#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।
‘আমি আপনার সাথে আর ঘুরতে পারব না; পায়ে ব্যথা ধরেছে আমার। এবার যেকোনো একটা ড্রেস কিনুন তো।’
‘এইটুকু হেঁটেই পায়ে ব্যথা ধরেছে, আশ্চর্য! আপনি তো দেখছি ভীষণ দূর্বল। রোজ দুই গ্লাস করে দুধ খাবেন, তাহলে গায়ে অনেক বল পাবেন।’
তেতিয়ে উঠল ইশফাক। বলল,
‘ঠাট্টা করছেন আমার সাথে?’
‘না। ঠাট্টা কেন করব? ভালো কথা বলেছি; শুনলে শুনবেন, না শুনলে নাই।’
‘আপনি আর কিছু না বলে দয়া করে এবার কিছু একটা কিনুন, আমার পক্ষে আর ঘোরা সম্ভব না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, চলুন না ঐ দোকানটাতে যাই। এটাই লাস্ট, আর ঘুরব না।’
ইশফাক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত দু ঘন্টা যাবত মেয়েটা একই কথা বলে যাচ্ছে। তাই বিরক্ত হয়ে সে বলে,
‘চলুন।’
অনেক দেখে এবার গিয়ে একটা জামা মনে ধরে তার। লাল রঙের গাউন একটা। ইশফাকেরও পছন্দ হয়, তবে রেনুর সামনে সেটা প্রকাশ করে না। রেনু দামাদামি করে দাম দেয়। খুশি মনে ইশফাককে বলে,
‘এবার চলুন, অল্প কিছু জুয়েলারি কিনে চলে যাব।’
ইশফাক বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘আবার জুয়েলারি?’
‘ওমা, ম্যাচিং জুয়েলারি পরতে হবে না?’
বেচারা, তার আর কিছু করার নেই। অগত্যাই পিছু যায় তার। জুয়েলারি দোকানে গিয়েও একই অবস্থা; পুরো দোকান এক করে ফেলেও কিছু পছন্দ করতে পারছে না সে। ইশফাক একপাশে মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে পণ করেছে, জীবনেও সে বিয়ে করবে না। এই মেয়ে জাতির কেনাকাটা নিয়ে বিদঘুটে এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আজ তার। বিয়ে করলে আজীবন এই কষ্ট সহ্য করতে হবে।
ইশফাক নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ কী দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। তাদের বরাবর আরেক দোকান থেকে এইদিকেই একটা ছেলে চেয়ে আছে। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেনুতে স্থির। ইশফাক অনেকক্ষণ খেয়াল করে সেটা। ছেলেটা চোখ নাড়িয়ে চাড়িয়ে যেন রেনুর পুরো শরীর মুখস্থ করছে। আচমকা তীব্র রাগে গর্জে উঠে ইশফাক। ছেলেটার দৃষ্টি ভীষণ কুৎসিত, বুঝতে তার বেশি বিলম্ব হয়নি। চোয়াল শক্ত হয় তাতে। বড়ো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ছেলেটার মুখ বরাবর। ইশফাকের অকস্মাৎ আগমনে ছেলেটা ভড়কে যায়। পরে বিরক্ত হয়ে বলে,
‘কী ভাই, এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন?’
ইশফাক চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘ঐদিকে কী দেখছিস?’
ছেলেটা আমতা আমতা করে বলে,
‘ক-কোন দিকে? আমি তো এমনিই এদিক ওদিক দেখছি।’
ইশফাক গর্জে উঠে বলে,
‘এদিক ওদিক দেখছিস, না কি মেয়েদের শরীর মুখস্থ করছিস?’
‘এই এই, একদম বাজে কথা বলবেন না।’
‘বাজে কথা না কেবল, বাজে কাজ করে দেখাব। চোখ তুলে মাটিতে পুঁতে দেব, শালা। ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ের দিকে এভাবে তাকাবি না, সাবধান করছি।’
ছেলেটাও আর চুপ থাকে না। ক্রোধ নিয়ে বলে,
‘কেন রে, তাকালে কী করবি শুনি?’
ইশফাকের রাগ আকাশ ছুঁলো। সে সজোরে ঠা’স করে এক চ’ড় বসাল ছেলেটার গালে। সঙ্গে সঙ্গেই ঝিনঝিন করে শব্দ হতে লাগল তার কানের ভেতর। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে বধির মনে হলো যেন। গালে হাত দিয়ে ঢোক গিলল। এক চ’ড়েই কুপোকাত, ব্যাপারটা তাই আরকি। চ’ড়েরও শব্দ হলো খুব। আশেপাশের মানুষ তাই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। দোকানদার বেরিয়ে এসে বলল,
‘কোনো সমস্যা, সাহেব?’
ইশফাক তার দিকে চেয়ে বলল,
‘এই ছেলে কে?’
‘আমার দোকানের কর্মচারী। অন্য গ্রাম থেইকা আইজই প্রথম আইছে। ও কি কিছু করছে, সাহেব?’
‘জমিদার বাবুর বোনের দিকে নজর দিয়েছিল; কপাল ভালো যে, এখানে জমিদার বাবু নেই, থাকলে আর এই চোখ দিয়ে অন্যকিছু দেখা আর হয়ে উঠত না।’
দোকানদার ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। হাত জোড় করে বলল,
‘মাফ করবেন, সাহেব। নতুন তো বুঝে নাই। বাবুরে কিছু জানাইয়েন না, তাইলে মার্কেটে আর দোকনডা থাকত না আমার।’
‘ঠিক আছে, জানাব না। এই ছেলেকে সাবধান করবেন, ভবিষ্যতে যেন আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে না তাকায়।’
‘জি জি, আমি কইয়া দিমু।’
ইশফাক ফিরে এসে ফের রেনুর পাশে দাঁড়ায়। রেনুর হাতে একটা সুন্দর নেকলেস। ভারি পছন্দ হয়েছে তার। সে নেকলেসে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ছেলেটাকে মারলেন কেন?’
ইশফাক ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ঐদিকেও মনোযোগ ছিল?’
রেনু মৃদু হেসে বলে,
‘তার আমাকে ভালো লাগছিল বলে তাকিয়ে ছিল, তাই বলে এভাবে মা’রবেন তাকে। সবাই কি আর আপনার মতো নির্দয় যে, সুন্দর জিনিস কাছে পেয়েও ধরে রাখতে চাইবে না।’
ইশফাক কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘ছেলেটা যে তাকিয়ে ছিল সেটা বুঝেও আগে বলেননি কেন?’
‘এই কাজটা করবেন বলেই বলিনি।’
‘ভবিষ্যতে আর এমন কিছু করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করবেন।’
‘আপনি আছেন তো প্রতিবাদ করার জন্য।’
‘সবসময় থাকব না।’
‘জোর করে রেখে দিব।’
‘সম্ভব না। কেনাকাটা হলে চলুন।’
রেনুর মনঃক্ষুন্ন হলো খুব। পছন্দ হওয়া নেকলেসটা দোকানদারের হাতে দিয়ে বলল,
‘এটা রেখে দিন।’
দোকানদার বলল,
‘আপনার না এটা খুব পছন্দ হয়েছিল, নিবেন না?’
‘না, এখন আর পছন্দ হচ্ছে না। চলুন।’
রেনু দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইশফাক, অতঃপর দোকানদারকে বলল,
‘এটা প্যাক করে দিন।’
________
‘যদি তোমাদের কারোর সাথে না’ই গিয়ে থাকে, তবে কার সাথে গিয়েছে মেয়েটা?’
মেঝ, ছোট দুই জা’য়ের উপর খুব চেঁচাচ্ছেন আম্বিরা বেগম। কথামতো, তাঁদের কারোর সাথে রেনুর মার্কেটে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ তাঁরা কেউ যায়নি কিন্তু, মেয়েটা ঠিকই গিয়েছে। কার সাথে গিয়েছে সেই চিন্তায় বর্তমানে অস্থির আম্বিরা বেগম। মেহতাবও ঘরে নেই। সেই সকালে বেরিয়েছিল, এখনো ফেরেনি। সকালে নাস্তার টেবিলে তনুকাকে একবার দেখা গিয়েছিল, এরপর তাকেও আর দেখা যায়নি। মেঝ কাকী ঊর্মি বলে উঠলেন,
‘তনুকার সাথে যায়নি তো আবার?’
‘বাড়ির বউ, আমাকে না বলে কয়ে কেনাকাটা করতে চলে যাবে? এইটুকু জ্ঞানবোধ নিশ্চয়ই ওর আছে?’
ঊর্মি মাথা নোয়ালেন। এমনটা তো তারও মনে হচ্ছে না। মেয়েটা এমন দায়িত্ব কর্তব্যহীন না। এইটুকু বোঝ ওর আছে।
একজন ভৃত্য সেই মুহুর্তে কক্ষে এসে বলে,
‘ইশফাক সাহেব তার কক্ষে নেই, বড়োমাতা।’
‘সে আবার কোথায় গেল?’
আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন। ভৃত্য বললেন,
‘পাহারাদার বলেছে, উনাকে গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখেছে। কোথায় গিয়েছে, জানে না।’
‘সাথে আর কেউ ছিল?’
‘সেটা ওরা দেখেনি।’
রাহীলা তখন চট করে বলে উঠলেন,
‘রেনু আবার তার সাথে যায়নি তো?’
আম্বিরা বেগম ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দিলেন,
‘আমার মেয়ে একজন সহকারীর সাথে একা কেনাকাটা করতে চলে যাবে? এই চিন্তা তোর মাথায় এল কী করে, ছোটো?’
রাহীলা বোকা বোকা হেসে বললেন,
‘না না, এমনিতেই বললাম আরকি।’
‘আন্দাজে কথা না বলে চুপ থাক, এমনিতেই মাথা গরম আমার।’
রাহীলা সবার চক্ষু আঁড়ালে মুখ ভেংচি দিয়ে চুপ হলো।
হাতে ব্যাগ চেপে ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকছিল রেনু। ভয় পাচ্ছে এখন, ভেতরে গিয়ে কী জবাব দিবে তাই ভেবে। আচমকা তখন পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডেকে উঠে,
‘রেনু, কোথ থেকে এলে?’
ভয়ে কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে উঠে পেছন ফেরে সে। তনুকাকে দেখে বুকে ফুঁ দেয়। হেসে বলে,
‘তোমাদের রিসিপশনের জন্য জামা কিনতে গিয়েছিলাম।’
তনুকা হেসে বলে,
‘তাই? কার সাথে গিয়েছিলে?’
রেনু ইতস্তত সুরে বলে,
‘ইশফাক ভাইয়ের সাথে।’
‘একা?’
রেনু উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তনুকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘বাড়িতে বলে গিয়েছিলে?’
রেনু অসহায় ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বলে। তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘এখন শুনলে মা রাগ করবেন না?’
রেনু বিষন্ন সুরে বলল,
‘খালি রাগ? তুলকালাম কান্ড বাঁধাবেন।’
তনুকা মুচকি হেসে রেনুর গালে হাত রাখে। বলে,
‘চলো, আমিও একটু দেখে আসি সেই তুলকালাম কান্ড।’
রেনু অসহায় সুরে বলে উঠল,
‘বউমনি!’
তনুকা হাসল। বলল,
‘বউমনির কাছে সবকিছু শেয়ার না করলে, বউমনি মোটেও তোমাকে সাহায্য করবে না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। সব শেয়ার করব, তুমি শুধু আজকের মতো আমাকে বাঁচিয়ে দাও।’
‘ঠিক আছে। ভেবে নাও, আজ তুমি একদম সেইফ।’
চলবে…..
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।
রেনুকে দেখা মাত্রই তেড়ে এলেন আম্বিরা বেগম। মুখে তাঁর ক্রোধ ঝলমল করছে। বাজখাঁই সুরে বললেন,
‘তুমি কার সাথে মার্কেটে গিয়েছিলে?’
তনুকা তার পাশেই। রেনু তার দিকে তাকায়। তনুকা প্রসন্ন হেসে বলে,
‘মা, আমার সাথে।’
আম্বিরাসহ বাকি সকলে হকচকিয়ে ওঠে। আম্বিরা বেগম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
‘ঘরের বউ আমাকে না জানিয়ে মার্কেটে গিয়েছিল? এত বড়ো স্পর্ধা কী করে হলো তোমার?’
তনুকা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ঘরের বউকে যে ঘরেই বন্ধী থাকতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। প্রয়োজনে বাইরেও যেতে হবে। আজ প্রয়োজন ছিল, তাই বাইরে গিয়েছিলাম।’
আম্বিরা বেগম চোয়াল শক্ত করলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘তাই বলে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না?’
তনুকা মাথা নত করে বলল,
‘তার জন্য আমি দুঃখিত। তাড়ায় ছিলাম, তাই আর বলা হয়ে ওঠেনি।’
আম্বিরা বেগম রাগে জ্বলছেন যেন। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সরে দাঁড়ান। তনুকা রেনুকে বলে,
‘তুমি ভেতরে যাও, রেনু।’
রেনু ত্রস্ত পায়ে নিজ কক্ষের দিকে যায়। তনুকা শাশুড়ির দিকে চেয়ে বলে,
‘ভুলের জন্য চাইলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন, মা।’
আম্বিরা বেগম আগুন চোখে চাইলেন। বললেন,
‘তুমি আমার চোখের সামনে থেকে যাও এখন।’
তনুকা কথা বাড়াল না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিজ কক্ষের দিকে।
‘দেখলে ভাবি, কী সাংঘাতিক মেয়ে! তোমাকে পাত্তাই দিল না। কত বড়ো সাহস ওর! কাউকে কিছু না বলে ননদ নিয়ে চলে গিয়েছে মার্কেট ঘুরতে, বাইরের মানুষেরা এখন কী বলবে কে জানে?’
আম্বিরা বেগম মাথায় হাত রেখে সোফায় বসলেন। চোখ মুখ গম্ভীর তার। রাহীলা খুশি হলো তাতে। উর্মি বললেন,
‘ছোট মানুষ, ভাবি; বুঝেনি।’
‘ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়ে নিশ্চয়ই ছোট নয়,মেঝো।’
আম্বিরা বেগমের কর্কশ স্বরের প্রতিদানে চুপ রইলেন ঊর্মি। কথা বলার ভাষা তিনিও হারিয়েছেন। তনুকার কাছ থেকে এমন কাজ বিশ্বাসাতীত ছিল তাঁর।
_____
মেহতাব অন্দরে প্রবেশ করতেই আম্বিরা বেগমকে দেখলেন, সোফায় মাথা ফেলে বসে আছেন। চোখ বোজা। দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে এসে তাই মায়ের শিউরে বসে। ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, আম্মা?’
আম্বিরা বেগম চোখ মেলে চাইলেন। ছেলের অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তাকে দেখা মাত্রই উগলে দিলেন সমস্ত ঘটনা। মেহতাব সব শুনে বলল,
‘তনু তো এমন দায়িত্বহীন না, আম্মা। তাহলে এমন কেন করল? অন্তত একবার আমাকেই জানাতে পারত।’
আম্বিরা বেগম গর্জে উঠে বললেন,
‘সেটা তোমার বউকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো না, কেন এমন করেছে।’
মেহতাব শ্বাস ফেলে বলল,
‘ঠিক আছে, আমি জিজ্ঞেস করব।’
নিজের ঘরে আসে মেহতাব। তবে ঘর শূন্য মেলে। তনুকা কোথাও নেই। গোসলখানা আর বারান্দায় চোখ বুলিয়েও তাকে পায়না মেহতাব। তাই ভাবে, হয়তো রেনুর রুমে। তার আন্দাজ সঠিকও হলো। তনুকার হদিস মেলল সেখানেই। রেনুর ঘরের দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে মেহতাব। ভেতরে রেনু এক লাল রঙের জামা গায়ে দিয়ে নেচে কুদে কী কী যেন করছে। তনুকা সেসব দেখছে, আর মজা পেয়ে হাসছে ভীষণ। তনুকার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে নিমিষেই সব ভুলে বসে মেহতাব। অপলক চেয়ে রয় সেদিকে। মেহতাবকে খেয়াল করা মাত্রই তনুকা হাসিয়ে থামিয়ে বলে উঠে,
‘আপনি? কখন এলেন?’
মেহতাব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘মাত্রই।’
ভাইজানকে দেখে স্থির হয় রেনু। ভয়ে তনুকার পাশে চুপটি করে বসে। মাথা নত করে বলে,
‘ভাইজান, বউমনির কোনো দোষ ছিল না। আমি জোর করেছি বলেই বউমনি গিয়েছিল। নাহলে কখনোই যেত না।’
‘যাওয়াটা সমস্যা না। কাউকে না বলে যাওয়াটা সমস্যা।’
তনুকা মৃদু আওয়াজে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি বুঝতে পারিনি।’
‘ঠিক আছে, ক্ষমা করে দিলাম। এবার ঘরে চলো। আর এই যে ম্যাডাম, শুধু এমন লাল পরী সেজে ঘুরলে হবে না; সামনে না এস এস সি, ভালোমতো পড়াশোনা কর। ফেইল করলে কিন্তু বিয়ে নিশ্চিত।’
রেনু কপাল কুঁচকে বলে উঠে,
‘না, মোটেও আমি বিয়ে করব না।’
‘তাহলে পড়াশোনা কর ভালো করে।’
‘আচ্ছা, তোমার রিসিপশনটা শেষ হয়ে যাক; তারপর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করব।’
_________
‘মায়ের মতো আপনিও কি রেগে আছেন?’
‘না, রেগে থাকব কেন?’
‘আসলে সত্যিই তখন অনুমতি নেওয়ার কথাটা মাথায় ছিল না। আগে তো খুব স্বাধীন ভাবে চলা ফেরা করেছি, তাই আগের মতোই কাউকি কিছু না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দুঃখিত তার জন্য।’
‘ক্ষমা করে দিয়েছি তো। আর কত দুঃখিত হবে?’
‘মা খাবার টেবিলে একটুও কথা বলেননি।’
‘কালকেই এই রাগ পড়ে যাবে। এখন একটু এদিকে এসো তো।’
তনুকা একটু এগিয়ে বলে,
‘কেন?’
‘আমার কোলে মাথা রেখে শোও, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
তনুকা অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেহতাবের কথা মতো কাজ করল। মেহতাব দুপা লম্বা করে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসেছে। তার কোলের উপর তনুকার মাথা। খোঁপা বিহীন উন্মুক্ত চুল ছড়িয়ে আছে এক পাশে। মেহতাব বেশ যত্ন করে হাত বুলাচ্ছে তাতে। মাঝে মাঝে একটু চুল নাকের কাছে ধরে শুঁকছে। কেমন এক মাতাল করা ঘ্রাণ যেন পাচ্ছে সে। বারংবার সেই ঘ্রাণে শরীরে শিহরণ দিচ্ছে তার। তনুকার চোখের পাতা নিমীলিত। সে স্মিত সুরে বলে উঠে,
‘রাতেও বাবা ঠিক মতো খায়নি।’
এই অসময়ে বাবার কথা তুলাতে খানিকটা বোধ হয় বিরক্ত দেখায় মেহতাবকে। তবে মুখে তার ছায়া মাত্র পড়তে না দিয়ে জবাব দেয়,
‘শরীরটা বোধ হয় আরো খারাপ করেছে, তাই এমন করছেন।’
‘ভালো ডাক্তার দেখানো খুব জরুরি।’
‘তুমি না কাকে বললে?’
‘হ্যাঁ, শনিবারে আসবেন বললেন।’
‘উনি এসে দেখলেই বলতে পারবেন সব।’
‘কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হয় কি বাবাকে মা’র সাথে রাখলেই বোধ হয় ভালো হতো। প্রিয় মানুষের ছায়া বাবাকে সুস্থ হতে সাহায্য করত, যেটা এখন সম্ভব হয়ে উঠছে না।’
‘আচ্ছা, ডাক্তার এসে আগে দেখে যাক; তারপর না হয় আমি এই ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলব।’
‘ঠিক আছে।’
_______
হঠাৎ শো শো শব্দে ঘুম ভাঙে তনুকার। চোখ মেলে চেয়ে দেখে সে মেহতাবের কোলেই ঘুমাচ্ছে। মেহতাবও হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন কখন কে জানে। তনুকা আস্তে করে উঠে বসে। জানলার দিকে চেয়ে দেখে, জানলার পর্দা খুলে আসার উপক্রম। আচমকা বাইরে এত বাতাস বইছে কেন? ঝড় আসবে না কি? তনুকা দ্রুত জানলার কাছে যায়। জানলা আটকাতে নিয়েও স্থির হয়ে যায় তার হাত। দূরে আবারও ছায়া মানব দেখে সে। এবার ছায়াটা একটু স্পষ্ট। দুটো মানুষের ছায়া। কাছাকাছি অবস্থান তাদের। বিচার মহলের বাইরের অংশে যে একটা ঘর আছে, তার’ই পেছনে তাদের অবস্থান। তনুকা চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে হয়, সে বোধ হয় ছায়া মানবগুলোকে চিনে ফেলেছে। মৃদু হাসে সে। আস্তে করে জানলাটা আটকে দেয়। মেহতাবের পাশে গিয়ে বসে। মেহতাবের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে কেন যেন বড্ড মায়া হয় তার। এই শ্যামলা মুখে মায়ারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব। এই পুরুষের সমস্ত রূপ যেন এই শ্যামলা রঙেই নিহিত। প্রেমে না পড়ে থাকাটা দুষ্কর। তনুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রেমে পড়া যাবে না। প্রেমে পড়লে ঠকানো হবে। সে যে ঠকাতে পারবে না তাকে। তনুকা অস্থির হয়। ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে একটা মেসেজ লেখে, “কবে আসবে?” ওপাশ থেকে উত্তর আসে না কোনো। ফোন রেখে চুপচাপ একপাশে শুয়ে পড়ে সে। মেহতাবকে আর ডাকার প্রয়োজন বোধ করেনা।
চলবে….