প্রাণেশ্বর পর্ব-১৯+২০

0
359

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯।

সব শুনে অতি বিস্ময়ে তনুকা রা হারিয়ে বসে। মেহতাব এমন একটা সিদ্ধান্ত কী করে নিতে পারে? একটা মানুষের ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ কেউ তার শরীরের অংশ চায় না কি? এটা তো অন্যায়, ঘোর অন্যায়।

তার পায়ের সামনে বসে মেয়েটি সমানে কাঁদছে। তনুকা ধরে উঠায় তাকে। আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘কিচ্ছু হবে না, চলো।’

তনুকা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আম্বিরা বেগম ডাকেন তাকে। গম্ভীর স্বরে বলেন,

‘বিচার মহলে যাওয়া বারণ, ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই।’

তনুকা ফিরে তাকায়। শক্ত আওয়াজে বলে,

‘ভুলিনি, মা। তবে কোনো অন্যায়ও আমি সহ্য করতে পারব না। ক্ষমা করবেন, আমাকে যেতেই হবে।’

‘তোমাকে ভরসা করেছিলাম, বউমা। এখন তো মনে হচ্ছে সংসারে অশান্তিটা তুমিই লাগাবে।’

‘অন্যায়ের বিরোধিতা করলে যদি সংসারে অশান্তি লাগে তবে, সেই অশান্তিতে আমার কিছু যায় আসে না।’

এই বলেই তনুকা মেয়েটার হাত ধরে ছুটল। আম্বিরা বেগম ভোঁতা মুখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ কী একটা চিন্তায় কপাল কুঁচকে নিলেন। ভাবলেন, “মেয়েটার বড্ড সাহস, এত সাহসই না ভবিষ্যতে আবার…”, এতটুকুতেই থেমে গিয়ে তিনিও মাথার ঘোমটা ঠিক করে ছুটলেন তনুকার পেছন পেছন।

মেয়েটির পেছনে ছুটে আসা প্রহরী দুজন থমকে দাঁড়ায়। তনুকাকে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে পড়ে যেন। সেদিন সকালের কথা মনে আছে তাদের। তাই ভীত হয় ভীষণ। তনুকা প্রহরী একজনকে গিয়ে বলে,

‘বিচার মহলের ভেতরে গিয়ে জমিদার বাবুকে বলুন, উনার স্ত্রী উনার সাথে এক্ষুনি দেখা করতে চান।’

লোকটি আমতা আমতা করে বলল,

‘বিচার কার্য শেষ না হওয়া অবধি বাবু আসবেন না।’

‘যা বলেছি তাই করুন, নয়তো আমিই ভেতরে চলে যাব।’

প্রহরীর ভয়ের মাত্রা বাড়ল। অস্থির স্বরে বলল,

‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’

একজন প্রহরী ছুটে বিচার মহলে প্রবেশ করে। ততক্ষণে আঙ্গুল কাটার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। উপস্থিত জনগণ বেশ উৎসুক এসবে। একটা ছেলে তার শরীরের একটা অংশ হারাচ্ছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই তাদের। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি। ইশফাক তার দিকে চেয়ে বলল,

‘হুকুম দিন, আমি প্রস্তুত।’

মেহতাব কিছু বলার আগেই প্রহরী সাহস নিয়ে বলে উঠে,

‘মার্জনা করবেন বাবু, ছোট মাতা আপনাকে ডাকছেন।’

মেহতাবের কপালে ভাঁজ পড়ে। জিজ্ঞেস করে,

‘কে? বিবিজান?’

প্রহরী নত জানু করে বলে,

‘জি, বাবু। এক্ষুনি যেতে বলেছেন, না হয় উনি ভেতরে চলে আসবেন।’

‘তুমি বলোনি, আমি ব্যস্ত?’

‘বলেছি। শুনেননি, উল্টো ভেতরে চলে আসার হুমকি দিয়েছেন।’

মেহতাব চেয়ারের হাতল চাপড়ে কী ভাবল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বলল,

‘যাও, আমি আসছি।’

প্রহরী বেরিয়ে যায়। মেহতাব দাঁড়িয়ে বলে,

‘কিছুক্ষণের জন্য বিচারকার্য স্থগিত করা হলো। আমি ফিরে আসার পর পুনরায় সব শুরু করা হবে।’

মেহতাব বেরিয়ে যেতেই মহলে শুরু হয় এক চাপা গুঞ্জন। সবাই কানাঘুষা করছে, তাদের জমিদার বাবু আজকাল একটু বেশিই বউকে মান্য করে চলছেন। নয়তো, যেই ব্যক্তি বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে কেয়ামত হয়ে গেলেও এক চুল নড়তেন না, তিনি শুধুমাত্র বউয়ের ডাকে এভাবে সব ফেলে ফুলে ছুটে চলে গেলেন? তাহলে কি জমিদার বাবুও হয়ে গেলেন বউয়ের গোলাম?

মতিব মজুমদার মেঝো ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,

‘দেখলেন ভাই, ছেলেটা কেমন বউয়ের ন্যাওটা হয়েছে? এমন চলতে থাকলে তো এই ছেলে একদিন বউয়ের হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে জমিদারী ভাসাবে।’

মেঝ কাকা গুমোট স্বরে বললেন,

‘প্রত্যেক পুরুষ’ই কম বেশি বউয়ের ন্যাওটা হয়ে থাকে, এ আর এমন কোনো বড়ো ব্যাপার না।’

মতিব মজুমদারের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করল। এই এক কারণেই মেঝ ভাইকে তাঁর পছন্দ না, কখনোই লোকটাকে সে মেহতাবের বিরুদ্ধে নিতে পারে না যে।

________

তনুকার পাশে দাঁড়ান মেয়েটাকে আপাদমস্তক পরখ করে মেহতাব জিজ্ঞেস করে,

‘ডেকেছ কেন, বিবি?’

তনুকা শান্ত গলায় বলল,

‘এটা কেমন সিদ্ধান্ত? কারোর ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আপনি তার আঙ্গুল কাটতে পারেন না।’

‘ছেলেকে জোর করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছে।’

‘আপনি আদেশ দিয়েছেন বলেই তো দিয়েছে। আদেশ ফিরিয়ে নিন, এটা অন্যায়।’

‘ন্যায় অন্যায় বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে, বিবি।’

‘থাকলে এমন একটা আদেশ দিতেন না।’

‘নাহলে মেয়ের বাবা কখনোই ঐ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।’

‘আমি বিয়ে করমু না, বাবু। তাও তার আঙ্গুল কাইটেন না।’

মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল।

‘ঠিক বলছো? বিয়ে করবে না?’

মেহতাবের তীক্ষ্ণ প্রশ্নের জবাবে, মেয়েটি সোজা শব্দে আওড়াল,

‘না, করমু না।’

‘ঠিক আছে, ভেতরে গিয়ে এই কথাটাই বলবে। চলো।’

মেহতাব যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মেয়েটাও সাথে চলে। তনুকা পা বাড়াতেই মেহতাব ফিরে চায়। গম্ভীর সুরে বলে,

‘তুমি ভেতরে যাও, তনু। তোমাকে যেন মহলের আশেপাশেও না দেখি।’

তনুকার চোখ মুখ বিষন্নতাই ছেয়ে যায়। সে হতাশ সুরে বলে,

‘এসব কাটাকাটি ছাড়াও তো বিয়েটা হতে পারে। আপনার হুকুমে সব সম্ভব।’

‘মেয়ের বাবা রাজি না, এক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।’

তনুকা মেয়েটির দিকে চাইল। মেয়েটার চোখগুলো কেমন যেন ছলছল করছে। যেন এক অফুরন্ত ভালোবাসাকে না পাওয়ার আক্ষেপ ঐ অক্ষিযুগল বেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। সে ফের তাকায় মেহতাবের দিকে। অসহায় সুরে বলে,

‘আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন, মেহতাব। আমার অনুরোধ।’

মেহতাব স্মিত হাসল। তনুকার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বলল,

‘চেষ্টা করব।’

তারপর মহলে চলে এল সে। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটল। উৎসুক জনতার মাঝে ফের এসে উৎসাহের স্রোত ভর করল। মেহতাব গিয়ে বসে তার আসনে। মেয়েটি একটু আঁড়াল হয়ে দূরে দাঁড়ায়। তার সম্মুখে ছেলেটি, একটা টেবিলে বসা। সেই টেবিলে সাজানো বেশ কয়টা ধারালো ছু ড়ি। ইশফাক পাশেই দাঁড়ানো। টানটান হয়ে আছে তার প্রশ্বস্থ বুক। উজ্জ্বল ফরসা গা জড়িয়ে রাখা কাবলি পাঞ্জাবীটা ঘামে ভিজে আছে। সে নিরস মুখে চেয়ে আছে মেহতাবের দিকে। মেহতাব জোরে শ্বাস ফেলে। প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কাজী ডাকা হয়েছে?’

একজন সেবক বলে উঠে,

‘জি বাবু, কাজী চলে এসেছেন। আঙ্গুল কাটার পরপরই বিয়ে পড়ানো হবে।’

‘কাজী সাহেবকে ডেকে আনো; বিয়ে এখনই পড়ানো হবে।’

উপস্থিত জনতার মাঝে ক্ষীণ চাঞ্চল্যতা তৈরি হয়। একজন প্রশ্ন করে বসে,

‘তাহলে কি আঙ্গুল কাটা হবে না?’

মেহতাব সহসাই বলে উঠে,

‘না।’

এতে পুনরায় ক্ষিপ্ত হয় মেয়ের বাবা। বলে,

‘তাইলে আমি মেয়ের বিয়ে দিমু না। আমার প্রমাণ লাগবই।’

মেহতাব চোয়াল শক্ত করে লোকটার দিকে চাইল। তারপর হুকুমের সুরে বলল,

‘ইশফাক, আমার কথা যে অমান্য করবে আঙ্গুল তার কেটে নিয়ে আসবে।’

ইশফাক মাথা কাঁত করে বলে,

‘জি।’

এরপর বৃদ্ধ লোকটি আর কিছু বলার সাহস পায়নি। তবে উপস্থিত জনতা খুশিই হয়েছে এতে। ছেলে মেয়ে দুটো ভালো থাকলেই হলো, এত ঝামেলা করে কী লাভ?

তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। এই খবর চলে গেল অন্দরমহল পর্যন্ত। তনুকা যখন জানতে পারল যে, আঙ্গুল কাটা ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, তখন খুশি আর ধরে রাখতে পারছিল না সে। মেহতাব তার কথা রেখেছে। তার মানে মেহতাবের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার মতামত। এতটুকুতেই ভীষণ তৃপ্ত হলো সে। অবশেষে মনে হলো, জীবনে একজন ভালো মানুষ পেয়েছে, যার কাছে তার মূল্য অত্যধিক।

আম্বিরা বেগমের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মহলের বাইরেই একটা কক্ষে বসে ছিলেন তিনি। ছেলের কাজে অধিক বিরক্ত হলেও প্রকাশ না করে হাসলেন কেবল। ভাবলেন, “নারী জাতির চেয়ে ভয়ংকর কোনো জাতি হতেই পারে না।” অথচ তিনি ভুলে গেলেন, তিনিও সেই জাতির’ই অংশ।

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।

‘আজকাল বউয়ের কথাতেই উঠ বস করছো দেখছি।’

মায়ের এমন বিদ্রুপাত্মক বাক্যবাণের বিপরীতে স্মিত হাসল মেহতাব। দৃঢ় স্বরে বলল,

‘মেহতাব মজুমদার কারোর কথায় উঠ বস করে না, সেটা নিশ্চয়ই আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না, আম্মা।’

আম্বিরা বেগম বিরক্ত হলেন। বললেন,

‘তবে অর্পিত আদেশ আবার ফিরিয়ে নিলে কেন? কেন ছেলের আঙ্গুল কাটলে না?’

‘প্রয়োজন বোধ করিনি।’

‘প্রয়োজন বোধ করোনি, না কি তোমার বউ চায়নি বলে?’

‘আপনি যা ভাববেন তাই।’

মেহতাব পা বাড়ায়। আম্বিরা বেগম পেছন ডেকে বলেন,

‘মেয়েটাকে বেশি প্রশ্রয় দিও না, শেষে না তোমাকেই ব’লির পাঁঠা মানায়।’

মেহতাব ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। ঘাড় কাত করে বলে,

‘আমার বিবিজানের তরে বলি হতে আমি এক পায়ে রাজি।’

‘তুমি অন্ধ হয়ে গিয়েছ, মেহতাব। এখন আমার ভয় হচ্ছে।’

মেহতাব হাসে। বলে,

‘ভয় পাবেন না, আম্মাজান। আপনার ছেলের শক্তির সামনে কেউ টিকতে পারবে না।’

মেহতাব চলে যায়। আম্বিরা বেগম অসহায় সুরে বলে উঠেন,

‘কিন্তু তোমাকে যে এক নারী দূর্বল করে তুলছে, তা কি তুমি বুঝতে পারছ না?’

______

মেহতাব কক্ষে প্রবেশ করে। তনুকা যেন তারই অপেক্ষাতে ছিল। তাই তার আগমনে মুখের হাসি চওড়া হয় বেশ। হেসে বলে,

‘আমি আজ খুব খুশি, মেহতাব।’

মেহতাব হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,

‘কেন?’

‘আপনি আমার কথা রেখেছেন, তাই।’

মেহতাব একপলক দেখে তাকে। মেয়েটার উচ্ছ্বেসিত চোখ মুখ দেখে তারও ভালো লাগে। তবে জবাবে কিছু বলে না। তনুকা নিজ থেকেই বলে,

‘আরেকটা কারণেও খুশি।’

‘কী সেটা?’

মেহতাবের প্রশ্ন। তনুকা জবাবে বলে,

‘বাবার মেসেজ এসেছে। বলেছেন, ভালো আছেন আর খুব শীঘ্রই ফিরবেন।’

‘বলেছিলাম না, তুমি অযথাই চিন্তা করছো।’

‘না জানিয়ে যাওয়াতে একটু চিন্তা হচ্ছিল আরকি।’

মেহতাব গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে ফেলে। তনুকা অস্বস্তিতে পড়ে যায় যেন। ইতস্তত স্বরে বলে উঠে,

‘আপনি জামা পাল্টাবেন? আমি বাইরে যাব?’

‘না, প্রয়োজন নেই। আমি গোসল করব এখন। আলমারি খুলে সবুজ রঙের পান্জাবীটা গোসলখানায় রেখে এসো।’

তনুকা তাই করল। মেহতাব চলে গেল গোসল করতে। তনুকা দাঁড়িয়ে থেকে আর কী করবে, সে তাই যায় রান্নাঘরে। দুপুরের রান্না শেষ। লতা রান্নাঘর পরিষ্কার করছে। তনুকা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘বাবাকে পরে কে খাবার দিয়েছিলেন?’

‘বড়ো আম্মা গিয়া খাওয়াইয়া আইছেন।’

তনুকা ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ।’

লতা মিনমিনিয়ে বলল,

‘একটা কথা কমু, বউমনি?’

‘হ্যাঁ, বলুন না।’

‘আপনি কিন্তু জাদু জানেন। কেমনে আমাগো ভাইজানরে বদলায় ফেলাইছেন।’

তনুকা অবাক হয়ে কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘মানে? বদলে ফেলেছি মানে?’

‘জানেন, এমন কোনোদিন হয় নাই যে ভাইজান একটা হুকুম দিয়া আবার ফিরাইয়া নিছেন, আজ পত্থমবার এমন হইছে; তাও শুধুমাত্র আপনার কথাতেই। আপনি সত্যিই জাদু জানেন।’

তনুকা মুচকি হাসল। বলল,

‘এই কথা আপনিও জানেন?’

‘খালি আমি না, পুরা গ্রাম জানে। সবাই তো কানাঘুষা করতেছে যে, জমিদার বউ আউয়ার পর বদলায় গেছেন; এহন তিনি বউয়ের কথাত চলেন। নাইলে জীবনেও যেই কাজ হয় নাই আইজ সেই কাজ কেমনে হইল।’

তনুকা বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘সেখানে অনেক মানুষ ছিল, অথচ কেউ এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে কিছুই বলল না। সবাই কী করে একটা মানুষের আঙ্গুল কাটা দেখতে পারতো? উনাদের খারাপ লাগত না? এখন আমার কথায় জমিদার তাঁর ভুল শুধরে ফেলাতে এত কথা? আশ্চর্য! উনারা কী করে এমন একটা অন্যায়কে সমর্থন করছেন? নূন্যতম বিবেকও কি নেই?’

লতা হাসে। বলে,

‘আপনি নতুন আইছেন তো, বউমনি; তাই কিছু জানেন না। জমিদার বাবুর বিচার অনেক কঠিন। এমন বিচার করেন যে, দেখলেই গায়ে কাটা দিয়া ওঠে। দ্বিতীয়বার কেউ এই ভুল করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এমন ভয়ংকর উনার বিচার।’

‘অন্যায় করলে শাস্তি দেওয়াটা স্বাভাবিক। তবে কারোর ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আঙ্গুল চাওয়াটা অন্যায়। আর কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি মোটেও আপোষ করব না।’

লতা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠে,

‘আপনি খুব সাহসী।’

তনুকা ম্লান হেসে বলে,

‘আপনি কবে থেকে এখানে কাজ করছেন?’

‘পাঁচ বছর হইব বোধ হয়।’

তনুকা ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ।’

__________

শ্বশুরমশাইকে খাইয়ে দিয়ে তনুকা নিজ ঘরে ফিরে। মেহতাব তখন তৈরি হচ্ছিল। তনুকা তাই জিজ্ঞেস করল,

‘কোথাও বেরুবেন?’

‘হ্যাঁ, গ্রাম পর্যবেক্ষণে।’

তনুকা ততক্ষণাৎ আবদার করে বসল,

‘আমাকে নিবেন সাথে?’

মেহতাব তাকায় তার দিকে। বলে,

‘যাবে তুমি?’

‘হ্যাঁ, যদি আপনি চান।’

‘ঠিক আছে, তৈরি হও।’

তনুকা খুশি হলো। চট করে কামিজ পাল্টে শাড়ি পরল। মাথায় ঘোমটা টানল বড়ো করে। আয়নায় নিজের শূণ্য মুখটা একবার পরখ করে বলল,

‘তৈরি আমি।’

মেহতাব তার সম্মুখে দাঁড়াল এসে। বলল,

‘কাজল দাও, এমন শূণ্য চোখ আমার পছন্দ না।’

তনুকা চট করে কাজল টানল চোখের নিচে। গাঢ় দেখাল সেই রেখা। চোখগুলো ভরাট হয়ে উঠল তাতে। মেহতাব আপ্লুত সুরে বলে উঠল,

‘আমার কাজল রাঙা, বিবিজান।’

ক্ষীণ ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হয়ে তনুকা বলল,

‘চলুন এবার।’

তনুকাকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি করে গ্রাম দেখবে মেহতাব। তার আদেশ মতো ইশফাক সবকিছুর আয়োজন করে। ঘোড়ার গাড়ি চালানো দায়িত্বটাও নেয় সে।
মেহতাব আর তনুকা পেছনে বসে আছে। ইশফাক ঘাড় কাত করে একবার জিজ্ঞেস করে,

‘ভাইজান, ছাড়ব।’

‘হ্যাঁ।’

মেহতাবের অনুমতি পেয়ে ইশফাক ঘোড়ার গলার কাছের দড়ি টেনে ধরে। তাতেই শব্দ করে নড়ে উঠে ঘোড়াগুলো। আচমকা নড়ে উঠায় ভয় পেয়ে যায় তনুকা। মেহতাব তার হাত চেপে বলে,

‘ভয় পেও না। পড়বে না, আমি আছি।’

জবাবে আলতো হাসে তনুকা। গেইটের সামনে ঘোড়ার গাড়ি পৌঁছাতেই সেটা থেমে যায়। মেহতাব জিজ্ঞেস করে,

‘কী ব্যাপার, ইশফাক? থেমে গেলে যে?’

‘আপনার বোন পথ আটকিয়েছেন, ভাইজান।’

মেহতাব ঘাড় কাত করে বাইরের দিকে তাকায়। ঘোড়ার গাড়ির সামনে দাঁড়ান রেনুকে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

‘এই রেনু, তুই এভাবে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

রেনু ভাইয়ের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,

‘কোথায় যাচ্ছো, ভাইজান?’

‘গ্রাম পর্যবেক্ষণে।’

‘বউমনিকেও নিয়ে যাচ্ছো?’

‘হ্যাঁ।’

রেনু সঙ্গে সঙ্গেই আবেদন করে বসে,

‘আমিও যাব।’

‘তুই সবে স্কুল থেকে এসেছিস, ভেতরে গিয়ে আগে ফ্রেশ হো, খাবার খা।’

‘না না, আমি যাব। অনুরোধ করছি, ভাইজান।’

তনুকা মেহতাবকে বলে,

‘এত করে বলছে যখন নিয়ে নিন না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অগত্যাই বলে,

‘আয়।’

রেনুর খুশি আর দেখে কে। সে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তাকে দেখে তনুকাও খুশি হয় খুব। জিজ্ঞেস করে,

‘না খেয়ে থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না?’

‘উঁহু। একদমই না।’

_________

গ্রামের পিচ ঢালা পাঁকা রাস্তায় শো শো করে ঘোড়ার গাড়িটি ছুটে চলছে। সেই বাতাসের দাপটে ঘোমটা ধরে রাখতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তনুকাকে। রেনু চোখ বুজে বসে আছে। মেহতাবের চুল সব এলোমেলো। বাতাসের দাপটে চোখ খুলে রাখাও মুশকিল। মেহতাব তনুকার দিকে ফিরে। জিজ্ঞেস করে,

‘ভালো লাগছে, বিবিজান?’

তনুকা মুচকি হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, খুব।’

মেহতাবের খুব ইচ্ছে করছিল, সেই মুহূর্তে তনুকার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বসে থাকতে। কিন্তু সামনে ছোট বোন বলে পারছে না সে।

গাড়ি থেমে যায় একটি নদীর পাড়ে এসে। নদীর নাম মনোহর। মেহতাব গাড়ি থেকে নামে, একহাত বাড়িয়ে দেয়। তনুকাও নেমে পড়ে সেই হাত ধরে। মেহতাব আবার হাত বাড়িয়ে দেয় বোনের জন্য। রেনু তখন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘ছোট বেলা থেকে যে গাড়ি চড়ে বড়ো হয়েছি, সেটা থেকে নামতে আমার সাহায্য লাগবে না। আমি এমনিই নামতে পারব, ভাইজান।’

মেহতাব হেসে বলে,

‘ঠিক আছে, নাম।’

বলেই মেহতাব হাঁটা ধরে। রেনু চঞ্চল ভীষণ। লাফালাফি ঝাপাঝাপিতে দারুণ আগ্রহী। তাই ঘোড়ার গাড়ির তিনটি সিঁড়ি একসাথে পাড় হতে লাফ দিয়ে বসে সে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও জমিতে পা পড়ার সাথে সাথে ভারসাম্য রাখতে পারে না ঠিক, পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু ভাগ্য ভালো, এর আগেই ইশফাক ধরে ফেলে তাকে। তাড়াতাড়ি সোজা করে দাঁড় করায়। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে উঠে,

‘লাফালাফি ছাড়া কি আর কিছু পারেন না আপনি?’

রেনু ফের দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,

‘পারি তো। বলব কী পারি?’

ইশফাক ভ্রু কুঁচকে ফেলে। অযাচিত ভয় মনে এসে হানা দেয়। রেনু কিছু বলার আগেই সে বলে উঠে,

‘না, আপনার আর কিছু বলতে হবে না। আপনি যান।’

বলেই সে নিজেই দ্রুত সেখান থেকে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।

চলবে….