। এত রাতে এখানে দুজন মানুষ কী করছে? ছায়া দেখে মানুষ চেনার উপায় নেই। সে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও চিনতে পারল না। মেহতাব তনুকার মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কী ব্যাপার, বিবিজান? আসো।’

তনুকা ফিরে চাইল। গম্ভীর সুরে বলল,

‘ঐখানে দুজন মানুষ।’

কপাল কুঁচকাল মেহতাব। জিজ্ঞেস করল,

‘কোনখানে?’

‘গেইটের সামনে বড়ো গাছের পেছনে।’

মেহতাব উঠে এল। তবে সে আসার আগেই ছায়াযুগল মিলিয়ে গেল যেন। মেহতাব ভালো মতো সব দেখে বলল,

‘কোথায় তনু? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’

তনুকাও চেয়ে দেখল, অদ্ভুত ভাবে সামনে কোনো ছায়া নেই। সে মেহতাবের দিকে চেয়ে অস্থির গলায় বলল,

‘আমি মাত্র দেখেছি, ঐ গাছের পেছনে দুজন মানুষের ছায়া ছিল।’

মেহতাব স্মিত সুরে বলল,

‘ভুল দেখেছ, বিবিজান। হয়তো ওটা কোনো গাছের ছায়া ছিল।’

‘না না। আমি স্পষ্ট দেখেছি, ওটা মানুষের ছায়া।’

‘কোথায় তবে? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

‘এতক্ষণ তো ছিল, হুট করে কোথায় চলে গিয়েছে বুঝতে পারছি না তো।’

মেহতাব ছোট্ট শ্বাস ফেলে তনুকার গালে হাত রাখল। বলল,

‘এত ভেবো না। ভুল দেখেছ তুমি। আমার মহলে যথেষ্ঠ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই।’

‘কিন্তু…’

সঙ্গে সঙ্গেই তনুকার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে মেহতাব বলল,

‘আর কোনো কথা না, ঘুমাতে এসো। ঘুমালে মাথা থেকে এসব চলে যাবে।’

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।

রাতে ঠিকঠাক মতো ঘুম হয়নি তনুকার। মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল বিচরণ করে চলছিল ঐ ছায়াযুগল। কারা ছিল ঐ দুজন মানুষ? মেহতাব আসার সঙ্গে সঙ্গে কেনই বা তারা মিলিয়ে গেল? এই সবটাই কি তার একটা ভ্রম? এত বিরাট একটা ব্যাপার কি সত্যিই সামন্য একটা ভ্রম হতে পারে? না কি এর পেছনেও রয়েছে কোনো রহস্য?

অন্যদিন সকালের নাস্তাটা সবার আগেই সেরে মেহতাব বিচার মহলে চলে যায়। তবে আজ আর তেমন কিছু হয়নি, সকলের সাথেই টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে সে। টেবিলে সাজানো নাস্তার পদের শেষ নেই। সবাই গভীর মনোযোগে খেলেও, তনুকার মনোযোগ সেদিকে নেই। সে এখনো রাতের প্রত্যক্ষকৃত ঘটনায় বিভোর। খাবার মাঝেই মেহতাব তাকে এক দুবার পরখ করে। হুট করেই তাই রাহীলাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে বসে,

‘কাকী, রাতে কাকা কোথায় ছিলেন?’

খাবারের মাঝে আচমকা এমন প্রশ্নে প্রথমে খাটিকটা ভড়কে যান রাহীলা। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে বলেন,

‘তোমার কাকা তো রুমেই ছিল, কেন?’

‘পুরো রাতে কি একবারও রুম থেকে বের হননি?’

কাকী কপাল কুঁচকে বললেন,

‘না তো, কী হয়েছে বলবে?’

‘কিছু না।’

মেহতাবের “কিছু না” শুনে কাকী ক্ষুব্ধ হলেন বেশ। হুট করেই এসব প্রশ্ন করে তাকে চিন্তায় ফেলে, এখন বলছে কিছু না; তবে এত প্রশ্ন করার কী প্রয়োজন ছিল? মেহতাব না চাইলে জবাব তিনি জীবনেও পাবেন না বলে বৃথা চেষ্টা আর করলেন না। ক্ষিপ্ত হয়ে মনোযোগ দিলেন খাবারে। খাবার টেবিলের বাকি মানুষজন কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাদের দেখে আবার নিজেদের খাবারে মনোযোগ দেয়। তনুকা এক পল অবাক হয়ে ভাবে, “মেহতাব কি এসবের জন্য কাকাকে সন্দেহ করছেন? কিন্তু কাকা এমন কিছু কেন করবেন?”

_____________

শ্বশুরমশাইয়ের রুমে গিয়ে দেখল, তিনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তনুকা বেশ কিছুক্ষণ ডেকেও তাঁকে জাগাতে পারল না। তাই বাইরের প্রহরীদের বলে এল, তিনি উঠলে যেন তাকে জানানো হয়।

,

চুলে ফিতা বাঁধছে রেনু। আয়নায় অমনোযোগী দৃষ্টি তার। নাক মুখ শুষ্ক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়ের ভারি মন খারাপ। তাই তনুকার উপস্থিতিটাও ধরতে পারল না সে। তনুকা বেশ কিছুক্ষণ তাকে পরখ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার পিচ্চি ননদিনীর কি আজ মন খারাপ?’

চকিতে ফেরে রেনু। তনুকাকে দেখে কিঞ্চিৎ হাসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হাসিটা ভীষণ মেকি। তনুকা ফের জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?’

রেনু সামনে ফিরে চাইল। আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,

‘আমি কি সত্যিই খুব পিচ্চি, বউমনি?’

এমন প্রশ্নে খানিকটা অবাক হলেও তনুকা হেসে জবাবে বলল,

‘পিচ্চিই তো। সবে ক্লাস টেনে পড়ো, এইটুকু একটা মেয়ে।’

‘অথচ আমার ক্লাসের বেশ কিছু মেয়ের বিয়েও হয়ে গিয়েছে, দুইজনের তো আবার বাচ্চাও আছে। আর তোমরা আমাকে পিচ্চি বলো।’

অভিমানী শুনালো তার সুর। তনুকা হাসল। বলল,

‘আর কে পিচ্চি বলে তোমায়?’

‘ঐ বদ লোকটাও, উনি তো…’

থেমে গেল রেনু। টনক নড়ল আচমকা। ইশ, কী বলে ফেলছিল সে? জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠে,

‘কিছু না।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘এই বদ লোকটা আবার কে?’

‘কেউ না কেউ না, বউমনি। আমি এমনিই বলছিলাম। আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে, নয়তো ক্লাস ধরতে পারব না। যাচ্ছি আমি।’

বলেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুট লাগাল সে। এমন ভাবে ছুটল যেন, পুলিশের কাছ থেকে চোর পালাচ্ছে। তনুকা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। মনে মনে আওড়ায়, “মেয়েটা কি প্রেম করছে?”

__________

‘আমার মাইয়াডার কোনো দোষ নাই, বাবু। সব দোষ এই হারাম’জাদার।’

লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলল। তার শিউরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি গর্জে উঠল ততক্ষণাৎ। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘আমরা একজন অন্যজনরে ভালোবাসি। আপনি কেন মানতে চাইতেছেন না?’

‘তোর মতো ফহি’ন্নির পুতের ভালোবাসা আমার মাইয়াই লাগত না।’

ছেলেটি ব্যঙ্গ করে হাসল। বলল,

‘এ্যাঁ, কোথ তে আইছে রাজা বাদশা। নিজেরই কোনো চাল চুলা নাই, আবার আইছে আমারে ফহিন্নি কইতো।’

বৃদ্ধ লোকটি তেড়ে গেলেন। আজ এই ছেলের একটা হেস্তনেস্ত তিনি করেই ছাড়বেন। ছেলেটিও কম যায় না; নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,

‘আমি কাউরে ভয় পাই না, আমার কাছে ভালোবাসাই সব। ভালোবাসার জন্য আমি নিজের জীবন দিতেও এক পায়ে খাড়া।’

বৃদ্ধ লোকটি ছেলেটির গায়ে ঠাস করে চ’ড় বসালেন। তাতে সেই ছেলের বাবা ক্ষেপে উঠলেন খুব। তেড়ে এসে বললেন,

‘এই বুইড়া, তুই আমার পোলার গায়ের হাত তুলছোস কোন সাহসে? দোষ কি আমার পোলার একার? তোর মাইয়া নিজ ইচ্ছাতেই আমার পোলার হাত ধইরা পলায়ছিল, দোষ তোর মাইয়ারও কম না।’

বৃদ্ধ লোক তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘চুপ কর, বেটা। আমার মাইয়ার কোনো দোষ নাই। তোর পোলা যাদু টোনা কইরা আমার মাইয়ারে নিয়া ভাগছিল। সব দোষ তোর পোলার।’

‘খবরদার, আর একটাও বাজে কথা কইলে। শাক দিয়া মাছ ডাকন যায় না। মাইয়ার দোষ স্বীকার কর, বুইড়া।’

বৃদ্ধ আবারও তেড়ে যেতে চাইলেন। এর মাঝেই আওয়াজ তুলল মেহতাব। কর্কশ সুরে বলল,

‘কী শুরু করেছেন আপনারা? এখানে বিচার করার জন্য তো আমি আছি, তাই না? নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা বন্ধ করুন।’

‘বাবু, আপনি কিছু করেন। এই লোকটা আমার ভালোবাসারে আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিতে চাইতেছে।’

‘পালালে কেন তোমরা?’

মেহতাব প্রশ্ন করল। ছেলেটা কাচুমাচু করে বলল,

‘নাহলে ঐ লোক একটা বুইড়া বেটার সাথে মাইয়ার বিয়া দিয়া দিতেন।’

‘মেয়ে কী চায়? তোমার সাথে থাকবে ও?’

‘জি, বাবু। ও আমার সাথেই থাকতে চায়, কিন্তু বাপের জন্য পারে না।’

‘তুমি যে ওকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো তার কী প্রমাণ?’

ছেলেটি চোখ তুলে চেয়ে বলল,

‘কন বাবু, কেমনে প্রমাণ দিতাম? যা কইবেন তাই করমু।’

মেহতাব ক্রূর হাসল। তার পাশে দন্ডায়মান ইশফাকের দিকে চেয়ে বলল,

‘ছুড়ি নিয়ে এসো, ওর বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা কেটে নিবে; এটাই হবে ওর ভালোবাসার নিদর্শন।’

এমন আদেশ শুনে সকলের মাঝে চাপা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ছেলেটির বাবা কেঁদে বললেন,

‘বাবু, কী কন এডি? ভালোবাসার জন্য এহন আমার পোলার আঙ্গুল দিতে হইব?’

‘জীবন চাইনি না তো আর, সামান্য আঙ্গুলে আর কী’ই বা যায় আসে? এই ছেলে, আঙ্গুল দিতে পারবে না তুমি?’

ছেলেটি অকপটে বলে উঠল,

‘পারমু, বাবু।’

মেহতাবের মুখে চওড়া হাসি ফুটল। উঁচু গলায় বলল,

‘সাবাস বেটা, সব প্রেমিককে সর্বদা এমনই অকুতোভয় হতে হবে। আজকের পর থেকে কেউ আর তোমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আর হ্যাঁ, একজন কাজী ডেকে নিয়ে এসো; আঙ্গুল কাটার পর পরই ওদের বিয়ে দেওয়া হবে।’

ছেলেটি ভুলে যায় সব ভয়। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার আনন্দ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার। সে হেসে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। শুধু একটা আঙ্গুল কেন, আজ একটা হাত চাইলেও পিছপা হবে না সে।

আঙ্গুল কাটার ঘটনা মেয়ের কান অবধি চলে যায়। যে মেয়েকে নিয়ে এত কাহিনী, সে মহলের বাইরে আলাদা নজরদারিতে ছিল। যখনই এমন আদেশ শুনেছে, কলিজা শুকিয়ে উঠেছে তার। ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আঙ্গুল চায় না সে। নিজের প্রিয় মানুষের ক্ষতি করে পাওয়া ভালোবাসায় কোনো সুখ নেই। এর জন্য সারাজীবন আফসোস করে মরতে হবে তার। সে ভেবে পাচ্ছে না কী করবে? থামাতে হবে এসব। অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখে। হঠাৎ তার মাথায় আসে, জমিদার বাবুর নববধূর কথা। শুনেছে সেই মেয়ে মারাত্মক সাহসী, জমিদার বাবুর মুখের উপর কথা বলার সাহস আছে তার। তাকে এই মুহুর্তে একমাত্র সে’ই সাহায্য করতে পারে। তার পাশেই প্রহরী দুজন। উপায়ান্তর না পেয়ে দিক বেদিক ভুলে মহলের দিকে ছুট লাগাল সে। প্রহরী প্রথমে বোকার মতো চেয়ে থাকলেও, পরে মেয়ের উদ্দেশ্য টের পেয়ে ছুট লাগায় তারাও। তবে তাকে ধরার আগেই সে সোজা অন্দরে চলে আসে। আর ভাগ্যক্রমে তনুকাকেও পেয়ে যায় একদম বসার ঘরে। তাকে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে, সে’ই জমিদারের নববধূ। তাই বিলম্ব করল না আর, ছুটে গিয়ে পায়ে পড়ল। এক শ্বাসে বলল,

‘আমার ভালোবাসারে বাঁচান, ভাবিজান। বাবু যে তার আঙ্গুল কাটার আদেশ দিছেন।’

চলবে….